ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণকাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, আনতে পারে চোখে জলও। জাগিয়ে তুলতে পারে জীবনজিজ্ঞাসা, প্রতিবাদের ভাষা। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণকাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।

 

কচ্ছের রান – সীমাহীন ধবলতা ও মনু সাঁইয়া

সোমনাথ ভট্টাচার্য


~ কচ্ছের রানের আরও ছবি ~


আপনি কি মনু সাঁইয়াকে চেনেন? চিনবেনই বা কী করে? আপনি তো কখনো কচ্ছের রানে যাননি। গিয়ে থাকলেও সাম-ই-শারদ-এ থাকেননি। থেকে থাকলেও, আপনার থাকার দু-দিন আগে তো সেখানে বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে যায়নি!
এসব শর্ত না মেনে আপনি যদি ভুজ শহর থেকে জাতীয় সড়ক-৩৪১ নামের যে রাস্তাটা সোজা উত্তর দিকে চলে গিয়েছে সেটা ধরে চলতে থাকেন তাহলেও ভিরান্ডিরা হয়ে, খাওরা (খাবরা) গঞ্জ ছাড়িয়ে দশ-বারো কিলোমিটার গেলে আপনি পৌঁছে যাবেন রানের তীরে। তবে সাবধান, যদি আপনি ভুজ শহরের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দপ্তর থেকে অনুমতিপত্র সংগ্রহ না করে আনেন তবে আপনাকে চেকপোস্টের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে বৃহৎ রানের ধবলতা আর অসীমতাকে উপভোগ করতে হবে, খুব কাছে যেতে পারবেন না, লবণে হাত দিতে পারবেন না। আপনার দেখাটা হবে পাঁচিলের বাইরে থেকে তাজমহল দেখার মতো। অথবা, হরিদ্বার থেকে হিমালয় দেখার মতো। আপনি যা দেখবেন সেটা কি নিস্তরঙ্গ জলরাশি? নাকি ভেজা বরফ? নাকি শুধু লবণ আর লবণ? সে ব্যাপারে বই-এ পড়া, কানে শোনা বিদ্যে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর আপনি যদি অনুমতি নিয়ে যান তবে ওরা আপনাকে ওই রাস্তা ধরেই এগিয়ে যেতে দেবে রানের গভীরে 'ইন্ডিয়া ব্রিজ' পর্যন্ত। তখন আপনি রানের প্রকৃত স্বাদ পাবেন। রাস্তাটা অবশ্য ওখানে শেষ হবেনা, চলে যাবে রানের বুক চিরে পাকিস্তান সীমান্ত অবধি। আপনি যেহেতু অসামরিক ব্যক্তি, তাই আপনাকে আর এগোতে দেওয়া হবে না।
আর যেতে পারেন কালো ডুঙ্গারে এবং সেখানকার একান্ত নিজস্ব দৈনন্দিন ঘটনাটি চাক্ষুষ করতে পারেন। সেখানে যাওয়ার পথ গিয়েছে খাওরা থেকে পূর্ব দিকে। শেষ বিকেলে ওখানে গিয়ে পৌঁছোবেন। কালো ডুঙ্গার হল একটা বড় টিলা। গায়ে যথেষ্ট ছোট গাছ আর ঝোপ আছে বলে কম আলোয় এটাকে কালো দেখায়। তারই গা বেয়ে গাড়ি করেই ওপরে উঠে পৌঁছে যাবেন দত্তাত্রেয়র মন্দিরে। সেখানে আপনাদের মধ্যে কেউ পুজো দেবেন, কেউ প্রণামী দেবেন, কেউ শুধুই প্রণাম করবেন। আর, যিনি এসব কিছুই করবেন না তাঁর জন্য, এবং অবশ্যই সবার জন্যই বরাদ্দ থাকবে সেই ঘটনাটি। (লোক-মতে) দেবতা দত্তাত্রেয় শিবা-রূপ ধারণ করে তাঁর পূজার উপচার গ্রহণ করবেন। তবে মন্দিরে এসে নয়, মন্দির থেকে অনেকটা দূরে, জঙ্গলের কাছে একটা বেদির ওপরে দত্তাত্রেয়র প্রসাদী ভাত রেখে দিয়ে থালা বাজানো হবে। একটু পরে কয়েকটা শিয়াল এসে সেই ভাত খেয়ে যাবে। টিলার ওপর থেকে দেখবেন রানের দৃশ্যও। পাহাড়ের পাদদেশে, রানের উপকূলে অগভীর জমা-জলের মধ্যে কয়েকটা সারস, ফ্লেমিংগো, পেলিকান আর বাস্টার্ডও দেখতে পাবেন। কিন্তু মনু সাঁইয়াকে পাবেন না।

* * *

আর যদি ভিরান্ডিরা থেকে বাঁদিকে মোড় নেন তবে বারো-তেরো কিলোমিটার গেলে পৌঁছে যাবেন সাম-ই-শারদ-এ। 'সাম-ই-শারদ' কথাটার বাংলা মানে হল 'সীমান্তে সূর্যাস্ত'। এটা একটা ভিলেজ রিসর্ট বা গ্রামীণ অতিথিশালা। এটাকে ভিলেজ রিসর্ট বলার একাধিক কারণ থাকতে পারে: প্রথমত, হোড়কা গ্রামের মধ্যে না হলেও তার পরিসীমার মধ্যে এটা অবস্থিত; দ্বিতীয়ত, হোড়কার গ্রাম কমিটির দ্বারা এটা পরিচালিত; আর শেষত, এটা মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা নকল গ্রাম। যাঁরা মাটির পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি দেখেননি তাঁরা 'পথের পাঁচালি', 'অপরাজিত', বা অন্য কোনও সাদা-কালো বাংলা সিনেমা দেখে নিতে পারেন।

বাংলার গ্রামের সঙ্গে এই পাঁচিলের যে অমিল পাবেন তা হল, বাংলার পাঁচিলগুলো হল মোটা মাটির দেওয়াল - তার মাথায় খড়ের আচ্ছাদন থাকে। আর এখানে, কচ্ছে, সরু-মোটা ডালপালার বেড়ার ওপরে মাটি লেপা, ডালপালাগুলো মাটির আড়ালে নিজেদের অস্তিত্ব গোপন করতে নারাজ, তাই মাথা উঁচিয়ে থাকবে। আর, মিল পাবেন পাঁচিলের গায়ে ছোটো, নিচু সদর দরজাটায়, যার মাথাতে খড় বা ঘাসের ছাউনি থাকবে। দরজার কাছে দুটো বৃক্ষ কচ্ছের বিরল দৃশ্য তার ছায়ায় দুটো গরু বাঁধা থাকবে। দরজা পেরিয়ে ঢোকার পর আপনি যে আতিথেয়তা পাবেন তা 'এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজা'-র তুলনায় অনেক অদক্ষ, অনেক সাদামাটা, কিন্তু অনেক আন্তরিক। এর পরে একটা বৈঠকখানা এবং খোলামেলা খাওয়ার মণ্ডপ। পাঁচিল-ঘেরা অঞ্চলটার মধ্যে অনেকগুলি খড়ে ছাওয়া, মাটির দেওয়ালের গোলাকার কুটির (যেগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ভুঙ্গা বলে)। বাইরের চেহারাটা গ্রাম্য হলেও ভিতরটা বিলাসবহুল। আপনি সেগুলিতে থাকবেন না। কুটিরগুলিকে ডানদিকে রেখে বাঁয়ে এগিয়ে যাবেন। আপনার বাঁপাশে একটা সৃজিত বনে দুটো গাধা ঘুরে বেড়াবে। এরই শেষে এই গ্রাম্য পরিবেশের নকল দিকটাকে প্রকট করে তুলেছে যে তাঁবুগুলি তারই কোনোটাতে আপনি থাকবেন।

স্নানাদি সেরে খাওয়ার উদ্দেশ্যে আপনি যখন বৈঠকখানা তথা খাওয়ার মণ্ডপে পৌঁছোবেন তখন দেখবেন সেখানে গানের আসর বসেছে। মেঝেতে পাতা গালিচায় বসে একজন তানপুরা বাজিয়ে গান করছেন, চারজন যন্ত্রানুসঙ্গী। সবাই কচ্ছের ভূমিপুত্র, মালকোঁচা মারা ধুতি, সাদা লম্বা ফুল-শার্ট, মাথায় রঙিন কাপড়ের পাগড়ি। কেউ কিছু বলবে না, আপনি নিজের থেকেই গিয়ে বসবেন গায়কদের সামনের অথবা পাশের মাটির বেদিতে বেঞ্চে বসার মতো করে পা ঝুলিয়ে, বা পা গুটিয়ে আসন-পিঁড়ি হয়ে। গুজরাটি বা মারাঠি যে সব যাত্রীরা আপনার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে থাকবেন তাদের কেউ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াবেন। হাত দুটো সামান্য ওপরে তুলে তুড়ি দেবেন গানের তালে তালে। কোমর থেকে ওপরের অংশটা দুলতে থাকবে একই তালে। তারপর পা দুটোও। তিনি অবশ্যই যৌবনোত্তীর্ণ একজন পুরুষ। তারপর আরও একজন। তারও পরে কোনো মহিলা, এবং শেষে যুবক-যুবতীরা। তাদের নৃত্যের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে আপনারও মনে। আপনি বসে বসে তুড়ি বা তালি দেবেন। কম্পন অনুভব করবেন পায়ের পেশীতে, শিরদাঁড়ায় এবং মস্তিস্কে। কিন্তু, সামাজিক নৃত্যবিরোধী বাঙালি সংস্কার কাটিয়ে সেই উৎসবে যোগ দিতে পারবেন না; দর্শক হয়েই থাকবেন। সকলের মাঝে বসে নিজের মূদ্রাদোষে নিজেই একা হবেন।

সন্ধ্যার পরে বৈঠকখানাতে একে একে এসে জমা হবেন কিছু বয়স্ক মানুষ। প্রায় সবারই পরনে সাদা ধুতি-শার্ট; মাথায় রঙিন বা সাদা পাগড়ি অথবা টুপি। কারও হাতে লাঠি। কারও মোটা গোঁফ, শেষপ্রান্ত পাকানো। কেউ বা প্যান্ট-শার্ট পরিহিত। এঁরা হোড়কা গ্রামের বরিষ্ঠ নাগরিক। তাঁরা নিজেদের মধ্যে গল্প করবেন। আপনি যদি আলাপী ও অনুসন্ধিৎসু হন, তবে ওঁদের আড্ডায় যোগ দেবেন।
ওদের কাছ থেকে জানতে পারবেন, কচ্ছের পশ্চিমদিকের এই অঞ্চলটা আগে রানেরই অংশ ছিল। উত্তরবাহী বর্ষা-জলের নদীগুলির পলি জমে জমে জলকষ্টসহিষ্ণু মানুষগুলির বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এখানে পানীয় জলের বড় অভাব। বাংলা 'গ্রাম' শব্দটার কচ্ছীয় প্রতিশব্দ হল 'ঝিল' যার বুৎপত্তিগত অর্থ 'যেখানে খাবার জল পাওয়া যায়'।
ওঁরা আবহাওয়ার কথা বলবেন, জিনিস-পত্রের দামের কথা বলবেন, রানের কথাও বলবেন। ''বড় অদ্ভুত জায়গা, চির-অচেনা। একটা বিশাল শূন্যতা। যান না, গিয়ে দেখবেন।"
"রানের ওপারেই তো পাকিস্তান। তাই না?" আপনি জিজ্ঞেস করবেন। সবাই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়বেন।
"গিয়েছেন কখনও কেউ?" আবার আপনার প্রশ্ন। এবারে সবাই চুপচাপ।
"ও-কথা জিজ্ঞেস করবেন না কখনও।" একজন বলবেন। "কেন?"
"ওটা বেআইনি। মিলিটারি দেখতে পেলে গুলি করে মেরে দেবে, না-হয় তো জেলে পুরে দেবে। গিয়ে থাকলেও আপনাকে কেউ বলবে না।"
"আপনারা বোধহয় রানে পৌঁছোতে পারবেন না।" ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পালটান কোনো একজন।
"কেন?" আপনি প্রশ্ন করবেন।
"দু-দিন আগে খুব বৃষ্টি হয়েছে, জলে-কাদায় আপনাদের গাড়ি চলতে পারবে না।"
আপনার হতাশ চোখকে নজর করে কেউ একজন বলে উঠবেন, "যাক না। চেষ্টা করেই দেখুক।" তিনি আরও বুঝিয়ে বলবেন,"থোরডো পৌঁছে দেখবেন এখানকার মতো একটা অতিথিশালা আছে, সেখানে খোঁজখবর নিলে জানতে পারবেন পথ কেমন আছে।"
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বরিষ্ঠরা দু-তিন জন করে আসরত্যাগ করবেন। যিনি বেশি কথা বলছিলেন তাঁকে এগিয়ে দেওয়ার অজুহাতে আপনি তাঁর সঙ্গ নেবেন। আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে। এক সময়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়বেন। বলতে থাকবেন, "যুবক বয়সে আমি অনেকবার রান পেরিয়েছি। এখন শুধুমাত্র ড্রাগ আর অস্ত্রের চোরাকারবারিরাই ওখানে যায়। মিলিটারির লোকেরা এই ব্যবসা বন্ধের জন্য খুব চেষ্টা করছে।" তিনি শির বেরকরা হাতের পাঞ্জাটা নাড়িয়ে বলবেন "কিন্তু ওরা কী করে পারবে? রান কী একটুখানি জায়গা? ওরা সব জায়গায় যেতেই পারে না। কোনো কোনো জায়গায় শুখার সময়েও ওদের জিপ বা ট্রাকের চাকা কাদায় আটকে যায়। রানকে কেউ চিনে উঠতে পারে না। এক-এক বছরে ওর এক-এক রূপ।" সামনের অন্ধকার প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে তিনি একটু বেশি সময় ধরে নীরব থাকবেন। তারপর আবার বলতে শুরু করবেন। তাঁর গলার স্বর বিষাদময়। "অনেক বছর আগে আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি, ওর নিজের উটটাকেও। ও আমার মতো অভিজ্ঞ ছিল না। আমার কথা শুনল না। বলেছিলাম, এ-বছর বর্ষা দেরিতে শেষ হয়েছে, তোমাকে ঘুরপথে যেতে হবে। শুনল না। ওর তাড়া ছিল। ওরা গরিব ছিল ...।" বিষাদের হাসি ফুটে উঠবে তাঁর গালের রেখায়। "আমরা সবাই গরিব, কিন্তু ও চাইছিল জমি কিনে কোঠা বাড়ি করবে। ... ওর বড় তাড়া ছিল।" আবার একটা দীর্ঘ নীরবতা। আবার অদৃশ্য দিগন্তের দিকে শূন্য দৃষ্টিপাত। "বড় ভালো ছেলে ছিল। আমি তার বড় ভাই। ওর আমার কথা শোনা উচিত ছিল।" তিনি আবার চুপ করবেন।
"কী হল তার?" বোকার মতো প্রশ্ন করবেন আপনি।
"ওর ছেলেটাও ছিল ওর সঙ্গে। বারো বছর বয়েস। ফুটফুটে, তরতাজা একটা ছেলে ..."
ভিতর থেকে দুঃখের বাষ্প ঠেলে বেরিয়ে এসে আবার তাঁকে বাকরুদ্ধ করবে। "ও অন্যপথে গেল।" ভিতরের বাষ্পটা একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসবে। তিনি মুখ তুলবেন। সাম-ই-শারদ-এর ইলেকট্রিকের আলোর একটা টুকরো এসে পড়বে তাঁর মুখে। আপনার মনে হবে এই কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি আরও বেশি বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, আপনি তখন সাংবাদিকদের মতো নাছোড়বান্দা।
"কী হল তাদের?"
"ও পথ হারিয়ে ফেলেছিল। আমরা ফেরার পথে ওদের দুখানা উটকে দেখতে পেয়েছিলাম। সেগুলো প্রায় মরতে বসেছিল। আমরা ও দুটোকে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছিলাম।"
"ও হয়তো অন্য পাড়ে পৌঁছে গিয়েছে। কোনো এক দিন ফিরে আসবে।"
"এখানে ওর বউ আছে, অন্য বাচ্চারা আছে।"
"হয়তো মিলিটারির লোকেরা ওকে অ্যারেস্ট করেছে।"
"নাঃ - এ-সব আঠাশ বছর আগের কথা। তখন এখানে এত মিলিটারি ছিল না।"
"তাহলে উনি মারাই গিয়েছেন?"
ভদ্রলোক তাঁর লাঠির মাথার ওপরে রাখা হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকবেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর মাথা তুলে বলবেন, "ও 'সফেদ' হয়ে গিয়েছে।"
"সফেদ?"
"যারা রান থেকে ফেরে না, তাদের আত্মার একটা অংশ রানে থেকে যায় 'সফেদ' হয়ে। এই বিশাল রানে এ-রকম অনেক আছে। কে জানে কত! শত-শত মানুষ, শত-শত 'সফেদ'। যে অংশটা গ্রামে ফিরে আসে তাকে আমরা প্রেত বলি। তাকে ভয় পাই। কিন্তু 'সফেদ'দের আমরা ভয় পাইনা। আমরা যখন রান পেরিয়ে যাই তখন ওঁদের স্মরণ করি। ওঁরা আমাদের রক্ষা করেন, পথ চেনায়।"
"কিন্তু আপনি তো কখনো তাঁদের দেখেননি।"
"তোমাকে তো আগেই বলেছি, বড় অদ্ভুত জায়গা এই রান। এখানে অদ্ভুত সব ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় ব্যাখ্যা করা কঠিন। পৃথিবীতে আর কারো সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাবে না, এমনকী অন্য সব মরুভূমির সঙ্গেও। এর স্বভাব আলাদা, ভাষা আলাদা। তার কথা তুমি যদি মন দিয়ে শোন, তাকে ভালো করে দেখ, তাহলে তুমি নিরাপদ থাকবে ...।"
"আপনার ভাই সে-সব মন দিয়ে শোনেনি?"
"ও খুব ভালো লোক ছিল। কিন্তু অল্প বয়স। খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। অনেকরকম সমস্যায় মাথাটা ভরা ছিল। তাই ও সব কিছু ভালো করে শুনতে পায়নি।"
"আপনার সব সময়ে তার কথা মনে পরে, তাই না?"
"সে আমার একমাত্র ভাই ছিল। আমার পাঁচটা বোন আছে। কিন্তু ও ছিল আমার একমাত্র ভাই।"
"তাহলে আপনার মনে হয়, সে এখনও এখানে আছে?"
"অবশ্যই। ও সফেদ হয়ে গেছে। ও এখানে চিরকাল থাকবে।"

* * *

আপনি এখানে আসার আগে ইন্টারনেটে রানের ছবি দেখেছেন। ঘন নীল আকাশপটে পূর্ণিমা-চাঁদ, আর সেই নীলিমা ছড়িয়ে পড়েছে ধবল সমভূমিতে, আর কিছু নয়, একটাও গাছ নয়, ঘাস নয়, এক টুকরো মেঘ নয় এই হল রান। সেই ছবি পেতে হলে আপনাকে রান উৎসবের সময়েই আসতে হত। অন্য সময়ে কাউকে রাতের বেলা রানের মধ্যে থাকতে দেওয়া হয় না। তবু, কাজু বাদামের অভাবে চিনে বাদাম দিয়ে রসনা তৃপ্ত করার বাসনায় রাতের খাবারের পর আপনি এবং আপনার সঙ্গীরা বেরিয়ে পড়বেন পাঁচিলের বাইরে। শুক্লা অষ্টমীর চাঁদ অস্ত যেতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক দেরি। চেয়ারে পিঠ বাঁকিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে সে আসন্ন ছুটির প্রহর গুনছে। মুখে কর্মদিবস-অবসানের খুশির হাসি। তার অর্ধতনু থেকে প্রতিফলিত সূর্যালোক হোড়কার প্রান্তরে একটা স্বপ্নালু আবছায়া সৃষ্টি করবে। দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা মাঠে গাছ পাবেন ওই রিসর্টটায় আর দূরে পাকা রাস্তার ওপারে একটা জায়গায় কয়েকটা। পায়ের নিচের সমতল প্রান্তরটার কালো রঙের মাটি সাদা-বালির চরের মতো জমাট অথচ নরম। বেশ কিছু দূরে দূরে এক থেকে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি লম্বা অচেনা কোনো চারাগাছ বা গুল্ম। সেই ফাঁকা মাঠে আপনাদের পরস্পরের কথাগুলিকে মনে হবে দূর থেকে ভেসে-আসা শব্দ। আপনারা এদিক ওদিক ঘুরবেন। হঠাৎই সেই জ্যোৎস্নানিশির নিসর্গশোভা উপভোগের প্রতিবন্ধক হিসেবে আপনাদের মনে একটা ভয় জাগবে। সাপ, বিছে বা অজানা কোনো পোকামাকড়ের ভয়। আপনারা সাবধানে পা ফেলে আস্তানায় ফিরবেন।

সকাল বেলায় স্নানাদি সেরে, নাস্তা খেয়ে, অতিথি নিবাসের পাওনা মিটিয়ে, আপনাদের মালপত্র গাড়িতে তুলে, মনে সংশয় নিয়ে রওনা হবেন হোয়াইট রান দেখতে। সাম-ই-শারদ থেকে বেরিয়ে পাকা রাস্তায় পড়ে আপনাদের গাড়ি ডানদিকে ঘুরে যাবে। মসৃণ পথের দু-ধারে ছাড়া-ছাড়া কাঁটা ঝোপ - সম্ভবত বাবলা কাঁটা। কোনো কোনো জায়গায় তাও নেই - দুধারে শুধু ধু ধু মাঠ। লালচে কালো মাটি। ছড়ানো-ছিটানো গোছা-গোছা ঘাসের আকারের কিছু গুল্ম। হঠাৎ-হঠাৎ দু-একটা ক্ষেত। কিন্তু গ্রাম কোথায়? সবুজ ক্ষেতের ওপারে তাল-নারকেল-সুপারি বা আম-কাঁঠালের বাগান দেখে গ্রাম চেনার বাঙালি-চোখে আপনি কোনো গ্রাম খুঁজে পাবেন না। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গ্রাম চেনার গুজরাটি, কচ্ছীয় চোখ চাই। পাকা রাস্তা থেকে মেটে রাস্তা বেরিয়েছে মাঝে মাঝে - গ্রামের অস্তিত্বের অভিজ্ঞান। সরল-সিধে রাস্তায় কখনো দু-মিনিট, কখনো পনেরো মিনিট বাদে এক-একটা গাড়ির দেখা পাবেন। কদাচিৎ দু-একজন মেয়ে বা পুরুষ গরিব মানুষের দেখা পাবেন মাথায় কাঠ-কুটোর বোঝা অথবা ছাগল চরাচ্ছে। লম্বা-বাঁকা শিং-ওয়ালা গরুর পাল কখনও আপনাদের পথ জুড়ে দাঁড়াবে; আবার, বাঁয়ে-ডাইনে সরে গিয়ে আপনাদের এগিয়ে চলার অনুমতি দেবে। কিছু দূরে দূরে লেখা দেখবেন এটিএম ২৫, ২০ বা ৫ কিলোমিটার দূরে। আর পাবেন থোরডো যেতে কতটা পথ বাকি সেটা জানিয়ে দেওয়ার কিলোমিটার ফলক। এমনই চলতে চলতে এক সময়ে দেখবেন বেশ কিছু বৃক্ষ, কয়েকটা বাড়ি - কোনোটা গোল, কোনোটা চৌকো। গোল ঘরগুলোর মাথাটা পাতায় ছাওয়া, শঙ্কু আকৃতির। চৌকো বা আয়তাকার ঘরগুলোর কোনো-কোনোটার মাথায় ঢালাই-ছাত, কোনোটা দোচালা, কোনোটা পিরামিড-ধরনের চার-চালা। এরই মধ্যে একটা হল একটা ব্যাঙ্ক - স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। তার লাগোয়া এটিএম। একটা দোকান - না চায়ের দোকান নয়, ভুজিয়ার দোকানও নয়। বিড়ি-সিগারেট, বিস্কুট-লজেন্স, সাবান আর মুদির সামগ্রী কিছু। এটাই বাসস্ট্যান্ড। ভুজ থেকে সারাদিনে একটা বাস আসে, আবার ফিরে যায়। গাড়ি থেকে নেমে আপনার সঙ্গীরা কেউ হয়তো এটিএম থেকে টাকা তুলবে, কেউ সিগারেট কিনবে। তারপর আবার এগিয়ে চলবেন।

কিলোমিটারখানেক চলার পর দেখবেন একটা পাঁচিল ঘেরা জায়গার মধ্যে কয়েকটা ডুঙ্গা যেমন দেখেছেন একটু আগে। সেটা ছাড়িয়ে একটু যেতেই রাস্তাটা মিশেছে আর একটা পাকা রাস্তার সঙ্গে - ইংরেজি T অক্ষরের মতো করে। সেখানে দাঁড়িয়ে সামনে বাঁ দিকে দেখবেন সারি সারি অনেক তাঁবু, পিছনে দেখা যাবে ফেলে আসা পাঁচিল-বন্দি ঘরগুলোকে। ওটাই কি সেই গ্রামীণ অতিথিশালা? না কি তাঁবুগুলো? কোন দিকে সফেদ রান? কাকে জিজ্ঞেস করবেন? লোক কোথায়? অন্য গাড়িও নেই একটাও। আপনাদের গাড়িটা যেহেতু ভুজের বদলে আমেদাবাদ থেকে নেওয়া তাই তার ড্রাইভার আপনাকে কোনো দিশা দেখাতে পারবেন না। কাজেই সমাধানের আশায় আপনারা তাঁবুগুলোর দিকেই এগোবেন। সেখানে দুই সারি তাঁবুর মাঝখানের পথের মতো জায়গাটায় তিনজন লোক দেখতে পাবেন - মাত্র তিনজনকে। রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে, তাই গাড়ি থেকে নেমে আপনারা এগিয়ে যাবেন তাদের দিকে। দু-জন ছুতোর মিস্তিরি - প্যান্ট আর গেঞ্জিপরা, তাঁবুগুলোর ভিতরের অঙ্গশয্যার কাজে রত। তৃতীয়জন কচ্ছের ভূমিপুত্র। দীর্ঘদেহী, মাঝবয়সী লোক। পরনে সেই কচ্ছের জাতীয় পোশাক – একটু উঁচু করে পরা মালকোঁচা-মারা ধুতি, সাদা লম্বা ফুল শার্ট, হেড অফিসের বড়বাবুর মত খোঁচা গোঁফ, মাথায় ভাঁজ-করা হনুমান-টুপি। গুজরাটের প্যাটেলদের সম্পর্কে একটা রটনা আছে, তারা নাকি এক সেট পোশাক পরতে শুরু করলে ছেঁড়ার আগে পর্যন্ত সেটা পালটায় না। কচ্ছের লোকদের ক্ষেত্রেও সেটা যদি সত্যি হয় তবে আপনি নিশ্চিত হবেন যে এই লোকটার পোশাক বদল করা হয়েছে মাত্র মাসখানেক আগে।

আপনি ওদের কাছে রানে যাওয়ার পথ আর তার সম্ভাব্য গম্যতা সম্পর্কে জানতে চাইবেন। মিস্তিরিদের একজন জানাবে রাস্তায় কাদা হয়ে আছে, আগের দিনই একটা গাড়ি আটকে গিয়েছিল। আপনি জানতে চাইবেন "হেঁটে যাওয়া যাবে না?" ওদের একজন হয়তো বলবে, "অনেকটা পথ।" আর একজন আশ্বাস দেবে, "কেন পারবেন না?" ওরা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে যে কথাবার্তা চালাবে তার থেকে বোঝা যাবে - সরপঞ্চের একটা উটে টানা গাড়ি আছে, ট্যুরিস্টদের রানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেটা ভাড়া দেওয়া হয়। সরপঞ্চের বাড়ি দু-কিলোমিটার দূরে। সাদা পোশাকের লোকটা জানাবে - সরপঞ্চ সম্ভবত ভুজে গিয়েছে নিজের কাজে, তার গাড়ি পাওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত ওরা চেকপোস্ট পর্যন্ত যাওয়ার পরামর্শ দেবে; সেখান থেকে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। এই প্রস্তাবে সাদা পোশাকের লোকটির উৎসাহ দেখে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন সে আপনাদের সঙ্গে যেতে রাজি আছে কিনা। লোকটি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানাবে। যেতে যেতে অবশ্য সে বলতে থাকবে - তার বাড়িতে অনেক কাজ আছে, সে থাকগে, বিদেশি বাবুদের সাহায্য করাটাও মহৎ কাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি তার নাম জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন সে-ই 'মনু সাঁইয়া'।
আপনাদের গাড়িটা মাথা ঘুরিয়ে, থোরডো থেকে যে রাস্তায় আপনারা এসেছিলেন সেটাকে ডাইনে ফেলে রেখে সোজা এগিয়ে চলবে। ধু-ধু মাঠের মধ্য দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনারা পৌঁছে যাবেন চেকপোস্টে। এখানেই পাকা রাস্তা শেষ। চেকপোস্ট মানে একটা ছোট ঘর - ইঁটের দেওয়াল, মাথায় পলিথিনের চাল - এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দু-জন বন্দুকধারী জওয়ান। তারা আপনাদের প্রত্যেকের পরিচয়পত্র দেখতে চাইবে, কোথা থেকে এসেছেন জানতে চাইবে। ব্যস, এইটুকু। মনু সাঁইয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য সেসব লাগবে না। স্থানীয় লোক বলে কথা।

পাকা রাস্তা এখানেই শেষ, কিন্তু রাস্তা এখানে শেষ নয়। দু-পাশের মাঠের থেকে এক-দেড় ফুট উঁচু করে চিহ্নিত মাটির রাস্তা এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত, একই সরল রেখায়। ইলেকট্রিকের খুঁটিগুলিও পথের আরও একটা নিশানা। বৃষ্টি-ভেজা আলগা মাটি গাড়ির চাকার চাপে কাদা হয়ে থাকবে। গাড়ি নিয়ে ওই পথে চলতে গিয়ে কেউ একজন কাদার বাঁধনে আটকা পড়েছিল গতকালই, সে কথা আপনার জানা হয়ে গেছে। তবে মাঠের মাটি চাপসহ। দেখেশুনে চললে সেখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে চলা যায়। কিন্তু, আপনাদের ড্রাইভার নিজেই গাড়ির মালিক, তাই অতি সাবধানী। তিনি কিছুতেই রাজি হবেন না। কাজেই হেঁটেই এগোতে হবে। মনু সাঁইয়া যখন সঙ্গে আছে, তখন আর ভয় কী?
পথের নির্দেশ তো পড়েই আছে। তাকে বাঁ দিকে রেখে ভেজা কিন্তু শক্ত মাটির ওপর দিয়ে পথ চলা। মনু সাঁইয়া ছাড়বে কেন? তার দায়িত্ব সে অবহেলা করতে রাজি নয়। মাঝে মাঝেই বলবে, 'ও-দিকে নয়, এ-দিক দিয়ে চলুন।' পূর্ব, পশ্চিম আর উত্তর দিকে হাত দেখিয়ে বার বার বলবে, 'ইয়ে পুরি রন হ্যায়।' আরও বলবে রাস্তার জন্য বরাদ্দ এক কোটি টাকা কীভাবে সামান্য ওইটুকু মাটি ফেলেই গায়েব হয়ে গেছে। মনু সাঁইয়াকে ছাড়াই আপনারা দিব্যি চলতে পারতেন। তবু মনু সাঁইয়া ভরসা। শুধু কি তাই? গাইড বিষয়টাই বেড়ানোর একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আপনি কোনো পুরোনো মন্দির, মসজিদ, প্রাসাদ, দূর্গ দেখতে যান নিজে নিজে বোর্ডের লেখা দেখে দেখে চলতে পারেন, আগে থেকে কারও লেখা পড়ে একটা ধারণা করে আসতে পারেন সে-সব হবে শিক্ষালাভ, আপনার দ্রষ্টব্যটি হবে পাঠ্যপুস্তকের পাতা। আর, গাইড নিন তিনি খাজুরাহোর ট্রেনিং নেওয়া গাইড হোক বা মুর্শিদাবাদের কাটারা মসজিদের সামনে বসে-থাকা চতুর্থশ্রেণি-পর্যন্ত-পড়া বৃদ্ধটিই হোক তারা আপনাকে অনেক কিছু দেখিয়ে দেবে যা আপনার অদক্ষ চোখে ধরা পড়ত না; তারা অনেক কিছু বলবে যা কল্পকাহিনি, অনৈতিহাসিক লোককথা, তবু এক সময়ে মনে হবে গাইড নয়, গল্প বলছে মূর্তিগুলি, প্রাসাদের দেওয়ালগুলি। নির্বাক চিত্রগুলি সবাক চলচ্চিত্র হয়ে উঠছে। গাইড যেন কবিতার গায়ে সুর। মনু সাঁইয়ার কথাগুলি সেই জনহীন প্রান্তরকে বাঙ্ময় করে তুলবে।

ধূসর নেড়া মাঠে ধূলিকণাহীন আকাশ ভেদ-করে-আসা শেষ-শীতের সকালের রোদ্দুরও কারও কারও কাছে চড়া মনে হবে। মাঝে মাঝে ঘাসের উচ্চতার গাছ, এদের কোনোটার নাম নুনিপানি - মৌরি-লজেন্সের আকৃতির ছোটো সবুজ ফল তার, সামান্য টক স্বাদ। দু-একটা চড়াই আর শালিখের মাপের পুরোটা ধূসর রঙের লেজ-লম্বা কোনও পাখি। চলতে চলতে এক সময়ে দেখবেন সামনে একটু বেশি কাদা; আর তার ওপারেই আপনার তিন-হাজার-কিলোমিটার-দূর-থেকে-বয়ে-আনা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবতা, কৈশোর-থেকে-বয়ে-বেড়ানো ম্যাপবইয়ের পাতায় বিন্দু-বিন্দু-দিয়ে-চিহ্নিত রহস্যের উন্মোচন কচ্ছের রান, গ্রেটার রান, হোয়াইট রান। মনু সাঁইয়ার নির্দেশে সেখান থেকে সাবধানে চলে বাঁ দিকের রাস্তাটায় উঠবেন, সেখানে কাদা কম। দু-এক মিনিট। কাদা শেষ, মাটি শেষ, রাস্তা শেষ, ইলেক্ট্রিকের খুঁটি শেষ - শুধুই লবণ, লবণের প্রান্তর, লবণের সাগর। আপনি পা দেবেন লবণে। শক্ত - বরফের মতো শক্ত। আপনি এগিয়ে চলবেন। আপনারা এগিয়ে চলবেন। দু-দিন আগের বৃষ্টির জল তখনও শুকোয়নি। কোথাও জুতোর সোল-ভেজানো জল, কোথাও শুকনো। জল বাঁচিয়ে বা না-বাঁচিয়ে আপনার এগোবেন। এগোতে থাকবেন। চারদিকে শুধুই সাদা লবণ। কাছে কোনও কোনও জায়গায় মানুষের পায়ের চাপে বা গাড়ির চাকার চাপে নিচের কাদা উঠে এসে হালকা কালো বা মেরুন ছোপ তৈরি করেছে। দূরে কেবলই ধবলতা। আপনারা কয়েকজন ছাড়া কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই কোথাও কোনও পাখি নয়, পোকা নয়, ঘাস নয়, মরু-গুল্ম নয়, শেওলা নয়। এক-এক জায়গার হলুদ আস্তরণটা হয়তো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। আপনারা পিছু ফিরবেন। দূরে চেক-পোস্টটা ঝুলনের খেলনার মতো চোখে পড়বে। কাছে কাদার অঞ্চলটা শ্বেত-সাগর আর ধূসর মাটির মধ্যে কালো বিভাজিকা হয়ে পড়ে আছে বলে মনে হবে। মাঠের ঘাস-সম চারা-গাছগুলিকে আলাদা করে চেনা যাবে না। আপনার গা ছমছম করবে। এই অনুভূতিটা আরও অনুভব করার জন্য আপনি লবণ-মরুর মধ্যে আরও এগোতে চাইবেন। আপনারা সঙ্গীরা বাধা দেবে। মনু সাঁইয়াও বারণ করবে। 'ইয়ে পুরি রন হ্যায়' হাতটাকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে সে বলবে। 'ইধার পাকিস্তান হ্যায়, উধার রাজস্থান।' সাদা প্রকৃতির মধ্যে সাদা পোশাকের মনু সাঁইয়া - হাতে সাদা লবণ। সফেদ রানের ভূমিপুত্র মনু সাঁইয়া।

সবার কথা অমান্য করে আপনি এগিয়ে যেতে উদ্যত হবেন। দু-পা এগোবেন। তখনই সাদা লবণ থেকে ঠিকরে আসা আলোর ঝলকানিতে আপনার চোখে ধাঁধা লাগবে। আপনার মনে পড়ে যাবে এক সাহেবের লেখা একটা কাহিনি, যিনি একা জিপ চালিয়ে রানের ভিতরে কুড়ি-পঁচিশ মাইল চলে গিয়েছিলেন। তিনি জিপ থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করছিলেন সেই প্রাণহীন, বর্ণহীন, শব্দহীন, সীমাহীন তেপান্তরকে। এক সময়ে ফেরার ইচ্ছে নিয়ে পিছন ফিরতেই তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল দুপুরের চড়া সূর্যালোকে উত্তপ্ত শুষ্ক বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়েও। গাড়িটা থেকে দুশো মিটার দূরে দাঁড়িয়ে তিনি গাড়িটা দেখতে পাচ্ছিলেন না। সূর্যের আলোয় লবণ-তল এত চকচক করছিল যে তিনি তাঁর নিজের পদচিহ্নগুলিও দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল - 'হারিয়ে গেছি আমি।' নিজের বোকামির জন্য নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছিলেন। মনে পড়ে গিয়েছিল আর একজন অভিযাত্রীর কথা - উত্তর মেরু-অভিযানের সময়ে যিনি হঠাৎ-ওঠা তুষারঝড়ের কবলে পড়ে যেখানে প্রাণ হারিয়েছিলেন, সেই জায়গাটা ছিল তাঁর তাঁবু থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে। রানের সাহেব অবশ্য ফিরতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা মনে করে আপনি আরও এগোনোর ইচ্ছা ত্যাগ করবেন।

* * *

এবার ফেরার পালা। মনু সাঁইয়া একটা প্লাস্টিকের থলিতে অনেকটা লবণ ভরে নেবে, আপনারাও নেবেন। মনু সাঁইয়াকে জিজ্ঞেস করবেন তার গ্রাম কোথায়। সে বলবে কাছেই; ভিলেজ রিসর্টটা থেকে এক ক্রোশ এগিয়ে। সে বলবে এর আগে অনেক সাহেবের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। তাদের একজন ছিল রাজস্থানি সাহেব। তাকে সে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। দুধ খাইয়েছে, ছাঁচ খাইয়েছে। খুব বড় সাহেব সে। মনু সাঁইয়াকে ফোন নম্বর দিয়ে গেছে। সে তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে, সাহেবের নম্বর খুঁজে বের করে আপনাকে বলবে তাঁকে ফোন করতে। আপনি প্রায় বাধ্য হবেন হালকা চালে তাকে জিজ্ঞেস করতে, সে আপনাদেরও বাড়ি নিয়ে যেতে রাজি কি না। সে বলবে 'কিঁউ নেহি?' সে আবারও সেই রাজস্থানি সাহেবের কথা বলবে। বলবে সে তাকে কত যত্ন করেছিল, সাহেব কতটা খুশি হয়েছিল। বহুবার বলবে।

এক সময়ে আপনাদের নজরে পড়বে কাদার ওপারে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে, তার একটা আপনাদের। বুঝতে পারবেন অন্য গাড়িটাকে আসতে দেখে আপনাদের গড়ির চালক সাহস পেয়ে তাকে অনুসরণ করেছে। গাড়িতে ওঠার আগে মনু সাঁইয়া একটা নম্বর দিয়ে সেখানে আপনাকে ফোন করতে বলবে, কারণ তার নিজের ফোনে প্রয়োজনীয় ব্যালেন্স থাকবে না। এটা তার ছেলের নম্বর। সে ছেলেকে জানিয়ে দেবে যে আপনারা তার বাড়িতে যাচ্ছেন, যেন খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখে। চেকপোস্টে পৌঁছে আপনারা দাঁড়াবেন। দু-জন রক্ষীর একজন হয়তো অসমিয়া। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙ্গালী-অসমিয়া তো দেশোয়ালি ভাইয়া। সে আপনাদের সঙ্গে অনেক গল্প করবে। তার সঙ্গী চা বানিয়ে খাওয়াবে। তখনই নজরে পড়বে, দূরে কাঁচা রাস্তাটার ওপর আপনাদের দেখা অন্য গাড়িটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ। চাকা কাদায় বসে গিয়ে গিয়েছে। আপনাদের ড্রাইভার, রক্ষীদের একজন আর আপনাদের মধ্য থেকে দু-একজন ছুটবে গাড়িটাকে উদ্ধার করতে, সঙ্গে অবশ্যই মনু সাঁইয়া। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়িটাকে বিপদ-মুক্ত করে সবাই ফিরে আসবে। গাড়িটা চেকপোস্টের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। তাদের আরোহীরা - দুই জোড়া ধনী গুজরাটি দম্পতি - আপনাদের কিংবা রক্ষীদের কাউকে ধন্যবাদ না জানিয়েই চলে যাবে। হয়তো ভাববে এই লোকগুলোর পক্ষে এটা করাই দস্তুর, ধন্যবাদ দেওয়াটা বাতুলতা। টাকা বাড়তি হলে হয়তো সৌজন্যে ঘাটতি পড়ে। ফেরার পথে থোরডোর অতিথিশালাটায় একবার ঢুঁ মারবেন। চত্বরটার গেটের সামনে একটা উটে টানা সুসজ্জিত গাড়ি দেখতে পাবেন। রথ বলা যেতে পারে। মনু সাঁইয়ার কাছে জানতে চাইবেন সেটাই সরপঞ্চের গাড়ি কিনা। অতিথিশালার লোকেরা জানিয়ে দেবে, তা নয়, এটা ট্যুরিস্টদের প্রমোদ-ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়। অতিথিশালার বাইরের চেহারাটা গ্রাম্য তাই নাম 'ভিলেজ রিসর্ট'। ভিতরটা বিলাসবহুল। এটা পুরোপুরি ব্যবসায়িক, গ্রাম-কমিটির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

থোরডোর স্টেট ব্যাঙ্কে পৌঁছাবার আগেই মনু সাঁইয়ার নির্দেশে ডান দিকে নেমে যাবে গাড়িটা। কয়েক মিনিট পরেই দেখবেন কিছু বড় বড় গাছ, আর তার ফাঁকে দু-একটা বাড়ি। তারই একটা মনু সাঁইয়ার। গাড়ির আওয়াজ পেয়েই দশ-বারোটা বাচ্চা কেউ সস্তার জামা পরে, কেউ খালি গায়ে - জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে আপনাদের দিকে তাকিয়ে। আপনারা ওদের দেখতে এসেছেন - ওরা দেখবে আপনাদেরকে। একজন দীর্ঘাঙ্গী স্বাস্থ্যবতী প্রৌঢ়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। পরনে ঘাগরা আর ব্লাউজের ওপর সূচিশিল্পময় একটা চোলি (অ্যাপ্রনের মতো), বাহুদুটো রঙিন চুড়িতে ঢাকা। মনু সাঁইয়া আলাপ করিয়ে দেবে তার স্ত্রী। পাশে তার বড় ছেলে। তার ধোপদুরস্ত সাদা জামা, ধুতির জায়গায় পাজামা, মাথায় রিবকের ছাপ লাগানো টুপি - নতুন প্রজন্মের পোশাক। রাস্তার দিকে পিছন ফেরানো টালির দো-চালা ইঁটের দেওয়ালের যে ঘরটা, তাকে বাঙালি মতে বৈঠকখানা বা দলিচ বলা চলে। বারান্দা আর ঘরের দেওয়ালে চুন এবং বিভিন্ন রঙ দিয়ে নকশা করা। সামনে একটা মোটরবাইক দাঁড় করানো। আপনাদের বসানো হবে দলিচের ঘরে এবং বারান্দায়। দলিচের সামনে দশ-বারো মিটার দূরে একটা মাটির ঘর; সেটারও সামনে একটা বারান্দা, উঠোন থেকে অনেকটা উঁচু। ঘরটার মুখ বৈঠকখানার দিকে নয় পাশ ফেরানো হয়তো আবরুর জন্য। কয়েক মিটার দূরে দূরে এমনই কয়েকটা ঘর। একেকটা এক এক ছেলের। মনু সাঁইয়া জানাবে এই হল তার যৌথ পরিবার। বাচ্চাগুলো এসে জমা হবে বৈঠকখানায়। তারা সবাই স্কুলে পড়ে, হিন্দি বোঝে, বলতে পারে। তারা আপনাদের সঙ্গে আলাপ জমাবে। আপনার বুকে ঝোলানো ক্যামেরাটা দেখে বলবে, 'ফটো মারো।' আপনি ফোটো তুলবেন। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা করে। যখনই ভাববেন একক ছবি তোলার পালা শেষ, তখনই নতুন একটা ছেলে বা মেয়ে এসে বলবে, 'ফটো মারো।' ডিজিটাল ক্যামেরার পর্দায় ছবি দেখেই তাদের আনন্দ ছাপানো ছবি পাক বা না পাক।

আপনাদের ভ্রমণ-দলের একমাত্র-নারীসদস্য আপনার স্ত্রীকে ডেকে নেওয়া হবে অন্দরমহলে। কিছুক্ষণ পরে আপনার ডাক পড়বে ছবি তোলার জন্য। ঘরে ঢুকে দেখবেন একটা সাদা ধবধবে কয়েক দিনের বাচ্চা আপনার স্ত্রীর কোলে। গাত্র-বর্ণ উজ্জ্বল গৌর হওয়া সত্ত্বেও আপনার স্ত্রীর নাম কৃষ্ণা। এখন ওই বাচ্চা-কোলে তাকে দেখে সেই নামকরণের সার্থকতা সম্পর্কে আপনার সমস্ত সন্দেহ দূরীভূত হবে। পরে যখন জানতে পারবেন যে বাচ্চাটার সারা অঙ্গে পাউডার মাখানো ছিল, তখন অবশ্য আপনার স্ত্রীর নামকারকের দক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ পুনর্জাগরিত হবে। আপনি সেই ছবি তুলবেন। বাচ্চার মায়ের বয়স সতেরো-আঠেরো বাচ্চা-কোলে তার ছবিও তুলবেন। বাচ্চাটাকে একটা দোলনা-বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর মনু সাঁইয়ার স্ত্রী আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন আপনারা তাদের হাতের কাজের জিনিস-পত্র দেখতে চান কি না। আপনার মনে একটা সন্দেহের আভাস জাগবে। তবু সম্মতি জানাবেন। শুরু হবে আপনার স্ত্রীকে সাজানো। ঘাগরা, চোলি, গলায় রুপোর কাডলা (হাঁসুলি), পুঁতির হাসডি (চিক) আলমারি, বাক্স, ট্রাঙ্ক খুঁজে খুঁজে এক-একটা বের করে এক-এক জন পরিয়ে দেবে। ছোট্ট ঘরটা ভর্তি সক্রিয় নারীবাহিনীর মধ্যে একমাত্র পুরুষ আপনি, নীরব দর্শক। আপনার কিছুটা অস্বস্তি হবে। এক পুত্রবধূ নিজের খোঁপা থেকে একটা ত্রিভুজাকৃতি পুঁতির অলঙ্কার (আম্বাডা) খুলে পরিয়ে দেবে তার মাথার। একজন একটা ওড়না দিয়ে ওর মুখটা একদম ঢেকে দেবে বিয়ের কনের মতো। আপনাকে বলা হবে, 'ফটো মারো।' আপনি ফটো তুলবেন। আপনার স্ত্রীকে বলা হবে আয়নায় নিজেকে দেখতে। সাজটা কেমন সেটাও জিজ্ঞেস করা হবে। সেই সজ্জার নতুনত্ব এবং পুঁতি ও সূচিকর্মের সূক্ষ্মতা, বৈচিত্র ও বিশালতা আপনাকে অভিভূত করবে। গৃহকর্ত্রী সেটাই চাইছিলেন। তিনি আপনার নিবিষ্ট চোখদুটোকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বলবেন, 'কিনবে?' আশঙ্কা-মিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, 'কত?' উত্তর মিলবে, 'পাঁচ হাজার।' আপনারা দু-জনেই চমকে উঠবেন। আমতা-আমতা করে বলবেন, 'বেড়াতে বেরিয়েছি, অত টাকা নিয়ে তো আসিনি।' আপনি বুঝবেন আপনাকে সেখানে ডাকা হয়েছে শুধুমাত্র চিত্রগ্রাহক হিসেবে নয়, তহবিলের ধারক হিসেবেও। ওদের এবং আপনাদের, উভয়ের হিন্দি-জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে পারস্পরিক বোঝাপড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আপনার ভীষণ ভয় করবে। পকেট থেকে অনেক টাকা না খসিয়ে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব বলে মনে হবে। কেড়েকুড়ে নেবে কিনা সে-সন্দেহও হবে। তখনই দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারবেন বড় ছেলে। তিনি ওদেরকে বুঝিয়ে বলাতে ওরা একটা একটা করে দাম বলতে থাকবে। চোলিটা দু-হাজার, ঘাগরা এক হাজার, ইত্যাদি। শ্রমের মূল্য হিসেব করলে বিশেষ অবৈধ দাম বলছে বলে আপনার মনে হবে না। কিন্তু, কী হবে তা দিয়ে? কে ব্যবহার করবে? আপনার দেশে তো সেগুলি বেমানান। বেড়াতে এসে এত টাকা খরচ করবেনই বা কেন? শেষ পর্যন্ত একশো টাকায় গলার হাসডি বা চিকটা নেওয়ার পর ছাড়া পাবেন। বাইরের ঘরটায় ফিরে আসবেন দু-জনে। এবার আসতে শুরু করবে গ্রামের অন্য বাড়িগুলির কিশোরীরা। গলার চিক, বাজুবন্ধ যে যা পারে তাই নিয়ে। একজন নিয়ে আসবে মাথায়-পরার পুঁতিতে গাঁথা একটা চওড়া গোল বেড়ি, যার এক পাশ থেকে এক-দেড় ইঞ্চি চওড়া চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা পুঁতি আর সুতোয় গাঁথা একটা লেজ ঝুলবে (অলঙ্কারটার নাম ইন্ধনি)। কেউ হয়তো নিজের খোঁপার সাজটা (আম্বাডা) খুলে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিয়ে আসবে। পঞ্চাশ-একশো যা পাওয়া যায়। চাপমুক্ত পরিবেশেও উপরোধ এড়ানো কঠিন হবে। আপনার যাত্রাসঙ্গীদের কেউ এবং আপনার স্ত্রী আরও কিছু কিনবেন।
তবে কি এই জন্যই মনু সাঁইয়ার আমন্ত্রণ ছিল? আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে। আপনার মনে পড়বে বাতাপী-ইল্বলের গল্প। তবে বাতাপীরা আগে খাইয়ে পরে বধ করত; এরা আগে বধ করে পরে খাওয়াবে। সেই খাবারের যেমন স্বাদ, তেমন বৈচিত্র্য আর তেমনই প্রাচুর্য পরিবেশনেও তেমনই আন্তরিকতা। ঘি-মাখানো রুটি, পরোটা, তিন রকম সবজি, শেষে চাটনি, দুধ, কিছু মিষ্টি। আর গুজরাট যখন - ছাঁচ তো থাকবেই।
খাওয়া-দাওয়ার পর কিছু গল্প হবে। জানতে পারবেন, মনু সাঁইয়ার ছেলেমেয়েদের সবারই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। চাষযোগ্য জমি আছে সামান্যই। এক ছেলে ভুজে থাকে। বাকিরা কখনও কন্ট্রাকটারের অধীনে রাস্তার কাজ করে, কখনও নিজের জমিতে খেতিবাড়ি করে, কখনও অন্যের জমিতে মজুর খাটে। গল্প চলতে চলতে আপনি মনু সাঁইয়ার হাতে এক হাজার টাকা দেবেন। সে না-না করেও টাকাটা নেবে, খুশি হয়েই। বিদায়ের আগে সব নাতি-নাতনিদের নিয়ে কর্তা-গিন্নি হাজির হবে, সঙ্গে সবকটি পুত্রবধূ, আর বড় ছেলে। আপনারা গাড়িতে উঠবেন। আপনাদের গাড়িটা বাঁক ঘুরে তাদের চোখের আড়াল না-হওয়া পর্যন্ত তারা হাত নাড়বে।
পথে পড়ে আপনারা মনু সাঁইয়ার চালাকি নিয়ে আলোচনা করবেন। হিসেব করবেন টাকাটা বেশি দেওয়া হয়ে গেল কি না। তারপর, নক্ষত্রানা পর্যন্ত ছ-ঘন্টার যাত্রাপথে যখন খানা তো দূরের কথা, কোনও চায়ের দোকানও চোখে পড়বে না, তখন মনে হবে–

ভাগ্যে মনু সাঁইয়া ছিল,
কী দুর্দশাই হত তা না হলে।

* * *

কৃতজ্ঞতা:
১) Tourism Corporation of Gujarat Limited
২) Shaam-E-Sharhad Village Resort
৩) India– The Rann of Kutch, The haunted and mysterious wasteland between India and Pakistan, by David Yeadon
৪) ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে কচ্ছ-ভ্রমণে লেখকের সঙ্গী - রাধাদা, অংশুদা, মৃণালজ্যোতি এবং শ্যামলী।


~ কচ্ছের রানের আরও ছবি ~


এজি বেঙ্গল থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেরানি সোমনাথ ভট্টাচার্যের অনিয়মিত অভ্যেস গল্প, কবিতা লেখা - কচ্চিৎ-কদাচিৎ বেড়ানোর গল্পও। বেড়ানোর নেশা বলতে তেমন কিছু নেই। তবে চাকরি করাকালীন এলটিসির দৌলতে তো হতই, তার পরেও আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গ পাওয়ার সু-যোগে বেড়ানো হয়ে যায় প্রায়ই। এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও যেতে তো ভালো বাসেনই, আবার ঘর থেকে দুই পা ফেলে নারকেল গাছের মাথায় সূর্যাস্ত দেখেও আনন্দ পান।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher