ত্রিবেণী তীর্থপথে
উদয়ন লাহিড়ি
ওপরে সবুজ আর নীচে হলুদ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন খৈনি পিষছে। আরেকজন দেখলাম জানালা দিয়ে যতটা সম্ভব মুখ বার করে বলল "ওয়াক থু"। এরই নাম লোকাল ট্রেন। তাতেই সবাই উঠে পড়লাম। যাব কল্যাণী হয়ে ত্রিবেণী। হাওড়া থেকেও বর্ধমান কাটোয়া লাইনের ট্রেন ধরেও যাওয়া যায় ব্যান্ডেল। ওখান থেকে ত্রিবেণী। আমরা যাচ্ছি শিয়ালদহ হয়ে। মাত্র ৪৮ কিমি দূরে কল্যাণী। কল্যাণী থেকে ম্যাজিক গাড়ি ধরে ত্রিবেণী - উদ্দেশ্য এই অঞ্চলের তিন ধর্মের প্রধান স্থাপত্যগুলো দেখা।এখানে খ্রিস্টান, মুসলিম এবং হিন্দু ধর্মের যেভাবে মেলবন্ধন হয়েছে তার নিদর্শন অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ আছে। প্রকৃত অর্থেই ত্রিবেণী। জাফর খান গাজীর দরগা, হংসেশ্বরী মন্দির, অনন্ত বাসুদেব মন্দির, বিখ্যাত ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবাড়া। তিনটি ধর্মের বিখ্যাত এতগুলো স্থাপত্য একেবারে এক দিনে দেখে ফেলা - আজ ২৬ জুন,২০১৬।
আমার মনে হয়, এই সব জায়গা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করতে তিনটে ব্যাপার জানা দরকার - পৌরাণিক, স্থানীয় ইতিহাস আর কিছু লোকশ্রুতি। যে কটা জায়গায় গেলাম তার সম্পর্কে এই সব ঘটনা ঘাঁটবার কিছুটা চেষ্টা করেছি। কিছুটা আন্তর্জাল, বাকি বই আর খানিক স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলে সংগৃহিত। তথ্যের ভুল বা কোথাও আমার বোঝার ভুল হলে মার্জনা করবেন। আর শুধরে দিলে আমার স্বল্প জ্ঞানে কিছু আলোর ছিটে লাগবে।
ট্রেন চলেছে। গাছপালা সব পেছনে সরে যাচ্ছে। পৃথিবীকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবার আনন্দে বাইরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি। দলের বাকিরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মশগুল।আমার সে দিকে নজর নেই। মনে হচ্ছে, ট্রেনটা যেন একটা টাইম মেশিন - নিয়ে চলেছে শত শত বছর আগের এক যুগে। যেখানে আমি একজন অত্যন্ত আধুনিক মানুষ - বিজ্ঞান চিন্তা, পোশাক-আষাক, মোবাইল সবকিছু নিয়ে। এই গর্ব যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না, একটু গভীর চিন্তা করেই বুঝলাম। আজ যে সব স্থাপত্য দেখব, সেই রকমটি কই আজকের স্থপতিরা তো তৈরি করতে পারেন না। কই সেই অপূর্ব কারুকার্য,যা আজকের শিল্পীরা বানাতে পারেন না।এই স্থাপত্যগুলির যে গল্প কই আজকের সাহিত্যিকরা তো লিখতে পারেন না। আধুনিকতায় কে জিতবে আর কে হারবে সেই দোলাচল নিয়ে দেখতে চললাম সেই সব স্থাপত্য যা আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পরও একই রকম থেকে যাবে। আমার পরের প্রজন্ম আবারও হয়তো লিখবে পুরানো সেই দিনের কথা, বারবার।
ট্রেনটা ভীষণ ব্রেক কষে জাড্য ধর্ম অনুযায়ী স্থিতিশীল বস্তুতে রূপান্তরিত হল আর আমিও দুম করে বাস্তবে এসে পড়লাম। কল্যাণী স্টেশন – হিসেবমত বর্ষা কাল। কিন্তু প্রখর রোদ্দুর পুড়িয়ে দিচ্ছে, এদিকে নীল আকাশে মেঘের ভেলা। তারমধ্যে ঘামে জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে। কল্যাণী স্টেশন থেকে যাচ্ছি ত্রিবেণী। একটা ম্যাজিক গাড়ি পেলাম।
হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মা নাকি ঠিক করেন এখানেই তিনি দ্বিতীয় কাশী বা বেনারস বানাবেন। কিন্তু শিব কিছুতেই তা করতে দেননি। না হলে এটাই হয়তো আর একটা বেনারস হত। প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। এত মন্দির এখানে ছিল যে ত্রিবেণীর নাম দেওয়া হয় তীর্থরাজ।
ত্রিবেণীতে দেখার মত হল বেণীমাধব মন্দির। মকরসংক্রান্তিতে খুব ভিড় হয়। কথিত আছে এখানেই কোনও এক কালে নাকি গঙ্গা যমুনা আর সরস্বতী মিলে গিয়েছিল। তাই থেকেই নাম হয় ত্রিবেণী। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা অনেক চেষ্টা করেও যমুনার কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। তার বদলে রয়েছে বিদ্যাধরী নদী। সরস্বতী নাকি এখনও আছে যদিও সেটা খাল ছাড়া কিছু নয়, পানাতে ভরে গেছে। দেবানন্দপুরে গেলে দেখা যাবে মজে যাওয়া সরস্বতী নদী। পুরাণ আর ইতিহাসের মধ্যে বেশ ঝগড়া আছে মনে হচ্ছে।
কিন্তু শুধুই কি মন্দির! আছে মসজিদও। অসাধারণ স্থাপত্য তার। জাফর খান গাজীর মসজিদ। কল্যাণী স্টেশন থেকে প্রথমেই পড়বে ঈশ্বর গুপ্ত ব্রিজ। এখানে নদীর সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবার মতো। ভীষণ জ্যামে আটকে ছিলাম বলেই দেখতে পেলাম ব্রিজের ওপর থেকে গঙ্গা। দেখলাম বালি মাফিয়ারা কিভাবে নদীর বালি তুলে নিচ্ছে। নদীর বালি তুলে নিয়ে কী সর্বনাশ যে এরা ডেকে আনছে সেটা একজন বিজ্ঞানীই সঠিক ভাবে বলতে পারেন। ঈশ্বর গুপ্ত ব্রিজ পেরিয়ে ত্রিবেণীর অন্যতম আকর্ষণ এই মসজিদ।
মসজিদটা আয়তক্ষেত্রাকার। ইট আর পাথরের তৈরি। এই জায়গাটা ছিল আদি সপ্তগ্রামের অংশ। সাল ১২৯৮। জাফর খান গাজী সপ্তগ্রাম আক্রমণ করলেন। রক্তে লাল হয়ে উঠল মাটি।তৎকালীন হিন্দুরাজ ধর্মপালকে হত্যা করলেন গাজী। বহু মন্দির ধংস করলেন। সেই বছরই এই মসজিদটি তৈরি করেন জাফর খান গাজী। সমস্ত মন্দিরের ভাঙা অংশ দিয়ে তৈরি হল এই মসজিদ। গাজী ছিলেন দিল্লির সুলতানের সৈন্যদলের দলপতি। এই মসজিদের মূল মিরহাবের ওপর আরবি ভাষায় খোদাই করা একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়। আসল ও পুরাতন মসজিদটির দশটি গম্বুজ ছিল। ছয়টি কোনোরকমে টিঁকে আছে। শিলালিপি থেকে এও জানা যায় এই মসজিদটি কোনও এক কালে মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহার হত। কথিত একটি কৃষ্ণ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর তৈরি হয় এই মসজিদ। এখানে যিনি পীর আছেন তিনি নাকি আগে সূর্য প্রণাম না করে নামাজ পড়েন না। মসজিদের মূল প্রার্থনাস্থলের প্রবেশ পথটি পাঁচখিলানযুক্ত এবং পাথর আচ্ছাদিত। ছাদহীন ভিতরের প্রার্থনাকক্ষের সুদৃশ্য অলঙ্করণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রার্থনাকক্ষ দেখে বুঝলাম এটা শুধু মসজিদ নয়, দরগাও বটে। উঁচু রাস্তাটির পাশে সাবেকি বাতিদানগুলো পথের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। রাস্তাটি মসজিদের পাশ দিয়ে গোল করে ঘুরে গেছে। এ পথে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ে হুগলী নদী।
ছাদহীন জাফর খাঁ গাজীর সমাধি সৌধটি ১৩১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। শোনা যায় রাজস্থানের বাঘা মসজিদের স্থাপত্যের অনুকরণে করা। সম্ভবত পাথরগুলি আনাও হয়েছিল রাজস্থান থেকেই। সবই আগ্নেয় পাথর বা ব্যাসল্ট। বাকিটা হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসপ্রাপ্ত ইট, কাঠ আর পাথর। গোলাপি রঙের পাথরও দেখলাম।
ত্রিবেণী আর বাঁশবেড়িয়া পাশাপাশি। বাঁশবেড়িয়াও মন্দির-অধ্যুষিত গ্রাম। প্রচুর টেরাকোটার কাজ। একসময় নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং উৎসাহিত হয়ে নন্দলাল বসুকে দায়িত্ব দেন টেরাকোটার মন্দিরগুলির দেওয়ালে যে শিল্পকর্ম বা কারুকার্য আছে তা নথিভুক্ত করবার। নন্দলাল বসু এই নির্দেশ পালন করেছিলেন বলেই শোনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই নথি কোথায়? এর কোনও উত্তর পাইনি।
বাঁশবেড়িয়া ইতিহাসের পাতায় উঠে আসে শাহজাহানের সময়ে। তখন সালটা ছিল ১৬৫৬। শাহজাহান পাটুলির রাঘব দত্তরায়কে যে জমির জমিদার হিসাবে নিযুক্ত করেন সেটাই বর্তমানের বাঁশবেড়িয়া। কথিত আছে রাঘব দত্তরায়-এর ছেলে রামেশ্বর দত্তরায় একটা বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত বাঁশবনকে পরিষ্কার করে তৈরি করেন একটা দুর্গ,দত্তরায়দের প্রাসাদ আর বাংলার দুটি মৌলিক স্থাপত্য সৃষ্টি - একটি হংসেশ্বরী মন্দির আর অন্যটি অনন্ত বাসুদেব মন্দির। সেই বাঁশবন থেকেই সম্ভবত এর নাম বাঁশবেড়িয়া। বাঁশবেড়িয়া আদি সপ্তগ্রামেরই আর একটি অংশ ছিল। সেই সময় এই গ্রাম ছিল একটি নাম করা বন্দর এবং ব্যবসা বাণিজ্যের পীঠস্থান।
অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটি তৈরি করেন রামেশ্বর দত্তরায়। কৃষ্ণের মন্দির।১৬৭৯ সাল। এই মন্দিরের তিনটি দিকে আছে অসাধারণ টেরাকোটার কাজ। আর একটা দিক নিরাভরণ। অষ্টভুজ চিলেকোঠাটিতে টেরাকোটার কাজ অসাধারণ। বিভিন্ন দেবদেবী, নরনারীর প্রেম আর যুদ্ধের ছবি আঁকা আছে এইসব দেওয়ালে।
রাঢ় বাংলা যেমন মল্লভূমি। তেমনি বলা যেতেই পারে বাঁশবেড়িয়া হলো দত্তরায়ভূমি। বাংলার বাইরের স্থাপত্যে প্রচুর পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। পাথরের তুলনায় মাটি সহজলভ্য হওয়ায় বাংলায় ব্যবহার হতো পোড়ামাটি। পাথরের মতো শক্ত, আর সুন্দর কারুকার্য করা যায়। টেরাকোটার প্রচলন হয় ইতালিতে। 'বেকড আর্থ' পরে নাম বদলে টেরাকোটা। কিন্তু এটা বলতে কোনও বাধা নেই যে বাংলার টেরাকোটার সমৃদ্ধ কাজের খ্যাতি জগতজোড়া।
প্রচলিত গল্পকথা বলে, একদিন গভীর রাতে নৃসিংহ দত্তরায় স্বপ্নাদেশ পান যে দেবী হংসেশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৬৭৩ সালে মন্দিরটি তৈরি করা শুরু করলেও তাঁর অকালমৃত্যুতে মন্দিরটি শেষ করেন বিধবা রানি শঙ্করী। পাশেই অনন্তবাসুদেব মন্দির। মন্দির কমপ্লেক্সের বাইরে সোয়ানভাবা কালী মন্দির। মন্দির কমপ্লেক্স ঘিরে একটি পরিখা রয়েছে। এটাতে নাকি লঞ্চ চালু হয়েছিল। জেটিগুলো এখনো আছে। তবে লঞ্চ এখন আর চলে না। এটাও নৃসিংহ দত্তরায় তৈরি করেন। এই জায়গাটি ত্রিবেণী আর ব্যান্ডেলের মাঝামাঝি। জায়গাটিকে মন্দির কমপ্লেক্স বলা যেতেই পারে।
হংসেশ্বরী মন্দিরের গড়ন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। তেরোটি একুশ মিটার উঁচু মিনার আছে। এগুলো দেখতে অনেকটা প্রস্ফুটিত পদ্মের কুঁড়ির মতো। মিনারগুলোকে বলে এক একটি রত্ন। মন্দিরটির উচ্চতা একুশ মিটার আর ভেতরে পাঁচটি তলা। এই পাঁচটা তলা হল ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না এবং চিত্রিণী – মানুষের দেহের পাঁচ নাড়ীর সঙ্গে তুলনীয় কাপালিকমতে - হংসেশ্বরী স্বয়ং কুলকুণ্ডলিনী রূপে অবস্থিতা।
মন্দিরটাকে দেখলে হিন্দু স্থাপত্য বলে মনেই হয় না। যেন সেই শার্লক হোমসের রহস্য ঘন এক দুর্গের চেহারা। ইতিহাস ঘেঁটে বুঝলাম যে আদৌ হিন্দু স্থাপত্যই নয়। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে 'অনিয়ন ডোম চার্চ' নামে বিখ্যাত বেসিলস ক্যাথিড্রাল-এর রেপ্লিকা এটি - একেবারে ট্রু কপি। মাথাটা পুরো গুলিয়ে গেল। তাহলে কি এটা আগে চার্চ ছিল যা দখল করা হয়েছিল? নাকি এর স্থপতি কোনও রাশিয়ান? মাথার মধ্যে প্রশ্নগুলো ঘুরতেই থাকল।
দেবী হংসেশ্বরী বসে আছেন পদ্মাসনে। চারটি হাত। নীল রং। নিমকাঠের তৈরি। হংসেশ্বরী দক্ষিণাকালীরই একটি রূপ বলে শুনলাম তবু যেন অজানা এক দেবী। কালী শুনেছি, দুর্গা, লক্ষী এসব শুনেছি। কিন্তু হংসেশ্বরী! এই মন্দির কমপ্লেক্সে বৈষ্ণব আর শাক্ত মতবাদ সহাবস্থান করছে।
এরপর ব্যান্ডেল চার্চ। আসল নাম কিন্তু ব্যান্ডেল চার্চ নয় - বাসিলিকা অফ হোলি রোজারি। পর্তুগিজদের তৈরি। সালটা ১৫৯৯। সেই বছরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়াপত্তন ঘটে আর রানি এলিজাবেথ ইংল্যান্ডে বসে অনুমোদন করেন ভারতে ওই নামে ইংরেজ উপনিবেশ গড়ে তোলবার।
একটা খুব ক্ষীণ মত আছে যে 'বন্দর' শব্দটির অপভ্রংশই ব্যান্ডেল। আর একটি জোরালো মতও আছে, সেটা পরে বলছি। মোগল সম্রাট আকবর পর্তুগিজদের অনুমতি দিলেন হুগলী নদী বন্দরটি ব্যবহার করবার জন্য যাতে পর্তুগিজরা এখানে নিজেদের বাসস্থান গড়ে তুলতে পারে। উপনিবেশ গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগিজ ক্যাথলিক পাদরিরা স্থানীয় আদিবাসীদের ধর্মান্তকরণ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে তৈরি হয় হাজার পাঁচেক খ্রিস্টান জনবসতি। ১৫৭৯ তে পর্তুগিজরা এখানে একটা পূর্ণ বন্দর আর একটি দুর্গ গড়ে তোলে। এর কিছুদিন পরেই আকবর অনুমতি দেন খ্রিস্টধর্ম প্রচার আর চার্চ গঠনের জন্য। ১৫৯৯ তে তৈরি হল এই চার্চ।
১৬৩২ সালে অর্থাৎ চার্চটি তৈরি হওয়ার তেত্রিশ বছর পর আক্রমণ করেন শাহজাহান। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় পর্তুগিজরা। শাহজাহানের নির্দেশে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় চার্চটি। বান্ডেলের মাটি রক্তে লাল হয়ে ওঠে। ফাদার জন দ্য ক্রুজ আর তার সঙ্গীদের বন্দি করে শাহজাহান নিয়ে যান আগ্রাতে। এক পাগলা ভয়ঙ্কর হাতির সামনে ফেলে দেওয়া হয় ফাদারকে। হাতিটা কিন্তু মারল না ফাদারকে। উল্টে শুঁড়ে করে বসিয়ে দিল পিঠে। এইরকম একটা অলৌকিক ঘটনা দেখে শাহজাহান ওই পোড়া চার্চের জমির সহ আরও অনেক বড় জমি বিনা শুল্কে দেন সেই ফাদারকে।
সেই জমির ওপর তৈরি হয় বর্তমান চার্চটি। তৈরি করেন গোমেজ ডি সোটো। যখন ১৬৬০ সালে এই চার্চটি তৈরি হচ্ছিল তখনই পাওয়া গেল পুরাতন চার্চের একটি প্রস্তরখণ্ড। যত্নে রক্ষিত সেই প্রস্তরখণ্ডটির গায়ে আজও দেখা যায় খোদাই করা আছে ১৫৯৯।
এ নিয়ে আবার আর একটা গল্প আছে। শোনা যায় যে, শাহজাহানের আক্রমণের সময় থেকে থেকে মেরি মাতার মূর্তিটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপর থিয়াগো বলে একজন নাকি গভীর রাতে নদীর ওপাড় থেকে ফাদারকে ডাকে আর বলে মেরি মাতা ফিরে এসেছেন। ফাদার ভাবেন যে সেটা ছিল স্বপ্ন। কিন্তু পরের দিন সকালে একটি জেলে নদীর পাড়ে মূর্তিটি দেখতে পেয়ে ফাদারের কাছে নিয়ে আসে।
আরও শোনা যায়, চার্চটির প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান হচ্ছিল, সেইসময় একটা জাহাজ দেখা যায় হুগলী নদী বন্দরে। জাহাজের ক্যাপ্টেন বিধস্ত অবস্থায় পৌঁছালেন সেই অনুস্থানে। সকলে অবাক হয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, বঙ্গোপসাগরে তাঁরা এক ভয়ঙ্কর ঝড়ে পড়েছিলেন, বাঁচার কোনও সম্ভাবনাই প্রায় ছিল না। ক্যাপ্টেন মেরি মাতাকে স্মরণ করলে প্রায় এক অলৌকিক উপায়ে ক্যাপ্টেন রক্ষা পান সেই ঝড় থেকে। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন জাহাজের মাস্তুলটি দিয়ে দেবেন মেরি মাতার উদ্দেশ্যে। অথচ জাহাজের মাস্তুলই হল তার প্রধান অংশ যেটা ছাড়া জাহাজ চলবেই না। তবুও সেই ক্যাপ্টেন কথা রাখেন আর মাস্তুলটি দিয়ে যান এই গির্জায়। জাহাজের মাস্তুলকে ইংরেজিতে বলে মাস্ট (mast) আর মাস্ট-কে পর্তুগিজ ভাষায় বলে 'ব্যান্ডেল'।
ঢুকতেই আর্চ গেট। যার ওপর মুকুটে আছে মেরি মাতার মূর্তি আর আছে নৌকাতে ছোট্ট যীশু। চার্চে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া যায় একেবারে ছাদে। সেখানে মূর্তি "Our Lady of the Happy Voyage"-এর । এখানে সবাই মোমবাতি জ্বালায়। তার থেকে ঠিক পিছনে ঘুরলেই অসাধারণ দৃশ্য - হুগলী নদী আর জুবিলি ব্রিজ-এর। এটি পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো রেলব্রিজ যেটা হুগলী নদীর ওপর তৈরি হয়েছিল ১৮৮৭ সালে। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের গোল্ডেন জুবিলি উপলক্ষে তৈরি হয় এই ব্রিজ, তাই এই নামকরণ।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এবার প্রধান ভবন। সেখানেই "Our Lady of Holy Rosary" এর মূর্তি। আরও দুটি ভবন আছে যেখানে যীশুর ও জন বস্কোর মূর্তি আছে। এছাড়াও সারা চার্চে ছড়িয়ে আছে নানা খ্রিস্টান ধর্মগুরুর মূর্তি। আর আছে সেই মাস্তুলটার ভাঙা অংশ। লাগোয়া একটি কবরখানাও।
ব্যান্ডেল চার্চের পেছনেই হুগলী নদী। একটা নৌকা নিয়ে ইমমাবাড়ায় গেলে খুব ভালো লাগে। হেঁটে মিনিট পনেরো লাগে ইমামবাড়া পৌঁছাতে। হুগলী ইমমামবাড়া অর্থাৎ ইমামের বাড়ি। কিন্তু ভারতে এর মানে এমন একটি বাড়ি বা হলঘর যেখানে দাঁড়িয়ে মহরম দেখা যায়। সমাজসেবী হাজি মোহাম্মদ মহসিনের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি এই ইমামবাড়া। তৈরি করতে মোটামুটি বছর কুড়ি লেগেছিল। শেষ হয় ১৮৬১ সালে। স্থপতি ছিলেন কেরামাতুল্লা খান।
ইমামবাড়া দোতলা একটি বাড়ি। মাঝখানে আয়তক্ষেত্রাকার একটি বিশাল উঠোন। সুন্দর ভাবে সাজানো ফোয়ারা আর চৌবাচ্চাসহ। তবে এখানকার মুখ্য আকর্ষণ হল দুটি পঁচাশি ফুট উঁচু মিনার। একটি ছেলেদের জন্য অন্যটি মেয়েদের জন্য। মোট ১৫২টি বেশ উঁচু উঁচু সিঁড়ি আছে। এর ছাদ থেকেও দেখা যায় হুগলী নদীর অসাধারণ দৃশ্য আর জুবিলি সেতু। দুটি টাওয়ারের ঠিক মাঝখানে তিনতলা যে ভবনটি আছে তার একেবারে ওপর তলায় রয়েছে একটি ঘড়ি। নীচের তলাগুলিতে আছে একটি ঘন্টা আর আছে ঘড়ির যন্ত্রপাতি। তবে এই অংশটি বন্ধ পর্যটকের কাছে। উঠোনের শেষদিকের ঘরটিতে আছে অসাধারণ সব ঝাড়বাতি। আর আছে নানা রকম শিল্প নিদর্শন। উঠোনের পেছনের দিকে আছে একটি সূর্যঘড়ি।
ধীরে ধীরে কালের গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে ইমামবাড়া। নষ্ট হয়ে গেছে ফোয়ারাগুলি। যে জলাশয়গুলোয় একদা কাকচক্ষু জল ছিল এখন পানা জমে সবুজ হয়ে গেছে। তবু ইমামবাড়ার ইমারতটি আজও দাঁড়িয়ে আছে। আর তার ঘড়িটি একইভাবে ছ'শ বছর ধরে সঠিক সময় দেখিয়ে পনেরো মিনিট অন্তর করে জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্বকে।
পরের গন্তব্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত দেবানন্দপুর। জন্মভিটেটি এখনও আছে। তার এক অংশে শরৎ স্মৃতি পাঠাগার ও মিউজিয়াম। রক্ষিত আছে লেখকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। এখানে উনিশ শতকের কিছু আটচালা টেরাকোটার মন্দিরও রয়েছে। দেখলাম প্যারিপন্ডিতের পাঠশালা, মেজদিদি গ্রন্থে উল্লিখিত সেই বিশালাক্ষী মন্দির, লেখকের বাল্য ক্রীড়াভূমি গড়ের জঙ্গল, সরস্বতী নদী সাঁকো যা বর্তমানে ব্রিজ, দাসমুন্সিদের পূজামণ্ডপ আর হেদুয়া পুকুর, দোলমঞ্চ ও আরও নানা প্রাচীন মন্দির, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের স্মৃতিফলক ও লেখকের আবক্ষ মূর্তি, মোহন মুন্সির দালান।
ফিরে আসতে আসতে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। কালপ্রবাহে ক্ষয়ে যাচ্ছে সবই। তবু কেন যেন মনে হল আজ যা দেখলাম তার সৃষ্টি বা বিনাশ সম্ভব নয়। যেন আগেও দেখেছি একে বারবার। আরও কতকাল কেটে যাবে। বহুযুগ পরে আগামীতে হয়তো আবারও ফিরে আসব। তবে আজকের মত বিদায়।
ম্যাকনালি ভারত ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে কর্মরত উদয়ন লাহিড়ি অবসর পেলেই ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন।