এবার মেদিনীপুর
তপন পাল
-১-
এবারের গন্তব্য পাথরা – মেদিনীপুর শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে, কংসাবতী নদীতীরের এই গ্রামটি দুশো বছরেরও বেশি পুরাতন; চৌত্রিশটি মন্দিরের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ।
১৭২৮ সালে মহম্মদ আলি রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত হলেন। নাম নিলেন আলিবর্দি খান। ১৭৩২ সালে বৈদ্যনাথ ঘোষালকে তিনি রত্নচক পরগনার রাজস্ব আদায়কারীর পদে নিযুক্ত করলেন। তারপর ১৭৩৩-এ আলিবর্দি বিহারের নায়েব নাজিম। ১৭৪০-এ গিরিয়ার যুদ্ধজয়, ১৭৪১-এ ফুলওয়ারির যুদ্ধজয় করে তিনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার একচ্ছত্র নবাব। তাঁর শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যনাথবাবুরও উত্থান, মজুমদার পদবি গ্রহণ, ক্রমান্বয়ে মন্দির নির্মাণ ও অগণিত পুণ্যার্থী সমাগম।
নবাব বাহাদুর ঘোষালের এই খ্যাতিবিস্তৃতি ভালো চোখে দেখলেন না। বন্দীত্ব ও হস্তীপদে মস্তক চূর্ণ করার আদেশ জারি হল। কিন্তু হাতিটি ছিল ভারি লক্ষ্মী। সে দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুবৎ। ঘোষালের মুক্তি আর আটকায় কে! প্রথানুগ রাজকর্ম থেকে পরিবারটি সরে এল বাণিজ্যে। নীলচাষ তখন সদ্য শুরু হয়েছে। ওই পরিবারেরই আর একটি শাখা বন্দোপাধ্যায় পদবি নিয়ে তখন বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। পরপর গড়ে উঠতে লাগল মন্দির।
পরবর্তীকালে পরিবারটির বাসস্থান পরিবর্তন ও আনুষঙ্গিক কারণে মন্দিররাজি যখন সরকার বাহাদুর ও বিদ্বজ্জনের ঔদাসীন্যে বিলুপ্তির পথে, তখন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি, ইয়াসিন পাঠান নামধারী জনৈক স্থানীয় বাসিন্দার আগ্রহে খড়্গপুর আই আই টির তত্বাবধানে সরকার বাহাদুর মন্দিররাজির সংরক্ষণে সম্মত হন।
কিন্তু এ তো গেল প্রায় আড়াই শতকব্যাপী ইতিহাস। এবার বর্তমান।
-২-
সকালবেলায় হাওড়া। সাড়ে ছটার মেদিনীপুর লোকাল। পথের সব স্টেশনে থেমে, দ্রুতগামী রেলগাড়িগুলিকে পথ দিতে দিতে উলুবেড়িয়া, মেচেদা, পাঁশকুড়া, খড়্গপুর পেরিয়ে মেদিনীপুর। যাত্রাটি দীর্ঘ, অনধিক সাড়ে তিন ঘণ্টার; তবে কোনভাবেই ক্লান্তিকর নয়। বর্ষা প্রায় এসে গেছে, তবু আকাশে অকাল শরৎ। লাইনের দুধারে টগর, পুটুশ, আকন্দরা বিছিয়ে আছে, চলনবিলে পদ্মপাতা হাত তুলে ডাকছে। ভূচিত্র সবুজ, সন্ধিপূজার পদ্মরা পুকুরে সম্ভাবিত হয়ে উঠছে অলক্ষ্যে। দামোদর, রূপনারায়ণ, কংসাবতী পেরিয়ে মেদিনীপুর - এবং রেলগাড়িতে সারাপথ ভক্ষ্যের অবিরত বৈচিত্র্যময় সমাহার ও সদ্ব্যবহার।
স্টেশনে থেকে বেরিয়েই রিক্সা অটো ভাড়াগাড়ির সম্মিলিত হ্রেষাধ্বনি। এক ভাড়াগাড়িচালককে আমি যতই বলি যে আমি পাথরা দেখব, তারপর সময় থাকলে কর্ণগড়, মালঞ্চ, হিজলি... সে ততই বলে ভাববেন না, আপনাকে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ডি এম অফিস, গির্জা... সব দেখিয়ে দেবো। শেষে তাঁকে কিঞ্চিৎ কড়াভাবেই বলতে হলো দেখো বাবা, আমি থাকতে আসিনি। নতুন জিনিস কিছু দেখব না; তুমি আমাকে পুরনো জিনিসই দেখাও। ভ্রাতাটি আমার ভোজনরসিক। এতদূরে এলে, আর হিজলির ক্ষিরের গজা না খেয়েই চলে যাবে? চলো না! আরে একটু আধটু সুগার সব বাঙালিরই আছে। তাতে কি কারও মিষ্টি খাওয়া আটকাচ্ছে? বাস ডিপো, হাসপাতাল, অগণন রিক্সা অটোর সারি, ক্রিং ক্রিং প্যাঁ প্যাঁ পেরিয়ে শহর শেষ। তারপর ফাঁকা মাঠ, ঢেউখেলানো জমি। তবে শহর ক্রমবিস্তৃতির পথে খুব শিগগির এখানেও এসে পৌঁছবে। কংসাবতীর গা দিয়ে হাতিহালকা পাথরা রোড।
কিন্তু হাতি কখনও হালকা হয় নাকি? আমি হাতি তুলে কখনও দেখিনি বটে, তবে যাঁরা তুলেছেন তাঁরা বলেন হাতি বেশ ভারি। আমাদের শৈশবে পুজোর সময় মাঠে সার্কাসের তাঁবু পড়ত। সেখানে এক পালোয়ান বুকে হাতি তুলতেন। হাতি তাঁর বুকের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ তিনি শুয়ে থাকতেন। তারপর উঠতেন। তাঁর হাবভাব আচরণ দেখে বাল্যকালেই আমার ধারণা হয়েছিলো যে হাতি অতিশয় ভারি; এতটাই ভারি যে হাতিকে চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে নিয়ে গেলেও সে ভারিই থাকবে। ক্রমে জানা গেলো হাতিহালকা এক ঈদগা মসজিদের নাম। তার নামে সংখ্যালঘু প্রধান গ্রামটির নামও হাতিহালকা। এক সন্ত পির নাকি একদা এক উদ্ধত দুর্বিনীত হাতিকে হালকা করে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই নাম। এই অঞ্চলে হাতির উৎপাত নিয়মিত, ফলে গল্পটি অবিশ্বাস করিনি। রাস্তায় দুহাত পরপর চাঁদার উৎপাত। কারণ সামনে ঈদ। রামনগর আই সি ডি এস সেন্টারের সামনে যে দলটি ঈদের চাঁদার জন্যে গাড়ি দাঁড় করালো তাদের তিনজনের কব্জিতে লাল সুতো তাগার মত বাঁধা। বিনা পরিশ্রমে ফুর্তি করার সুযোগ আমোদগেঁড়ে কর্মবিমুখ বাঙালি কবে ছেড়েছে?
পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্পের উন্নতির পন্থা প্রকরণ নিয়ে যারা ভাবেন, তাঁরা কি এই সমস্যার বিষয়ে আদৌ অবগত? আমি মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াই, তাই জানি যে এই ব্যাধি সারা পশ্চিমবঙ্গে বছরভর। দুর্গা কালী জগদ্ধাত্রী সরস্বতী পুজোর সময় নির্দিষ্ট। অপরাপর সময়ে রক্ষাকালী, গণেশ, শীতলা, পঞ্চানন্দ, শিব... খলের হয় না ছলের অভাব! একটা লাগিয়ে দিলেই হল। দুর্গাপুর কিংবা মেদিনীপুর, রামপুরহাট কিংবা কোলাঘাট, গাড়িভাড়া করতে গিয়ে বাতানুকূলিত তো দূরস্থান, অবাতানুকূলিত ভদ্রস্থ গাড়িও পাওয়া যায় না। ঘুরে ফিরে সেই লজঝড়ে মারুতি ওমনি। প্রতিতুলনায় ওড়িশা বা উত্তর প্রদেশের কোন শহরে পৌঁছে পছন্দমত গাড়ি ভাড়া করতে অসুবিধা হয় না। যে বা যিনি বেড়াতে যাবেন, তিনি পয়সা খরচ করবেন। সেই পয়সা স্থানীয় অর্থনীতিতে অক্সিজেন যোগাবে। যিনি পয়সা খরচা করছেন, তিনি তার বিনিময়ে কিছু স্বাচ্ছন্দ্য প্রত্যাশা করতেই পারেন। কিন্তু আমরা তা দিতে অপারগ।
রাস্তা বরাবর দুহাত পরপর লটারির দোকান। গ্রামীণ মানুষ কি সত্যিসত্যি বিশ্বাস করে যে লটারির টিকিট কেটে বড়লোক হওয়া যেতে পারে! এরই মধ্যে লিকপিকে সেতু পেরিয়ে পাথরা।
-৩-
পাথরায় পথিপার্শ্বে, কাঁসাইয়ের কূলে, গ্রামের ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অদ্যাবধি চৌত্রিশটি মন্দির, তার মধ্যে আঠাশটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এর আওতায়। কিছু ভেসে গ্যাছে কাঁসাইয়ের জলে, আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় তার চিহ্ন অবলুপ্ত। শক্ত ল্যাটেরাইট পাথরের নবরত্ন মন্দিরটি পথিপার্শ্বে, পাশে এক আটচালা মন্দির, শিবালয়, ভগ্নপ্রায় দুর্গাদালান। গ্রামে ঢোকার মুখে কতিপয়, সেগুলি দেখে আমরা গ্রামের দিকে। আকাশে অকাল শরৎ, কাঁসাইয়ের জলে তারই ছায়া। ছাগল চরিয়ে, জ্বালানি ডালপালা সংগ্রহ করে মেয়েরা উঠে আসছে নদীগর্ভ থেকে। জীবন এখানে ধীর লয়ে চলে।
অতঃপর গ্রামে। মজুমদারদের কাছারিবাড়ি ধ্বংসের মুখে; আগাছাসঙ্কুল, মনুষ্যবর্জ্যে ভরপুর। পা বাঁচিয়ে ঢুকতে গিয়ে কতিপয় গ্রামবাসীর কৌতূহলের মুখে পড়তে হল। তাঁরা জানালেন সকালের দিকে হলে ঢুকতে পারতেন না। চন্দ্রবোড়ারা (Russell's Viper: Daboia russelii) সারারাত এখানে থাকে, রোদ বাড়লে বনের মধ্যে ঢুকে যায়। এরকম সম্ভাবনা আগেই মাথায় এসেছিল, তদনুযায়ী প্রস্তুতিও ছিল। গ্রামের ছেলে হওয়ার সুবাদে সাপদের সঙ্গে চিরকালই আমার ভাব ভালবাসা! এতদূর এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা না করে চলে যাওয়া যায় নাকি; বিশেষত চন্দ্রবোড়ার মত সেলেব্রিটি সাপের সঙ্গে! ভারতে এই সাপের কামড়েই সর্বাপেক্ষা বেশি লোক মারা যান, এবং অতীব যন্ত্রণাদায়ক সেই মৃত্যু। গোখরা, কেউটে, শাঁখামুটি, কালাচের মত চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মৃত্যু তাৎক্ষণিক নয়, বিলম্বিত। তা পাওয়া গেলো একটা। ভারী বুটের ভুমিস্পন্দনে বেচারা পালাবার পথ খুঁজছিলো। সব প্রজাতির সাপই বন্যপ্রাণ (সংরক্ষণ) আইন ১৯৭২ দ্বারা সংরক্ষিত ও সাপ মারা একটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ। কৈশোর পেরোবার পর আমি সাপ মেরেছি বলে মনে পড়ে না। কাছারিবাড়ির সিঁড়ি ভগ্নপ্রায়, মাথা তুলেছে অশ্বত্থ নিম বট। তাদের ধরেই ছাদে ওঠা গেল। চোখ অনেকদুর অবধি দেখতে পাচ্ছে; লাল, ঈষৎ ঢেউখেলানো ভূমি বিছিয়ে ইউক্যালিপটাস সোনাঝুরি নিম। দূরে গাঁদার বেগুনের বরবটির আবাদ, আর কাঁসাই। মজুমদারদের কাছারিবাড়ির সামনেই পাশাপাশি তিনটি পঞ্চরত্ন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটবড় আরও কয়েকটি। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় প্রতিটিই অনন্য। কার কার দেওয়ালগাত্রে পোড়ামাটির কাজ। কাছেই রাসমঞ্চ। একটু এগিয়ে শীতলা মন্দির, লোকমুখে তার নাম বুড়িমার থান।
-৪-
এবার ফেরার পালা মেদিনীপুরে। মেদিনীপুর শহরটাও মোটামুটি ঐতিহাসিক। নতুনবাজারে কংসাবতীর ধারে পঞ্চরত্ন ধাঁচের কালী মন্দির, সঙ্গে তিনশো বছরের অশ্বত্থ। কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে দেড়শ বছরের জগন্নাথ, তবে এখন অনসরকাল, শ্রীজগন্নাথ ভ্রাতা ভগিনী সহ শয্যাগত। রাজবৈদ্য পাঁচন সেবন করাচ্ছেন; মন্দির বন্ধ। ষোড়শ শতকের পির লোহানি বাবার মসজিদ দেখে মিরবাজারে টিকিয়া মসজিদ, আর আলিগঞ্জে সম্রাট আওরঙ্গজেবের দিওয়ান কেফায়েতুল্লা দ্বারা নির্মিত পুর্বমুখী তিন গম্বুজের দিওয়ানখানা মসজিদ। মির্জা মহল্লায় সপ্তদশ শতকের জোড়া মসজিদ, আর খানকা শরিফ, মহম্মদ মৌলানা হজরত শায়েদ শাহ মেহের আলি আলকাজুরির সমাধি। মহতাবপুরের এদ্গার শাহ সাহেবের সমাধিতে দুই সম্প্রদায়ের লোকেই শিরনি চড়ায়। বিস্তর ঘোরাঘুরি হল শহরে। এবারে তো মহাপ্রাণীটির কথা ভাবতে হয়। জেলা পরিষদ ভবনের সম্মুখে এক পাইস হোটেল। গরম ভাত ডাল পোস্তর বড়া আলুভাজা, উচ্ছে কুমড়ো বরবটির এক অনুপম চচ্চড়ি, সুসিদ্ধ সীতাপতি বিহঙ্গমের পাতলা ঝোল, আম তেঁতুলের চাটনি। বড় শান্তি হল খেয়ে। গরিবের ছেলে তো, ভালোমন্দ একটু খেতে পেলে বড় খুশি হই গো!
-৫-
পরবর্তী গন্তব্য কর্ণগড়, লোকবিশ্বাসে মহাভারতের কর্ণের রাজ্য। শালবনির পথে ভাদুতলা। সেখান থেকে ডাইনে বেঁকে সংরক্ষিত অরণ্যের গা বেয়ে রাস্তা অনাবাদি ঊষর জমি চিরে। ১৭৯৮-এ রানী শিরোমণির নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহের উৎসস্থল। বৃটিশরাজ কি নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল তা তো আমরা জানি।
আমাদের দ্রষ্টব্য উড়িষ্যার কেশরী রাজবংশের রাজা মহাবীর সিং নির্মিত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।ওই রাজবংশের রাজা কর্ণকেশরী কর্তৃক নির্মিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্থানীয় মন্দিরগুলি। কিন্তু চালক আমাদের নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো মহামায়া মন্দিরে। আরে ভাই গড় কই? ঈষৎ রুখো উচ্চারণে, তেরিয়া মেজাজে সে জানাল গড় কই তা সে কি করে জানবে? 'তুমি বলেছিলে কর্ণগড়, তো এটাই কর্ণগড়। বিশ্বাস না হয় দেখে নাও, লেখা আছে'। সে তো আছেই। কিন্তু আস্ত একটা দুর্গ লোপাট হয়ে যাবে এটাও তো মেনে নেওয়া যায় না। মহামায়া মন্দিরের প্রশাসনিক লোকজনদের জিজ্ঞাসা করতে তাঁরা অবাক হলেন। এই লতপতানি গরমে এক প্রায় প্রৌঢ় দুপুর রোদে কিনা গড় দেখতে যেতে চায়! তাঁরা বিস্তর চেষ্টা করলেন আমাকে নিরুৎসাহিত করার – কিচ্ছু নেই মশাই, গিয়ে কি দেখবেন। শেষমেশ আমি শুধু ওই গড়টি দেখার জন্যেই কলকাতা থেকে গেছি শুনে জানালেন ওখান থেকে তিন কিলোমিটার গিয়ে, গাড়ি রেখে, কাঁদর (একধরণের ছোট নদীর মত। দুটো ঢাল দুদিক থেকে এসে মিশলে মাঝখানে একটা খাদের সৃষ্টি হয়। বর্ষায় সেখানে জল জমে, নামে বড় নদীর পানে) ধরে কিলোমিটার খানেক হাঁটলে পড়বে নদী। নদীতে এখন জল নেই, হেঁটে পেরনো যাবে। ওপারে সেই দুর্গ। পথ দেখানোর জন্য একজনকে দিলেন।
তা যাওয়া গেল। ভরদুপুরে চারদিকে মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা। কেউ কোত্থাও নেই। কাঁদর ধরে হেঁটে নদীও পাওয়া গেলো। পূর্বরাত্রে বৃষ্টি হয়েছে। নদীর বুকের শরঘাস হোগলাবন পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর ভালোই জল, হেঁটে যাওয়া যাবেনা। কোত্থাও কেউ নেই, ব্যাগে গামছা আছে, তবু সাহস হলো না কারণ ওপারের পাড় খাড়া উঠে গেছে অরণ্যানীতে। দূরবীনে দেখা গেলো ভাঙা ইট ছড়ানো। যতই চেঁচাই, কেউ শুনতে পাবেনা। ভাম বনবিড়াল খ্যাঁকশিয়াল খাটাশ ধরলে, যদি তারপরে বেঁচেও থাকি, ইনজেকশন নিতে হবে।
এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে। ওপারের দুর্গ ভৌতিক স্বরে ডেকে বলল, কোথা যাও, পান্থ, কোথা যাও – আমি নহি পরিচিত, মোর পানে ফিরিয়া তাকাও। ততক্ষণে আমি গাড়িতে। গাইডটিকে সম্মানদক্ষিণা দিয়ে মহামায়া মন্দিরে নামিয়ে সিধে মেদিনীপুর ইস্টিশনে। পথে একপশলা বৃষ্টি। তখন তিনটে তেত্রিশ, কিন্তু তিনটে তিরিশের লোকাল ছাড়েনি। একদৌড়ে জানালার পাশে।
-৬-
তা বারো কামরার লোকাল ছাড়লো, কংসাবতীও পেরোল। ও মা! তারপর দেখি একটা স্টেশন, নাম কাঁসাই হল্ট। অবসরে রেলচর্চা করে থাকি, কিন্তু এমন মজার ইস্টিশন আগে দেখিনি। হ্রস্ব প্ল্যাটফর্ম, শুধুমাত্র চতুর্থ কামরাটি প্ল্যাটফর্মে, সামনে পিছনে বাকি এগারোটি বাইরে।
খড়গপুর, এবং বহু প্রতীক্ষিত লেবু চা। অম্বুবাচীনিবৃত্তি পরবর্তী দিনটি দ্রৌপদীর শাড়ির মত দীর্ঘ। নিসর্গ দেখতে দেখতে, আকাশে শামুকখোলের দলের নীড়ে ফেরা দেখতে দেখতে বাউড়িয়া পৌঁছালাম ছটায়। তখনও আকাশে রোদ।
গ্রন্থঋণঃ
১। Blair B. Kling: The Blue Mutiny, The Indigo Disturbances in Bengal, 1859-1862 (Philadelphia, University of Pennsylvania Press, 1966)
২। Dictionary of Historical Places. Bengal. 1757 -1947, Department of History, Jadabpore University, PRIMUS BOOKS
৩। The Telegraph, Next weekend you can be at ... March 2, 2008, July 6, 2008
৪। Lewis Sydney Stewart O'Malley, Bengal District Gazetteers - Midnapore, Bengal Secretariat Book Depot, Calcutta, 1911
৫। কিংবদন্তীর দেশে, সুবোধ ঘোষ। কলিকাতা নিউ এজ পাবলিশার্স। ১৯৬১
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।