অজানা দ্বীপ মৌশুনী
অনিরুদ্ধ ভৌমিক
অনেকদিন ধরেই বেরিয়ে পড়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সকলের আবদার এবারও একটা 'আউট অফ ট্র্যাক' জায়গা ঠিক করতে হবে, যা দু'রাতের মধ্যে ঘুরে আসা যায়। তাই রীতিমতো পড়াশুনা করার দায়িত্ব পড়ল আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ওপরেই। এক সপ্তাহের মধ্যে বেশ কিছু ভ্রমণ পত্রিকা, গুগল ও আমাদের মতো আরও কিছু ভ্রমণপিপাসু বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে একটা জায়গার নাম উঠে এল - 'মৌশুনী আইল্যান্ড।' প্রথমে নিজেরই ধন্দ লাগছিল, নামটা 'মৌশুনী' নাকি 'মৌসুমী'। দেখলাম, কলকাতা থেকে মাত্র ১৬০ কিমি দূরত্বে নামখানা ব্লকের অন্তর্গত এক অখ্যাত দ্বীপের নাম এই 'মৌশুনী আইল্যান্ড'। যার কথা ২০১৪ সালের 'The Hindu' সংবাদপত্রে "Bengal's Sinking Island" নামে একটা প্রচ্ছদকাহিনিতে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৬ ডিসেম্বর, আমরা দুজনে ও আরও তিনবন্ধু মিলে ধর্মতলায় হাজির হলাম। প্রাইভেট বাসে চেপে নামখানার উদ্দেশ্যে যখন যাত্রা শুরু হল ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে সাতটা। রবিবারের কলকাতা তখন সবে আড়মোড়া ভাঙছে। আমতলা, ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ পেরিয়ে নামখানা পৌঁছালাম, বেলা সাড়ে এগারটা। বাসস্টপ থেকে টোটোতে চেপে নদীঘাট। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরিয়ে, আবার মোটর ভ্যানে চেপে যাত্রা শুরু দশ মাইলের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে অপর একটি ভ্যানে করে পাড়ি দিলাম আর একটি নদীঘাটের দিকে, নাম যার 'পাতিবুনিয়ার ঘাট'। ভারী অদ্ভুত সব নাম। পাতিবুনিয়া যাওয়ার পথে একটু একটু করে বদলাতে লাগল দৃশ্যপট।
সরু ইটের একপাশে সরকারি সংরক্ষিত এলাকা বা খাল বলাই ভালো, যেখানে সারি সারি ট্রলার দাঁড়িয়ে আছে। আর অন্য পাশে জেলে ও মাঝিদের গোবরমাটি দিয়ে নিকানো পরিষ্কার পরিছন্ন ছোট ছোট ঘর। প্রতিটি বাড়িতেই গরু-মুরগির সমাগম। অনেক জায়গায় চোখে পড়ল মাছ ধরার জাল শুকোচ্ছে, কোথাওবা ট্রলার মেরামতির কাজ চলছে, কোথাও মহিলারা জাল বুনছে। এই সমস্ত সরল-সাধারণ মানুষগুলোর জীবনযাপনের ছবি মনে করিয়ে দিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প "পদ্মা নদীর মাঝি"-র কথা। ঘাটের ঠিক কাছ থেকে নাকে ভেসে আসছিল 'শুঁটকি' মাছের গন্ধ। যারা এ রসে রসিক, তাদের কাছে গন্ধটি সুখকর হলেও আমার কাছে মোটেও তা ছিল না। নদীবাঁধে উঠে দেখতে পেলাম চপলা চঞ্চলা নারীর মতো বয়ে চলেছে চেনাই নদী। বর্ষার মরশুমের মতো শীতেও তার ভরা জল। আর দূরে দেখা যাচ্ছে আমাদের গন্তব্য - মৌশুনী আইল্যান্ড।
এখানেও অপেক্ষা করছিল আরেক চমক। ঘাট তো রয়েছে কিন্তু কোন যাত্রী বা নৌকা নেই। আমাদের এই অবস্থা দেখে একজন স্থানীয় লোক এগিয়ে এসে বললেন, 'দাদা, সকালের শেষ ফেরী তো দুপুর সাড়ে বারোটায় চলে গেছে, পৌনে তিনটের সময় আবার ফেরী সার্ভিস শুরু।' শুনে তো মাথায় তো বজ্রাঘাত। হঠাৎ দেখি, এক পাটাতনের ও ছাউনিবিহীন একটা বোট এসে ঘাটে থামল। তাতে এক মুমূর্ষূ রোগীকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার জন্য আনা হয়েছে। রোগী নামার পর মাঝি ভাইকে আমাদের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রাজি করানো হল দ্বীপে পৌঁছে দেবার জন্য। এরকম এক বোটে করে নদীতে ভেসে পড়ার যে অনাবিল ভয়মিশ্রিত আনন্দ, তা লিখে বোঝানো দায়। নদী পারাপার হওয়ার শুরুতেই এক শঙ্খচিলের উড়ে যাওয়া চোখে পড়ল। চারদিকে রূপোর চাদরের মতো চিকচিক করছে চেনাই নদীর জল। ভেসে রয়েছে জেলেদের ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। নদীর বুক চিরে মাঝে মধ্যে ছুটে চলেছে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলার।
বেলা পৌনে দুটো নাগাদ অবশেষে পৌঁছালাম বহু প্রতীক্ষিত মৌশুনী দ্বীপে। ঘাট থেকে নদীবাঁধে উঠে যতদূর চোখ যায়, চারদিকে শুধু সবুজের সমাগম। মাঝে মধ্যে একটা দুটো মেঠো বাড়ি। আমাদের জন্য আগে থেকে অপেক্ষা করছিল উত্তম, সেই কাঁচা রাস্তা ও ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে চিনিয়ে নিয়ে এল থাকার জায়গায়। থাকার ব্যবস্থাটাও এই পরিবেশের সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্য পূর্ণ। সাদা রঙ করে আলপনা দেওয়া ইটের দেওয়ালের ওপর খড়ের ছাউনির পরপর দুটি ঘর। সামনে খানিকটা ফাঁকা ঘাসের জমির ওপর যত্ন করে লাগানো কিছু ফুলগাছ। অন্যদিকে সুপারি গাছের পাশে বাঁশের মাচা, বসার জায়গা।
আর বাঁশের বেড়ার লাগোয়া একটা বড় ও আরেকটা মাঝারি গোছের পুকুর। ঘরের ভিতর কোন তথাকথিত হোটেলের প্রাচুর্যতা না থাকলেও রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। রঙবেরঙের কাজ করা হাতপাখা, র্যাকের ওপর বেশ কিছু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও ইংরেজি পেপারব্যাক সাজানো, সাদা কলাই-এর থালার ওপর হাতে আঁকা সুন্দর কিছু সুভ্যেনির, আর সারা দেওয়াল জুড়ে আলপনা। এককথায় এই ছোট্ট ঘরেও যেন এক মনোরম গ্রাম্যতা। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে একেবারে গিয়ে বসলাম ভাতের পাতে। সঙ্গে আলুভাজা, ডাল, লাউ চিংড়ির তরকারি, মাছ ও চাটনি, এককথায় অনবদ্য।
রসনাতৃপ্তির শেষে এবার দ্বীপ ঘুরে দেখার পালা। আমাদের বিকেলের গন্তব্য তিন কিমি উত্তরের বালিয়াড়া সৈকত। শুরুর দিকে রাস্তা ভাঙা হলেও পরের পুরো রাস্তাটাই ঢালাই করা। অতএব যাওয়ার খুব বিশেষ অসুবিধা হলো না। রাস্তার দু-ধারে ধানক্ষেত, কোথাও আলু বা লঙ্কার ক্ষেত, কোথাওবা মাচা থেকে ঝুলছে কুমড়ো। মাটিতে ছড়ানো গাছে টমেটো। দেখতে দেখতে রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে ভ্যান চালক দাদার নির্দেশানুযায়ী ডান দিকে ঝাউবনের মধ্য দিয়ে খানিক হেঁটে বালিয়াড়ি।
যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। শীতের অস্তগামী সূর্যের গোধুলির স্নিগ্ধ আলোর সঙ্গে বিশালাকার সৈকতের নীরবতা মিশে এক অদ্ভুত রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে। সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তির বুক চিরে ভেসে আসছিল সিগাল ও টার্নারদের বিষন্ন স্বগতোক্তি। সন্ধ্যা ঘনাল সৈকতে। একটা আবছা অন্ধকারের জালের ঘেরাটোপে প্রকৃতি যেন তার সকল চিত্রপটের ওপর যবনিকা টেনে দিচ্ছে। এই প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা ছেড়ে এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরে চা, চিঁড়েভাজা, দিয়ে একপ্রস্থ জমাটি আড্ডা শুরু হল। রাত নটায় উত্তম আমাদের জন্য খাবার নিয়ে উপস্থিত - গরম রুটি, দেশি মুরগির মাংস ও মিষ্টি।
ভোরবেলা পাখির কোলাহলে ঘুম ভাঙল। আজকের গন্তব্য কাঁকড়ামারির চর - পাখি দেখার এক আদর্শ জায়গা। সকাল সাতটার মধ্যে চরে পৌঁছালাম, তখনও কুয়াশা ভালো করে কাটেনি। ভ্যানচালক বললেন, "কাল চারদিক পরিষ্কার ছিল।" প্রকৃতির খেয়ালের সঙ্গে পেরে ওঠা দুষ্কর। মাঝে মাঝেই নিবিড় নিস্তব্ধতা ভেঙে পাখিদের ডানার শব্দ আর সুমিষ্ট ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। চালকের ইশারায় দেখি একজোড়া কমন কিংফিশার এক দৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়ে বসে আছে। আমাদের উপস্থিতি তাদের ধ্যানে কোন বিঘ্ন ঘটায়নি জেনে আশ্বস্ত হলাম। সতর্ক দৃষ্টিতে আমরা কখনও জলের দিকে, কখনও ঝোপঝাড়ের দিকে ও গাছের ডালের ওপর চোখ রেখে এগিয়ে চললাম। এগোতে এগোতে বুঝতে পারছি গাছগুলো ক্রমশ ঘন হয়ে একে অপরের হাত ধরে সমস্ত জায়গাটাকে বেড়া দিয়ে রেখেছে। মাথার ওপর একটা গাছে তখনো কতগুলো টিয়া ঘুম থেকে ওঠেনি। তাদের আর বিরক্ত করার ইচ্ছা হল না। খুব কাছ থেকে পাখির ডানাঝাপটানো আওয়াজ শুনে দেখি একটা হোয়াইট বিলড সি ঈগল মরা গাছের ডালে বসে। কানে আসছিল ফিঙের শিস্। ইতি-উতি চাইতে ফিঙে দম্পতিদের দেখে এবার আমরা অন্যরাস্তা ধরলাম। ভাটা চলতে থাকায় কতগুলো স্যান্ডপাইপারও চোখে পড়ল। আরও খানিক এগোনোর পর পাখিদের তীব্র কলতান কানে আসল। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখি, একটা কাঁটা ঝোপের ওপর পাঁচটা বার্ন সোয়ালো বসে তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে। পাখি দেখা সাঙ্গ হল।
আজ মৌশুনী দ্বীপ ছেড়ে বেরোনোর পালা। ঘরে ফিরে চটপট টিফিন খেয়ে, জিনিসপত্তর নিয়ে নদীপথের রাস্তা ধরলাম - পরের গন্তব্য 'হেনরি আইল্যান্ড'-এর উদ্দেশ্যে।
বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত অনিরুদ্ধের ছোটবেলা থেকেই নানান ভ্রমণ পত্রিকা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, জিম করবেট পড়ে, বিভিন্ন লেখায় বর্ণিত জায়গাগুলিকে দেখার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন কলেজে উঠে। ২০০৫ থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে তথা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ও কর্মসূত্রে বিদেশের এমন অনেক জায়গা দেখেছেন, যার নাম হয়তো কম মানুষই শুনেছেন। জীবনে খুব সহজ তিনটি বিষয়ে বিশ্বাস করেন – যা দেখব, যা শিখব এবং যা খাব - তাই-ই সঙ্গে যাবে, বাকি সব এই পৃথিবীতেই পড়ে থাকবে। তাই সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রের অমোঘ টানে নিরন্তর ছুটে চলেছেন।