বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

পরিযায়ীদের সংসারে়

পলাশ পান্ডা

পাখি দেখার কৌতূহলটা বরাবরের। জানুয়ারির ভরা শীতের রাতে তাই লেপের মায়া কাটিয়ে ঠান্ডাকে নিতান্ত উপেক্ষা করেই ট্রেনে উঠে বসি, গন্তব্য চুপিচর। শীতের কয়েকটা মাস বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর চুপিচরে পরিযায়ীদের এক মেলা বসে। ওখানকার স্থানীয় মানুষেরা যে ভাবে চরটিকে চোরাশিকারীদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদের বিশেষ বাহবা দিতে হয়। চুপিচর গঙ্গার ধারে এক অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ রূপে বিস্তৃত হয়েছে। এর বিস্তার প্রায় ২-৩ কিমি। শীতকালে হ্রদটি পরিযায়ীদের আস্তানাতে পরিণত হয়। পরিচিত এক বন্ধু দেখলাম উৎসাহী, তাকেই সঙ্গী করে ২৬ জানুয়ারি বেরিয়ে পড়লাম চুপিচরের উদ্দেশ্যে।

পূর্বস্থলী যেতে গেলে সবথেকে সহজ পরিবহণ হল ট্রেন। সারাদিনই হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইনে প্রচুর লোকাল ও মেল ট্রেন চলাচল করে। ঠিক করেছিলাম সকাল ৫.৩৬ মি.-এর ট্রেনটা ধরব। রাত দেড়টায় বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু হাওড়াগামী লোকালটি সামান্য লেট করায় প্রথম ট্রেন মিস করলাম। অগত্যা ৬.২৬ মি.-এর মেইন লাইনের ব্যান্ডেলগামী লোকালে চেপে ব্যান্ডেলে নেমে ট্রেন পাল্টে পূর্বস্থলী পৌঁছালাম সাড়ে নটা নাগাদ। রাস্তাতে খাওয়া হয়ে ওঠেনি, স্টেশনে নেমে প্রথমেই চা আর টিফিন করে নিলাম। স্টেশনেই চুপিচর যাওয়ার জন্য প্রচুর অটো, টোটো ও রিকশা পাওয়া যায়। টোটোতে চেপে চরে পৌঁছাতে মিনিট দশেক সময় লাগল। নামতেই চোখে পড়ে গেল বিরাট একটি সাইনবোর্ডে সমস্ত নিয়মকানুন সহ নৌকার রেটচার্ট লেখা রয়েছে।

ঘাটে গিয়ে ঘণ্টায় ১২৫ টাকা হিসেবে এক মাঝির সঙ্গে কথা বলে নৌকায় উঠে বসলাম। ছুটির দিন হওয়ার জন্য ভালোই ভিড় জমেছে। চরের পাশে পার্কে পিকনিক করবার ব্যবস্থাও রয়েছে। সেখানে স্কুলের কিছু বাচ্চা এসেছে পিকনিক করতে। ছোট ছোট নৌকায় করে পক্ষীপ্রেমীদের দল গোটা হ্রদটাতে বিচরণ করছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের কাছে দেখলাম বড় মাপের লেন্স লাগানো ক্যামেরা, অনবরত শাটারের শব্দ কানে আসতে লাগল। নৌকার মাঝিই আমাদের গাইড। দেখলাম উচ্চারণগত ত্রুটি কিছুটা রয়ে গেলেও মাঝিভাই পাখিদের নাম ভালোই রপ্ত করেছেন। নৌকায় উঠতে না উঠতেই তিনি ইশারা করে দেখালেন সামনে কচুরিপানার মধ্যে কয়েকটা কমন কুট আপন মনে খাবার খোঁজায় ব্যস্ত। এমন ভাবে কচুরিপানার মধ্যে মিশে রয়েছে যে প্রথমটায় চোখেই পড়ছিল না, নৌকাটা একটু এগোতে দেখতে পেলাম। তারপর লগি ঠেলে বামদিক বরাবর নৌকো এগোতে লাগল। খানিক এগোতে দেখি কয়েকটা লিটল গ্রিব ঘোরাঘুরি করছে। একটু কাছে যেতেই ছপাত ছপাত শব্দ করে উড়ে গেল। এরপর যেখানে নিয়ে গেলেন, দেখি গোটা তিরিশ-চল্লিশ শামুকখোল জটলা পাকিয়ে রোদ্দুর পোয়াচ্ছে। একটু দূরে একটা কালোমাথা কাস্তেচোরা জলের মধ্যে খাবার খোঁজায় ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় মাঝি দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন - একঝাঁক বালিহাঁস আমাদেরই নৌকোর পেছনে এসে নামল। খুব কাছাকাছি থাকায় বেশ কয়েকটা ভালো ছবি পাওয়া গেল। এরই মাঝে দেখতে পেলাম পার্পেল হেরন, পার্পেল সমফেন, গ্রে হেডেড ল্যাপউইং, জলময়ূর, জলপিপি, জিরিয়া, বালুবাতান আর অজস্র পানকৌড়ি।

