আবার সমুদ্রে
তপন পাল
মাসে অন্ততঃ একবার সমুদ্র না দেখলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তা কাছেপিঠে আর সমুদ্র কোথায়! বকখালি যাওয়ার বড় হ্যাপা, আর চাঁদিপুর গেলে ফেরার সময় ১২৮২২ ধৌলি এক্সপ্রেস বড়ই দেরি করে। রাত সাড়ে সাতটার পরিবর্তে সাড়ে নটায় সাঁতরাগাছি নেমে মনে হয় এ কোথায় নামলাম!
অগত্যা ঘরের কাছেই আরশিনগর - দিঘা। ওয়ারেন হেস্টিংস কথিত ব্রাইটন অফ দি ইষ্ট। অবশ্য আমাদের প্রজন্মের কাছে দিঘার এক স্বতন্ত্র আবেদন আছে। দিঘা পর্যটন কেন্দ্রকে জনপ্রিয় করায় 'বিকেলে ভোরের ফুল' নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্রের অবদান রয়েছে। ১৯৭৪-এ চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পায় আমি একাদশ শ্রেণীতে পড়ি। স্কুল কেটে ওই ছবি দেখার ও তৎপরে এক সপ্তাহ 'দিঘা দিঘা দিঘা', 'নীল সমুদ্র ডাকছে' ইত্যকার গানে বুঁদ হয়ে থাকার স্মৃতি এখনও অমলিন। তারপর রেলগাড়ি হয়ে গিয়ে দিঘা তো এখন দিনান্তভ্রমণ গন্তব্য।
তবে কিনা এ বছরে গরমটা বড় বেশি পড়েছিল। তাই পুত্র কন্যার বিরোধিতায় মাস দুয়েক যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বার বার সে কথা বলতে তারা কোথা থেকে এক ওয়ালপেপার এনে পড়ার ঘরের দেওয়ালে লটকে দিল।
ছবিটি বড় ভালো — কালচে সবুজ জল অনুচ্চ তরঙ্গায়িত - কিন্তু বড়ই শান্ত। আমাদের বঙ্গোপসাগরীয় চঞ্চলতায় ওই প্যাসিফিক প্রশান্তি বড়ই বেমানান।
তাই গ্রীষ্ম শেষ হতেই মন চলো বৃন্দাবনে। এবারের পরিকল্পনাটি কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী। সকালে ১২৮৫৭ তাম্রলিপ্ত ধরে সাড়ে নটায় কাঁথি। সেখান থেকে ঘুরেফিরে সন্ধ্যে ছটা কুড়িতে দিঘা থেকে ১৮০০২ কান্ডারী ধরে সাঁতরাগাছি।
উদ্দেশ্য —
১) তমলুক দিঘার মধ্যে রেললাইনের স্মৃতিমেদুর শব্দ শোনা! ভারতে এখন সবখানেই রেলপথ ঝালাই করা। তমলুক দিঘা শাখায় তা অদ্যাবধি ফিশপ্লেট দিয়ে জোড়া। তাই রেলগাড়ি চলার শৈশব সংলগ্ন ঘটাং ঘটাং ঘট আওয়াজ একমাত্র ওই শাখাতেই শোনা যায়।
২) যাত্রাপথের দুধারে বর্ষার ঘন সবুজ ভূচিত্র দেখা।
৩) কাঁথির নাচিন্দা মন্দির ও মারিশদার জগন্নাথ মন্দির দেখা।
৪) 'আমাদের ছুটি'-র ফোরামেই বাঁকিপুটের কিছু ছবি দেখে জায়গাটিকে স্বচক্ষে দেখার বড় ইচ্ছা হল। সঙ্গে জুনপুট, দরিয়াপুর লাইট হাউস, রসুলপুর ও কপালকুন্ডলা মন্দির দেখা।
৫) মন্দারমনি ও শংকরপুর।
রেল যাত্রা —
বাড়ি থেকে সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে সোয়া ছটায় হাওড়া উনিশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়বে। ফাঁকা কামরাগুলি ঢুকতে খুঁজে পেতে সি ১ কোচে উঠে ঊনচল্লিশ নম্বর সিটে বসে পড়া গেল। সিটটি জানলার ধারে। গাড়ি ছাড়ল।
শীতে এই গাড়ি থেকে সূর্যোদয় দেখা এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু এখন দিন বড়। সূর্য অনেক আগেই উঠে পড়েছে। ক্রমে সাঁত্রাগাছি, বাউড়িয়া, উলুবেড়িয়া - থামা না থামা অনেক ইষ্টিশান পেরিয়ে মেচেদা।
বারবার যাতায়াতের সূত্রে এই পথ চেনা। এই তো সেদিন এক সাহেব আর তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে কোলাঘাট ঘুরতে এসেছিলাম। সেই সাহেবের মা ২৭ আগষ্ট, ১৯৪৭ রাত ১১টা ৪৪-এ কোলাঘাট স্টেশনে এক রেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। ১৪আপ হাওড়া নাগপুর প্যাসেঞ্জার কোলাঘাট স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ৮আপ হাওড়া টাটা প্যাসেঞ্জারের পিছনে ধাক্কা মেরেছিল। সাহেব তখন চার বছরের। এই ঘটনার পর পরই সাহেবের পিতা ভারত ছাড়েন। এতদিন বাদে দুই ছেলেকে নিয়ে Historical Family Tour-এ কোলাঘাট দর্শন।
মেচেদা পেরিয়ে পাঁশকুড়ার একটু আগে বাঁদিকে ঘুরে গাড়ি দিঘা অভিমুখে। আদিগন্ত সবুজ পেরিয়ে কাঁথি বেলা সাড়ে নটায়।
তারপর —
দরদস্তুর করে একটা গাড়ি ঠিক হল। সওয়ারি আমি একাই। প্রথম গন্তব্য নাচিন্দা। জাতীয় সড়কের ধারে এই মন্দিরটিকে দিঘা যাতায়াতের পথে দেখেছি অনেকবার। অপ্রথানুগ বিগ্রহের মন্দিরটি আদতে দেবী শীতলার। কিন্তু নতুন গাড়ি কেনার পর জনগণ এই মন্দিরে পূজা দেন। গাড়ির সঙ্গে জগন্নাথদেবের সম্পর্ক আমরা জানি - কিন্তু গাড়ির সঙ্গে ছোঁয়াচে রোগের দেবীর এই সমীকরণ সত্যিই আশ্চর্যের।
উজিয়ে, অর্থাৎ কলকাতার দিকে দশ কিলোমিটার মত গিয়ে মন্দির। মন্দিরচত্ত্বরে তখন ভোগের যোগাড় চলছে - সবজি কোটা, মাছ কোটা - কিন্তু সময় নেই। ভোগ খেতে না পাওয়ার দুঃখ হু হু করে বুকের মধ্যে। কবে কোন কোন খানে গিয়ে ভোগ না খেয়ে চলে আসতে হয়েছে - বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির, রাজবলহাটের রাজবল্লভীর মন্দির, জয়রামবাটির মাতৃমন্দির - সেই দুঃখ বুকের ভেতর থেকে এক পুকুর বিষাদ তুলে আনে যেন।
তারপর জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে সরু রাস্তা ধরে নাচিন্দার বাহিরি জগন্নাথ মন্দির। পরিত্যক্ত ওড়িশি ধাঁচের বিশাল মন্দিরটি চারশো বছরের প্রাচীন। পুরীর রাজা তাঁর প্রজারা কেমন আছে দেখতে একবার এক রাজকর্মচারীকে দূত করে এখানে পাঠিয়েছিলেন। তিনি এসে বন্যারোধ থেকে কৃষি - জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কিছু ব্যবস্থা নেন। তারপর তিনি যখন ফিরতে চান, স্থানীয় জনগণ তাঁকে যেতে দেয়নি। আক্ষেপে তিনি বলেন - না গেলে আমার প্রভুর সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটবে। তখন স্থানীয়রা প্রস্তাব দেন তাহলে আপনার প্রভুকে এখানে আনুন। আপনার ও আমাদের সবাইয়ের জন্য গড়ে ওঠে ওই জগন্নাথ মন্দির।
পরবর্তীতে বিগ্রহ স্থানান্তরিত হয়েছে নতুন মন্দিরে, কিঞ্চিৎ দূরত্বে সেও দাঁড়িয়ে পূর্ণ মহিমায়। জগন্নাথ দেবের নবকলেবরের প্রস্তুতি চলেছে।
ঘুরে ফের কাঁথি - তারপর সরলরৈখিক কাঁথি জুনপুট রাস্তা ধরে জুনপুট। জুনপুটের বিখ্যাত মাটির সৈকত (Clay Beach) দেখার ইচ্ছাটা অনেক দিনের। কিন্তু আজকের জুনপুট যেন এক নেক্রোপলিস - মৎস্য বন্দর থেকে পর্যটন কেন্দ্র — সম্ভাবনা ছিল অসীম; কিন্তু কেন যেন কিছুই হয়ে উঠল না। তাই এক হাঁটু কাদা ভেঙে বৃষ্টিতে ভিজে কাঁকড়া ধরা আর মাছ শোকানোই এর ভবিতব্য।
কাঁকড়া খেতে ভালোই লাগে। কিন্তু কাঁকড়া ধরা যে কী পরিশ্রমসাধ্য ও বিপজ্জনক কাজ, তা আগে জানা ছিল না। কাদা প্যাচপেচে মাঠের ওপরে দুই ব্যক্তিকে নীচু হয়ে কিছু করতে দেখে জিজ্ঞাসা করি, 'কি করছো গো?' 'আজ্ঞে কাঁকড়া ধরছি।' 'তাই নাকি!' চকিতে গামছা পরে আমিও ওঁদের সঙ্গে যোগ দিই। আকাশের নীচে, জল, হাওয়া, সবুজ আর মাটির সান্নিধ্যে চলে আমাদের অভিযান। তাঁদের হাতে লোহার লম্বা শিক। তার মাথাটি বাঁকা। গর্ত দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন কোন গর্তে কাঁকড়া আছে, তারপর শিকটি ঢুকিয়ে বাঁকা মাথায় কাঁকড়ার দাঁড়াটি আটকে তাকে তুলে আনা।
কিন্তু যেখানে গর্ত গভীর, শিক কাঁকড়া অবধি পৌঁছয় না। তখন কাদায় উবু হয়ে বসে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে, হাত ঢুকিয়ে কাঁকড়াকে তুলে আনতে হয়। 'ভয় করে না - গর্তে তো কাঁকড়া ছাড়া অন্য কিছুও থাকতে পারে?' 'সে আর ভাবতে গেলে চলে?' সত্যিই তো - জীবন বড়ই জটিল। সারা সকাল ঘুরে ওঁরা মাত্র দুটি কাঁকড়া পেয়েছেন। আর রয়েছে মাছ শোকানো। বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বাঁশের মাচার ওপরে, বড় বড় সিমেন্টের চৌবাচ্চায় ও ড্রামে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে কত মাছের মৃতদেহ!
লাল কাঁকড়া দেখতে বাঁকিপুট যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কাদায় রাস্তা দুর্গম - সেটি এ যাত্রায় আর হয়ে উঠল না। দরিয়াপুর লাইট হাউসে ভ্রমণার্থীদের ঢুকতে দেওয়া হয় বেলা তিনটের পর, তাই সেটি বাইরে থেকেই দেখতে হল।
সারথি মহোদয় তারপর নিয়ে গেলেন পেটুয়াঘাট দেশপ্রাণ মৎস্য বন্দরে। দশ টাকা টিকিট কেটে ঢুকতে হল। রসুলপুর নদীর তীরে নতুন গড়ে ওঠা বন্দরটিতে ব্যস্ততা তুঙ্গে - কী প্রখর তার বৈপরীত্য জুনপুটের অলস কর্মহীনতার সঙ্গে। প্রায় শ'দুয়েক ট্রলার ঘাটে রয়েছে বাঁধা - কোনটায় বরফ উঠছে, কোনটায় ডিজেল। কোনটা থেকে মাছ নামছে তো অন্যটায় সারেং কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে সহযোদ্ধাদের মধ্যাহ্নভোজনে ডাকছেন। প্রতিটি ট্রলারের মাথায় তিনটি করে জাতীয় পতাকা- সামুদ্রিক ঝোড়ো হাওয়ায় তারা পত পত করে উড়ছে নীল আকাশের পটভূমিকায়।
ঘুরে ফিরে রসুলপুর গ্রাম - ফেরিঘাট। সেখানেও জলে ট্রলার ভাসছে। নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ - জবাব পেলাম ইটাবেড়িয়া। জানি না সত্যি কিনা।
সারথীটি কিঞ্চিৎ বাচাল, কিন্তু কিই বা আর করা যাবে। সেই মহাভারতের যুগ থেকেই সারথীরা বাচাল। তবে বাঁচোয়া যে তিনি গাড়ি চালাতে চালাতেই কথা বলেন। গাড়ি থামিয়ে নয়। তাঁর কথা শুনতে শুনতে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।
রসুলপুর থেকে বেরিয়ে কপালকুন্ডলা মন্দির। ছোটখাটো গৃহস্থবাড়ি সংযুক্ত মন্দির। তারপর কাঁথি ফিরে বিলম্বিত মধ্যাহ্নভোজন।
তাজপুর - সরু রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে অনেকখানি; দুধারে প্রচুর হোটেল। তারপর বিস্তৃত সৈকত। বাঁয়ে নদী এসে সাগরে মিশেছে। নদীর পরপারেই মন্দারমনি।
সৈকতটি সমতল - বহুলবিস্তৃত। একটি বড় ঢেউ এলে জল পা ভেজাতে চলে আসে। অনেক অনেক দূর অবধি সুউচ্চ বাতিস্তম্ভে সৈকত রাতেও আলোকিত, তবে হোটেলগুলি সৈকত থেকে বেশ কিছুটা দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে। হোটেলগুলিতে যাঁরা থাকেন তাঁরা সূর্যাস্তের পর কী করেন, জানতে কৌতূহল ছিল। সৈকতে বেশ ভিড়। দেখে মনে হল অধিকাংশই দিঘা থেকে দিনান্তভ্রমণের পথিক।
এবার শংকরপুর। দশ টাকার টিকিট কেটে সরকারি অফিসের এলাকার মধ্য দিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখি সমুদ্র গ্রাস করেছে সৈকত; জেগে আছে শালখুঁটির বাঁধ। সমুদ্র তখন উত্তাল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, কালো মেঘ সাগরের আয়নায় ঝুঁকে মুখ দেখছে। যতদূর চোখ যায় - আমি আর চা ও আনুষঙ্গিক বিক্রেতারা।
হাতে অনেক সময়। দিঘা থেকে রেলগাড়ি ছাড়বে ছটা কুড়িতে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকি, একা একা।
শেষে উঠতেই হয়। নিউ দিঘা। কাজু কিনে ষ্টেশনে।
ফেরা — তখনও ১৮০০১ কান্ডারী ঢোকেনি। ষ্টেশনে থিক থিক ভিড়। মহিলা, বাচ্চা... দলবল জানতে চায় অসংরক্ষিত কামরাটি কোথায় পড়বে।
অবশেষে ট্রেন ঢোকে। বাতানুকূল কামরা ঝাড়াই পোঁছাই এর জন্য খালি করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেখি কামরার দেওয়ালে তদবধি ১২৮৫৭ তাম্রলিপ্তর আরক্ষণ তালিকা। তাতে আমার নাম জ্বলজ্বল করছে। প্ল্যাটফর্মে ঘুরে দেখি অসংরক্ষিত কামরায় থিকথিকে ভিড়। বহু মানুষ দাঁড়িয়ে।
রেলগাড়ি ছাড়ে। এক ঘুমে মেচেদা পার। সাঁতরাগাছি রাত ৯টা পঁচিশ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।