ব্রাজিলে দিনকয়েক
বনানী মুখোপাধ্যায়
গত বছর মেয়ে জামাই আমাকে আদর করে ব্রাজিলে নিয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে ব্রাজিল মানে ভূগোলের ম্যাপ আর পেলে। ব্যস। কিন্তু বনানীদির ইচ্ছের সঙ্গে সকলের ইচ্ছে মিলবেনা এটাই সত্যি। অতএব, চলো দিল্লি না বলে চলো ব্রাজিল বলতেই হল।
১৯ ডিসেম্বর ২০১৫, আমাদের বিমান যাত্রা শুরু। প্রথমে নিউইয়র্ক, সেখান থেকে মায়ামি, ওখানে চার ঘণ্টা বসার পর প্লেনে সাও পাওলো। এই নামটা আমার জানা। খবরের কাগজে খেলার পাতায় দেখেছি, সেখানে তিন-চার ঘণ্টা বসে থাকার পর আবার আর একটা প্লেন। তার নাম টাম। এ আবার কেমন নাম? এবার গন্তব্য ইগুয়াজু। এখানকার ফলস নাকি বিশ্ববিখ্যাত। তা হবে। নাম শুনে ভাবলাম আমরা কি জাপানে যাচ্ছি নাকি? নামটা তো সে রকমই। কিন্তু না, এটা ব্রাজিলে। অবশ্য আমার কাছে ব্রাজিলও যা, জাপানও তা। সবই ভূগোল। ওকে, চালাও পানসি ইগুয়াজু।
এখানে একটা মুশকিল, বেশিরভাগ লোকই ইংরিজি জানেনা, হয় স্প্যানিশ, নয় পর্তুগিজ, সর্বনাশের মাথায় পা, কথা বোঝাব কী করে? আমার তেরো বছরের নাতি তিতাসই ভরসা, ও একটু একটু স্প্যানিশ জানে। এই যাত্রায় ওই আমাদের কর্ণধার। পা রাখলাম ইগুয়াজুতে, না, জাপানে নয়, ব্রাজিলেই। হোটেলের নাম - বেস্ট ওয়েস্টন। বেশ ভালো, দেখলে ভক্তি আসে। রেডি হতে না হতেই খাবার সময় হয়ে গেল, ম্যানেজারকে জিগ্যেস করে জানা গেল কাছেই একটা ভাল রেস্তোঁরা আছে নাম - বাফেলো ব্ল্যাঙ্কো। সর্বনাশ! মোষ?? সে কি রে বাবা? মোষের মাংস খেতে হবে? লালমোহনবাবুর কল্যাণে ব্রাজিলের বিচ্ছু তো জানি, কিন্তু ব্রাজিলের মোষ! সেঁটা কি বস্তু?? রাস্তা থেকেই গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এবার সোজা গিয়ে ঢুকে পড়লাম সেখানে। চারদিক সুন্দর করে সাজানো, বসে পড়লাম সবাই।
তারপর শুরু হল মিউজিকাল চেয়ারের মতো একটা ব্যাপার। একজন এলেন হাতে একটা বড় লোহার শিক, তাতে অনেক মাংস গাঁথা। তেনার আরেক হাতে ভয় পাবার মতো একটা ছুরি, প্রত্যেকের পাতে ওর থেকে কেটে কেটে মাংস দিয়ে চলে গেলেন। তারপর আরেকজন এলেন সেম ছুরি সেম মাংস, আবার একজন একই কেস, তারপর আরেকজন। প্রত্যেকেই ওই লোহার ডাণ্ডা থেকে কেটে মাংস দিয়ে গেলেন। শুধুই মাংস আর কিছুই নেই। ওদেরও হাসি হাসি মুখ, আমাদেরও সেম। কথা নেই। শুধু ইশারা। কী জ্বালাতেই পড়লাম রে বাবা। এরপর জামাইয়ের ইচ্ছেতে তেনার ফটোগ্রাফার বউ রান্নাঘরে গিয়ে ছবি তুললেন, আমরা সকলে বিশাল একটা ছুরি ধরলাম তাতে একটা বিশাল মাংস-র টুকরো। সকলের হাসি হাসি মুখ, বাঃ। এদিকে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া।
পরের দিন। আজ যাওয়া হবে ইগুয়াজু ফলস। কিন্তু ব্রাজিলের দিক থেকে নয়, আর্জেন্টিনার দিক থেকে। উঃ কী সহজেই না নামগুলো লিখছি, কিন্তু বনানীদির কপাল মন্দ তিনি আর্জেন্টিনায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না, কারণ তেনার ভিসা নেই। আগে বলা ছিল ভিসা লাগবে না, এখন বলছে লাগবে। না না কোনও মতেই বনানী মুখুজ্যেকে আর্জেন্টিনায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবেনা। শেষ কথা। মনে মনে বললাম, দুর হ, তোদের দেশে যেতে আমার বয়েই গেছে। আমার সঙ্গীদের তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা, মাকে হোটেলে রেখে তারা যাবেনা। অনেক কষ্টে বোঝানোর পর তেনারা রাজি হলেন। মেয়ে খাবারদাবার ফোন সব দিয়ে, টেক্সট কী করে করতে হয় শিখিয়ে দিয়ে, বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে সাত ঘণ্টার জন্যে একা থেকে গেলাম হোটেলের ঘরে। টিভিতে সিএনএন ছাড়া কিছু দেখার নেই, আর সব স্প্যানিশ চ্যানেল, আমার টেক্সটই ভরসা। একবার মেয়েকে আরেকবার আমেরিকায় ছেলেকে ঘন ঘন টেক্সট করতে লাগলাম। ওরা ফেরার পর আবার সেই মাংসের জগতে, আবার লোহার ডাণ্ডা, আবার বিশাল ছুরি।
পরের দিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম ব্রাজিলপ্রান্তের ইগুয়াজু ফলস দেখতে। না, এখানে কেউ বনানীদিকে ঢুকতে দেবনা বলেনি। জামাই বাবাজির হাতে জলজ্যান্ত ভিসা। গাড়ি করে গেট পর্যন্ত গিয়ে আবার বাসে করে অনেকটা ভেতরে যেতে হল। দূর থেকেই তেনার গুড়গুড় ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝলাম এবার দর্শন পাব। তারপরই দেখলাম সেই অপূর্ব সুন্দর জলরাশি। এধার ওধার সেধার - সবদিক দিয়ে ছাপিয়ে পড়ছে। অনেকটা নায়াগ্রার মত। একটু একটু করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আর আমাদের ডানদিক দিয়ে তিনিও চলেছেন চারদিক উপচিয়ে সশব্দে, সগর্বে।
যদিও জল অনেকটা দূরে তবু তার জোর এতটাই যে আমরা ভিজেই যাচ্ছিলাম। জলের রঙ কখনও সাদা কখনও গেরুয়া। লালমাটি জলে মিশলে যেমন দেখতে লাগে ঠিক তেমন। ব্রাজিলের বেশিরভাগ রাস্তাই লালমাটির। ভাবলাম রবীন্দ্রনাথ কি এখানেও আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছেন? একেবারে রাঙা মাটির পথে এনে ফেলেছেন? এই ব্রাজিলে! আর শান্তি করে যে একটু দেখব তারও উপায় নেই। আমার অক্লান্ত অমিত শক্তিশালিনী ফটোগ্রাফারকন্যা তিড়িং বিরিং করে এত ছবি তুলছেন যে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যদিও জানি সে ছবি দারুণ হবে, তবু আমরা তিনটি মডেল পোজ দিতে দিতে ক্লান্ত, কিন্তু তিনি ক্লান্ত নন।
এবার আবার ওপরে ওঠা। আবারও বাসে চেপে চলে এলাম গেটের কাছে - সেখানে গাড়ি আসবে হোটেল থেকে লাগেজ নিয়ে, আর সেটাই চিন্তা, যদি সব লাগেজ না পাই? তাহলে? কী জ্বালা! কাউকে বলতেও পারছিনা, বকুনি খাব। কী করব স্নেহের স্বভাবই এই, অকারণে অনিষ্ট আশঙ্কা করে। যাকগে, ঠিক সময়ে গাড়ি এল। হ্যাঁ সব লাগেজ নিয়ে। পাশেই এয়ারপোর্ট। চলে গেলাম। এবার রিও ডি জেনিরো। বাপ রে, ভূগোল যে তাড়া করে বেড়াচ্ছে! একঘণ্টা পরে পৌঁছলাম সেখানে। লাগেজপত্র নিয়ে বাইরে এসে দেখি, 'Lakshman Srinivasa' লেখা একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে খুশী খুশী মুখে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে আমাদের দেশের লোকেরই মত।
খানিকটা পথ আসতেই দেখলাম সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের মাথার ওপর দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভগবান যীশু। না, ক্রুশ নেই। সাদা আলখাল্লা পরা। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যেদিক দিয়েই গাড়ি যাচ্ছে, দেখা যাছে তাঁকে। অনড় অবিচল। দেখতে দেখতে চলে এলাম সমুদ্রের কাছে। কোপাকাবানা বিচ। কিন্তু হোটেল কোথায়? ঠিকানা দেখে যেখানে দাঁড়ালাম জায়গাটা কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডের মতো। গিজগিজ করছে লোক, গিজগিজ করছে বাড়ি আর গিজগিজ করছে গাড়ি। তারই সামনে সীবিচ। অদ্ভুত ব্যাপার হোটেলের অ্যাড্রেস মিলছে, কিন্তু নাম মিলছেনা! আসলে ব্রাজিলের ভাষায় নামটা লেখা বলে বোঝা যাচ্ছিল না। দরজার সামনেই গাড়ির ভেতর বসে ছিলাম। ভোগান্তি আর কাকে বলে!
হোটেল নয়, অ্যাপার্টমেন্ট। ন-তলার ওপরে। ঘরে ঢুকে আমি আর নাতি দুজনেই ধপাস, খুবই টায়ার্ড। বাকি দুজন বিচে ঘুরতে গেল। কিন্তু ফিরল মুখে একরাশ মেঘ নিয়ে। শুনলাম বিচে যাওয়া মাত্র লক্ষ্মণের সোনার চেন ছিনতাই হয়েছে, তবে চেনটা নিতে পারেনি, সোনার গণেশের লকেটটা চলে গেছে। প্রথম দিনেই মন খারাপ।
পরের দিন। ২৩ ডিসেম্বর। এই বাড়িটার একটা সুবিধে আছে, উলটোদিকেই ট্রাভেল এজেন্টের অফিস - RIO MAXIMA। সেখান থেকেই বাসে উঠতে হবে। আজ যাব ওই যীশুকে দেখতে। আমার তো হাত পা ঠান্ডা। অত ওপরে উঠব কী করে? কিন্তু বলতে সাহস হচ্ছেনা, তাহলেই শুনব "সব সময় এত নেগেটিভ কথা বোলোনা তো।" অতএব চুপচাপ গিয়ে বাসে উঠলাম আর বসে বসে পজিটিভ কথা ভাবতে লাগলাম।
গাইডটি বেশ ভাল, মাঝারি বয়স, নাম কার্লোস, একবার ইংরেজিতে বলছে, আরেকবার স্প্যানিশে। আমরা ছাড়া আর যারা বাসে আছে তারা কেউ ইংরেজি জানেনা। প্রথমেই যাওয়া হল মহান যীশুর আশ্রয়ে – ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার (CHRIST THE REDEEMER)। এই নামেই উনি পরিচিত – বিশ্বের নতুন সাত আশ্চর্যের একটি। আমি তো ভেবেই যাচ্ছি, কী করে উঠব? বাবা যীশু, কত পাতকীকে উদ্ধার করেছ এবার বনানীদিকেও উদ্ধার করে দাও প্রভু। একটা কোন ব্যবস্থা করে দাও। কী আশ্চর্য, একটু এগোতেই দেখলাম সামনে চলন্ত সিঁড়ি, ওপরে ওঠবার জন্যে, একটু ওঠার পর আবার চলন্ত সিঁড়ি! আমি তো যারপরনাই প্রীত। যীশু কথা শুনেছেন। কিন্তু সবসময়ই যে বনানীদি আনন্দে থাকবেন তার তো কোনও মানে নেই, তাঁকেও তো প্যাঁচে ফেলতে হবে। তাই ফেলা হল। শেষ চত্বরে পৌঁছবার জন্যে আর চলন্ত সিঁড়ি নয়, রোপওয়ে। ব্যস, সব্বনাশের যেটুকু বাকি ছিল, বাবা যীশু তাও করে দিলেন। কাঁদবারও উপায় নেই, তিন শত্রু - মেয়ে জামাই আর নাতি একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। নাতির হাত ধরে অসীম সাহসে ভর করে উঠে পড়লাম সেই শূন্যে ভাসন্ত কামরাতে। চারদিকে কাঁচের জানলা, সব দেখা যাচ্ছে। দম বন্ধ করে যীশুবাবাকেই ডাকছিলাম।
অবশেষে পৌঁছলাম সে জায়গায় - কোরকোভাদো পাহাড়ের চূড়ায়। যীশুর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখতে হচ্ছে - বিশাআআল মূর্তি, সাদা আলখাল্লা পরা, দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে, যেন সবাইকে আশ্বাস দিচ্ছেন - তোমাদের কোনও ভয় নেই, আমি আছি। চোখে জল এসে গেল। নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম এই জায়গায় আসার জন্যে এত ভয় পাচ্ছিলাম! ছিঃ। তবে মনে মনে একটু অহংকারও হচ্ছিল এই অসামান্য মূর্তিটা দেখতে পেলাম বলে। এবার নীচে নামার পালা, একেবারে বিজয়িনীর মত গট গট করে রোপওয়েতে চেপে, চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, অসীম সাহসী হয়ে নেমে এলাম। ওপরের চত্বর থেকে ব্রাজিল দেখা একটা অভিজ্ঞতা। কোনদিন ভুলবনা।
এবার গন্তব্য রিও-র বহু পুরনো চার্চ, চারদিক খুব সুন্দর করে সাজানো, সিলিঙটা লালনীল কাঁচ দিয়ে ঘেরা। অপূর্ব দৃশ্য। অত লোক, সারিবদ্ধ হয়ে দেখছে, কিন্তু কেউ একটু শব্দ করছে না। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। বুকের ধক ধকও। যেতে যেতে মারকানা ফুটবল স্টেডিয়াম দেখতে পেলাম ওরা নেমে গেল, আমি না। ওখানে এখন না আছে পেলে না আছে মারাদোনা, তো আমি গিয়ে কী করব? এরপর যেখানে রিও-র বিখ্যাত কার্নিভাল হয়, সেখানে নামা হল, যে পোশাক পরে ওখানে মেয়েরা নাচে, আমার বীরাঙ্গনা কন্যা অবলীলায় সেই পোশাক পরলেন আর ছবিও তুললেন। মিথ্যে বলবনা, দেখতে ভালই লাগছিল।
এবার লাঞ্চ, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই রেস্তোঁরা, সেখানে বাসের সবাই খেতে গেলাম। ব্যুফে। অসুবিধে একটাই - কেউ একটা শব্দও ইংরেজি জানেনা। মোটামুটি ইশারাতেই সব সারতে হচ্ছে।। এরপর যাওয়া হবে সুগার লোফ-এ (SUGAR LOAF)। এটা একটা বিশাল পাহাড়ের চারদিকে রাস্তা, রেলিং দেওয়া। তাই ধরে ঘুরতে ঘুরতে ওপরে ওঠা। না কষ্টও হয়নি, বুড়ি বনানীদি ব্রাজিলে আসবে এ তো কল্পনারও অতীত ছিল। কী জানি, আরও কী কী দেখা বাকি আছে!
২৪ ডিসেম্বর, আজ এখানে ছুটির দিন, অফিসকাছারি বন্ধ। অতএব আজ কোথাও যাওয়া নেই। সারাদিন সমুদ্রের পাড়ে বিচরণ কর। খাও-দাও কেনাকাটা কর। কিন্তু কোনোক্রমে ওই দামী ক্যামেরাটি বিচে নিয়ে এসো না, তাহলে তক্ষুনি অন্যের করায়ত্ত হয়ে যাবে। অতএব মনের দুঃখে বনে না গিয়ে সবাই সাগর নিয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিল। বিকেলে আবার বিচে গিয়ে দেখলাম সব আলোয় আলোকময়। বড়দিনে কোপাকাবানা বিচও সেজেছে। সান্টা দাদুও গাড়ি করে ঘুরে গেলেন। বেশ ভাল লাগছিল।
২৫ ডিসেম্বর, আজ আমরা অরণ্যচারী হব। কেন? জানিনা। কিছুতেই বলতে পারলাম না - আরে বাবা, আমি কী করতে জঙ্গলে যাব! সাদামাটা নাটক লিখি। ওসব জঙ্গল নিয়ে উপন্যাস লেখার কোনও ইচ্ছে নেই। কিন্তু চোরা না শোনে ধরমের কাহিনি। আমাকে যেতেই হবে। শুনলাম, ওখানে নাকি অনেক বাঁদর আছে, শুধু বাঁদর দেখতে যাব? বাঃ, শুনে পরান জুড়িয়ে গেল। আবার সেই একই জায়গা থেকে বাসে উঠলাম। ক্লারা বলে একটি মেয়ে, সে-ই গাইড, সঙ্গে আর একজন আছেন। অনেকটা বেঁটে, নৃপতি চাটুজ্জের মত দেখতে। ষাট কী পঁয়ষট্টি মতো বয়স হবে। ভাল ইংরেজি বলেন। অনেকটা পথ যাওয়ার পরও জঙ্গল আর আসে না।। কোথায় সীতা কোথায় সীতার মতো কোথায় জঙ্গল, কোথায় জঙ্গল বলে হাঁপিয়ে উঠেছি তখনই তিনি এলেন। ইতিমধ্যে আর একটি অল্পবয়সী মেয়ে বাসে উঠেছে, সে আমাদের নতুন গাইড আলেক্সা; ভারী হাসিখুশি, ইংরেজিও ভাল বলে। সে আর নৃপতিবাবু একবার স্প্যানিশ আর একবার ইংলিশ বলতে বলতে চললেন। এটা রেইন ফরেস্ট, নাম তিজুকা ন্যাশনাল পার্ক। রিও শহরের অনেকটা এলাকা জুড়ে এই জঙ্গল নাকি বিশ্বের বৃহত্তম আর্বান ফরেস্ট। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, রাস্তার দু ধারে প্রচুর কাঁঠাল গাছ দেখলাম। বড় বড় কাঁঠাল ঝুলছে দেখে ভাবছিলাম, আচ্ছা, এরাও কি এঁচোড়ে পাকে? নাকি সেটা শুধু বঙ্গসন্তানদের জন্যেই প্রযোজ্য? এছাড়া কলাগাছও প্রচুর। ছোট ছোট মোচা ঝুলছে। রঙটা একটু পার্পল ধরনের। কেমন খেতে কে জানে! ছোলা, ঘি-গরম মশলা দিয়ে রান্না করলে কি একইরকম লাগবে? প্রচুর জবা গাছও দেখলাম। নানা রঙের জবা। বিশাল ঝরনা, অনেক দূর থেকে নেমে আসছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। আর একটু উঁচুতে উঠে দেখলাম ব্রাজিলের শেষ সম্রাটের খাওয়ার জায়গা। বিরাট চত্ত্বর। জঙ্গলে বেড়াতে এসে রাজামশাই এখানে সদলবলে খাওয়াদাওয়া করতেন। বাগানে দোলনাটা দেখে মনে হচ্ছিল, ওখানে যারা দোল খেত, সেই রাজকুমারীরা কেমন দেখতে ছিল? সুন্দর? কেমন পোশাক পরতো?
ইতিমধ্যেই আলেক্সার সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে। এসো, চলো আর ভালবাসি, এই তিনটে বাংলা কথাও শিখে গেছে। থেকে থেকেই বলছে - চ - লো, এ--- সোঁ আর ভা---- লো---- বা-- সি। আমাকে তো 'মম, মম' করে মাথা খেয়ে দিচ্ছে। আমার সঙ্গে ছবিও তোলা হল। হেঁটে হেঁটে হয়রান হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন অরণ্যের দিনরাত্রি। আলো-আঁধার মেশা বড় বড় গাছের ছায়ায় সবাই মিলে বেড়াবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
ফিরে এসে রাত্তিরে আবার বিচ। আলোয় ঝলমল করছে। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরে ফেরত এলাম। আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে উলটোদিকের বাড়িটার অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটাতে খ্রিস্টমাস ট্রি সাজানো। একেকটা ঘরে এক-এক রকম পর্দা। এক-এক রকম লোকজন। একটা ঘরের বারান্দায় এক বুড়ি ঠায় বসে আছে। আর একটা ঘরে সাত-আটটা ছেলেমেয়ে খুব সেজেগুজে বসে গিটার হাতে গানবাজনা করছে। অন্য আরেকটা ঘরে একজন লোক সমানে পায়চারি করছে, থামছে, বসছে, ব্যায়াম করছে, গেঞ্জি খুলে ফেলছে আবার পায়চারি। হিচককের রিয়ার উইন্ডো (REAR WINDOW) ছবিটার কথা মনে পড়ছিল। মাথায় অনেক প্লটও এসে গেল। দেখা যাক, ফিরে বনানীদির দপ্তর থেকে কী লেখা বেরোয়।
২৬ ডিসেম্বর। আজ আবার বাসে করে বেরনো হল। যা যা দেখবার আছে, সব দেখতে হবে। এদিনের গাইডটি ভীষণ স্মার্ট। বয়স বছর পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে। অনর্গল ইংরেজি, স্প্যানিশ আর পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছে। আমাদের ফটোগ্রাফারও যথারীতি ছবি তুলে যাচ্ছেন, আমরাও যথারীতি পোজ দিয়ে যাচ্ছি। আর সহ্য হচ্ছে না।
বাসে আজ অনেক বেশি লোক। তার মধ্যে দুজন ব্রেজিলিয়ান মহিলা – মা আর মেয়ে, প্রচুর কথা জিগ্যেস করছে গাইডকে। মহিলা আমারই বয়সী হবেন বোধহয়, মাঝে মাঝেই আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকাচ্ছেন। বুঝতেই পারছিনা ঘটনাটা কী? এরপর যদি ক্যাচ-কট-কট হয়ে যাই তাহলে তো অনর্থ হয়ে যাবে। বনানীদি পুরো বেসামাল। আমার কথা উনি বুঝবেননা, আর ওনার কথা আমিও। মনে মনে বললাম, বাবা যীশু, উদ্ধার কর। প্রথমে একটা মিউজিয়াম দেখে তারপর রাজার প্রাসাদ। খাসমহলে ঢোকার আগে নিজের জুতোর নীচে আর একটি বিশেষ জুতো পড়তে হবে, তারপর পা ঘসে ঘসে ভেতরে যেতে হবে। আমার কপালে এমন জুতো এল যার ভেতর আমার পুরো ফ্যামিলি ঢুকে যাবে। একেবারে নাকানিচোবানি অবস্থা।
বিশাল মহল, বিশাল বিশাল অনেক ঘর; রাজা, রানি, রাজপুত্র, রাজকন্যে - সবার ঘর। এছাড়া খাবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর, গান শেখার ঘর। ঠিক সেই আসবাব দিয়ে, সেই ভাবেই রাখা আছে। চারদিকে সোনা রুপো হীরে চুনি পান্নার ছড়াছড়ি। মনে হচ্ছিল যেন হীরকরাজার দেশে এসেছি। রাজার মুকুটটা দেখে অবাক লাগছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, যিনি প্রথম পরেছিলেন না জানি কেমন দেখতে ছিলেন!
বাইরে এসে বসলাম, আর ওরা গেল ছবি তুলতে। আর তক্ষুনি বুঝলাম কী ভুল করেছি। আমি ধৃত হলাম। আগে থেকেই সেখানে বসে আছেন ওই মহিলা। আমাকে ওঁর ভাষায় যীশুর জীবনী শোনাবার চেষ্টা করলেন। আমি হাসি হাসি মুখে বোঝবার ভান করতে লাগলাম। একবার বললেন - মাদার তেরেসা? কাল কুটা? ইন্ডিয়া? মাথা নাড়লাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললাম মাদার তেরেসা। ব্যস, মহিলা খুব খুশি।
এরপর লাঞ্চ। খেতে হবে। কী খেলামটা বলতে পারবনা। ভাতের মত একটা কিছু, তার সঙ্গে স্বাদগন্ধহীন চিংড়িসেদ্ধ। সবাই খাচ্ছে। আমিও খেয়ে নিলাম। এরপর আরও দু-একটা জায়গা দেখা হল, যদিও সেগুলো খুব একটা দেখার মতো নয়, তবু যাওয়া হল। কাল চেকআউট করব।
রাত্রে কোপাকাবানা বিচে আবার টহল দিলাম। মন খারাপ করছিল। অনেকক্ষণ বসে থেকে চলে এলাম। কাল আবার নতুন যাত্রা শুরু হবে। এবার পেরু – সেখানে রয়েছে ইনকাদের প্রাচীন রাজধানী মাচুপিচু, সেও আরেক আশ্চর্য।
বিদায় ব্রাজিল, বিদায় অতন্দ্রপ্রহরী সদাজাগ্রত যীশু।
মধুসংলাপী নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের কন্যা বনানী মুখোপাধ্যায় নিজেও অত্যন্ত জনপ্রিয় শ্রুতিনাট্যকার। শিশুকাল থেকেই নাটকের পরিবেশে মানুষ। ইচ্ছে ছিল মঞ্চ অভিনেত্রী হওয়ার, কিন্তু হলেন নাট্যকার। হয়তো সেটাই ভবিতব্য ছিল।