সুন্দরী রুপিনে
ঝুমা মুখার্জি
~ রুপিন পাস ট্রেক রুট ম্যাপ ~ রুপিন পাস ট্রেকের আরও ছবি ~
২০১৩-র জুনে প্রকৃতির রোষে গাড়োয়াল যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল তারপর আমাদের মত অনেক পাহাড়প্রেমী ওপথে যাওয়ার সাহস দেখায়নি। অধিকাংশ রাস্তাঘাট বন্ধ, গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন। তবে এই পবিত্র পুণ্যভূমি থেকে বেশিদিন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাও কষ্টকর,পুজোর ছুটিতে তাই বেরিয়ে পরলাম। এবার ট্রেক রুটটা একটু আলাদা। প্রবেশ যে পথে প্রস্থান অন্য পথে। আমাদের ট্রেক শুরু উত্তরাঞ্চল থেকে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাব হিমাচল। গাড়োয়াল ঘোরা প্রায় অসম্ভব বলে হিমাচলের কিন্নর সার্কিট ঘোরার পরিকল্পনা মাথায় এল। কিন্তু সেটাও অভিনব, অ্যাডভেঞ্চারাস হওয়া চাই। সেইজন্য রুপিন পাস ট্রেকিংয়ের হোমওয়ার্ক শুরু। কুড়ি-পঁচিশজনের বড় একটা দল। সঙ্গে আমাদের দশ বছরের মেয়ে টুপুরও যাবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অপরিচিত সকলে আটদিন একসঙ্গে কাটানো - এও এক নতুন অভিজ্ঞতা।
দেরাদুন স্টেশনে বাকি সদস্যেরা অপেক্ষায় ছিলেন। এখান থেকেই রওনা হব ধৌলার দিকে। অনেক অচেনা মুখের মধ্যে একটা মুখ খুব চেনা লাগল। হাসিমুখে এগিয়ে এসে হাত বাড়ায়। আরে এ তো সেই চমন, হর কি দুন ট্রেকে আমাদের গাইড ছিল। সেদিনের কলেজ পড়ুয়া চমন আজ অনেক পরিণত। সাতটার মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিল। সকাল থেকেই মেঘে ঢাকা আকাশ,আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে বৃষ্টি হবেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই নামল । ভিজে মাটির গন্ধ ভুলিয়ে দেয় জানলার কাচ তোলার কথা। ধৌলার দূরত্ব আড়াইশো কিমির মত। সন্ধের আগে পৌঁছব বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষ তাড়াও নেই। প্রকৃতি, পথচলতি মানুষ দেখে আর নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে বেশ সময় কাটছিল। এর মাঝে পুরলাতে এক ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক তারপর আবার চলা। নেটওয়ারে এসে থামতে হয় মিনিট দশেকের জন্য, এখান থেকেই শুরু গোবিন্দ ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি,তাই প্রবেশের অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়। এখানেই সাঁকরির রাস্তা পৃথক হয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে হর কি দুন ট্রেক শুরু। গাড়ি এসে থামল ছটা নাগাদ। ঘন জঙ্গলের মাঝে,আমাদের আজকের ক্যাম্পসাইট। সামনেই রুপিন নদী বয়ে চলেছে, ঘন অন্ধকারে এর থেকে বেশি দেখা গেল না। অপেক্ষা সকালের।
সেবা গ্রাম
সঙ্গীদের সোরগোলে ঘুম ভাঙল। আকাশ পরিস্কার,হাল্কা ঠান্ডা। ধৌলার সকাল বেশ মনোরম। আজকের পথ দীর্ঘ, তবে কঠিন নয়। বরফমোড়া শৃঙ্গ, অসংখ্য ছোট-বড় ঝরনার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, তাছাড়া রুপিন নদী তো সর্বক্ষণের সঙ্গী। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঝরনার পাশে বসে দু'দন্ড জিরিয়ে নিয়ে আবার চলা। নানা রঙের বাহারও তাক লাগায়। পাহাড়ের ঢালে লাল রামদানার ক্ষেত তাকিয়ে দেখার মত। গৃহস্থের বাড়ির জানলায় উদাসী যুবতীর মুখ বা পাহাড়ি শিশুর হাসি, কখনও এক ঝাঁক ঈগল ক্যামেরার লেন্সে ধরা দেয়। বৈচিত্র্যের কোনও অভাব নেই। দুপুর নাগাদ সেবা গ্রামে পৌঁছে গেলাম, সবুজে ঘেরা সুন্দর গ্রামটি, মুখ্য আকর্ষণ কেন্দ্রে ঘড়ির আকৃতির এক প্রাচীন মন্দির। তবে দরজা বন্ধ, মন্দিরের দরজা তিন-চার বছরে একবার খোলে ও পুজো হয়। তাছাড়া কোনও কিছু উৎসর্গ করার ইচ্ছা থাকলে পাথরের দেওয়ালে আটকে দেওয়া যায়। এভাবে অনেক মেডেল, শিল্ড, কয়েন আটকানো আছে। আমরাও একটি কয়েন আটকে প্রণাম করে এগোলাম। গ্রামের কোনও বাড়িতে অতিথি হয়ে এখানেও থাকা যায়।
গ্রাম ছাড়িয়ে ফুলের বাগান, রকমারি ফলের বাগান পেরিয়ে নদীর গা ঘেঁসে দেড় কিমি রাস্তা আরও হেঁটে একটা কাঠের সেতু পার করে আজকের গন্তব্য। একদল ভেড়া আর ছাগল আমাদের পথ আটকেছে অস্থায়ী এক কাঠের সেতুর ওপর, যা উত্তরাঞ্চল ও হিমাচলকে পৃথক করেছে। ১৬ কিমি রাস্তা প্রথম দিনের পক্ষে যথেষ্ট। রঙের বাহার, পাখির কাকলি, নদী-ঝরনা, ছবির মত গ্রাম, হিমাচলি শিল্পশৈলী শহুরে মানুষকে আমূল পাল্টে দেয়। কোথা দিয়ে সময় চলে যায় হাঁটতে হাঁটতে। মনের আনন্দে এগিয়ে যাই আর ছবি তোলা চলে ফাঁকে ফাঁকে। সেটাই বিশ্রাম। অবশেষে আজকের গন্তব্যে - নদীর তীরে হলদি খাদ। সরবতের গ্লাস নিয়ে বসে পড়লাম। আড্ডা-গল্পে কেটে গেল সময়।
ঝাকার পথে
নিজেরা ট্রেক করা আর কোনও বড় দলের সঙ্গে ট্রেকিং-এর তফাত এবার বুঝলাম। এখানে প্রতিযোগিতা সঙ্গীদের সঙ্গে নয়, শুধুই নিজের সঙ্গে প্রকৃতির। টিমের গাইডের লক্ষ্য সকলকে নিরাপদে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া। তাই প্রথম দিনেই তাকে বুঝতে হয় ট্রেকারদের গতি। দলে বিভিন্ন বয়সী ট্রেকার যেমন রয়েছে তেমনি ফিটনেস সকলের সমান নয়। তাই কয়েকটি দলে ভাগ করা হয়। যাদের গতি ধীর বা বয়স্ক তারা যাবে সবার আগে। শুরুতেই সাঙ্ঘাতিক চড়াই ও বোল্ডার ওয়াক বেশ খানিকটা। বেশ কঠিন। সাবধানে পথটুকু পার হলাম। আসলে আমাদের ক্যাম্প নদীর তীরে ছিল তাই বেশ অনেকটা উঠতে হল। এরপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সহজ পথ। ছোট ছোট ঝরনা ডিঙিয়ে, পাতার স্পর্শ গায়ে মেখে, পাখিদের ডাক শুনে একসময় জঙ্গল শেষ। এবার সহজ গাড়ির রাস্তা শুরু। বেশ মজার, প্রথমে কঠিন পথ পার হয়ে তারপর সরল পথ। শুরুতেই যা পরীক্ষা। পর পর হিমাচলি গ্রাম পেরিয়ে যেতে হবে।
গোসাংগু প্রথম গ্রাম। এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সামনে এগিয়ে যাব না এখানেই ট্রেক শেষ। এখান থেকেই দায়িত্ব সহকারে রোহরু পৌঁছে দেবে। সিমলা যাওয়ার গাড়ি ওখান থেকেই পাওয়া যাবে। উৎসাহী ট্রেকারদের সকলেই যে রাস্তা কিওয়ারি গ্রাম যাচ্ছে সেদিকেই পা বাড়াল। ধীরে ধীরে প্রকৃতির রূপ বিস্মৃত,মোহিত করছে। ডানদিকে বহমান সুন্দরী রুপিনে মিশছে চঞ্চলা ঝরনা। খানিক বিশ্রাম, ছবি তোলা, পিছিয়ে পড়া সঙ্গীর অপেক্ষায় একটু থামা, গলা ভিজিয়ে আবার চলা। জিসকুন গ্রামে চা পানের বিরতি। এখানে ছোট বাজার আছে, প্রয়োজনীয় প্রায় সবই পাওয়া যায়। কেনাকাটার পাট চুকিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে খানিক সময় কাটালাম। সবাই অবাক খুদে ট্রেকারকে দেখে। একজন প্রবীন বলেই ফেলেন, এত অল্পবয়সীকে রুপিনে নিয়ে কেউ যায় না, আমরা যেন রেখে যাই ওনার কাছে। কিন্তু মেয়ে তো হার মানার পাত্রী নয়, হাসিমুখে নিজের স্যাক নিয়ে এগোল।
গ্রামের পথ ছেড়ে আবার পাথুরে পথ, তবে সর্বক্ষণ রুপিন ও তার শাখানদীগুলো সঙ্গী, জলের অভাব নেই। নদীর ধারে বসেই লাঞ্চ সেরে নিলাম। দুপুর প্রায় দেড়টা, খাবার পেটে পড়তেই দু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কিন্তু পথ যে আরও বাকি। আবার চড়াই শুরু। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার জঙ্গল - পাইন, ফার, আখরোট গাছ ছাড়া আরও নানা গাছ-গাছালিতে ঘেরা। এদিকে আমার কন্যা মাটি থেকে আখরোট কুড়িয়ে বেজায় খুশি। আনন্দে তার হাঁটার গতি আরও বেড়ে গেল। জঙ্গলে গ্রামের মেয়েরা কাঠসংগ্রহে ব্যস্ত। শীত যে আসন্ন। তাদেরই একজনকে জিজ্ঞাসা করি ঝাকা গ্রাম আর কত দূর? জানা গেল প্রায় এসে গেছি। এক কিশোর দায়িত্ব নিল পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার। দলের বেশিরভাগজন পেছনে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ গন্তব্যে হাজির। আজ গ্রামের বাড়িতেই অতিথি হিসেবে থাকা। গৃহকর্তা প্রত্যেককে একটি করে আপেল দিয়ে স্বাগত জানালেন। ঝাকা-ই এ পথের শেষ গ্রাম। সন্ধেতে আজ আর সঙ্গীদের সঙ্গে নয়, এ বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে গল্পে দারুণ সময় কাটল। শহুরে আড্ডার থেকে আলাদা, চিন্তাভাবনা জীবনযাত্রা ভিন্ন। কষ্টকর কিন্তু সুখী জীবন। গৃহকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানলাম হিমাচলের প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও এরা কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। ছেলে বিদেশে কর্মরত আর মেয়ে সিমলায় ডাক্তারি পড়ছেন। কিন্তু নিজেরা অতি সাধারণভাবেই থাকেন।
সরযুবাস থ্যাচ /বুরাস কান্ডি
ঝাকা ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু সামনে আরও অনেক কিছু অপেক্ষায় আছে। আবার পথ চলা শুরু হল। প্রথমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। রাস্তা বেশ ভালোই। মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে একঝাঁক রুপোলি চড়াই শ্রেণির পাখি নজরে এল। কাছাকাছি যাওয়ার আগেই উড়ে গেল। অসাধারণ সে দৃশ্য, রূপালি ডানায় আলোর ঝকমকানি দেখার মত। এ পথে সারাক্ষণ পাখির ডাক শোনা যায়, তবে দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বেশ নিশ্চিন্তে হাঁটছিলাম, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর আবার বিপজ্জনক রাস্তা -মানে রাস্তা শেষ, এবার নিজেকে রাস্তা বানিয়ে হাঁটতে হবে। ইতিমধ্যে গাইড হাঁটার কৌশল সবাইকে যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দুদিনের পরীক্ষায় সবাই সফল। আজ থেকে পথ ক্রমশ আরও কঠিন হবে। খরস্রোতা নদীর গা দিয়ে জঙ্গলের রাস্তা শেষে ভি শেপের রিভার বেড ধরে পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে ব্যালেন্স করে এগোনো। প্রতিটি পদক্ষেপ সন্তর্পণে ফেলে নিজের ওয়াকিং পোল রাখার জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। সাধারণত ডানহাতে পোল রাখা হয়, কিন্তু এখন বাঁদিকে নিতে হবে। ধীরে ধীরে বোল্ডারের ওপর দিয়ে এগোলাম। পাইন, ফার, ম্যাপেল পিছনে ফেলে এসেছি। এখন মাঝে মাঝে গুরাসের ঝোপ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বোল্ডার ওয়াকিং বেশ কষ্টকর, বিপজ্জনকও। বেশ কিছুক্ষণ পর বুগিয়ালের দেখা পাওয়া গেল। এবারে লাঞ্চ, একটু বিশ্রাম তারপর আরও দুই কিমি হাঁটা। তবে এখানেও ক্যাম্প করা যায়, আদর্শ জায়গা তার জন্য, কিন্তু আমরা কাল রেস্ট ডে রেখেছি তাই এগিয়ে যাব খানিকটা। এ জায়গার নাম বুরাস্কান্ডি। ধীরে ধীরে গাছপালা কমে যাচ্ছে, ভুর্জগাছ আর কিছু গুরাস ছাড়া আর কোন গাছপালা নেই। সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তিনটে নাগাদ আজকের ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে শরীরে নেমে এল রাজ্যের ক্লান্তি। ম্যাগি আর চা খেয়ে অবসাদ দূর করে অ্যাক্লেমেটাইজেসনের জন্য দু কিমি চড়াই ভেঙে ওপরে যেতে হল। ফিরে এসে নদীতীরে বসে সূর্যাস্তের শোভা দেখে ঠান্ডার প্রকোপে আর বাইরে থাকা গেল না। আজকের রাস্তায় নদীর রূপ মুগ্ধ করেছে। পাহাড়ি নদী কখন খরস্রোতা কখন শান্ত, কোথাও দুধ সাদা তো কোথাও তুঁতে নীল। সেসব ছবি দেখে পথের বর্ণনা লিখতে লিখতে ডিনার এসে গেল।
ধন্দেরাস থ্যাচ /লোয়ার ওয়াটার ফল ক্যাম্প
গরম জল, চা, জ্যাকেট, দুটো গ্লাভস্, উলেন মোজা, টুপি কোনও কিছুই ঠান্ডা কমাতে পারছে না। মেয়ের কান্নাকাটি শুরু - প্রচন্ড ঠান্ডায় হাতের আঙুলে ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ,আগুনে হাত গরম করে গ্লাভস পড়ালাম, তবু ও যেতে চাইছে না আর। ওদিকে ইউ শেপের ভ্যালি আর রুপিন নদীর উৎস ওয়াটারফলস একদম হাতের ও চোখের নাগালে, এসব ছেড়ে ফিরে যাওয়ার যে আর উপায় নেই। প্রতিবার হিমালয়ে দুর্গম স্থানে এলেই একটা দ্বন্দ্বে পড়ে যাই - একদিকে হিমালয়ের অমোঘ টান আর অন্যদিকে মেয়ে। ভীষণ ঠান্ডা আর হাওয়ার দাপট, একটু রোদের দেখা নেই। আজকে খুব সামান্যই হাঁটা। তাই একটু রোদ্দুরের অপেক্ষায়। মেয়ে শান্ত হতেই যাত্রা শুরু করলাম। আজকের গন্তব্য নাগালের মধ্যেই, ছুঁয়ে ফেলার অপেক্ষায়। সবুজের চিহ্ন নেই রুক্ষ পাহাড়ে, বায়ুর ক্ষয়কার্যের নিদর্শন পথ জুড়ে। সঙ্গী হয়েছে এক পাহাড়ি কুকুর। আজ পুরোটাই বোল্ডার ওয়াক, কখন যেন দূর থেকে দেখা স্নোব্রিজে পৌঁছে গেলাম। সেখানে যাওয়ার সাহস দেখাইনি, অন্য পথ ধরলাম। হাঁটার ক্লান্তি বা ধকল আজ বেশ কম। সবাই নিজেদের ছন্দে চলেছে। আমাদের সঙ্গে দু তিনজন যারা ছিল তারাও হঠাৎ হারিয়ে গেল। মনে হল সবাই পৌঁছে গেছে আজকের গন্তব্যে, দ্রুত পা চালালাম। আজ আর কোন বিরতি নেই সোজা ক্যাম্পসাইট।
কালকের পাথুরে রুক্ষ অঞ্চল থেকে আজকের ক্যাম্পসাইটে এসে বেজায় খুশি আমি। অসাধারণ এ জায়গা। সবুজ তৃণভূমি, সামনেই অসংখ্য ঝরনার ধারা নেমে এসে রুপিন নদীতে মিশেছে। কাল থেকে প্রতীক্ষায় ছিলাম কখন এই রুপিন ভ্যালিতে পা রাখব। টিমের বাকি কেউই পৌঁছাননি, আমরা তিনজন প্রথম স্বর্গোদ্যানে পা রাখলাম। ঝাকায় দু'জন ট্রেকারের সঙ্গে আলাপ হয়, গতকাল তারা একদিনেই এখানে এসেছিল। সঠিক অ্যাক্লেমাটাইজেশন না হওয়ায় তাদের একজন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গাইডের নির্দেশে ফিরেও যাচ্ছেন তাঁরা। খারাপ লাগল শুনে। আসলে পাহাড়ে এসে তাড়াহুড়ো নয় একদম,যেখানে যতটা সময় তা দিতেই হবে। পথশ্রমের ধকল কম তাই আজ সবাই বেশ চনমনে, দুপুরে জমিয়ে খিচুড়ি, পাঁপড়, আচার খাওয়া আর আড্ডা। তারপর একটু হাঁটাহাঁটি, এরই মধ্যে আগামী কালের কর্মসূচি জানিয়ে দেওয়া হল। আগামী দুদিন বেশ কঠিন, আর যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। এই উচ্চতায় আবহাওয়ার কোনও ভরসা নেই, সকাল থেকে দুপুর অব্দি বেশ রোদ ঝলমলে, ধীরে ধীরে মেঘেদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যখন তখন তুষারপাত শুরু হতে পারে। বিকেল থেকে ঝোড়ো হাওয়া সঙ্গে তুষারপাত শুরু হল। টেন্টে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন বুঝতে পারিনি। রাজু ভাইয়ার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল, ডিনার নিয়ে হাজির। তখনও তুষারপাত হয়ে চলেছে, কিন্তু খাবার, গরম জলের জোগান কোনও কিছুর ত্রুটি নেই। কালকের চিন্তায় বাকি রাত প্রায় জেগে।
রতি ফেরি/ আপার ওয়াটার ফল ক্যাম্প
আজ বেশ গুরুত্বপুর্ণ দিন। শুরু থেকেই বেশ কঠিন। দূর থেকে দেখা আর নয় এবার ওই জলপ্রপাত পার হতে হবে। জল বেড়ে গেলে তখন আমাদের যাত্রা স্থগিত। তাই আজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে হবে। ব্রেকফাস্ট রাস্তায়। আলোআঁধারিতে মোহময়ী রুপিন ভ্যালিকে গুডবাই, সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। নিজেদের ছোট স্যাক নিয়ে দুজন গাইড ভাইয়ের সঙ্গে টিমের সবাই হাঁটা দিল। দলের বাকি সদস্যরা, কুক পোর্টাররা আসছে পরে। ঘোড়াদের কাজ শেষ তাই মালবহনের দায়িত্ব পুরোটাই পোর্টারদের। এদের সঙ্গে নিজেদের কিছুতেই তুলনা করতে পারি না। যেমন এদের গতি তেমনি ক্ষমতা। পাহাড়ি এই মানুষগুলো সৎ, পরিশ্রমী আর সরল। এদের সাহায্য ছাড়া আমাদের ইচ্ছা অধরাই থাকত। ঘাসে মোড়া ক্যাম্পসাইট ছাড়তেই হল, শুরু হল কঠিন চড়াই। পাথরে পা রেখে ক্লাইম্বিং, বেশির ভাগ পাথরই যেখানে নড়ছে। সাবধানে পা ফেলে ওঠা বেশ কঠিন। নীচের দিকে তাকিয়ে উঠে যাচ্ছি, ওপরে তাকাতে বেশ ভয় করছে। হাঁপিয়ে পড়ছি, মাঝে মাঝে থামতে হচ্ছে। সামনে পাহাড়ের গা বেয়ে জলধারা নেমে আসছে এটা পেরিয়ে ওপরে উঠে যেতে হবে,ভীষণ পিচ্ছিল পাথর, গাইড ভাইয়ার হাত ধরে একে একে পার হলাম। তারপর ভয় কাটল। এদিকে দলের দু'একজন অসুস্থ বোধ করছে, সবাইকে জলপানের নির্দেশ দিলেন গাইড, সঙ্গে শুকনো খাবার খাওয়া হল।
আজকের দিনটা কেটে গেলেই নাকি সব চিন্তার অবসান। এখানেই শেষ নয় এখন পেরোতে হবে খরস্রোতা নদী,জলপ্রপাত পরপর। বিপদ পদে পদে। যে ওয়াটারফলস দেখে দুদিন কেটেছে আজ তারই সামনে দাঁড়িয়ে, বিশ্বাসই হচ্ছে না। যেমন অপরূপ সুন্দরী, তেমনি ভয়ঙ্কর। কালো পাথরে ধাক্কা খেয়ে ধাপে ধাপে নেমে আসছে দুধ সাদা জলের ধারা, সৃষ্টি করেছে সুন্দরী রুপিন। সূর্যের আলো জলে পড়ে চোখ ঝলসে যায়, বিভিন্ন কোণ থেকে ক্যামেরাবন্দী করলাম এই অসাধারণ দৃশ্য। ক'দিন পরই থমকে যাবে এর গতি, প্রবহমান জলধারা জমে বরফ হয়ে যাবে। গাইডের নির্দেশে পার হলাম বহমান জলধারা,আবার এক অভিজ্ঞতা। একজন বরফ-ঠান্ডা জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছি্লেন, গাইড ভাইয়ার তৎপরতায় রক্ষা পেলেন। এই জলপ্রপাত দেখে আর আশ মেটে না। কেটে যায় সময়, তবু যেতে ইচ্ছা করে না এখান থেকে। আবার দুরূহ চড়াই আর দুর্গম পথ চলা শুরু। রুক্ষ ধুসর পাহাড়ে সাদা চকের যে দাগ দেখা যাচ্ছে, আসলে তা ছোট-বড় গ্লেসিয়ার। আজ যেন হাঁটছি কম,দাঁড়াচ্ছি বেশি। কখনও তা ক্লান্তিতে কখনওবা প্রকৃতির অচেনা রূপ দেখার অছিলায়। আজ পুরো পথই চড়াই এবং বেশ কঠিন। বাইশ জন ট্রেকার ছাড়াও সঙ্গে রয়েছেন গোটা দশেক পোর্টার - তাই বেশ বড় দল। পিছিয়ে পড়লেও ভয় নেই, সঙ্গে কেউ না কেউ আছেন সর্বক্ষণ। তবে আবহাওয়া খারাপের দিকে, ঠান্ডা হাওয়া চলছে। পা চালাতে হবে। খিদে তেষ্টা সবই ভুলতে বসেছি। তবে আমাদের রাজু ভাইয়া যখন রুটি সবজি হাতে দিল তখন কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছিলাম না। মনে হল এত সুস্বাদু খাবার জীবনে যেন প্রথমবার খেলাম। প্রায় এসেই গেছি তাই একটু বসা যেতেই পারে। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর অবশ হয়ে আসছে। ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর আজকের ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে গেলাম। সবাই মিলে টেণ্ট লাগানোর কাজে হাত লাগানো হল। গতকালের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড যতটা সুন্দর ছিল আজ ঠিক উল্টো। পাথুরে এবড়ো খেবড়ো রুক্ষ একটা জায়গা আশেপাশে জলের কোন উৎস নেই। কেউ কেউ বেরোলো জল আর কাঠের সন্ধানে। আমি এতটাই ক্লান্ত যে শুয়েই পড়লাম, যদিও কাজটা ঠিক নয়। এদিকে দু'একজন অসুস্থ হয়েও পড়েছে। মেয়ে নিয়ে একটু ভয় তো করছেই, প্রায় চার হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় অবস্থান করছি। তবে আজ ওকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছে। সন্ধে থেকে আজও তুষারপাত হল। এই উচ্চতায় ঘুম প্রায় হয় না। মাঝরাতে বাইরে এসে দেখি চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে প্রান্তর, আকাশে হাজার বাতি জ্বলে উঠেছে। খোলা আকাশের নীচে পাঁচ মিনিট কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম টেণ্টে। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের পাঁচ ডিগ্রি কম টেণ্টের ভেতরেও।
রতি ফেরি/ আপার ওয়াটার ফল ক্যাম্প
এপাড়ে নালাটি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক নদীর আকার নিয়েছে। আর সেই পাথরের ওপর বেশ কয়েকজন নেমে শিবের নামগান করছে আর দুহাত তুলে নাচছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই পৌঁছে গেলাম ধঞ্চো গ্রামে। এখানে কিছু জনবসতি আছে। তবে এই মেলার সময় লঙ্গরখানা আর গ্রামের ঘরবাড়ি আলাদা করে চেনার উপায় নেই। যাত্রাপথে ধঞ্চোই প্রথম বিশ্রামস্থান। অনেকেই এখানে রাতে থেকে পরদিন আবার যাত্রা শুরু করেন। তাই রাত কাটানোর জন্য অনেক টেন্ট রয়েছে। তার অনেকগুলি একেবারে ধঞ্চো নালার পাশেই। তৈরি হয়েছে অনেক অস্থায়ী পাবলিক টয়লেট। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর দেড়টা। একটা লঙ্গরখানা থেকে রাজমার ডাল, ভাত আর সুন্দর গন্ধযুক্ত এক তরকারি দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে হর-পার্বতী সেজে বহুরূপী দুটি শিশুও চেটেপুটে ডালভাত খেয়ে নিল। ওরা স্থানীয় গাদ্দি অধিবাসী, বছরের এই ক'টা দিন খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হয় না, অন্য সময় ভেড়ার পাল চড়িয়েই দিন কাটে। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় খাবার সব সময় পৌঁছায় না। আর শীতে তো পুরোটাই বরফে ঢেকে যায়। লঙ্গরখানাটি স্থানীয় কাংড়া উপত্যকার একটি ক্লাবের। ওদের কাছেই জানতে পারলাম, ধঞ্চো আসলে ভগবান বিষ্ণুর বাগানবাড়ি। কেউ কেউ একে 'বৈকুন্ঠধাম'ও বলে। শীতের ছ'মাস শিব ঠাকুর মণিমহেশের বাসস্থান ছেড়ে সমতলে চলে যান। তখন তিনি এই পার্বত্য অঞ্চল দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান ভগবান শ্রীবিষ্ণুর হাতে। হাতে সময় কম, তাই খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চললাম।
যত ওপরের দিকে উঠছি প্রকৃতি যেন অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠছে। ধঞ্চো নালা পাথরের ওপরে আরও খরস্রোতা আর ধবধবে সাদা জলের ধারায় পরিণত হচ্ছে। চারদিক খোলা একটি পাহাড়ের ওপর এসে নির্বাক হয়ে সামনে চেয়ে রইলাম। সামনের পাহাড়ের ওপর থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট ধাপে ধঞ্চো নালা নেমে এসেছে সমতলে। প্রত্যেকটি ধাপই এক একটা ছোট জলপ্রপাত। ধঞ্চোর লঙ্গরখানাতেই শুনেছিলাম পুরাণ অনুসারে শিব একবার ভষ্মাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এক প্রাণঘাতী বর দিয়ে ফেলেন, সে যার মাথাই স্পর্শ করবে সে মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু চতুর ভস্মাসুর প্রথমেই তা স্বয়ং শিবের ওপর প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়। বিপদ বুঝে শিব ঠাকুর পালিয়ে ধঞ্চোর এই জলপ্রপাতের আড়ালে থাকা এক গুহায় আশ্রয় নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু মোহিনীর রূপ ধরে নর্তকী রূপে ভস্মাসুরের সামনে আবির্ভূত হয়ে নাচের ভঙ্গীমায় ভস্মাসুরকে নিজের হাত নিজের মাথায় রাখতে বাধ্য করেন। সঙ্গে সঙ্গে ভস্মাসুর নিজেই ভস্মে পরিণত হয়।
জলপ্রপাতের দুপাশ দিয়ে দুটো রাস্তা সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলেছে মণিমহেশের দিকে। বাঁদিকের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে যে পথে যেতে হবে, সে পথ সর্পিল রেখা হয়ে ওপরে উঠে গেছে, আর সেই পায়ে চলা পথের দুপাশে হলুদ ডেইজি ফুলের চাদর বিছানো। ভগবান বিষ্ণু নিজে হাতেই যেন তার প্রিয় বাগানবাড়িটি সাজিয়ে রেখেছেন।
সামিট রুপিন পাস
এতদূর আসা, এত কষ্ট সফল হবে যদি আজ পাস পেরোতে পারি। গাইড ভাইয়া সকলকে আজকের রাস্তা সম্পর্কে কিছু তথ্য নিয়ম বলে দিলেন। আগেই বলেছি দলে নানা বয়সী ট্রেকার আছে,আমার মেয়ে সর্বকনিষ্ঠ, যে প্রথম এই পাস অতিক্রম করবে। আজ পথ আরও বিপদসঙ্কুল, নদী ঝরনা যা দেখার হয়ে গেছে, এই উচ্চতায় যা আছে সবই জমে বরফ। পাথরের খাঁজে খাঁজে বরফ জমে আছে, পা স্লিপ করছে। সতর্কতা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। ত্রিভুজাকৃতি ভাসমান বরফের নীল জলে সাদা মুকুট পড়া পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি দেখে পা থমকে গেল। একেই বলে গ্লেসিয়াল পুল। আজ যেন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে কে প্রথম পাস অতিক্রম করবে। আমি এতে সামিল হতে পারলাম না। মেয়ের সঙ্গেই আছি। রুপিন পাসের নীচে দাঁড়িয়ে মনে হল ৭০-৭৫ ডিগ্রি খাড়া। নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে মনে হল পারব না এই ওয়ালে উঠতে, কিন্তু মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে এগোলাম, সঙ্গীসাথীরা বেশ খানিকটা উঠে গেছে। ওদের অনুসরণ করলাম। শেষ পরীক্ষায় হেরে গেলে চলবে না। ওপরে না তাকিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে উঠতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে ওপর থেকে লুজ পাথর গড়িয়ে পড়ছে তাতে আঘাতের সম্ভবনা। যথেষ্ট ঝুঁকি এ পথের। নিজের থেকেও বেশি মেয়ের কথা ভাবছি। ঈশ্বরকে স্মরণ করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। কানে আসছে উল্লাস ধ্বনি।
অবশেষে সফল হতে পারলাম। একে অপরকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত সবাই। আমার কাছে এখন অবিশ্বাস্য মনে হছে। সামান্য উপকরণ সহ পুজো হল পাসে,যদিও কোনও মন্দির বা মূর্তি নেই। বরফাবৃত ধৌলাধার রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সবাই বরফের ময়দানে বিজয় উৎসবে মেতেছেন,ফটোসেশন চলছে সঙ্গে। চার হাজার ছ'শ পঞ্চাশ ফুট উচ্চতায় আত্মবিশ্বাসী টিম একত্রে ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে উতরাই পথ ধরল।
এ পথ বেশ মজার। বরফে ঢাকা। সবাই বরফের ঢালে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এসে থামলাম অসাধারণ সুন্দর এক গ্লেসিয়াল পুলের সামনে। স্বচ্ছ জলে বরফ ঢাকা পাহাড়চূড়ার প্রতিবিম্ব ধরে রাখলাম ক্যামেরায়। আজ একবারও জ্যকেট খোলার কথা মনে হয়নি,সারাদিনই কনকনে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, আর চারদিক তো বরফে ঢাকা। ক্রমাগত পাথুরে মাটিতে হেঁটে ক্লান্ত। ঘন্টা খানেক হাঁটার পর সবুজের দেখা পেলাম,যেখানে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে সদাহাস্যময় রাজু ভাইয়া অপেক্ষা করছেন। প্রকৃতির রূপ ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে, ধূসর প্রকৃতি নানা রঙের স্পর্শে বর্ণময় হয়ে উঠছে। কাল থেকে সবাই আবার নিজের নিজের কর্মজগতে ফিরে যাবে,আজও টিমের কয়েকজন সাংলায় নেমে যাবে। তাই প্রায় সবাই আজ এগিয়ে গেছে। আমাদের বিশেষ তাড়া নেই, পাহাড়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় ভাল লাগে, ধীরে ধীরে হেঁটেও চারটের মধ্যে আজকের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আজ লোকজন অনেক কম, তাছাড়া সবাই বেশ ক্লান্ত তাই ক্যাম্প সাইট একদম শান্ত।
সাংলা ভ্যালি
শরতের ঝলমলে সোনালি সকাল। চা ম্যাগি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম দেরি না করে। ৪১০০ মিটার উচ্চতা থেকে ৩৬০০ মিটার উচ্চতায় নেমে যাব। ১২ কিমি রাস্তা উতরাই হলেও হাঁটা মুখের কথা নয়। একটানা উতরাই পথে হাঁটা বেশ ক্লান্তিকরও। আজ কোনও বিরতি নেই, অনবরত চলা। সবুজ তৃণভূমি, ঘন পাইনের জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে দুপুর দুটোয় আপেলের দেশে পা রাখলাম। কিন্নরবাসীরা সোনালি আপেল হাতে স্বাগত জানায়। দূর থেকেই তুঁতে নীল বসপা নদী ও সাংলা শহর দেখা যাছে। কিন্তু এখনও দেড় কিমি যেতে হবে নানা রঙের, নানা স্বাদের আপেল বাগিচার মধ্যে দিয়ে। একদম অন্যরকম সুন্দর এই পথ, ক্লান্তি তেষ্টা সব ভুলিয়ে দেয়। বসপা নদীতীরে অবস্থিত ছোট শৈলশহর সাংলা-র প্রেমে পড়ে গেলাম। ভিড়-কোলাহল–ব্যস্ততা এখানে কম, ট্যুরিস্টদের নিয়ে কিন্নরবাসীদের তেমন মাথাব্যথাও নেই। এখন আপেলের সিজন, এরা তাই ভীষণ ব্যস্ত। আটদিন জনারণ্য থেকে দূরে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম থাকার পর তাই আমাদের এমন ঠিকানারই দরকার ছিল। মনের মত আশ্রয়ও পেয়ে গেলাম। এবার হিমাচলের কিন্নর সার্কিট ঘুরে দেখার পালা। সে গল্প আরেক দিন।
~ রুপিন পাস ট্রেক রুট ম্যাপ ~ রুপিন পাস ট্রেকের আরও ছবি ~
নিজের সংসারকে সুন্দর করে রাখা ছাড়াও ঝুমা মুখার্জি ভালোবাসেন অনেককিছুই। তাঁর ভালোলাগা-ভালোবাসার তালিকায় বই পড়া, গান শোনা, নতুন নতুন রান্না করার পাশাপাশি রয়েছে ইন্টারনেট সার্ফ করে পাহাড়ের ছবি দেখা আর নানা ট্রেক কাহিনি পড়া। আসলে তাঁর কাছে সবার চেয়ে প্রিয় ট্রেকিং-ই। পাহাড়ের ডাকে বছরে অন্তত দুবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনই। আর এই বেড়ানোয় তাঁর সঙ্গী প্রিয়জনদের তালিকায় রয়েছে ডায়েরি আর কলমও।