স্বর্গরাজ্যের সপ্তহ্রদ

পর্ণা সাহানা

 

~ কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেকরুট ম্যাপ ~ কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেকের আরও ছবি ~

"অগর ফিরদৌস রুহে জমিন অস্ত্
হামিন অস্ত-ও, হামিন অস্ত-ও, হামিন অস্ত্ ...."

জীবনের প্রথম ট্রেক। ছোট থেকে কোনদিনই তেমন ডাকাবুকো প্রকৃতির ছিলাম না। স্কুলের স্পোর্টস ইভেন্টেও কোনও উল্লেখযোগ্য যোগদানের উদাহরণ নেই আমার। সেই আমি যাচ্ছি কিনা ট্রেকে? তাও আবার ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায়? ভূস্বর্গ আমার জন্যে না জানি কী পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে!

৮ই জুলাই, ২০১৬: যাত্রা শুরু

অবশেষে সব জল্পনা কল্পনা, সব মানসিক প্রস্তুতি, হাঁটা প্র্যাকটিস করার কিছু বৃথা প্রচেষ্টা – সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে এলো যাত্রা শুরুর দিন। সকাল ছটায় রওনা দিলাম দিল্লি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। পিঠে রুকস্যাক, পায়ে হাইকিং-শ্যু, রুকস্যাকে বাঁধা হাইকিং পোলটাও উঁকি দিচ্ছে মাঝে মাঝে। নিজেকে বড় অচেনা লাগে যে! যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর। সেখানে "Trek The Himalayas" (আমাদের ট্রেকিং সংস্থা)-এর গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাদের সোনমার্গ বেস ক্যাম্প-এ নিয়ে যাওয়ার জন্য।

সোনমার্গ - সোনার তৃণভূমি। নাল্লা-সিন্ধ-এর তীরে অবস্থিত এই আলপাইন উপত্যকা যেন স্বর্গের প্রথম প্রবেশদ্বার। এখানেই এক ছোট প্রবহিনীর ধারে আমাদের বেস ক্যাম্প। চারপাশ পাহাড় ঘেরা। পায়ের নীচে সবুজ ঘাসের গালিচা আর মাথার ওপর সুনীল আকাশ। দুচোখের সামনে শুধুই অনাবিল সৌন্দর্য। চা-বিস্কুট সহযোগে ট্রেকলিডার নীতিনের ট্রেক ব্রিফিং এবং সহ-অভিযাত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে শুরু হল অভিযানের প্রাথমিক পর্ব।

ধীরে ধীরে বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসে। পাহাড়ের চুড়োগুলোতে লাগতে থাকে অস্তরাগের নেশা। তারপর কখন যেন ঝুপ করে কে আমাদের মুড়ে ফেলে ঘন অন্ধকারের চাদরে। পাহাড়ে রাত্রির একটা আলাদা রূপ আছে। চোখ বন্ধ করলে তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করা যায়। আর চোখ খুললেই মাথার ওপর কোটি তারার শামিয়ানা। সময় যেন এখানেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। না, পুরোপুরি থেমে যায়নি সে। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায় ঝিঁঝির ডাকে, ওই খরস্রোতা নদীর কল্লোলে, আমাদের ঘিরে থাকা এই অলীক নিস্তব্ধতায়। রাত্রে টেন্টের ভেতর স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে শুয়ে শুনতে পাই ঝমঝম বৃষ্টির মূর্ছনা। ঝলমলে তারাখচিত আকাশের মনে হঠাৎ এমন বাঁধভাঙা অভিমান ঢালল কে?

৯ই জুলাই, ২০১৬: সভ্যতার বন্ধন ছিন্ন হল

সকালে ঘুম ভাঙল যখন, আকাশের আর মুখ ভার নেই। টেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখি সামনের পাহাড়ের কপালে উদয় ভানু তার প্রথম জয়টীকা এঁকে দিয়েছে। আজ থেকে আসল ট্রেকিং শুরু। সকাল ৮.১৫ নাগাদ আলু-পরটা আর চা সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটা শুরু হল। শুরুতেই একটা খাড়া চড়াই। তবে প্রথম দিন বলে উদ্যম আর উত্তেজনার অভাব নেই। ট্রেক-গাইডের উপদেশ মতো সোজা চড়াই রাস্তায় না উঠে আঁকা-বাঁকা জিগ-জ্যাগ পথে ওপরে ওঠা শুরু হল। এতে নাকি কষ্ট কম হয়। ওপর থেকে আমাদের ফেলে আসা ক্যাম্পসাইট, ছোট্ট নদী, পাহাড় ঘেরা সবুজ উপত্যকা আর তার বুকে TTH-এর নীল টেন্ট দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে কিছু স্থানীয় শিশুদের টফি-র আবদার। ব্যাগে প্রচুর মাঞ্চ আর ম্যাঙ্গো ক্যান্ডি নিয়ে বেরোনো হয়েছে, তাই ওদের সঙ্গে ভাব জমাতেও অসুবিধা হয় না।

আস্তে-আস্তে আমাদের ক্যাম্পসাইট আর দৃষ্টিগোচর হয় না। সামনে শুধুই নয়নাভিরাম সবুজ, আর মাঝে মাঝে পিছন ফিরে সোনমার্গ–এর রূপশোভায় মুগ্ধ হওয়ার পালা। আজ আমরা সোনমার্গ এর ৭৮০০ ফুট-এর বেস ক্যাম্প থেকে পৌঁছব ১১,৫০০ ফুট-এর নিচনাই ক্যাম্পসাইট-এ। অর্থাৎ প্রায় ৪০০০ ফুট চড়াই পেরোতে হবে। আর বস্তুত: আজই আমরা নাগরিক সভ্যতাকে বিদায় জানাব আগামী সাত দিনের জন্য। মোবাইল নেটওয়ার্ক-ও থাকবে না এরপর। তাই সবাই একবার করে বাড়িতে কথা বলে নেওয়া হল। আমরা নিজেদের এবার সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিলাম প্রকৃতি মায়ের কোলে।

যত ওপরে উঠছি, পেছনে সোনমার্গ উপত্যকা ততই নিজেকে উন্মুক্ত করছে- নতুন আভরণে নিজেকে সজ্জিত করছে। দু-চোখে মুগ্ধতা নিয়ে এগিয়ে চলেছি। ম্যাপল- পাইন বনের সুগন্ধ ভুলিয়ে দিচ্ছে হাঁটার সমস্ত ক্লান্তি। পথে দেখা হল কয়েকজন আর্মি অফিসারের সঙ্গে। ওঁরা 'লং রুট পেট্রোলিং'- এর মাধ্যমে ভূ-স্বর্গের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে চলেছেন। এভাবেই সাত-আট দিন এই উপত্যকা থেকে সেই উপত্যকা ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে ওঁদের।

শেক্দুর-এর টেবল টপ-এ পৌঁছে আমাদের আজকের লাঞ্চ ব্রেক। সকালে প্যাক করে দেওয়া স্যান্ডউইচ আর ডিমসেদ্ধ সহযোগে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া হল। এখানে একটি দোকানও আছে। সেখানে ম্যাগি পাওয়া যাচ্ছে দেখে ম্যাগি-পাগলরা অবশ্য সুযোগ মিস করলনা মোটেই! খাওয়ার পর্ব মিটলে আবার শুরু হল হাঁটা। আশার কথা এরপর আর চড়াই নেই তেমন। রূপোলি বার্চ-এর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নামছি। নীচে নদীর স্রোতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই শব্দই আমাদের লক্ষ্য। নদীর কাছে পৌঁছে দেখি সে কী অপূর্ব রূপ তার! কী এক মাতাল খুশীতে উত্তাল সে! প্রবল স্রোত যেন সেই পাগল করা উচ্ছাসেরই বহি:প্রকাশ। এমন সাদা রং আগে দেখেছি কি? এই পাগলিনীকে সঙ্গী করেই বাকি পথটুকু পেরোব আমরা। এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। নদীর শব্দটুকুর বাইরে আর কোনও শব্দ কর্ণগোচর হয়না। প্রকৃতিকে এমন ভাবে কাছে পাওয়ার, এমন ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ আগে কখনও আসেনি। পাহাড়ে আগেও বেড়াতে গেছি বহুবার। কিন্তু সমস্ত নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, যাবতীয় আধুনিক প্রযুক্তি থেকে মুক্ত হয়ে তাকে এমনভাবে আলিঙ্গন করার সৌভাগ্য আগে কখনও হয়নি। হাঁটার ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে গিয়ে নিজের জোরে নি:শ্বাস ফেলার শব্দটাও যেন রূঢ়ভাবে কানে বাজে, নিজেকে অপরাধী মনে হয়!

হেঁটেই চলেছি, রাস্তা যেন আর শেষ হয়না! অভিষেক, সম্বিতদা, আর সাত্যকি তাদের ফোটোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি ভাবছি কখন আসবে আমাদের ক্যাম্পসাইট? অবশেষে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে পৌঁছলাম নিচনাই ক্যাম্পসাইট। তবে ট্রেকলিডার নীতিনের কড়া নির্দেশ টেন্টে ঢোকা চলবে না। এই জায়গাটাও অসম্ভব সুন্দর। আসলে পানীয় জলের সুলভ প্রাপ্যতার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পসাইট নদীর ধারেই বাছা হয়। আর তাতেই সৌন্দর্য্য যেন কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আড্ডা, ছবি তোলা- এসবের মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যায় কখন। চা, সুস্বাদু স্যুপ – একে একে দিয়ে যাচ্ছে কিচেনস্টাফরা। পড়ন্ত বেলায় নদীর জলে এক মায়াবী রঙের ছায়া মিশছে। সেই মায়ায় মিশে যাচ্ছি আমরাও - ভেসে যাচ্ছি... হারিয়ে যাচ্ছি....

১০ই জুলাই, ২০১৬: নিচনাই পাস অতিক্রমের পরীক্ষা

সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া। এদিকে আজই এই ট্রেকের প্রথম পাসটা পেরোতে হবে। নিচনাই পাস, ১৩,১০০ ফুট উচ্চতায়। নিচনাই পাস-ই হল সপ্তহ্রদ-এর প্রবেশ দ্বার। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর - এই সময়টুকুই পার হওয়া যায়। বাকি সময় সম্পূর্ণ বরফে ঢেকে থাকায় চলাচলের অযোগ্য। এই কারণেই কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেক রুটটিতেও এই তিন মাসের জন্যেই ট্রেকারদের অধিকার। বছরের বাকি সময়টা পাহাড় আর প্রকৃতির নিজস্ব, ব্যক্তিগত। এই দীর্ঘ বিরহই হয়ত পাহাড়প্রেমীদের মনে জাগিয়ে তোলে আরও তীব্রতর আকর্ষণ। বাধ্য করে নতুন করে তার প্রেমে পড়তে। সেই নিখাদ প্রেম যে একবার আস্বাদন করেছে, তার পক্ষে অসম্ভব সেই নির্মোঘ হাতছানি উপেক্ষা করা।

অভিমানী আকাশকে সঙ্গী করেই বেরোনো হল। ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হয়েছে ক্যাম্পেই। শুরুতে বেশ লম্বা একটা চড়াই অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জ সামনে। যদিও অধিকাংশ সহযাত্রীদের দম এবং হাঁটার গতি ঈর্ষণীয়। কি জানি, তারা দুটোর বেশি ফুসফুসের অধিকারী কিনা! তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। হয়ত তাগিদও নেই তেমন। আমি মুগ্ধ হতে চাই, প্রকৃতির রূপসুধা পানে নিজেকে ধন্য করাতেই আমার আগ্রহ। স্বভাবত:ই কিছুদূর এগিয়েই দাঁড়াই, বুক ভরে শ্বাস নিই, আর তাকিয়ে দেখি ফেলে আসা পথটা। অভিষেকরা যথারীতি ছবি তোলে, আমি শুধু দু'চোখ ভরে দেখি। মনে মনে বলি, তোমাকে কখনও ভুলব না, কিন্তু পাহাড়, তুমিও কি মনে রাখবে তোমার এই মুগ্ধ প্রেমিকাকে?
মাঝরাস্তায় বৃষ্টি শুরু হল। সামনে একটা চওড়া গ্লেসিয়ার। বরফের ওপর দিয়ে এতটা রাস্তা হাঁটার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তার ওপর বৃষ্টি হয়ে জল কাদায় আরও পিচ্ছিল হয়ে গেছে পথ। গোড়ালি ঠুকে ঠুকে গ্রিপ তৈরি করে স্টিকের সাহায্যে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতি পদক্ষেপে পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা। সামনে টিমের কনিষ্ঠতম সদস্য সাত্বত, অনায়াসে এগিয়ে চলেছে। অগত্যা, নিজের মান বাঁচাতে আমাকেও যেতেই হবে। সাহস সঞ্চয় করে এগোতে থাকলাম।

এই প্রসঙ্গে সাত্বত-র কথা একটু বলি। সম্বিতদার ছেলে। ন বছর বয়েসে এটা ওর চতুর্থ ট্রেক! প্রথম ট্রেকে যায় দুবছর বয়সে, পোর্টারের পিঠে চেপে। বাবা-মা দুজনেই ট্রেক পাগল বলে ছোট থেকেই এই সৌভাগ্যের অধিকারী। উদ্যম এবং গতিতে যেকোনও পূর্ণবয়স্ক লোককে টেক্কা দিতে পারে। এবারে ট্রেকটা পুরোটা হেঁটে শেষ করার শর্ত বাড়ি গিয়ে কেএফসি-র চিকেন পপকর্ন খাওয়াতে হবে!

বেশ কয়েকবার আছাড় খেয়ে, পা পিছলে গ্লেসিয়ার পেরিয়ে এলাম। কয়েকজন তো না হেঁটে স্লাইড করে নিল কিছুটা। বৃষ্টির জন্যে ঠান্ডাও বেড়েছে। পাসের ওপর হাওয়ার দাপটও প্রবল। কোনরকমে পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাত গরম করার চেষ্টা করছি। নিচনাই পাস যেন একটা বিশাল গহ্বরের উন্মুক্ত অবতল মুখ। চারপাশে তুষারশৃঙ্গ পর্বতে ঘেরা। পাস অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জে পাস করার পর উতরাই এর পালা। বৃষ্টির জন্যে রাস্তা অল্প পিছল হয়ে আছে। পা পিছলে গেল দু-এক বার। সামনের নিচনাই ভ্যালিটায় ছোট ছোট পাহাড়ি ফুলের পসরা। একটা নদীর ধারে বসে বিস্কুট, চকলেট খেয়ে, জলের বোতলে জল ভরে আবার হাঁটা লাগালাম। সম্বিতদা ছবির জন্যে মাঝে মাঝেই যেখানে সেখানে চলে যাচ্ছে। একবার তো কাদায় পা এমন ভাবে ঢুকে গেল যে আর বেরোতেই চায় না। পা যদিও বা বেরোল, জুতো থেকে গেল কাদার মধ্যেই। শেষে হাতে করে টেনে বার করতে হল, জুতো তখন কাদায় মাখামাখি। এরকমই হাসি-মজায় পৌঁছলাম ক্যাম্পে। গরম গরম ভাত, ডাল আর স্যালাড আমাদের অপেক্ষায়। আয়োজন সামান্য হলেও খিদের মুখে তার স্বাদই যেন অমৃত!

বিষণসার বা বিষ্ণুসর গ্রেট লেকস এর অন্যতম। ক্যাম্প থেকে লেক অবশ্য কিছুটা দূরে। বিকেলের দিকে আমরা গেলাম লেকের ধারে। সে এক অদ্ভুত শান্তির জায়গা। চারপাশে পাহাড়, মাঝখানে প্রায় গোলাকার লেক, শান্ত নীল জল, যার থেকে নীলম নদীর উৎপত্তি। এই বিষণসার একটি oligotrophic লেক, তাই শ্যাওলাহীন জল কাচের মত নির্মল, স্বচ্ছ। চারধারের পর্বতবেষ্টনীর প্রতিবিম্ব সুস্পষ্ট দেখা যায়। এই জাতীয় লেকের নিচের অংশে অক্সিজেন এর পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রচুর মাছও থাকে এখানে, বিশেষত: ট্রাউট। এখানে মাছ ধরার জন্যে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয় রাজ্য সরকারের মৎস্যকল্যাণ দপ্তর থেকে। আমরা পৌঁছে দেখলাম বেশ কিছু মৎস্য-শিকারীর ভিড় লেকের কাছে, ট্রাউটের আশায়। আমাদের বাঙালির জিভ, মাছের নামেই সিক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু খাওয়ার তো কোনও উপায় নেই। অগত্যা ফিরে আসতে হয়। আশেপাশের তৃণভূমিতে যত্রতত্র ভেড়ার পাল চরে বেড়াচ্ছে তখন। অলস বিকেল এভাবেই কেটে যায়। রাত্রি নেমে আসে... আরও একটি দিনের আশা জিইয়ে রেখে।

১১ই জুলাই, ২০১৬: নৈসর্গিক কৃষ্ণসার

গত রাত্রেই ট্রেকলিডার নীতিন বলে রেখেছে আজকের কঠিনতম রুট-এর কথা। তবে গত দু দিনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ যাত্রীরা আজ আর উদ্বিগ্ন নয় এ নিয়ে। বেশ খোশ মেজাজেই সবাই যাত্রা শুরু করলাম। ক্যাম্পসাইট থেকে ঘন্টাখানেকের হাঁটা পথের পর পৌঁছলাম কৃষ্ণসার লেকের ধারে। এই লেকটির সৌন্দর্য বাধ্য করে নিমেষে তার প্রেমে পড়তে। লেকের সামনে একটা খাড়া রিজ, তার গায়ে সর্পিল রেখা যেন এঁকে দিয়ে গেছে কেউ। রিজটা এতটাই খাড়া যে বিশ্বাসই হতে চায় না হেঁটে এর চূড়ায় ওঠা যায়! বস্তুত: সেটাই তখন আমাদের সহযাত্রীদের ঠাট্টার বিষয়বস্তু, কে উঠবে ওই রিজ-এর চূড়ায়? এমন সময় নীতিন এসে দিল সেই ভয়ংকর সংবাদ! আমাদের ওই রিজ-এর চূড়াতেই পৌঁছতে হবে। ওই সর্পিল রেখাগুলিই আমাদের হাঁটার ট্রেইল। অগত্যা, চড়াই শুরু হল।

যত ওপরে উঠছি, কৃষ্ণসার ততই মোহময় হয়ে উঠছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি কিভাবে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে জলের রং। সে এক অদ্ভুত নীল। আর সেই নীল জলের বুকে ছোট্ট একটি পাথর, সবুজ শ্যাওলায় ঢাকা। এমনই নৈসর্গিক তার রূপের ব্যঞ্জনা, চোখ ফেরাতেই পারি না আমি। আরও কিছুটা ওঠার পর বিষণসারও দেখা গেল কৃষ্ণসার এর পিছনে। রিজ-এর চূড়া অবধি ওঠার কষ্ট বিন্দুমাত্র বুঝতে দিল না এই দুই লেকের যুগ্ম সম্মোহন।
এর পরের গন্তব্য এই ট্রেক-এর উচ্চতম স্থান, গাদসার পাস, ১৩,৭৫০ ফুট উচ্চতায়। রাস্তা বলতে মানুষের পা আর ঘোরার ক্ষুরে তৈরি হয়ে যাওয়া চিহ্ন, তাই অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে। আমার মত ফার্স্ট টাইম ট্রেকারের জন্য পথটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। তবে আবারও প্রকৃতির অতুলনীয় সৌন্দর্য্য সব কষ্ট লাঘব করে দেয়। গাদসার পাস-এর মাথায় পৌঁছনোর পর আত্মবিশ্বাস আরও কিছুটা বেড়ে গেল। নিজের সাফল্যে যেমন গর্ববোধ হয়, তেমনই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে পাহাড়ের এই বিপুল বিস্তৃতির সামনে। একমাত্র পাহাড়ই পারে এমনভাবে অবলীলায় মন থেকে অহংকারের পর্দা ছিঁড়ে ফেলতে। মনের যাবতীয় ক্ষুদ্রতা সব মুছে যায় এর পায়ের তলায়। শহুরে আড়ম্বর, অনাবশ্যক সংস্কার, সঙ্কোচ সব কোথায় হারিয়ে যায়। এখানে সবাই সমান, সবাই ভীষণ নগণ্য এই মহান বিশালতার কাছে।

গাদসার পাস থেকে গাদসার লেকের রাস্তাটা বর্ণনাতীত সুন্দর। মাইলের পর মাইল জুড়ে যেন বসেছে ফুলের মেলা। প্রকৃতি যেন আমাদের স্বাগত করার জন্য পুরো রাস্তাতেই বিছিয়ে রেখেছে রংবেরং এর ফুলের গালিচা। রাস্তার মাঝে মাঝে অনামী আরো কিছু লেক। অল্প বরফও ভাসছে লেকগুলির জলে। এই রাস্তা ধরেই এলাম গাদসার লেকের ধারে। লেকটির অবস্থান ও মায়াবী রূপ দীর্ঘ পথশ্রান্তি দূর করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। গাঢ় ফিরোজা নীল জলে ছড়ানো ছিটানো বরফের টুকরো। লেকের জল গিয়ে মিশছে একটি নদীতে। নদীগুলিও যেন এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য দেখে মাতোয়ারা। তবে এই মনমাতানো রূপের পেছনে আছে কিছু কাহিনিও। কাশ্মীরি ভাষায় এই লেকের অপর নাম যমসার বা মৃত্যুহ্রদ। স্থানীয় মেষপালকদের বিশ্বাস এই লেকে বাস করে এক দৈত্য যার আকৃতি অক্টোপাসের মত এবং সে তার শুঁড় দিয়ে ভেড়াদের টেনে নেয় লেকের গভীরে। তাই তারা লেকের ধার পারতপক্ষে মাড়ায় না। জানিনা আমাদের ট্রেক গাইড ইজাজ ভাইও এই কাহিনিতে বিশ্বাস করে কিনা। দেখলাম সেও লেকের ধারে না এসে নদীর ধারেই বসে থাকল। তার সঙ্গে টীমের অধিকাংশ সহযাত্রীরাও। শুধু আমরা ৬ জন (নাকি সাড়ে পাঁচ, সাত্বতকে কি পূর্ণবয়স্কদের দলে ফেলা যায়? যদিও অভিজ্ঞতায় সে আমাদের অনেকের থেকেই এগিয়ে!) বাঙালিই লেকের ধারে এক উঁচু পাথরের প্ল্যাটফর্মে বসে সেরে নিলাম আমাদের লাঞ্চ, প্রকৃতির শোভা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে করতে।

এরপর যেন আর শরীর চলতে চায় না। নীতিনের বলা কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে; মনে শুধু একটাই চিন্তা যে কখন আসবে ক্যাম্পসাইট? মাঝে এক জায়গায় আর্মি চেকপোস্টের প্রথামাফিক চেকিং সেরে নেওয়া। সেখানেও আবার ট্রাউটের লোভনীয় গল্প। অতিকষ্টে বাকি রাস্তাটুকু পেরিয়ে ক্যাম্পে গিয়ে গা এলিয়ে দেওয়া হল। স্যুপ খেতে খেতে আড্ডা দিয়ে কেটে গেল বিকেলটা। অভিষেকরা ক্রিকেট খেলারও আয়োজন করল খানিকক্ষণ। আরও একটা দিন কেটে গেল অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করে দিয়ে।

সন্ধেবেলা এক অতর্কিত দু:সংবাদ। শ্রীনগরে নাকি কারফিউ জারি হয়েছে। পরিস্থিতি খুবই আশঙ্কাজনক। বিস্তারিত তথ্য জানার কোনও উপায় নেই। শুধু আমাদের একদিন পর ট্রেক শুরু করা টীমের মুখে শুনে যেটুকু জানা যায়। তাতে গল্প অতিরঞ্জিত হচ্ছে কিনা যাচাই করার উপায়ও কিছুই নেই। বেশ চিন্তা হতে লাগল। পরিস্থিতির আঁচ কিছু তো টের পাচ্ছি না, কিন্তু না জানি বাড়িতে এই খবর শুনে কি অবস্থা! পরে নীচে নামার পর আস্তে আস্তে জেনেছি হিজবুল মুজাহিদিন নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুকে ঘিরে এবারের গন্ডগোলের সূত্রপাত। ভুস্বর্গকে নরক বানানোর এই বীভৎস খেলা কবে বন্ধ হবে?

১২ই জুলাই, ২০১৬: প্রকৃতির রূপের পসরা

আজ সকাল থেকেই আকাশ ঝলমলে। আর তাতে রূপসী প্রকৃতি যেন আরও অনুপমা হয়ে উঠেছে। আজ প্রথমেই পেরোব একটা বরফের ব্রিজ। এখানে নদীর জল জমে বরফ হয়ে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়ে। জুলাই থেকে বরফ আস্তে আস্তে গলতে শুরু করে। এখন কয়েকফুট পুরু বরফের নীচে জল উঁকি দিচ্ছে। আর এই পুরু বরফের স্তরই আমাদের নদী পেরোনোর ব্রিজ। এই বরফ সেতু পেরোনোর পর সামনে বেশ চড়াই রাস্তা। তবে পুরো রাস্তাতেই সৌন্দর্য এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে – পাহাড়ে, খরস্রোতা নদীতে, পাইন গাছের সারিতে, রংবেরং এর পাহাড়ি ফুলে – যে ক্লান্তি বা অবসাদ কোনটাই আমাদের গ্রাস করার অবকাশ পায় না। আকাশ খুব পরিষ্কার ও মেঘমুক্ত থাকায় নাঙ্গা পর্বত, যা পাকিস্তানে অবস্থিত, তার শৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হল। প্রকৃতি তো আর মানুষের মত LOC-এর বিভাজন মানে না। অনায়াসে ধরা দিতে পারে প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ চোখে – স্থান, কাল, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে।
আজ অভিষেকের জন্মদিন। উপহার তো প্রকৃতিই সাজিয়ে রেখেছে রাশি রাশি। ১১,০০০ ফুট উচ্চতায় জন্মদিন কাটানোর সুযোগটাই তো একটা বড়সড় সেলিব্রেশন! তবুও আর্মি ক্যাম্পে চেকিং-এ যাওয়ার আগে সুযোগমত তুলে নিলাম কিছু ঘাসফুল। গোলাপী, নীল, সাদা, বেগুনী – কতই না তার রঙের বাহার! আমার উপহার তো এমনটাই, আমার মতই, সাধারণ কিন্তু আন্তরিক। আর পাহাড়ের আভিজাত্যও এমনই, যে দেখনদারির বাহুল্যতা এখানে বড়ই খেলো হয়ে যায়। সেই আভিজাত্য এমন সম্ভ্রম জাগিয়েছে যে ব্যাগে করে আনা কাজলের স্টিকটা এই কদিনে একবারও বার করার ইচ্ছে হয়নি। পাহাড় যেন সমস্ত বাহুল্য আভরণ এক এক খুলে ফেলতে শেখাচ্ছে। শেখাচ্ছে অন্তরের অন্তরতম "আমি" টাকে খুঁজে পেতে, সব বাহ্যিক আবর্জনা ফেলে দিতে।

দীর্ঘ পথের শেষে ক্যাম্পসাইট-এর দেখা পাওয়াটাই যে কি মধুর! তবে এখানে আমাদের ক্যাম্প সাতসারের জোড়া লেকের ধারে নয়। লেকের দর্শন পেতে যেতে হবে মেন্গেন টপ। বেশ দুর্গম রাস্তা। তার ওপর বেশ লম্বা ছিল আজকের পথটা। তাই এখন সবাই গা এলিয়ে দিয়েছে। আরও ওপরে যাওয়ার আর কারোরই বিশেষ ইচ্ছে নেই। আমিও গোড়ালিতে চোট পেয়েছি একটু। এদিকে আরও দুদিনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া বাকি আছে এখনও। তাই আর ঝুঁকি নিলাম না। শুধু সম্বিতদা আর সাত্যকি গেল। সন্ধেবেলা মোমবাতি জ্বালিয়ে আর হ্যাপি বার্থডে গান গেয়ে অভিষেককে শুভেচ্ছা জানানোও হল। রাত নামার সঙ্গে শুরু হল আগামীকালের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি।

১৩ই জুলাই, ২০১৬: দুর্গম বোল্ডারের মরণ-ফাঁদ

পাহাড়ে আবহাওয়া বড্ড অভিমানী আর খামখেয়ালী। তার মনের গতি বোঝা বড়ই শক্ত। আজ সকালে আবার আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টিও হচ্ছে মাঝে মাঝে। আর এদিকে আমাদের সামনে বোল্ডারের সমুদ্র! সেই বোল্ডারদের চেহারাও দেখার মত! বসে, লাফিয়ে, গড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে – না জানি আরও কী কী ভাবে পার হচ্ছি আমরা! প্রতি পদক্ষেপে ঝুঁকি। আমি তো একবার পাহাড়ের ঢালে গড়িয়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। নরম মাটি, আঁকড়ে ধরার মত কিছুই নেই, শুধু কিছু আলগা পাথর ছাড়া। সেগুলো ধরতে গেলেই আরও গড়িয়ে যাচ্ছি। অবশেষে নীতিন এসে হাত ধরে তুলল আমাকে। এই সব কিছুই অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেক গুণে। কষ্ট করার, কষ্ট সহ্য করার যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে, সেটা আজ বুঝলাম। সেই আনন্দ যেন নেশার মত আচ্ছন্ন করছে। মনের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা এক গোপন মন চাইছে এই বোল্ডারের রাস্তাটাই চলতে থাকুক আরও!

এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও রেহাই নেই। আবার খাড়া রিজ সামনে। রিজে উঠতে উঠতে সামনে দেখছি কিভাবে মেঘের আস্তরণের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে নাম না জানা এক উঁচু শৃঙ্গ। যেন প্রমাণ করে দিচ্ছে – যে শিখরে পৌঁছেছে, তার সাফল্যকে কোনও অন্তরায়ই আড়াল করতে পারে না।
পৌঁছলাম জাজ পাস-এর মাথায়। তখনও আকাশে পুরোই মেঘের আচ্ছাদন। তবুও তার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে গঙ্গাবল আর নন্দকুল – যমজ লেক। মেঘ আর কুয়াশাও সেই অপরূপ নিসর্গকে আড়াল করতে পারেনি, এমনই তার রূপের ছটা! অভিষেকরা মেঘ কাটার অপেক্ষায় বসে থাকলো ক্যামেরা নিয়ে, বাকিরা নামা শুরু করলাম। পাহাড়ে চড়াই অতিক্রম করার পর উৎরাই দেখলে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। যদিও উৎরাইতেও কষ্ট আছে যথেষ্ট। অনেকটা নামার পর সমতলে এসে পড়লাম। এখান থেকে গঙ্গাবল আর দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে নন্দকুল লেক আর তার সামনে হরমুখ শৃঙ্গ (কাশ্মীর উপত্যকার উচ্চতম শৃঙ্গ এটি)– এরাই আমাদের পথপ্রদর্শক।

নন্দকুল লেকের ধারে আমাদের টেন্ট তখন রেডি। আর এখানে এক রাত্রি নয়, দুটো রাত কাটাব। হাতে অঢেল সময়। এখানেও দেখলাম মৎস্যশিকারীদের ভিড়। সারা বিকেল ছবি তুলে, আড্ডা দিয়ে আর স্বর্গীয় রূপসুধা পান করে কেটে গেল। তবে শ্রীনগরের পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তাটা ক্রমাগত খচখচ করেই চলেছে।

১৪ই জুলাই, ২০১৬: অখন্ড অবসর

আজ আমাদের সেই বহু কাঙ্ক্ষিত রেস্ট ডে। গত রাত্রেই কিচেন স্টাফদের বলে রাখা হয়েছিল আজ "নো বেড-টী", আর ব্রেকফাস্ট দশটার আগে নয়। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, জমিয়ে আলুর পরোটা খাওয়া, ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো, আজ পুরোপুরি ছুটির মেজাজ। একটু পরে রওনা হলাম গঙ্গাবল-এর দিকে। এক প্রবল খরস্রোতা নদী পেরোতে হবে কয়েকটা পাথরের ভরসায়। সেই পাথর যেমন পিচ্ছিল, তেমনি ব্যবধান তাদের মধ্যে। একবার পা পিছলে পড়লে সোজা স্বর্গলাভ! এটাও অতিক্রম করে চলে এলাম লেকের ধারে। গঙ্গাবল ২.৫ কিমি. লম্বা আর চওড়ায় প্রায় ১ কিমি. বিস্তীর্ণ। আমরা ছাড়া আর বিশেষ লোকজন না থাকায় বেশ নির্বিঘ্নে, নিরিবিলিতে উপভোগ করা গেল বেশ কিছুটা সময়।

ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে গল্প-গুজবে কেটে গেল সময়টা। আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। কালকেই তো আলবিদা জানানোর পালা এই পাহাড়কে, এই প্রকৃতিকে। এই নদী, মাঠ-ঘাট, ভেড়ার পাল; এই টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ; এই বিলাসবর্জিত দিন, এই চূড়ান্ত সাদামাটা অথচ ভীষনভাবে দামী জীবনযাপন – সব কিছুকে কাল বিদায় জানাতে হবে। প্রাণপনে তাই শুষে নিতে চাইছি ভালোলাগা আর মুগ্ধতার শেষ বিন্দুটুকু।

১৫ই জুলাই, ২০১৬: শেষের সে দিন

অবশেষে আজ অন্তিম দিনের যাত্রার জন্যে তৈরি আমরা। সকালে স্লিপিং ব্যাগ তো রোজই গোছাতাম, আজ টেন্ট খোলার কাজেও হাত লাগলাম। গত সন্ধেতেই যদিও ট্রেক কমপ্লিশন সার্টিফিকেট পেয়ে গেছি, তাও আজকের দিনটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুহূর্তের অসতর্কতা ডেকে আনতে পারে চরম বিপদ। তার ওপর সকাল থেকেই আকাশ ভাঙা বৃষ্টি নেমেছে। ১৫ কিমি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে আজ। পুরোটাই নামা, নারানাগ আজ আমাদের গন্তব্য। ওখান থেকে শ্রীনগর যাওয়া হবে গাড়িতে, সম্ভব হলে আজই। কিন্তু মাথার ওপর কারফিউ-এর চিন্তা খাঁড়ার মত ঝুলছে। বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। ভয়ানক পিচ্ছিল কর্দমাক্ত রাস্তা এবং মুষলধারে বৃষ্টিকে সঙ্গী করে চলেছি। ক্রমাগত খাড়া উৎরাই-এর জন্যে হাঁটুর দু:সহ অবস্থা। নারানাগ পৌঁছে লাঞ্চ সেরে নেওয়া হল। তখনও শ্রীনগরের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের কেউ কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। উপরন্তু নিরাপত্তার কারণে সমস্ত মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ। বাড়িতে যোগাযোগ করার কোনও উপায় নেই এবং সেটাই সব থেকে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। না জানি সব খবর টিভিতে দেখে মা-বাবা কী চিন্তাই না করছে! অবশেষে ঠিক হল আমরা রাত ১.৩০ নাগাদ রওনা দেব এবং কাকডাকা ভোরে শ্রীনগর এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাব যাতে কারফিউ এড়ানো যায়। দীর্ঘ এক সপ্তাহের নিরামিষ খাওয়ার যন্ত্রণা রাত্রে চিকেন খেয়ে মেটানো গেল কিছুটা।

১৬ই জুলাই, ২০১৬: ফেরার পালা

পরিকল্পনামত ভোর ৪.৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর এয়ারপোর্ট। বাড়িতেও যোগাযোগ করে নেওয়া গেল একজনের পোস্ট-পেইড মোবাইল থেকে। ফ্লাইটের টাইম অনেকটা দেরিতে। এদিকে এয়ারপোর্টের ভেতরে নাকি ফ্লাইটের দু ঘন্টা আগে ছাড়া ঢোকা যাবে না। অগত্যা বাইরের ঘাসের লনেই বসে পড়া হল। ফ্লাইটও ক্রমাগত ডিলে হয়ে চলেছে। তাও এল এক সময়। ফিরে এলাম আবার দিল্লির বুকে।

~ কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেক রুট ম্যাপ ~ কাশ্মীর গ্রেট লেকস ট্রেকের আরও ছবি ~

পছন্দের বই আর গান পেলে বাকী পৃথিবীকে আলাদা করে দিতে সময় লাগে না পর্ণা সাহানার। প্রিয় অবসর বিনোদন নানারকম রান্না আর হস্তশিল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রালয়ে কর্মরতা। নিজের হাতে সংসার গোছানোয় বিশেষ যত্নশীল। মাঝে মাঝেই মুক্তির আনন্দে বেরিয়ে পড়া কারণ ছোট থেকেই পায়ের তলায় সর্ষে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher