ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি
ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র - লাদাখ পর্ব
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
~ লাদাখের আরও ছবি ~
প্রথম পত্র
বন্ধুবর,
অপার্থিব কিছু পাওয়ার জন্য ভয়াবহ এক পার্থিব দৌড়ের গল্প দিয়েই আমার এই পত্রাঘাত শুরু করি। লাদাখ জায়গাটা তো এমনিতেই শহুরে আমাদের চেনাজানা দুনিয়ার বাইরে, তার ওপরে আমার ভোদাফোনের টাওয়ার অর্থাৎ বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না, কাজেই অপার্থিব ভাবাটা ঠেকাচ্ছে কে? মাঝে মাঝে হোটেলে অবশ্য ফ্রি ওয়াই-ফাই পেয়ে ছিলাম, ওই যাকে বলে বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ...!
যাকগে যা বলছিলাম, ১২ অক্টোবর, ২০১৫ ভোর তিনটেয় উঠে তৈরি হয়ে জে এন ইউ-এর গেস্টহাউস থেকে দিল্লি এয়ারপোর্টের দিকে রওনা গাড়িতে। পৌঁছে বিস্তর চেকিং-এর হ্যাপা শেষ করে সবে টয়লেট থেকে বেরিয়েছি, ওমা শুনি এয়ার ইন্ডিয়ার থেকে ফোন করে জানতে চেয়েছে আমরা কোথায়! তখনও প্রায় আধ ঘন্টা বাকি। দেখি আমরা আছি তিরিশ নম্বর টার্মিনালের কাছে আর প্লেন ছাড়বে ষাট নম্বর থেকে। বোঝো ঠেলা! সিকিওরিটি চেকের সময় বু আর বুই দুজনেরই ভারী ভারী জুতো খুলিয়ে ছেড়েছে, বাব্বা বাব্বা, জুতোর ফিতে বাঁধার সময়টুকু তো দেবে! মালপত্র নিয়ে দৌড় দৌড় দৌড়। ওই যে, প্লেন ধরা সহজ নয়। সবার আগে দীপ আর সৌম্য। দীপের মোবাইলে মাঝে মাঝেই এয়ার ইণ্ডিয়ার তরফ থেকে মালপত্র নামিয়ে দেওয়ার হুমকি আসছে। যাই হোক, আমি আর মেয়ে কোথাও দাঁড়াইনা, এমনকী চলমান পথের থুড়ি এসকালেটরের ওপর দিয়েও দৌড়াই প্রাণপণে। লড়ঝড়ে শরীরে ব্যথা জানান দেয় এদিকে সেদিকে, সে ভাবার সময় নেই ৩৫-৩৬...৪২-৪৪...৫৬-৫৮...ওই এসে গেল প্রায়..৫৯-৬০...উফফফফ..., বুই আর আমি পৌঁছেও যাই হাঁপাতে হাঁপাতে। চিন্তা শুধু বীরেনকে নিয়েই। বুকে যন্ত্র বসানো, ওর না আবার শরীর খারাপ করে। শুনি দীপ আর সৌম্যের সঙ্গে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারের লোকজনের হিন্দিতে গরমাগরম বাতচিত চলছে। আমিও লালমোহনীয় হিন্দিতে যোগ দিই। আরে, আপনারা যখন ফোন করেছেন, তখন তো আমরা এদিকেই আসছিলাম, কে জানত দিল্লি এয়ারপোর্ট এত লম্বা! আর আমাদের সঙ্গে একজনের বুকে পেসমেকার বসানো আছে, কতটা তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব? ওরাও হুমকি দেয় আপনাদের জেনে রাখা উচিত ছিল, এখনই বাকীরা না পৌঁছালে মালপত্র সব নামিয়ে দেব। যদিও কুড়ি মিনিট আগেই গেট বন্ধ হওয়ার কথা, কিন্তু প্লেন ছেড়ে যাওয়ার তো তখনও দশ মিনিটের বেশি বাকী রয়েছে। এ যেন আমাদের শঙ্করীদি, বৌদি তাড়াতাড়ি বল কী রান্না হবে, হুড়মুড়িয়ে রান্না করে সময়ের আগে সব্বাইকে খাইয়ে দিয়ে বাসনটা মেজে ফেললেই ব্যস, কাম ফতে।
যাইহোক, দূরে বীরেন, টুসি আর বু-কেও দেখা যায়। আমরা উৎসাহিত গলায় বলি, ওই তো এসেই গেছে, কাউন্টারের লোকদুটিও গজগজ করতে করতে ক্ষান্ত দেয়। পৌঁছে বীরেন হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আমি তো ভাবলাম আর ধরতেই পারব না। প্রায় হয় প্লেন নয় প্রাণ গোছের অবস্থা আর কী। দীপ আশ্বাস দেয়, আরে এখনও প্লেন ছেড়ে দেওয়ার টাইম তো হয়নি, আমাদের কাছে টিকিট আছে, উঠতে দেবে না মানে? আমাদের লাগেজ খুঁজে পেতে নামাতে আরও দশ মিনিট তো লেগেই যেত, আর ইতিমধ্যে আমরা উঠে পড়লে আবার লাগেজও ওদের ওঠাতেই হতো। অতএব...। যাইহোক আমরাও টপাটপ প্লেনে চড়ে বসি আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্লেন রানওয়ে দিয়ে গড়াতে শুরু করে।
দাঁড়াও, আগের কথা আগে সেরে নিই, তোমাকে তো বলেইছিলাম যে, অনেকদিন ধরেই আমাদের লাদাখ বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছিল, মানে চলেই যাচ্ছিল। যেবারে প্রায় সব ঠিকঠাক, তখনই বীরেনের বুকে পেসমেকার ধরণের যন্ত্রটা বসল আর তাই প্ল্যান থমকে গিয়েছিল। মুশকিল হচ্ছে, ইদানীং বীরেনের বক্তব্য, যন্ত্র দিয়ে আর কতদিন চলবে, তাই নাকি ওর হয়তো আর লাদাখ দেখা হবে না। অতএব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেটলে সব ফাইনাল করা হল। বেশি হাঁটাহাঁটি বা সিঁড়ি ভাঙা চলবে না, নিজের শরীর বুঝে বাকিটা। ওদিকে যাওয়ার দিন যত কাছে আসে আমার নিজের শরীরগতিক ততো খারাপ হতে থাকে। কিন্তু না, ক্যানসেল করলে বীরেন ভারী কষ্ট পাবে। নিজেকে তাই বলি, ওঠো হে।
তা উঠেই পড়ি অক্টোবরের দশ তারিখ বিকেল চারটে নাগাদ রাজধানী এক্সপ্রেসে। সেই কোন ছোটবেলায় আনন্দমেলায় সমরেশ বসুর লেখা গোগোলের অ্যাডভেঞ্চার 'রাজধানী এক্সপ্রেসের হত্যারহস্য' পড়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে চাপবার সখ হয়েছিল, তা এ্যাদ্দিনে পূরণ হল। ভাগ্যিস, দীপের এল টি সি ছিল, আরও ভাগ্যিস, আমি মনে মনে বড় থুড়ি হোৎকা হয়ে যাইনি, তাই ছোটবেলার মতোই মজা পেলাম। ট্রেনে ডায়েরি লিখিনি, চলমান জানলার পাশে বসে স্রেফ খান দুয়েক কবিতা।
দিল্লি পৌঁছে গাড়ি ভাড়া করে জে এন ইউ-এর দিকে রওনা। ওখানকার গেস্টহাউসে আমাদের জন্য ঘর বুক করে রেখেছিল আমার হস্টেলের বন্ধু পালু, অর্থাৎ শর্মিষ্ঠা পাল। এই প্রথম স্যুইটে থাকলাম সেও এক ছেলেমানুষি মজা আর কুড়ি বছর পর আরও এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা সেও দারুণ মজার।
আমাদের ঠাঁই হল আরাবল্লী ইন্টারন্যাশনাল গেস্টহাউসে। অদূরে অন্য একটা বাড়ির একতলায় ডাইনিং হল – গেস্টরা তো বটেই, অনেক ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকেরাও খেতে আসেন। দুপুরের খাওয়ার পালা শেষ করতে না করতেই পালু, শোভন আর ওদের ছোট্ট ছেলে 'ধিঙ্গিপদ' ওরফে সৌরাংশু হাজির। ছোট বেগুন দিয়ে মাখোমাখো তরকারিটা দিব্যি হয়েছিল। দুপুরের গনগনে রোদের মধ্যেই ওদের সঙ্গে পার্থসারথি রকে গিয়ে ঘোরাঘুরি হল। সেখান থেকে নেমে ওরা কোয়ার্টারে ফিরে গেল, আমরা চললাম অটোতে চেপে কুতুব মিনার দর্শনে।
ইতিহাসের আনাচে-কানাচে ঘুরতে ঘুরতে মাথা আক্ষরিক অর্থেই ঝিমঝিম। সন্ধ্যাবেলায় পালুদের বাড়িতে স্ন্যাকসের নেমতন্ন, ও নানারকম খাবার বানাতে খুব ভালোবাসে। চন্দনদা বলে, চল স্নেক (স্ন্যাকস্-এর সংক্ষিপ্তকরণে) খেয়ে আসি। পালুর বাড়ি পৌঁছে মাথায় জল ঢালি হুড়মুড়িয়ে, তারপরে বিছানায় বেশ খানিকক্ষণ গড়াগড়ি দিই। তারপর ওর বানানো ফিস ফ্রাই আর দুরকমের কেক খেয়ে ক্রমশঃ চাঙ্গা হই। ওরই মধ্যে বীরেন টুসিকে বলে দারুণ এই ফিসফ্রাইটা বানানো শিখে নিতে, নিরামিষাশী চন্দনদা চুমকিকে পালং শাকের নিমকির রহস্য শিখে নিতে উৎসাহ দেয়। আর আমি বলি, এসবের থেকে এমন বন্ধু থাকাটাই ভালো নয় কি যে সবই বানাতে পারে, একটু কষ্ট করে শুধু তার ঠিকানায় পৌঁছে গেলেই হল। পেট প্রায় ভরাই, তাই রাতের খাওয়ার জন্য কেউ আর নড়তে রাজি হল না, শোভন, বীরেন আর দীপ গিয়ে কাছের ধাবার থেকে খাবার নিয়ে আসে। এত খাবার শেষও হয়না। খাওয়ার শেষে নিজের চারচাকায় দফায় দফায় আমাদের গেস্টহাউসে পৌঁছে দেয় শোভন। আসলে জে এন ইউ-এর চত্ত্বরটা এত বড় যে হেঁটে যাওয়ার জন্য অনেকটাই। ভারী ভালো লাগে সবুজ গাছে ছাওয়া বিস্তীর্ণ এলাকা। বুইকে বলি, ভালো করে পড়াশোনা কর, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পড়তে যদি আসতে পারিস। তবে বুইয়ের আকর্ষণ পড়াশোনা নয়, ধিঙ্গিপদ - মা ভাইটা কি মিষ্টি না? আমার প্রায় সতের বছরের মেয়ে বলে। ভাইয়ের সঙ্গে তার বড্ড ভাব হয়ে গেছে। ওদিকে জে এন ইউ ক্যাম্পাসে কুড়িয়ে পাওয়া ময়ূরীর পালক তার টুপিতে গোঁজা। সেটা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে কাড়াকাড়িও চলে রীতিমত।
এতো গেল আগের কথা। তারপরে তো ১২ তারিখ মহালয়ার ভোররাতে উঠে মোবাইলের স্পিকারে 'জাগল তোমার আলোর বেণু' শুনতে শুনতে এয়ারপোর্টে পৌঁছে শেষঅবধি রোক্কে রোক্কে বলে আমরা প্লেনে চেপে পড়লাম সদলবলে। সদলবলে মানে, আমরা তিনজন, তাছাড়া বীরেন, টুসি, বু আর সৌম্য - সবাই এক-একটা জানলার পাশে। চুমকি- চন্দনদার ফ্লাইট আলাদা – ছাড়তে এখনও খানিক দেরি আছে। দীপের এল টি সি-র কল্যাণেই আমার যা একটু-আধটু প্লেনে চড়া। প্লেনে উঠলেই নিজেকে কেমন বুড়ো আঙলার রিদয়ের মতো লাগে। সেই হাঁসের পিঠ থেকে দেখা খেলনার মতো ছোট্ট ছোট্ট বাড়িঘর, সবুজ চৌখুপি ক্ষেত, নদী আর রাস্তার দাগ। ওপর থেকে পৃথিবীটাই এত ছোট হয়ে যায় যে মনে হয়, মানুষ মিথ্যেই শুধু নিজেদের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি করে, পুরোটাই কী বিষম অর্থহীন। লাদাখ-কাশ্মীর বেড়ানোর সময় প্রায়ই এই কথাই মনে হয়েছে মিলিটারি সেনা আর সাধারণ মানুষদের জীবন দেখতে দেখতে।
মেঘেদের রাজ্যে রোদের ঝলক পেরিয়ে যেতেই চোখে পড়ে নীচে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে শ্বেতশুভ্র কারাকোরাম পর্বতমালা। কোনও পাহাড়ের মাথায় বরফের সাদা চাদর, কারোর বা মেঘের। মেঘ আর বরফ মিলেমিশে রোদ-ছায়ায় সে এক অপরূপ দৃশ্য। শুধুই মুগ্ধ হওয়া।
প্লেন থেকে নেমে লেহ্-এর লাউঞ্জেই আমরা গড়াগড়ি যাই। বাপরে কী ঘুম পাচ্ছে, ওদিকে এয়ারপোর্টের মাইক্রোফোনে ঘনঘন নানা সতর্কবাণী ঘোষণা হচ্ছে যারা আমাদের মত আচমকা সমতল থেকে উড়ে এই দশ হাজার ফিট ওপরে উঠে এসেছে অ্যাক্লামাটাইজেসন তাদের কি করা উচিত আর অনুচিত সে ব্যাপারে। বিভিন্ন জায়গায় লেখা রয়েছে প্রথমদিন দিনের বেলায় ঘুমাবেন না। কী জ্বালা! একটু ঘুমোতেও দেবে না ছাই। বসার সোফাতেই হাই তুলতে তুলতে গুটিসুটি হই শীতে আর ঝিমুনিতে। চন্দনদাদের প্লেন আরও কিছুক্ষণ পরে পৌঁছাবে, ফলে অপেক্ষা আর অ্যাক্লামাটাইজেসন দুটোই একসাথে হতে থাকে। চন্দনদারা পৌঁছালে এয়ারপোর্টের বাইরে পা রাখতেই লেহ্-এর রূক্ষ্ম সৌন্দর্য মুগ্ধ করে আমাদের। কিন্তু দেখি একটাও গাড়ি নাই। যে কটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল সবই আগে থেকে বুক করা, এরোপ্লেনের অন্য যাত্রীরা একফলে আবারও অপেক্ষা এবং নিজেদের পোঁটলাপুঁটলি হাতড়ে বিস্কুট, চিঁড়ে, ছোলা ভেজানো, কোল্ড ড্রিঙ্কস এসব খাওয়া। বাপরে কী ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমার তো প্লেনেই পাশের লোকটা না খেয়ে প্লেট ফেরত দিচ্ছে দেখে ওর খাবারটাই খেতে ইচ্ছে করছিল, নেহাত চক্ষুলজ্জার খাতির! তবে আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত যে যেরকম খিদে আর ঘুম পাচ্ছে তাতে আমরা নিশ্চয় অলরেডি অ্যাক্লেমাটাইজড।
অবশেষে গাড়ি পাওয়া গেল। আমাদের ড্রাইভারের নাম থুড়ি টাইটেল তুন্ডুপ। লেহ্-এর নেড়া পাহাড় আর লাল-সবুজ-হলুদ রঙিন গাছের রূপ দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে মূল বাজার চত্ত্বর পেরিয়ে ওল্ডফোর্ট রোডে পৌঁছাই। অক্টোবরের পাতা ঝরার সময় বলেই প্রকৃতির এত বিচিত্র রূপ। এবার হোটেলের সন্ধান করতে নামে দীপেরা। আর তুন্ডুপ গল্প জোড়ে আমার সঙ্গে - হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করে, আপনারা নমস্তে-কে কী বলেন? আমি বলি, নমস্কার। তুন্ডুপ হাসিমুখে বলে, নমস্কার, নমস্কার, জুল্লে জুল্লে। আমরাও বলি, জুল্লে। লাদাখে দিন কাটাতে কাটাতে ক্রমশঃ জানতে পারি, গুড মর্নিং, গুড ডে থেকে গুড বাই সবই ওদের কাছে, 'জুল্লে'। পথেঘাটে সব জায়গায় লেখা থাকে, 'জুল্লে' আর সর্বত্র চেনা-অচেনা লোকজনেরা দেখা হলে হাসিমুখে বলে ওঠেন, 'জুল্লে'। এই মায়াময় শব্দটা তাই বড় ভালো লেগে যায় আমার।
হোটেল ঠিক করে মালপত্তর তুলে ঘরে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে প্রায় দুপুর। হোটেল 'বিমলা', উচ্চারণ হবে বিম্লা। মালকিনের মেয়ের নামে। কেয়ারটেকার ধনগিরির সঙ্গে ক্রমশঃ আলাপ জমে ওঠে। ছেলেটি একেবারে বিভূতিভূষণের লেখা থেকে উঠে আসা একটি চরিত্র। এর কথা পরে লিখছি। তিনতলায় সিলিং অবধি কাচের জানালায় মোড়া চারটে ঘর। ঝলমলে দিন, ঘর থেকেই দেখা যায় একপাশে লেহ্ প্যালেস আর অন্যদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি স্তোক-কাংরি। হোটেলের বাগানে আপেল গাছে লাল-সবুজ আপেলের ভিড় নজর এড়ায় না কারোরই। ঢুকেই রিসেপশনের আগে বাইরে টেবিলের ওপরে রাখা একটু পোকায় কাটা কী দাগ লাগা বাতিল আপেল দিয়ে আমাদের আপেল খাওয়া শুরু হয়, তারপরে বীরেন হাত বাড়ায় গাছের দিকে। তবে আপেল পর্বও বিরাট, তাই ক্রমশঃ প্রকাশ্য। আপাতত এদিন বিশ্রাম, শরীরের সঙ্গে উচ্চতাকে মানিয়ে নেওয়া আর বেড়ানোর পরিকল্পনা ঠিকঠাক করে ফেলতে গাড়ির সঙ্গে দরাদরি। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ, লাদাখের সিজন শেষ, তাই হোটেল, গাড়ি আগে থেকে কিছুই ঠিক করে রাখা হয়নি, পৌঁছে যা কিছু করা যাবে, ভিড় তো নেই, এই ভরসায়।
আসল বেড়ানোর শুরু হবে পরদিন থেকে, আমার ডায়েরিরও। সন্ধ্যায় 'আমাদের ছুটি'-র সুবীরদার রেফারেন্সে যোগাযোগ হওয়া হাসানের সঙ্গেই কথা পাকা হয়, টেম্পো ট্র্যাভেলার - চৌদ্দ জনের সিটে আমরা ন'জন আর মালপত্তর। জানা যায় ড্রাইভার যে থাকবে তার নাম মানে টাইটেলও তুন্ডুপ!
এবারে ডায়েরির পাতায় চোখ বুলাই। বেশিটাই লিখেছি পথে, গাড়ির ঝাঁকুনি খেতে খেতে, তাই নিজের হাতের লেখা নিজের কাছেই দুর্বোধ্য এখন। উদ্ধারের একটা চেষ্টা করে দেখা যাক। এই ডায়েরি লেখার ঠেলায় এবারে একপাটি গ্লাভস হারিয়েছি। খোদ ডায়েরিটাও বার দুয়েক অন্ততঃ হারাতে হারাতে কান ঘেঁষে বেঁচে গেছে। আর আমার ঘড়ির ব্যান্ড লুজ হয়ে যাওয়ায় পরের দিকে কটা বাজে বলে সব্বাইকে বিস্তর জ্বালিয়েছি। চন্দনদাই বোধহয় মন্তব্যটা করেছিল, তুমি তো দেখছি প্রফেসর শঙ্কুর মতো ডায়েরি লিখছ। অনেকসময় কেবল নোট রেখেছি, সেগুলোও ঠিকঠাক করে দাঁড় করাতে হবে। তবে দীপ আমার লেখার পরিমাণ দেখে বলেছে, এই যা লিখেছ, এটাই তো ঢের হয়ে গেছে। সে যাইহোক...
১৩/১০/২০১৫
বেলা সোয়া ১১টা। সিন্ধুঘাট অথবা সিন্ধুদর্শন সাইট
একদিকে মাটি-পাথরের পাহাড়ের দেওয়াল আর অন্যদিকে দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের চূড়া। সবুজে, হলুদে, লালে ঝলমলে গাছের সারি। বিন্দুসম সিন্ধু বয়ে চলেছে। আগে আরও খানিক ভেতরে যাওয়া যেত, দীপ দেখায়, এখন ব্রিজ ভেঙে গেছে। একটু দূরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে বিশাল পোঁটলা কাঁধে এক বাবা নামে, সঙ্গে দুই মিষ্টি মেয়ে নিজেদের থেকে বড় ব্যাগ দুহাতে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পাথর পেরোয়। আরেক মিষ্টি বাচ্চা কোলে নিয়ে এবার মা গাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায়। আরও একজন পুরুষ রয়েছে, সেও বেরিয়ে আসে। আমি বাচ্চাটাকে দেখেই ভারী খুশি হয়ে আদর করি। ওদিকে বাবা আর মেয়েরা জল পেরিয়ে একটা বড় পাথরের ওপর কাপড়ের বোঝাগুলো নামিয়ে রাখে। কাচবে কি? দেখা বা জানা হয়না, তুন্ডুপ ভাইয়া তাড়া লাগায়, আমরাও গাড়িতে উঠে বসি।
এরপর গন্তব্য ড্রুক হোয়াইট লোটাস স্কুল - আমির খান অভিনীত 'থ্রি ইডিয়টস' খ্যাত র্যাঞ্চোর স্কুল। আমি নামি না। এই একা নিস্তব্ধতায় বসে থাকতেও ভালো লাগছে। ঘুম পাচ্ছে বরফ পাহাড়ের মাথায় রোদ ঝলসানো দেখতে দেখতে। শরীরটা বেশ খারাপই লাগছে। রবি ঠাকুরের কবিতার একটা লাইন মাথার মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে - যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।
বেশ চড়চড়ে রোদ্দুর। অন্যদের কাছে অস্বস্তিকর হলেও আমার বেশ আরাম লাগছে। গা-হাত-পা ব্যথায় ভেঙে আসছে। আরও দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল। জানলার ধারে বসে এলোমেলো লিখছি। এবারে এলোমেলো লিখবই ঠিক করেছি, যা মনে আসবে তাই।
হলুদ-সবুজ পাতায় বাতাস লেগে কাঁপছে, কাছে গেলে হয়তো মর্মরধ্বনি শোনা যেত। কিন্তু নামতে ইচ্ছে করছে না, খুব ঘুম পাচ্ছে। মনটা কেমন প্রশান্ত লাগছে পাহাড় আর গাছেদের সান্নিধ্যে।
গতকাল নীল আকাশে মাঝেমাঝেই সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল, আজ মেঘ নেই। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে কখনও।
এই প্রকৃতির মধ্যে একটা লোনলিনেসের ফিলিংস আছে। অন্ততঃ আমার কাছে। অথবা নিস্তব্ধতা, কে জানে!
স্কুলের আগে পরপর অনেকগুলো চোর্তেন ছিল, সমাধিভূমি আর কী। বেশ অদ্ভুত না, স্কুল, চোর্তেন, পাহাড়, নিস্তব্ধতা সব পাশাপাশি। এবারে মনে হচ্ছে, ভ্রমণ মানে শুধু দেখা নয়, গভীর অনুভূতিও, হোয়াট আই ফেল্ট।
আপেল খাচ্ছি। বিম্লা হোটেলের বাগানের মিষ্টি আপেল। বাইরে রোদ্দুর ঝলসাচ্ছে।
দুপুর ১২.০৫। থিকসে মনাস্ট্রি
ন্যাড়া পাহাড়ের ওপর থিকসে মনাস্ট্রি। মুখোমুখি বরফ পাহাড়। ১৪৫টা সিঁড়ি ভেঙে উঠি। নামবার সময়ে বুই গুণেছিল। সিঁড়ির মাথার কাছে পাহারাদার দুটো সিংহ মূর্তি। এই মনাস্ট্রির মূল আকর্ষণ ভেতরে দোতলাসমান মৈত্রেয় মানে ভবিষ্যৎ বুদ্ধ আর বাইরে দাঁড়িয়ে ওপর থেকে উপত্যকার বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য। আমার কিন্তু চোখ টেনেছিল অদ্ভুত মূর্তিগুলো।
আগে এই মনাস্ট্রির পেছনের গল্পটা বলে নিই দাঁড়াও।
বারো তলা উঁচু এই মনাস্ট্রিটা তৈরি হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। এই শতাব্দীর প্রথম দিকে 'হলুদ টুপি' বা গেলুগ ধারার প্রবক্তা জে সোংখাপা তাঁর ছ'জন অনুগামীকে লাদাখে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এই ছ'জনের মধ্যে শেরাব সাংপোর হাতে তিনি অমিতায়ুস বুদ্ধের একটি ক্ষুদ্র মূর্তি দিয়ে লাদাখের রাজার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। রাজা তখন শ্যে প্যালেসে থাকতেন। মূর্তিটি পেয়ে উৎসাহিত হয়ে তিনি মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক সহযোগিতা করেন। 'হলুদ মন্দির' নামে পরিচিত ছোট গুম্ফাটি তৈরি করা হয়েছিল সিন্ধু নদের উত্তরে। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শেরাবের ছাত্র পালদেন মনাস্ট্রিটিকে বড় করে বানাবার উদ্যোগ নেন। গল্পকথা বলে, সোংখাপার ভবিষ্যৎবাণী ছিল, সিন্ধু নদের দক্ষিণ পাড়ে তাঁর ধর্মের প্রভাব বিস্তার হবে। থিকসে মনাস্ট্রির প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীকালে স্পিতুক ও লিকির মনাস্ট্রি গড়ে ওঠায় তাঁর এই আশা সত্যি হয়। সেও আরেক গল্প - শেরাব আর পালদেন সাংপো পুজোআচ্চার সময় বুদ্ধকে উৎসর্গীকৃত 'তোরমা' ছুঁড়ে দিতে যাবেন, ঠিক সেইসময় দুটো কাক এসে পাত্রটি নিয়ে পাহাড়ের অন্য পাড়ে উড়ে যায়। তোরমাটি শেষপর্যন্ত থিকসেতে একটি পাথরের ওপর সযত্নে অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পান পালদেন ও তাঁর অনুগামীরা। দৈব নির্দেশ মনে করে থিকসেতেই তাই মনাস্ট্রি গড়ে তোলেন পালদেন।
সোনালি রঙের দোতলা সমান উঁচু বিশাল মৈত্রেয় বা ভবিষ্যৎ বুদ্ধমূর্তি যে ঘরে তার বাইরের ঘরটায় মাঝে শাক্যমুনি বুদ্ধ মূর্তির দু'পাশে দুই প্রহরী। এই বুদ্ধের বাঁয়ে ডাইনে সবই মেডিসিন বুদ্ধ। বসে থাকা অবস্থার মূর্তিগুলির সবারই কোলের কাছে রাখা হাতের ওপর ওষুধের পাত্র। একেকজনের বিচিত্র সব নাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। মৈত্রেয় বুদ্ধের হাতেও ওষুধের পাত্র।
মৈত্রেয় বুদ্ধমূর্তির বাঁয়ে বেশ কয়েকটা অদ্ভুত দেখতে মূর্তি রয়েছে। এগুলো তান্ত্রিক বৌদ্ধমূর্তি। নারী-পুরুষের মিলিত মূর্তি – বুদ্ধ-শক্তির। প্রথমটি বসা ভঙ্গিমা। সম্ভবত দশটা মাথা। ছটা মাথা চোখে পড়ল। সামনের নীল রঙের দেহটি নারীর, পিছনে কালো দেহটি পুরুষের। একেকটা মাথা একেক রঙের – লাল, সাদা, কালো ইত্যাদি। অজস্র হাত, দশটা গুনতে পারলাম। একেকটা হাতে একেকরকম অস্ত্র। মূর্তিটির নাম ইংরেজি হরফে লেখা আছে - গুহ্যসমাজ। তথ্যে রয়েছে, যোগ তন্ত্রের সর্বোচ্চ ধাপের বজ্র পরিবারের এই মূর্তিটি যে গুণ তৈরি করে তা ক্রোধ পরিবহন করতে পারে। বুঝলাম এ আমার জন্য।এর বাঁ পাশের মূর্তিটি দাঁড়ানোর ভঙ্গীমায় নারী-পুরুষ আলিঙ্গনরত। নারী মূর্তিটির লম্বা বাদামী চুল, দেহ লাল, মুখ দেখা যাচ্ছে না। পুরুষ মূর্তিটির দেহ কালো, দুটি মাথা হলুদ ও সবুজ। এদেরও দুজনের একাধিক হাতে অস্ত্র। পুরুষটির এক হাতে তিনমাথা একটি মুণ্ড।মূর্তির গলায় নরকরোটি ও নরমুণ্ডের মালা।নারী মূর্তির পায়ের তলায় দুটি শায়িত মূর্তি, সম্ভবত পুরুষের।তাদের একজনের পরনে বাঘছাল। মূর্তির নাম চক্রসম্বর। এও সেই উচ্চমার্গের তন্ত্র। এর কাজ আবেগ মারফত আত্মাভিমানকে পরিবহন। এর বাঁদিকে আলিঙ্গনরত দুটি ভয়াবহ মূর্তি। পুরুষ মূর্তির রঙ নীল। পশুর মাথার মতো মোট নয়টি মাথা দেখা যাচ্ছে। সামনে একটি নীল রঙের বড় মাথার দুপাশে তিনটি করে অন্য রঙের মাথা। সেই নীল মাথার ওপরে আবার লাল মাথা, তার ওপরে হলুদ মাথা। আলিঙ্গনরত নারী মূর্তিটি ছাইরঙের। পুরুষ মূর্তির অজস্র হাত-পা। হাতে নানা অস্ত্র, পায়ের তলায় মানুষ ও হাতি। গলায় ও মাথায় নরকঙ্কাল। গলায় নরমুণ্ডের মালা। এই মূর্তিটির নাম বজ্রভৈরব। মঞ্জুশ্রীর সবচেয়ে রাগতভাব। তার রাগ এতটাই বেশি যে সে রাগ নিজেকেও কখনও আত্মীভূত করে ফেলে। একেবারে আমার রাগের মতো আর কী। এ হল এক ধরণের শূন্যতা যা প্রকাশ পায় প্রবল রাগের ভেতর দিয়ে।
প্রার্থনা শেষ হল। ওরই মাঝে ছোট-বড় লামারা কাঠের বাটি-চামচে স্যুপজাতীয় কিছু খেল। আমরাও বাইরে বেরিয়ে আসি। সামনে তাকালে খেত, ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর। ওরই মাঝে সিন্ধু বয়ে যাচ্ছে আপনমনে। দূরে একপাশে ন্যাড়া পাহাড় আর অন্যদিকে পাহাড়ের মাথায় বরফ সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে।
দুপুর ২ টো। শ্যে প্যালেস।
শ্যে প্যালেসের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। অনেক সিঁড়ি। আজ আবার এত সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠব না। প্যালেসের সামনে রাস্তার ওপারে ঘেরা জায়গায় জলে মাছ খেলা করে বেড়াচ্ছে। আকাশ আর গাছের প্রতিফলন জলে। পেছনে ঝলমলে উপত্যকার বিস্তার। রাস্তার ধারে অসংখ্য প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। ফাঁকে ফাঁকে বিজেপি-র পতাকাও চোখে পড়ছে। মনে প্রশ্ন জাগল, বৌদ্ধদের কোনও রাজনৈতিক দল নেই কেন?
রাস্তার ধারে ন্যাড়া পাহাড়ের গায়ে হলুদ পাতার ঝাঁকড়া মাথার গাছগুলো মাথা দুলিয়ে কী যে বলছিল জানিনা, তবে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল ওদের।
কংগ্রেসের পতাকা লাগানো একটা গাড়ি গেল পাশ দিয়ে। এরমধ্যেই কবে যেন ভোট। 'জিতেগা, জিতেগা, কংগ্রেস পার্টি জিতেগা।' এই সপ্তাহেই লাদাখে পঞ্চায়েত ভোট হবে। অনাবিল এই শান্ত সৌন্দর্যের মাঝে সেদিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে অস্ফুটে একটা কথাই বেরিয়ে এল – 'ভারতবর্ষ'!
আকাশ পরিস্কার। রাস্তাতে সবসময়েই বরফমাথা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এইমাত্র আকাশে দু-তিন টুকরো আলগা মেঘ ভেসে এল।
আসলে এখানকার ভাষা নিস্তব্ধতা। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে কোথাও।
দুপুর ৩টে। হল অফ ফেম
লে এয়ারফিল্ডের কাছেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৈরি দোতলা 'হল অফ ফেম' মিউজিয়াম। ইন্দো-পাক যুদ্ধে বিশেষতঃ কার্গিল যুদ্ধে নিহত সেনাদের স্মৃতিতে এটি নির্মিত। একতলায় নিহত সেনাদের ও বিভিন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্যাবলী এবং একটি স্যুভেনির শপ রয়েছে। দোতলায় সৈনিকদের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ইত্যাদি রয়েছে। সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে প্রতিরক্ষার আয়োজন সংক্রান্ত একটি আলাদা সেকশনও আছে।
বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি দেখা শেষ করে পাশেই একটা দোকানে ঢুকে দুপুরের খাওয়া হল।
বেলা ৩-৪৫। স্পিতুক মনাস্ট্রি
একশো চল্লিশটা সিঁড়ি ভেঙে এতটা ওপরে না এলে পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে সিন্ধু উপত্যকার এই ব্যাপ্তি ঠিক অনুভব করা যেত না। গুম্ফার মতো মনাস্ট্রিটিতে বুদ্ধমূর্তির মুখ ঢাকা। বছরে একবার উৎসবের সময় ঢাকা খোলা হয়। ভেতরে মহাকাল মূর্তি। মেয়ে আর দীপ দেখে এসে বলে। জুতো খুলে ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করেনা আর। মানে এই ভারি জুতোজোড়ার সঙ্গে জুতোজুতি বা গুঁতোগুঁতি করতে। স্পিতুকের অবশ্য তেমন কিছু গল্প নেই। ১১ শতকে লামা চামচুগ ওড এব-এর ভাই ওড-ডে মনাস্ট্রিটির প্রতিষ্ঠা করলে লোৎসেওয়া রিনচেন জাংপো বলেছিলেন, এই স্থান থেকে এমন একটি ধর্মীয় জাতির উদ্ভব হবে যা একটা উদাহরণ রেখে যাবে। ১৪ শতকে রাজা গ্রাস-পা-বুল-ল্ডে মনাস্ট্রিটির নতুন করে সংরক্ষণ করেন। লাল টুপিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে হলুদ টুপির দল মনাস্ট্রির অধিকার দখল করে।
তুমি তো জানোই ধর্মের এসব কচকচি আমার ভালো লাগে না। তথ্য জানার জন্য পড়তে হয়, লিখতেও হয়। ওপরের চত্ত্বরে ক্লান্ত আমি ঘুরে বেড়াই। উপত্যকার বিস্তীর্ণ দৃশ্য চোখ টানে – একপাশে রুক্ষতা, অন্যদিকে সবুজ।
নামার সময় সিঁড়ির পাশে উজ্জ্বল হ্লুদ পাতায় আলো আলো গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাতে বেশ লাগে। মনটাও আলো হয়ে যায় যেন। আকাশে এতক্ষণে অনেকটা সাদা মেঘ উঠেছে।
বিকেল ৪-৩০। শান্তি স্তূপ
পাহাড়চূড়ায় উঠে বিশাল স্তূপটাকে দেখে চন্দনদার সহাস্য মন্তব্য – সমুখে শান্তি স্তূপাকার, রবীন্দ্রনাথ এই দেখেই লিখেছিলেন।
ওপর থেকে লে শহরের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখে দেখে মুগ্ধ হই বারবার। বিকেল ফুরিয়ে আসছে, শীত করে। ঠান্ডার গায়ে বিষণ্ণতার একটা আঁচল জড়ানো থাকে। পাহাড়ি রুক্ষতায় হলুদ ম্যাপেল পাতা ঝরায় সে বিষণ্ণতা বাড়ে।
ভাবছি, ক্যামেরার ফ্রেমে বেশি বড় ছবি ধরা পড়ে নাকি মনে?
রোদ পড়ে আসছে, ঠান্ডা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। একেকটা জায়গায় ন্যাড়া পাহাড় পাথুরে, একেক জায়গায় বালির মতো লাগছে।
একা একা নামছিলাম। এক বয়স্ক লামা হাসি মুখে অন্য কোনও ভাষায় প্রশ্ন করলেন। বুঝতে পারলাম না, ইংরেজিতে জানতে চাই কি বলছেন? উনি এবার ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করেন, কোন দেশ থেকে এসেছি? বুঝলাম বিদেশি ভাবছেন। হাসি মুখে বলি, কলকাতা। উনিও কলকাতা শুনে হেসে বলেন, 'বালোবাসি।' মজা লাগে শুনে। ওঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে নামি। প্রশ্ন করেন, 'এত মানুষ কলকাতা থেকে এখানে আসেন কেন? আমরা যদি যাই?' বলি, আসুন না, কিন্তু আপনাদের এখানকার মতো এত সুন্দর নয় আমাদের শহর। আমরা ভিড়ের মধ্যে থেকে ক্লান্ত হয়ে এখানে বেড়াতে এসে নিঃশ্বাস নিই। আপনাদের হয়তো কষ্ট হবে, তবু আসুন।
৫-৩০। শঙ্কর গুম্ফা
দিনের শেষে পৌঁছাই শঙ্কর মনাস্ট্রিতে। ঘরের ভেতর ঘর। একেবারে বাইরের ঘরে ভবিষ্যৎ বুদ্ধ মৈত্রেয়-র তান্ত্রিক মূর্তির সামনে একা একজন লামা মন্ত্রপাঠ করছেন। মাঝে মাঝে একটা বড় চ্যাপ্টা ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্রে বড় লাঠির মতো ডান্ডা দিয়ে আঘাত করছেন। ভারী গম্ভীর একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে। ভেতরে ঢুকি। ভেতরের চারটে ঘর জুড়ে বিভিন্ন বৌদ্ধ গুরুদের মূর্তি। যার মধ্যে অনেক মাথার অবলোকিতেশ্বর মূর্তি বারবার নজর কাড়ে। একেবারে ভেতরের ঘরে নারীরূপে একটি অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি চোখে পড়ল যেটা আর কোথাও দেখিনি। মাঝের একটা ঘরে বেশ কয়েকজন লামা বসেছিলেন। তাঁরা প্রসাদ দিলেন হাতে।
হোটেলে ফিরছি যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে।
(ক্রমশ)
~ লাদাখের আরও ছবি ~
'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত নেশায় লেখক, ভ্রামণিক, ভ্রমণসাহিত্য গবেষক। প্রকাশিত বই - 'অবলা বসুর 'ভ্রমণকথা', 'আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত - ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা' (সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত)