মণির খোঁজে মণিমহেশে
সুদীপ্ত দত্ত
~ মণিমহেশ ট্রেক রুট ম্যাপ ~ মণিমহেশ ট্রেকের আরও ছবি ~
পাহাড়, নদী, সমুদ্রের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটানোর মধ্যে যে শান্তি তা ভাষায় বোঝানো খুব কঠিন। একবার সেই শান্ত প্রকৃতির স্বাদ পেলে দ্বিতীয়বার কি আর তাকে উপেক্ষা করা যায়? তাই সেপ্টেম্বরের পয়লা তারিখে জমানো ছুটি খরচ করেই বেরিয়ে পড়লাম নতুন এক পথে, হিমাচলের শেষ সীমানায়। অলিম্পকদার (আমরা ডাকি এডি) ২০১৮ পর্যন্ত এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার এটা দ্বিতীয় ধাপ, আগের বছর ২০১৪ তে অমরনাথ যাত্রার পর এবার মণিমহেশ। প্রতিটিই শিব ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত, মায়াময় এক দুর্গম ঠিকানা। আকারে খুব বড় নয়, সৌন্দর্যেও হয়তো মণিমহেশ লেকটি আর পাঁচটা সাধারণ লেকের থেকে আলাদা কিছু নয়, কিন্তু মায়াবী রূপ ও মহিমায় একে রাখা হয় মানস সরোবরের ঠিক পরেই। তাই এই লেক দেখার জন্য পর্যটক আর পুণ্যার্থীদের যে ভিড় হবেই তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কলকাতায় বসে অনেক খুঁজেও এমন কাউকে পেলাম না যে এই পথে আমাদের গাইড করতে পারে। তাই অলিম্পকদার যোগাড় করা একটা গাইডবুক আর কিছুটা ইন্টারনেটের ওপর ভরসা করেই রওনা দিলাম।
বিষণ্ণ এক নদী
হিমগিরি এক্সপ্রেস ঘন্টা চারেক লেট করে যখন পাঠানকোট পৌঁছল তখন ভর দুপুর। মণিমহেশ যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপে আমাদের পৌঁছতে হবে ভারমোর। পাঠানকোট ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি ট্যাক্সি ইউনিয়নের লোকেরা ইচ্ছেমতন দরকষাকষি শুরু করেছে যাত্রীদের সঙ্গে। ইন্টারনেট দেখে এক ট্যাক্সি অপারেটরের খোঁজ পেয়েছিলাম, তাকে ফোন করে অনেক কম খরচেই ট্যাক্সি বুক করে নিলাম। ইউনিয়নের ঝামেলা এড়াতে গাড়ির মালিক নিজেই একটা রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আমাদের মণিমহেশ যাত্রার কথা শুনে বললেন, এ এক ভীষণ কঠিন যাত্রা, এমনকি অমরনাথ যাত্রার চেয়েও অনেক কষ্টকর। একটু অবাক হলাম, সঙ্গে কিছুটা অবিশ্বাস! গাইড বইয়ের বর্ণনার সঙ্গে কোনওভাবেই যেন মেলাতে পারলাম না। "মকাই কি রোটি" আর "সরষো কি শাগ"-এ বিকেলবেলা "লাঞ্চ" সেরে ভারমোরের পথ ধরলাম। গাড়ির ড্রাইভার পাপ্পুজি পাঞ্জাবি বৈষ্ণব। শিব ও বিষ্ণুর উপাসনামূলক প্রাণোচ্ছল পাঞ্জাবি ভক্তিগীতি শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম হিমাচল প্রদেশের ৩৩নং রাজ্য সড়ক ধরে। কিছুক্ষণ পরেই রাভী নদী যাত্রাপথের সাথী হল। রাভী, বাঙালির কাছে যা ইরাবতী নামেও পরিচিত, এক আপাত শান্ত নদী, অনেক বাঁধ ও জলাধার যেন তার প্রাণোচ্ছলতা ছিনিয়ে নিয়েছে। কখনও পাহাড়ের আড়াল আবার কখনও বা সুগভীর গিরিখাতে নিস্তরঙ্গভাবে বয়ে চলা ইরাবতীর বিষণ্ণতা যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল হিমাচলের আকাশকেও। ঘন কুয়াশা আর মেঘলা আকাশে সন্ধ্যা নেমে এল বড় তাড়াতাড়ি। পথে মণিমহেশ যাত্রার তীর্থকর দেওয়ার জন্য গাড়ির লম্বা লাইন ও পরে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হল। ভারমোর পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে দশটা।
মণিমহেশের দোরগোড়ায়
হিমাচল সরকার অনুমোদিত যে হোম স্টে-তে উঠলাম সেখান থেকেই ভারমোর শহরটা শুরু। সামনের বাড়িঘরগুলোকে যেন পাহাড়ের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। তাই শহরের পুরো ছবিটা চোখের সামনে ধরা পড়ে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে শীত সেভাবে জাঁকিয়ে বসেনি, কিন্তু কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় শীতের আভাস স্পষ্ট। সেই ঠান্ডা উপেক্ষা করেই ছাদে চলে গেলাম রাতের শহরকে অনুভব করতে।
ভারমোরের রাত মায়াবী আলোয় ঝলমল। পাহাড়ের গায়ে যেন অজস্র জোনাকি একসঙ্গে মিটমিট করে জ্বলছে, আর সামনেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য গাড়ির আলো এক সর্পিল রেখা তৈরি করেছে। রাতের পরিষ্কার আকাশে চাঁদকে যেন অনেক কাছে মনে হল, কলঙ্কগুলোও অনেক স্পষ্ট, আলো-আঁধারিতে রাস্তার একপাশে অতল খাদ আর অন্য পাশে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া পাথুরে পাহাড় অনুভব করা যাচ্ছে। আলোর রেখা পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে দিগন্তে গিয়ে কোন এক পায়ে চলা পথ বেয়ে নেমে গেছে খাদের দিকে। শহরের উল্টোদিকের পাহাড়ে শুধুই অন্ধকার।
ভারমণী মায়ের খোঁজে
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল। ভারমোরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভারমণী মাতার মন্দিরে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছে অলিম্পকদা। গাড়ি আসার তখনও ঢের দেরি দেখে একাই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মর্নিং ওয়াকে। সকাল ছ'টায় ভারমোরে তখনও রাতের অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। দূরে কুচকুচে কালো 'মণিমহেশ কৈলাশ' পর্বতের চূড়া আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। এখানে তা 'কৈলাশ' নামেই পরিচিত, তবে মানস সরোবরের কৈলাশ শৃঙ্গের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। রাস্তার পাশে খাদের কিনারায় গিয়ে নীচের দিকে তাকালাম। নীচে অনেক গভীরে জলের রেখার উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ পড়ল 'কৈলাশ' পর্বতের ওপর। এই পাহাড়ের পেছন দিক থেকে আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে। মনে হল কেউ যেন পর্বতের চূড়ার পেছন থেকে অসংখ্য টর্চ ফোকাস করেছে আকাশের দিকে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের ওপার থেকে রবিমামা উঁকি মারলেন, আর ভোরের আলো মুহূর্তের মধ্যে পুরো শহরকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে তুললো। কিন্তু এখানে সূর্যের আলোর তেজ খুব বেশি, খালি চোখে তাকাতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম মূল শহরের দিকে। যদিও গাড়ি বুক করাই আছে তবুও ভারমণী মায়ের মন্দিরের দিকে পায়ে হেঁটেই যাওয়ার ইচ্ছে হল। ভারমোর বাজারের কাছে এসে আশেপাশের লোকজনকে জিগ্যেস করে ভারমণী মাতার মন্দিরের পথ ধরলাম। পায়ে চলার পথ গাড়ি চলার পথের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা, দূরত্ব অনেকটাই কম। গাড়িপথ যেখানে প্রায় দশ কিলোমিটার সেখানে হাঁটা পথ মাত্র তিন-চার কিমি। ঝরনার আকারে নেমে আসা একটি পাহাড়ি নালার পাশ দিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো পায়ে চলা পথ উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর দিকে। সামনে কিছু দর্শনার্থীও একই পথ ধরেছেন। তাঁদের অনুসরণ করতে করতে উঠতে থাকলাম।
সেপ্টেম্বর মাস, তাই পাশের আপেল বাগানও পরিপুষ্ট লাল আপেলে ভরা। কিছুদূর যেতেই গ্রাম শেষ হয়ে পাহাড়ি ঢাল শুরু হল, আর সিমেন্টের রাস্তা শেষ করে পাথুরে-মাটির পথ ধরতে হল। কিছুটা ওপরে উঠতেই ডান পাশের বিস্তীর্ণ নীল আকাশ আর পাহাড়ের সারি চোখের সামনে ভেসে উঠল। প্রকৃতির এই রূপকে প্রাণভরে না দেখে এগিয়ে যেতে মন চাইল না, দাঁড়িয়ে পড়লাম নির্জন পাহাড়ি পথে। বাঁদিক থেকে সবুজ গালিচার মত তৃণভূমি পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে, আর তার মাঝখান দিয়ে সরু আঁকাবাঁকা রেখা হয়ে এগিয়ে চলেছে পায়ে চলার পথ। সেই পথ কখনও সিমেন্ট বাঁধানো কখনও বা শুধুই মাটির। ডানদিকে এক বিশাল শ্যাওলা রঙের পর্বতশ্রেণি যেন মূর্তিমান দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে প্রকৃতির সুন্দরতম অলংকার হল মেঘ-কুয়াশাহীন গাঢ় নীল আকাশ যা কলকাতার বাঙালির কাছে নিতান্তই দুর্লভ। এই সুন্দর প্রকৃতির বুকে দূরে পাহাড়ের কোলে দেখতে পেলাম এক ছোট্ট মন্দির। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই আবিষ্কার করলাম এই নিরিবিলি পথে আমি ছাড়া আর কোনও জনমানব নেই, যে দর্শনার্থীদের অনুসরণ করছিলাম তারা পাহাড়ি খাঁজের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পায়ে চলা পথ দুভাগ হয়ে গেল। পড়ে গেলাম চরম দোটানায়। তুলনামূলক চওড়া পথটি ধরেই ওপরের দিকে এগিয়ে চললাম। রাস্তাটি কখনও সর্পিল, কখনও সমকোণের আকৃতি, কখনও সিঁড়ির মত কখনও বা উটের কুঁজের আকার নিয়েছে। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল পাহাড়ের ওপরে দেবদারু গাছের সারি। মোবাইল নেটওয়ার্ক সব সময় পাওয়া যাচ্ছিল, তাই সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল না। আরও অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল একটি ভেড়ার পাল। মেষপালকের কাছে মন্দিরের পথ জিগ্যেস করতেই বলল আমি অনেকটা ঘুরপথে চলে এসেছি। তবে পেছনে ফিরে যেতে হবে না, এই পথে আরেকটু সামনে এগোলেই ভারমণী মায়ের মন্দির চোখে পড়বে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিভোর হওয়ার খেসারত দিতে হল প্রায় দু'কিলোমিটার বেশি হেঁটে। এমন সময় অলিম্পকদা ফোন করে জানালো বুক করা গাড়ি আসেনি, অগত্যা হেঁটেই এই পথে রওনা হয়েছে। আমি বারবার বলে দিলাম কোনো গাইডকে সঙ্গে নিয়ে নিতে। একটু এগোতেই ভারমণী মাতার মন্দিরের রাস্তা চোখে পড়ল।
ভারমণী মাতার মন্দিরের দুটি প্রবেশপথ, প্রায় দু'ঘন্টা হেঁটে একটি পথে এসেছি, অপর পথটি তুলনামূলকভাবে ভারমোর থেকে কম দূরত্বের, যা আগেই ছেড়ে এসেছিলাম। দুটি পথেই আর্চের আকৃতির দুটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারের সামনে এক সাধু দর্শনার্থীদের আশীর্বাদ করছেন। আমি মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। সামনেই একটি ছোট সুইমিং পুল আর সেখানকার ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিয়ে স্নান করছে অগনিত পুণ্যার্থী। সকাল তখন আটটা, মন্দিরে তখনও ভিড় বিশেষ হয় নি। মণিমহেশের মেলার রেশ বজায় রেখে এখানেও তৈরি হয়েছে বেশ কিছু লঙ্গরখানা। একটা দোকান থেকে পুজোর সামগ্রী কিনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভারমণী মায়ের পুজো দিলাম। এখানে পুজো দেওয়ার সময় ধূপ জ্বালানো হয় আর একটা জড়ির কাজ করা উত্তরীয় মায়ের পায়ে সমর্পণ করা হয়। পুজোর প্রসাদের জন্য যা নিবেদন করবেন তার কিছু অংশ মায়ের বেদিতে রেখে বাকি অংশ ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। প্রসাদ হিসেবে সাদা মুড়ি আর ছোট নকুলদানাই বেশি প্রচলিত। ভারমণী মাতার এখনকার মন্দিরের পেছনেই রয়েছে প্রাচীন মন্দিরটি। সেখানে এখন পুজো দেওয়া হয় না। মন্দির চত্বরের মাঝখানে রয়েছে একটি জলাশয়। পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জল একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে সেখানে এসে পড়ছে, আবার অন্য একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে সে জল বের হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের সমস্ত লঙ্গরখানা ও দোকানদার এই জল ব্যবহার করছে, ও অবশেষে সেই জল গিয়ে পড়ছে আগের দেখা সেই সুইমিং পুলে। মন্দির চত্বরের মাঝের এই জলাশয়েই আগে পুণ্যার্থীরা স্নান করতেন, কিন্তু এখন আর এখানে স্নান করতে দেওয়া হয় না। পুজো দিয়ে সামনের একটি লঙ্গরখানায় সকালের খাওয়া খেয়ে নিলাম। লঙ্গরখানায় সমস্ত খাওয়াই নিরামিষ, আর বিভিন্ন রকমের ডাল, আতপ চালের ভাত আর আচার মোটামুটি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। যত খাবার চাই তত খাবার বিনা পয়সায় দিতে এরা প্রস্তুত, কিন্তু খাবার নষ্ট করা একেবারেই নাপসন্দ। অলিম্পকদাকে ফোন করে জানতে পারলাম একটা গাড়ি পেয়ে গেছে এখানে আসার জন্য, এক দোকানদার তার গাড়িতে লিফ্ট দিয়েছেন, তবে পৌঁছতে এখনও অনেক দেরি। ফিরে গেলাম সেই দোকানে যেখান থেকে পূজার উপকরণ কিনেছিলাম। দোকানদারের কাছে জানতে চাইলাম ভারমোরের ইতিহাস। বললেন, ভারমোরের আদি নাম ব্রহ্মপুর। রাজা মেরুবর্মন এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা। তবে এর এক পৌরাণিক ইতিহাস জানাতেও ভুললেন না। সংক্ষেপে তা অনেকটা এরকম – শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভারমণী মাতা নিজে হাতে মনোরম এই শহরকে গড়ে তুলেছিলেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পাহাড়ের অপর পাশে থাকা সন্ধোলা নাগের জলভাণ্ডার থেকে পবিত্র জল চুরি করে এনেছিলেন এই শহরের অধিবাসীদের কাছে সরবরাহের জন্য। ভগবান শিব চুরাশিজন সঙ্গী নিয়ে মণিমহেশ যাত্রার সময় ভারমণী মাতার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ভারমণী মাতা তাঁদের ভারমোরে থাকার অনুমতিও দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর পাহাড়ের চূড়া থেকে শিবের অনুচরদের জ্বালানো আগুন ও ধোঁয়া দেখতে পান। প্রকৃতিপ্রেমী ভারমণী মাতা তখনই শিব ঠাকুরকে ভারমোর ছেড়ে যেতে নির্দেশ দেন। অবশেষে শিব তাঁর অনুচরদের এই শহরেই ছেড়ে খুব সকালে মণিমহেশের দিকে রওনা দেন। ভারমোরে চৌরাশির মন্দিরে সেই অনুচরদের চুরাশিটি সমাধি রয়েছে। শিবঠাকুরের ইচ্ছানুসারে ভারমণী মাতার মন্দিরের সামনের এই জলাশয়ে স্নান করে যাত্রা শুরু না করলে মণিমহেশ অভিযান সফল হলেও তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছেলে মারা যাওয়ার পর প্রকৃতিকন্যা ভারমণী মাতা মনের দুঃখে নিজেও সমাধিস্থ হন। ভারমোরে ভারমণী মাতা দেবী দুর্গা বা গৌরীর প্রাণোচ্ছল রূপ হিসেবে পূজিতা হন।
পৌরাণিক কাহিনিতে অনেক ক্ষেত্রে হিসেব মেলানো কঠিন হলেও তা যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল। কে জানে হয়তো ভারমণী মাতা ছিলেন কোনও দক্ষ স্থপতি, যিনি পাহাড়ের উল্টোদিকের লেক থেকে টানেল বানিয়ে ভারমোরে জলের যোগান দিয়েছিলেন! পুরো ভারমোরেই সাতটি ভূগর্ভস্থ জলধারা রয়েছে, যার অনেকেরই উৎপত্তি নিশ্চিত করে বলা যায় না। হয়তো একমাত্র ভারমণী মাতার কাছেই ছিল এই উৎসসন্ধান।
মন্দিরের পাশে পাহাড়ের ঢালে ধাপ কেটে কেটে অনেক পায়েচলা পথ উঠে গেছে। তার পাশে কিছুক্ষণ বসে রইলাম নিস্তব্ধ পাহাড়ের কোলে। একটু পরেই অলিম্পকদা পৌঁছে গেল মন্দিরে। কিন্তু তখন অসংখ্য দর্শনার্থীর ভিড়। অলিম্পকদা পুজো দিয়ে আসতে আসতে দুপুর প্রায় বারোটা। হেঁটে ফেরার জন্য তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত রাস্তাই বেছে নিলাম। আসার সময় এই রাস্তা খুঁজে পাই নি, কিন্তু এবার সবাই এই পথেই নেমে চলেছে। পায়ে চলার পথটি ধুলোময়, আর সৌন্দর্যে ওপরে যে পথে উঠেছিলাম তার চেয়ে অনেকটাই ম্যাড়ম্যাড়ে। তবে এই পথে বেশ কয়েকবার চোখে পড়ল মণিমহেশ কৈলাশ শৃঙ্গ। এ পথে আপেল বাগান ছিল, কিন্তু তা ওই পথের মত উন্মুক্ত নয়, তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। গোয়াল ঘর আর বসত বাড়ির মধ্য দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি শহরের কাছে পৌঁছে গেলাম। পথে পড়ল হেলিপ্যাড, এখান থেকেই মণিমহেশ যাওয়ার হেলিকপ্টার ছাড়ে, পৌঁছে দেয় গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত। ফেরার পথে আমার "দামী" ট্রেকিং স্যু এর সুকতলা গেল খুলে! ভারমোরে পৌঁছে বাজারের কাছে এক মুচিকে পেয়ে গেলাম। পুরো শহরে মাত্র একজনই মুচি, তাই সকলের জুতো সারাইয়ের যাবতীয় দায়িত্বও তাঁরই। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম, যা হওয়ার ভারমোরে হয়েছে, মণিমহেশের পথে হয়নি।
মণিমহেশ যাত্রা উপলক্ষ্যে ভারমোরে লোকের মেলা। এই মেলা শুরু হয় জন্মাষ্টমীর দিন আর শেষ হয় রাধাষ্টমীতে। এই এক পক্ষকাল এখানে হোটেলগুলোতে তিল ধারণের যায়গা থাকে না। পুরো শহর জুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য অস্থায়ী "লঙ্গরখানা"। বিনি পয়সায় খাবারের পাশাপাশি খুব দরকারে একরাত থাকার ব্যবস্থাও করে দেয় এঁরা। বছরের অন্য সময় এই শহরকে শহর বলেই চেনা যায় না, তখন ভারমোর যেন আড়ম্বরহীন, নিরিবিলি এক ছোট্ট পাহাড়ি লোকালয়। শহরের বাসস্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে কিছু দোকানপাট তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের এটিএম থাকলেও এই সময় অধিকাংশই অর্থশূন্য। হোম স্টের সবচেয়ে কাছের লঙ্গরখানা থেকেই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। এখানে বিভিন্ন রকমের ডাল, ভাত আর সবজির পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে গরম গরম জিলিপি!
মোটরপথের শেষ সীমানায়
পরদিন খুব সকালেই বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল মণিমহেশের পথে। প্রথমে আমাদের পৌঁছতে হবে হাদসার, সেখান থেকেই শুরু হবে পায়ে চলা পথ। সেই মত হোম স্টের ম্যানেজারকে বলে গাড়ির বন্দোবস্তও করা ছিল। কিন্তু প্রথমতঃ গাড়ি আসতে একটু দেরি হল, আর তারপর সঙ্কুল পাহাড়ি পথের ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে আধঘন্টার পথ দেড় ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে হাদসার পৌঁছতেই বেজে গেল সকাল দশটা। হাদসারকে শহর না বলে গ্রাম বলাই ভাল। আসলে এখানে জনবসতি খুবই কম, রাস্তার পাশে গুটিকতক বাড়ি আর মণিমহেশ যাত্রা উপলক্ষ্যে অল্প কয়েকটি দোকান। একটা বাস স্ট্যান্ড আছে যা ভারমোরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে, এই মেলার সময় ভিড় থাকলেও অন্য সময় যাত্রীর দেখা পাওয়া যায় না। বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটা ধাবা, যেখানে সামান্য কিছু খাবার পাওয়া যায়। পথেরও শেষ প্রান্ত যে থাকতে পারে তা এখানে এসে উপলব্ধি করলাম। গাড়িগুলো এখান থেকেই আবার ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভারমোরের দিকে। এখান থেকে দুটি পায়ে চলার পথের একটি চলেছে কুগতি পাসের দিকে, আর অপর একটি পথ মণিমহেশে। বেশ কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছলাম মণিমহেশ যাত্রার প্রধান তোরণের সামনে। মাথার ওপর ঝোলানো মস্ত এক ঘন্টা বাজিয়ে যাত্রা শুরু করছে সবাই। নীচে এক সুন্দর জলধারা বয়ে চলেছে। মণিমহেশ লেক থেকে বেরিয়ে এই নালা গিয়ে মিশেছে আমাদের পরিচিত রাভী নদীতে। খরস্রোতা এই জলের রেখা মণিমহেশ থেকে হাদসার পর্যন্ত ধঞ্চো নালা নামে পরিচিত, এর পর রাভী পর্যন্ত তা বুধিল নদ। একটু খোঁজ করতেই মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পোর্টার পেয়ে গেলাম। আমার পোর্টার কাম গাইড তালেব হুসেন, জম্মুর লোক। মণিমহেশ যাত্রা উপলক্ষ্যে এখানে এসেছে কিছু রোজগারের আশায়। অলিম্পকদার রুকস্যাক বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বৃদ্ধ লালদিনের। সেও তালেবের "দেশের লোক"। অলিম্পকদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হবে বলেই ঠিক করল, তাতে সময় অনেকটাই বাঁচবে। আমি হেঁটে যাব বলেই মনস্থির করলাম। ঠিক হল, অলিম্পকদা গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, আর অলিম্পকদার মালপত্র নিয়ে লালদিন তো যাবে আমার সঙ্গেই। হাদসারে যাত্রাপথ দুটি তলায় ভাগ করা, সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওপরের রাস্তা দিয়ে যে পথে আমরা যাত্রা শুরু করলাম তার দু'ধারে দেবদারু গাছের সারি। নীচের রাস্তাটা ধঞ্চো নালার পাশ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে এই রাস্তার সঙ্গেই এসে মিশেছে। ওপরের রাস্তার ধারে কিছু সাধু সন্ন্যাসী দুহাত তুলে আশীর্বাদ বিতরণ করছে, কিন্তু পছন্দমত দক্ষিণা না পেলে শাপ-শাপান্ত করতেও ছাড়ছে না। আমরা খুব সতর্কভাবে তাদের নজর এড়িয়ে এগিয়ে চললাম। হাদসার থেকে মণিমহেশ লেক প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার। এতটা পথ চলার জন্য একটি সস্তার কাঠের লাঠিও কিনে নিলাম।
হাদসারে ধঞ্চো নালা পাথরের ওপর দিয়ে প্রবল স্রোতে বয়ে চলেছে। সবরকম শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে তার গর্জন। এখানে ধঞ্চো নালার খুব কাছে পৌঁছানো যায়, ছোঁয়া যায় তার বরফশীতল জল। আমার জলের বোতলে সেই জল ভরে নিলাম, আর তাতে দু'ফোটা জিওলিন। প্রকৃতির দেওয়া কোল্ড ড্রিঙ্কস পান করার এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?
শুরুতে নিজের রুকস্যাক নিজের পিঠে নিয়েই চলতে শুরু করলাম। আমার ধারণা ছিল পথ অতটা কঠিন নয়। তাই তালেবকে বললাম "যতক্ষণ পারি আমি নিজেই নিজের বোঝা বহন করি, ততক্ষণ তুমি আমার গাইড। হাঁপিয়ে গেলে ব্যাগটা তোমায় দিয়ে দেব। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই আমায় ছেড়ে আগে আগে চলে যাবে না"। ফলতঃ তালেব পাশে পাশে খালি হাতেই হেঁটে চলল, আর একটু পড়ে পড়েই আমার কাছে ব্যাগ চাইতে লাগল। আরও সমস্যা হল অন্যান্য পোর্টাররা তালেবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতে থাকল আর তালেব মনে মনে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। কিছুটা এগিয়ে একটু দম নেওয়ার জন্য থমকে দাঁড়ালাম, একটু ছায়া দেখে পিঠের রুকস্যাকটা পাশে রাখতেই তালেব সেটা তুলে নিল নিজের পিঠে। এরপর পুরো রাস্তায় সেটা আর বইতে দেয় নি।
ভগবান বিষ্ণুর সাজানো বাগান
মণিমহেশ যাত্রার একদম শুরুর দিকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম, তাই পথের সব জায়গায় দোকানপাট তখনও তৈরি হয় নি। তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে দোনারি বলে একটি যায়গায় গুটিকয়েক দোকান খুঁজে পেলাম। এখানে এখনও লঙ্গরখানা বসেনি। চলার পথ মোটামুটি সমতল, কিছুটা ধুলোময়। আর পাশ দিয়ে চলা ধঞ্চো নালার গর্জনে নিস্তব্ধতাও ভেঙে খান খান। পথে পুণ্যার্থীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। একটু পরেই যা দেখতে পেলাম তাতে এক নিমেষেই সমস্ত সাহস কোথায় যেন কর্পূরের মত উবে গেল। নীচ দিয়ে পাথুরে খাদে বয়ে গেছে সেই নালা, আর ওপরে রেলিং-বিহীন এক কাঠের সাঁকো। সেই সাঁকো পেরিয়ে যেতে হবে নালার অপর পাড়ে আর তা দিয়ে পিলপিল করে হেঁটে চলেছে অসংখ্য যাত্রী আর ঘোড়া-খচ্চরের পাল। একটা ছোট্ট ধাক্কা বা শরীরের ব্যালেন্সে একটু গোলমাল হলেই সরাসরি নীচের পাথরের ওপর পড়তে হবে। সাঁকো পেরোনোর আগে অনেক্ষণ ধরে সাহস অর্জন করলাম, অনেক ছবি তুললাম। তারপর দেখতে পেলাম দু'পা কেটে বাদ যাওয়া এক প্রতিবন্ধী স্রেফ হাতে ভর দিয়েই রওনা হয়েছে মণিমহেশের পথে। অবলীলায় সে এগিয়ে চলল সাঁকো বেয়ে। তাকে অনুসরণ করে নির্বিঘ্নেই অপর পাড়ে পৌঁছে গেলাম।
এপাড়ে নালাটি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক নদীর আকার নিয়েছে। আর সেই পাথরের ওপর বেশ কয়েকজন নেমে শিবের নামগান করছে আর দুহাত তুলে নাচছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই পৌঁছে গেলাম ধঞ্চো গ্রামে। এখানে কিছু জনবসতি আছে। তবে এই মেলার সময় লঙ্গরখানা আর গ্রামের ঘরবাড়ি আলাদা করে চেনার উপায় নেই। যাত্রাপথে ধঞ্চোই প্রথম বিশ্রামস্থান। অনেকেই এখানে রাতে থেকে পরদিন আবার যাত্রা শুরু করেন। তাই রাত কাটানোর জন্য অনেক টেন্ট রয়েছে। তার অনেকগুলি একেবারে ধঞ্চো নালার পাশেই। তৈরি হয়েছে অনেক অস্থায়ী পাবলিক টয়লেট। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর দেড়টা। একটা লঙ্গরখানা থেকে রাজমার ডাল, ভাত আর সুন্দর গন্ধযুক্ত এক তরকারি দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে হর-পার্বতী সেজে বহুরূপী দুটি শিশুও চেটেপুটে ডালভাত খেয়ে নিল। ওরা স্থানীয় গাদ্দি অধিবাসী, বছরের এই ক'টা দিন খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হয় না, অন্য সময় ভেড়ার পাল চড়িয়েই দিন কাটে। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় খাবার সব সময় পৌঁছায় না। আর শীতে তো পুরোটাই বরফে ঢেকে যায়। লঙ্গরখানাটি স্থানীয় কাংড়া উপত্যকার একটি ক্লাবের। ওদের কাছেই জানতে পারলাম, ধঞ্চো আসলে ভগবান বিষ্ণুর বাগানবাড়ি। কেউ কেউ একে 'বৈকুন্ঠধাম'ও বলে। শীতের ছ'মাস শিব ঠাকুর মণিমহেশের বাসস্থান ছেড়ে সমতলে চলে যান। তখন তিনি এই পার্বত্য অঞ্চল দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান ভগবান শ্রীবিষ্ণুর হাতে। হাতে সময় কম, তাই খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চললাম।
যত ওপরের দিকে উঠছি প্রকৃতি যেন অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠছে। ধঞ্চো নালা পাথরের ওপরে আরও খরস্রোতা আর ধবধবে সাদা জলের ধারায় পরিণত হচ্ছে। চারদিক খোলা একটি পাহাড়ের ওপর এসে নির্বাক হয়ে সামনে চেয়ে রইলাম। সামনের পাহাড়ের ওপর থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট ধাপে ধঞ্চো নালা নেমে এসেছে সমতলে। প্রত্যেকটি ধাপই এক একটা ছোট জলপ্রপাত। ধঞ্চোর লঙ্গরখানাতেই শুনেছিলাম পুরাণ অনুসারে শিব একবার ভষ্মাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এক প্রাণঘাতী বর দিয়ে ফেলেন, সে যার মাথাই স্পর্শ করবে সে মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু চতুর ভস্মাসুর প্রথমেই তা স্বয়ং শিবের ওপর প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়। বিপদ বুঝে শিব ঠাকুর পালিয়ে ধঞ্চোর এই জলপ্রপাতের আড়ালে থাকা এক গুহায় আশ্রয় নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু মোহিনীর রূপ ধরে নর্তকী রূপে ভস্মাসুরের সামনে আবির্ভূত হয়ে নাচের ভঙ্গীমায় ভস্মাসুরকে নিজের হাত নিজের মাথায় রাখতে বাধ্য করেন। সঙ্গে সঙ্গে ভস্মাসুর নিজেই ভস্মে পরিণত হয়।
জলপ্রপাতের দুপাশ দিয়ে দুটো রাস্তা সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলেছে মণিমহেশের দিকে। বাঁদিকের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে যে পথে যেতে হবে, সে পথ সর্পিল রেখা হয়ে ওপরে উঠে গেছে, আর সেই পায়ে চলা পথের দুপাশে হলুদ ডেইজি ফুলের চাদর বিছানো। ভগবান বিষ্ণু নিজে হাতেই যেন তার প্রিয় বাগানবাড়িটি সাজিয়ে রেখেছেন।
মেঘের দেশের নায়ক
ধঞ্চো পেরিয়ে চড়াই পথ পরপর সর্পিল বাঁক নিয়ে ওপরে, অনেক ওপরে উঠেছে। নীচ থেকে ঘাড় ওপরে তুলে তাকালে শুধু পথ চলতি মানুষের রেখা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেই রেখা যে কতটা ওপর পর্যন্ত পৌঁছেছে তা ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না, পাহাড়ের ওপরে একটি বিন্দুর আকারে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। এতটা চড়াই দেখেই আমার গলা শুকিয়ে এল। কিন্তু জল কোথায়? সে তো তালেবের কাছে আমার রুকস্যাকে। অনেক ঘাড় ঘুরিয়েও তালেবের দেখা পেলাম না, পথ চলতি মানুষের স্রোতে কোথাও হারিয়ে গেছে। অগত্যা তেষ্টা চেপে রেখে বৃদ্ধ লালদিন আর আমি চড়াই বেয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম। খুব আস্তে, কিন্তু না থেমে একটানা আধঘন্টা হেঁটে ওপরে উঠে এলাম। দেখলাম তালেব আগেই সেখানে পৌঁছে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাদের নীচে রেখে চলে আসার জন্য আমি দু'কথা শুনিয়েও দিলাম। শেষমেশ ঠান্ডা জলে গলা ভিজিয়ে আমার রাগ কমল। শিব ঠাকুরের প্রতিটি দুর্গম তীর্থক্ষেত্রে ক্লান্তি এড়াতে পুণ্যার্থীরা বিভিন্ন শ্লোক উচ্চারণ করে। কোথাও "ব্যোম ভোলে", "জয় ভোলে", আবার কোথাও "ভোলে বাবা পার করেগা..." কিংবা "হর হর মহাদেব..."। এখানে শ্লোকটি একটু আধুনিক, "এক দো তিন চার, ভোলে নাথ কি জয় জয়কার..."।
এর পরের পথ অনেকটাই সমতল, চড়াই প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সেই পথ অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে, পথে কোথাও দোকান-পাট বা লঙ্গরখানাও নেই। অনেকক্ষণ পর দেখতে পেলাম পাহাড়ের পাথর কেটে একটি চাতাল তৈরি করে সেখানে একটি শিবলিঙ্গের পুজো করা হচ্ছে। এই উপাসনাকক্ষটিকে অস্থায়ী বলে মনে হল না। বুঝলাম কাছাকাছি কোন গ্রাম রয়েছে যেখানকার লোকেরা নিয়মিত এখানে পুজো দিয়ে থাকে। আর কিছুটা এগিয়ে পাহাড়ের গায়ে একটা বাঁক ঘুরতেই পৌঁছে গেলাম একটি বড় লোকালয়ে। এই গ্রামের নাম সুন্দরাসী। এখানেও বসেছে অসংখ্য লঙ্গরখানা, তবে সংখ্যায় ধঞ্চোর থেকে অনেক কম। যাত্রাপথে এপর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন পথ পেরিয়ে এসে যে একটু বিশ্রাম নেব সে উপায় নেই। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা। তালেবকে জিগ্যেস করলাম – "আর কত দূর?" জবাব এল – "আউর স্রেফ দো-তিন কিলোমিটার বাকি ।" মনে মনে হিসেব করলাম, আমার যা চলার গতি তাতে এই রাস্তা যেতেই দু'ঘন্টা লেগে যাবে।
পাহাড়ের ওপরের দিকে চেয়ে দেখলাম ধূসর জলভরা মেঘ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। বুঝলাম বৃষ্টি আসন্ন। তালেবকে জিগ্যেস করলাম এই অবস্থায় এগনো কতটা নিরাপদ? বলল – "বাবু, চিন্তা মত কিজিয়ে, হামলোগ জলদি পৌঁছ যায়েঙ্গে ।" গৌরীকুণ্ড আমরা নাকি এক ঘন্টাতেই পৌঁছে যাব। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে তখনই সেখান থেকে বিদায় নিলাম। সুন্দরাসী থেকে দু'টো পথ চলে গেছে গৌরীকুণ্ডের দিকে। দূর থেকে ওপরের পথে সাদা বরফের মত কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা চললাম নীচের পথ ধরে। এপথে যাত্রী অনেক কম, আর ঘোড়া বা খচ্চর কিছুই নেই। আমি তালেবকে জিগ্যেস করলাম এই পথে কোনও বিশেষ সুবিধা আছে? উত্তর এল – "হাঁ বাবুজি, ইসমে টাইম বহুত কম লাগতা হ্যায়"। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম বৃদ্ধ লালদিনও ওপরের পথই ধরল। কিছুটা যেতে না যেতেই পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা মেঘ আমাদের ঘিরে ধরল। রেইন কোটটা তালেবের পিঠের রুকস্যাকে, কিন্তু এই টিপটিপে বৃষ্টিতে তা আর বের করতে ইচ্ছে করল না। রাস্তার পাশে দেখতে পেলাম প্লাস্টিকের জামা-প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এগিয়ে চললাম। একটু এগোতেই রাস্তা আর খুঁজে পেলাম না। দেখলাম তালেব সরাসরি পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠছে। অনেকটা রক-ক্লাইম্বারদের মত কখনো কখনো হাত দিয়ে পাথর আঁকরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। হাতের লাঠিটায় কোনো হাতল না থাকায় হাতে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা করছিল। তাড়াতাড়ি পথ চলতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়েও উঠেছিলাম। তার ওপর বৃষ্টিতে পাথুরে পথ যেমন পিছল তেমনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। পাথরের ওপরে পা রাখতেও ভয় হচ্ছিল, নীচের দিকে তাকাতেও সাহস হচ্ছিল না - মাথা ঘুরে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। বেশ কিছুটা ওপরে গিয়ে তালেব আমার করুণ অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারল। পাথর বেয়ে আবার নীচে নেমে এল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। পিঠে রুকস্যাক আর এক হাতে আমায় প্রায় টানতে টানতে ওপরে নিয়ে চলল। একটু পরেই দেখতে পেলাম বিদ্যুতের ঝলকানি, সশব্দে বাজ পড়ল খুব কাছেই। খোলা আকাশের নীচে সাড়ে তিন হাজার মিটার পাহাড়ের ওপরে বৃষ্টি আর বজ্রপাত আর যাই হোক খুব একটা উপভোগ্য বলে মনে হল না। অনেক কষ্টে পাথুরে পথ পেরিয়ে পায়ে চলা পথের সন্ধান পেলাম। তালেবের কাছে জানতে পারলাম এই পথই হল "বান্দরঘাটি"। প্রায় বাঁদরের মত দেয়াল বেয়ে উঠতে হয় বলে পথটির এই নাম। বেজায় কঠিন বলে অধিকাংশ অভিযাত্রীই এপথে আসতে চায় না। পথের পাশে একটা ছাউনি দেওয়া দোকান দেখতে পেলাম, কিন্তু সেখানে আগে থেকেই অনেক অভিযাত্রী জড়ো হয়েছে, তিল ধারণের জায়গাও নেই। অগত্যা তালেব আমাকে কখনও টানতে টানতে, কখনও বা উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল। কিন্তু কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় আর প্রচণ্ড পরিশ্রমে আমি তখন নিস্তেজ হয়ে পড়েছি। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, পায়ে চলার পথও বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। শুধুই তালেবকে অনুসরণ করে চললাম, আর একটু পরেপরেই জিগ্যেস করতে লাগলাম – "গৌরীকুণ্ড আর কত দূর?" আর একটাই উত্তর পেলাম – "বাস, আউর থোড়া..."। পাহাড়ের প্রায় মাথায় পৌঁছে দেখতে পেলাম ঘোড়ার লাইন। একটু পরেই চোখে পড়ল একটা টেন্টের টিমটিমে আলো, বুঝতে অসুবিধা হল না যে গৌরীকুণ্ড আর বেশি দূরে নয়।
ভগবানে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্ন আমি সব সময়ই এড়িয়ে যাই। যাকে কোনোদিন দেখিনি তার সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা আমার সাজে না। কিন্তু তালেব যেন ভগবানের দূত হয়ে আমার কাছে এসে আমার জীবনের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছিল। সারা জীবনের জন্য আমি ওর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।
শান্তির ঠিকানায়
পাহাড়ের ওপর একটা সমতল জায়গা – গৌরীকুণ্ড। বান্দরঘাটির চড়াই পেরিয়ে ওপরে উঠে ঘোড়া-খচ্চরের সারি, অসংখ্য টেন্ট আর লোকারণ্যের মাঝে মুহূর্তে যেন হারিয়ে গেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সোয়া সাতটা, এই জনসমুদ্রে অলিম্পকদাকে খুঁজে পাওয়া এক দুঃসাধ্য কাজ। তবে আমাদের মধ্যে এক অলিখিত সমঝোতা আছে, সাধারণত প্রধান ফটকের সামনে বা অনুসন্ধান কেন্দ্রের কাছে আমরা একে অন্যের জন্য অপেক্ষা করি। এক্ষেত্রেও আমায় কোনও সমস্যায় পড়তে হল না, প্রবেশপথ বলে আলাদাভাবে কিছু না থাকলেও, সমস্ত পথ এক জায়গায় এসে মিশে গৌরীকুণ্ডে ক্যাম্প এরিয়ায় প্রবেশ করেছে। সেই সংযোগস্থলের ঠিক মুখেই যে টেন্ট রয়েছে তাতেই একটা বেঞ্চের ওপর অলিম্পকদা বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, আমি পৌঁছতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুঝতে পারলাম আমার দেরি দেখে চাপা টেনশনে ভুগছিল।
গৌরীকুণ্ড মণিমহেশের আগে শেষ ক্যাম্প, পথে পাওয়া ক্যাম্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। অলিম্পকদা দুপুর দেড়টায় এখানে পৌঁছে আমাদের থাকার জন্য একটা টেন্ট বুক করে রেখেছে। ভিজে সপসপে শরীরটা নিয়ে কোনও রকমে টেন্টের বিছানায় আশ্রয় নিলাম। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার মত ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম, ক্লান্ত শরীরে ভিজে জ্যাকেট ছেড়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে আশ্রয় নিতেও খুব কষ্ট করতে হল। টেন্টে সার বেঁধে পরপর অনেকগুলো বিছানা পাতা। একসারি বিছানা মাটি থেকে কিছুটা ওপরে, সম্ভবতঃ নীচে খাট রয়েছে আর তাতে গদি পাতা, তাই ভাড়াও কিছু বেশি, বিছানা পিছু ৩০০-৫০০ টাকা, আর মাটিতে পাতা বিছানা অপেক্ষাকৃত সস্তা ১৫০-২০০ টাকা। তবে ভিড় অনুযায়ী এই দামের হেরফের হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন টেন্টে চেয়ে চিন্তে একটা লম্ফ জোগাড় করা গেল, তার টিমটিমে আলোতে শুধু আমাদের বিছানার সামনেই যা একটু আলোর আভা দেখা গেল কিন্তু তা টেন্টের শেষ মাথা অবধি আর পৌঁছাল না। এদিকে অলিম্পকদার ব্যাগ নিয়ে লালদিন তখনও এসে পৌঁছায় নি। তালেব চলল তার সাথীকে খুঁজতে। কিছু পরেই দুজনে হাসিমুখে এসে দাঁড়াল। ব্যাগ বওয়ার জন্য ছ'শো টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও আমরা এক হাজার টাকা করে দিয়ে দিলাম, আর ঠিক হল পরদিন ফিরে যাওয়ার সময়ও ওরাই আমাদের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাবে। দুজনেই খুব খুশি হয়ে আমাদের 'খোদা হাফেজ' জানিয়ে চলে গেল। টেন্টের আলো-আঁধারিতে দু'চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল।
মায়াবী সেই হ্রদ
ক্লান্তি সত্ত্বেও রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙে গেল। একবার টেন্টের বাইরে গিয়ে দেখি সেখানে আরও অনেকেই টর্চ হাতে বেরিয়ে এসেছে। আকাশের দিকে চেয়ে তারাগুলোকে যেন খুব কাছে মনে হল। পূর্ণিমা নয়, কিন্তু পরিষ্কার আকাশে জ্যোৎস্নার আলো একাই সব অন্ধকার দূর করে দিয়েছে। টর্চ বন্ধ করে যে পথে এসেছিলাম সেদিকে একটু এগিয়ে গেলাম। সার বেঁধে ঘোড়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। আর কিছুটা এগিয়ে যেতেই বান্দরঘাটির ঢালু পথ দেখতে পেলাম। ফিরে আসতে গিয়ে টেন্ট হারিয়ে ফেললাম। বেশ খানিকক্ষণ খোঁজার পর সেই টিমটিম করে জ্বলা লম্ফই টেন্টটিকে চিনিয়ে দিল।
ঘুম থেকে উঠেই আমরা ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। অলিম্পকদা ঘোড়ার ব্যবস্থা করল, প্রথমে তারা আমাদের মণিমহেশ লেক পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, এরপর আমাদের হাদসার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও ওদেরই। ব্যাগ বয়ে নেওয়ার জন্য তালেব আর লালদিনের খোঁজ পড়ল, কিন্তু কোথায় তালেব, সে এই সাতসকালেই রওনা হয়ে গেছে হাদসারের পথে, অন্য কোন পর্যটকের পথের সাথী হয়ে। ঠিক হল লালদিন একাই দুজনের রুকস্যাক বয়ে নিয়ে যাবে।
মণিমহেশ লেক এখান থেকে বিশেষ দূরে নয়, কিলোমিটার খানেক হবে। গৌরীকুণ্ডের হেলিপ্যাডকে পাশে রেখে একটি কাঠের সাঁকো পেরিয়ে অপর পারে পাহাড়ের ওপরে মিনিট পনেরো ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেতে যেতেই পৌঁছে গেলাম লেকের দোরগোড়ায়। মণিমহেশ লেকটা অনেকটা গোলাকার, কোমর উচ্চতার পাথরের পাঁচিলে ঘেরা, তার চারদিক দিয়ে বাঁধানো পাথরের রাস্তা। আকারে খুব বড় নয়, সাধারণ পাহাড়ি লেকের মতই এর বিস্তৃতি, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মণিমহেশ কৈলাশ পাহাড়ের চূড়া এই লেকের সৌন্দর্য অনন্যসাধারণ করে তুলেছে। অসংখ্য তাঁবু খাটানো হয়েছে লেকটিকে ঘিরে, বসেছে অনেক দোকানপাট। একটি দোকান থেকে আমরা পুজোর সরঞ্জাম কিনে নিলাম।
সকাল তখন সোয়া সাতটা, ভোরের আলো তখনও ফোটে নি। এদিন জন্মাষ্টমী, মণিমহেশ মেলার প্রথম দিন। লেকের পাশেই চলছে হর-পার্বতীর পুজো, সঙ্গে রয়েছে বাসুকী নাগ। পাশে কৈলাশ পর্বতের দিকে মুখ করে রয়েছে পাথরের ওপর সাদা রঙ করা শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি আর তার সোনালী এক ধাতব প্রতিকৃতি। একটু পরেই সূর্যোদয়ের সময় হল, সবার নজর কেড়ে নিল এতক্ষণ আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা কৈলাশ পর্বত। সূর্য আবির্ভূত হল এই পর্বতের ঠিক পেছনে। প্রথমে পর্বতের পেছনে দেখা গেল এক দিব্য জ্যোতি। ধীরে ধীরে সেই আলোর উৎস ক্রমশঃ ওপরে উঠতে থাকল। পর্বতের মাথার ওপর হালকা সাদা মেঘ অনেকক্ষণ ধরেই ভেসে বেড়াচ্ছিল। এক সময় কৈলাশের চূড়ার ছায়া পড়ল সেই সাদা মেঘের ওপর, তাতে মেঘের ওপর যেন জটাধারী শিবের এক প্রতিকৃতি ফুটে উঠল। লক্ষ্য করলাম ভাবাবেগে আবিষ্ট অলিম্পকদার দু'চোখ বেয়ে নেমে এসেছে জলের ধারা, জিগ্যেস করলাম "কি হল? চোখে জল কেন?" জবাব এল – "ওপর দিকে চেয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছ না!" অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়েও আমার চোখে বিশেষ কিছুই এল না, বুঝলাম আমার যুক্তিবাদী মনের স্তর এতটাই পুরু যে অনেক অপার্থিব অলৌকিক দৃশ্যও কোনও বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই যে দুর্লভ, দৈব ছবি অলিম্পকদার চোখে ধরা পড়েছে, আমার চোখে তা অধরাই রয়ে গেল। অগত্যা সেই পাহাড়চূড়ার অনেক অনেক ছবি ক্যামেরা বন্দি করলাম, এই আশায় যে যদি পরে কোনওভাবে সেই ছবি আমার চোখেও ভেসে ওঠে!
চতুর্দিক থেকে 'হর হর মহাদেব' ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। একটু পরে কৈলাশের চূড়ার এক পাশের ছোট চূড়ার পেছনে সূর্যের আলো হীরের দ্যুতির মত এক রামধনুরঙা আলোর ছটা তৈরি করল। আস্তে আস্তে সূর্য যখন পর্বতের আড়াল থেকে আকাশে ভাসল তখন চারদিক শান্ত হল। মণিমহেশ লেকের উচ্চতা চার হাজার মিটারেরও বেশি, তার ওপর বায়ুদূষণ একেবারেই নেই, তাই সূর্যের আলোর তেজ এখানে খুবই বেশি, খালি চোখে সেদিকে তাকানোর চেষ্টা না করাই ভাল। আমরা লেকটাকে একপাক ঘুরে নিলাম। লেকের জলের ওপরে ভাসছে বরফের আস্তরণ, আর সেই ঠান্ডা জলেই স্নান করছে অসংখ্য পুণ্যার্থী। পৌরাণিক মতে স্বয়ং শিব ঠাকুর এই লেকের প্রতিষ্ঠাতা, এবং এর তীরে তপস্যা করেই তিনি সমস্ত পাপ দূর করেছিলেন, তাই এর জলে স্নান করাটাই রীতি, কিন্তু এই বরফ জলে নামার সাহস আমাদের হল না, লেকের কিছুটা জল মাথায় ছুঁইয়েই ক্ষান্তি দিলাম।
স্থানীয় গাদ্দিদের বিশ্বাস পূর্ণিমা রাতে সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত আকাশে কৈলাশ পর্বতের চূড়ার 'নাগমণি' থেকে নাকি দিব্য জ্যোতি ঠিকরে বের হয়। তবে যুক্তিবাদীদের দাবি অনুযায়ী তা আসলে কৈলাশ পর্বতের বরফের স্তরে চাঁদের আলোর প্রতিফলন। আমাদের পক্ষে সেই মণি দেখতে পাওয়ার কোনও উপায় নেই, কারণ প্রথমতঃ পূর্ণিমার রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব, আর দ্বিতীয়তঃ কৈলাশ পর্বতের চূড়া মেঘমুক্ত পাওয়াও দুর্লভ। মণিমহেশ কৈলাশ পর্বতের মহিমা স্থানীয় লোকেদের মুখে মুখে ফেরে, এই পর্বত এতটাই দুর্গম যে আজ পর্যন্ত কোনো পর্বত অভিযাত্রী এই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতে পারে নি। এই পাহাড়ে উঠতে গিয়ে এক মেষপালক তার ভেড়ার পাল সমেত পাথরে পরিণত হয়েছে, একই দশা হয়েছে একটি সাপেরও! তবে আধুনিক কালে বছর পঞ্চাশেক আগে এক পর্বত অভিযান বিফল হওয়ার পর মণিমহেশ কৈলাশ অনেক লোককথার সৃষ্টি করে অজেয় হয়েই রয়ে গেছে। সূর্যের তাপ খুব দ্রুত বাড়তে থাকল, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। কালো, সাদা আর রংবাহারি পাহাড়ে ঘেরা পার্বত্য লেককে পেছনে ফেলে ফিরে চললাম গৌরীকুণ্ডের পথে, তবে এবার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে।
কল্পলোক থেকে বাস্তবের পথে
ফেরার পথে দিনের আলোয় গৌরীকুণ্ডের প্রাণচঞ্চলতা আরও বেশি করে চোখে পড়ল। গৌরীকুণ্ডে একটি ছোট জলাশয় আছে, তার জল মণিমহেশের মত বরফ-শীতল নয়, বরং ঈষদুষ্ণ। এখানে মহিলাদের জন্য স্নানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আর পুরো অঞ্চলটাকে পর্দা আর কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। শুনতে পেলাম গৌরীকুণ্ডের এই জলাশয় নাকি মণিমহেশের মূল লেকের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু কিভাবে তা আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। লোকমুখে শুনলাম স্নানের সময় পার্বতী এই জলাশয়েই স্নান করতেন আর শিব বেছে নিয়েছিলেন মণিমহেশ লেক। টেন্ট থেকে ব্যাগ-পত্তর নিয়ে তা লালদিনের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে চললাম হাদসারের পথে। হেঁটে আসার সময় যে পথে এসেছিলাম ফেরার পথ তার থেকে কিছুটা আলাদা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বান্দরঘাটির পথে ফেরা সম্ভব নয়, তাই আমরা ওপরের পথ ধরলাম।
আসার সময় দূর থেকে এ পথে সাদা বরফের মত 'কিছু একটা' দেখতে পেয়েছিলাম, কাছে আসতে বুঝলাম তা আসলে একটা হিমবাহ, রাস্তার ওপর দিয়ে চলে গেছে। সেই হিমবাহ কেটেই রাস্তা তৈরি হয়েছে। পথের একপাশ থেকে হিমবাহ ঢাল বেয়ে নীচে এসেছে, আর অন্যপাশে গভীর গিরিখাতে নেমে গিয়েছে। মাঝের পিচ্ছিল পথ ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাওয়া বিপজ্জনক, আমরা হেঁটেই পার করলাম। এদিনের পথে ভিড় অনেক বেশি, উল্টো পথে ঘোড়া আর খচ্চরের সংখ্যাও ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। ঘোড়া আর খচ্চরের সম্ভবতঃ কোনো অলিখিত শত্রুতা রয়েছে, তাই মালবাহী খচ্চর কাছাকাছি এলেই আমার ঘোড়ার সহিস ঘোড়াটার সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখকে আড়াল করছিল। চলার পথে আমার ঘোড়াটাকে একটু অসুস্থ লাগছিল, ও বারবার অলিম্পকদার ঘোড়ার থেকে পিছিয়ে পড়ছিল। ধঞ্চোর কাছে একবার বাঁ পা মুড়ে পড়েই গেল, অনেক কষ্টে টাল সামলে নিলাম। এর পর হাঁটাপথেই রওনা দিলাম। পথে তালেবের সঙ্গে দেখা, সে সকাল থেকে আরো বার দু'য়েক এপথে যাতায়াত করে নিয়েছে! বুঝলাম আগের দিন আমার জন্যই বেচারা একবারের বেশি উপার্জন করতে পারে নি। আমরা খুব তাড়াতাড়িই হাদসার পৌঁছে গেলাম, কিন্তু বৃদ্ধ লালদিন দু'দুটো রুকস্যাক নিয়ে অনেক পরে পৌঁছাল।
হাদসার থেকে ভারমোর যাওয়ার বাস ছাড়ে, কিন্তু মেলার সময় বাসেও অসম্ভব ভিড়। অনেক চেষ্টা করেও অন্য গাড়ি খুঁজে পেলাম না। অত লোকের ভিড়ের মাঝে এতদিনে প্রথম এক বাঙালি মুখ খুঁজে পেলাম, মেদিনীপুরের অভিজিৎবাবু, চাষবাস সামলেও ঘুরে বেড়ানোই যার ধ্যান-জ্ঞান, তিনিও ফিরলেন মণিমহেশ থেকে। অবশেষে হোটেল থেকে পাঠানো গাড়িতে আমরা তিনজন ভারমোরের পথ ধরলাম।
~ মণিমহেশ ট্রেক রুট ম্যাপ ~ মণিমহেশ ট্রেকের আরও ছবি ~
'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার সহসম্পাদক সুদীপ্ত দত্ত খুবই বহির্মুখী প্রকৃতির, কাজের ফাঁকে ছুটি পেলেই বেড়িয়ে পড়েন নিরালার খোঁজে। নতুন জায়গার সাথে মিশে আপন করে নেন সেখানকার জীবন, সংস্কৃতি আর খাদ্যাভ্যাস। আর তারপর? পাঠকের কাছে সেই অভিজ্ঞতা সাধ্যমত তুলে ধরার চেষ্টা করেন তাঁর অনভিজ্ঞ ভাষায়।