ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণকাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, আনতে পারে চোখে জলও। জাগিয়ে তুলতে পারে জীবনজিজ্ঞাসা, প্রতিবাদের ভাষা। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণকাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।

 


বালিপাসে মুখোমুখি

সুমন বিশ্বাস


আনন্দ...

দৃশ্য ১

গিরিবর্ত্মের উপরে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ, সঙ্গে রয়েছে তার কয়েকজন বন্ধু। আজ তাদের হিমালয়ে পদচারণার চতুর্থ দিন। অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছেছে তারা। লক্ষ্য কী? একটা পাহাড়ের ওপরে পৌঁছানো, তারপর অন্য দিকে নেমে যাওয়া। পাহাড়ের ঠিক ওপরে তুষার নেই, যদিও তুষার মাড়িয়ে, তুষারে ধাপ কেটে তাদের এখানে পৌঁছতে হয়েছে। শনশন শব্দে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, চকচকে নীল আকাশের বুকে ঝকঝকে সূর্যের আলোয় চারিদিকের দৃশ্য অতি চমৎকার।
পুরুষটি অন্যদের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে পাথরের ওপরে বসল। অন্যরা তাকে ডাকছে একসঙ্গে ছবি তোলার জন্যে, তার কানে আদৌ সে ডাক ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে না। দুহাতে চোখ মুখ ঢেকে সে বসে আছে তো আছেই, অন্যরা ভাবল ও হয়তো ক্লান্তিতে অমন করে বসে আছে। ক্লান্ত হওয়ারই তো কথা, এই কদিন ওদের সবার ওপর দিয়ে যা গেছে! আজ সকালের কথাই ধরা যাক না।

হিমাঙ্কের নীচের অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় সারা রাত তাঁবুতে এপাশ ওপাশ করেছে, ঘুম আসেনি। শেষে ভোর চারটে নাগাদ দুত্তোর বলে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে, ভেবেছে মুখ-টুখ ধুয়ে রওনা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নেবে। ও হরি, তাঁবুর ভেতর থেকে জলের বোতল বার করতে গিয়ে দেখে পুরো জলটাই জমে বরফ হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে মুখ ধুতে যেতে হয়েছে পাশ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে যাওয়া এক পাহাড়ি নালায়। ঠান্ডায় হাত-মুখ কেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাড়াতাড়ি এসে পোর্টারদের প্রাতরাশ তৈরি করার আগুনে হাত সেঁকে মুখে রক্ত সঞ্চালনের জন্যে হাত দিয়ে ঘষাঘষি করে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়েছে।
অন্ধকার তখনও একইরকম। যদিও দৃষ্টি খানিকটা সয়ে গেছে এতক্ষণে, অন্ধকার আর অত ঘন মনে হচ্ছে না। মাথার ওপর তারারা অস্বাভাবিক উজ্জলতা নিয়ে চেয়ে আছে, সব থেকে বড় চোখ তাদের মধ্যে চন্দ্রদেবের। সামনে যেন ঢিলছোঁড়া দূরত্বে স্বর্গারোহিণী শৃঙ্গ অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। কারোর কারোর মতে এই শৃঙ্গ ধরে পাণ্ডবেরা সশরীরে স্বর্গে যেতে চেয়েছিলেন, অবশ্য এই মানুষটির সামনে শৃঙ্গটির যে দিকটি রয়েছে, সেই দিক ধরে নয়, তার বিপরীতে সতোপন্থ তালের পথ ধরে। পৌরাণিক কাহিনি যাই হোক না কেন, শৃঙ্গটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লোকটির মনে হল, স্বর্গ থাকুক বা না থাকুক, স্বর্গ নামক কল্পনার চিরকালীন আনন্দলোকে পৌঁছানোর পথ যেন এমনটাই হয়!
……..না, ট্রাভেলগ লেখা আমার কম্ম নয়! সেই এরপর কত কষ্ট করে আজ সকালে বালি উদারি (১২৫০০ ফিট) থেকে শুরু করে ঘন্টা ছয়েক হেঁটে যমুনোত্রী পাসে, যা সাধারণভাবে বালি পাস (১৬০০০ ফিট) নামে পরিচিত পৌঁছানো, ভয়কে জয় করে পদে পদে পা পিছলে গভীর খাদে পড়ার বা পাথর গড়িয়ে মাথায় পড়ার বিপদের আশঙ্কা পেরিয়ে পাহাড় ভাঙা, পথের অভাবে জমে যাওয়া পাহাড়ি নালা ধরে এগোনো, জলের অভাবে কষ্ট পাওয়া, ক্রিভাস এড়িয়ে সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসে দেওয়া হিমবাহের ওপর দিয়ে চলা, তারপর দড়ি ছাড়া শুধু আইস অ্যাক্সের সাহায্যে প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাড়া পাথর গড়িয়ে পড়া পাহাড়ি দেওয়াল বেয়ে ওঠা, এসবের খুঁটিনাটি বর্ণনা ট্রাভেলগের বৈশিষ্ট্য। এগুলো একেবারেই যেন ক্লিশে হয়ে গেছে, যেকোন পাহাড়ে হাঁটার বিবরণে এসবের একঘেয়ে বর্ণনা পড়তে আমরা অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে ঘটা বা না ঘটা দু-একটা দুর্ঘটনার বর্ণনাও গুঁজে দেওয়া দস্তুর। এমন লেখা পড়তে আমার ভালো লাগে না, নিজে লিখতেও ইচ্ছা করে না, লিখছিও না। বদলে যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই অনুভূতির বর্ণনাকেই বিষয় করা যাক। শুধু দুটি কথা বলে নিয়ে সেদিকে এগোই।

দলের কেউ উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হয় নি, তার কারণ মনে হয় দলের সকলের উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার আগ্রহ, রোজ হাড়ভাঙা খাটুনির পরে ক্যাম্পে পৌঁছেও কেউ তাঁবুতে ঢুকে শুয়ে পড়েনি তক্ষুনি, বরং আশপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। শুয়েছে শুধু রাত্তিরটুকুতে। নাহলে এই গিরিবর্ত্ম অতিক্রমের ট্রেকে, যেখানে পিছিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই - অসুস্থজনকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে কেউ উচ্চতাজনিত কারণে অসুস্থ হলে ভীষণ মুশকিলে পড়তে হত।
আর উল্লেখ করতে হয় ফেনকমলের কথা। দুর্লভ এই ফুল হিমালয়ের সর্বত্র ফোটে না, এখানে সেই ফুলের ছড়াছড়ি। একটাই দু:খ, ফুলগুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে, যার সৌন্দর্য সম্বন্ধে এত পড়া যায়, তার কিছুই উপলব্ধি করা গেল না। বর্ষাকালে, নিদেনপক্ষে সেপ্টেম্বরে এলেও ফুলগুলোকে দেখার সুযোগ হত তাদের পূর্ণবিকশিত রূপে।

যা বলছিলাম, পুরুষটি মুখ ঢেকে বসে আছে কেন? সবাই আনন্দে উচ্ছ্বসিত, ঝকঝকে সূর্যালোকে একদিকে স্বর্গারোহিণী পর্বতের সবকটি শৃঙ্গই স্বমহিমায় উজ্জ্বল, অন্যদিকে কালানাগ, বান্দারপুঁছ আর ইয়েলো টুথ, তাদেরও সৌন্দর্য কিছু কম নয়। নাম না জানা আরও কত শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে চারিদিকে। মানুষটি সে সব কিছুই দেখছে না, কিছুই কি তার দেখার আগ্রহ নেই, তাহলে কি করতে এসেছে এখানে?
যেদিন থেকে হাঁটা শুরু করেছে, প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করেছে মানুষটি। হিমালয়কে ভালবাসে সে মনপ্রাণ দিয়ে, হিমালয় তাকে কখনো নিরাশ করে না, এই কয়েকদিনের পদচারণাতেও প্রতিটি মুহূর্ত হিমালয় তার ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছে, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে মানুষটির সামনে। আনন্দে মন ভরিয়ে দিয়েছে, তৃপ্তিতে বুক ভরিয়ে দিয়েছে। আর এখন? ভাল করে দেখা যাক তো...
একী, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে মানুষটি, আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে তার চোখে যেন জল দেখা যাচ্ছে? সেই কবে থেকে ওর সঙ্গে পরিচয়, শৈশবের পরে তো ওর চোখে আর জল দেখি নি, বেশ বুঝতে পারছি বেচারি খুব লজ্জায় পড়ে গেছ, যদি ওর চোখের জল কারোর নজরে পড়ে যায়, তাই অমন ভাবে মুখ লুকিয়ে রয়েছে। এত বছরে যার চোখে কখনো জল দেখিনি, কী হল তার? অন্যদের চোখ এড়িয়ে প্রশ্ন করলাম।
জলভরা চোখ তুলে সে আমাকে উত্তর দিল, "এটুকুও বোঝ না? তুমি আবার কতদিন ধরে হিমালয়ে হাঁটাহাঁটি করছি বলে গর্ব কর? একেই আনন্দাশ্রু বলে। জীবনে এমন আনন্দ আগে কখনো পাই নি, তাতেই মনে হয়..."
আমার অসহিষ্ণু উত্তর, "সে তো চিরকালই দুজনে একসঙ্গে থেকেছি, তোমার এই হাল তো আগে কখনও দেখি নি?"
"আমিও অবাক হয়ে যাচ্ছি, দেখ না, চোখের জল থামানোর চেষ্টা করছি, কিছুতেই থামাতে পারছি না।"
"কেন, আজ কী এমন হল?"
"জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু মন জুড়ে এমন এক আনন্দ, যার ব্যাখ্যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা নেই আমার। এমন কত জায়গাতেই তো পৌঁছেছি আগেও, উত্তরাখণ্ডে, হিমাচলে, সিকিমে, নেপালে - আগে তো কখনও এমনটা হয় নি।"
হেসে ফেললাম। বললাম, "সামান্য ট্রেকের গন্তব্যে পৌঁছেই এত আবেগের বাড়াবাড়ি? কোনও শৃঙ্গের মাথায় উঠতে পারলে তাহলে কী করতে? বুড়ো হয়ে যাচ্ছ নাকি?"
লোকটিও হেসে ফেলল, "হবে হয় তো। আর না, সবাই ডাকছে, চল এবার দেখি পুজো কেমন হচ্ছে।"
গাইড আর ওদের দলের স্থানীয় সহায়কদের দিকে এগিয়ে গেল সে। ততক্ষণে পুজো হয়ে গেছে। পুজোর প্রসাদের নকুলদানা খেল। তা ও খায়, নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও পুজোর প্রসাদে ওর আপত্তি নেই, বলে - "খাবার জিনিস খাব না কেন? এর সাথে ভক্তিফক্তির কোন সম্পর্ক নেই!"
তা তো হল, গাইডের হাত থেকে শুকিয়ে যাওয়া পচা নারকেল প্রসাদ চেয়ে নিচ্ছে কেন? ওটা তো খাওয়ার অযোগ্য। তালুকা গ্রামের মুদি দোকানী সুযোগ পেয়ে দিব্যি ঠকিয়েছে পচা নারকেল গছিয়ে দিয়ে। তার টুকরো ও চেয়ে নিয়ে রুকস্যাকে গুছিয়ে রাখছে কেন? হিমালয় ওকে ভগবানে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ল নাকি?
সুযোগ পেতেই খোঁচা মারলাম, "এটা কী হল?"
উত্তর পেলাম, "জ্বালিও না তো। মায়ের জন্যে নিলাম।"
"ওই পচা নারকেল?"
"মায়ের হাতে দেব, পচা কী ভাল মা বুঝবে, হাতে পেলেই মা খুশী হবে। আমার এই কয়দিনের আনন্দের ভাগ তো মাকে দিতে পারব না, প্রসাদটুকুই তাই দেব।"
"অত আনন্দ আনন্দ কর না, নীচে নামবে কি করে ভেবে দেখেছ? নামবে যেদিকে সেদিকে তো খাড়া দেওয়ালের মত পাহাড়ের ঢাল। পিঠে পনেরো কিলোর বোঝা নিয়ে নামতে পারবে?"
"সে দেখা যাবে।"

দৃশ্য ২

ওপরের ঘটনার পর তৃতীয় দিন।
লোয়ার দামনির জঙ্গল ছেড়ে ঘণ্টাখানেক হেঁটে ওরা সবাই নেমে এসেছে বাঁধানো রাস্তায়। পথের একদিকে সার দিয়ে রকমারি দোকান, অন্যদিকে গভীর খাত দিয়ে যমুনা নদী বয়ে চলেছে তীব্র স্রোতে। বাঁধানো পথটি ধরে বাঁ দিকে কয়েক কিমি গেলে যমুনোত্রীধাম। ধামের দিকে যাওয়ার আগ্রহ নেই দলের কারোরই। বদলে ডান দিকে কয়েক কিমি হেঁটে ওরা জনপদে পৌঁছাবে, যেখান থেকে গাড়ির পথ শুরু। সেই দিকে রওনা দেওয়ার আগে বেশ কয়েক দিন পরে সভ্য জগতে ফিরে আসাটাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পালন করতে হবে না? একজনের চা খাওয়ার প্রস্তাবে দলের সবাই তাই সানন্দে সাড়া দিল।

সেই লোকটিকে আবার চোখে পড়ল, মনোযোগ দিয়ে ধামের যাত্রীদের দিকে দেখছে। যাঁরা বাঁদিকে যাচ্ছেন তাঁদের ধামে পৌঁছতে সময় লাগবে এখনও খানিকক্ষণ, আর যাঁরা ডানদিকে যাচ্ছেন, তাঁদের তীর্থদর্শন সাঙ্গ হয়েছে, ফিরে আসছেন। পদযাত্রী নেই বললেই চলে, যাঁরা যাচ্ছেন সবাই মোটামুটি খচ্চরের পিঠে বা মানুষের কাঁধে চেপে, সবই ডান্ডি, কান্ডি একেবারেই চোখে পড়ছে না। ওদের দিকে তাকিয়ে আমাদের পরিচিত সেই মানুষটি কি এত দেখছে?
জিজ্ঞাসা করলাম, "কি দেখছ এত আগ্রহ নিয়ে?"
"জানই তো, এতদিন হিমালয়ে আসছি, কখনও কোন তীর্থের এত কাছে আসিনি, আজ এই প্রথম এলাম। সবার কাছে শুনেছি এই তীর্থপথ নাকি খুব দুর্গম, কোথায়? বাঁধানো রাস্তা, ধারে লোহার রেলিং, খাদে পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।"
"দুর্গম ছিল একসময়, বইতে পড়েছ নিশ্চয়। এখন কি আর তা থাকে? কোন তীর্থই এখন আর আগের মত দুর্গম নেই। দিনকাল বদলেছে, এখনকার তীর্থযাত্রীরা কি অতীতে বইতে যেমন পড়া যায় তেমন কষ্ট সহ্য করে তীর্থে যায় নাকি? অত সময় কোথায় এখনকার মানুষের হাতে?"
"তা তুমি মন্দ বল নি। কিন্তু শুধু যাত্রাপথটাই কি বদলেছে? আর কিছু বদলায় নি?"
"আবার কী বদলাবে? সেই তো দলে দলে মানুষ চলেছে, আগেও যেত, এখনও যাচ্ছে।"
"কিছুই তোমার চোখে পড়ে না। মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ। কী দেখছ?"
"কী আবার দেখব?"
"কত দূর দূর অঞ্চল থেকে এরা সব এসেছে, কেউ অভীষ্ট পূরণের এত কাছে, কেউবা লক্ষ্যে পৌঁছে ফিরে আসছে, এদের চোখেমুখে তৃপ্তি বা আনন্দের ছাপ কোথায়? খচ্চরের পিঠে যারা যাচ্ছে, তাদের চোখেমুখে শুধু ভয় ফুটে বেরোচ্ছে। আর যারা মানুষের পিঠে চেপে যাচ্ছে তাদের মুখে যেন কলকাতার হাতে টানা রিকশায় চেপে যাওয়ার সময়ে যাত্রীদের মুখে যে গর্বোদ্ধত ভাব দেখা যায়, তেমন একটা ভাব।"
বললাম, "তুমি বড় বাজে বকো।"
"বাজেই বকছি হয়তো। কিন্তু কী জান, হিমালয়ের পথে পথে হাঁটতে গিয়ে অনুভব করেছি সব সময়, হুজুগে কিছু লোককে বাদ দিলে যারাই আমাদের মত পথ হাঁটে, শুধু লক্ষ্যে পৌঁছানোটা তাদের উদ্দেশ্য থাকে না, চলার পথের আনন্দই তাদের টেনে আনে এখানে। পথের সব কষ্ট তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। এতদিন বইতে পড়ে পড়ে তীর্থযাত্রীদের সম্বন্ধেও যেন সেই ধারণাই মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। হিমালয়বিষয়ক লেখাতে কত সময় পড়েছি ভক্তি আর পুন্যার্জনের আগ্রহ এই তীর্থযাত্রীদের টেনে এনে পথে নামায়, দুঃখ কষ্ট পেতে পেতে তারা গন্তব্যে পৌঁছায়, আর পুরো যাত্রাপথটাই তারা হিমালয় ভ্রমণের আনন্দ পায়। ভেবেছিলাম তেমন আনন্দই তারা পায় যেমন আমরাও পাই, আমরা - যাদের মধ্যে ভক্তির ছিঁটেফোঁটাও নেই। কিন্তু আজ এদের মধ্যে সেই আনন্দটাই তো চোখে পড়ছে না। যেন কর্তব্য পালনে চলেছে, একটা ধাম 'শেষ' করে আরেক ধামের দিকে যেতে হবে, সেই তাড়া এদের মধ্যে, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর বা পথ চলার তৃপ্তি বা আনন্দ কাউকেই তো পেতে দেখলাম না। এখনকার ভক্তি কি তাহলে এমনটাই? নামকরা সব লেখকেরা তাহলে কী লিখে গেছেন? মনে হয় গাড়িতে চেপে, তারপরে মানুষ বা খচ্চরের পিঠে চেপে যাওয়ার ফলে আর আগের সেই তীর্থযাত্রার কষ্ট নেই বলেই এদের মধ্যে লেখকদের বলা সেই আনন্দ উপভোগের ক্ষমতাও হারিয়ে গেছে। আর আমরা এখনও হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে ঘুরি বলেই আমাদের সেই আনন্দ উপভোগের আগ্রহ একটুও কমে নি মনে হয়, যা সত্তর বছর আগে ছিল, এখনও একই রকম রয়েছে।"

"লম্বা বক্তৃতা দিয়ে ফেললে দেখছি। এই কয়জন তীর্থযাত্রীকে দেখে সবার সম্বন্ধে ধারণা করে ফেললে? অনেক বড় বোদ্ধা হয়ে গেছ!"
"তা ঠিক বলেছ, পুরোটাই হয়তো আমার দেখার ভুল, বোঝার ভুল।"
চা খাওয়া হয়ে গেছে, মানুষটি নিজের রুকস্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে শুরু করল গাড়ির পথের দিকে।

দৃশ্য ৩

কয়েকদিন পরের কথা। সকালবেলা লোকটা কলকাতায় বাড়ি এসে পৌঁছাল। দীর্ঘ রেলযাত্রাতে ক্লান্ত, বিরক্ত। বাড়িতে ঢুকে রুকস্যাকের জিনিসপত্র খালি করছে দেখতে পাচ্ছি, যেগুলো কাচার জিনিস সেগুলো আলাদা করে রাখছে। হাতে পড়ল সেই গিরিবর্ত্মের উপরে পুজোর প্রসাদ শুকনো নারকেলটুকু, যা যত্ন করে মায়ের জন্যে নিয়ে রেখেছিল।
টান মেরে টুকরোটাকে বাগানে ফেলে দিল মানুষটি। আমি হা হা করে উঠলাম, "কর কী, কর কী!" বলে।
ও বলল, "পচা এক টুকরো নারকেল, ফেলব না তো কী করব?"
"সে তো ওখানে যখন হাতে পেয়েছিলে তখনই পচা ছিল, তখন তো দিব্যি গুছিয়ে রেখেছিলে, এখন ফেলে দিচ্ছ কেন?"
উত্তরে ও আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল। বলল, "কী দেখছ?"
"কি আবার দেখব? আকাশ দেখছি, একটু মেঘলা, বৃষ্টি হবে মনে হয়।"
"ধুর, তা বলছি না, আকাশের রঙটা দেখ। কেমন? ধূসর, তাই না? যখন এই প্রসাদ হাতে নিয়েছিলাম, কেমন ছিল আকাশের রঙ? ঘন নীল। হিমালয়ে ওই নীল আকাশের নীচে যাকে মনে হয়েছিল মূল্যবান, আজ এই সমতলে ধূসর আকাশের নীচে এসে তার মূল্য আর কানাকড়িও নয় আমার কাছে।"
"তোমার জন্যে তো আননি, এনেছ মায়ের জন্যে, তিনি মূল্য দেন কি না দেন সেইটা দেখবে না?"
"কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়া আমার ধাতে নেই। এবার ভাগো তো, আর বকিও না, এই কয়দিন খুব জ্বালিয়েছ, এবার আমার পেছন ছাড়। তাড়াতাড়ি চান খাওয়া করে অফিস বেরোব।"
ভাবছিলাম, পাহাড় থেকে সমতলে ফিরে সেই আনন্দই হারিয়ে ফেলল সে! এই জন্যই কি পাহাড় ওকে টানে বার বার, নতুন আনন্দের সন্ধানে?

পেশায় ব্যবসায়ী সুমন বিশ্বাসকে পেশার কারণে কলকাতাতেই থাকতে হয়... কিন্তু মন পড়ে থাকে পাহাড়ে-জঙ্গলে-সমুদ্র সৈকতে। সব থেকে পছন্দ হিমালয় ভ্রমণ, তাই সময় সুযোগ পেলেই ছোটেন হিমালয়ে। পছন্দ পায়ে হেঁটে ঘোরা, গাড়িতে চাপেন যখন বাধ্য হন শুধু তখনই... আর ভালবাসেন বই পড়তে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher