ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণ কাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, চোখের জল অথবা প্রতিবাদের ভাষাও জাগিয়ে দিতে পারে। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণ কাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।
পাগলের মেলায়
রফিকুল ইসলাম সাগর
কখনও কখনও কোনও রকমের পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়ি,শহর ছাড়িয়ে অচিন কোনও গাঁয়ের পথে। এইতো কিছুদিন আগের কথা,ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত এগারটা ছুঁইছুঁই। ঘরে ফিরব ফিরব করছিলাম। তখনই বন্ধু শাকিল জানাল,প্রাইভেট কার নিয়ে ভোরবেলা মতলব যাবে। সঙ্গে যাবে জাহাঙ্গীর ভাই। আমাকেও যাওয়ার জন্য খুব জোর করল। যাব না বললাম প্রথমে। কিন্তু তারপরই মন দেখি যাই যাই করছে। যাব কি যাব না পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। বললাম,বাসায় গিয়ে ঠিক করি,তারপর জানাচ্ছি। ঘরে ফিরেই ঠিক করলাম ঘুরেই আসি। বন্ধুকে যাচ্ছি বলে জানিয়ে দেওয়ায় খুব খুশিও হল। খুব ভোর বেলা মোবাইলটা বেজে উঠল। ডাক পড়ল। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর পাঁচটা প্রায়। ঘন্টাখানেক পর ভাড়া করা গাড়িতে শাকিল আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে রওনা দিলাম। রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা। শহরের ঘুম ভাঙার আগেই আমরা পেরিয়ে গেলাম। মহাখালী থেকে রওনা হওয়ার সময়ই জাহাঙ্গীর ভাই নাস্তা খাওয়ার কথা বলেছিল। পরে গাড়িতে বসে কথায় কথায় কাচপুর ব্রিজ চলে এলাম। ড্রাইভারকে জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, সামনে কোনও ভালো রেস্টুরেন্টে থামাতে,খুব খুদা লাগছে। খুদা অবশ্য লাগারই কথা তিনজন ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছিলাম। একজনের মুখ থেকে আরেকজনের কেড়ে নিয়ে যেন চলছিল কথার প্রতিযোগিতা। অবশেষে সেই সামনেটা হলো মেঘনা ব্রিজ পেরিয়ে। একটি রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলাম। নান রুটির সাথে ডাল অর্ডার করে অপেক্ষা করছিলাম। ওয়েটার বলল,নান রুটি হবেনা। পরোটা হবে। জাহাঙ্গীর ভাই কিছুটা উত্তেজিত গলায় বললেন,যা আছে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। কয়েক মিনিট পর পরোটার প্লেট আর ডালের বাটি সামনে রেখে গেল ওয়েটার। খাবার দেখতে ছিল আকর্ষণীয়। খেয়েও আমরা সবাই সন্তুষ্ট। সব শেষে চা-পান করে উঠে পড়লাম।
দাউদকান্দি ব্রিজ পেরিয়ে ডান দিকে শ্রীরায়ের চর রাস্তায় ঢুকলাম। সামনে বিশাল বড় এক ট্রাক। গোটা রাস্তা দখল করেছে। ট্রাকটিকে ওভারটেক করে সামনে যাওয়ার মতো ফাঁক নেই রাস্তায়। ট্রাক একটু যায়,একটু থামে। পিছন পিছন আমাদের গাড়ি। এভাবে যেতে যেতে ট্রাকটি সামনে গিয়ে ডানদিকের আরেকটি রাস্তায় ঢুকল। আমরা সোজা চললাম। ট্রাকের পিছনে আটকা পরে দু মিনিটের পথ যেতে আমাদের সময় লাগল প্রায় পনের মিনিট। এবার একটাই পথ তবে আঁকাবাঁকা। যে জন্য কম গতিতে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। প্রায় পাঁচ কি.মি. পথ পেরিয়ে গাড়ির চালক মুখ খুললেন। এক এক করে বলতে শুরু করলেন,এই পথে পূর্বে কবে কবে এসেছিলেন। তার সঙ্গে পথে কিছু কিছু জায়গা দেখিয়ে বলছিলেন, তিনি এখানে এসেছেন,সেখানে এসেছেন। এরপর আমরাও তাকে নানারকম প্রশ্ন করছিলাম। যাচ্ছিলাম লেংটার মেলা নামে খ্যাত হযরত সোলেমান শাহ (র:)-এর মাজারে। গাড়ি চালকের কাছে সোলেমান শাহ (র:) সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বললেন, 'সোলেমান শাহ উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়ার দাবিদার। তিনি পোশাক পরিধান করতেন না আর তাই লেংটা বাবা নামেও পরিচিত। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিয়ে করেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। সারাদেশ ঘুরে বেড়ালেও মতলবের বেলতলীতে বেশিরভাগ সময় থাকতেন। ওরসের সময় এই বেলতলীতে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়। আশে-পাশের কয়েক গ্রামজুড়ে ভক্তেরা থাকেন। কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে বসে ভান্ডারী, মারফতী ও বাউল গানের আসর। এছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবারও গানের আসর জমে। অনেকে এ আসরকে লেংটার মেলা, পাগলের আসর, পাগলের মেলাও বলে।'
লেংটার মেলা সম্পর্কে আগেও অনেকের কাছে শুনেছিলাম। পত্র-পত্রিকাতেও অনেক লেখা পড়েছি। তবে এবারই প্রথম যাওয়া। শ্রীরায়ের চর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটারের বেশি পথ ভিতরে এসে খাড়া একটি ব্রিজ পড়ল। সম্ভবত এটি বাগারবাড়ী ব্রিজ। ব্রিজ থেকে দুদিকে দুটি পথ দেখতে পেলাম। আমরা বাঁ দিকের রাস্তায় এগোলাম। সব মিলিয়ে দাউদকান্দি ব্রিজ থেকে প্রায় পঁচিশ কি.মি. পথ পেরিয়ে একটু দূর থেকে চোখে পড়ল, দু'তিনটি মিনার। বুঝতে পারলাম চলে এসেছি বেলতলী। গাড়ি নিয়েই সরাসরি ঢুকে গেলাম মাজার গেটের সামনে। লাল ইট বিছানো পিচ ঢালাই বিহীন পথ। দু'পাশে গামছার দোকান। মাজার গেটের কাছাকাছি আগরবাতি, মোমবাতি, ফিতে, সন্দেশ ও তবারকের দোকান। দেখতে পেলাম মাজারের মূল ভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ চলছে। ভক্তদের আনাগোনা একেবারেই চোখে পড়ল না। হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখলাম মাজার জিয়ারত করছেন। দু'একজনকে দেখলাম মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে দুহাত পেতেছেন। তবে বেলা গড়ালে মানুষের আনাগোনা বাড়বে বলে মনে হল। ভাগ্যবসত সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আর তাই ঠিক করলাম রাত পর্যন্ত থেকে গানের আসর দেখে যাব।
এবার সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম সাদুল্যাপুর। শাকিলের এক আত্মীয়র বাড়িতে। বেলতলী থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। দুপুরে পেট শান্ত করে আবার বের হলাম। এবারের গন্তব্য ষাটনল লঞ্চঘাট। সাদুল্যাপুর থেকে ঘন্টাখানেক সময় লাগল। পিচঢালা পথ থেকে নেমে কাঠের সাঁকোতে হেঁটে লঞ্চঘাটে প্রবেশ করতে হয়। হেঁটে যাওয়ার সময় সাঁকোর নীচ থেকে একজন মহিলা ডাকল। তাকিয়ে দেখি দুজন মহিলা নৌকায় মাছ ধরেছে। আমাদের মাছ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল,কিনব নাকি? কথায় কথায় যখন তারা জানল আমরা ঢাকা থেকে এসেছি, মাছের দাম চাইল,১৮০০ টাকা। যার দাম কিনা খুব বেশি হলে ৪০০ টাকা হবে। আমরা কথা না বাড়িয়ে এড়িয়ে চলে গেলাম। লঞ্চঘাটে দীর্ঘ সময় কাটল। প্রতি আধঘন্টা পর পর ঘাটে লঞ্চ ভিড়তে দেখলাম। লঞ্চগুলো একেবারেই ছোট ছোট। নারায়ণগঞ্জ থেকে চাদপুর। আবার চাদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে ছোট এ লঞ্চগুলো এখানে ভেড়ে। বড় এবং বরিশালগামী দূর পাল্লার লঞ্চগুলো এখানে দাঁড়ায় না।
সন্ধ্যার হওয়ার পর ষাটনল থেকে সাদুল্যাপুর পৌঁছে বেলতলীর দিকে যাওয়ার পথে গান বাজনার আওয়াজ কানে আসছিল। সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলাম পুরোপুরি জমজমাট অবস্থা। নানান কিসিমের মনোরোগী চোখে পড়ল। শুধু পুরুষই নয় মহিলার সংখ্যাও অনেক। মূল মাজার দালান ব্যতীত পাশের একটি করে বড় কক্ষ বিশিষ্ট আলাদা আলাদা দালানের ভেতরে বসেছে গানের আসর। একেকটা দালানের ভেতর আলাদা আলাদা গানের দল। ভিন্ন ভিন্ন গান গাইছে। বাজছে তবলা, ঢোল, বাঁশি, হারমোনিয়াম। গানের তালে তালে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছে, কেউ বসে চোখ বন্ধ করে তালে তালে মাথা নাড়ছে। আবার কেউ দাঁড়িয়ে গানের তালে তালে শরীর নাড়াচাড়া করছে। কেউ কেউ শুধু হাততালি দিচ্ছে। ভেতরে ফ্যান বন্ধ। জ্বলছে আগর বাতি, মোমবাতি। সব দালানের ভেতরেই একই চিত্র দেখতে পেলাম। সব আসরেই পুরুষের সঙ্গে প্রায় সমান সংখ্যক নারীদেরও তালে তালে নাচতে দেখলাম। ঘুরে ঘুরে দেখার সময় লক্ষ্য করলাম, একটি দালানের ভেতর গানের আসরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে লাল শার্ট পরনে একজন পাগল। মাথায় চুল নেই। প্রথমে দেখি বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়াচাড়া করছে। এভাবে কয়েক মিনিট পর পর সে দু'হাত উঠিয়ে সোজাসুজি ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করার সঙ্গে সঙ্গে নাচতেও লাগল। তারপর আবার আগের মতো দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচাড়া করতে থাকল।
মাজার এলাকায় দোকানগুলোতে যেকোনও পণ্য কিনতে প্যাকেটে লেখা মূল্যের চেয়ে দুই থেকে পাঁচ টাকা বেশি দিতে হল। একটু পর গান বাজনার আওয়াজ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। দেখলাম সবগুলো আসরের ভেতরেই সবাই খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। এরপর আবার গান বাজনা হবে কিনা তা দেখার জন্য আর অপেক্ষা করলাম না। বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠে পড়লাম।
পেশায় সাংবাদিক রফিকুলের বাড়ি বাংলাদেশে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনে রম্য লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির শুরু। বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক কার্টুন ম্যাগাজিন 'টুনস ম্যাগ বাংলা' সম্পাদনা সহ বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিত কলম ধরেন। পাশাপাশি যুক্ত রয়েছেন নানান সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে। ভ্রমণ, আড্ডা ও ছবি তোলা তাঁর পছন্দের বিষয়।