স্মৃতিতে শ্যামদেশ

শ্রাবণী ব্যানার্জী


~ থাইল্যান্ডের আরও ছবি ~


কলকাতা থেকে ব্যাংকক যাত্রাকে এখন একটা দারুণ ফরেন ট্রিপ বললে অনেকে একটু মুখ টিপে হেসেই ফেলবেন হয়তো। ইদানীং বাঙালিরা প্রায় সের দরে টিকিট কেটে থাইল্যান্ড ভ্রমণে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে সেটি দিল্লি বা মুম্বাই যাওয়ারই সামিল বরং অনেক কম টাকাতেই ভালো ভালো হোটেলে থাকছেন আর ব্যুফে ব্রেকফাস্টে একেবারে আকন্ঠ খেয়ে রাস্তাঘাটে পা মাসাজ করাতে বসে যাচ্ছেন। এমন কী থাইল্যান্ডে গেলে বাংলায় লেখা 'বাঙালির গর্ব' দর্জির দোকানও দেখতে পাবেন। বাস্তবিক থাইল্যান্ডের মত সস্তায় ভালো হোটেল, মুখরোচক খাওয়া আর নানা ধরণের সুস্বাদু ফলের সম্ভার পৃথিবীতে খুব কম দেশেই আছে। তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে কিনা জানি না, এদেশের মানুষগুলিও বড় শান্তিপ্রিয় আর ব্যবহারও সুন্দর তাই একবার গেলে মনে হয় যেন বারবার এখানেই ফিরে আসি।
আমি যে যুগে প্রথম থাইল্যান্ড পাড়ি দিই সে সময়ে এখনকার মত হুট বলতে ছুট বিদেশ ভ্রমণ তো দূরের থাক সাধারণের কাছে প্লেনে চাপাটাও ছিল এক বিরাট ব্যাপার। মনে আছে ছোটবেলায় কেউ একটা বিদেশি সাবান হাতে দিলেই আনন্দে লাফাতে থাকতাম। তাই আজও সেই বহুযুগ আগে ফেলে আসা আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার দিনটি যেন চোখের সামনে ভেসে আসে। স্মৃতির পর্দাটিকে বহুক্ষণ ধরে সরালে তবেই সেখানে চোখে পড়বে উঁকি ঝুকি দিচ্ছে এক অসীম কৌতূহলী কুড়ি বছর বয়সী মেয়ের মুখ। সেটা ছিল আশির দশকের প্রথম দিক। মেয়েটি যদিও বিবাহিতা তবুও পিত্রালয়েই থাকে কারণ তার স্বামী তখন জাপানে। সাতমাস সেখানে কাটিয়ে আজকের এই ভ্রমণকাহিনির লেখিকাটিকে তিনি কলকাতা থেকে ব্যাংকক যেতে বলেছিলেন তাহলে ক'টাদিন খুব হৈ হৈ করে কাটানো যাবে। তার আগে বিদেশ ভ্রমণ তো ছেড়েই দিন জ্ঞানত কোনদিন প্লেনেই চাপিনি তাই আনন্দে একবারে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। বয়সে কুড়ি হলেও আমার সেদিনের আকৃতি প্রকৃতি কোনওটাই সে সাক্ষ্য দিত না। যাত্রার দিন পরণে ছিল সালোয়ার কামিজ আর শ্যাম্পু করা চুলে আমার দিদিমার দ্বারা রচিত মাথার দুধারে দুটি কলাবিনুনি। ওঁর ধারণা ছিল বিদেশ বিভুঁইয়ে লম্বা লম্বা বেণী ঝুলিয়ে গেলে নজর লেগে যাবার সম্ভাবনা।
প্লেনে ওঠার সাথেসাথেই আমার পাশে এক অসম্ভব কেতাদুরস্ত স্যুট পরা ভদ্রলোক এসে বসলেন। সবকিছু নিয়ে তার চেহারাটি এতটাই রাশভারি ছিল আর যেরকম খাঁটি সাহেবি ইংরেজি উচ্চারণে তিনি এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে কথা বলছিলেন যে, সেসব দেখে আর আলাপ করতে সাহস পাইনি। পোশাক বা গ্ল্যামারে একেবারে পারফেক্ট টেন। আমাকে মাথা নিচু করে পাশে বসে থাকতে দেখে হঠাৎ করেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন 'হ্যালো আই অ্যাম মিস্টার মুখার্জি'। ব্যাস্ যেই না বলা আমি আনন্দে সবকিছু ভুলে 'ওমা আপনি বাঙালি' বলে চেঁচিয়ে উঠলাম! ভদ্রলোক বেগতিক দেখে বললেন, 'তোমার বাবা-মা অন্য কোথাও বসেছেন বুঝি'? ওঁর বিশেষ দোষ ছিল না, একে তো মাথায় কলাবিনুনি তাতে আবার এতটাই রোগা ছিলাম যে বয়েস আন্দাজে আমাকে ঢের বেশি ছোট দেখতে লাগতো। রেগে গিয়ে বলেছিলাম, 'বাবা মা কেন আসবে? আমি টিন এজার নই, কুড়ি বছর বয়েস আর ম্যারেড'। ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বলেছিলেন, 'ও সরি, তবে আমার বয়স কিন্তু বিয়াল্লিশ, তাই তুমি বললাম বলে রাগ করোনি তো?' চোখ প্রায় কপালে তুলে বলেছিলাম 'ও বাবা বিয়াল্লিশ? তাহলে তো আমায় তুমিই বলবেন।' হায়, তখন কি আর জানতাম আমার জীবনেও এমন একটা দিন আসবে যখন বিয়াল্লিশের দিকেও স্নেহের চোখে তাকাতে হবে!
কথাচ্ছলে জানিয়েছিলেন, বহুদিন ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ব্রিটিশ গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কলকাতায় ফিরে গেছেন আর এখন কোম্পানির কাজে মাঝে মধ্যেই থাইল্যান্ড দৌড়াতে হয়। তখন আমার কাছে সব ল্যান্ডই ছিল ফরেন আর সেই সুবাদে ইংল্যান্ড থাইল্যান্ড তো একেবারেই ভাই ভাই। এক মুহূর্তও আর মুখ বন্ধ রেখে সময় নষ্ট করিনি, তিন ঘন্টার প্লেনযাত্রাতে দুটি ল্যান্ড সম্বন্ধেই অনর্গল প্রশ্ন করে ভদ্রলোকের মাথা প্রায় বিগড়ে দিয়েছিলাম। আশেপাশে সিট ফাঁকা থাকলে তিনি অবশ্যই সেটিকে সদ্বব্যবহার করতে ছাড়তেন না, নেহাৎ প্লেন প্রায় ভর্তি থাকায় বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে আমার প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিতে দিতে গিয়েছিলেন এমন কী চকোলেট খেতে ভালোবাসি শুনে রেঙ্গুন এয়ারপোর্ট থেকে অনেকগুলো চকোলেট কিনে উপহারও দিয়েছিলেন।
ব্যাংককে নেমে দূর থেকে এক মুখ চাপা দাড়ি, ঝাঁকড়া চুল ও চোখে গগলসসহ একটি লোককে হাত নাড়াতে দেখে ভয় পেয়ে বলেছিলাম –'দেখুন না মিঃ মুখার্জি ওই দাড়িওয়ালা লোকটা তখন থেকে আমার দিকে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে, আপনি আমাকে আমার হাজব্যান্ডের হাতে তুলে দিয়ে তবেই হোটেলে যাবেন।' তখন বিদেশে বিভুঁইয়ে বাঙালিরাই ছিল বাঙালিদের পরম বন্ধু ও রক্ষাকর্তা। অবশেষে আর একজনের সঙ্গে হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে আমার স্বামীর টনক নড়ে আর আমিও পেছন থেকে আমার নামটি শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারি। ভেবেছিলাম আমার এই লেটেস্ট পারফরমেন্সটি দেখার পর ভদ্রলোক সত্বর অদৃশ্য হয়ে যাবেন আর নিজের ব্যাচেলার থাকার সিদ্ধান্তটিকে নিজেই সাধুবাদ জানাবেন, কিন্তু বাস্তবে হল ঠিক তার উল্টো। উনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বললেন 'কাল সকালে তোমরা দুজনে তৈরি হয়ে থেকো আমি নিজে এসে তোমাদের ব্যাংকক শহরটা ঘুরিয়ে দেখাব।' আমরা তো শুনে হাঁ। এখন হলে কোনও উদ্দেশ্য আছে মনে করে ধারে কাছেই ঘেঁষতাম না, কিন্তু তখন আমাদের বয়েসটাও ছিল অতি অল্প আর যুগটাও ছিল একটু ভিন্ন।

পরেরদিন সকালেই উনি গাড়ি নিয়ে আমাদের হোটেলে চলে এলেন। সেদিন আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল রাজবাড়ি। ব্যাংককের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে চাওপ্রায়া নদী আর তার ধারেই এই রাজবাড়িটি। সতেরোশো বিরাশি থেকে উনিশশো পঁচিশ সাল পর্য্যন্ত রাজপরিবারসহ রাজা এখানেই বাস করতেন। তার আগে ব্যাংককের পাশেই আয়ুথায়াতে রাজধানী ছিল, যা কিনা অযোধ্যারই অপভ্রংশ আর তারই ইঁটপাথর দিয়ে এই রাজবাড়িটি তৈরি হয়। প্রথম রাজাকে ডাকা হত রাজা রাম বলে তাই বর্তমান রাজার নাম ভূমিবল হলেও তিনি হলেন নবম রাম। দুশো স্কোয়ার মিটার জুড়ে রাজবাড়িটা ঠিক তাক লাগানোর মত একটা বড় প্রাসাদ নয়, কেমন যেন টুকরো টুকরো ভাবে ছড়ানো, প্রতিটি রাজাই তাদের পছন্দমত কিছুটা করে বাড়িয়ে গেছেন। এখানেই প্রথম এক পিস পান্নার বুদ্ধমুর্তিটি দেখি। প্রায় ছশো বছর আগে উত্তর থাইল্যান্ডের এক মন্দিরে একটি ছোট সিমেন্টের বুদ্ধমুর্তি বাজ পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় আর তার ভেতর থেকে এই ছাব্বিশ ইঞ্চি পান্নার বুদ্ধ মুর্তিটি বেরিয়ে আসে। রাজপ্রাসাদের দেওয়ালে রামায়ণের কাহিনি আঁকা ছবিগুলো দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তখন মিঃ মুখার্জি বলেছিলেন, এদেশে দক্ষিণ ভারতের চোলা রাজবংশ অনেকদিন রাজত্ব করেছিল। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীর প্রভাবও এখানে প্রচণ্ড। সারা থাইল্যান্ড জুড়েই শিব গণেশ ও ব্রহ্মামুর্তি দেখা যায় আর এদেশের লোক তাদের ভক্তি ভরেই পুজো করে। যে কারণে ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে সমুদ্রমন্থনের সময় দেবাসুরের যুদ্ধটাও খুব সুন্দর করে দেখানো আছে।
থাইল্যান্ডের সাথে ভারতবর্ষের মিল বহু দিক থেকেই। ওরাও আমাদের মতো হাতজোড় করে নমস্কার করে আর সেই অবস্থায় মাথাটা কতটা নামাচ্ছে তার ওপরে কাকে কতটা সম্মান দেখানো হচ্ছে সেটা নির্ভর করে। এদেশে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সম্মান সবথেকে বেশি তাই তাদেরকে হাতজোড় করে 'ওয়াই' করার সময় লোকজনের মাথা একেবারে কোমরের কাছে গিয়ে ঠেকে যায়। এখানে রাস্তার নাম 'নগরীন্দ্র', হাসপাতালের নাম 'বিভাবতী', স্টেশনের নাম 'অশোক', সি-বিচের নাম 'কমলা', নারকেল হল 'নালিকিয়া', বিশ্ববিদ্যালয়কে বলে 'মহাবিদ্যালয়' আর রাজার নাম তো আগেই বললাম 'ভূমিবল'। এদেশের লোকজন প্রতিটি কথাই অত্যন্ত টেনে টেনে বলে যেমন ধরুন অশোক এর উচ্চারন হবে অশো......ক, মেয়েরা হ্যালো বললে হবে সোয়াদিকা……এই শেষে 'কা' বা 'খা' বলে টানটা এমনই জোরালো যে শুনলে লোকজনের মুখই হাঁ হয়ে যাবে।

রাজবাড়ির খুব কাছেই 'ওয়াট পো' মন্দির। মিঃ মুখার্জি বলেছিলেন, এই মন্দিরের আঙিনাতেই নাকি প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে থাই মাসাজ শেখানো হয়। চতুর্দিকে অজস্র বুদ্ধমূর্তির মধ্যে সেদিন সবথেকে বেশি দৃষ্টি কেড়েছিল ছেচল্লিশ মিটার লম্বা একটি শোয়ানো বুদ্ধমূর্তি যার সঙ্গে বিষ্ণুর অনন্তশয্যার অনেকটা মিল আছে। তার সাইজ এমনই যে মুখ থেকে পা একসঙ্গে দেখা অসম্ভব। এখানে অনেকগুলি প্রকাণ্ড গোঁফসমেত পেল্লাই চিনে মূর্তি চোখে পড়ে। তারাই যেন মন্দিরের পাহারাদারের মতো চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে।
মাত্র কয়েক মাস আগেই আবার ব্যাংকক গিয়েছিলাম আর এই ওয়াট পোর সামনেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সারাদিনের জন্য ট্যুরিষ্ট বোটের টিকিট কেটে চাওপ্রায়া নদীর আশেপাশেই ঘুরছিলাম, একসময় শোয়ানো বুদ্ধটিকে আর একবার দেখার ইচ্ছায় ওয়াট পোর সামনেই নেমে পড়লাম। প্রায় সাথেসাথেই এক ভদ্রলোক 'নমস্তে' বলে এগিয়ে এসে ছোটবেলা থেকেই তিনি হিন্দি সিনেমার কতটা ভক্ত সেটি বোঝাতে লাগলেন। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের তফাৎ থাকায় সেফ সাইডে থাকার জন্য একেবারে শশীকাপুর থেকে শুরু করে দিলেন আর আমার কাছে এসে সেটি অমিতাভ বচ্চনে শেষ হল। পাশ থেকে আমার স্বামীর স্বগোতক্তি কানে এল — কী ভাগ্যি একেবারে রাজ কাপুর থেকেই শুরু করে দেয়নি! আমাদের দেখে লোকটি বিলক্ষণ বুঝেছিল যে ছোটবেলার স্মৃতিতে অযথা শাহরুখ খান বা ঐশ্বর্য্য রাইকে টেনে এনে কোনও লাভ নেই। রাজেশ খান্না মারা যেতে দুদিন ধরে চোখের জল ফেলেছে জানিয়ে বলল, 'এখন তো আর মন্দিরে ঢুকতে পারবে না কারণ মংক-রা প্রার্থনায় বসেছেন, তাই দেড় ঘন্টা রোদে দাঁড়িয়ে না থেকে একটা 'টুকটুক্' ঠিক করে দিচ্ছি কাছেই আর একটা মন্দিরে চলে যাও।' বহুবার ব্যাংককে এসে আমরাও এখন সেয়ানা হয়ে গেছি তাই সেকথা উপেক্ষা করে সোজা মন্দিরেই ঢুকে গেলাম আর বলা বাহুল্য মংকদের প্রার্থনায় বসার ব্যাপারটা পুরোটাই ভাঁওতা। তাকিয়ে দেখি লোকটা আমাদের দেখিয়ে যেভাবে দাঁত-মুখ খিঁচোচ্ছে যার সঙ্গে ডারউইনের থিয়োরি অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষদের চালচলনের বিস্তর মিল আছে।
এই ব্যাংককেই মাত্র বছর তিনেক আগে আমেরিকান শিল্পপতি 'জিম থমসন' যিনি প্রথম থাই সিল্ককে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন তার বাড়ি দেখে ফিরছি এমন সময় রাস্তাতেই একটি লোক এসে আমাদের পাকড়ালো। একটা অটো বা টুকটুক ধরিয়ে দিয়ে থাই সিল্কের এগজিবিশনে পাঠানোর নামে প্রথমে একটি জুয়েলারির দোকানে ঢুকিয়ে দিল। সেখানে সুবিধা হল না দেখে পাশের দোকানে নিয়ে গিয়ে ভালো জিনিসের প্রতি আমার স্বামীর চোখ কতটা তৈরি ইত্যাদি বুঝিয়ে তাকে একটা বড়সড় কাঠের হাতি গছিয়ে দিয়েছিল। সেদিন কোনও রকমে তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। আমার প্রথম ব্যাংকক দর্শনের সঙ্গে আজকের এই ট্যুরিস্টঠকানো ব্যাংককের অনেকটাই তফাৎ। কী ভাগ্যিস্ মিঃ মুখার্জিকে সেই যুগে দেখেছিলাম এখন হলে নির্ঘাৎ তাঁকেও এদের দলেই ফেলে দিতাম!

সেদিন ওয়াট পো থেকে বেরিয়ে উনি আমাদের ওঁর প্রিয় একটি থাই রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। জীবনে প্রথম থাই রান্না খেয়ে এত ভালো লেগেছিল যে সেই স্মৃতি আজও আমার কাছে অতি মধুর। গ্রিনকারি, প্যাড থাই, পেঁপে মেশানো ঝাল সোমটাম্ স্যালাড, তামকা বা তমইয়াম্ স্যুপ যাই খান না কেন লেমন গ্রাস ও নারকেল দুধ দিয়ে তৈরি থাই খাবার এক কথায় অনবদ্য। সেদিনই অবশ্য থাইল্যান্ডের হকার যে কী হতে পারে সেটি দেখারও সৌভাগ্য হয়েছিল। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর সঙ্গেসঙ্গেই একটি হকার উলের তৈরি হ্যামক কেনার জন্য ঝুলোঝুলি করতে লাগল। মিঃ মুখার্জি তাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য সিকিভাগ দাম বললেন আর লোকটাও তৎক্ষণাৎ সেটিকে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পয়সা চাইল। আমরা তো দেখে থ। অগত্যা মিঃ মুখার্জি সেটিকে কিনে বললেন — 'আমি ব্যাচেলার মানুষ একা দুলে আর কী করব ভাই তোমরাই বরং এটাতে দোল খেও' বলে হ্যামকটি আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। এরপর উনি আমাদের সাড়ে পাঁচ টন সোনার বুদ্ধমূর্তি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় আটশো বছর আগে সুখোথাই রাজবংশের সময়ে এটি তৈরি হয়।
মাত্র কয়েক মাস আগেই সেই ঐতিহাসিক সুখোথাই জায়গাটি আবার দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু সে কথায় পরে আসছি। বার্মিজদের লুটের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সে সময়ে এই সোনার মূর্তিটিকে পুরু প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। আর মাত্র দুশো বছর আগে এদেশের রাজা ভেতরে সোনার অস্তিত্ব না জেনেই ব্যাংককের একটি মন্দিরে সেটিকে স্থাপনা করেন। উনিশশো চুয়ান্ন সালে মন্দির সংস্কারের সময় অত বড় মূর্তিটিকে তুলতে গিয়ে মাটিতে পড়ে প্লাস্টার ভেঙে গিয়ে ভেতর থেকে সাড়ে পাঁচটন সোনার বুদ্ধমূর্তিটি বেরিয়ে আসে। মিঃ মুখার্জি সেদিন বলেছিলেন, থাইল্যান্ডের কোনও মন্দিরে ঢুকে কোনও বুদ্ধের মুখ যদি একটু লম্বাটে বা ডিম্বাকৃতি দ্যাখো তাহলে ধরেই নিও সেটি সুখোথাই রাজবংশের সময়ে তৈরি হয়েছিল।

সেই সময়টি এখনকার মত আধুনিক টেকনোলজির যুগ ছিল না যে দ্রষ্টব্যস্থানে ঢোকার আগে একবার উইকিতে চোখ বুলিয়ে নিলে কাজ চলে যায়, তাই সেদিন ওঁর ইতিহাসের জ্ঞান দেখেও আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম। এখনকার প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই অবশ্য ইতিহাস বা জায়গাগুলি দেখার থেকে ছবিগুলোকে তাড়াতাড়ি ফেসবুকে পোস্ট করার ব্যাপারেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। লাঠির ডগায় ক্যামেরা সেঁটে অন্যদের গুঁতো মেরে সেলফি তুলত তুলতেই এগিয়ে চলেন আর দ্রষ্টব্য স্থানগুলিকে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য পেয়েও বঞ্চিত হন।
ফিরে গিয়ে আবার দেখা হবে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিঃ মুখার্জি সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বিদায় নিলেও তারপর যে দেড়বছর কলকাতায় ছিলাম ওঁর সঙ্গে আর একবারের বেশি দেখা হয় নি। কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় ওঁর ফ্ল্যাটে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম আর সেখানেই উনি বলেছিলেন 'ভবিষ্যতে নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে আমার মতো অনেক নতুন মানুষের সাথে তোমার আলাপ হবে, কিন্তু পথের আলাপ পথেই শেষ করে দিও। রাস্তায় অল্প সময়ে দেখে যাকে ভালোলাগে তাকে কাছ থেকে দেখলে ভালো নাও লাগতে পারে।' আমরা তাঁর কথা রেখেছিলাম। যদিও সেদিনের সেই মেয়েটি আজ এত বছর পরেও তার পথে আলাপ মিঃ মুখার্জিকে ভোলেনি।
পরেরদিন আমরা ব্যাংককের কাছে পাতায়া সি-বিচে গিয়েছিলাম। আজকের ঘিঞ্জি পাতায়ার সঙ্গে সেদিন সুন্দর পাতায়ার বহুদিক থেকেই অমিল। সে যুগে এদেশের প্রায় প্রতিটি সমুদ্রতটেই ছিল এক বিশেষ শ্রেণীর মেয়েদের আনাগোনা। ট্যাক্সিতেও বড় বড় অর্ধনগ্ন মেয়েদের ছবি রাখা থাকত আর প্রায় চতুর্দিকেই চোখে পড়ত বিদেশি ছেলের সঙ্গে হাত ধরে চলেছে এদেশীয় মেয়ে। ভাবতে অবাক লাগে তার মাত্র কয়েক মাস আগেও আমার আধা মফঃস্বলি মানসিক গঠনে তরুণ-তরুণীরা এক ঘরে থাকলেই তাদের বিবাহিত দম্পতি বলে ধরে নিতাম, তাই এখানে একটা মজার ঘটনা না জানিয়ে পারছি না। আমার স্বামী জাপান থেকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, 'কাজু হিকো' নামে ওঁর এক ঘনিষ্ট জাপানি বন্ধু কলকাতায় বেড়াতে যাচ্ছে তাই আমি যেন তাকে বাড়িতে ডেকে এনে যত্ন করে খাওয়াই আর কিছু ভালো উপহার দিই। একটি মেয়ে সমেত কাজুকে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেই অবধারিতভাবে তাকেই কাজুর বউ ধরে নিয়ে একটি ওয়াল হ্যাংগিং, ছোট নটরাজ মূর্তি আর দু প্যাকেট লপচু চা দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করেছিলাম। উপহারগুলো পেয়ে তার 'বউ' আহ্লাদে আটখানা হয়ে কতবার আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো সেই বর্ণনাসমেত চিঠি পেয়ে আমার স্বামীর তো একে,বারে মাথায় হাত। বউ তো দূরে থাক দুদিন আগেও কাজুহিকো মেয়েটিকে চিনতো না শুধু ভারতবর্ষ যাওয়ার খাতিরে তাকে সাময়িক ভাবে জুটিয়েছিল। অন্যদিকে আমার মা তখন কাজুকে হাত মুখ নাড়িয়ে লুচি খাওয়ার পদ্ধতিটা বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু তাতেও সে বাগে আনতে পারলোনা দেখে ধৈর্য্য হারিয়ে নিজেই মাঠে নেমে গেলেন। লম্বা বেগুনভাজাগুলোকে পুর হিসাবে ব্যবহার করে পাটিসাপটার স্টাইলে লুচি পাকিয়ে কাজুর মুখে গুঁজে দিতে লাগলেন আর তার সঙ্গে মুখে টপাটপ পড়তে লাগল আলুর দমের আলু। মা ছিলেন স্কুলের কড়া হেডমিস্ট্রেস্, তাই সেদিন কাজুহিকোর করুণ কাকুতিমিনতিও ওঁর হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। তখন কি ছাই জানতাম যে জাপানিরা একেবারেই মিষ্টি পছন্দ করে না! সবশেষে এক বাটি কড়া রাবড়ি পেটে পড়ার পর তারা সেই যে বেগে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর ওমুখো হয়নি।

সেবার ব্যাংকক থেকে প্লেন নিয়ে আমরা ফুকেৎ সি-বিচে গিয়েছিলাম, সে সময় ফুকেৎ ছিল অত্যন্ত ফাঁকা ফাঁকা। মনে আছে সাঁতার না জেনেও প্রচণ্ড জোরে স্পিড বোট চালাতে গিয়ে আমরা দুজনেই সমুদ্রে উল্টে পড়ি আর বেশ কিছুটা নোনা জল খাওয়ার পর লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করে। কিছু বছর আগে ফুকেতে 'ফ্যান্টসী' দেখতে গিয়েছিলাম যেখানে থাইল্যান্ডের দর্শনীয় স্থানগুলির মিনিয়েচার ভার্সান রাখা আছে আর তার সঙ্গে সারাক্ষণই চলেছে থাই নাচের প্রদর্শনী। এই ফুকেতেই আমি জীবনে প্রথমবার থাই মাসাজের আস্বাদ পাই। গোটা থাইল্যান্ড জুড়েই মাসাজের জায়গার ছড়াছড়ি আর তাদের পদ্ধতিও প্রায় এক। কোথাও সারা গায়ে গোলাপ জল ছিটিয়ে বা তেল মাখিয়ে মাসাজ করছে, কেউ বা পিঠে কড়কড়ে বালির মত পদার্থ ঢেলে ঝামা ঘষে যাচ্ছে আর কেউ কেউ বা ঠাণ্ডা দই আর সুগন্ধী মশলা ঢেলে সারা বডিটাকেই ম্যারিনেট করে দিচ্ছে।
মাত্র বছরখানেক আগে ব্যাংককের হেলথল্যান্ডে মাসাজের জন্য ঢুকেছিলাম। দুঃখের বিষয় সবার হাত সমান মোলায়েম নয়, আমারটি আবার দেখলাম বেশ কিছু বিভিন্ন সাইজের কাঠের হাতুড়ি নিয়ে সামনে বসে গেল। কখনও মাসাজের নামে কনুই দিয়ে গুঁতো মারে আর কখনও বা সাঁড়াশির মত আঙ্গুল দিয়ে হাত পা টানতে থাকে। মাঝে মধ্যেই শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টগুলো হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে দিচ্ছিল আর আমিও প্রতিবার লাফিয়ে লাফিয়ে জানিয়ে দিচ্ছিলাম আমি তখনও জীবিত। এক সময় দেখি আমার পাশের মহিলার পিঠে একটি মেয়ে মাসাজের নামে নেচে যাচ্ছে, পৃথিবীতে সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয় যে পিঠে মানুষ চাপলো না মশা চাপলো তার তফাৎই ধরতে পারে না, তাই ভয়ে কোনও রকমে সেদিন আমারটিকে পিঠে ওঠা থেকে নিরস্ত করেছিলাম।
মাসকয়েক আগের ভ্রমণে প্রথমবার ব্যাংকক থেকে সাতশো কিলোমিটার উত্তরে চিয়াংমাই অঞ্চলটি দেখতে যাই। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা হলেও এটি সমতলে অর্থাৎ ভ্যালিতে অবস্থিত। স্বপ্নেও ভাবিনি এখানে এরকম দলে দলে বিদেশি ছেলেমেয়েদের দেখতে পাব। তারা ঝাঁকে ঝাঁকে সাইকেল বা বাইক চালিয়ে আসছে আর রাস্তার ধারে বসে ফুর্তিতে থাই খাবার খেয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার ভাতের ওপর ক্ষিরের মত ঘন দুধ, আম আর বাদাম দেওয়া ম্যাংগো স্টিকি রাইস নিয়ে পথেই বসে গেছে। বেশিরভাগই জলের বদলে ডাব খাচ্ছে আর কেউ কেউ বা রামবুতান ফলটিকে মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে মুখে পুরছে। এই ফলটি খেলে মনে হবে একেবারে লিচু খাচ্ছেন। এছাড়া লাল ড্রাগন ফল, আম, আনারস, পেঁপে, ডাঁসা পেয়ারার তো ছড়াছড়ি। কয়েকটি আমেরিকান ছেলেকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল, তারা বাইক নিয়ে পাহাড় ও জঙ্গলে ট্রেক করতে চলে যায়, এখান থেকে সমুদ্রের ধারে ক্রাবিতে যাবে আর সেখানে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে তবে দেশে ফিরবে।
চিয়াংমাই-এ চারিদিকেই মন্দির তাই ছোটখাটো পোশাক পরে ভেতরে ঢোকা নিষিদ্ধ, সেফ সাইডে থাকার জন্য প্রায় প্রতিটি ট্যুরিষ্টই দেখলাম একটি করে পাতিয়ালা স্টাইলের হাতিয়ালা প্যান্ট কিনে নিয়েছে। পায়ের গোড়ায় জোরালো ইলাস্টিক্ থাকায় দৈত্যদানব থেকে লিলিপুট সবার পায়েরই কোনও না কোনও স্থানে সেটি চেপে বসে যাবে, লুটিয়ে পড়ার চান্স নেই। মধ্য প্রদেশের ওঠা নামা নিয়েও মাথা ঘামানোর ব্যাপার নেই কারণ কোমরে অপর্যাপ্ত কাপড় ও দড়ি সহ প্যান্টগুলি জাপানের 'সুমো' রেসলার থেকে স্বর্গতা 'মেরিলিন মনরো' সবার কোমরের কথা স্মরণে রেখেই তৈরি করা হয়েছে। এ একেবারে অল পারপাস্ ক্রিম। মন্দিরে ঢোকা থেকে হাতির পিঠে চাপা সবেতেই কাজে লেগে যাবে চিন্তা করে আমিও গোটা দুয়েক প্যান্ট কিনে নিলাম।

প্রায় আটশো বছর আগে লানা রজ পরিবার এই চিয়াংমাই শহরটি তৈরি করে। বার্মিজ আক্রমণের ভয়ে তারা প্রথমেই জায়গাটিকে উঁচু পাঁচিল আর পরিখা দিয়ে ঘিরে দেয়। এর ভেতরে প্রায় গোটা তিরিশেক বুদ্ধ মন্দির দেখা যায়। আমাদের দেশের পাড়ায় পাড়ায় শিবমন্দিরের মতো এখানেও দুপা এগোলেই একটি করে মন্দির আর সেগুলি লাল কালো পাথরের ওপর সোনালি কাজ দিয়ে সাজানো যা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এই মন্দিরগুলিতে রাস্তার কুকুরদেরও কেউ দূরছাই করেনা বরং তাদেরকে খুব যত্ন করে থালাতে খেতে দেয়। আমাদের দেশের মন্দিরের মত এখানে পান্ডাদের অত্যাচার নেই, তাই সেই সুন্দর শান্ত পরিবেশে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের স্তব শুনতে শুনতে আপনা থেকেই কেমন যেন শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে আসে। আমেরিকান ছেলেমেয়েরাও দেখলাম হাঁটু মুড়ে হাতজোড় করে বুদ্ধ মূর্তিগুলির সামনে বসে আছে। এখানে একটি নির্দিষ্ট রুটে 'সংথাও' বা রেড ট্যাক্সি যাতায়াত করে আর সেরকমই একটি নিয়ে আমরা পরের দিন আধঘন্টা দূরে পাহাড়ের ওপর 'দয় সুতেপ' এর বুদ্ধ মন্দিরে পৌঁছে গেলাম। তিনশোটা সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে ওঠার সময় মাঝে মধ্যেই মেঘ এসে শরীর ঢেকে দিচ্ছিল, তবে আমাদের বরাত ভালো কিছুক্ষণের মধ্যেই রোদ ওঠায় সেই সোনার রঙের মন্দিরগুলো যেন আলো পড়ে একেবারে ঝলমল করে উঠল। ঢোকার মুখে জুতো খোলার সময়ে একটু ভয়ে ভয়েই ছিলাম কারণ গতবার আদ্যাপীঠে আমার অমন সাধের চটিজোড়া কেউ নিমেষের মধ্যেই চক্ষুদান করে দেয়। এখানে সেটি হলে খালি পায়ে তিনশো সিঁড়ি নেমে আধ মাইল পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে হবে চিন্তা করেই গায়ে জ্বর এসে গেল। অতএব ভগবান বুদ্ধকে স্মরণ করে জুতোজোড়াকে একটু দূরে সরিয়ে রাখলাম। শোনা যায় সাতশো বছর আগে একটি শ্বেত হস্তী এই পাহাড়ের ওপর এসে তিনবার ডেকে মারা যায়, তখনকার রাজা তেরশো তিরাশি সালে পাহাড়ের ওপর মন্দিরটি তৈরি করেন। চতুর্দিকে সোনালি রঙয়ের চাঁদোয়া, স্তুপ, অজস্র বুদ্ধ মূর্তি ও ছোট ছোট মন্দির নিয়ে জায়গাটি এক কথায় অত্যন্ত ঝলমলে। আমিও মোমবাতি জ্বালিয়ে ও একটি পদ্মফুল ভগবান বুদ্ধের পায়ে রেখে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাইরে এসে দেখলাম আমার জুতোজোড়া স্বস্থানেই বিরাজ করছে।

চিয়াংমাই-এর চারিদিকেই পাহাড় আর জঙ্গল আর সেরকম একটি জায়গায় মেসা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। হাতিদের ফুটবল খেলা দেখে আনন্দ পেলেও সব থেকে অবাক হয়েছিলাম তাদের ছবি আঁকা দেখে। নিজের চোখে না দেখলে সেই সুন্দর গাছ ও ফুলের ছবিগুলি হাতির আঁকা বলে হয়ত বিশ্বাসও করতাম না। কারোর যদি জীবনে মাহুত হবার বাসনা থেকে থাকে তাহলে এখানে তিনঘন্টার একটি কোর্স নিয়ে সেই সখটাও মিটিয়ে নিতে পারেন। ট্যুরিষ্টরা প্রথমে হাতিগুলোকে ভালো করে খাইয়েদাইয়ে নদীতে স্নান করতে নিয়ে যাবেন আর সবশেষে হাতিগুলোর গায়ে ভালো করে পাঁক ও ধুলোর প্রলেপ লাগিয়ে তাদেরকে পোকার হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবেন। সকালে কয়েকটি আমেরিকান ছেলে-মেয়েকে সেখানে ঢুকতে দেখেছিলাম কিন্তু তিনঘন্টা পরে শ্বেতবর্ণ ছেলেমেয়েগুলিকে আপাদমস্তক কাদায় মোড়া ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণে রূপান্তরিত হতে দেখে আমার টেম্পোরারি মাহুত হবার বাসনা একেবারে পার্মানেন্টলিই উবে গেল। সেই পাহাড়ি অঞ্চলে হাতির পিঠে চেপেও এক বিপত্তি। হাতি পাহাড়ে উঠলে আমরাও পেছন দিকে হেলতে থাকি আবার খাদে নামলে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি। সেখান থেকে গেলাম অর্কিড আর প্রজাপতির ক্যাম্পে। অর্কিডের যে এতরকমের রঙ হতে পারে এখানে না এলে হয়তো অজানাই থেকে যেত। পাহাড়, ঝরনা আর চারিদিকে ফুল নিয়ে জায়গাটা সত্যিই বড় সুন্দর। এর পাশেই বাঁদরদের ক্যাম্প ছিল কিন্তু আমার স্বামী পয়সা খরচ করে বাঁদর দেখতে রাজি হলেন না কারণ ওঁর গ্রামের বাড়িতে তেনারা প্রতিদিন ফ্রিতেই দর্শন দিয়ে যান। বাঘের ক্যাম্পও এখানে বিদ্যমান যদিও চালচলনে তারা বেড়ালেরই নামান্তর কারণ অতি অনায়াসে তাদেরকে কোলে বসিয়ে মস্তক আঘ্রাণ করে মুখ চুম্বন করা যায়। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে আফিম্-এর এফেক্টে তারা নাকি ঝিম মেরে থাকে।
এখানে বেশ কয়েকদিন থাকায় আমরা দুবেলাই 'গ্রিন বামবু' নামে একটি মাসাজের জায়গায় যাতায়াত শুরু করেছিলাম। নামটা যতই উৎকটই হোক একমাত্র এরাই আমাকে কোন বাঁশই দেয়নি। বশিষ্ঠ বা দুর্বাসা মুনির স্টাটাস না থাকলেও ঢোকার সঙ্গেসঙ্গেই বালি ও মধু দিয়ে আমাদের চরণযুগল ধুইয়ে দিত। এদের মাসাজের পদ্ধতি এতটাই আরামের যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আশপাশের ঘর থেকে তীব্র নাসিকা ধ্বনি কানে আসত। আমি আবার এই মাসাজ-এর সময়ে ঘুমিয়ে পড়ার পক্ষপাতী ছিলাম না। দুবেলা যাতায়াত করাতে ওরা আমাদের দশ পার্সেন্ট করে ডিসকাউন্ট দিতে শুরু করেছিল, পাশের মহিলার দেখাদেখি আমিও আরও কিছুটা কমানোর ইচ্ছায় ছিলাম কিন্তু আমার স্বামী নিষেধ করলেন। ওঁর মতে বেশি বার্গেইন করতে গেলে হয় মাসাজের নামে ঠেঙিয়ে দেবে নয়ত সাঁড়াশির মত আঙুল দিয়ে গলা টিপে ধরবে। পৃথিবীতে কিছু কিছু ব্যাপারে নাকি একেবারেই বার্গেইন করা উচিত নয়!
দিন পাঁচেক চিয়াংমাই-এ কাটিয়ে ফিৎসানলো যাবার প্লেন ধরলাম। দিনে একটি মাত্র প্লেন সেখানে যায় তাই 'কান' এয়ার ছাড়া আর কোনও গতি নেই। প্লেনের সাইজ দেখে ভয়ে আমার মত প্রাণীরও মুখ বন্ধ হয়ে গেল। সিটের সংখ্যা দশ তারমধ্যে আবার প্রথম দুটি পাইলট ও কোপাইলটের জন্য সংরক্ষিত। পাইলটই আমাদের হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে পেছনে রেখে দিলেন। এমন সময় দেখি একটা লোক শাকপাতা সমেত একটি বোঁচকা হাতে প্লেনের গায়ে ধাক্কা মারছে। পাইলট চট করে ভেতরটা দেখে নিয়ে ফুল বলে জানিয়ে দিল অর্থাৎ দশজন হয়ে গেছে। অবশেষে প্রচুর আওয়াজ করে প্লেনটি যে হাইটে চলতে শুরু করল তাতে দেখলাম নীচে কিছু ছেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াচ্ছে আর আমার পেছনে বসা বিদেশি মেয়েটি তাদের দিকে ফ্লাইং কিস্ ছুঁড়ে দিচ্ছে! চারদিকে পাহাড় থাকলেও তখনও ভ্যালিতেই ছিলাম তাই প্লেন কোন উচ্চতায় যাচ্ছে সেদিকে মাথা ঘামাইনি কিন্তু সামনে পাহাড় এগিয়ে আসতে দেখে রীতিমত ভড়কে গেলাম। পাশ থেকে আশ্বাসবাণী কানে এল 'ভয় নেই, পাহাড়ে গিয়ে গুঁতো মারবে না, দেখবে ঠিক টপকে যাবে'। হঠাৎ খেয়াল করলাম পাইলটের ঠিক পিছনেই একটা ষন্ডাগুন্ডা মত লোক বসে, দুজনের মধ্যে দরজা তো দূরের থাক কোনও কাঁচের ব্যবধানও নেই। আধা-ঘুমন্ত বেটার হাফকে ধাক্কা মেরে বললাম 'পেছনের ওই লোকটা যদি খুব জোরে পাইলটের মাথায় মারে তাহলে কী হবে'? ঘুমজড়িত কন্ঠে আবার সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, 'কী আর হবে, তবে ও নিয়ে কিছু চিন্তা কোরো না তুমি, আসার আগে ছেলেকে কোথায় কী রাখা আছে খুব ভালো করে বুঝিয়ে এসেছি যাতে না ফিরলে কোনও অসুবিধাই না হয়' বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। অবশেষে আমাদের সেই পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মহাযাত্রাটি শেষ হল আর আমরাও এক পিস-এ ফিৎসানলো পৌঁছে গেলাম।

পরের দিন খান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঐতিহাসিক সুখোথাই দেখতে গিয়েছিলাম। আটশো বছর আগে রাজা ইন্দ্রাদিত্যের আমলে এটাই ছিল থাইল্যান্ডের রাজধানী। তাঁর পুত্র রাজা রামখামহে-এর সময়ে জায়গাটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। সে সময়ে প্রজারা এতটাই সুখে ছিল যে তারাই এই নগরটির নামকরণ করে 'সুখথাই'। সুখের কারণটিও সুন্দর লেখা আছে — সেদিন প্রজাদের পুকুরে মাছ ছিল, গোলাভরা ধান ছিল আর এই আমলে তারা কোন যুদ্ধবিগ্রহের মুখ দেখেনি তাই সবাই বড় সুখে শান্তিতে দিন কাটিয়েছিল। ব্যাংককে রাখা সেই চোখ ধাঁধানো সাড়ে পাঁচ টন সোনার বুদ্ধমূর্তিটিও এই রাজারই অবদান। সবুজ ঘাসে মোড়া আর বড় বড় গাছে ছাওয়া দু'কিলোমিটার বিস্তৃত ঐতিহাসিক জায়গাটি সত্যিই বড় স্নিগ্ধ। দূরে জলের ধারে আমগাছগুলির তলায় আজও বিশ্রাম নিচ্ছে গরুর দল, সব মিলিয়ে এ যেন এক আশ্রমের পরিবেশ। তারই মাঝে মাঝে ছড়িয়ে আছে বড় বড় বুদ্ধমূর্তি, অজস্র মন্দির আর রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। একদা যে স্থানে সোনার বুদ্ধের পুজো হত আজ তার ছাদ থেকে ঝোলে অসংখ্য বাদুড়, এর থেকে বড় ট্রাজেডি আর কি হতে পারে? আটশো বছর আগের সেই প্রাণবন্ত নগরীটি আজ যেন এক ঘুমন্ত পুরী। যদিও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতে, " As a well spent day brings happy sleep so a life well used brings happy death" - তবুও মনটা একটু ভারাক্রান্ত হয়েই রইল।
সব থেকে বেশি নজর কাড়ে মহাঠাট মন্দির। মন্দিরের বিশালতা এমনই যে ভগ্ন অবস্থাতে দেখলেও বিস্ময় লাগে! বিভিন্ন বুদ্ধমূর্তির সঙ্গে দুটি বারো মিটার উঁচু দাঁড়ানো বুদ্ধমূর্তিও চোখে পড়ে। একদা এখানেই ছিল রাজা ইন্দ্রাদিত্যের প্রাসাদ যা কিনা আজ প্রায় ধ্বংস। সেই ভগ্ন প্রাসাদে বসে আমিও যেন কল্পনায় সেদিনের সেই সুখোথাই-এর সুখী মানুষগুলিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তারা যেন ভালোবেসে আনন্দ করে ফুলের ডালি হাতে এগিয়ে চলেছে ভগবান বুদ্ধের মূর্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে।
আজও তো সেই বৌদ্ধবিহারগুলি দাঁড়িয়ে আছে। শুধু সেদিনের সন্ন্যাসীরা নেই, একদা যাদের সুললিত কন্ঠে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হত সেই অতি পরিচিত সুর—

বুদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি
ধম্মং স্মরণং গচ্ছামি
সঙ্ঘং স্মরণং গচ্ছামি...


~ থাইল্যান্ডের আরও ছবি ~


শ্রাবণী ব্যানার্জীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher