ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণ কাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, চোখের জল অথবা প্রতিবাদের ভাষাও জাগিয়ে দিতে পারে। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণ কাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।
জিস্ দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়
কাঞ্চন সেনগুপ্ত
কলকাতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট... তিব্বত।
এ আর এমন মুশকিল কি!
আপনি যদি 'কোথায় যাচ্ছি'র থেকেও বেশি ইন্টারেস্টেড থাকেন 'কিভাবে যাচ্ছি', 'কোথা কোথা দিয়ে যাচ্ছি' আর 'কাদের সঙ্গেই বা যাচ্ছি' এসমস্ত খুঁটিনাটিতে, তবে জানিয়ে রাখি ওই তিব্বত যাওয়ার কাছাকাছি রোমাঞ্চকর জার্নির সন্ধান এখন আমার ঝুলিতে। আপনি চাইলেই বের করতে পারি ঝুলি থেকে বেড়াল।
আচ্ছা বেশ! অতই যখন ঝোলা-ঝুলি করছেন, তাহলে এই নিন... ওমা বেড়াল হয়ে গেছে চশমা! বেশ, চোখে এঁটে বসুন তবে, আমি টিকিটটা কেটে ফেলি তাড়াতাড়ি।
আরে মশাইরা করেন কি... ভুলেও ওই যন্ত্রটায় চাপতে যাবেন না, ওটা টাইম মেশিন। ওটায় করে এখন আমায় চার মাস পাস্টে যেতে হবে, তবেই-না সেই রোমাঞ্চকর তিব্বত যাত্রার টিকিট পাব।
এইটুকুতেই চোখ কপালে তুললে কি'করে চলে... আজকাল এছাড়া আর উপায় কি বলুন! এই ধরনের হুট-বলতে-পুট তো আর টিকিট পাওয়া যায় না। মাধ্যমিকের প্রিপারেশন আর হলিডেতে ট্রেনের টিকিট পাওয়া একই রকম চাপের। তার ওপর আবার টিকিট ক্যান্সেলেশন চার্জ এখন এমন যে মনে হবে কেটে রাখা টিকিটটারও একটা বিমা করিয়ে রাখি, যদি কোনো কারণে শেষ মুহূর্তে যেতে না-পারি!
তবে চিন্তা করবেন না একদম, পুরনো হাওড়া স্টেশনের একপাশে পড়ে থাকা ১৪ নং প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ান, আমি হুট করে যাব ঠিক চার মাস আগে, আর পুট করে ফিরব কনফার্মড টিকিট নিয়ে।
আমি কিন্তু জানতাম ঠিক এই কথাটাই উঠবে। আরে মশাইগণ, টাইম মেশিনে শুধু টাইমের এপার-ওপার করা যায়, জায়গার এপার-ওপার করতে ইন্ডিয়ান রেলই ভরসা। আরও ভরসার কথা এই যে সরকার থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই, এমন ব্যবস্থা(!) নেওয়া হতে চলেছে টিকিট বুকিং, ক্যান্সেলেশন ইত্যাদিতে, যে-কেউ রেল ভ্রমণ মনস্থ ক'রে যেন বিফল মনোরথ না হয়। (যদিও এইসব...এবং আরও আরও এইসব ভীষণ রকম কার্যকরী পদক্ষেপের সুফল সম্পর্কে বেশির ভাগ অশিক্ষিত আহাম্মক ভারতবাসীকে সোজা সরল ক'রে বোঝাতে গিয়ে ভারত সরকারের বেশ ভালোই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে প্রচারে, বিজ্ঞাপনে।) আপাতত বিজ্ঞাপনের বুক্নিতে বুক বেঁধে পাড়ি দিলাম টাইম মেসিনে, ঠিক চার মাস আগে...
#
#
#
এতো করেও পারলাম না, বুইলেন।
ডিসেম্বর ২৫ টিকিট নেই
২৬ টিকিট নেই
২৭ টিকিট নেই
অগত্যা এগোতে লাগলাম
২৪ টিকিট নেই
২৩ টিকিট নেই
২২-এ গিয়ে সকালের ফলকনামায় টিকিট পেলাম।
এখন, ২২ তারিখ যাওয়া মানে দিনটা পুরো ট্রেনেই। গোপালপুরে হোটেলে ঢুকব যখন তখন ডিনারের অর্ডার নিতে আসবে। আর সেখানে মাত্র ২৩ তারিখটা থেকে ২৪-এর রাতেই ফেরার ট্রেন (২৫শে ডিসেম্বর ছুটি। ওই দিনই ফিরতে চাইছি। নানান ঝামেলায় যদি ট্রেন লেট করে, অফিস কামাই যাওয়ার ভয় নেই। তাছাড়া নাছোড় রুটিনে জুতে যেতে খানিক মানসিক প্রস্তুতির জন্য ২৫ তারিখটা হাতে রাখা)।
আর সেইজন্যেই খুব-করে চাইছিলাম ২১ রাতে যদি রওনা দেওয়া যেত, আর ২২ সকাল সকাল চেক ইন্... তাহলে খানিক হলেও ২২, ২৩, ২৪ ছুটিটা মালুম হোত অ্যাট্লিস্ট।
কোনও ট্রেনে কোনও টিকিট নেই!
একবার ভাবলাম টাইম মেসিনটাই কি টাইম ফেল্ করল নাকি? ২১শে ডিসেম্বর রাত্রিবেলার যেকোনো ব্রহ্মপুরগামী ট্রেনে, স্লিপারে (এসি আজকাল আগে ফুরিয়ে যায়) মাত্র চারটে টিকিট পেলাম না!
ও হ্যাঁ, নামটা ব্রহ্মপুর, বেহ্রামপুর নয়; ওখানে পৌঁছে রেল স্টেশনে দেখেছি, ইংরাজি ও হিন্দিতে ব্রহ্মপুরই লেখা ছিল। ওড়িয়াতেও লেখা ছিল, তবে তা আমাদের কাছে অর্থহীন। যাই হোক ক্ষ্যাপা কুত্তার মতো হেদিয়ে মরছি যখন টিকিটের জন্য তখন আমাদের তিল মাত্র হলেও আশার বাতি দেখাল যে ট্রেনটি সেটিই একদা কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার হয়ে রানাঘাট হয়ে তিব্বত নিয়ে যেত মাত্র সোয়া ঘন্টায়!
আর এখন সপ্তাহে একদিন মাত্র (হাওড়া থেকে সোমবার) সুদূর মজফ্ফরপুর থেকে ছেড়ে হাওড়া হয়ে ভাইজ্যাগ হয়ে চেন্নাই হয়ে... ... ...
ট্রেন নং. ওয়ান ফাইভ টু টু এইট, মজফ্ফরপুর – ইয়স্য়ন্থপুর এক্সপ্রেস।
না, কন্ফার্মড টিকিট হল না তবু, আর.এ.সি. ১১,১২,১৩,১৪। তো ভি অচ্ছা! চার মাস সময় আছে, একটু একটু করে এগোলেও চলবে।
তবু জানি না কেন, আমাদের চারজনের মধ্যে একজন 'মজফ্ফরপুর' শুনে নাক সিঁটকাল! বাকিরা সবাই খুব এক্সাইটেড। অফিসে দরখাস্ত, হোটেল বুক সব সাত তাড়াতাড়ি সারা। এমন কী বেড়াতে বেরনোর দু'দিন আগেই যখন পোঁটলা ভারি করায় ব্যস্ত (হোটেলে ফোন করে একবার আলগোছে জেনেও নিলাম যে শীত নেই গোপালপুর-অন-সীতে) ঠিক তখনই মোবাইলে এস.এম.এস ঢুকে গেল ইন্ডিয়ান রেলের তরফ থেকে, কনফার্মড্ টিকিট উইথ বার্থ ও কোচ নাম্বার। বুকিং স্ট্যাটাস বলছে একজন দলছুট S9-এ। বাকিরা S4। নিজেদের মধ্যে এও আলোচনা করে নিলাম, ট্রেনে উঠে S4-এর কাউকে বলে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া যাবেখন S9-এ যাওয়ার জন্য, আর একান্তই যদি রাজি না-হয়, তাহলেও চিন্তার কিছু নেই, একরাতের তো কিস্সা। আমাদের তখন ডগমগ আহ্লাদ। ব্রহ্মপুরে রাইট টাইম সকাল সাড়ে নটা (৯-৩৫)। সেখান থেকে অটো ধরে গোপালপুর-অন-সী'তে হোটেল সীসাইড ব্রীz কতক্ষণ আর... বেলা এগারোটার মধ্যে স-মু-দ্র-ও-ও-ও-ও...।
#
আমাদের এসব ছোট ছোট আদুরে চাওয়াগুলি লক্ষ্য করে অলক্ষ্যে যিনি মিচকি মিচকি হাসেন, তাঁর সাথে একবার লেফ্ট অ্যান্ড রাইট ডুয়েলে যাওয়ার ইচ্ছা রইল।
ট্রেন নং. ওয়ান ফাইভ টু টু এইট, মজফ্ফরপুর – ইয়স্য়ন্থপুর এক্সপ্রেস ঘড়ি ধরে কাঁটায় কাঁটায় বাইশটা পঞ্চান্নতে ১৪ নং প্ল্যাটফর্ম ঘেষে দাঁড়াল। তার আসা... এসে দাঁড়ানো দেখে ভালো ঠেকল না। মনে মনে খানিক দমে গেলেও বুঝতে দিলাম না। যে নাক-সিঁটকেছিল, সে আরও খানিক সিঁটিয়ে গেল, তাকে সান্ত্বনা দিলাম, 'হাওড়ায় তো খালি হবে, তাছাড়া আমাদের তো কনফার্মড রিজার্ভেশন, চিন্তা কী!' সান্ত্বনা দিলাম বটে তবে গলায় তেমন জোর নেই। ট্রেন থামতে এস ফোর লক্ষ্য করে এগোতে লাগলাম। জেনারেল কম্পার্টমেন্টগুলো পেরোনোর কালে জানলা দিয়ে ভেতরটা যে-রূপ ঠাহর হল, যেন দেওয়ালির আগে ওস্তাদ কারিগর দোতলা তুবড়ি বানিয়েছে মশল্লা ঠেসে। শুধু মুখের কাছে তারাবাতির আগুনটা ধরা বাকি। তখনও মনে মনে প্রবোধ দিচ্ছি, রিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে এরকম ভিড় হবে না নির্ঘাত। পা যেন সরছে না, কিন্তু টেনে নিয়ে চলেছি... উপায় নেই, কষ্ট না করিলে কেমনে আসিবে 'অচ্ছে দিন'?
এস-ফোর
দরজার মুখটায় এসে দাঁড়িয়েছি। পেছন থেকে কোনও ঠেলাঠেলি নেই, কারণ লোকই তো নেই প্ল্যাটফর্মে। শুধু কামরার দরজাটা ভেজানো। আমি এগিয়ে গিয়ে ঠ্যালা দিলাম। লোহার দরজা অর্ধেক হাঁ হয়ে আটকে গেল কিসে যেন লেগে! আধফালি যা দৃষ্টিগোচর হল, মোটা বেডকভারে এপার-ওপার বাঁধা একটি হ্যামক! (সমুদ্রের এখনো ঢের দেরি, হাওড়াতেই সমুদ্রপাড়ের একছিটে আভাস পেলাম)।
দরজা দিয়ে উঠেই ডান হাতে যে একটি বসার সিট থাকে তার ওপরের কোনো জায়গা থেকে টেনে আড়াআড়ি বাথরুমের দরজার সামনের কোনো একটা আংটায় বাঁধা এক অত্যাশ্চর্য মোহন-ঝোলা। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম দরজার বাইরেই, এ জিনিস নতুন দেখছি... আর আমাদের মধ্যে থেকে সেই-একজন ফেটে পড়ল, "আমি বলেছিলাম...আমি বলেছিলাম...।" আমরা বাকি যারা তাকে খুব করে আস্বস্ত করেছিলাম, তাকে আর বেশি বলতে না-দিয়ে এবং একবার মাত্রও তার দিকে দৃকপাত না-করে, কামরার ভেতরে নিজেদেরকে মালপত্র সমেত জাস্ট গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা দেখতে লাগলাম।
প্রথমতঃ নিজেদের মোড অফ মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে গেল দ্রুত। মুখ খুললেই হিন্দি বেরোচ্ছে, সে যেমনই হোক। সেই ঝোলাকে কোনও একটি ঘুমন্ত লাশ সমেত গুঁতিয়ে খানিক জায়গা করে এগিয়ে গেলাম গুনে গুনে দুই পায়ের পাতা। সিট নাম্বার ঊনসত্তর-সত্তর ইত্যকার। অর্থাৎ বেশি ভেতরে ঢুকতে হবে না, একেবারে সামনেই...পাওয়া গেছে দুটো আপার আর একটা মিড্ল। এস-নাইনে যেটা সেটাও মিড্ল। কিন্তু যেখানে পা-দিয়ে টুক করে বডিটা প্লেস করব বার্থে, চলাফেরা করার সেই সরু প্যাসেজটায়, মেঝেতে পাশাপাশি সেঁটে শুয়ে আছে দু'জন! এবং তাদের ধাক্কা দিয়েও জাগানো যাচ্ছে না। এই পর্যন্ত এসেই আমাদের মোমেন্ট অফ ইনার্শিয়া থমকে গেল। দাঁড়িয়ে পড়লাম। এভাবে হবে না। আমাদের সামনে-পেছনে-উপরে-নীচে...সর্বত্র লোক আর লোক আর লোক। "লোক-না-পোক"... সেই রাতের কথা লিখতে লিখতেই মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল কথাটা। মশাইরা আপনারা সব 'রাগ ঘৃণাকে আটকান', অপরাধ নেবেন না প্লিজ, ঠাসাঠাসি নয়, থিক্থিকে নয়, গিজগিজ নয়... সে যেন একেবারে বিজ্বিজ্ করছে মানুষ(!) সত্যি বলতে কী, এতটা ভাবিনি। যেদিকে মাথা ঘোরাচ্ছি, অপেক্ষা করে আছে ঘিন্ঘিনে রকমের বিষ্ময়কর দৃশ্যপট --- আপনাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই বর্ণনার বিস্তারে আমি যাচ্ছি (মনে রাখবেন বিস্তারে যাচ্ছি মাত্র, বাগাড়ম্বরে নয়।)
কামরার ভেতর পায়ে চলার পুরো প্যাসেজটায় যেভাবে শুয়ে অকাতরে ঘুমাচ্ছে (বা ভান করছে), মনে হচ্ছে বদ্ধভূমি গুয়েন্তেনামো থেকে শিপিং কন্টেনার ভর্তি গুলিবিদ্ধ লাশ নিয়ে পাচার হচ্ছে! আশেপাশের যে কটি বার্থে চোখ গেল, অল্প আলোয় ওই ছায়া ছায়া আবছায়াতে দেখলাম যেন দলা পাকানো পাকানো গাঢ় চাপ চাপ অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে মালে-মানুষে। কোথাও সিটের ধার ঘেঁষে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে ঘুমন্ত একজোড়া পায়ের পাতা ও একটি মাথা। এক ঝলকে আঁৎকে উঠি - সামলাই নিজেকে, ওটা আসলে একজনের দুটি পা ও আরেকজনের মাথা - সেটা বুঝেও শিউরে উঠি। কোথাও একটা স্বস্তিকর ফাঁকা একফালি জায়গা খুঁজতে থাকি কামরাময়, যেখানে অ্যাটলিস্ট, আমার চোখ দুটোকে রাখতে পারি খানিকক্ষণ। সেই আশায় একেবারে সিলিং-এ তাকালাম। সিলিং জোড়া, অ্যাজইউসুয়াল, কালো ঝুপ্পুস রেলের ফ্যান (ঠিক এমনটি আর কোত্থাও দেখিনি রেল ছাড়া)। অ্যাজইউসুয়াল বন্ধ, ঘুরছে না, কিন্তু আমার মাথাটা ঘুরে গেল বোঁ করে, ফ্যানের ওপরে ওগুলো কী... চপ্পল?! ভালো করে ঠাহর করলাম, প্রত্যেকটার ওপর, একই অবস্থা!
#
বাবা একবার খুব উদাসীন ভাবেই প্রশ্নর মতো করে বলেছিলেন, "আচ্ছা যে মানুষটাকে সহ্যের শেষ সীমা পেরিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে, এমনকি হাতে-পায় পেরেক পুঁতে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রায় অনুভুতি শূন্য প্রাণটুকু যে বেঁচে আছে তাও শরীর ছেড়ে দেওয়ার অপেক্ষায়, এমতাবস্থায় সেই মানুষটি নীচে ক্রন্দনরত কিছু নাবালক নাবালিকাকে দেখে হাসবেন না তো আর কী-ই বা করবেন? তাঁর সেই হাসির মধ্যে আর অন্য কোনো মহান দর্শন খোঁজার কোনো মানে হয়?" এসব বিতর্কিত কথা এবং আমি তর্ক তুলেওছিলাম সে সময়, তবে বরাবরের মতো বাবা ওইটুকু বলেই চুপ; তর্কে পাওয়া যেত না তাকে। বিশ্বাসে পাওয়া যেত হয়তো।
#
সেই রাতে সেই ট্রেন কম্পার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে আমার হাসি পেয়ে গিয়েছিল। আমার হাসির সঙ্গে যিশুর হাসি বা আমার অবস্থার সঙ্গে যিশুর অবস্থার মিল খুঁজতে যাবেন এমন বোকা আপনারা নন, তবে ওই আরকি, কোথা থেকে কিভাবে যে বাবাকে মনে পড়ে যায় বুঝে উঠতে পারিনা আজও! আমি সত্যিই হেসে ফেলেছিলাম। মাথার ওই ওপরে জুতোর অবস্থান দেখে যতটা চমৎকার লেগেছিল, কামরার মধ্যে আস্ত একটা হ্যামক দেখেও তা হয়নি!
ওই হাসিটাই জড়তা কাটিয়ে দিল। চোস্ত হিন্দিতে বলতে শুরু করলাম, ভাই রিজার্ভেশন হ্যায়, উঠিয়ে, উতর যাইয়ে, চলিয়ে জলদি কিজিয়ে, জলদি কিজিয়ে, সাথ্মে লেডিস হ্যায়, এ বাবু, উঠ্ঠো না, কায় নাহি শুনে হো, চলো চলো উতর যাও, সিট খালি করো... সিট খালি করো...
কোথায় খালি করবে তা কিন্তু বুঝতে পারছি না নিজেরাই! কোথাও তো কোনো জায়গা বাকি নেই। প্রথম খালি হোল মিড্ল বার্থটা। একটি বোরখা ও দুটি ছানা মুহূর্তের মধ্যে টুপ টুপ করে খসে পড়ে দুটি লোয়ার বার্থ ও তারও লোয়ার মেঝেতে যে কোথায় মিলিয়ে গেল, ওই আধো আলোয় ঠাহর করা গেল না। মনে হল কালো পাপড়ির একটা বিশাল ফুল, অসময় ফুটে উঠে হতচকিত আবার পাপড়ি মুড়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওই রাতে ওই সময় ওইখানে একটা ফ্ল্যাশ হল আমার ব্রেনে এবং আমি যথার্থ অনুভব করলাম 'তার কাটা' কারে কয়, কয় প্রকার ও কী কী! নিজেকে বললাম, "ইফ ইউ ওয়ান্ট টু সার্ভাইভ ইন দিস্ সিচুয়েশন, বি আ তার-কাটা"...হ্যাঁ ইংরাজিতেই বলেছিলাম, মনে মনে। চোখ দিয়ে, কান দিয়ে এবং হ্যাঁ অবশ্যই নাক দিয়েও যেসব সেনসেশন ঢুকছে ভেতরে, তারা সবাই যদি ব্রেনে নালিশ জানাতে থাকে আমায়, তবে এক্ষুনি প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াতে হবে আর হাত নেড়ে বিদায় জানাতে হবে আমাদের সাধের হলিডে ট্রিপকে। তাই ব্রেনের 'আম-দরবারে' তালা ঝোলালুম।
আর বেশিক্ষণ নেই ট্রেন ছাড়ার, আমাদের দুজন কমরেড আপার বার্থ দুটোয় উঠে গেছে, আরেকজন চলে গেছে এস-নাইনের উদ্দেশে। তাকে প্ল্যাটফর্মে নেমে ছুটতে হয়েছে। বুঝতেই পারছেন কামরার ভেতর দিয়ে যেতে হলে, ও যখন পৌঁছবে, ট্রেনও তখন ব্রহ্মপুর পৌঁছবে। এই সময় ফোনে জানতে পারলাম, ওপারে যে গেছে সে জলের বোতল নেয়নি সঙ্গে। আমি একটা জলের বোতল নিয়ে ছুটলাম। বোতলটা দিয়েই ছুটে ছুটে ফিরে এসে, চটি পরেই উঠে গেলাম আমার জন্য ফাঁকা করে রাখা মিড্ল বার্থটায়। কোনো রকমে জাস্ট সেঁধিয়ে গেলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার মনে ঠিক দুটো কথা এলো,
(এক) আমরা প্ল্যান করেছিলাম, ট্রেনে উঠে সিট অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করব যাতে সবাই এক জায়গায় থাকতে পারি। এটা খুব পরিচিত অ্যাডজাস্টমেন্ট, ট্রেন সফর করা প্রায় প্রত্যেকেই এ-ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সেই পরিচিত ব্যাপারটাই এখন অবাস্তব রকমের হাস্যকর লাগছে (...সরি আই মিন্ হাস্যকর রকমের অবাস্তব লাগছে)। তৎক্ষণাৎ মাথায় এলো, আচ্ছা প্রথম থেকেই তিনটে না-বলে যদি চারটে সিট রিজার্ভ আছে বলে চড়াও হতাম! এদের কারও রিজার্ভেশন আছে বলে তো মনে হয় না। আরামসে এখানেই চারজনের জায়গা হয়ে যেত। (তখন তখন বুদ্ধিটা মাথায় আসাতে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। এখন ফিরে ভাবছি যখন, কেমন একটা লাগছে। এখনকার সুসংহত আমি, তখনকার 'তার-কাটা' আমিকে ভেবে লজ্জিত হলাম।)
আর (দুই) যে কথাটা মনে এলো তাকে 'পজিটিভ থিঙ্কিং' বলা যেতে পারে। রাতের ট্রেনে মাঝ রাস্তা থেকে লুটেরা উঠে ডাকাতি-ছিনতাই কিছু করার চেষ্টা করতে পারে, এরকম একেবারেই মনে হল না। ভেবে খুব শান্তি পেলাম, ট্রেন স্পিড নিলেই কামরার ভেতরটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হবে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেব। এই ভাবনা আমায় এতটাই উদ্বুদ্ধ করল যে আমি ওই মিড্ল বার্থে ঘাড় গুঁজে বসে গায়ের মোটা গেঞ্জি খুলে, ব্যাগ থেকে হাতড়ে হাতড়ে নরম গেঞ্জি বের করে (অপেক্ষাকৃত) আরাম করে শুলাম।
ট্রেন তখন গতি নিয়েছে ভালোই। চিত হয়ে শুয়ে দেখছি সামনের সাইড আপারে, এক মধ্য বয়ষ্ক ও এক যুবা সঙ্গে কোলবালিশের মতো ব্যাগেজ। মাঝবয়সি যেভাবে দেয়ালে দু'পা তুলে চিৎপটাং হয়ে বার্থের বেশির ভাগটা দখল করে আছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সঙ্গের ছেলেটিকেও মনে হয় আরেকটা বাড়তি লাগেজ ভাবছে। সাইড লোয়ারে একই অবস্থা, তবে এদের মধ্যে মনে হল খানিক হলেও সদ্ভাব আছে। এদিকে আমরা তিনজন যে নির্মম ভাবে তিনটি বার্থে লম্বা দিয়েছি, স্ব স্ব 'ব্রেনের তার' সময় মতো কেটে না রাখলে তা সম্ভবপর ছিল না। আমাদের নীচের বার্থ দুটো ও সংলগ্ন মেঝে ও তৎসংলগ্ন প্যাসেজে যা স্লিপিং অ্যারেঞ্জমেন্ট (ছেলে বুড়ো শিশু মহিলা নির্বিশেষে) ছিল, আমার ধারনায়, মানুষ প্রায় অনুভুতি শূন্য না-হলে মনে হয় না ওভাবে যাত্রা করতে পারে! তাও দু-এক ঘন্টার সফর নয়; ম্যাক্সিমাম প্যাসেঞ্জারই চলেছে চেন্নাই, নয়তো ব্যাঙ্গালোর। মাইগ্রেটেড লেবার। পেটের দায়।
#
এইখানটাই যথোপযুক্ত সময় আবার একবার ট্রেন নং. ওয়ান ফাইভ টু টু এইট, মজফ্ফরপুর – ইয়স্য়ন্থপুর এক্সপ্রেস-এর যাত্রাপথটা দেখে নেওয়ার...
সুদূর মজফ্ফরপুর থেকে ছেড়ে হাওড়া হয়ে ভাইজ্যাগ হয়ে চেন্নাই হয়ে... ... ...
ঝাড়া ৪৮ ঘন্টা-কি-তারও বেশি এই অবস্থায়!
#
কোনও একজনের মোবাইলে কোনো ভোজপুরি সিনেমা চলছে (হেডফোন কানে দিয়ে সিনেমা দেখবে এমন স্বার্থপর কেউ ছিল না ট্রেনে)। আপ্রাণ ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঝামেলা এড়াতে পারলাম না। বড়লোক ও বলাই বাহুল্য কোরাপ্ট নেতার মেয়ে, এক অটোচালক (কিন্তু সিনেমার হিরো)-র প্রেমে পড়েই যত ঝামেলা বাঁধিয়েছে। ঝামেলা পেকেছে বেশ উচ্চরবে। সুতরাং পাশ ফিরে থাকি কিকরে! একটাই ভরসা, ঘটনাক্রম (শুনে যতদূর আন্দাজ হচ্ছে) অকল্পনীয় দ্রুতগতি সম্পন্ন! সে গতির ভগ্নাংশমাত্র পেলে পৌনে এক ঘন্টায় কলকাতা থেকে তিব্বতে পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়।
হেইইই! শ'খানেক অটোরিক্সার গর্জানিতে নায়ক চড়াও হল বোধহয় নেতার উঠোনে, তো এই শুনতে পেলুম সেই গর্জানির ওপরই কাঁপা কাঁপা আবেগমথিত ফুলশয্যার লিরিক্যাল ডায়লগ (যেন সুজির রসগোল্লা)। যেই ভাবলুম দিলওয়ালে দুল্হানিয়া নিয়ে বাড়ি গেল বোধহয়, ওমা! অপরিণামদর্শী নায়িকার মাথাগরম ভাই গর্জাতে আরম্ভ করল, 'মুন্ডু চাই মুন্ডু চাই'...
ধীরে ধীরে খানিক আলগা ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে ওই শব্দের জঞ্জাল থেকেও, অ্যাটলিস্ট আমার মনে হল যে আমি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারলাম। তন্দ্রা ঘনিয়ে এল এসবের মধ্যেও। ভনিতা করে লাভ নেই, সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমটা ভাঙ্গল সামান্য চেঁচামেচিতে। ঘুমভাঙা মানে ধড়ফড় করে ওঠা নয়, আস্তে চোখ দুটো খুলল মাত্র। কামরায় আলো আরও কিছু কমে যাওয়া ছাড়া নতুন কিছু দেখলাম না, শুধু কানে এল, "হটাও ইস্কো, শালা ঝুলা ঝুলাকে রখ্খা হ্যায়! টিকিট দিখাও, টিকিট... হেই তুম দিখাও, তুম দিখাও..." এরূপ শুনতে শুনতেই কালো কোটধারীরা দৃষ্টি গোচর হলেন। মাইরি বলছি, এতোটা আমি ভাবতে পারি নি। এর মধ্যে TTE আসবে, সত্যিই দেশটার কিছু হবে একদিন-না-একদিন। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা এমন ভঙ্গিমায় বের করে আনলাম, সোনার কেল্লায় যেমন ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে ফেলু মিত্তির তার বালিশের তলা থেকে কোল্ট .৩২ টা বের করেছিল। সেই কায়দায় রেল কোম্পানির পাঠানো এস এম এস টা বের করে রাখলাম। কিন্তু চেকারদের তো দৃষ্টিই নেই আমার দিকে। থাকবার কথাও নয়।
আবারও অভিনব এক মন্তাজ খোলা চোখের সামনে। অনেকটা এইরকম, আমি চেষ্টা করছি,
নিচের ঝুপ কালো চাপ চাপ মানুষের কুণ্ডলীগুলো সচকিত হয়ে উঠল। একই সীমিত অঙ্গনে কেমন সঞ্চরিত হতে লাগল, আর তার মাঝে ঠিক জায়গা করে আখাম্বা এসে দাঁড়ালেন দুই মূর্তিমান। তাদের দৃষ্টি, মনোযোগ সবই নিম্নগামী... "টিকিট টিকিট...টিকিট দিখাও...হেই সোতা কাহে...উঠ্ঠো টিকিট দিখাও..."
চেকারের পায়ের কাছে কিলবিল করছে আধা-ঘুমন্ত দেহগুলি। তার মধ্যে থেকে জোড়া তিনেক হাঁটু ভর করে জেগে উঠল গোটা তিনেক মাথা মাত্র। আমি দেখলাম বিস্রস্ত কাঁপা কাঁপা হাতগুলো কয়েকটা টিকিটের মতো কিছু তুলে ধরল, প্ল্যাটফর্ম কাউন্টার থেকে যে টিকিট পাওয়া যায়। মিড্ল বার্থে শুয়ে ঘুম ঘুম চোখে ওই আবছায়ায় বোঝা সম্ভব নয় ওতে কয়জনের টিকিট আছে, কোনো রিজার্ভেশন আছে কিনা আদৌ। আমার দেখার কথাও নয়। যাদের দেখার কথা তারা টিকিটগুলো হাতেও নিল না। যেহাতে পেন ধরা ছিল, ঐ পেনের পেছন দিকটা দিয়ে টিকিটগুলোকে দু'একবার খুঁচিয়ে কী বুঝল কে জানে (তিব্বত যাওয়ার বুকিং বোধ হয় টিকিট খুঁচিয়েই বুঝে যাওয়া যায়), তবে মনে হল ওই দলা পাকানো কাগজের টুকরোগুলোকে ছুঁতেও যেন ঘেন্না পাচ্ছে। দূর থেকেই সরু রিডিং চশমার ওপর দিয়ে তেরছা তাকিয়ে একবার চকিতে চোখ বুলিয়ে নিল স্তুপাকৃত দেহগুলোর ওপর...মাইরি বলছি, কি-বুঝল খোদাই জানে, দুজনেই এগিয়ে গেল কামরার আরও ভেতরে! শিল্পী জয়নাল আবেদিনের মন্বন্তরের ছবিগুলোর 'ফ্যান দাও ফ্যান দাও' ভঙ্গিমার রেপ্লিকার মতো টিকিট হাতে জেগে ওঠা মাথাকটা, নিমেষে আবার তলিয়ে গেল কেমন, যেমন উঠেছিল। আমি মোবাইল পকেটে পুরে পাশ ফিরে শুলাম।
আবার ঘুমের আশ্রয়ে ঢুকে পড়ার আগের মূহুর্তে মনে হল, কেমন হত যদি চেকারদ্বয়ের খানিক সময় নিতাম, ভুরু দুটো কুঁচকে জিজ্ঞাসা করতাম, 'হোয়াট ইস্ দিস্? দিস্ ইস্ নট ডান্! এটা একটা রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টের অবস্থা? কেন অ্যালাও করছেন এসব? এভাবে কেন যাব আমরা যারা আগে থেকে নিয়ম মোতাবেক ন্যায্য মূল্য দিয়ে সিট রিজার্ভ করেছি? মেয়েরা তো বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারছে না! কিছু একটা করুন!' কি হতে পারত বলুন তো! বেশ খানিক ভাবলাম। তারপর মনে হল সমস্যা সমাধানে চেকারদ্বয় পরের স্টেশনে আমাদের তিনজনকেই হয়তো নামিয়ে দিত ট্রেন থেকে। ভেবে বেশ পুলকিত হলাম, আবার হাসলাম মনে মনে, আর ঘুমিয়ে পড়লাম।
ট্রেন ব্রহ্মপুরে রাইট টাইম সকাল সাড়ে নটা (৯-৩৫)। সকাল হওয়ার আগেই বিভিন্ন কারণে বহুবার-আরও ঘুম ভেঙেছিল। শেষ মেস আর ঘুমাবো না ঠিক করলাম এবং দিনের আলোতে আরও পরিষ্কার, আরও দগদগে হয়ে ওঠা কামরার মধ্যে থেকেও নেহাতই স্বাভাবিক আছি দেখাতে ব্যাগ থেকে ব্রাশ-পেস্ট বের করে গটগট করে বাথরুমের দিকে (যতটা গট্গট্ করা সম্ভবপর ছিল। হ্যামকটা দেখলাম খোলা হয়েছে)। বাথরুমের দোর গোড়াতেই আটকে গেলাম, ভেতরে লোক তো আছেই বাইরেও আমার আগে দু'জন। এদিকে অতোটা গট্গট্ করা মনে হয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। শরীরের বায়োলজিক্যাল ক্লকটা এমন সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে যে নিজের বোকামিতে নিজেরই রাগ হচ্ছে। ঘুমিয়ে থাকলেই হত। ভেস্টিবিউল পেরিয়ে ওদিকের দরজা দুটোর সামনেও লাইন। এখন কতদূর এসেছি কে জানে, গাড়ি খানিক স্লো যাচ্ছে। এর মধ্যে অ্যালমুনিয়ামের বালতিতে দু'বোতল জল নিয়ে 'পানি পানি' করতে করতে ভেস্টিবিউল পেরিয়ে ঠেলা-ঠেলি করতে করতে ঠিক সামনেটায় এসে হাজির হল একজন। তক্ষুনি মাথায় খেলে গেল; একটা বোতল কিনে নিলাম (এর আগে কোনোদিন কিনিনি রেলের এই জলের বোতল)। পর পর দুটো টয়লেটই খালি হল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ল আগের লোক। লাইনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আরও একজন। লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম, "দাদা, আমি যাব আপনার আগে?" (হিন্দি বোল-চাল মাতায় উটেচে)। ভাষা কোনো সমস্যা হয় না যদি তা মর্মোৎসারিত হয়। লোকটি আমায় আশ্বস্ত করল, "আরে হম্ তো কাল রাত সে ইহই পে বয়ঠে হুয়ে হ্যায়, হম্হে সন্ডাস নহি যানা, আপলোগ যা রহে হো, ইসিকে খাতির খ্ঢ়া হু ইঁহা।" নিরুপায় হয়ে দুটির একটি দরজায় থাবড়া মেরে বসলাম। লোকটি আমায় বুদ্ধি দিল, "বাবুজি ইয়ে-য়ালা নহি, উধর-য়ালা আগে খুলেগা, ইয়ে-য়ালে মে লেডিস্ লোগ গয়া হুয়া হ্যায়।" ঠিকই তো আমিও তো দেখেছি। ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলল। উফ্ফ্ফ্! যাত্রাপথে এতটা রোমাঞ্চও চাই নি।
#
গাড়ি স্লো যাচ্ছে। কিন্তু শেষ যখন সিডিউল মিলিয়েছিলাম তখনও পর্যন্ত পারফেক্ট অন-টাইম যাচ্ছিল। এখন সকাল পৌনে আট। আমার পেছনে লাইন আরও বেড়েছে। টয়লেটের সামনের এক চিলতে জায়গাটায় এখন কাল রাতের থেকেও বেশি চাপাচাপি। তবু ফুরফুরে লাগছে আমার। আর তখনই ধা করে চোখের সামনে আবার, "...কাল রাত সে ইহই পে বয়ঠে হুয়ে হ্যায়, হম্হে সন্ডাস নহি যানা, আপলোগ যা রহে হো, ইসিকে খাতির খ্ঢ়া হু ইঁহা।"
কেন?
এ কেমন সফর?
কেন সপ্তাহে শুধুমাত্র একটিদিন (সোমবার) চালানো হবে এই ট্রেনটিকে?
এবং আমরা (মানে আমরা সবাই), যাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না তারা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মালগাড়ির থেকেও জঘন্য অবস্থায় 'জাস্ট লোড্' হয়ে যাত্রা করতে বাধ্য হব কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাগিদে? দিনের পর দিন!
রাতের অন্ধকারে যে 'তার'গুলো কেটে রাখা সম্ভবপর হয়েছিল, সেগুলো দিনের আলোয় খামোখা জুড়ে যেতে চাইছে নাকি? মহা মুশকিল্!
এতো লম্বা জার্নি, পুরো ট্রেনে রিজার্ভেশন বলে কিছু নেই, শুধু টিকিট হয়ে রয়ে গেছে। হ্যাঁ, এসি বগি গুলোতেও একই অবস্থা। এ-লাইনে পোড়-খাওয়া দু'এক জনের সঙ্গে হাল্কা আলাপচারিতায় যা বুঝলাম, তিব্বত যাওয়ার এই থ্রিল-প্যাক্ড ট্রিপে ফি-হপ্তায় এই একই কিস্সা। চেন্নাইতে বন্যা পরিস্থিতি বলে নাকি ট্রেনে অন্যবারের তুলনায় ভিড় খানিক কম!
আসলে আমি যাকে সমস্যা ভাবছি, সেটাই আদপে সমাধান! আর কোনো উপায় নেই! আমি শুয়ে পড়লাম আমার নির্ধারিত বার্থে (যেন বার্থ রাইট রক্ষা করছি)। সকাল সাড়ে আটটা। ট্রেন দাঁড়িয়েছে অনামা একটা নেড়া স্টেশনে। আপার বার্থের সাথীরা চোখ টিপে পড়ে আছে। আমার পায়ের কাছে একটা সতেরো/আঠেরো বছরের ছেলে কোনো রকমে ডিঙি মেরে বসে আছে। দেখে খারাপ লাগছে, মনে হচ্ছে বলি, আয়, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়, কিন্তু বলতে পারছিনা। বরং এমন-মনে-হচ্ছে-কেন তাই ভেবে অবাক লাগছে!
এরা কেউ আমায় মিড্ল বার্থ নামিয়ে দিতে বলছে না। কারণটা সিম্পল, লোয়ার বার্থে আমাকে বসতে দেওয়ার মতো জায়গা নেই। আমি লোয়ারে তাকালাম (সরাসরি চাক্ষুষ করতে সংকোচ হচ্ছে। পর্দানসীন জেনানারা রয়েছে। ঠারে ঠোরে দেখছি।) প্রমাণ সাইজের থেকে সামান্য বড় একটি ফ্যামিলি। কম-বেশি সদস্য সংখ্যা পনেরো হবে। পুরুষ গোটা ছয়েক, কিশোর থেকে মাঝবয়সি, না না গোটা আটেক। চার/পাঁচ জন মহিলা, তরুণী বলা চলে। সবার বয়স কাছাকাছি মনে হল। এঁদের মধ্যে সকলেই হিজাবাবৃত নন, মাত্র দু'জন কালো বোরখা পড়ে আছেন তবে মুখে আবরণ রাখেন নি। আর গোটাতিনেক শিশু তাদের খিল খিল, হুটোপাটি ও চ্যাঁ-ভ্যাঁ সমেত। প্রাতরাশ চলছে নীচে। বেশ কিছু প্লাস্টিক বেরিয়েছে। তার মধ্যে থেকে বেরোল গোল চাক্তির মতো স্টিলের টিফিন বক্স। মোটা মোটা রুটি ও পরোটার মাঝামাঝি কিছু রাখা হল এক পাঁজা। হাতে হাতে বিলোনো হল তাসের মতো। সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা। এক ঢাকনায় রাখা আছে আচার। কিসের আচার বুঝতে পারছি না। আর গোল টিফিন বক্স খুললে বেরোল চানাচুর।
লক্ষ্য করবেন শুধুমাত্র পরিবারের পুরুষেরা কাছাকাছি এসে বসে টিফিন করছে, আর আলোচনা করছে সিরিয়ায় আইসিস্রা আসলে ইহুদি, শুধু শুধু মুসলিমদের দোষ দেওয়া হচ্ছে (কোন্ একটা টিভি চ্যানেলে এটা বলেছে)।
মেয়েরা বাচ্চাদের বায়না আর দস্যিপনা সামলাচ্ছে কখনো আদরে – কখনো শাসনে আর নিজেদের মধ্যে কী-খানিক রসের কথা বলেই এ-ওর গায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। প্রায় আধা ঘন্টা দাঁড়ানোর পর ট্রেন ছেড়েছে। ঠিক সময় মতো আর পৌঁছানো হল না ব্রহ্মপুর। সিডিউল দেখে লাভ নেই, কারণ কতদূর এসে গেছি কেউ বলতে পারছে না।
পুরুষদের খাওয়া শেষ। বাকি যা পড়ে রইল, আবার ঢুকে গেল সেই সেই প্লাস্টিক মোড়কে, তারপর দলপতি মতো দেখতে দাড়িওয়ালা লোকটা উঠে দাঁড়াল (বরাবর সাইড লোয়ারের লোভনীয় জায়গাটা দখল করে রেখেছে)। এমনকি ওই সাইড লোয়ার লাগোয়া প্লাগ পয়েন্টটাই শুধু ঠিক আছে, এই কামরার বাকি পয়েন্টগুলো সব অকেজো) লুঙ্গি থেকে চানাচুরের গুঁড়ো ঝাড়ল, আর তারপর খাবারের প্যাকেট গুলো আমিনা-না-রেহানা কার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "অব তুম লোগ খালো মিল-বাঁটকে।"
আসলে সমস্যা কিছু নেই, সমস্যা ভাবলেই সমস্যা। এসবই নানাবিধ কঠিন সমস্যার সুবিধাজনক সমাধান সূত্র।
#
ধরুন না, একশ শতাংশ যাত্রীর ত্রিশ শতাংশও যদি টিকিট কাটে ও বাকি সত্তর শতাংশ-র সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে এভাবে চালিয়ে নেয়, তাহলে ভারতীয় রেলের কাছে এটাই সুন্দর সমাধান। যখনই ট্রেনে কোথাও যাই, রেল লাইনের দু'পাশে অনেকখানি জায়গা ছেড়ে, সাদা সাদা সিমেন্টের খুটি পোঁতা দেখি। রেলের জমি। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। এখনও কলকাতা থেকে দুর্গাপুর মাত্র ১৭৫ কিমি রাস্তা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস যায় প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টায়। টিকিটের দাম প্রায় নব্বই টাকা। রিজারভেশন ও সুপারফাস্ট ট্রেনের আলাদা চার্জ ধরে টিকিট ভাড়া একশ ছাড়িয়ে যায়। সামনে লাইন ক্লিয়ার না থাকলে কিন্তু আপনার ট্রেন লোকাল হয়ে যেতে পারে! আপনি কিন্তু সুপারফাস্টের জন্য দেওয়া ভাড়া ফেরৎ পাবেন না (সিনেমা হলে এসি খারাপ থাকলে যা হয় আরকি)। তবু ইংরেজ আমল থেকে লাইন সেই পাঁচটি। আর যদি ভাবেন সস্তায় যাবেন লোকালে। সারা দিন হাতে রাখুন।
#
বাবু মশায়রা, ধৈর্য হারাবেন না প্লিজ, এগুলো কোনোটাই সমস্যা নয়, সমস্যার সমাধান। আমাদের তো বুলেট ট্রেন থেকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া থেকে ইন্ক্রেডিব্ল ভারতের পথে এগিয়ে যেতে হবে। তাই গোড়ার গলদগুলোর যেসব সুবিধাজনক সল্যুশন রাখা গেছে এতদিনে সেই লাইনেই গাড়ি চলুক আপাতত...
#
আপাতত আমরা আবার দাঁড়িয়ে পড়েছি আরো একটি আউট-অফ-সিলেবাস্ স্টেশনে। ধুত্তেরি! ঝাড়া-খাড়া দিয়ে উঠতে গিয়ে আপার বার্থে মাথাটা ঠুকে গেল। কপালটায় হাত বুলোতে বুলোতে আপার বার্থের নিচের দিকে পাটাটায় চোখ গেল। আমার চোখের ঠিক সামনেই ডটপেন দিয়ে হিন্দীতে একটা হালফিলের বিতর্কিত বাংলা সিনেমার নাম লেখা, 'गांडु'! এবার খেয়াল করে বার্থ থেকে নেমে পড়লাম। উঠতে নামতে শত চেষ্টা করলেও এর-ওর গায় পা লেগে যাচ্ছে। লজ্জিত হয়ে পড়ছি, সরি বলছি, জাস্ট ভ্রূক্ষেপ করছে না কেউ। গায়ই মাখছে না, বুঝতেই পারছে না 'সরি' কেন বলছি। কামরার সরু দরজার গোড়ায় বসে আছে একজন, যাকে উঠতে হবে যেহেতু আমি প্ল্যাটফর্মে নামব। মোবাইলে কথা বলতে বলতে একদিকের পাছাটা তুলে এতটুকু জায়গা দিল যে আমার ধৈর্যচ্যূতি ঘটল, আমি প্রয়োজন মতো জায়গা নিয়ে নামলাম। বসে থাকা ব্যক্তির মেঝেতে লোটাতে থাকা জামার প্রান্তভাগ আমার চটির তলায় মলিন হল, হাঁটুতে গুঁতো খেল, তবু আমি 'সরি' বলিনি এবার, বরং লোকটি কী-বলে সেটা দেখার জন্য তার দিকে ঘুরে তাকালাম। আমার দিকে তাকালোই না। ফোনেই কথা বলে চলেছে আর গুট্খা চিবিয়ে চলেছে। আমার মুখের সামনেই 'ফচাৎ' শব্দে এক মুখ থুতু ফেলে নিজের মনেই কথা বলতে থাকল। সরি বলিনি তাকে, এক্সপেক্টই বা করি কীকরে! মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
যত লোক ভেতরে কামরায়, তত লোকই প্রায় প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, জটলা করে বা একান্তে মোবাইলে। স্টেশনের নাম লেখা কোনও বোর্ড নেই ধারে কাছে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে আধা ঘন্টার ওপর। কী-ব্যাপার? ভাবছি এস-ফোরের দিকে যাব কিনা। এর মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিলে যেকোনও কামরায় উঠে তো আর নিজের জায়গায় ফিরতে পারব না। আর প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে যে যাব, পুরো ভিড়টাই ক্রমাগত থুতু ফেলে চলেছে। আমারও ঘেন্না-ফেন্না হাওয়া হয়ে গেছে। অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করতে থাকলাম, এমন একটা মুহূর্ত গেল না, যখন আমি কাউকে-না-কাউকে 'থুক্তে' দেখলাম না। হতদরিদ্র একটা মুলুক সারা দিনে কয়েক কোটি টাকার শুধু থুতু ফেলে। ট্রেনের টিকিট কাটে না, কিন্তু স্যামসুং-এর মোবাইল রাখে। বেকায়দায় ভেজা বেড়াল হয়ে থাকতে পারে, কায়দামতো পেলেই 'মোগাম্বো'।
#
সে যাক, তবে এই ঘিন ঘিনে কার্যকলাপটা আমায় আগেও ভাবিয়েছে। এত কেন থুতু ফেলা? এত থুতু আসেই বা কোত্থেকে? নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, ঘুম থেকে ওঠার পর যদি কোনো কারণে দৈবাৎ দাঁত মাজতে-মুখ ধুতে দেরি হয় তবে অনবরত থুতু ফেলতে ইচ্ছা করে। মুখের ভেতরটা থেকে সমস্ত ভেতরটাই অস্বস্তিকর রকমের #ফিলিং নোংরা (এখানে একটা লাগসই ইমোজি দিতে হত)। আমার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি, বাইরে, রাস্তা-ঘাটে পড়ে থাকা আবর্জনা, দুর্গন্ধ, জঞ্জাল দেখলেও থুতু ফেলার তাগিদ জাগে না, অনেকেরই যেমন হয়, তবে নিজের মধ্যে জঞ্জাল থাকলেই ওরকমটা হয়। তাই আমার মতো করেই যদি ভাবি, এই যে গাদা গাদা পৌনপুণিকের মতো পৃথক চেহারাহীন মানুষগুলো, এরাও কি নিজেদের ভেতরের ময়লাই বিরামহীন উগরিয়ে চলেছে নিজেদেরই চারপাশে --- যন্ত্রের অভ্যাসে!
সত্যি বলছি, হাত অবশ হয়ে আসছে, এ-লেখা তো তারা কেউ পড়বে না! কোনও লেখাই তারা আদৌ পড়েছে কিনা কে-জানে! ছোটবেলার সাধারণ জ্ঞানের বইতেও তো লেখা ছিল, 'মলিন পোশাক বোঝায় তোমার অভাব, কিন্তু অপরিষ্কার পোশাক বোঝায় তোমার স্বভাব'। মলিন পোশাক যে কারোর গায়েই ছিল না এমনটা নয়, তবে চটকদার পোশাকের প্রদর্শনও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সর্বস্ব নোংরা, আদতেই নোংরা!
#
দুই কামরার ফাঁকে, বেশরমের মতো লুঙ্গি উঠিয়ে এক ষাটোর্ধ প্রৌঢ় বসে পড়ল উবু হয়ে, প্ল্যাটফর্মেই...আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কামরার সিঁড়িতে পা ও হাতলে হাত রেখে নিজেকে ভেতরে নিয়ে ফেললাম কামরার। কানে এলো বিশ্রী ভাবে গয়ের তোলার শব্দ, আমি ব্রেনের তার কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ফোন করলাম এস।ফোরে। মোবাইলের ব্যাটারির যা অবস্থা এই মুহূর্তে চার্জ না-দিলেই নয়। কিন্তু ওই একটাই পয়েন্ট, খালি পাওয়া যাচ্ছে না। মেনে নিতে হবে, কিচ্ছু করার নেই, এটাই আমার দেশ। আমি কাল রাতে ওদের আমার থেকে একরত্তি ছেড়ে দিই নি, আজ পেতে চাইব কোন্ মুখে?
#
জানা গেল, শ্রীকাকুলামে মালগাড়ি উল্টেছে কাল রাতে। একদিকের লাইন বন্ধ। আরেকদিকের লাইন ধরে একটা একটা করে গাড়ি ছাড়া হচ্ছে। ট্রেন এখন লোকাল ট্রেন। প্রতিটি স্টেশনে দাঁড়াবে অবশ্যই...আর তা কতক্ষণের জন্য দাঁড়াবে ড্রাইভারও জানে না। এখন ঘড়িতে সাড়ে নটা বেজে গেছে। হিসেব মতো আমাদের ব্রহ্মপুর পৌঁছে যাওয়ার কথা। হোটেল থেকে গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই ড্রাইভারের কাছ থেকে খোঁজ পাচ্ছি ব্রহ্মপুরেও মেল ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। কথা প্রসঙ্গে ড্রাইভার জানতে চাইল আমরা কতদূর। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার পরেই ড্রাইভারকে কল্ করেছিলাম। পড়লাম ভারি ফ্যাসাদে। কেউই জানে না ব্রহ্মপুর আর কতদূর (কারও উৎসাহও নেই এ ব্যাপারে)। কোনোমতে একজনের থেকে (রেলের প্যান্ট্রিতে কাজ করে সম্ভবতঃ) জানতে পারলাম বালুগাঁও পেরোইনি এখনো। শিডিউল অনুযায়ী বালুগাঁও ব্রহ্মপুরের আগের স্টপ যেখানে ট্রেন পৌঁছানোর কথা ৮:২৩-এ। গতিক ভালো নয়। মোবাইল নিভু নিভু, তবু চার্জ দেওয়ার জায়গা পাচ্ছি না। দুটো পয়েন্ট সব সময় এন্গেজ। তাড়াতাড়ি ড্রাইভারের আর হোটেলের নাম্বার দুটো আরেকজনের ফোনেও সেভ্ করিয়ে নিলাম। মুখে মুখে আসন্ন ভোগান্তির খবর ছড়াল। দেখলাম আমাদের মতো যাদের আর ঘন্টা খানেকের জার্নি বাকি ছিল, তাদেরই ছটফটানি বেশি। ছোট বড় খানিক সবুজ খানিক পাথুরে টিলা, কোথাও দিঘি, কোথাও মাঠ, কোথাও ক্ষেত, কোথাও গ্রাম সহযোগে বাইরের প্রকৃতি মন-ভোলানো। তবু আর ভোলানো যাচ্ছে-না মন কিছুতেই। যারা প্রতিজ্ঞা করেছিল টং ছেড়ে নামবে না, তারাও অবস্থা বেগতিক দেখে, একে একে নেমে এসে টয়লেটে গেল। আমিও ভাবছি একবার এস-ফোরে ফোন করব...ঠিক তখনই স্লো হয়ে এলো গাড়ি, আরো একটা নেড়া স্টেশন, আবার অপেক্ষা শুরু। প্রতিবারই আগের বারের তুলনায় প্রতীক্ষার সময় বাড়ছে।
নেমে পড়লাম আবার।
নেমে পড়লাম সেই অন্য এক ভারতবর্ষের মাঝখানে। আমি যতই নিজেকে মনে মনে এই ভিড়ের মধ্যে স্থাপন করছি, ততই ভিড় আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাকে বাধ্য করছে তাকে দূর থেকে দেখতে। হয়তো অন্যত্র আমিও এমনই কোনো ভিড়ের অংশমাত্র। আমিও সেখানে বাধ্য-বাধকতার জাতাকলে নির্নিমেষ পিষে এলাম ইঁহাতক! কিন্তু আপাতত স্থৈর্য হারিয়েছি। ফলতঃ তিল মাত্র বিচ্যুতিও তাল হয়ে মাথায় ভাঙ্গছে। অথচ ঘটমান বর্তমান কিন্তু অকল্পনীয় কিছু নয়। আর আমিও কোনো অবুঝ শিশু নই। ভিড়ের দিকে তাকাই, দিব্যি আছে সবাই। এমনকি সত্যিকারের শিশুরাও কি অবিচল!
#
(আমিই খামোখা মনে মনে আউড়ে যাই মাথা-মুন্ডু কি-সব!)
মনে হতে থাকে এই মানুষগুলোর রোজকার জীবন-চর্যা কতখানি নরকগ্রস্ত যে এরূপ ভোগান্তিময় কালক্ষেপণেও কত সাবলীল। এই ভারতবর্ষটা গাদাগাদি করে ভারতীয় রেলের সেকেন্ড ক্লাস স্লিপারের মেঝেতে, সিঁড়িতে, টয়লেটের সামনে বসে সফর করার মতো করে জিন্দেগি গুজরান করে চলেছে আবহমান পরম্পরায়!
#
কী অহেতুক রেগে যাই। ভিড় তোয়াক্কা না করে এস-ফোরের দিকে হাঁটতে থাকি। জটলা ছায়ার মতো সরে সরে রাস্তা দিতে থাকে। আমার আরও মনে হয়, এরা কেউ বেঁচে নেই। এদের মধ্যে দিয়ে কিছু ক্রাইসিস বেঁচে আছে শুধু। সেগুলো রাখা হয়েছে বাঁচিয়ে, যুগ যুগ ধরে খুব যত্ন করে।
দুইবেলা পেট ভরে দু'মুঠো সংসারের পেটে --- শুধু এইটুকু আয়োজনে দিন-রাত নাস্তানাবুদ বিশাল এক ভারতবর্ষের। আর কিচ্ছু ভাববে না। কিচ্ছু না।
না ক্রোধ, না জ্ঞান, না সাহস, না চিৎকার, আর না চেতনা। ভেন্টিলেশন পয়েন্টগুলো হল যৌনতা, কলহ, ভোট, মেগা-সিরিয়াল আর থুতু ফেলা --- নিছক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া সকল, এক অমোঘ অভ্যাস।
#
এস-ফোরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি অবসন্ন, খানিক চিন্তিত দুজনেই। কথা খুব একটা হচ্ছে না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। প্ল্যাটফর্মের চাতাল থেকে ডানহাতে নামলেই জমি কিছুটা ঝোপ-ঝাড় ঘাড়ে করে সামান্যই খাঁড়াই হয়ে আবার চ্যাটালো। ঐ চ্যাটালো অংশেই পাতা আছে পিচ বাঁধানো মসৃণ হাইওয়ে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ১০০/১৫০ মিটার হবে। শুনশান বলা চলে। রাস্তাটা পার হয়েই জমির এমন খামখেয়াল, সটান উঠে গেছে ওপর দিকে ওপাশের সীমানা আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়েছে! আমরা সচকিত হয়ে তাই দেখছি... ভারি মিষ্টি নরম সবুজ ঢাকা এক পাহাড়, কোলের কাছে পিচ-বাঁধানো রাস্তা নিয়ে বসে আছে। পাহাড়ের ছাতায় বিছানো আকাশের নীল যেন দ্রব হয়ে আছে, দিগন্তে পৌঁছনো গেলেই আজলা আজলা মিলতে পারে, তারপর খাও, গায় মাখো তোমার মর্জি, কিন্তু দিগন্তে পৌঁছাও আগে... দেখি!
চোখের সামনে দিয়ে দেশলাইয়ের বাক্সের মতো ধবধবে মারুতি চলে যায়, আমরা এ-ওর মুখ চাওয়া-চায়ি করি, 'তবে কি মালপত্র নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াব, যদি কোনও ব্যবস্থা করা যায়!' চিত্রার্পিত সিনারি এখন বক্ওয়াস্! ট্রেনের বিকট গম্ভীর হর্ন বেজে উঠল। মনে হল এর থেকে শ্রুতিমধুর আর কোনো নাদ ধ্বনিত হয়নি আজও ত্রিলোকে। এস-নাইনের দিকে ছুট লাগালাম। ছায়া-ভিড় চুম্বকের টানে আলপিনের মতো সেধিয়ে যাচ্ছে কামরায় কামরায়, আর যেতে যেতে আরো আরো স্পষ্ট করে দেগে দিয়ে যাচ্ছে স্টেশন চত্তর, 'মনে রেখো... আবার আসব... বিদায়... থুঃ থুঃ ত্থুঃ...'
#
এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। বার কয়েক ফোনে কথা হয়ে গেছে ড্রাইভারের সঙ্গে। তিনি এখনও অপেক্ষায়, ব্রহ্মপুরে। এখন যে একফালি নিতান্ত স্টেশনমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ওয়ান ফাইভ টু টু এইট, মজফ্ফরপুর – ইয়স্য়ন্থপুর এক্সপ্রেস, তার বাঁপাশের লাইন জুড়ে এক ধুম্সো মালগাড়ি এপাশটা আরো দমবন্ধ করে তুলেছে। ট্রেন থামা মাত্রই আমি নেমে এস।ফোরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। জানি হুট করে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কোনো চান্স নেই।
স্টেশনটির নাম ছত্রপুর। বন্ধুটির স্মার্ট ফোনে গুগ্ল ম্যাপ দেখিয়ে দিল এখান থেকে ব্রহ্মপুর দু'কিলোমিটার। এটা খুব একটা ভরসাযোগ্য তথ্য নয় তবে এটুকু ঠিক যে আর অল্পই দূরত্ব বাকি। বন্ধু আমার বুদ্ধি দিল, "ড্রাইভারকে বলে দেখি না..." তৎক্ষণাৎ ফোন এবং ড্রাইভার আশ্বাস দিলেন, "আপ লোগ স্টেশনকে বাহার টিকিট কাউন্টারকে সাম্নে ওয়েট কিজিয়ে, ম্যায় গাড়ি লেকে আতা হু।" মনে হল নাচি, এই ট্রেনটার ছাদে উঠে নাচি।
দুদ্দাড় বেগে কামরার ভেতর প্রবেশ করলাম। সেই সাইড লোয়ারের বেনাম বাদশাহ্ তাড়াতাড়ি আমায় চার্জার প্লাগপয়েন্ট খালি করে দিল। এখন আর প্রয়োজন নেই তার। তাকে হৃদয় থেকে শুক্রিয়া জানিয়ে, হুড়মুড় হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম আমরা তিনজন প্ল্যাটফর্মে। ঘাড় ঘুরিয়ে না দেখেও দিব্যি বুঝতে পারলাম আরো দ্রুত গতিতে শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেল।
আমাদের তখন পায় কে! যেন 'এলো সময় রাজার মতো...'। চারমূর্তিতে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত নিরুদ্দিষ্ট ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে চলেছি স্থির লক্ষ্যে, আর ভিড়ের প্রতিজোড়া চোখ তাকিয়ে আমাদের দিকে। আমরা যেন নিছক হোঁচট খেতে খেতে চলা একটা সফরকে পিছনে ফেলে রেখে বেরিয়ে আসছিলাম না শুধু, আমরা বেরিয়ে আসছিলাম ঘুষঘুষে এক অচলায়তন সিস্টেম ছিঁড়ে। সবচেয়ে আনন্দের হয়ে উঠেছিল এই অনুভূতি যে শুধু অসহায় সমর্পণ নয়, মুখের মতো জবাব আছে দেওয়ার মত। সবটা মেনে নিলুম না। সবটা মানিয়ে নিতে পারলাম না।
জানি, নেহাত বালখিল্য মনে হতে পারে, তবু... ... আসলে নিয়ত, সর্বথা আষ্টে-পৃষ্ঠে জর্জরিত থাকতে থাকতে, আর সিস্টেমের সামনে অসহায় থাকতে থাকতে, ওই নগন্যটুকু 'কুছ-পরোয়া-নেহি'ও আমাদের অনেক আলাদা করে দিল ভিড়ের থেকে। দৃশ্যতই আমাদের চারজনের মুখগুলো ঝলমল করছিল। হেঁটে চলেছিলাম, যেন পরাজিত সন্ত্রস্ত সেনাদের মধ্যে দিয়ে চলেছে চার গ্ল্যাডিয়েটর!
ওভার ব্রিজের ওপর থেকে ছত্রপুর স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চল যা চোখে পড়ল, মন বলল, 'এখানেই থেকে যাও, আর কোথায় যাবে? কেনই বা যাবে?' এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে সিঁড়িটা স্টেশনের বাইরের হাতায় নেমেছে। স্টেশন সংলগ্ন অনেক কিছু আছে। অটো স্ট্যান্ড, বজরংবলীর মন্দির, মাঝারি এক অশ্বত্থ গাছের তলায় বাঁধানো বেদীতে কোনো এক দেবা বা দেবীর থান, সরু নদীর মতো নাজুক বাঁক নেওয়া পিচের রাস্তা দিগন্তে মিলিয়ে যায়, তার পাশ ধরে গোটা কয়েক চা-পান-বিড়ি-এটা-ওটার দোকান এবং তার পরেও ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এসব শুনে যদি ভেবে বসেন যে আমরা সেই তো আবার আরেক ঘিঞ্জির মধ্যে এসে পড়লাম, তাহলে এক্কেবারে বিচ্ছিরি মিস্টেক করে ফেলবেন। আমি কিছুটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। ধরে নিন ওভার ব্রিজের পর থেকে স্টেশনের বাইরেটা বেশ... বেশ ছড়ানো একটা মাঠ --- লালচে ধুলোর মাঠ। আর ওপরের ওই সমস্ত এটা-সেটা ছড়ানো ছিটানো, অনেকটা করে জায়গা নিয়ে নিয়ে, যে যার মতো ওই মাঠটির আনাচে কানাচে রয়েছে। কেউ কারও ঘাড়ের ওপর নেই। কোনও গাদাগাদি নেই, কোনও তাড়াহুড়া নেই। সার সার অটো কিন্তু কেউ এসে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকল না যে কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন, কারণতো সবাই জানে, ওখান থেকে কোথাও তো আর যাওয়ার নেই।
একা বজরংবলীই দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় দেড়তলা উঁচু। তাঁর উল্টো দিকে অশ্বত্থর শান-বাঁধানো বেদীতে পিঠের বোঝা নামিয়ে রাখলাম। দেখতে পাচ্ছি দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির ফাঁক দিয়ে, ট্রেন তখনও ছাড়েনি। ওদিকে তাকিয়েই ক্লান্ত শরীরেও এমন টগবগানি স্ফুর্তি জাগল, মনে হল এই পাতলা ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়েনি খানিক! জোর গলায় হাঁক পারলুম 'চা খাব'।
চা-খাওয়া হয়েছিল। আরও কিছু খেয়েছিলাম, মনে নেই। ছত্রপুর থেকে ট্রেন যখন আমাদের ফেলে আবার চলা শুরু করে 'তিব্বতের' পথে, আমরা সানন্দে টা-টা করতে থাকি। চুপচাপ জায়গাটার নিঝুম কয়েকটা মানুষ আমাদের দেখতে থাকে অপলক। অবাক হয় কিনা বোঝা যায় না। গাড়িও এসে গিয়েছিল আধাঘন্টার মধ্যে। তারপর তারিফ করার মতো চকচকে নিটোল নিগাড্ডা রাস্তা দিয়ে গাড়ি আমাদের নিয়ে চলল গোপালপুর-অন-সী।
(তারপর গোপালপুরের গল্প নতুন করে কী-আর বলব)
আমরা কিন্তু আবার গোপালপুর যাব। এবার আমাদের ট্রেন আর হয়তো ছত্রপুর নামের অজস্টেশনটায় থামবে না। আমরা কয়জন তবু বার বার খোঁজ নেব, 'ছত্রপুর কি পেরিয়ে গেল?' জানলা দিয়ে উদ্গ্রীব হয়ে দেখতে থাকব, খুঁজতে থাকব, দূর থেকে কোনো বীর হনুমান দেখা যায় কিনা, দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দেড়তলা। কম্পার্টমেন্টের আর কেউ বুঝতেই পারবে না কেন এই কয়জন নেহাতই নিরালা এক চিলতে ভূমিখণ্ডের দিকে আঙুল তুলে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, "ওই যে ছত্রপুর, ওই যে ছত্রপুর।"
আর যদি সেদিনও পাশের লাইনে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে মালগাড়ি...
#
এমন ভাবি-না-কেন, সেদিনও কোনও কারণে লাইন ক্লিয়ারের সিগনাল্ না পেয়ে আমাদের ট্রেনটা এসে ছত্রপুরে দাঁড়াল...
একশ শতাংশ ঠিক ধরেছেন, দোতলার সমান বজরংবলীর দিব্যি, আমরা আবার নেমে পড়ব হুড়মুড় হুড়মুড় করে। আবার ওই অশ্বত্থতলায় মালপত্র রেখে চায়ের অর্ডার দিতে যাব। জানিনা, চিৎকারও করতে পারি... আমাদের জীবনের যে কয়েকটা মুহূর্ত ওইখানটায় রেখে এসেছি, সেই সময়টুকুতে অনেকটা জীবন ধরা রইল। ছত্রপুর স্টেশন-চত্ত্বর কোনো হলিডে ডেস্টিনেশন নয়। কেউ যাবেন না। আমরাও আর কোনওদিন যাব কিনা সন্দেহ। অথচ ভাবলেই ভালো লাগছে, ট্রেন থেমে রয়েছে ছত্রপুরে, আমরা নেমে পড়েছি, আর ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিচ্ছি, 'ছত্রপুর আ-যাইয়ে প্লিজ'!
কাঞ্চন সেনগুপ্তের ছেলেবেলা কেটেছে ইস্পাত নগরী দুর্গাপুরে। কর্মসূত্রে কলকাতায়। ২০০০ সাল থেকে বেসরকারি কনস্ট্রাকশন ফার্ম সিমপ্লেক্সের সঙ্গে যুক্ত। ভালো লাগে লেখালেখি, ছবি তোলা, বেড়ানো। আবার কখনওবা সময় কেটে যায় ছবি আঁকায় বা টুকিটাকি হাতের কাজে।