দুর্গাপুর – ইতিহাসের খোঁজে

তপন পাল



-১-
দুর্গাপুর। শুনলেই মনে হয়না খুব দুর্গম জায়গা?
১৭৬৫। বর্ধমানের মহারাজা জঙ্গলমহলের একাংশ পত্তনি দিলেন গোপীনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর নামে মৌজাটির নাম হল গোপীনাথপুর। আমৃত্যু গোপীনাথ চেষ্টা করে গেলেন ঘন জঙ্গল কেটে বসত বানানোর। তাঁর মৃত্যুর পর বংশধর দুর্গাচরণ সাগরভাঙা অঞ্চলে নতুন বসত বসালেন। ১৭৯৩-এ প্রতিষ্ঠিত হল কালীমন্দির, ১৮০৩-এ শিবমন্দির। সাগরভাঙার সেই জমিদারবাড়ি আজও নাকি দাঁড়িয়ে!
সময় গড়ায়। ১৮৫৪-র ১৫ অগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি রেলগাড়ি চালাল হাওড়া থেকে হুগলী। ১ সেপ্টেম্বর রেললাইন গিয়ে পৌঁছল পান্ডুয়া, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৫-তে বর্ধমান হয়ে রানিগঞ্জ। তখনই স্থানীয় লোকজনের প্রচেষ্টায় দুর্গাচরণের নামে স্থানীয় স্টেশনের নাম হল দুর্গাপুর। ১৯০৫-এর ঘোর রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে বার্ন কোম্পানি নিঃশব্দে সূচনা করল শিল্পায়নের। অতঃপর দামোদর, মেঘনাদ সাহা, নেহরু, বিধান রায়, ভারতের রূঢ়… নানান লব্জের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে গেল এক জনপদের লৌকিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাতত্ত্ব।
আমাদের শৈশবে, ১৯৬৯ নাগাদ, শুকতারা পত্রিকায় হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ধারাবাহিক একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, খুব সম্ভবত নাম ছিল রক্তদেউল। ডাকাতদল কর্তৃক এক জমিদারকন্যার অপহরণ ও কালক্রমে সেই বালিকার ওই দলের নেত্রী হয়ে ওঠার উপাখ্যান। পরবর্তীকালে কোণঠাসা হয়ে ওই দলনেত্রী মেজর জেনারেল সার উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান (আগস্ট ১৭৮৮ - ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬)-কে জানান অমুক দিনে তিনি জঙ্গলস্থিত কালীমন্দিরে আত্মসমর্পণ করবেন। ঠগীদমনকারী স্লিম্যান নির্ধারিত দিনে গিয়ে দেখেন বালিকাটি আত্মহত্যা করেছেন, ধরা দেননি। সেই তখন থেকে আমার দুর্গাপুর দেখার ইচ্ছে। অধুনালুপ্ত হাওড়া মোগলসরাই প্যাসেঞ্জার বা আজকের শতাব্দী, যখনই রেলগাড়ি দুর্গাপুরে থেমেছে আমার ইচ্ছে হয়েছে গাড়ি থেকে নেমে চলে যেতে। কিন্তু... অমন কত ইচ্ছেই তো হয়। সব কি আর পূর্ণ হয়!
২১ অগস্ট ২০১৬, রবিবার। ১৩০৫১ হাওড়া-সিউড়ি হুল এক্সপ্রেস। এই ট্রেনটিতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এতদিন কোন সংরক্ষিত কামরা ছিল না। একটি সংরক্ষিত আসনযান কামরা ডি-১ পরীক্ষামূলক ভাবে ১৫ আগস্ট থেকে ছয় মাসের জন্য ওই গাড়িতে সংযোজিত হয়। যদি সংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণী কামরার পৃষ্ঠপোষক জোটে তাহলে ওই কামরাটি পাকাপাকিভাবে ওই গাড়িতে সংযোজিত হবে। শোনা যাচ্ছে শিগগিরই গাড়িটি সুপার ফাস্ট শ্রেণীতে উন্নত হবে এবং তার ক্রমিক হবে ২২৩২১/২২৩২২। এই ট্রেনটি আগে ডিজেলে চলতো। ২০১৪-র অক্টোবরে ভালকি মাচান থেকে ফিরেছিলাম এই ট্রেনে। তদবধি তিনি ডিজেল ছিলেন। সাবেকি ALCO ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ট্রেনের এক স্বাতন্ত্র্যনির্দেশক 'পুল' থাকে – যেন কাদার উপর দিয়ে হড়কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকদিন ধরে ডিজেল ট্রেন চাপতে ইচ্ছে হচ্ছিল। স্টিম তো আর নেই, স্মৃতিমেদুরতা রেখে সে তো হাঁটা দিয়েছে না ফেরার পথে। তাই ডিজেলই সই। কিন্তু পাই কই? দক্ষিণ-পূর্ব রেলে হাওড়া থেকে ডিজেলচালিত ট্রেন এখন মাত্র দুটো, ১৮০০৭/১৮০০৮ হাওড়া-সিমলিপাল ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ও ২২৮০৩/২২৮০৪ হাওড়া-সম্বলপুর সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটোর কোনোটাই যাওয়ার মতন নয়। পূর্ব রেলের সাহেবগঞ্জ লুপ লাইন হয়ে যাওয়া সব গাড়িই অবশ্য ডিজেলচালিত। কিন্তু উত্তরবঙ্গে কোথায় যাব এই ভরা বর্ষায়? হায় ডিজেল, তোমার দিন গিয়াছে।
আজকাল যখন কারও ডুয়ার্স যাওয়ার গল্প শুনি, একরাশ স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে। চাকরি জীবনের শুরুতে, ১৯৮১ – ১৯৮৫, আমি ছিলাম উত্তরবঙ্গে। তখন মুঠিফোন ছিলনা, এমনি ফোনেও কারোকে ডাকতে হলে ট্রাঙ্ককল বুক করে তীর্থের কাক হয়ে ফোনের পাশে বসে থাকতে হত। একটা গাড়ি নিয়ে একবার অফিস থেকে বেরোতে পারলেই আর তোমাকে পায় কে! কোথাও তোমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে! এমনি ভাবেই তো পারুলবনের চম্পার সাথে চেনাজানা। তখন ডুয়ার্সে শখ করে বেড়াতে যাওয়ার লোক ছিল কম, জীবন ছিল অনেক শ্লথ, মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ। বায়ু মধু বহন করত, নদী-সিন্ধুসকল মধু ক্ষরণ করত। ওষধি-বনস্পতিসকল ছিল মধুময়। কত অচেনা অজানা অরণ্যে চা বাগানে কত দিন কত রাত কাটিয়েছি তখন। তারপরেই উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি।

-২-
অবশেষে দুর্গাপুরে। ঘড়িতে তখন দশটা। দুর্গাপুরে কলকাতার মত হলুদ ট্যাক্সি চলে, তাঁরা সার দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে। তাঁদের একজনকে ঠিক করা হলো। তিনি সবিনয়ে জানালেন, দেউল শ্যামারূপা কিস্যুটি চেনেন না, কারণ তাঁরা ভাড়া পান মূলত সেলস-এর লোকেদের; তবে 'চিন্তা করবেন না, নিয়ে ঠিকই যাব।' তা তিনি গেলেনও, এবং দিনের শেষে দেখা গেল আমার সঙ্গে সারাদিনে ঘুরে, মন্দির-টন্দির দেখে তিনি অতিশয় প্রীত হয়েছেন। দুর্গাপুর স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে অনেক ধন্যবাদ জানালেন, বললেন আমার সৌজন্যেই তাঁর দেবীদর্শন হল।
শহর ছাড়াতেই শাল সেগুন পলাশের জঙ্গল। কোনও শহরের এত কাছে অরণ্য দেখতে পাওয়াটা ভাগ্যের কথা। প্রথম গন্তব্য রাঢ়েশ্বর শিব, লোকমুখে যা আড়াশিব নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। শহর ছাড়িয়ে বনস্পতির ছায়ায় অনেকখানি ছড়ানো জমি নিয়ে মন্দিরটি অনেকটা উঁচু ভিতের ওপর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও কয়েকটি 'থান'। পিছনে বাবার বিল। শীতের কোথায় কি, এর মধ্যেই দ্বিচক্রযানারূঢ় বালকবৃন্দ বনভোজনে ব্যাপৃত। গেলে মনে হয় গাছের ছায়ায়, গাছের হাওয়ায়, বাবার মায়ায় দিনটা মন্দির চত্বরে শুয়েই কাটিয়ে দিই।
তারপর অনেকখানি রাস্তা অরণ্যানী চিরে; মূল রাস্তা থেকে ডাইনে বেঁকে, গড়জঙ্গল রোড ধরে এঁকেবেঁকে, শ্যামারূপা মন্দির। ইস্কুলে উঁচু শ্রেণীতে আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে হত। মঙ্গলকাব্যের একটা অংশ ছিল লাউসেনের কাহিনি। গোপরাজ ইছাইঘোষ স্থানীয় রাজা কর্ণসেনকে পরাজিত করে অধুনা বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গা অধিকার করে নিজেকে স্বাধীন গোপভূমির সার্বভৌম রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। পরের বছর কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন ইছাইঘোষকে হত্যা করেন। 'মুক্ত হৈল ইছাই জগতে জয় জয়।। সমরে গোয়ালা বীর পড়িল নিশ্চয়।। রণ জিন্যা বসিল দুর্লভ সদাগর।।' ইছাই ছিলেন দেবী চন্ডীর ভক্ত। নিজের গড়ের মধ্যে মন্দির বানিয়ে সেখানে দেবীর পুজোর ব্যবস্থা করেন তিনি। মন্দিরটি বনের মধ্যে, অনেকখানি ছড়ানো জমি নিয়ে, বনস্পতির ছায়ায়; এবং এখানেও দ্বিচক্রযানারূঢ় যুবকবৃন্দ বনভোজনে ব্যাপৃত। ঢেউখেলানো জমিটির নাম শ্যামরূপার গড়। তবে কয়েকটি সিঁড়ি আর মাটির ঢিবি ছাড়া গড়ের আর কোনও চিহ্ন নেই। শ্যামরূপার মন্দিরটি নতুন। পুরোহিত মহাশয়ের কাছ থেকে যেটা জানা গেলো সেটা মোটামুটি এইরকম -
অনেক অনেক বছর আগে এখানে ছিল এক কাপালিকের আস্তানা, তিনি নরবলি দিতেন। মহারাজ লক্ষ্মণসেন (১১৭৮ – ১২০৬) বক্তিয়ার খিলজির দ্বারা গৌড় থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় নেন। তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন 'স্মরগরল খন্ডনং মম শিরসি মন্ড্নং দেহি পদপল্লব মুদারম'-এর কবি জয়দেব। কেন্দুলি থেকে অজয় পেরিয়ে তিনি এই মন্দিরে আসতেন। প্রথম জীবনে দেবী চণ্ডীর সাধনা করতেন। পরে তিনি বৈষ্ণব হয়ে যান। ভক্তের ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে দেবী এই মন্দিরে তাঁকে 'শ্যামা'রূপে দেখা দেন। তাই দেবী এখানে শ্যামারূপা। কবি জয়দেব লক্ষ্মণসেনকে বলেন ওই কাপালিককে নরবলি থেকে নিরস্ত করার জন্য। লক্ষ্মণসেন কবিকে বলেন তিনি রাজাদেশ জারি করতে চান না, ভাল হয় যদি কবি জয়দেব শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দিয়ে ওই কাপালিককে বোঝান, তারপরেও কাজ না হলে রাজাদেশের কথা ভাবা যাবে। কবি জয়দেবের সঙ্গে আলোচনায় কাপালিক তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। তিনি ওই আস্তানা ছেড়ে চলে যান। লক্ষ্মণসেন ওই জমির পত্তনি দেন তাঁর আশ্রিত সোমঘোষকে। সোমঘোষেরই পুত্র ইছাই ত্রিষষ্টিগড়ের মধ্যেই পৃথক ঢেকুরগড় স্থাপন করে নিজেকে স্বাধীন হিসাবে ঘোষণা করলে কাঁকসার জঙ্গল ঘেরা ত্রিষষ্টিগড়ের সামন্তরাজা কর্ণসেনের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ বাধে। হেরে যান কর্ণসেন; জয়ের নিশান হিসেবে ইছাইঘোষ দেউলটি গড়ে তোলেন। পরের বছর দুর্গাপুজোর সময় কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন ইছাইঘোষকে হত্যা করেন অজয় নদীর তীরে কাদুনেডাসায়। 'কাটা কন্ধ শ্যামরূপা কোলেতে করিয়া।। আপন দেউল মাঝে রাখে লুকাইয়া।। ... ইছাইঘোষের ঘর দেখি নারায়ণী।। আছাড় খাইয়া মহী পড়িল ঐমনি।। কপাট কাঞ্চন ঢাল ইছাইর ঘর।।...'
ইছাইঘোষের মৃত্যুর পর মন্দিরের অধিকার বর্তায় বর্ধমানের রাজ পরিবারে। বিগ্রহের ওপরের ঢাকনাটি নিয়ে যান ইছাইঘোষের পালিতা কন্যা। তাঁর শ্বশুরালয় ছিল অধুনা পুরুলিয়া জেলার অন্তঃপাতী কাশীপুরে। বিগ্রহের ঢাকনাটি নিয়ে যাওয়ার পথে বরাকর নদীর তীরে হ্যাংলা পাহাড়ে তা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পতিত হয়। কালক্রমে সেখানেই গড়ে ওঠে কল্যাণেশ্বরী মাতার মন্দির। তাই অদ্যাবধি এই মন্দিরে পূজা সাঙ্গ করতে হয় দ্বিপ্রহরের আগে, দ্বিপ্রহর থেকে পূজা শুরু হয় কল্যাণেশ্বরী মাতার মন্দিরে।
তা বর্ধমানের রাজপরিবারের পরিচালনায় বেতনভুক পুরোহিত মহাশয়দের তত্বাবধানে মন্দিরের পূজাপাঠ চলছিল ভালই। গোল বাঁধল স্বাধীনতার পরে জমিদারি উচ্ছেদের সময়। বর্ধমানের রাজপরিবার মন্দির পরিচালনায় তাঁদের অপারগতা জানালেন। বংশানুক্রমিক পুরোহিত দেবীর রোষানলে পড়তে চাইলেন না। দৈনিক পূজা ও আতপ চালের ভোগ চালু রইল, বন্ধ হয়ে গেল দুর্গাপুজো, পায়সান্নভোগ। অর্ধশতাব্দী পরে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় মন্দির তার লুপ্ত গৌরবের কিছুটা হলেও ফিরে পায়; মন্দিরের সংস্কার হয়, চালু হয় দুর্গাপুজো, পায়সান্নভোগ। মন্দিরের পাশেই মহর্ষি মেধাশ্রম। অনেকখানি জমি, অনেকগুলি মন্দির। মন্দিরে লোকজন পুণ্যার্থী দেখা গেল না, তবে রক্ষণাবেক্ষণের হাল দেখে বোঝা গেল আশ্রমের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো।

শ্যামারূপার মন্দির-মহর্ষি মেধাশ্রম থেকে শাল-অর্জুন-শিরীষ এবং বুনো গাছগাছালিতে ভরা গা ছমছমে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলে গেছে অজয়পাড়ের ইছাইঘোষের দেউলে। ইছাইঘোষ আর নেই, নেই তাঁর রাজ্যপাট; শুধু অজয় বয়ে চলেছে একইভাবে। শ'খানেক ফুট উঁচু মন্দিরের গায়ে জীর্ণ টেরাকোটার নকশা আজও বহন করে চলেছে অতীতের স্মৃতি। চারিপাশ ঘোর নির্জন। ও-পারে কবি জয়দেবের কেন্দুলি। এখানে সবিনয়ে একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার। পূর্ববর্তী বাক্যটি একটি বিবৃতি মাত্র, কোন দাবি নয়। কবি জয়দেবের জন্মস্থান তথা স্বত্বাধিকার নিয়ে বাংলা-ওড়িশার বিবাদ বিষয়ে আমি সম্যক অবহিত। ওড়িশা দাবি করে কবির জন্মস্থান খুরদা জেলায় প্রাচি নদীর তীরবর্তী কেঁদুলিশাসন গ্রামে। সেখানেও আমি গেছি। তাঁদের মতে কবির শিক্ষাদীক্ষা কোণার্কের নিকটবর্তী কুর্মাপটক গ্রামে। সেখানেও আমি গেছি, চন্দ্রভাগা সৈকতে জয়দেব পার্কও দেখেছি।

-৩-
অজয়কে দেখে মন ভাল হয়ে গেল। নীল আকাশের নিচে বালি, শরঘাস, মধ্যে মধ্যে চড়া। তার মধ্যেই অনেকখানি জায়গা বিছিয়ে বয়ে চলেছে সে ব্যস্ততাবিহীন। তবে এপার থেকে কেন্দুলি যাওয়া খুব একটা সহজ নয়। যাত্রা শুরু করার পর অনেকবারই মনে হয়েছে এভাবে না এলেই ভাল হত, বিশেষত একাকী ও এই বয়সে। এই ঘোর বর্ষাতেও অজয়ে খুব একটা জল নেই, এবং চড়া পড়ে যাওয়ায় ফেরিঘাটটি সরে গেছে অনেকখানি, প্রায় এক কিলোমিটার উজানে। ফলে বালির উপর দিয়ে সেই এক কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবে, আবার ওপারে গিয়ে নৌকা থেকে নেমে এক কিলোমিটার ভাটিতে হাঁটতে হবে। ফেরাও একই পথে, অর্থাৎ মোট চার কিলোমিটার হাঁটা। উঁচু পাড় থেকে নদীবক্ষে নামার পথ অতীব খাড়াই, বর্ধমানপ্রান্তে যদিও বা শরঘাস ধরে কোনক্রমে নামাওঠা যায়, বীরভূম প্রান্তে শরঘাস নেই, খাড়াই পথটি নুড়িপাথরে আকীর্ণ, এবং নুড়ি সরে গিয়ে পপাত ধরণীতলে হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। সেও না হয় মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু পড়ে গিয়ে কেটে-ছড়ে বাড়ি ফিরলে আর দেখতে হবে না, হয়ত এভাবে একা একা ঘোরাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। বীরভূমপ্রান্তের এক কিলোমিটার হাঁটাপথের মধ্যে একটি ধারা এসে অজয়ে মিশেছে, সেখানে প্রায় হাঁটুজল। কিন্তু তাই বলে জীবন কি আর থেমে থাকে! ভটভট শব্দে নৌকা যাচ্ছে আর আসছে। নৌকায় পেরোচ্ছে মানুষ, সাইকেল, দ্বিচক্রযান, তিন চাকার ভ্যানরিকশা। আকাশ এখানে অনেকটাই নিচু হয়ে এসেছে জলে মুখ দেখতে, নিচে জল। হাঁটাপথের কষ্টস্বীকার না করলে জল মাটি আকাশের এই অনুপম রচনা কি দেখতে পেতাম!

অজয় পেরিয়ে ওপারে। জল পেরিয়ে খাড়াই বেয়ে যেখানে উঠলাম সেখানে রাস্তার দুপাশে সারি দিয়ে লোক বসে, গোঁসাইবাবার মন্দিরে আজ বাৎসরিক উৎসব, সেই উপলক্ষে নরনারায়ণ সেবা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে গিয়ে জয়দেব মন্দির। চতুর্বর্গ রেখশিখর নবরত্ন মন্দিরটি পোড়ামাটির কাজ সমাকীর্ণ, বেশ বড়, অনেকখানি জায়গাজুড়ে উঁচু বেদির ওপর। পোড়ামাটির কারুকাজে বিষ্ণুর দশাবতার ও রামায়ণের কাহিনি। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুর ১৬৮৩ খৃস্টাব্দে কবি জয়দেবের জন্মস্থান বলে বিশ্বসিত জমির উপরে মন্দিরটি নির্মাণ করান।
অনেকক্ষণ লাগল মন্দিরটি ঘুরে ফিরে দেখতে। এবার ফেরা ওই পথেই। তবে একটা খটকা রয়েই গেল। বীরভূমপ্রান্তের কেন্দুলি বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম, পরপর আখড়া, আশ্রম, ইস্কুল, বড় বড় দোকানপাট, ডাক্তারের চেম্বার, প্যাথ ল্যাব... দেখে বোঝা যায় জায়গাটির আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল। প্রতিতুলনায় বর্ধমানপ্রান্তের দেউল নেহাতই একটা ছোট গ্রাম, যেখানকার চায়ের দোকানের চা মুখে দেয়া যায় না। তবু সেখানে বীরভূমপ্রান্ত থেকে মানুষের, সাইকেলের, দ্বিচক্রযানের, তিন চাকার ভ্যানরিকশার অনর্গল আসাযাওয়া। এর অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিটি কোনখানে সেটিই বোঝা গেল না।
ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বাদলের ধারাপাত। বাপ্পা পাল ঘুরতে বেরোবে, আর বৃষ্টি হবে না তা কী করে হয়? ঈশ্বর ভদ্রলোককেও তো তাঁর অস্তিত্ত্ব ও ক্ষমতা জাহির করতে হবে, নয়তো লোকে তাঁকে মানবে কেন! যদিও ভদ্রলোককে ইতোপূর্বে একবার বলেছিলাম নতুন কিছু ভাবতে; অস্তিত্ত্ব জাহির করার তো আরও অনেক পন্থা আছে। এই ধরুন আপনি যদি আমাকে পঞ্চাশ কি একশো কোটি টাকা দেন তাহলে তো আপনার অস্তিত্ত্ব আরও প্রবলভাবে জনচেতনাগোচর হয়, লোকে ধন্যধন্য করে, আপনার উদ্দেশ্য সাধিত হয়, আমারও কিঞ্চিৎ উবগার হয়। বললে বিশ্বাস করবেন না তাই শুনে ভদ্রলোক অবিকল গড়িয়াহাটের ফুটপাথের সেই কাচের বাসনওয়ালার মত জিভ কেটে বললেন, কি যে বলেন বড়দা, টাকাটাই কি জীবনের সব!!
অর্থের অর্থহীনতা নিয়ে কেউ জ্ঞান দিতে এলে বিরক্ত লাগে; কারণ অনেক ভেবে দেখেছি যে জীবনের কাছে আমার যা যা প্রত্যাশা, সবগুলোই টাকাসাপেক্ষ। আমার এক চাকরিতুতো দাদা বলতেন অর্থই জীবন, কারণ তাহা জীবনকে অর্থবহ করে; ক্রমিক নানাবিধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষকে জীবনের অর্থ উন্মোচনে উদ্বুদ্ধ করে; মৃত্যুকে বিলম্বিত করে জীবনকে দীর্ঘায়িত করে।
অন্য রাস্তা ধরে শহরের বুক চিরে শহরে ফেরা। সেই সুবাদে শহরটি দেখা হয়ে গেল। শহরে একটি সদ্য আবিষ্কৃত সপ্তদশ শতকের লুকানো সুড়ঙ্গমুখ দেখলাম, দুর্গাপুর নগর নিগমের হেরিটেজ কনজারভেশন কমিটি কর্তৃক সংরক্ষিত। তারপর দেড়শ পেরোনো ভিরিঙ্গি শ্মশানকালী মন্দির। তৎপরে এক সরাইখানায় মধ্যাহ্নভোজ।
বাকি রইল ভবানী পাঠকের টিলা ও দুর্গাপুর ব্যারেজ। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল জানে আজকের কোনও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে বসে 'আনন্দমঠ' বা 'দেবী চৌধুরানী' লিখবেন না, মন্দ্রস্বর বেজে উঠবে না কোথাও 'আমি ভবানী পাঠক' বলে। তাই সে আর ভাবে না। গায়ের ওপর গড়ে উঠল এনার্জি পার্ক, বন্ধও হয়ে গেল, সে নির্বিকার। এবারে নতুন একটা কিছুর কাজ চলছে, সামনেই উদ্বোধন।
অজয়ের পর এবার দামোদরের সঙ্গে দেখা। ১৯৫৫-তে নির্মিত দুর্গাপুর ব্যারেজটি চৌত্রিশটি জলদরজা সম্পন্ন, ৬৯২ মিটার লম্বা, ১২ মিটার উঁচু। আকাশ মেঘলা, চরাচরে অনিঃশেষ বৃষ্টিপাতের শব্দ, পরিমণ্ডলে মায়ানমার থেকে উড়ে আসা নিম্নচাপ। মাইথন পাঞ্চেত বিপদসীমার ওপর, তাদের ছাড়া জল হহু ধেয়ে আসছে দামোদর বেয়ে, সঙ্গে ভেসে থাকা কচুরিপানার দ্বীপ, তিনটি বাদে সবকটি জলদরজা উন্মুক্ত। ব্যারেজপ্রাঙ্গণ বেড়াবার জায়গা হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্যোগে কেউ কোত্থাও নেই। এই তো সময় নদীর সঙ্গে দেখা করার। অনেকক্ষণ বসে রইলাম সেখানে জল দেখতে। তারপর স্টেশনের পথে।

-৪-
ফিরতি যাত্রা প্রবাদপ্রতিম ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে। আগে তিনি ১৩৩১৮ ছিলেন, ২০১৩র জুলাইয়ে কুলীন হয়েছেন, সুপারফাস্ট হয়ে তাঁর নতুন পরিচিতি ২২৩৮৮। রেলগাড়িটি নিত্যযাত্রী ও পর্যটক উভয় মহলেই তুমুল জনপ্রিয়। ২১টি - মধ্যে মধ্যে ২৩টি কামরা নিয়েও তিনি সতত ভীড়াক্রান্ত। আমাদের শৈশবে শতাব্দী জনশতাব্দী, ইন্টারসিটিরা ছিলেন পিতার কনীনিকায় আলোকবিন্দু, তখন ইনি ও কোলফিল্ড ছিলেন কলকাতার সঙ্গে আসানসোল-ধানবাদ পশ্চাদভূমির একমাত্র যোগাযোগ। তবে ইনি এখন জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়, শুধু রবিবারে রবিবারে শতাব্দী থাকে না বলে ওইদিন তাঁর আভিজাত্যবোধ প্রবল হয়ে ওঠে। দুর্গাপুরে এঁর সময় ১৮:২০, হাওড়ায় ২১:২০ - তিন ঘণ্টা, মধ্যে বিরতি পাঁচটি। প্রতিতুলনায় বিরতিহীন শতাব্দী হ্রস্বতর পথে দুর্গাপুরে ১৯:০০, হাওড়ায় ২১:১০।
'নামিল শ্রাবণসন্ধ্যা, কালো ছায়া ঘনায় বনে বনে॥ আনো বিস্ময় মম নিভৃত প্রতীক্ষায় যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে' — যূথীমালিকারা না থাকলেও প্রতীক্ষাটি দীর্ঘায়িত হল, তিনি এলেন ছটা চল্লিশে, আমাদের কামরা সি-১ মাঝামাঝি, হাওড়ায় নেমে হাঁটতে হবে অনেকখানি। গাড়ি ছাড়ল, জানালায় শিল্পনগরীর আলোকে উদ্ভাসিত দিগন্ত। যাত্রীরা অধিকাংশই সুপ্তিমগন। শীতলতা পেরিয়ে কাচের দরজার ওপারে এক অন্য ভুবন, মুঠিফোনে উচ্চৈঃস্বরে ভোজপুরি গান বাজছে, মন দিয়ে শুনলে ও অর্থোদ্ধার করতে পারলে কান লাল হবেই।
পানাগড় মানকর পেরিয়ে বর্ধমান। চা, ঝালমুড়ি। আকাশভাঙা বৃষ্টিপাতের মধ্যে হাওড়ায় ২২:১৫।


পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher