বঙ্গের উত্তরে

দেবাশিস রায়

 

~ লামাহাটা-তিনচুলে-লেপচাজগতের আরও ছবি ~

পায়ের তলার সরষেগুলো পুরনো হয়ে গেলেও বেড়ানোর নাম শুনলেই আমার গিন্নির মাথার পোকাগুলো নড়েচড়ে বসে। আর তা সংক্রামিত হতেও বেশি দেরি হয় না!
মাঝে ব্যয় সংকোচের নিমিত্তে "পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য" স্টাইলে পদব্রজে ভ্রমণ (ট্রেকিং) ধরেছিলাম, কিন্তু দু-এক দফা ঘুরতে না ঘুরতেই মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়! গিন্নিও কম যান না, বলেন - সে কী? সপরিবার ভ্রমণ বাদ? বালাই ষাট! ক্ষতি পূরণে হাতের বালা, গিনির লকেট মায় কয়খান হাজারদুয়ারি শাড়ি; ব্যস - হাতে রইল ফাঁকা পকেট!!
তাই আবার রুট বদল। রং রুটে আর নয়!
কোন চুলোয় যাই, ভাবছি বসে দিন রাত। বরাবরের মতই খুব একটা মাপজোক আগে থেকে করা হয়ে ওঠে না। তার মধ্যেই যাতায়াত, থাকার ব্যবস্থাদি করে ফেলতে হবে। উৎসবের মাস (এখন অবশ্য বারো মাসই উৎসব), উৎসবের প্রাক্কালে আনন্দ ভাগ করে নেবার তীব্র বাসনায় মন আনন্দে পরিপূর্ণ, প্রাণে আরাম, হৃদয়ে প্রশান্তি; অথচ পকেটের ব্যাটারির (পড়ুন রেস্ত) চার্জ প্রায় তলানিতে।
তবু চুলোচুলি ঝুলোঝুলি করে মানচিত্র ছকে ফেলা গেল - লামাহাটা - তিনচুলে - লেপচাজগত, উত্তরবঙ্গের অল্প পরিচিত পাহাড়তলিত্রয়ী কেন্দ্র করে।

দুর্গোৎসবোত্তর প্রথম রবিবারে প্রাক্তনী বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে সান্ধ্যকালীন আড্ডা সেরে বরাদ্দ মিষ্টির প্যাকেট হাতে দে ছুট। লোকাল ট্রেনে শিয়ালদা পৌঁছানোর ফাঁকেই মিষ্টিমুখ।
ট্রৈনিক সফরে অকুস্থলে যাওয়ার এক্সপ্রেস গাড়ির পোষাকি নাম 'পদাতিক'! কী কান্ড। ওদিকে শিয়ালদাতে ব্যবস্থাপনায় স্টেশন ম্যানেজারের বোর্ডে 'আনন্দ বর্ধন' সাহেবের নাম দেখে আনন্দ বেড়ে গেল! এক্সপ্রেসে চেপে বার্থ খুলেই সটান শয়ান - আহ্ কি আরাম, এর নাম 'বার্থ' না হয়ে 'রিবার্থ' হলেও ক্ষতি কী!!

ঘুমের চাদর পাতলা হতেই কানে হালকা কোলাহল। ভোরের আলো এসে পিছলে পড়ছে চলন্ত গাড়ির ডাবল কাঁচের জানালায়, উলটোদিকে সেখানেই জটলা, জানলার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারার সমবেত প্রয়াস। মই বেয়ে নেমে পড়া গেল। দুই লোয়ার বার্থের তলা থেকে এক-এক পাটি চপ্পল খুঁজে বার করে উল্লম্ব হলাম (ট্রেন কোচে চপ্পল বড় লোভনীয় বস্তু, রাতের বেলা অন্যের চপ্পল পায়ে গলিয়ে ভেস্টিবিউল সন্নিহিত ছোট কামরায় আবশ্যিক কর্ম সারতে যাওয়ার যাত্রী বন্ধুর অভাব নেই, তাই চপ্পল সুরক্ষিত রাখবার এই বিধি পালনীয়)।
একটাই টেনশন। সোজা হয়ে দাঁড়ালেও গরম চা পান করার ভরসা পাইনে। জানালার কাঁচে তখনও চুল না আঁচড়ানো মাথার ভিড়। তারই ফাঁক দিয়ে কর্ণার কিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই, চোখে ধাঁধা, হৃদয়ে কু ঝিক ঝিক। চলন্ত সবুজের সীমানা ছাড়িয়ে সামনের দৃশ্যপটে শুধুই পাহাড় - বরফ ঢাকা উন্নত শির। জঙ্ঘায় তার তুষার মণি কাঞ্চন, নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা!!
আহা, কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!!
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন নিউজলপাইগুড়ি ঢুকবে। এতবার উত্তরবঙ্গের এই প্রধান স্টেশনটি দিয়ে ট্রেনসফর করেছি, কিন্তু এ দৃশ্য আগে চোখে পড়ে নি। তাই যারপরনাই আপ্লুত, চোখে তৃষ্ণার আবাহন। ফলাফল, সকালের টেনশন গায়েব, তিন রুপিয়ার গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে উদার মনে ১০ টাকার নোট দিয়ে দেওয়ার সাহেবি মেজাজ! গিন্নি সেই ভোর বেলাতেই লোয়ার বার্থ ছেড়ে একপ্রস্থ লিপস্টিক আর আই লাইনারে চোখ রেখেছেন। এবার নামতে হবে যে, পাড়ি দিতে হবে পাহাড়ি পথ - যেখানে কয়েক রাতের জন্য আমাদের নাম লেখা আছে শৈলাবাসের বুকিং রেজিস্টারে।
মালপত্তর সব নামিয়ে পুঁটলি এবং পরিবারবর্গের মাথা গুণে সাহেবিয়ানা ঝেড়ে ফেলি। এবার আমি আর বন্ধুবর বিনে পয়সার কুলি। শ্রম লাঘবের জন্য মাথা খাটিয়ে প্রায় সব পুঁটুলির পশ্চাৎদেশেই চাকা লাগিয়ে এনেছি। চাকা আবিষ্কারের এমন সুফল আর কখনও অনুভূত হয় নি!
গাড়ি লাগবে? দাজ্জিলিন - জ্ঞানটক কোথায় যাবেন? ক'জন আছেন? হোটেল, ব্রেকফাস্ট? কী চান বলবেন তো! অহ, হোটেল গাড়ি বুক আছে!
হাসিমুখে পুরানো বন্ধু নবীন তার নতুন কেনা গাড়ি নিয়ে হাজির এনজেপি স্টেশন চত্বরে। মাত্র সতেরো দিন আগে হাতে পেয়েছে, এর মধ্যে সাত দিনের একটি সফর সেরে এসেছে কলকাতানিবাসী অন্য পার্টি নিয়ে। আমার সাথে সম্পর্কটি অবশ্য শুধুই পার্টি-ড্রাইভার নয় - অনেকটাই পারিবারিক। এ তল্লাটে নিয়মিত বেড়াতে আসা অনেকেরই এমন আত্মীয়তা তৈরি হয়ে আছে পাহাড়তলির ঘরে ঘরে, এখানে ওখানে। নবীনকে বুকে জড়িয়ে প্রাক শীতের সকালে বুক ভরে উষ্ণতা নিলাম। আমাদের ছয় মাথার ছয়দিনের একান্নবর্তী পরিবারে জায়গা হল আর এক আত্মীয়ের, ডুয়ার্সের সামসিংনিবাসী নবীন। সফরে সঙ্গী হল সাফারি। যাত্রা হল শুরু।
রেলস্টেশন জনপদ ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল সবুজ জঙ্গলের পেট চিরে কালো রাস্তা ধরে। যতদূর চোখ যায় শুধুই শাল মহুলের বন। শালুগোড়া হয়ে যাবো তিস্তাবাজার। দ্বিমুখী রাস্তায় মাঝে মাঝেই নীরবতা খানখান করে সাঁই সাঁই বেড়িয়ে যাচ্ছে বিপরীতমুখী গাড়ি। এভাবেই বেশ কিছুটা সময় এই বনপথে অতিক্রান্ত হবার পর তিস্তার পাড়ে প্রাতরাশের বিরতি।
আগের সপ্তাহেই বেশ কয়েকদিন ধরে অঝোরে বৃষ্টি হয়েছে, তিস্তার জলে তার ছোঁয়া, যদিওবা এখন রোদ ঝলমলে চারদিক। আকাশ নীল।
আমাদের জাঙ্গল সাফারির ক্ষণিকের ইতি। এবার উপোস ভঙ্গ - রাস্তার ধারে ধাবায়। সেখান থেকেই আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলা। এক পাহাড়ের ছায়ায় অন্য পাহাড়, কালো ধূসর রঙের বাহারি শেড, তারই আড়ালে উধাও সকালে ট্রেন থেকে দেখা সেই বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
তিস্তাবাজার থেকে করোনেশন ব্রিজকে ডানহাতে রেখে তিস্তার পাড় ধরে ধরে রাস্তা এগিয়ে গেছে পাহাড়ি ধাপে। ঘন ঘন উচ্চতা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে আবহাওয়া, পাহাড়ি বাঁকে পালটে যাচ্ছে ছবি। পাকদণ্ডী পথে ফেলে আসা রাস্তা, চা বাগান আর দীর্ঘদেহী ইউক্যালিপটাস আলো আঁধারির ছায়া গায়ে মেখে স্মার্টফোনের 'স্মৃতি' ভারাক্রান্ত করতে করতে চলেছে। এ পথ আমার অচেনা নয়। শুধু তার রঙ রূপ গন্ধ প্রতিবারই আলাদা মনে হয়। চেনা মানুষ অচেনা আবরণে আভরণে। পুরনো প্রেম ফিরে ফিরে আসে আনমনা চাহনিতে। গাড়ির চার্জারে ফোনের ব্যাটারি দম নেয়। কম্প্যাক্ট ডিস্কে মৃদুস্বরে বাজে, আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ...

পেশক রোড ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে এমনই এক ঢিপিতে পৌঁছানো গেল, যেখান থেকে নিচে তাকালে সরাসরি পাখির চোখে নৈসর্গিক জলছবি দর্শন। তিস্তা আর রঙ্গিতের আলিঙ্গন। সাধ করে ভিউ পয়েন্টের নাম রাখা হয়েছে "লাভার্স পয়েন্ট"। লাভার্স সামিটও হতে পারত। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার রওয়ানা। সবে যখন আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে, ঝড় ওঠেনি, বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে, তখনই হঠাৎ করেই পৌঁছে গেলাম প্রথম গন্তব্যে - তোরণে লেখা - আপনাকে লামাহাটায় স্বাগত!

রাস্তার ধারেই কিছু রিসর্ট আর হোম স্টে'র ব্যবস্থা। নিরিবিলি, ছিমছাম। পথ চলতে চলতে রাস্তার ধারে একটু জিরিয়ে নেওয়ার মতো। পাহাড়ের ঢালকে আঁচল করে রাস্তা থেকে নিচে পাথুরে কোলে দুই তল আর রাস্তা থেকে ওপরে দুই তল মিলিয়ে চারতলা রিসর্ট লামাহাটা রেসিডেন্সি, আধুনিক জীবনযাপনের সব উপকরণ নিয়ে হাজির। তিন দেওয়ালে ভর করে ছাদ, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফেসিং অপর দেওয়ালে কাঁচের আচ্ছাদন। আকাশ পরিস্কার থাকলে ঘরে বসেই একশো আশি ডিগ্রি মনোবাসনা পূরণ। তখন বিকেল, উলটো দিকে সোনালি রোদ আলস্যে জড়িয়েছে দার্জিলিং পাহাড়ের ঘন বসতিপূর্ণ ইঁট কাঠ পাথরের বাক্সগুলোকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশের সব রঙ শুষে নিয়ে সূয্যি যাবে অস্তাচলে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে হাজার তারার আলোয় ভরা জোনাকগুলি উঠবে জ্বলে। কোথাওবা পাকদণ্ডী পথে তখনও জ্বলবে নিভবে একলা গাড়ির হেডলাইট, শেষ রাত ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ি দেবার আগেই তাকে পৌঁছতে হবে বাকি পথ।
এ জায়গাটার শান্ত স্নিগ্ধতা বৌদ্ধিক ধ্যানের মতই গম্ভীর, সার দিয়ে লাগানো বৌদ্ধমন্ত্র সম্বলিত উঁচু উঁচু পতাকার সারিতে বাতাসের শব্দ এখানকার নীরবতা ভাঙে, হাওয়ায় ভর করে নিঃশব্দে শান্তির বাণী ছড়িয়ে যায় গাছে গাছে পাতায় পাতায়, প্রাণ থেকে প্রাণান্তরে।

এরই উপকন্ঠে বাস্তুতন্ত্রকে অক্ষুণ্ণ রেখে বাস্তুভ্রমণের এক অখন্ড উদ্যোগ, সাহেবি নাম "ইকো-ট্যুরিজম", অল্প সীমানার মধ্যেই গাছে গাছে হাত ধরাধরি করে এক ফুলের বাগান, আঁকাবাঁকা পায়ে চলা পথ ধরে একটা সুদৃশ্য পার্কের আলপনা - লামাহাটা বিনোদন উদ্যান, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মানসকন্যা - তাই চলতি নামে, "মমতা পার্ক" লামাহাটার অন্যতম আকর্ষণ।

গতকাল রাতেই ঘর থেকে পাহাড়ের বিপরীত প্রান্তে যে নিত্য দীপাবলির আয়োজন দেখেছিলাম, আজ দিনের বেলায় সেই কোলাহলে যাবার বাসনায় নবীনের সওয়ারিতে আবার সফর। গন্তব্য দার্জিলিং, এক ঘন্টার পথ, সারাদিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসবো নিরালা সন্ধ্যায়, লামাহাটায়। এবারের দার্জিলিং অবশ্য অনেক পরিচ্ছন্ন, প্রশাসনিক তৎপরতায় ট্যুরিস্ট ভগবান, আতিথ্যে ত্রুটি নেই। ম্যাল-এর জায়ান্ট স্ক্রিনে ফ্রি টিভি চ্যানেল, পরিধিস্থ চেয়ারগুলো যথারীতি বরিষ্ঠ নাগরিকদের স্মৃতি রোমন্থনে অবসন্ন। তারই মাঝে চোখে পড়ে নতুন প্রজন্মের টাট্টুঘোড়ায় চেপে টগবগ টগবগ অথবা সাবানজলের ফেনার স্বচ্ছ গোলকের সার দিয়ে বাতাসে ভেসে চলা। এ ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর অপরিবর্তনীয়। যেমন আজো পালটায় নি কেভেন্টারস-এর সসেজ আর অক্সফোর্ড-এর চেনা গন্ধ বা টয়ট্রেনের অমোঘ হাতছানি বাতাসিয়া লুপের চেনা অলিন্দে।

সারাদিন ঘোরাঘুরি করে যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যা সাতটা হবে। অর্ধেক লামাহাটা তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, বাকি অর্ধেক চন্দ্রাহত - টোলখাওয়া চাঁদের কপালে টি দিয়ে, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। টেংরি কাবাব চিবোতে চিবোতে আমরাও সেই জোয়ারে স্নাত হলাম। অচেনা ফুলের গন্ধে আর ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্টে রাত হল মোহাচ্ছন্ন।
রাত পোহালেই কানে এল, বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি - সঙ্ঘং শরণম গচ্ছামি। মৃদু স্বরে বেজে চলেছে ক্রমাগত, তারই অনুরণন ছড়িয়ে পড়ছে কাছে দূরে, পাহাড়ের ঢালে। নিচের বস্তিতে ডানা ঝাপটিয়ে মোরগ ডেকে উঠল বোধহয়, গা ঝাড়া দিয়ে উঠবার অ্যালার্ম।

আজ যাওয়া হবে "তিনচুলে"। খুব বেশি দূর নয় লামাহাটা থেকে। আধ ঘন্টা গাড়িতে। তবে এ রাস্তা মূল পথ থেকে গেছে বেঁকে, উপর পানে নুড়ি বিছানো সর্পিল গ্রাম্য পথে। দুই নম্বর গিয়ারে গাড়ি। নির্জন পথ। বেশ কিছুটা পথ চলে আসার পর বিপরীতমুখী একটা গাড়ি দেখতে পেলাম। বস্তা বোঝাই। নবীনের মুখে শুনলাম, ওগুলোতে আদা আছে। মনে পড়ল, আদার কারবারিরা নাকি জাহাজের খোঁজ রাখে না। এলাকাতে আদার চাষবাস হয় ভালোই। উপর থেকে নেমে আসা গাড়িটাকে জায়গা করে দিতে আমাদের গাড়িটা অনেকটা আগেই দাঁড়িয়ে গেল। পাহাড়ি পথে নিচে নামার গাড়িকে আগে সুযোগ দিতে হবে। এটাই দস্তুর।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর একটা চাতালমত জায়গায় পৌঁছলাম। এখান থেকে নিচের ফেলে আসা পথটাকে দেখে ময়াল সাপের মত শুয়ে আছে বলে মনে হয়। কেউ কোত্থাও নেই। হাতে সময় অনেক। মোবাইলের সংযোগও বিচ্ছিন্ন। গাড়ি থেকে নেমে কিছু ছবি তুললাম। এই ক'দিনেই রিকু আর শুভ দারুণ বন্ধু হয়ে উঠেছে। ওরা গল্পে মেতে আছে। আমার বন্ধু এবং তার পরিবারও হয় কানে তার গুঁজে গানের দেশে, নয়ত বা আধোঘুমে। স্ত্রীকে দেখলাম এক জায়গায় বসে চুপচাপ স্থাণুবৎ। বিরক্ত না করে, আমিও বসে পড়লাম এক পাথরে। নিজের সাথে কথা। কতক্ষণ জানি না। নবীনের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো, চলেঙ্গে সাব! চলো, চলো যাই। তিনচুলে।

এতক্ষণে জানা গেল, ফরেস্ট অফিস মারফৎ বুক করা তিনচুলের স্কাই হাই রিসর্টই আসলে "রাই রিসর্ট"। প্রাইভেট প্রপার্টি। বন দফতর বুকিং এজেন্সি হিসাবে পরিষেবা দেয়। সামরিক বিভাগের প্রাক্তনী রাই বাহাদুর গ্রামে ফিরে এসে ক্যান্টনমেন্টের মত করে এলাকাটা সাজিয়েজেন। গাছে গাছে চক্রাকারে মিলিটারি রঙের প্রলেপ। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাইনের সারি, যেন বলছে - হে ক্ষণিকের অতিথি, আপনাকে অভিবাদন! টিলার মাথায় এক পাহাড়ি গ্রামে সুন্দর করে লতাপাতায়, নাম না জানা ফুলে আর গাছপালায় সাজানো এক শৈলাবাস। চারপাশ রৌদ্রোজ্জ্বল, ঝোপে ঝোপে সূর্যমুখী আনন্দে উদ্বেল। তার রঙ আর চমকে মাতোয়ারা মৌমাছির দল।

থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাটি আশাপ্রদ। হতাশার কারণ শুধু কিছু অনিয়ন্ত্রিত বে-আক্কেলে গেস্টস (ঘোস্ট বললেও কম বলা হয়), যারা আনন্দের আতিশয্যজনিত কারণে সপরিবারে নিজেদের মুখোশ খুলে দিয়ে গেল ঐ সাদাসিধে পাহাড়িয়া মানুষগুলোর সামনে। আজকাল বেড়াতে গিয়ে এ উৎপাত প্রায়ই চোখে পড়ে। বাধ্য হয়েই গভীর রাতে তাদের আনন্দে হস্তক্ষেপ করতে হল। তাতে কাজও হল। এসব ভূতেরা একটু ভিতুই হয়।
সূর্যোদয় দেখব বলে অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়া। শাল জড়িয়ে চললাম টিলার মাথায় রিসর্টের গা দিয়ে পায়ে চলা পথে। সঙ্গী হল ইতিমধ্যেই আপন হওয়া ছয় মাসের অ্যালশেসিয়ান 'মেসি'। সূর্যোদয়ের আগেই আকাশ প্রতিভাত আবিরের রঙ ছড়িয়ে, দিগন্তে যখন উজ্জ্বল আলোক বিন্দু মাথা তুলছে, উল্টোদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে আলতো রোদের ছোঁয়া, দিনের প্রথম আলো তার মুকুটে। চোখের নিমেষে দৃশ্যপটে পরিবর্তন - আলোর গায়ে আলো, আঁধার সরিয়ে ধারে কাছের আবছা কালো পাহাড়গুলো দ্রুত পর্দা সরিয়ে ফেলছে, খাঁজে খাঁজে ঠিকরে পড়ছে আলোকচ্ছটা, কোলের কাছে সাদা মেঘের ঢেউয়ে প্রতিফলিত হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে দিগদিগন্তে। এ এক নয়নাভিরাম ছবি, ক্যামেরা গুটিয়ে রাখলাম। লেন্সের শক্তি নেই প্রভাতের সে হোলিখেলাকে সে বন্দি করে। চোখ ভরে এঁকে নিলাম সেই দুর্লভ ঊষালগ্ন।
নরম রোদে অবগাহন শেষে নেমে আসার সময় খেয়াল করলাম, রাতজাগা সেই সহভ্রমণার্থীরা তখনও চুলায় আগুন জ্বেলে ঘুমের দেশে, তিনকূলে তাদের কেউ কোত্থাও নেই। সেইদিন সকালে রাই পরিবারের সকলের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেরার প্রস্তুতি। স্থানীয় প্রথামত গলায় উত্তরীয় পড়িয়ে রাই পরিবার বিদায় জানালো আমাদের, পরম আত্মীয়তায়। অকৃত্রিম আবেগে চোখের কোণাটা চিকচিক করে উঠল।

ওখান থেকে সরাসরি পথ নেমে গেছে গ্রামের মধ্য দিয়ে, তিস্তাবাজারের দিকে, বড়মাঙ্গোয়া হয়ে। আমরা উল্টোপথ ধরলাম। সারাটা পথ চুপচাপ । যাবো লেপচাজগত। পেশক রোড ধরে ঘুম হয়ে যেতে হবে মিরিকের পথে। ফেরার সময়েও লামাহাটা অতিক্রম করলাম আরো একবার। কিন্তু মন পড়ে রয়েছে তিনচুলেতে - ফেলে আসা খোলা জানলায়।
প্রায় বছরদশেক আগে একবার এসেছিলাম লেপচাজগত। চারপাশের পাহাড়ি বনভুমির মাঝখানে নিঃসঙ্গ এক বনবাংলো, বাহারি রডোড্রেনডন ঘেরা। একমাত্র চৌকিদার তার অতন্দ্র প্রহরী। সেখানে রাত্রিবাস ছিল এক শিহরণ। আজকের লেপচাজগতে ট্যুরিস্টদের চাহিদা মেটাতে বেসরকারী উদ্যোগে ইতিউতি গজিয়েছে কংক্রিট হোটেল। তবু বনবাংলোটি তার স্বকীয়তা বজায় রেখে একান্নবর্তী হয় নি। কার্পেটমোড়া বিশাল বিশাল ঘরে এখনও বনেদিপনার ছোঁয়া। বাইরের পলেস্তেরায় অযত্নের চেহারা প্রকট হলেও অন্দরমহল এখনও রক্ষণশীল। নির্ভেজাল আড্ডা আর অলস দুপুরে নির্জন বনপথে খানিক হাঁটাহাঁটি ক্লান্তি ঘুচিয়ে দেয়। বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে নেওয়া শহরের ধোঁয়াশ্রয়ে ফেরবার আগে।

এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট, আরো কাছাকাছিই মনে হয়। পরের দিনটা ধারেকাছে মানেভঞ্জন, সুখিয়াপোখরি, পশুপতি গেট (নেপালের একটি প্রবেশপথ) হয়ে মিরিক ঘুরে এলাম। মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু-ফালুট যাওয়ার ট্রেকিং পথে অনেকেরই চেনা। ঐ পথে "চিত্রে" গ্রামটি চিত্রাবৎ বললেও কম বলা হয়। এখানে রাস্তা ধরে এগোনোর সময় প্রায়ই চোখে পড়বে সীমা সুরক্ষা বল বা এসএসবি-র ক্যাম্প। রাস্তার একদিকে ভারতীয় সীমা, অন্যদিকে নেপাল ভূখন্ড। আবার পশুপতি গেট দিয়ে নেপালে ঢুকে কিছু কেনাকাটা পরিবারের মান ভঞ্জনের সহায়কও বটে।
মিরিক পৌঁছে মধ্যাহ্ন ভোজন। চারদিকে প্রচুর দোকানপাট, মানুষের ছড়াছড়ি। সবকিছু কেমন যেন অবিন্যস্ত। লেকের সৌন্দর্য গ্রাস করেছে মনোহারী দোকান আর রেস্তোরাঁর ভিড়। সবুজের দফারফা। শুধু একই আছে, লেকের বিপরীত প্রান্তে পাহাড়ের গায়ে সরু পথ বেয়ে গাছপালার ছায়াপথে একটানা যাতায়াত ঘোড়সওয়ারীর। কখনও ছোট বাচ্চা কোলে স্থূলকায়া, কখনোবা তরুণী তন্বীর। কাছেই আস্তাবলের বোঁটকা গন্ধ নাকে আসে। নাম না-জানা পাখি এসে ঘোড়ার গা থেকে পোকা খুঁটে খায়। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘোটককুলের রেচনপদার্থ। দ্বিপদ প্রাণীদের জন্য অবশ্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুলভ ব্যবস্থা। ইংরাজিতে বিজ্ঞপ্তি - 'শর্ট ৫, লং ১০ টাকা' এবং 'নো চেঞ্জ'।
ফেরার সময় রাস্তা সংলগ্ন ঢেউ খেলানো চাবাগিচায় হেলে পড়া আলতো রোদ্দুরে ফটোসেশন! কচ্ছপের পিঠের মতো উবু হয়ে আছে দুটি পাতা-একটি কুঁড়ি - চায়ের ঝোপ, সারি সারি। কনেদেখা আলোয় সেই বাগিচায় অন্ত্যমিল কবিতা উচ্চারণ। আজ রিকু আর ওর মাকেও খুব প্রাণোচ্ছল লাগছিল।

সূর্যাস্ত হতে না হতেই দিনের আলো নিভে এল। চারদিকে তখন আঁধার ঘনিয়েছে। গাছের মাথায় মাথায় চাঁদের উঁকিঝুঁকি শুরু হবে এবার। গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো রাস্তায় বসানো দুপাশের হলুদ রিফ্লেক্টরে ঠিকরে পড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে পাকদণ্ডী বেয়ে। বেলাশেষে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলাম রাতের আশ্রয়ে, লেপচাজগত। এদফায় পাহাড়ে আজই শেষ রাত।
লোটাকম্বল গোটানোই ছিল। এবার নামার পালা। পাহাড় থেকে। বন থেকে মন তুলে, কংক্রিটের জংগলে ফেরা। মংপো হয়ে ফিরবো ঠিক ছিল। রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত কুইনাইন ফ্যাক্টরির তৎকালীন কোয়াটার্স (রবীন্দ্র স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামীর) আজ "রবীন্দ্র স্মৃতি ভবন"। সরকারি-বেসরকারি ঔদাসীন্যে অবহেলায় পড়ে থাকা এক "জাতীয় ঐতিহ্য"। স্থানীয় এক রবীন্দ্র-অনুরাগীর তত্ত্বাবধানে পুরাতন ব্যবহার্য আসবাবসহ রঙ তুলি কলম চাক্ষুষ করার সুযোগ, প্রবেশ মূল্য ছাড়াই। এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধন এবং আলোকসজ্জার প্রচেষ্টা হয়েছে সরকারী আনুকূল্যে, কিন্তু তাতে পরিকল্পনার অভাব।
অশীতিপর নেপালিভাষী চৌকিদার শুদ্ধ বাংলায় গুনগুন গাইছেন, কেন তোমরা আমায় ডাকো... মনটা ক্ষণিকের জন্য বিষণ্ণ হয়ে গেল। চৌকিদার বলে চললেন, এ পথে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অনেকবার যাতায়াত করলেন। এখানেও এসেছিলেন। যত্ন করে বাঁধিয়ে রেখেছেন সেই ছবিও। রবি ঠাকুরের দালানে, যেখান থেকে আরাম কেদারায় বসে তিনি দৃষ্টি প্রসারিত করতেন নীল দিগন্তে।

এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর!

অতঃপর রাতের ট্রেন ধরার জন্য দে ছুট। এবার দার্জিলিং মেল। ঘড়ি ধরে চলা। ট্রেন যখন শিয়ালদা ঢুকছে, উৎসবক্লান্ত কলকাতার তখনও ঘুম ভাঙে নি। হাল্কা কুয়াশার চাদর সরিয়ে দিনের আলো ফুটেছে। ঘরে ফিরলাম। সত্যিই কি ঘরে ফেরা? মনের কোণে স্বগতোক্তি, পুনর্মূষিক ভবঃ।

~ লামাহাটা-তিনচুলে-লেপচাজগতের আরও ছবি ~

'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার অনেকদিনের বন্ধু দেবাশিস রায় ভালোবাসেন বেড়াতে। যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন এন জি ও-র সঙ্গে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher