দানিয়ুবে নৌকাবিহার

সৌমিত্র বিশ্বাস


~ ভিয়েনার আরও ছবি ~


জুন মাসে দিল্লির প্রচণ্ড দাবদাহে অবস্থা খুবই কাহিল, আর ঠিক তখনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো অস্ট্রিয়া যাওয়ার সুযোগটা এল বেশ হঠাৎই – এক বিশেষ কাজে যেতে হবে ভিয়েনার কাছে ব্যাডেন শহরে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি বিমানবন্দর থেকে সোজা ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল পৌঁছলাম এক রবিবারের ভোরে। গাড়ি চলল সুড অটোবান-এ-টু ধরে, অস্ট্রিয়ার গ্রামগঞ্জে সবে তখন সোনালি আলোর পরশ লেগেছে। বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম ছোট্ট শহরটিতে। অনতিদূরে সবুজ পাহাড়ের জটলা আর শহরের প্রবেশপথে আদিগন্ত আঙুর ক্ষেত – প্রথম দর্শনেই মনটা জয় করে নিল ছবির মত সুন্দর ব্যাডেন!

ভিয়েনা থেকে ২৬ কিমি দূরে উইনারওয়ালড্ পাহাড়সারির পাদদেশে ব্যাডেন। শহরের চারপাশে একশ কুড়িটি আঙুর বাগান। জার্মান ভাষায় ব্যাডেন অর্থ 'স্নান' – শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তেরোটি উষ্ণ প্রস্রবণ ও সামুদায়িক স্নানঘর এই নামের উৎপত্তির কারণ। সেই রোমান যুগ থেকেই উষ্ণ প্রস্রবণগুলির জন্যে ইতিহাসে ব্যাডেনের পরিচিতি। অতীতে তুরস্ক ও হাঙ্গেরি অস্ট্রো-জার্মান সাম্রাজ্য ভুক্ত ব্যাডেন আক্রমণ করেছিল বারবার। পরবর্তীকালে ব্যাডেন হয়ে ওঠে অস্ট্রিয়ান রাজ পরিবারের অতি পছন্দের গ্রীষ্ম নিবাস। অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ লুডউইগ ভ্যান বিঠোফেন (১৭৭০-১৮২৭) ব্যাডেনে বেশ কিছু বছর কাটিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৫৫ সাল অবধি মিলিত শক্তির পক্ষে সোভিয়েত সেনাবাহিনী অস্ট্রিয়া শাসন করেছিল এই ব্যাডেন থেকে।
ব্যাডেনে আমাদের হোটেলটি ছিল আদতে একটি প্রাসাদ – অধুনা চারতারা বিশিষ্ট হোটেল, কিন্তু হোটেল কোম্পানির প্রাসাদটির ঐতিহ্য বজায়ের প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। পুরনো আমলের কাঠের সিঁড়ি, কাঠের মেঝে, আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি, মর্মর মূর্তি - এসবই যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত। হোটেলটির বিশেষ আকর্ষণ স্পা আর সাওনা। দেখলাম অনেক পর্যটক এসেছেন অস্ট্রিয়ার ও জার্মানির কাছাকাছি ছোট শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে, ব্যাডেনে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে। হোটেলের পাশেই ব্যাডেন মিউনিসিপ্যালিটির গোলাপ উদ্যান 'রোজারিয়াম' - বেশ কয়েক একর বিস্তৃত। নানা প্রজাতির নানান রঙের গোলাপ ছাড়াও বাগানটিতে সার সার বহু পুরনো মহীরূহ, শান্ত জলাশয়, তিন-চারটি রেস্তোরাঁ – সপ্তাহান্তে ব্যাডেনাবাসীদের অতি প্রিয় আউটিং স্থল।

পৌঁছেছি রবিবার সকালে, পরেরদিন আসল কাজ। তাই আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম ভিয়েনার উদ্দেশ্যে। 'রোজারিয়াম'-এর মধ্য দিয়ে হাঁটাপথ, গোলাপ বাগানের শোভায় চোখ গেল জুড়িয়ে। ব্যাডেন শহরে রাস্তার দুপাশে ওপেন-এয়ার ক্যাফেটোরিয়া, থাই-চাইনিজ- জাপানি-ইতালিয় খাবারের রেস্তোরাঁ, সেরামিকস-এর পুতুল, নানারকম হস্তশিল্প ও চিজের দোকান, সুন্দর চ্যাপেল - এসব দেখতে দেখতে পৌঁছলাম ছোট্ট শহরটির ডাউন-টাউন অঞ্চলে। জায়গাটার নাম জোসেফসপ্লাত্জ, পরাক্রমী অস্ট্রিয়ান সম্রাট প্রথম কাইজার ফ্রান্জ জোসেফ (১৮৩০-১৯১৬)-এর নামে। অনেকটা জায়গা জুড়ে এক বিশাল চত্বর – কেন্দ্রে এক উষ্ণ প্রস্রবণ, কাছে গেলে নাকে আসে মৃদু গন্ধকের বাস।

জোসেফপ্লাত্জ থেকে ছাড়ছে ভিয়েনা যাওয়ার ট্রাম – ভিয়েনার স্টেট অপেরা পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিমি দূরত্ব, সময় লাগে এক ঘণ্টা আর ভাড়া ৪.৫০ ইউরো। দুই কোচ বিশিষ্ট ট্রাম গাড়ি – বসে পড়লাম বড় বড় কাঁচের জানলার ধারের আসনে। ব্যাডেন শহর ছাড়াতেই অস্ট্রিয়ার গ্রামাঞ্চল ধীরে ধীরে মেলে ধরল তার অপরূপ চিত্রিত ক্যানভাস – নানা রঙের ফুলে সাজানো ছোট্ট বাড়ি, দূরে পাহাড় ছোঁয়া আঙুরের ক্ষেত, ট্রাম লাইনের পাশে বহতা ছোট নদী, অনেকটাই আমাদের সর্ষে ফুলের মত দেখতে উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের রেপসিডের চাষ - একঘণ্টা যে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি! ট্রাম পৌঁছল ভিয়েনার উপকণ্ঠে, শহরে প্রবেশ করেই সেঁধোল মাটির তলায়।

ইন্টারনেটের সুবাদে জেনেছিলাম ভিয়েনার দানিয়ুবে নৌকাবিহারের কথা। দানিয়ুব সত্যিই এক মহানদী, ইউরোপের দশটি দেশ জুড়ে প্রবহমান। দৈর্ঘ্যে ২৯০০ কিমি দানিয়ুবকে আন্তঃ-ইউরোপিয়ান জলপথ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এ নদীপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানি সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক। অস্ট্রিয়ার সীমারেখার মধ্যে প্রায় ৩০০ কিমি ধরে বয়ে চলেছে দানিয়ুব - নদীর দুধারে গড়ে উঠেছে ভিয়েনা শহর। রবিবার দুপুরে দানিয়ুবের বুকে নৌকাবিহার – এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়? ট্রাম থেকে নামলাম কার্লসপ্লাত্জ-এ, সেখান থেকে পাতালরেল ধরে শ্বেডেনপ্লাত্জ। বড় রাস্তার ধারে দানিয়ুব ক্যানাল, জাহাজ-জেটি থেকে ক্রুজের রওয়ানা। ডিডিএসজি ব্লু দানিয়ুব নামের কোম্পানি চারটি দোতলা জাহাজ চালায় দানিয়ুব ক্রুজের জন্য, এছাড়াও তাদের নিয়মিত জাহাজ চলে ভিয়েনা থেকে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট ও স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভা। আমরা চড়লাম এম-এস স্লোজেন জাহাজে – ওপর ও নীচ তলার দুটি ডেকে প্রায় দুশ তিরিশ জন যাত্রীর বসার ব্যবস্থা, সাড়ে তিন ঘণ্টার ক্রুজ ২১ ইউরোর বিনিময়ে। জাহাজ চলল দানিয়ুব ক্যানাল দিয়ে - দুপাশে গথিক শৈলীর অট্টালিকা, আধুনিক অফিস পাড়া, গগনচুম্বী আবাসন। শহর ছাড়িয়ে শহরতলি – সুন্দর সব ভিলা ও শ্যালে, টাউন হাউস, কাঠের তৈরি গ্রীষ্মনিবাস। এসব পেরিয়ে জাহাজ পৌঁছল দানিয়ুবের মূল স্রোতে। কিছু দূর গিয়েই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের এক ব্যারাজ - দুটি লকগেটের মধ্যবর্তী খালে এসে দাঁড়ালো আমাদের জাহাজ ও দু'টি নৌকা। পেছনের লকগেট বন্ধ করে খালে ধীরে ধীরে ছাড়া হল জল, দুপাশের জলস্তর এক হলে খুলে দেওয়া হল সামনের লকগেট – জাহাজ পেরিয়ে এল ব্যারাজ।
দানিয়ুবের শোভা দর্শনের মাঝে অনেক ট্যুরিস্ট চললেন এম-এস স্লোজেনের রেস্তোরাঁ অভিমুখে। রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকাটি দীর্ঘ না হলেও চটজলদি খিদে মেটাবার জন্য যথেষ্ট - সেমোলিনার স্যুপ, হ্যাম বা টার্কির স্যালাড আর মেন কোর্সে বারবিকউ করা টার্কির ফিলে দিয়ে ভাত বা আলুসেদ্ধর সঙ্গে ভাজা ট্রাউট মাছ কিংবা বিফ রোস্ট তারপর ডেসার্ট হিসেবে কেক, পেস্ট্রি...সঙ্গে পানীয় বিয়ার বা ফরাসি ওয়াইন!

অস্ট্রিয়ায় তখন মনোরম গ্রীষ্ম, সপ্তাহান্তের ছুটিতে ভিয়েনাবাসী দানিয়ুবে জলক্রীড়ায় ব্যস্ত – চারদিকে স্পিডবোট ও জল-স্কুটারের ভিড়। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর এম-এস স্লোজেন ভিড়ল জেটিতে, বিখ্যাত বিশালাকায় রাইখ্সব্রুক সেতুর কাছে। রাইখ্সব্রুক সেতুটি তৈরি হয় ১৮৭৬ সালে, পরে সেটির প্রভূত সংস্কার করা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চাদপসরণকারী নাৎসি সেনাদের বিধ্বংসী আক্রমণ থেকে দানিয়ুবের একমাত্র এই সেতুটিকেই বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেতুটি ভেঙে পড়ে ১৯৭৬ সালে; ১৯৮০ সালে পুনর্নির্মিত হয় রাইখসব্রুক সেতু। ভিয়েনার কেন্দ্রস্থলে স্তিফানপ্লাত্জ থেকে দানিয়ুবের অপর পাড়ে ডোনাউস্টাড-এর সঙ্গে যোগাযোগকারী ব্যস্ততম এই ছয়-লেন বিশিষ্ট সেতু রোজ ৫০,০০০ যানবাহন ও মেট্রোরেলের ভার বহন করে। মিনিট দশেক বিরতির পর আবার চলল জাহাজ; দানিয়ুবের বুকে ২১ কিমি লম্বা এক কৃত্রিম দ্বীপের ধার ঘেঁষে। ডানদিকে রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন কার্যালয়, ২৫২ মিটার উঁচু দূরসঞ্চারের জন্য ব্যবহৃত 'দানিয়ুব টাওয়ার', বাঁদিকে ১৯৯৯ সালে আধুনিক শৈলীতে তৈরি ২৫০ মিটার উঁচু 'মিলেনিয়াম টাওয়ার', পশ্চিমপানে ঢলে যাওয়া সূর্যের আলোয় ভিয়েনার স্কাই-লাইন!
অবশেষে এম-এস স্লোজেন ফিরে এল যাত্রাশুরুর জেটিতে – একে একে তখন জ্বলে উঠছে রঙিন আলোর মালা, ভিয়েনা সাজছে এক রবিবারের সন্ধ্যাকে স্বাগত জানাতে। আমরা চললাম ব্যাডেনের পথে – সৃষ্টির আদিকাল থেকে বয়ে চলা, ইতিহাসের নীরব সাক্ষী মহানদী দানিয়ুবের কথা ভাবতে ভাবতে।


~ ভিয়েনার আরও ছবি ~


সৌমিত্র বিশ্বাস পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অধুনা নয়াদিল্লি নিবাসী, ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকে কর্মরত। চাকরিসূত্রে পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ। লেখালিখি করছেন অনেকদিনই – বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধই বেশি, কিছু ভ্রমণকাহিনি – এর আগে সবই ইংরেজিতে। বিশেষ শখ ফোটোগ্রাফি।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher