বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
দেবভূমির পবিত্রতায়
অয়ন দাস
~ কিন্নরের আরও ছবি ~
মাথায় হাত ছোঁয়ালেই সে ভস্ম হয়ে যাবে - কঠোর তপস্যার শেষে এই বর পেয়ে ভস্মাসুর পার্বতীকে পাওয়ার লোভে প্রথমে শিবের ওপরেই তা প্রয়োগ করতে গেল। ভস্মাসুরের হাত থেকে বাঁচতে শিব পালাতে পালাতে অবশেষে বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু নারী মূর্তি ধারণ করে কৌশলে অসুরকে নিজের মাথাতেই হাত ছোঁয়াতে বাধ্য করলে মারা পড়ল সে। ভস্মাসুরের হাত থেকে বাঁচতে শিব এই পর্বতে এসে বিষ্ণুর ধ্যান করেন। তাই এই পর্বতের নাম দেবভূমি যা কিন্নর কৈলাস নামে বেশি পরিচিত।
জুন মাসের এক সোনালি সকালে চলেছি সাংলার উদ্দেশ্যে। শিমলা থেকে সাংলার দুরত্ব ৯০ কিমি। ২২নং জাতীয় সড়ক ধরে যেতে যেতে ভারতীয় সেনাদের মনে মনে কুর্নিশ করতেই হয় পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করার এই অসাধ্য সাধনের জন্য। পথের দুপাশের দৃশ্য যেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা অপূর্ব নিসর্গের ছবি। রাজেন্দ্রানীর মত যেন নিজের শরীরকে এলিয়ে দিয়েছে পাহাড়ি রাস্তা। দুপাশে পাইন,ফার,দেবদারু সহ অজস্র চিরহরিৎ বৃক্ষ। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ পাহাড়কে যেন মায়ের মত আগলে রেখেছে ঘন নীল আকাশ। যেতে যেতে চোখে পড়ল শতদ্রু নদীকে কেন্দ্র করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। শতদ্রু সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৫৮৯ মিটার উচ্চতায় ১৩০ কিমি পথ দিয়ে বয়ে চলেছে।
করছামে যখন পৌঁছলাম তখন পশ্চিমাকাশে রঙের পাগলাঘোড়া ছুটে চলেছে। সন্ধে হয় অনেক দেরিতে। রাস্তাঘাট বেশ বন্ধুর। পথ যেন আর শেষই হয়না, চলেছি তো চলেছি। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল দিন। নির্জন গা ছমছমে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে তখনও এগিয়ে চলেছি। অবশেষে পৌঁছলাম সাংলা। কিন্তু হোটেলে ঢুকেই সারাদিনের ক্লান্তি কেটে গেল। একেবারেই ফাঁকা। ম্যানেজার থেকে কর্মচারী সকলেই বাঙালি। রিফ্রেস হয়ে বসতেই আমাদের হাতে গরম গরম পকোড়া আর কফির মাগ তুলে দিলেন।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি আমার জানলায় এসে হাজির হয়েছে বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়। বরফের মাথায় দিনের প্রথম গোলাপি আলো এসে পড়ে এক অদ্ভুত পবিত্রতার সৃষ্টি করেছে। আর সমস্ত পাহাড় জোড়া ঘন নীল আকাশ তাকে সাদরে বরণ করছে। এক অপরিসীম আনন্দে সমস্ত শরীর-মন ভরে উঠল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই অনন্তযৌবনার দিকে।
হোটেলের পাশেই রয়েছে বসপা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ৯৫ কিমি লম্বা ও ২৫ কিমি চওড়া খরস্রোতা বসপা নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি চালু হয়েছে ২০০৯ সালে।
সাংলা থেকে একঘন্টার রাস্তা ছিটকুল। ছিটকুলই হল তীব্বত সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রাম। ৩৪৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামে বাস করেন মাত্র ছশো মানুষ। এই অঞ্চলটি ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সেইসময় পুরো এলাকাটি ৫ ফুট বরফের তলায় চাপা পড়ে যায় এবং তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে।
মেঘরঙ আলোয় এক স্বপ্নের মত পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চললাম। উপত্যকায় চরে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল আর তাদের পাহারা দিচ্ছে একটি বড়সড় চেহারার লোমশ পাহাড়ি কুকুর।
নয়নাভিরাম ছিটকুলে যেন ছবির মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বৌদ্ধ গুম্ফা। দরজা এবং ছাদে কাঠের অপূর্ব কারুকার্য। মহান কোনও শিল্পী ছাড়া এমন কাজ অসম্ভব!
অনেক নীচে কিশোরীর মত প্রবল উৎসাহে বয়ে চলেছে চিরসবুজ বসপা নদী। মাথার ওপরে ঘন নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। সমস্ত ছিটকুলকে পিতার মত আগলে রেখেছে বরফে ঢাকা হিমালয় পর্বতমালা। ঠিক যেন এক একজন ধ্যানমগ্ন ঋষি। বসপা নদীর বয়ে চলার সুরেলা গান ছাড়া এখানে আর কোনও শব্দ নেই। অসম্ভব পবিত্র আর শান্তির এই পরিবেশে শরীর-মনে বড় আরাম লাগতে লাগল। পাথরের ওপর শুয়ে পড়ে বরফ ঠান্ডা বসপাকে আদর করতে লাগলাম।
ছিটকুল থেকে তিন ঘন্টার পথ কল্পা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৭৫৯ মিটার উচ্চতায়। সমগ্র কল্পা জুড়ে ধ্যানমগ্ন যোগীর মত বিরাজ করছে কিন্নর কৈলাশ পিক (৬৫০০মিটার), ফাওয়ারাং পিক (৬৩৪৯মিটার), জোর কাডেন পিক (৬৪৭৪ মিটার) এবং সারা পিক (৬০৮০মিটার)। কিন্নর কৈলাস পিকের ওপর রয়েছে ২০০০০ ফুট উচ্চতায় ৭৯ ফুট লম্বা এক পাথরখণ্ড যা দেখতে অনেকটা শিবলিঙ্গের মত - প্রকৃতির এক বিস্ময়। কথিত আছে ওইখানে বসেই নাকি ধ্যান করেছিলেন দেবাদিদেব। গ্রীষ্মকালে প্রতিবছর পুণ্যার্থীরা আসেন শিবলিঙ্গ পরিক্রমায়। ঝকঝকে সোনাঝরা রোদ পড়ে সেই শ্বেতশুভ্র পাহাড় শ্রেণীগুলি যেন হীরকখন্ডের মত দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে।
আপেল বাগানের মধ্যে বসে রূপসী কিন্নরের সেই অপার বিস্ময়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ি। অপরূপ এই স্থানে বিরাজ করছে এক অপার শান্তি। আমার শহুরে মন থেকে স্বার্থপরতা, কলুষতা, নীচতা জীর্ণ পাতার মত যেন ঝরে যায়। মনে হতে থাকে যেন রক্তমাংসের পৃথিবীতে নয়, আমি রয়েছি কোনো এক পবিত্র দেবভূমিতে।
~ কিন্নরের আরও ছবি ~
পেশায় চাকুরে অয়ন দাসের নেশা লেখা। তাঁর মনে হয় একজন ভ্রমণ লেখকের মূল কাজই হল মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া - ঘরে বসেও যাতে সে বেড়ানোর আনন্দ পায়। প্রকাশিত বই –'দুপায়ে দুনিয়া'।