under
স্মোকি পাহাড়ের অরণ্যে
কালিপদ মজুমদার
~ গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনের আরও ছবি ~
"গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনস" – সুন্দরের সেই দেশ রয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম কোণে।
এপ্রিল মাসের এক ভোরে দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্যের সমুদ্র শহর চার্লস্টন থেকে রওনা দিয়ে আই-২৬ এবং আই-৪১ রাজপথ ও শেষে ইউ.এস.-১৯ পথ বেয়ে স্মোকি মাউন্টেনের প্রবেশদ্বার চেরোকী শহরে যখন এসে পৌঁছালাম তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর। শহরের এক কোণে হোটেল "চেস্টনাট ট্রি"- তে জিনিসপত্র রেখে চারদিক কিছুটা ঘুরে দেখব বলে বেরিয়ে পড়লাম।
চেরোকী থেকে কিছু দূরে উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্যের শেষ সীমানায় আছে "ক্লিংম্যান্স ডোম" অঞ্চল। সেই পথ ধরে শহরের সীমা পার হতেই ধীরে ধীরে চড়াই শুরু হল। পাহাড়ের বুক চিরে দুই পাশের ঘন বনতল ধরে পথ চলেছে এগিয়ে। চলতে চলতে ডান হাতে দেখা দিল পাহাড়ি নদী - পিজিয়ান রিভার। দুরন্ত গতিতে নেমে আসছে সে কোন দূর পাহাড়ের অজানা শিখর থেকে। শত উপল খণ্ডে বাধা পেয়ে পেয়ে কী আনন্দ তার! ফেনার পাপড়ি তুলে নিশিদিন নেচে নেচে চলেছে গান গেয়ে গেয়ে।
কখনও ওপরে, কখনো নীচে, পাকে পাকে সুন্দরের ছবি আঁকা পথ বেয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে মন ভোলানো ঘন সবুজ তৃণভূমি দেখা দিয়ে আবার আড়ালে হারিয়ে যায়। সেখানে দু-এক জায়গায় দেখা হল হরিণ আর নীল গাই পরিবারের সঙ্গে। নির্ভয়ে চড়ে বেড়াচ্ছে তারা। গাছের চাঁদোয়ার ফাঁকে ফাঁকে আকাশের নীলিমা। শীতল বাতাস আর গভীর নির্জনতার বুকে পাখিরা নির্ভয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিকে ওদিকে। কোথাও বনফুলের শোভা আলো করে আছে বনভূমি। পথের কিনারে দু-এক জায়গায় দেখলাম ছোটো বরফের স্তুপ, এখনও শীত ঘুম ভাঙেনি ওদের।
দেখতে দেখতে এক সময় উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্যের সীমা পার হয়ে প্রবেশ করলাম টেনেসী রাজ্যের সীমানার মধ্যে। বড় রাস্তা ছেড়ে আর একটা পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে অনেকটা ওপরে উঠে এলাম "ক্লিংম্যান্স ডোম"-টাওয়ারে। সমুদ্রতল থেকে এই টাওয়ারের উচ্চতা – ৬,৬৪৩ ফুট, এটাই টেনেসী রাজ্যের উচ্চতম স্থান।
উঁচু টাওয়ারের মাথায় উঠে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম। যত দূরে চোখ যায়, ধরণীর মুক্ত অঙ্গন - মাঝে দিগন্ত জুড়ে অনন্ত অচল পর্বতমালার সারি। সেখানে নেই কোনও জনমানবের চিহ্ন, নেই কোনও ঘরবাড়ি। মনোহর সেই অচল রেখার ওপারে, আরও অনেক দূরে দেখা যায় আবছা নীল পাহাড়ের সারি ভুবন জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ সীমা ঘিরে। ক্ষীণ একটা নীলাভ কুহেলিকার আবরণ ছেয়ে আছে তাদের শিখরে শিখরে, কন্দরে কন্দরে। কি জানি এই জন্যই এই "স্মোকি" নাম কিনা! চরাচর জুড়ে অনন্ত প্রশান্তি আর এক স্বর্গীয় পরশ যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে সব। অবসন্ন আলোয় নীল পাহাড়ের দেশের সেই অনিন্দ্য সুন্দর রূপ দেখে মন আচ্ছন্ন হল এক গভীর আবেশে।
সামনে উত্তর-পশ্চিম কোণে, অনেক দূরে টেনেসী রাজ্যের আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে আবছা অ্যাপেলেসিয়ান পর্বতমালা। তারা যেন অন্য এক ধরণী থেকে আমাদের দিকে চেয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে। সেই দেশ বুঝি আমাদের এই ভুবনপারের অন্য কোনও এক ভুবন। তার এই পাড়ে, দক্ষিণে, অনেকটা নীচে দাঁড়িয়ে সুদূর প্রসারিত নান্তাহালা অরণ্যমালা। দূরের সেই অরণ্যের উপর সূর্যের তির্যক আলো আর পাহাড়ের নীলিমা মিলে আকাশ তলে রচনা করেছে এক অনুপম সুন্দর দৃশ্য। মনে হল সে বুঝি কোনও রূপকথার দেশ!
সামনে, অনেকটা নীচে আবছা দেখা যাচ্ছে সুদীর্ঘ ফন্টানা লেকের জলরাশির কিছুটা অংশ। সেখান থেকে আলোর বিচ্ছুরণ চোখে এসে পড়ছে। হু হু করে হিমেল বাতাস ছুটে আসছে চারদিক থেকে। মুহূর্তে শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মন এখান থেকে যেতে চায় না, তবুও এক সময় নীচে নেমে আসতে হল।
পথে অরণ্য আর পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আবার ফিরে এলাম চেরোকী শহরে। সুর্য তখন পশ্চিমের পাহাড়ের মাথার ওপরে। এখানে সন্ধ্যা হয় কিছুটা দেরীতে। উঁচু পাহাড়ের তলায় খুবই ছোটো শহর এই চেরোকী, তবে বেশ সাজানো গোছানো আর পরিচ্ছন্ন। শহরের একেবারে পশ্চিম সীমানা দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী "অকুনালুফতী"। অকুনালুফতীর জল বড় চঞ্চল আর ভারি শীতল। কাচ রঙ সেই স্বচ্ছ জলে কত মাছের ঝাঁক খেলে বেড়ায় মনের আনন্দে। বুনো হাঁসের দল কোথাও নির্ভয়ে জলে ভাসছে, আবার কোথাও মনের সুখে রোদ পোহাচ্ছে নদীর কিনারে, বালুর চরে। নিশিদিন অকুনালুফতীর স্বচ্ছ জলের স্রোতে কেঁপে কেঁপে চলে পাহাড় আর অরণ্যের নিবিড় ছায়া। নীল আকাশের সুনীল ছায়া নীরবে হাতছানি দেয় সেই জলতলে।
বহু দূর থেকে আসা পথ শহরের বুক চিরে চলেছে স্মোকি পর্বতমালার গভীর দেশ পার হয়ে আরও দূরে। সেই সড়ক আর নদীর কিনারে কত সুন্দর সুন্দর দোকানপাট, হোটেল, রেস্তোঁরা আর ঘরবাড়ি। সব যেন বিরাট পাহাড়ের গায়ে পটে আঁকা ছবি।
শহরের মাঝখানে, হসপিটাল রোডের পুব কিনারে আছে চেরোকী ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। এখানকার আদি বাসিন্দা চেরোকী রেড ইন্ডিয়ান জাতির ব্যবহার্য নানা প্রাচীন জিনিস - বিচিত্র রঙের মুখোশ, মালা, চুড়ি, পালকের টুপি, গয়না, পোশাক, বাসনপত্র আরও কত কী সুন্দরভাবে সাজানো আছে সেখানে। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে পথে আসতেই সহসা সামনে দেখি এক চেরোকী ইন্ডিয়ান রমণী তাদের পুরনোদিনের সাজপোশাক পরে দাঁড়িয়ে। গলায় নানা রঙের পুঁতি আর পাথরের মালা। মাথায় পালক গোঁজা বিচিত্র টুপি, দুই গালে উল্কি, মুখে তার মৃদু হাসি! আচমকা সামনে এমন প্রাচীন দিনের মূর্ত জীবন ছবি দেখে আমরা বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখতে দেখতে পথ চলতি আরও কিছু মানুষজন দাঁড়িয়ে পড়ল তাকে দেখার জন্য। ফটো তোলার হিড়িক পড়ে গেল। একটু ভীড় হতেই সেই রমণী সহসা কোথায় যেন গেল হারিয়ে।
চেরোকী ইন্ডিয়ানরা এদেশের প্রাচীন উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম। অতীত দিনে বহু ঝড়ঝাপটা এবং দুঃখকষ্ট সহ্য করে উত্তর ক্যারোলিনার এই অঞ্চলের চেরোকীরা আরও অন্য চেরোকীদের সঙ্গে মিলে দেশান্তরী হওয়ার দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করেছে এবং "ইস্টার্ন ব্যান্ড অফ চেরোকী ইন্ডিয়ান্স"-এর স্থাপনা করেছে। আজ তারা বেশ প্রতিষ্ঠিত।
সেখান থেকে ড্রামা রোড ধরে, নদী পার হয়ে, শহরের পশ্চিম কিনারে চলে এলাম অকুনালুফতি রোড ধরে। এই অঞ্চলটা বেশ নির্জন। পথ চলেছে পাহাড়ের তলা দিয়ে নদীর একেবারে পশ্চিম কিনারা ঘেঁসে। নদীর কিনারে ছোট একটা সুন্দর পার্কে এসে বসলাম। নাম তার "অকুনালুফতি আইল্যান্ডস পার্ক"। নদীর মরা বাঁকে কী সুন্দর একটা মুলি বাঁশের ঝাড়। ছোট ছোট গাছ আর সবুজ ঘাসে সাজানো পার্কে বাচ্চারা খেলা করছে আনন্দে। তাদের কলরবে পার্কটা মুখর হয়ে উঠেছে। লোভ সামলাতে না পেরে নদীর জলে নামলাম এসে। মিষ্টি জলে পা ডুবিয়ে শরীর শীতল হল, আর সে জল চোখে মুখে দিয়ে মুহূর্তে সব ক্লান্তি দূর হল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একসময় পাহাড়ের ওপারে সূর্য পাটে গেল। সাঁঝের আবছা আঁধারে ফিরে এলাম হোটেলের আস্তানায়।
পরদিন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ি পথে। লক্ষ্য এখান থেকে একষট্টি মাইল দূরের "কেডিস কোভ" নামক উপত্যকা। সকালের ঘন বনতলে ঠান্ডার একটা মিষ্টি আবেশ। পাখিরা তাদের প্রভাত বন্দনায় বনতল মুখর করে তুলেছে। পথের কিনারে, ডান দিকে আবার দেখা দিল সুন্দরী "পিজিয়ন রিভার"। তারই সঙ্গে কখনও দেখা দিচ্ছে দুরন্ত সব নালা আর তাদের কত শাখা-প্রশাখা। মাঝে মাঝে খাড়া পাহাড়ের বুকের তলা দিয়ে যেতে যেতে ভয়ে শিহরণ লাগছে মনে, যেখানে বিকট পাথর খণ্ড ঝুলছে মাথার ওপর। চলার পথে এক জায়গায় দেখলাম নীলগাইরা চরে বেড়াচ্ছে সবুজ তৃণভূমির বুকে। হরিণের দলের সঙ্গেও দেখা হল দু-এক জায়গায়। এমনি করে নিরন্তর চড়াই আর উতরাই পেরিয়ে চলেছি গম্ভীর পাহাড় আর তার চোখ ভোলানো সুন্দরের বুক চিরে।
এক সময় পথ ঢালু হয়ে নেমে এল সমতলে। পথের কিনারে দেখা দিল ঘন সবুজ তৃণভূমি। আসার পথে এক জায়গায়, খেতের ধারে দেখলাম কয়েকটা টার্কি চরে বেড়াচ্ছে। চলতে চলতে সহসা চারদিক ফাঁকা একটা বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝে এসে পড়লাম। সেখানে মেঠো পথ ধরে সামনের পাহাড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো দিনের একটা বাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়িটা এই স্মোকি অঞ্চলের ব্রিটিশদের প্রথম বসতির চিহ্ন, যা আজও সেই প্রাচীন দিনের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। পথ থেকে ভূমি ক্রমে ওপরে উঠছে পাহাড়ের দিকে। বাড়িটা পাহাড়ের নীচে একলা দাঁড়িয়ে। পাথরের দেওয়াল আর শ্লেট পাথরের চালার পুরোনো সে বাড়ি। মোটা হাতে চাঁচাছোলা করা বড় বড় গাছের গুঁড়ি চিরে দুভাগ করে তাই দিয়ে গড়ে তোলা ঘর। সামনে একচালার খোলা বারান্দা। ভিতরে এক কোণে পাথর ঘেরা আগুন জ্বালাবার ফায়ার প্লেস। তার গা দিয়ে ওপরে যাওয়ার সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি। মাথা নীচু করে উঠতে হয় সেই সিঁড়ি দিয়ে।
এখান থেকে সামনে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত বিস্তীর্ণ প্রান্তর ক্রমে ঢালু হয়ে নেমে চলেছে ধীরে ধীরে। তার ওপারে, দিগবলয় ঘিরে ঘন অরণ্য রেখা। এককালে এসব ছিল ভরা শস্য খেত। এখন দেশের সরকার সেসব অধিগ্রহণ করে মিলিয়ে দিয়েছে অরণ্য ভূমিতে। আরও কিছু ভ্রমণার্থীও এসেছে এই বাড়ি দেখতে। শিশুদের কলরবে সেই বাড়ি আর পাহাড় নির্জনতা ভেঙে জেগে উঠল।
ফেরার পথে দেখা হল মিস্টার ম্যাকের সঙ্গে। কাঁধে তার ছোট্ট ছেলেটি বাবার মাথার চুল মুঠো করে ধরে বসে আছে পা দুটি ঝুলিয়ে। আর, বড়োটি বাবার হাত ধরে চলেছে হেঁটে। সুদূর এই দেশেও আমাদের সেই চিরন্তন প্রাচীন গ্রাম্য জীবনধারার এমন চিত্র দেখতে পাব ভাবিনি! বড় ছেলেটির বয়স বছর পাঁচেক হবে, ছোটোর বোধহয় বছর দুই। জানলাম শিশুদুটির মা নেই। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাতৃহারা দুই শিশুকে নিয়েই দিন কাটে বাবার। আলাপ হল। কথায় কথায় ম্যাক জানালেন মাঝে মাঝেই শিশুদুটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি পথে। দেশ দেখার আনন্দ দিয়ে বুকের গভীরে সাথী হারানোর বেদনায় শান্তির প্রলেপ দিতে এমনি করে বার বার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া তাঁর। তাদের বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম দুদন্ডের সেই বিষাদ স্মৃতি নিয়ে।
দূর প্রান্তরের সীমানা ঘুরে পথ চলেছে এগিয়ে। চলতে চলতে অরণ্য কিনারে আবার দেখতে পেলাম ব্রিটিশদের সেই পুরোনো দিনের কিছু ঘরবাড়ি। ঘন বনের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট নালা আর টিলা-পাহাড়ের বুক চিরে চড়াই উতরাই পার হয়ে চলেছি এগিয়ে। পথে মাইল সাতেকের একটা পাক মত ঘুরে এক সময় চলে এলাম "কেডিস কোভ"-এ। এটা স্মোকি মাউন্টেন অঞ্চলের সর্বনিম্ন স্থান। সেখানে হেঁটে হেঁটে বনতলে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। সুন্দর লম্বা লম্বা পাইন গাছের তলা দিয়ে হাঁটার সময় তাদের মিষ্টি দেহ সুবাস যেন অনুভব করছিলাম চারদিকে। ভিজিটরস সেন্টারে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার চললাম এগিয়ে। এবার ফেরার পালা।
চলতে চলতে চোখ উদগ্রীব হয়ে আছে ভালুক দেখার জন্য। আসার সময়ও উদগ্রীব চোখে চারদিক খুঁজেছি তাদের আশায়। কালো ভালুকদের বাসভূমির জন্য বিখ্যাত এই অরণ্য-পাহাড় অঞ্চল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঘন সবুজ তৃণভূমি। ভালুকেরা নাকি কখনও কখনও সেখানে দেখা দেয়। কিন্তু শত আগ্রহ নিয়েও তাদের দেখা পেলাম না। তাই খানিকটা অপূর্ণ মন নিয়েই ফিরে চললাম।
অনেক ওপরের পাহাড় থেকে নির্জন অরণ্যের বুক চিরে নেমে চলেছি। তন্ময় হয়েছিলাম চারদিকের সৌন্দর্যের মাঝে, তাই কতটা পথ পার হয়েছি খেয়াল নেই। সহসা পথের বাঁকে দেখি দু-চার জন কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে কী যেন দেখছে। কেউ কেউ আবার ফটো তোলায় ব্যস্ত। মূহূর্তে নেমে পড়লাম আমরাও।
পথের কিনারে, নীচে, নালার ধারে একটা মাঝারি আকারের কালো ভালুক আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একা। কখনও সে নামছে নালায়, আবার কখনও উঠছে ওপরে। এ যেন কর্মহীন উদাসী বেলায় সময় কাটানোর খেলা। দেখতে দেখতে আরও মানুষজন জড়ো হল। তবে আশ্চর্য, কারও মুখে একটিও কথা নেই, নেই টুঁ শব্দটি। বাচ্চা বুড়ো সবাই নিঃশব্দ। আর, ভালুক ভায়ারও যেন নেই কোনো অসন্তোষের ভাব। আনমনে ঘুরে বেড়িয়েই চলেছে সে। ফটো তোলার ধুম পড়ে গেল।
প্রাণ ভরে দেখলাম সেই বন্য সুন্দরকে। আবার পথ চলা। পথের বাঁকে আবার যদি কোনও চমক অপেক্ষা করে থাকে তাই সজাগ চোখে চেয়ে আছি। মাঝে মাঝে হরিণ আর নীল গাইদের দেখা পেলাম দু-এক বার। পাহাড়ের পথ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এবার, একেবারে সামনে, পথের ডান হাতে দেখি দুটো পুঁচকে ভালুক ছানা খেলতে খেলতে লুটোপুটি খাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। কখনো দুজনে জড়াজড়ি করে পাহাড়ের ঢাল থেকে গড়িয়ে পড়ছে নীচে, আবার পরক্ষণেই দৌড়ে উঠছে ওপরে। সারা গায়ে তাদের ধুলো আর রাজ্যের শুকনো পাতার কুচি। ওদের কান্ড দেখে মনে হল একটু কোলে নিয়ে আদর করি। পরক্ষণেই ভাবলাম কী ভয়ঙ্কর ভাবনা। মা ভালুক যে আশেপাশেই আছে কোথাও সেটা নিশ্চিত।
অবাক চোখে বাচ্চাদুটোর দুষ্টুমি দেখছি। ক্রমে লোক বাড়ছে। সহসা নালার গভীর থেকে মা ভালুক বেরিয়ে এল। ঘোর কালো আর মস্ত তার চেহারা। তাকে দেখে খুব আনন্দ হল, আবার ভয়ও লাগল মনে। ছানারা মাকে দেখে দৌড়ে এসে একবারে মায়ের বুকের তলায় গিয়ে সে কী খেলা! মায়ের মুখে মুখ ঘষছে বারবার। মা তাদের একটু আদর করে আবার সরে যেতেই, নালার ওপরে পড়ে থাকা শুকনো, সরু লম্বা গাছটার ওপর দিয়ে এপার ওপার করার খেলায় মেতে উঠল ওরা। সে কী দুষ্টুমি তাদের। পড়ে যাওয়ার ভয়ও নেই একটুও, আর আমাদের এতগুলো লোকের দিকেও নেই কোনও ভ্রুক্ষেপ।
আমরা সবাই দেখেই চলেছি অবাক চোখে। স্তব্ধ, নিস্পন্দ বনভূমির বুকে মাঝে মাঝে দূরের কোনও অস্পষ্ট ধ্বনি ভেসে আসছে কখনও, কিংবা গাছের কোনও মরা ডাল খসে পড়ার শব্দ। তারই সঙ্গে, মাঝে মধ্যে দুষ্টুদুটোর কপট রাগের শব্দ। স্তব্ধ সব দর্শককুল। একটু পরে সহসা ঝোপের আড়াল থেকে মৃদু গর্জন হতেই ছানা দুটো পড়ি মরি করে এক ছুটে মায়ের কাছে হাজির। বুঝলাম এরই মধ্যে মায়ের সোহাগ আর শাসনে সহবত আদি ঠিক মতই রপ্ত করতে পেরেছে। হোটেলের ঘরে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে স্নানাদি সেরে সব জিনিসপত্র নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল ছেড়ে। আজ ফেরার দিন। এখান থেকে মাইল দশেক দূরে কয়েকটা জলপ্রপাত আছে শুনেছি। সেই দিকটাও একটু দেখে যাব বলে ঠিক করলাম। শহর ছেড়ে নানা আঁকা বাঁকা পথে চলতে চলতে দেখা দিল ছোট ছোট কিছু পাহাড় আর টিলা। তাদের কোলে সুন্দর সুন্দর ছবির মত বাড়ি ঘর, ফুলের বাগান আর সবুজের বাহার দেখে মন ভরে গেল।
এক সময় বড় রাস্তা ছেড়ে টিলার পথ ধরে চললাম। চলার পথ ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে এল। তারপর এল নুড়ি আর কাঁকর বিছানো পথ। চলতে চলতে এক জায়গায় এসে সেই পথও শেষ হয়ে গেল। দেখলাম সামনে নালার ওপরে কাঠের সরু পোল। সেই পোল পার হয়ে হেঁটে চড়াই ধরে কিছুটা যেতেই শুনতে পেলাম সামনে জলের শব্দ। আরও খানিকটা এগিয়ে দেখলাম দূরের পাহাড় থেকে আসা একটা বড় নালার জলধারা আচমকা অনেকটা নীচে লাফিয়ে পড়ছে। নীচে পড়েই রাশি রাশি ফেনার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার ছুটছে আরও নীচের নূতন দেশে। সে জায়গা থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার একটা জলপ্রপাত দেখতে পেলাম। এমনি করে লরেল, আব্রাহাম আর রেইনবো - এই তিনটে জলপ্রপাত দেখলাম ঘুরে ঘুরে।
চারদিকে পাহাড়ের পাক। তাদের আনাচে কানাচে আরও কিছু নালার দেখা পেলাম। ঘন বনতলের ছায়ায় ছায়ায় নানা দিক থেকে তাদের কলকন্ঠের অনুরণন কানে ভেসে আসছে নিরন্তর। তারি সঙ্গে পাখিদের কাকলি আর অজানা ফুলের সুবাস মিলে নির্জন সেই বনপথকে করে তুলেছে মধুময়। পথে আমাদের মত আরও কিছু মানুষজনের দেখা পেলাম।
সেখান থেকে নেমে এসে একটা মাইল তিনেকের পাকদন্ডি পথ ধরে ঘুরে দেখব বলে চললাম নানা ছোট টিলা আর নালার পথ কেটে। একেবারে নির্জন পথটা। গা যেন ছম ছম করছে সে পথে চলতে গিয়ে। হঠাৎ ছোট একটা নালার কিনারে দেখতে পেলাম একটা সাপ চুপচাপ শুয়ে আছে। লম্বায় ফুট চার-পাঁচেক হবে। এমন জনহীন অরণ্যপথে তাকে দেখে ভয় লাগল বেশ। উজ্বল ঘন কালো তার রঙ। এ দেশে ওকে বলে "র্যাট স্নেক"। কিন্তু আমাদের দেখে নড়ল না সে একটুও মোটে। হয়তো অতি ভোজনে লাচার হয়ে পড়েছে বেচারী। অগত্যা কিছু দূর দিয়ে ঘুরে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।
এবার অন্য একটা পথ ধরে চলেছি ঘুরে। উদ্দেশ্য আরও নতুন কিছু দেখা। যেতে যেতে এক জায়গায় পথের সামনে দেখলাম রেল লাইনের ওপর কয়েক সারি রেল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সাইডিং-এ। তাদের গায়ে বড় বড় হরফে লেখা - "গ্রেট স্মোকি মাউন্টেন রেলওয়ে"। সেই সুদূরের পথিককে বিদায় জানিয়ে আবার চেরোকী শহরে ফিরে এলাম। সেখান দিয়েই ফেরার পথ আমাদের।
অকুনালুফতির কিনারে সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। নদীর জলে হাঁসের দলের জলকেলি দেখতে দেখতে প্যান কেক খেতে বেশ ভালই লাগল। ওটাকেই আমরা বলি গোলা রুটি। তবে নানা রকম ক্রীম আর সস দিয়ে সেটাকে মনলোভা করে পরিবেশন করার কায়দায় কেবল যে দেখতে সুন্দর হল সেটা তা নয়, খেতেও সুস্বাদু লাগল।
প্রায় আটশ বর্গ মাইলের এই "দি গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনস ন্যাশানাল পার্ক" এর পঁচান্নব্বই শতাংশ অঞ্চলই গভীর অরণ্যে আবৃত। নানা বৈচিত্র্যে ভরা সেই বিরাট সুন্দরের সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র দেখার সুযোগ পেয়েই এই ভ্রমণে অভিভূত হয়েছি বার বার। সেদিনের গভীর অরণ্যের বুকের তলে "মাতৃক্রোড়ে শিশুদের" সেই অনাবিল ছবির স্মৃতি আজও মনে অমলিন হয়ে আছে।
~ গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনের আরও ছবি ~
ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের (জি এস আই) প্রাক্তন কর্মী কালিপদ মজুমদার তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে নিযুক্ত ছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নানান প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলে। অবসর গ্রহণের পর সন্তানদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ আসে। সেখানে অবস্থানকালে বিশাল সেই দেশের যে সামান্য কিছু অংশ ভ্রমণের সুযোগ হয় তার মধ্যে "দি গ্রেট স্মোকি মাউন্টেন্স ন্যাশনাল পার্ক" একটি অন্যতম সুন্দর স্থান। সেই বিরাট সুন্দরের বর্ণনার প্রয়াসে 'আমাদের ছুটি'-তে কলম ধরা।