অল রোডস লিড টু রোম
শ্রাবণী ব্যানার্জী
~ রোমের আরও ছবি ~
জানি না কেন সেই ছোটবেলা থেকেই 'ভিনি ভিডি ভিসি' – এই তিনটি লাতিন শব্দ আমার কানে ছন্দের মত বাজত। শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার পড়তে পড়তে বারবার মনে হত কোথায় সেই রোম যেখানে থাকতেন সেই যুদ্ধবিজয়ী নায়ক যিনি বলেছিলেন এলাম দেখলাম ও জয় করলাম?
জুলিয়াস সিজার থেকে জুলাই মাসটা এসেছে শুনে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম, আবার পরক্ষণেই মনে হয়েছিল হায়! একই মাসে জন্ম হয়েও আমাদের দুজনের মধ্যে কত ফারাক! অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার মত প্রেমিক প্রেমিকাদের কাহিনি পড়তে পড়তে মনটা যেন সেই অতীতের রোমেই পাখা মেলে চলে যেত। এই ভাবেই বড় হয়ে 'অল রোড লিডস টু রোম' মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে আমিও জীবনে দুবার রোম শহরে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম।
বহুবছর আগে দেখা রোমের স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা হয়ে আসছিল তাই কয়েক বছর আগে আগস্ট মাসে ছেলেকে নিয়ে আবার রোমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। রোমের ইতিহাস এতটাই বড় ও প্রাচুর্যময় যে লিখতে গেলে কোনও থই পাওয়া যাবে না। দুহাজার বছর আগের 'জুলিয়াস সিজার' নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলারের ধামাধরা 'মুসোলিনি' – কোন ডিকটেটরকে ফেলে কাকে ধরব কিছুই বুঝতে পারি না।
শোনা যায় রোম নামটা আসে রোমুলাস থেকে। সে ও তার ভাই রোমাস দুজনেই ছিল রোমান দেবতা মার্স-এর ছেলে। এক সময় রাজত্বের লোভে ভাই রোমাসকে খুন করে রোমুলাস ছোট ছোট সাতটি পাহাড়ের ওপর রোম প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম থেকেই রোমানরা সব কিছুতেই গ্রিকদের নকল করত, মায় দেবতাদের পর্যন্ত। গ্রিক দেবতাদের সর্বময় কর্তা ছিলেন 'জিউস', তিনিই হলেন রোমানদের 'জুপিটার'। গ্রিক সমুদ্র দেবতা 'পোসাইডন' ও রোমান্টিক নারী দেবতা 'আফ্রোদিতি' যথাক্রমে রোমানদের কাছে হয়ে গেল 'নেপচুন' ও 'ভেনাস'। রোমানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করত কী শিক্ষাদীক্ষায়, কী সংস্কৃতিতে, কী বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় গ্রিকদের সমকক্ষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাই একশো ছেচল্লিশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিস জয় করার পর ক্রীতদাস হিসাবে ধরে আনা এই গ্রিক বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞদের চিন্তাধারা কাজে লাগিয়েই রোমানরা একসময় সারা ইউরোপ জুড়ে রাজত্ব করেছিল।
টাইবার নদীর ধারে সাত পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটা প্রথম থেকেই লোকজনকে আকৃষ্ট করে। তবে সত্যিকারের রোমান ইতিহাস আরম্ভ হয় আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে যখন রোমান রিপাবলিকের জন্ম হয়। 'ডেমোক্রেসি' বা গণতন্ত্র শব্দটা এরা গ্রিকদের কাছে থেকে শেখে। তারা মনে করত কোনও একটি রাজার হাতে দেশটা পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়, তাহলে সে শক্তির অপব্যবহার করবে। তাই তিনশো জন লোক নিয়ে সেই সময়ে জন্ম হয় সিনেটের, যদিও জনসাধারণ ভোট দিয়ে দুজন কনসালকে দাঁড় করাত কিন্তু ক্ষমতার আসল চাবিকাঠি থাকতো এই সিনেটারদের হাতেই। উচ্চবিত্ত লোকেরা নিজেদেরকে বলত 'প্যাট্রিসিয়ান', অর্থাৎ অভিজাত বা আপার ক্লাস। আর সাধারণ লোকেদের তারা নাম দিয়েছিল 'প্লেবিয়ান'।
সাধারণ লোকেরা যখন খেয়াল করল প্রায় দুশো বছর ধরে তাদের হাতে কোনও ক্ষমতাই নেই, অর্থাৎ যা কিছু নিয়ন্ত্রণ সবই প্যাট্রিসিয়ানদের হাতে তখন তারা ক্ষেপে গিয়ে বিদ্রোহ করল আর ঠিক সেই সময়েই বিভিন্ন যুদ্ধ জয় করে তাদের লিডার হয়ে এল জুলিয়াস সিজার। গল অর্থাৎ এখনকার ফ্রান্স জয় করার পর সিজারের প্রতিপত্তি এতটাই আকাশছোঁয়া হয়ে যায় যে সিনেটাররা তাকে উপাধি দেয় ডিকটেটর অর্থাৎ যে সর্বেসর্বা। ক্ষমতায় আসার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি গরিবদের ট্যাক্স কমিয়ে ও বড়লোকদের ট্যাক্স বাড়িয়ে দিয়ে পয়সাওয়ালা সিনেটারদের চটিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, সুন্দরী ক্লিওপেট্রার মোহে পড়ে ঈজিপ্টের মত জেতা রাজ্যটা যখন আবার ক্লিওপেট্রার হাতেই ছেড়ে দিলেন, সিনেটাররা আর সহ্য করতে না পেরে খ্রিষ্টপূর্ব চুয়াল্লিশ সালে জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করল।
জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর জনসাধারণ তাঁর পালিত পুত্র অগাস্টসকে রোম সাম্রাজ্য চালানোর দায়িত্ব দেয়। এই অগাস্টসই ছিলেন প্রথম সম্রাট যিনি রোমকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন। তাঁর সময়েই তৈরি হল পৃথিবীর সব থেকে বড় স্টেডিয়াম যার নাম 'সার্কাস ম্যাক্সিমাস' অর্থাৎ সবথেকে বড় সার্কেল বা বৃত্ত। এই স্টেডিয়ামে প্রায় আড়াই লক্ষ লোক বসে খেলা দেখতে পারতো যার বেশির ভাগটাই এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। এই অগাস্টস বা অক্টাভিয়ানই প্রথম গরিবদের জন্য আবাসন তৈরি করেন যাতে প্রতিটি মানুষই ভালোভাবেই থাকতে পারে। ওঁর সভাতেই 'হোরেস' ও 'ভার্জিল'-এর মত কবিরা যাতায়াত করতেন, দুঃখের বিষয়ে এই অগাস্টস-এরই বংশধর নিরোর হাতে এসে পুরো রোমই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। নিরোর এতই কুখ্যাতি যে বলা হয় চৌষট্টি খ্রিস্টাব্দে রোম শহর যখন আগুনে পুড়ছিল তখন নাকি তিনি ফুর্তিতে বেহালা বাজাচ্ছিলেন। এরপর ট্রাজন ও হেড্রিয়ানের মত আরও কয়েকটি শক্তিশালী সম্রাটের পর ধীরে ধীরে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রাধান্য পেতে থাকে আর তার ফলস্বরূপ এই রাজ্যের ক্ষমতা অনেকটাই আর্চবিশপদের হাতে চলে যায়। অবশেষে চারশো খ্রিস্টাব্দে ভিসিগথ ও ভ্যান্ডালদের মত জার্মান উপজাতির লোকজন এসে পুরো রোমটাই লুটেপুটে ধ্বংস করে দেয়, তাই আজও এই ধরনের কাজকে আমরা ভ্যান্ডালিজম বলে থাকি।
রোমে আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল 'কলোসিয়াম'। চতুর্দিকে আধুনিক রোম শহরের মধ্যে প্রাচীন রোমের কিছুটা অংশ আলাদা করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। দুহাজার বছরের পুরোনো এই ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়ালে নিজের মনটাও যেন সেই অতীতের রোমে চলে যায়। আশি খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ভেসপাচিয়ান এই বিশাল গোল কংক্রিটের স্টেডিয়ামটি তৈরি করেন। তার কিছুদিন আগেই রোমানরা আগ্নেয়গিরির ছাই ও চুন মিশিয়ে পৃথিবীতে প্রথম কংক্রিট আবিষ্কার করে। চতুর্দিকে আর্চ দিয়ে ঘেরা এই চারতলা উঁচু স্টেডিয়ামে একসঙ্গে পঞ্চাশ হাজার লোক বসে খেলা দেখতে পারতো। কংক্রিটের স্টেজের নীচটা ছিল স্টোরেজের জায়গা, সেখানে অন্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ওরা বড় জন্তু জানোয়ারদেরও খাঁচায় পুরে রাখার ব্যবস্থা করেছিল।
রোমানরা কোনও ছোটখাটো জিনিস তৈরি করত না, এদের সবই খুব বড় মাপের, তা সে স্টেডিয়ামই হোক বা জনতার জন্য স্নানাগারই হোক। পুরো স্টেডিয়ামটাই দেখলাম বড় বড় আর্চ দিয়ে ঘেরা, যেটা নাকি একসময় সুন্দর সুন্দর স্ট্যাচু দিয়ে সাজানো ছিল। আজও দেখলাম কয়েকটি স্ট্যাচু অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলাবাহুল্য নতুন অবস্থাতে সেটা যে কত সুন্দর ছিল ধ্বংসাবশেষ দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এই স্টেডিয়ামের ভেতরে জল নিয়ে যাবারও ব্যবস্থা ছিল যাতে লোকে নকল জলযুদ্ধ দেখাতে পারে। দুহাজার বছর আগেও রোমান ইঞ্জিনিয়ারিং এতটাই জোরালো ছিল যে অনেক ব্যাপারেই আধুনিক ডিজাইনের সঙ্গে কোনও তফাৎ পাওয়া যাবে না।
এই কলোসিয়ামের স্টেজটাকে ঘন জঙ্গল করে সাজিয়ে তার মধ্যে হিংস্র জন্তু জানোয়ার ছেড়ে তারা নকল শিকারের খেলা দেখাত, আর কখনও বা সেটাকে বাস্তবায়িত করতে দাগী আসামীদের হিংস্র জন্তুদের মুখে ছেড়ে দেওয়া হত। সম্রাটের সামনে এই স্টেজেই গ্ল্যাডিয়েটাররা একে অন্যের সঙ্গে মরণ খেলা খেলত। শোনা যায় সম্রাট ট্রাজন একশো সাত খ্রিস্টাব্দে 'ডাসিয়া' যুদ্ধ জয় করে একশো তেইশ দিন ধরে এগারো হাজার জন্তু ও দশ হাজার গ্ল্যাডিয়েটরের খেলা দেখিয়ে লোকজনকে আনন্দ দিয়েছিলেন। বারবার মনে হচ্ছিল আহা কোনও যাদুবলে এই বিশাল স্টেডিয়ামটাকে যদি গোটা অবস্থায় ফিরে পাওয়া যেত!
যদিও কলোসিয়ামের পাশেই ঐতিহাসিক রোমান ফোরাম তবুও ঠিক করলাম তাড়াহুড়ো করে না দেখে অন্যদিন হাতে সময় নিয়ে আসব। প্যান্থিয়নের দিকে রওনা দিলাম। গ্রিক ভাষায় এই প্যান্থিয়নের মানে হল সকল দেবতার মন্দির। এই বিশাল গোলাকৃতি ডোমটাই একমাত্র ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। দুহাজার বছর আগেও যে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সমান একশো বিয়াল্লিশ ফিটের ডোম বানানো যেত সেটা যেন না দেখলে ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। যদিও ঢোকার মুখে সম্রাট আগ্রিপার নাম লেখা আছে, কিন্তু সম্রাট হেড্রিয়ানই এটাকে সুন্দর ভাবে শেষ করেন। এই প্যান্থিয়নের ভেতরেই শিল্পী রাফায়েলের সমাধি রয়েছে। ডোমের ছাদটা দেখলাম গোল করে কাটা যাতে আলো ঢুকতে পারে, তবে আমরা যখন গেলাম তখন আলোর থেকে বৃষ্টির জলই বেশি ঢুকছিল। দু-হাজার বছর আগেও তারা এত সুন্দর ড্রেনেজের ব্যবস্থা করেছিল যে আজও মেঝেতে এতটুকু জল জমে না। প্যান্থিয়নের ভেতরটা দেখলাম সুন্দর কারুকার্য খচিত স্তম্ভ দিয়ে সাজানো। প্যান্থিয়নে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে বৃষ্টি থামলে আমরা 'পিয়াজা নাভোনা'র দিকে রওনা হলাম।
রোম শহরে যত্রতত্রই বিখ্যাত ভাস্কর বার্নিনির তৈরি ফোয়ারা চোখে পড়ে, 'পিয়াজা নাভোনা'ও তার ব্যতিক্রম নয়। এই বিশাল লম্বাটে স্কোয়ারটি যদিও তৈরি হয় দু-হাজার বছর আগে, তবে বার্নিনি এখানে ফোয়ারাটি করেন ষোলোশো একান্ন সালে। এই ফাউন্টেন অফ ফোর রিভারস-এ দেখলাম চারটে বড় বড় স্ট্যাচুর গা দিয়ে জল পড়ছে, সেগুলি যথাক্রমে ভারতবর্ষের গঙ্গা, ইউরোপের দানিয়ুব, দক্ষিণ আমেরিকার প্লাটা নদী ও ঈজিপ্টের নীল নদকে বোঝানো হচ্ছে।
এরপরে যে স্কোয়ারে গেলাম তার নাম 'পিয়াজা দ্য পোপোলো' অর্থাৎ পিপল স্কোয়ার। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে সেটা হল একটা বিশাল ওবেলিকস, সেটি সম্রাট অগষ্টস ঈজিপ্টের টেম্পল থেকে তুলে এনেছিলেন। প্রথমে এটা সার্কাস ম্যাক্সিমাসে ছিল, পরে এখানে লাগানো হয়। মাত্র দুশো বছর আগেও এখানে লোকজনের সামনেই আসামীদের হত্যা করা হত।
সেদিনের লাঞ্চ কাছেই একটা রেষ্টুরেন্টে স্প্যাগেটি দিয়ে সারা হল, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর প্রাচীন রোমের সব থেকে চওড়া রাস্তা 'ভিলা ডেল কোরসো' দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। খেয়াল করলাম এখানে কষ্ট করে হাঁটতে হয় না, মোটামুটি লোকজনের ঠেলাতেই অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায়। রাস্তার দুধারে অজস্র নামীদামী দোকান, কারণ এটা নাকি রোমের ফ্যাশন পাড়া। এই ভাবে লোকজনের গুঁতো খেতে খেতে একসময় আমরা 'স্প্যানিস স্টেপস' পৌঁছে গেলাম।
স্প্যানিশ এম্বাসি কাছে থাকায় রাস্তার ওপর এই সিঁড়িগুলোর লোকে নাম দেয় স্প্যানিশ স্টেপস। দেখলাম জায়গাটা নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ার বা কোলকাতার ধর্মতলার মতনই জমজমাটি। সামনেই বার্নিনির তৈরি ফোয়ারাতে সিংহের মুখ দিয়ে জল পড়ছে আর লোকজন মনের আনন্দে গাইছে – এককথায় বেশ ফুর্তির জায়গা। স্প্যানিশ স্টেপের পাশেই একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ইংরেজ কবি কিটস-এর যক্ষা রোগে মৃত্যু হয়।
এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে প্রায় সন্ধের দিকে ট্রেভি ফাউন্টেন দেখতে গেলাম। ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনে দাঁড়িয়ে বহুবছর আগেকার একটা স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। এর খুব কাছেই একটা দোকানে জুতো কিনতে গিয়ে আমি বেশ কিছু সোনার গয়না সমেত ব্যাগ ফেলে এসেছিলাম। ইতালির মত জায়গাতে ব্যাগটা ফেরত পাব সে আশা বিশেষ ছিল না, তবুও পরের দিন গিয়ে বর্ণনা দিতে এক সুদর্শন যুবক একটু হেসে ব্যাগটা ফেরত দিয়েছিলেন। আজও দেখলাম তিনি সেই একই দোকানে কাজ করছেন, শুধু তফাতের মধ্যে এখন তাঁর চুলগুলো পুরোটাই সাদা। মনে মনে ভাবলাম আমাকে চিনতে পারলে সেও হয়তো বলত 'তুমিও আগের মত নেই বন্ধু'। আমার মধ্যেও কি আর অতীতে ফেলে আসা সেই চূড়ান্ত অগোছালো হাসিখুশি তরুণীটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে?
সতেরোশো বত্রিশ সালে সালভি এই ট্রেভি ফাউন্টেন ডিজাইন করেন, দেখে মনে হয় যেন সমুদ্র দেবতা নেপচুন ঘোড়ায় টানা রথে চেপে জলের মধ্যে দিয়ে ধেয়ে আসছেন। জলটা অবশ্য আসছে দুহাজার বছরের পুরোনো অ্যাকুইডাক্ট থেকে। এই অ্যাকুইডাক্টও রোমানদের আবিষ্কার। বহু দূরের জলাশয় বা নদী থেকে বড় বড় আর্চের ওপর পাইপ বসিয়ে সেই জল তারা শহরে টেনে আনতো। হঠাৎ খেয়াল করলাম বেশ কিছু বাংলাদেশি ছেলে নবদম্পতি ও অল্পবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফ্রিতে গোলাপ ফুল অফার করছে – দেখে মুগ্ধ হয়ে ছেলেকে বললাম 'দ্যাখ এরা কত ভালো, ফ্রিতে দেবে বলছে।' চটপট জবাব পেলাম যে, গোলাপটা ফ্রি নাকি মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, কারণ গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ওদের থেকে ছবি না তোলালে সঙ্গে সঙ্গেই হাত থেকে কেড়ে নিচ্ছে। আমি তো শুনে হাঁ!
লোকজন দেখলাম ট্রেভি ফাউন্টেনের ভেতর পয়সা ফেলছে যাতে তারা আবার রোমে ফিরে আসতে পারে। মনে পড়ে গেল বহুবছর আগে আমিও এই ট্রেভি ফাউন্টেনে পয়সা ফেলে প্রার্থনা করেছিলাম যেন আবারও আমি এই রোমে ফিরে আসতে পারি। ফিরে তো আসতেই হবে একবার কেন হয়তো বারবারই ফিরে আসতে হবে, কারণ রোম যে সেই চিরন্তন শহর যা বারবার দেখেও পুরনো হয় না, আজও যে এর আকাশে বাতাসে অ্যান্টনি, ক্লিওপেট্রা ও জুলিয়াস সিজারের মত নায়ক নায়িকারা ঘুরে বেড়ান, দুহাজার বছরেও যাঁদের স্মৃতি এতটুকু ম্লান হয় নি। আজও কল্পনায় রাস্তাঘাটে সেই রণসাজে সজ্জিত রক্তমাখা গ্ল্যাডিয়েটরদের পদধ্বনি শোনা যায় আর পাঁচশো বছর পরেও দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, বার্নিনি ও মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মত শিল্পীদের হাতের কাজ দেখতে দেখতে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। তাই এবারেও পয়সা ছুঁড়ে আমাকে বলতে হল – 'আবার আসিব ফিরে'।
সেদিনের মত বেড়ানোর ইতি টেনে পরেরদিন সকালেই ভ্যাটিকান সিটির দিকে রওনা হলাম। রোম শহরের মধ্যে এটি একটি সম্পূর্ণ আলাদা দেশ, এমন কী এর পোষ্ট অফিসও আলাদা। অত সকালে উঠেও দেখলাম কোনও লাভ হল না, কারণ ঝাঁকে ঝাঁকে ট্যুরিষ্ট আমাদের অনেক আগেই সেখানে পৌঁছেছেন। যাইহোক বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলাম। প্রথমেই গেলাম সেন্ট পিটার স্কোয়ারে যেখানে পোপ জনসাধারণকে দর্শন দিয়ে থাকেন। কারণ তার সামনেই সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা। এই পরমশ্রদ্ধেয় সেন্ট পিটার ছিলেন যীশুর সাক্ষাৎ শিষ্য, ক্রুসিফিকেশনের বহু বছর বাদে সেন্ট পিটারের হাড়গোড় কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায় আর সেইগুলিই এই চার্চের ভেতরে স্থান পায়। বিশাল চার্চটি এতটাই সাজানো যে ঢুকে যেন চোখ ঝলসে যায়।
মার্ক বলে একটি আমেরিকান ছেলে আমাদের খুব যত্ন করে এই চার্চের ভেতরে প্রতিটি জিনিসের মানে ব্যাখ্যা করে বোঝাল আর সত্যি কথা বলতে কী সেদিন এই ছেলেটির সাহায্য না পেলে গাইড বই পড়ে পড়ে পুরো চার্চটা দেখতে কতঘন্টা সময় লাগত ভগবানই জানেন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এই মার্ক আমেরিকার 'ইয়েল' বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টহিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করে।
এই ব্যাসিলিকার মধ্যেই মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর তৈরি 'পিয়েটা' দেখতে পেলাম যেখানে মা মেরী মৃত যীশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। এই শ্বেতপাথরের ভাস্কর্যটা এতটাই নিখুঁত যে ভাবতে অবাক লাগে মাত্র তেইশ বছর বয়সে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এটি তৈরি করেছিলেন। শ্বেতপাথরটা এতই পাতলা করে কাটা হয়েছে যে হঠাৎ করে মনে হয় যেন পাতলা সাদা কাপড়ের মধ্যে দিয়ে যীশুর দেহটা ফুটে বেরোচ্ছে। এই তিনশো চল্লিশ ফিট চার্চের বিশালতা পুরোটা ক্যামেরায় ধরাও যায় না।
ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে রাফায়েল, বার্নিনি, বত্তিচেলি ও মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মত শিল্পীদের হাতের কাজ দেখতে দেখতে রীতিমত মাথা ঝিমঝিম করে, মনে হয় চোখকে একটু বিশ্রাম দেওয়া ভালো। প্রায় বারো হাজার স্কোয়ার ফিট সিলিং চোখের অত কাছ থেকে এঁকে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। একটা দরজার মুখে দেখলাম সুন্দর নীল বেনারসীর মত চাঁদোয়া ক্লিপ দিয়ে লাগানো। তার বেশ কিছু জায়গা রীতিমত ভাঁজ হয়ে ফুলে থাকাতে ভাবলাম যে লাগিয়েছে সে হয়তো ঠিকভাবে লাগাতে পারে নি। আমি চট করে একটু কাপড়টার গায়ে হাত বুলোতে গিয়ে রীতিমত বোকা বনে গেলাম – কারণ সেটা কাপড় নয়, রং তুলির টানে এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে সামনে দাঁড়িয়েও বোঝার উপায় নেই। সিস্টিন চ্যাপেলে সারা সিলিং জুড়ে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর 'ক্রিয়েশন অফ আদম' ও 'ক্রিয়েশন অফ ওয়ার্ল্ড' দেখতে দেখতেই অনেক সময় কেটে যায়। দেওয়াল থেকে সিলিং যেদিকেই তাকাও শুধু পেন্টিং আর পেন্টিং, কোথাও এক অংশও ফাঁকা নেই।
পরের দিনের গন্তব্যস্থল ছিল রোমান ফোরাম। যদিও ফোরাম কথাটার মানে বাজার কিন্তু দুটি পাহাড়ের মাঝে এই উপত্যকা ছিল প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্পট। এর একদিকে প্যালাটাইন হিল। যেখানে থাকতেন সম্রাট অগাস্টস। আর অন্যদিকে ক্যাপিটোলাইন হিল। রোমানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জয় করে এই ফোরামেই সেলিব্রেট করতে আসতো। এখানেই জুলিয়াস সিজার ঈজিপ্টের রানি সুন্দরী ক্লিওপেট্রাকে অভ্যর্থনা জানান। এই ফোরামে ঢোকার মুখেই একটি বিশাল আর্চ চোখে পড়ে, যার নাম টাইটাস আর্চ। সত্তর খ্রিস্টাব্দে জেরুসালেম জয় করার পর সম্রাট টাইটাসের সম্মানে এই আর্চটি তৈরি করা হয়। দুহাজার বছর বাদেও সেই একই জায়গাতে রোমের অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই বিরাট কোর্ট হাউসের ভেতরে দাগী আসামীদের বিচার হত যার বেশির ভাগটাই এখন ধ্বংস। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের কিছু কিছু আইন এখনও চালু আছে। বিশাল আকারের ভেস্টাল মন্দিরটা আজও পরিষ্কার বোঝা যায়, যেখানে প্রাচীন রোমের নিয়মানুযায়ী ছটি কুমারী মেয়ের কাজ ছিল সারাক্ষণ রোমের পবিত্র আগুনটা জ্বালিয়ে রাখা। এই ফোরামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা হীরে, মুক্তো ও সিল্কের জামা কাপড় বিক্রি করতে আসত। এখানেই সিনেট হাউসে সাদা কাপড় অর্থাৎ টোগা পরে অন্যান্য সিনেটারদের সঙ্গে জুলিয়াস সিজারও কাজে আসতেন। এই ফোরামই ছিল প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।
অনেকেরই ধারণা যে জুলিয়াস সিজারকে এই রোমান ফোরামের মধ্যেই সিনেট হাউসের সামনে হত্যা করা হয়। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল। এই বিল্ডিংটা সেই সময়ে সারানো হচ্ছিল তাই সেদিনের সিনেটের মিটিং ডাকা হয় পম্পে থিয়েটারে। পরে তার মরদেহ এই রোমান ফোরামে নিয়ে এসে দাহ করা হয়। শোনা যায় পরমপ্রিয় ও শিষ্য ব্রুটাসের ছুরির আঘাত সহ্য করতে না পেরে তার মুখ দিয়ে সেই অন্তিম বাক্য বেরিয়ে এসেছিল – "এ ত্যু ব্রুত?" অর্থাৎ ব্রুটাস তুমিও? সেই জায়গায় অর্থাৎ টেম্পল অফ সিজারে ঢুকে দেখলাম আজও লোকজন তাঁর সম্মানে ফুল রেখেছেন। জানি না কেন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল, মনে হল গোটা ফোরামটা যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। যেন সামনেই দেখতে পেলাম জুলিয়াস সিজারকে দাহ করা হচ্ছে আর উন্মত্ত জনতা ক্ষেপে গিয়ে ফোরামের চতুর্দিকে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তাদের প্রিয় নেতাকে যারা খুন করেছে তাদের শেষ না দেখে জনতা ছাড়বে না।
বেশ কিছুক্ষণ বোধহয় ঘোরের মধ্যেই ছিলাম, তাই হঠাৎ পায়ে একটা নরম কিছুর স্পর্শ পেয়ে যেন স্বপ্নভঙ্গ হল। তাকিয়ে দেখি একটা হৃষ্টপুষ্ট বেড়াল আমার পায়ে মাথা ঘষছে। হায় কোথায় সিজার আর কোথায় এই বেড়াল! বাস্তব বড় কঠিন ঠাঁই, এরই পূর্বপুরুষ হয়তো জুলিয়াস সিজারের অতি আদরের বেড়াল ছিল সেই ভেবে তার গলা চুলকে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
এইভাবেই হাঁটতে হাঁটতে প্যালাটাইন হিল-এ সম্রাট অগাস্টস-এর বাড়ির কাছে চলে এলাম। যদিও বাড়িটা এখন অনেকটাই ধ্বংস তবুও তার সাইজ দেখে মনে হল অগাস্টস বেশ সাদামাটা ভাবেই থাকতেন। এর খুব কাছেই অগাস্টস-এর তৈরি সার্কাস ম্যাক্সিমাস, যেখানে দুহাজার বছর আগে আড়াই লক্ষ লোক বসে খেলা দেখতে পারতো। এখানেই বিখ্যাত চ্যারিয়ট রেস ও গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ দেখানো হত যার বেশির ভাগটা ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছুটা অংশ আজও পরিষ্কার দেখা যায়।
রোমান বাথ-এর কথা এত শুনেছিলাম যে এরপর সোজা চলে গেলাম কারাকালা বাথ দেখতে। রোমানরা বাথরুম বলতে কী বোঝাতো সেটা জানতে হলে অবশ্যই একবার কারাকালা বাথ দেখতে যাওয়া উচিৎ। এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যতটুকু গোটা আছে সেটা দেখলেও বিস্ময় লাগে। এটা বাথরুম নাকি একটা ছোটখাটো শহর ছিল সেটাই বোঝা ভার! প্রায় ষোলশো লোক এখানে একসঙ্গে স্নান করতে পারতো। এটা শুধু স্নানের জায়গাই ছিল না, এর ভেতরে লাইব্রেরি এমনকি আর্ট গ্যালারি পর্যন্ত ছিল, যেখানে নাকি নিয়মিত নাটক দেখানো হত। স্নানের জন্য চতুর্দিকে বড় বড় ফোয়ারা ছিল যেখানে কোথাও গরম আর কোথাও বা ঠান্ডা জল বার হত। সুইমিং পুলের চতুর্দিকে মোজাইকের কাজ দেখে আজও কেমন বিস্ময় লাগে। ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে জানা যায় এখানে ভালো লোকের সঙ্গে সঙ্গে অজস্র পকেটমার ঘুরে বেড়াত, এছাড়াও হকাররা তাদের জিনিস বিক্রির জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জোরে জোরে হাঁক পাড়ত। খাবারের দোকান থেকে মাসাজ পার্লার সবই এই কারাকালা বাথের মধ্যে ছিল। ভাবতে খারাপ লাগে এইসব সুন্দর জিনিস তৈরি করতে কত সময় লাগে অথচ দস্যুদের হাতে ধ্বংস হতে মাত্র একদিন।
ভাবছিলাম আজও তো সারা পৃথিবীতে রোমান হরফ শেখানো হয় তাই আমিও প্রতিটি বিল্ডিং, মন্দির ও সৌধের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে পারছি কবে বা কখন তারা তৈরি হয়েছিল আর লাতিন ভাষায় আজ কেউ কথা না বললেও সারা ইউরোপের সব ভাষার মধ্যেই তো তা ছড়িয়ে আছে। স্প্যানিশ ও পোর্তুগিজ ভাষার মধ্যে লাতিন ভাষার প্রভাব এতটাই যে আজও দক্ষিণ আমেরিকাকে লোকে লাতিন আমেরিকা বলে ডাকে। জুলিয়াস সিজারই প্রথম বারোমাসের সৌর ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। কখনও কী চিন্তা করে দেখেছি এখনও আমাদের সোলার সিস্টেমটা রোমান দেবতাদের নামে চলছে – যথাক্রমে মার্কারি, ভেনাস, মার্স, জুপিটার, স্যাটার্ন, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো!
অতীতের ইতিহাসে এতটাই বিভোর ছিলাম যে বুঝি নি কতটা সময় কেটেছে, হঠাৎ ছেলের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, তার নাকি অত্যন্ত ক্ষিদে পেয়েছে। সত্যিই তো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা তিনটে। ভাবলাম এখান থেকে বেরিয়ে সামনেই যে রেষ্টুরেন্ট পাব তাতেই ঢুকব। এখানে এসে একটা জিনিস খেয়াল করেছিলাম, এদের অনেক কথাই 'ও' তে শেষ হয়। যেমন অ্যান্টনি হয় আন্তোনিও, লরেন্স হয় লরেঞ্জো, এছাড়াও ভ্যালেন্তিনো, অ্যাঞ্জেলো ও লিওনার্দোরা তো আছেনই। হোটেলের গায়ে লেখা থাকে কম্প্লিতো অর্থাৎ ভর্তি। কোথাও লেখা 'ভ্যালিদো' আর কোথাও 'প্রাইভেতো'। ট্রেনের গতির উপর নির্ভর করে কেউ হয় 'এক্সপ্রেসো', কেউ 'র্যাপিদো' আর কোনওটা বা 'দিরেকতো'। রাস্তায় একজনকে রেষ্টুরেন্টের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি সামনের দিকে হাতটা বাড়িয়ে বললেন 'স্ট্রেতো' অর্থাৎ সোজা গেলেই পেয়ে যাবে।
কথাতেই আছে 'হোয়েন ইন রোম ডু, অ্যাজ দ্য রোমান ডু' তাই আমিও সোজা রেষ্টুরেন্টে ঢুকে বললাম "ওয়ানো কফিও", লোকটা শুনে খ্যাক্ খ্যাক্ করে হেসে বলল "নো ওয়ানো - উনো।" যাক্ বাবা কাছাকাছি তো গেছি, ওয়ানো আর উনোতে কতটুকুই বা তফাৎ? চিরতার মত তেতো আর কড়া কফি খেয়ে শরীরের সমস্ত স্নায়ু বেশ চনমনিয়ে উঠল। ছেলেকে পিৎজা খেতে দেখে আমি আর মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বার না করে দু'স্লাইস বোঝাতে দুটো আঙ্গুল তুলে সামনে রাখা পিৎজাটা দেখিয়ে দিলাম। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল দুয়ে? কি আশ্চর্য! এরা কি বাংলাও বলে নাকি? তারপরেই বুঝলাম দুই হলে দুয়ে।
'নি' তে শেষ হওয়া শব্দও দেখলাম খুব বেশি পেছিয়ে নেই। ডিকটেটর মুসোলিনি থেকে ডিজাইনার আরমানি – কারোর দাপটই কিছু কম নয়। বার্বেরিনি প্লাজাতে গিয়ে বার্নিনির ফাউন্টেন দেখে এলাম। ভেতরে হ্যাম ভরা স্যান্ডউইচের নাম পানিনি আবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা রেষ্টুরেন্টের নাম পাপিনি। হঠাৎ করে নিজের নামটাও কানে বেশ ইতালিয়ান ইতালিয়ান ঠেকল – তাই সেদিন ডিনারে পাস্তার অর্ডার দিতে গিয়ে মেনুকার্ডে 'তরতেলিনি', 'কাল্চোনি' ও 'ফেতুচিনি'দের দেখে আমি এই 'শ্রাবণী'-ও কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম।
এইভাবেই রোমে চারটি দিন যেন স্বপ্নের মত কেটে গেল। দ্বিতীয়বার এসেও মনে হল হাতে আর একটু সময় নিয়ে এলেই ভালো হত। এই রোমের আকর্ষণ এতটাই যে বারবার দেখেও পুরোনো হয় না। অতীতের জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির দল আজও রোমের মাটি দাপিয়ে বেড়ান। রাফায়েল, বত্তিচেলি, বার্নিনি ও মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মত শিল্পীদের হাতের কাজ দেখতে দেখতে যেন আর্টের বদহজম হয়ে যায়, তাই সেজেগুজে সন্ধেবেলা একটা ইতালিয়ান অপেরা দেখতে গেলে সেটা যেন অনেকটা অ্যান্টাসিডের কাজ করে। প্রতিদিন পৃথিবীবিখ্যাত ইতালিয়ান কুইজিনে খাওয়ার পয়সা না থাকলে পিৎজার জন্মস্থানে এক স্লাইস পিৎজা নিয়ে রাস্তায় বসে পড়তেই বা বাধা কোথায়?
এক কথায় রোমকে একাধারে খাদ্যরসিক, ইতিহাস প্রেমিক ও আর্ট লাভারদের স্বর্গ বললে অত্যুক্তি হয় না।
~ রোমের আরও ছবি ~
শ্রাবণী ব্যানার্জীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।