কিন্তু মূলত যাকে দেখবার জন্য এতদূর ছুটে আসা সেই রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড-এর দেখা এখনও পর্যন্ত পেলাম না। এই রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড সম্পর্কে দু-একটা কথা না বললেই নয় - এদের স্ত্রী ও পুরুষকে সহজেই চেনা যায়। পুরুষদের গোল কমলা মাথা, বুকটা কালো, পেটটা সাদা ও ওপরটা বাদামী এবং লেজটা কালো হয়। আর স্ত্রীদের প্রধানত বিবর্ণ বাদামী শরীর ও মুখটা সাদাটে হয়ে থাকে। এরা সবসময় দলগত ভাবে থাকে ও বিচরণ করে, কিন্তু অন্য কোন প্রজাতির মধ্যে মিশে যায়না। এদের খাবার খোঁজার ধরণ হল জলে ডুব দিয়ে। প্রধানত জলজ উদ্ভিদ খায়। লেকের ধারে বাসা বাঁধে ও একসঙ্গে আট থেকে বারোটা ডিম দেয়। ডিমের রঙ কিছুটা বিবর্ণ সবুজ। মাঝিভাইকে এদের কথা জিজ্ঞাসা করতে তিনি এক গাল হেসে বললেন, একটু সবুর করুন দেখতে পাবেন। তাঁর কথায়, এ বছর নাকি প্রচুর পরিমাণে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড এসেছিল, তার মধ্যে কিছু চলে গেছে। তবে যা রয়েছে তার পরিমাণও নেহাত একটা কম নয়। হাতে সময় খুব একটা বেশি নেই তাই অনুরোধ করলাম পোচার্ড-এর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি সেইমত নৌকার মুখ ঘুরিয়ে এগোতে লাগলেন।

শীতের অলস দুপুরে গ্রামের মেয়েরা স্নানের জন্য ঘাটে আসতে শুরু করেছে, দুটো ছোট ছেলে একটা ডিঙি নিয়ে খেলার ছলে ঝিলের জলে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুটা দূর যাওয়ার পর দেখলাম একঝাঁক সরাল কোথা থেকে ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আমাদেরই নৌকার সামনে জলে নামল। যেখানে নামল সেখানে চোখ পড়তে দেখলাম একটা পার্পেল হেরন ও কিছু পানকৌড়িও আগে থেকে বসে রয়েছে। শুরু হল জলক্রীড়া, ওদের ডানার আওয়াজে চারিদিকের নিস্তব্ধতাটা ভেঙে গেল। খেলায় এত মগ্ন যে কিছু কিছু সরাল আমাদের নৌকার কাছাকাছি চলে আসছিল। সামনে পেয়ে কিছু ছবি নেওয়ার পর ধীরে ধীরে ওদের পাশ কাটিয়ে এগোতে লাগলাম। এগোনোর পর যে দৃশ্য দেখলাম তা দেখে চোখ স্থির হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঝাঁকে ঝাঁকে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝিভাইকে বললাম যতটা কাছে যাওয়া যায় চলুন, সেই মত ধীরে ধীরে ওদের কাছে নৌকো এগিয়ে যেতে লাগল। পাশাপাশি আরও কয়েকটা নৌকো এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটা নৌকো আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতে পাখির দল ছপাত ছপাত করে উড়ে গিয়ে একটু দূরে বসল। দু চোখ ভরে দেখতে লাগলাম। মনটা এক অবর্ণনীয় আনন্দে ভরে উঠল। যে আশা নিয়ে শীতের রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম তা যেন সত্যিই আশাতীতভাবে সফল হল। এবার খুশী মনে ফিরতে পারব।

 

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের কম্পিঊটার অপারেটার পলাশ পান্ডা-র সখ ফোটোগ্রাফি ও বেড়ানো।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher