বিনসারের জঙ্গলে
সুদীপ্ত ঘোষ
~ বিনসারের আরও ছবি ~
মার্চের শুরু। পরিযায়ীরা যে যার মতো ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। বাতাসে শীতের আমেজ মিলিয়ে গিয়ে হাল্কা আগুনে মেজাজ। রাজস্থানের ধূসর রুক্ষ প্রান্তর জুড়ে শুধু বাবুল, হিঙ্গট আর ফণীমনসার ইতস্তত কাঁটাঝোপ। ফিল্ড ওয়ার্কের মাঝে প্রায় শুকনো জলাশয়ের পাড়ের কাদায় চিতার (লেপার্ড) পায়ের ছাপ মস্তিস্কের গ্রে সেলকে আর উত্তেজিত করে না। হাল দেখে সোহিনী বলল, 'তুমি ক্লান্ত। একটু স্বাদ বদল দরকার।' শুনে তো এককথায় রাজি। চল মন বৃন্দাবন। আই.আর.সি.টি.সি.-তে লগইন আর টিকিট বুকিং যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হয়ে গেল। সোহিনী হেসে বলল, 'সংসারের বাকি কাজে এতো প্রোঅ্যাকটিভ হলে আমাদের উন্নতি অবধারিত।' ঈষৎ হেসে ব্যঙ্গোক্তিটার পাশ কাটালাম। শাস্ত্রের তাই বিধান। তবে ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন বলতেই হবে। মাসখানেকের মধ্যেই জয়পুর থেকে কাঠগোদামের আসা-যাওয়ার দুটো টিকিট পাওয়া গেল। যেটা আজকের বাজারে দুষ্প্রাপ্য। জায়গা ঠিক না হলেও টিকিট কেটে নিলাম, কেন না কাঠগোদাম থেকে যাওয়ার অজস্র জায়গা। প্রকৃতির কোলে কোনও নিরিবিলি, নির্জন গ্রাম হলেই সবচেয়ে ভালো। দিনকয়েকের হোমওয়ার্ক আর ইন্টারনেট সার্ফিং-এর পর মনমত জায়গা ঠিক হল, বিনসার - আলমোড়া ডিস্ট্রিক্টে। পাহাড়, জঙ্গল, হিমালয় আর কী চাই? সঙ্গে উপরি পাওনা গৌনাপ গ্রাম। হোমস্টে। বিনসারের ঠিক নীচে। পাকদণ্ডী বেয়ে ৫-৬ কিলোমিটার। হিমালয়ের কোলে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে বসে জ্যোৎস্নায় ভেজা উপত্যকা নাকি এক অপার্থিব সৌন্দর্য। আগে কর্মসূত্রে ওই অঞ্চলে একাধিকবার গেলেও বিনসার যাওয়া হয়নি। দেরি না করে দিন তিনেকের জন্য কে.এম.ভি.এন.-এর ওয়েবসাইট থেকে বিনসারে গেস্টহাউস বুক করে নিলাম। মাঝের একদিন গৌনাপে হোমস্টে।
কাজ শেষ করে জয়পুর পৌঁছেই ফিল্ডের জিনিস নামিয়ে আবার লোটা কম্বল বেঁধে নিলাম। দুদিন পর জয়পুর থেকে রানিখেত এক্সপ্রেস। দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশে ছাড়ে। রাত দশটা নাগাদ দিল্লি পৌঁছে ডিনার। ডিনার করেই যে যার বার্থে কম্বলের নীচে সেঁধোলাম। সোহিনী রিডিং লাইট জ্বেলে খুলে বসেছে "জিম করবেট অমনিবাস।" নেক্সট ট্রিপে আবার করবেট ভাবতে ভাবতে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। ভোরের দিকে ঘুম ভাঙল প্ল্যাটফর্মের হৈ হট্টগোলে। ষ্টেশন হলদোয়ানি। কামরার দরজা খুলতেই শীতের আমেজ। ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়ে শুরু হল দিন। ট্রেন কিছু লেট। ভালোই হল, একদম কাকডাকা ভোরে পৌঁছাতে হবে না। সোহিনী তখনও গভীর ঘুমে। কাঠগোদাম পৌঁছানোর কিছু আগে সোহিনীর ঘুম ভাঙল। ফ্রেশ হয়ে অপেক্ষা কাঠগোদামের। লাগেজ বিশেষ কিছু নেই, দুজনের দুটো রুকস্যাক।
ষ্টেশন থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। বিনসার শুনে কাউকেই খুব একটা উৎসুক লাগলনা। নৈনিতাল, ভীমতাল হাঁকডাকই বেশি। ভিড় পাতলা হতেই যদিও বিনসার-এর জন্য ঝুলোঝুলি। গাড়ি দরদাম করে ঠিক করতেই, আরও দুজন এসে উপস্থিত। লিফট চাই। ভীমতাল অব্দি। শেয়ারে যেতে চায় পার্টনার পাচ্ছেনা। দেখে নিজেদের কলেজ লাইফ মনে পড়ে গেলো। ব্যাকপ্যাকার্স ট্রিপ। যদি হও সুজন, তেঁতুল পাতায় ন'জন। জীবনে কোথায় কার সাথে দেখা হবে তার তো কোনও ছকে বাঁধা নিয়ম নেই।
কাঠগোদাম থেকে বিনসারের দূরত্ব ১০৪ কিলোমিটারের আশেপাশে। গাড়িতে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো। কাঠগোদাম থেকে ভিমতাল, ভওয়ালি, আলমোড়া হয়ে বিনসার। রাস্তায় যখন নামলাম, সূর্যদেব দর্শন দিয়েছেন। শালবনের পাতার ফাঁক গলে আসা মুঠো মুঠো রোদ্দুর কালো পিচ ঢাকা রাস্তায় ইতস্তত ছড়ানো। শহুরে ঝঞ্ঝাট কাটিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলেছে গাড়ি। তবে পাহাড়ি হলেও রাস্তা যথেষ্ট চওড়া ও আরামদায়ক। জানলার কাচ নামাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল দস্যি হিমেল হাওয়া। বাতাসে এখনও শীতের ছোঁয়া। কামড়টাই যা নেই। সদ্য ঘুমভাঙা পাহাড় তখনও আড়মোড়া ভাঙছে। রাস্তার পাশের জঙ্গলে শালের আধিক্য। ধীরে ধীরে শালের জঙ্গল পাতলা হয়ে শুরু হয়ে গেল পাইন, ওকের দাদাগিরি। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় নরম মিঠে রোদ্দুর সঙ্গে করে পৌঁছালাম ভীমতাল। ক্ষণিকের বিরতি। চা এবং কিঞ্চিৎ জলযোগ। পথের বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে আবার পথচলা। চলার পথে চেনা দোকান, কফি শপ দেখে পুরনো স্মৃতির আনাগোনা, অজান্তেই পুরনো কথা, পুরনো বন্ধুদের জন্য মন কেমন। পাহাড়ের অচেনা বাঁকে নাম না জানা অর্কিডের ভিড়, পাইন বনের ফাঁক দিয়ে একঝলক তুষারশুভ্র গিরিশিখর। বাতাসে শীতের কামড়টা আরেকটু বেশি।
ভওয়ালি, আলমোড়া পেরোনোর পর প্রকৃতি আরও দিলখোলা। সবুজ ঘাসের গালিচামোড়া, কেয়ারি বাগান। বাঁশের বেড়া দেওয়া কাঠের বাড়ি। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বিনসার ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির দোরগোড়ায়। ফরেস্টচৌকিতে নিয়মমাফিক কাজকর্ম মিটিয়ে ঢুকে পড়লাম স্যাংচুয়ারির মধ্যে। নিবিড়, ঘন, আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখানো পাইন, ফার, ওকের জঙ্গল। লাল ফুলে ছাওয়া রডোডেনড্রনের সারি। ফুলে ঢাকা রাস্তা, পাহাড়ি বাঁকে ছায়ার মমত্ব, শহুরে, ছাপোষা, মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল। আমরা সবাই রাজা। না হলে হিমালয়ের কোলে এই নিরালা প্রান্তরে এত আয়োজন কিসের! কার জন্য এই রেড কার্পেট ?
গেস্ট হাউসে চেকইন করে লাঞ্চ সেরে নিলাম। বাইনোকুলার, সালিম আলির বই আর ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের রাস্তায়। পড়ন্ত দুপুরের রোদে তখনও ছেলেমানুষি আশকারা, মেঠো পাহাড়ি পথে ঝরে পড়া রডোডেনড্রনের কার্পেট বাঁচিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। নীচে উপত্যকায় মেঘেদের ভেসে চলা। উপত্যকা পেরিয়ে হিমালয়ের আঁকিবুঁকি। সুউচ্চ পাইন, ওকের প্রকাণ্ড গুঁড়ি, কাণ্ডে শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। সূর্যের আলো অনেক সময়ই মাটি অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। গাছের ডালে শাখামৃগদের দাপাদাপি। বয়স্ক ও বিচক্ষণ দলপতির গম্ভীর মুখে আর সাবধানী চোখে আগন্তুকদের পর্যবেক্ষণ। গাছে গাছে ছোট বড় নানা প্রজাতির পাখির কলতান। উঁচুনিচু পথ বেয়ে পৌঁছে গেলাম জিরো পয়েন্টের কাছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে কুমায়ুন হিমালয়ের মুখোমুখি। পাশেই বন্য জীবদের জন্য জল খাওয়ার পরিখা। ওয়াচ টাওয়ারের থামেই বাসা বেঁধে আছে গ্রেট টীটের দল। মানুষজনের দিকে বিশেষ ভ্রূক্ষেপ নেই। টীটের ঘর গেরস্থালী দেখার ফাঁকেই শরীরে বড়সড় ছায়া ফেলে উড়ে গেল হিমালয়ান ঈগল। নীল ঝকঝকে আকাশে প্রসারিত তার সফেদ ডানা - 'আলোর আকাশে ঈগল।'
ওয়াচ টাওয়ারের সামনের একফালি জমিতে তখন প্রজাপতির ওড়াউড়ি। নানা রঙের মেলা। জগত জুড়ে আনন্দমেলা। জীবনের ভালো মুহূর্তগুলো কেন জানি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। সম্বিৎ ফিরল গুঞ্জনে। জঙ্গলের রাস্তা থেকে ভেসে আসছে। সেলফি স্টিক হাতে শহুরে টুরিস্ট দলের আবির্ভাব হতেই আবার বনের পথে ফিরলাম। জঙ্গলের রাস্তায় কিছুটা ফিরে বাঁ দিকের টিলাটায় উঠতে শুরু করলাম। ও হরি, এ যে "শিয়ার জোন।" ভুতত্ত্ববিদ দম্পতি হওয়ার কিছু সুবিধা তো আছেই, চিন্তা ভাবনার ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করে। চোখ টিপে বললাম, "ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।" তখন বিকেল ঢলতে শুরু করেছে। ফেরার পথ ধরলাম। পাখিদের কলতানি এবার ঘরমুখো। গেস্ট হাউসে ফিরে চায়ের কাপ হাতে ছাদে। সূর্যাস্তে আকাশের রঙ বদল।
সন্ধ্যে নামল। শহুরে ক্যাকোফোনি ভুলিয়ে ঝিঁঝিঁ-র একটানা ঐকতান। গেস্ট হাউসের চারদিকের জঙ্গলে জমাট বাঁধা অন্ধকার। চাঁদের আলো হিমালয় আলো করে রাখলেও জঙ্গলের গভীরে তার প্রবেশ নিষেধ। এখানে বিদ্যুৎ নেই। রাতে ডিনারের সময় এক ঘণ্টার জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা। সামনের নিকষ কালো অন্ধকারে মিটিমিটি জোনাকি। অদূরে নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। হুইসলিং পাইনের ফিসফিসানি, শুকনো পাতায় খসখস শব্দে কোনও প্রাণীর হেঁটে যাওয়া, পাতা ঝরার শব্দে, বিকেলের রোম্যান্টিসিজম সন্ধ্যের মুখে গা ছমছমে। কাঠের ইন্টিরিয়রে সাজানো গেস্ট হাউস, উডেন ওয়াল, ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড, মোমবাতির আলোছায়া সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য অনুভূতি। কাঁচের জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। মোমবাতির আলোয় খুলে বসলাম স্টিফেন কিং-এর উপন্যাস, আর সোহিনীর হাতে জিম করবেট অমনিবাস।
পরদিন ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। জানলার বাইরে তখন উদ্দাম ঝড়ের দাপট, সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি। গৌনাপ যাত্রা বিশ বাঁও জলে। পাহাড়ি উপত্যকায় বসে জ্যোৎস্না দর্শন তখন অকূল পাথারে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির দাপট বেড়ে চলল। ডাইনিং রুম অব্দি পৌঁছানোই এক বিড়ম্বনা। এসেছিলাম জ্যোৎস্নার রূপ দেখতে, কিন্তু প্রকৃতি দেবীর ভাবনায় অন্য কিছু ছিল। সমস্ত পাহাড়, উপত্যকা জুড়ে মেঘের জলছবি। জঙ্গলে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশার মতো ঝুলে আছে মেঘ। জানলা খুললেই ভিজে মেঘের স্নান। মেঘ পিওনের ব্যাগে মনখারাপের দিস্তা ছিল কিনা জানা নেই, আমার কিন্তু বেশ লাগছিল জানলায় বসে পাহাড় আর বৃষ্টির ভালবাসা দেখতে। অবলীলায় কেমন মেঘের বুক থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে গভীর উপত্যকায়। গহীন অরণ্যানী সদ্যস্নাতা তরুণীর মত লজ্জাবনত। দুপুরে লাঞ্চের পর গেস্ট হাউসের ডাইনিং রুমের নীচের কাচঘেরা ঘরে বসলাম।
এখান থেকে চারিদিকে অনেকটা জঙ্গল দেখা যায়। গাছের ডালে কিছু হনুমান বৃষ্টিতে উপুস ঝুপুস ভিজে বসে আছে। ছোটটা মায়ের কোল ঘেঁষে। হঠাৎই উল্টোদিকের জঙ্গল থেকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এলো একটা হলুদ আর বাদামী ছোপের 'হিমালয়ান পাইন মার্টেন।' প্রচণ্ড ব্যস্ত জীবন তার। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নানা কসরত দেখাল। কখনও চলে এল খুব কাছে, কখনও গা ঢাকা দিল ঝোপের আড়ালে। গাছের ডালে বসা হনুমানের দলও তার খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত। বেশ মজাই লাগছিল, যেন আমরা খাঁচায় আর বাকিরা স্বাধীন। সত্যিই তো 'বন্যেরা বনে সুন্দর।' গতকালের আলাপ হওয়া ড্যানিশ দম্পতিও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। মার্টেনের দুষ্টুমি যখন চরমে তখনই আচমকা গাড়ির হর্ন। বেচারা সেই যে গা ঢাকা দিল আর দর্শন দিলই না। বিকেলে বৃষ্টিটা ধরে এল। কিন্তু ঠাণ্ডা এক ধাক্কায় তিন চার ডিগ্রি কমিয়ে দিল। আকাশের মুখ তখনও ভার। রাতের আকাশে তারা ফুটল না।
কাকভোরে দরজায় নক। পাশের রুমের বিদেশিনী বোর্ডার। "গুড মর্নিং। ইট্স প্লেজান্ট আউটসাইড।" ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ঘড়িতে চারটে পঁচিশ। লাফ দিয়ে জানলার কাছে গিয়ে পরদা সরালাম। মেঘ কেটে গিয়ে ভোরের আবছা আলোয় দূরের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে গেস্টহাউসের ছাদে, ওটাই ভিউ পয়েন্ট, দিগন্ত জোড়া হিমালয়। প্রায় তিনশো ডিগ্রির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ভিউ। অত সকালেও অনেকেই হাজির। গেস্টহাউসের সামনের গভীর উপত্যকা তখন মেঘসমুদ্দুর। শান্ত সমাহিত। সমুদ্দুরে মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো মাথা উঁচু করে আছে ছোটবড় পাহাড়। কখনও ঢেউ উঠছে সেই সাদা মেঘে। কখনওবা দুই সুউচ্চ শৈলশিরার মাঝ বরাবর মেঘের জলপ্রপাত। আকাশ একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে। একে একে চেনা যাচ্ছে তুষারঢাকা গিরিশিখর। নন্দাঘুণ্টি, ত্রিশূল, মৃগথুনি, মাইকতোলি, নন্দাদেবী, ছাঙ্ঘুছ, নন্দকোট আর সমগ্র পঞ্চচুল্লী। মনে হচ্ছে গোটা কুমায়ুন রেঞ্জটাই ছোঁয়া যাবে হাত বাড়িয়ে। পঞ্চচুল্লীর ওপর আকাশে তখন রঙ লেগেছে। আকাশে গোলাপি জলরঙের তুলির টান। দিনের প্রথম আলো ত্রিশূল শৃঙ্গে। পঞ্চচুল্লীর চূড়া টপকে এবার উঁকি দিল সূর্য। জীবনের অনেক সূর্যোদয়ের মধ্যে অন্যতম স্মরণীয়।
ব্রেকফাস্ট করে আবার জঙ্গল ভ্রমণ। আজ আর শিক্ষানবিশি নয়। গুরু পাকড়ালাম। গাইড। অভিজ্ঞ চোখে চিনিয়ে দিলেন হরেকরকম পাখি। কথায় কথায় জানলাম প্রায় দুশো বা তারও কিছু বেশি প্রজাতির পাখির সাম্রাজ্য এই বিনসার। তাছাড়া হিমালয়ান চিতল, কালো হরিণ, গড়াল, রেড জায়ান্ট ফ্লাইং স্কুইর্যাল, লেপার্ডও খুব দুর্লভ নয়। সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে টো টো। জঙ্গলের পাকদণ্ডী বেয়ে আবার হিমালয় দর্শন। মাঝে মধ্যে ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া। পাইনের কোণ কুড়ানো। পাখির আলাপচারিতায় আড়ি পাতা। এরই মাঝে ঝুপ করে নেমে এলো সন্ধ্যে। পাইন বনের মাথায় চাঁদ উঠলো। ঝকঝকে আকাশে নক্ষত্রমালা। ডিনার করে নিষ্প্রদীপ ঘরের জানলায় দুজনে। বাইরে জ্যোৎস্নামাখা পাহাড়। কান পেতে শুনছি সেই 'অন্ধকারের গান।'
পরদিন দুপুরে ফিরে চলা। মুঠিভরা জ্যোৎস্না, ঝরা পাতার গান আর ঝরেপড়া রডোডেনড্রনের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে ফিরে চললাম চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে। ফেলে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসে হয়তো আবার ফিরে আসার আশ্বাস। ঠিক জানি না।
~ বিনসারের আরও ছবি ~
পেশায় জিওলজিস্ট সুদীপ্ত ঘোষ বর্তমানে ভারত সরকারের 'জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার' জয়পুর অফিসে কর্মরত। কাজের সুবাদে বছরে ছয়মাস পাহাড়ে-জঙ্গলে। ফিল্ডে অবসর কাটে বই পড়ে – বিশেষত ক্রাইম থ্রিলার আর ভ্রমণকাহিনি। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখাও নতুন সংযোজন পছন্দের তালিকায়। ভালো লাগে বেড়াতে - পাহাড় আর জঙ্গল দুইই প্রিয়। এছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া অন্যতম পছন্দের কাজ। লেখালেখির অল্পবিস্তর চর্চা থাকলেও, কোনও পত্র-পত্রিকায় পাঠানোর দুঃসাহস আগে হয়নি।