বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
মাড়াই-এর জঙ্গল মাড়িয়ে
অভিজিৎ কুমার চ্যাটার্জি
~ সাতপুরা টাইগার রিজার্ভের আরও ছবি ~
নদীর সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, আচ্ছা স্কাইলাইনের এর বাংলা কী? ... দিগন্ত নাকি আকাশরেখা?
ঘুম থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে একমুঠো মিষ্টি রোদ।
ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো এই পাহাড় নদীকে দুচোখ ভরে দেখি শুধু। শঙ্কায় হাত ছোঁয়াতে পারিনা!
স্বাধীনতা কী অপার! এ তো, সৃষ্টির ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার চেতনা! এই ভীষণ স্বাধীনতা থেকে চোখ ফিরিয়ে নি কী করে! আচ্ছা, পাহাড়ের সংখ্যা কি সাত? নামতো তাই "সাতপুরা"!
তাওয়া নদীর ব্যাকওয়াটার - জায়গাটার নাম মাধাই, স্থানীয়রা বলেন "মাড়াই", ভূপাল থেকে মাত্র ১৪০ কি মি। আমরা অবশ্য এসেছি নাগপুর থেকে, দূরত্ব ২৯৩ কি. মি., সময় লেগেছে পাঁচ ঘন্টার মত। সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক-এর মধ্যে অবস্থান - যদিও বর্তমানে এটি টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট-এ উন্নীত হয়েছে।
মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম এর নতুন ঠিকানা – 'বাইসন রিসর্ট' - একদম ডেন্ডোয়া নদীর ধারে। নদীর ওপারেই জঙ্গল আর পাহাড়ের হাতছানি!
লঞ্চে চেপে জঙ্গল দেখা আর সিনেমার জঙ্গল দেখা প্রায় একই রকম। বনদপ্তরের লঞ্চে করে নদী পার করে এসে দাঁড়ালাম 'সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক'-এর দোরগোড়ায়।
অরণ্যে এসে অনেক সময়ই অরণ্য দেখাই হয় না। ছেলেমানুষের মতো শুধু জন্তু-জানোয়ার দেখার ইচ্ছেই জাগে - উঠে পড়লাম জিপসিতে। পিচসড়ক ছেড়ে জিপসি ঢুকল আলোছায়ামাখা অরণ্যে পথে।
অরণ্য সবুজ, কিন্তু সবুজ মোটেই একটা রং নয়, অন্ততঃ সাত রকম সবুজ তো রয়েছেই এই জঙ্গলে।
জিপসি একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। চুপ করে শুনি জঙ্গলের শব্দ - বোঝার চেষ্টা করি ওর ভাষা!
আসলে ক্ষমা আর তাচ্ছিল্যের একটা রাজকীয়তা থাকে, সব বিরুদ্ধতাই তো উত্তরের যোগ্য হয় না - জঙ্গল যেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
গুনগুন করে উঠি...
"The woods are lovely, dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep."
গাছের ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত আলো ঢুকে জীপ চলার রাস্তাকে কী ভীষণ রোমান্টিক করে তুলেছে! প্রকৃতির মতো বড় সিনেমাটোগ্রাফার আর হয় নাকি?
গাছপালা বলতে মূলতঃ বাঁশঝাড়, সেই সঙ্গে টুকটাক সেগুন, শাল, বহেরা - এই সব আর কী! তবে সব গাছ যে চিনি, তা তো আর নয়। মাঝে মধ্যেই রয়েছে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি।
গাইডের ডাকে সম্বিৎ ফিরল, বাঘ নাকি! দেখি বন থেকে বেরিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে একদল চিতল হরিণ। আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরের মতো পিঠ নিয়ে একজোড়া ইন্ডিয়ান বাইসন!
গাইডের চোখ কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে!
প্রতিটা মুহূর্তেই যেন কী একটা ঘটবে তার নিঃশব্দ উত্তেজনা।
চোখে পড়ল একদল সম্বর। গাইড বলল, 'ঝুন্ড' - সম্বরের দল। বারো চোদ্দোটা তো হবেই!
সময় তখন বিকেল আর গোধূলির পাকদন্ডিতে আটকে। ক্যামেরায় মেমোরি কার্ডে ধরা স্মৃতির চেয়ে অনেক বেশি মুহূর্ত চোখের ক্যামেরায় ধরে, মনের মনিকোঠায় ডেভেলাপ করে, চিরতরে স্মৃতির অ্যালবামে রেখে, এভাবেই ঘরমুখী আমরা। 'জঙ্গল' মানে বন্যজন্তুদের সুখের বাসর, নিশ্চিন্ত নীড়। বাঘ দেখার মাদকতা, থাক না বেঁচে, পরের বারের জন্য!
বর্ষাকাল বাদ দিয়ে সারাবছরই যাওয়া যায় মাড়াইয়ে, তবে যাওয়ার আগে পার্ক খোলা আছে কিনা দেখে নেওয়াই ভালো। পাঁচমাড়ি গেলে অবশ্যই জুড়ে দেবেন মাত্র ৮০ কিমি দূরে জঙ্গলের এই নতুন ঠিকানা।
~ সাতপুরা টাইগার রিজার্ভের আরও ছবি ~
পেশাগত ভাবে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার অভিজিৎ কুমার চ্যাটার্জীর নেশা ভ্রমণ। নেশার তাগিদে ঘুরে বেড়িয়ে নির্মাণ করেন পর্যটনকেন্দ্রগুলি নিয়ে নানান ট্রাভেল ডকুমেন্টারি।
অজানা খমকুট ড্যাম
সেখ মহঃ ওবাইদুল্লা
সময়-সুযোগমত মাঝে মাঝেই এদিকে ওদিকে বেড়িয়ে পড়ি। এবারের দেওয়ালি আর কালীপুজোর ছুটিতে গন্তব্য ছিল ওড়িশার পঞ্চলিঙ্গেশ্বর আর চাঁদিপুর। শনিবার সকাল ছটায় হাওড়া থেকে নির্ধারিত সময়ে ধৌলি এক্সপ্রেস ছাড়ল। বালাসোর পৌঁছালাম বেলা সাড়ে নটা নাগাদ। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়েই অটো পেয়ে গেলাম ওড়িশা ট্যুরিজম-এর পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পান্থনিবাসে পৌঁছানোর জন্য। পথের দুধারের দৃশ্য খুবই মনোরম, দু চোখ জুড়িয়ে যায়। পান্থনিবাসের অবস্থানটি ভারী সুন্দর জায়গায় - সামনেই স্বল্প উচ্চ নীলগিরি পাহাড়, পাথরের সারিগুলো দেখলে মনে হয় কেউ যেন খুব যত্ন করে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে।
টিফিন সেরে বেরিয়ে পড়লাম চারদিকটা একটু ঘুরে দেখতে। জায়গাটা এখনও তেমন জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটের মধ্যে পড়ে না, খুব বেশি হোটেল চোখে পড়ল না। মূলত আদিবাসী মানুষদের বাস, দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট, চাষ আবাদ আর পশুপালনই প্রধান জীবিকা। এখানে যাঁরা আসেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের উদ্দেশ্য নিয়েই আসেন। নীলগিরির ওপরে অবস্থিত একটি ধর্মস্থান। প্রায় তিনশো এগারটি সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছাতে হয় সেখানে। একটু কষ্টকর, কিন্তু ওপরে উঠতে পারলে বেশ ভাল লাগে।
এখানে আসার আগে এক পূর্বপরিচিতের কাছে শুনেছিলাম খমকুট ড্যাম-এর কথা। পান্থনিবাস থেকে দূরত্ব চার কিমির মত, গাড়ি করে যাওয়া যায় আদিবাসী গ্রামের ভেতর দিয়ে। আর একটা রাস্তা আছে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর-এর পাশের জঙ্গল দিয়ে, যেটায় আড়াই কিমি মতো দূরত্ব। কিন্তু দ্বিতীয় পথটি গাইড ছাড়া যাওয়া খুব বিপজ্জনক, ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি রাস্তা, হাতি আর ভাল্লুকের ভয় তো আছেই, তার সঙ্গে আছে রাস্তা হারানোর বিপদও। সেদিন বিকেলে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর ঘুরে আসার পর সময়ের অভাবে খমকুট দেখতে যাওয়া আর হল না। গাড়ি করে য়াওয়ার সময়টা ছিল, কিন্তু ইচ্ছা করছিল জঙ্গল পথ ধরে যাওয়ার জন্য।
পরদিন খুব সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়ে পান্থনিবাসের কাছে দুজন স্থানীয় বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পেলাম। ওদেরকে বলতেই রাজি হয়ে গেল। কিছু টাকার বিনিময়ে জঙ্গলপথে খমকুট নিয়ে যাবে। পান্থনিবাস থেকে একই পথে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে ওঠার সিঁড়িগুলো যেখানে আছে, তার একটু আগে পর্যন্ত গেলাম। তারপর বামদিকে একটা ঢালু পথ চলে গেছে জঙ্গলের দিকে, সেই পথ ধরলাম। খুব সকালে বেরিয়েছি, রাস্তায় মানুষজন প্রায় নেই বললেই চলে, যা কয়েকটা দোকানপাট আছে (প্রধানত পুজো দেওয়ার ডালি বিক্রি হয় আর দুয়েকটা চায়ের দোকান) তাও বন্ধ। কিছুটা যাওয়ার পর বাঁহাতে একটা ভাঙা বাড়ি চোখে পড়ল। জিজ্ঞেস করতে আমার এক গাইড বলল, আগে ফরেস্ট অফিস ছিল, এখন অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে, তাই এই ভগ্নদশা। বাকি পথ পুরোটাই প্রায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, পাশে নীলগিরি পাহাড়, কয়েকটা আদিবাসী কুটিরও চোখে পড়ল। জঙ্গলের পশুদের থেকে আত্মরক্ষার জন্য ক্যাকটাস জাতীয় কাঁটা গাছ লাগানো বাড়িগুলোর চারপাশে, পরিবেশ বান্ধব সুরক্ষা বলা যায় আর কী। পাশে একটা তারের বেড়া জাতীয় দেওয়া আছে, ওগুলোতে নাকি রাতে ইলেক্ট্রিক সংযোগ করা থাকে সুরক্ষার জন্য। প্রায় মিনিট কুড়ি চলার পর একটা খুব ঢালু খাদের মতো জায়গায় নামতে হল বেশ কষ্ট করে, তারপর আবার অনেকটা চড়াই। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম একটা উঁচু বাঁধের মতো জায়গা।
তীব্র ক্লান্তি নিয়ে ওঠার পর যা দেখলাম তা এক কথায় অনির্বচনীয়। চারদিকে জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা এক সরোবর, দু চোখ জুড়িয়ে গেল যেন। সরোবরের মাঝে একটা ছোট মন্দির আর একটা নজরমিনার দেখতে পেলাম। জায়গাটি এতটাই সুন্দর যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সরোবরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যায়। ড্যামটি সেরকম বড় কিছু নয়, সরোবর আর তার অবস্থানটা এতটাই সুন্দর যে তা বর্ণনার অতীত।
বেলা গড়িয়ে আসছিল। ইচ্ছে না থাকলেও ফিরে আসার জন্য সেই বনপথে আবার পা বাড়াতে হল।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক সেখ মহঃ ওবাইদুল্লা ভালোবাসেন ভ্রমণবিষয়ক লেখা পড়তে, চেনা অচেনা জায়গায় ঘুরতে আর ছবি তুলতে।