হো চি মিনের ভিয়েতনামে

রাইসুল সৌরভ


~ ভিয়েতনামের আরও ছবি ~

গত জুনের মাঝামাঝি ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে এশিয়ার একটি আন্তর্জাতিক আইনসমিতির আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই সম্মেলনের ওয়েবসাইটে একটি গবেষণা প্রবন্ধের সারাংশ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম দুরুদুরু বুকে। কিছুদিন পরে ওপার থেকে সাড়া এল সম্মেলনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে। ভিয়েতনাম সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার সেই শুরু। এমনিতে খুব একটা ধারণা ছিল না দক্ষিণ চীন সাগরের পাড়ে বিস্তৃতির পাখা মেলে শুয়ে থাকা লম্বাটে দেশটি সম্পর্কে। শুধু জানতাম তৈরি পোশাক খাতে এই দেশটি আমাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী! চাল রপ্তানিতে দ্বিতীয় কৃষি প্রধান এক দেশ, যারাও নাকি উন্নয়নের মিছিলে শামিল হতে বাংলাদেশের মতই ছুটছে প্রাণপণে। ইন্টারনেট ঘেঁটে আরও জানলাম চলতি সময়ের লু হাওয়াও আমাদের মতোই সেখানেও উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র।
ভিয়েতনাম ভ্রমণে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নিরাপত্তা ছাড়পত্র প্রয়োজন পড়ে। আয়োজকদের মাধ্যমে সেসব জোগাড় করে ভিসাপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ করে ১৩ তারিখে পিঠে দুটি ডানা লাগিয়ে হ্যানয়ের পথে উড়াল দেয়া।
ঢাকা থেকে হ্যানয় সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় যাত্রা বিরতিসহ আকাশে উড়ে উড়েই চলে গেল বার ঘণ্টা। তাই সূর্য যখন হ্যানয়ের মধ্য গগনে তখন যেয়ে নামলাম নৈ বেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। নেমেই দে ছুট সম্মেলনপানে। সম্মেলন যে শুরু হয়ে গেছে আগের রাতেই! বিমানবন্দর থেকে শহরের দিকে যেতে যেতেই মুগ্ধ করল হ্যানয়। প্রশস্ত, পরিষ্কার রাস্তা। ঢাকার মত অসহ্য জট নেই; অযথা ভেঁপুর আওয়াজ নেই। রাস্তার পাশ দিয়ে উদ্যান, ফাঁকা মাঠ, অদূরে অনুচ্চ দালান। এদের বেশিরভাগ বাড়ির বৈশিষ্ট্য হল ওপরের তলার ছাদ টিনের চালের মতো মাঝখানে উঁচু হয়ে দুধারে ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া। ঢাকার মতো সুউচ্চ ঘিঞ্জি বিল্ডিং না থাকলেও তাতে আভিজাত্যের কমতি নেই। সাধারণেই সে অসাধারণ!

যে কোনও সম্মেলনের উপরি পাওনা হল নানা দেশের, নানান বর্ণের, জাতের মানুষের সঙ্গে সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়ে যাওয়া। সম্মেলনের আয়োজক প্রতিষ্ঠান এশিয়াকেন্দ্রিক হলেও অংশগ্রহণকারীর দল মোটেই এশিয়াতে সীমাবদ্ধ ছিলনা; বরং তাবৎ দুনিয়ার বৈচিত্রের মেলবন্ধন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সেখানে। মূলত আন্তর্জাতিক আইনের বহুমাত্রিকতা এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব ও অবস্থানই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। সম্মেলনে যোগ দিয়ে নিজের গবেষণাকর্ম সবার সামনে তুলে ধরা মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও এ যাত্রার অন্যতম বড় অনুষঙ্গ ছিল ভিয়েতনামের মানুষ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে নিজের পরিচয় ঘটানো।
যে ভাবনা সেই কাজ। যাত্রার শুরুতে প্রস্তুতি ছিল হ্যানয় এবং তার আশপাশের অনন্য নিদর্শনসমূহ ঘুরে দেখা। কিন্তু হ্যানয়ে পা রেখে জানলাম ভিয়েতনামের বিখ্যাত নেতা হো চি মিনের নামে নাম রাখা শহরে না গেলে ভিয়েতনাম ভ্রমণ যে বৃথা। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত; আর কাল বিলম্ব নয়, সেদিন রাতেই হো চি মিনের পানে ডানা লাগিয়ে আবার উড়াল দেওয়া। আসলেই তাই; হো চি মিনের সঙ্গে হ্যানয়কে মেলানো দায়। সচরাচর যা ঘটে এখানে তার উল্টো। হ্যানয় কাগজে কলমে ভিয়েতনামের রাজধানীর তকমা পেতে পারে; কিন্তু ভিয়েতনামের পর্যটনের রাজধানীর নাম হো চি মিন! হ্যানয় কিছুটা শান্ত-নিরিবিলি শহর। আর পাঁচটা রাজধানী শহরের মত না। রাত দশটা নাগাদ সেখানে নেমে আসে নির্জনতা। আর তার ঠিক উল্টো হল হো চি মিন। সে শহর কখনও ঘুমায় না; বরং রাতে তার রূপ উপচে পড়ে। সমস্ত আনন্দ-উচ্ছ্বাস রাতের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। আর সমগ্র শহরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত যে জায়গা তার নাম ভুই বেন। কপালগুণে আমাদের আবাসও সেই ভুই বেনে। মধ্যরাতে হো চি মিনের মাটি স্পর্শ করার পর কিসের নিস্তব্ধতা? সমস্ত যৌবন নিয়ে যেন এ শহর পর্যটকদের আগমনকে স্বাগত জানানোর জন্যই অপেক্ষায় রয়েছে। সেই রাতেই তাই আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখা এবং বিনোদনের সকল আয়োজন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা!

কয়দিনের যাত্রা ক্লান্তির সঙ্গে সকালের অলস ঘুম যোগ হওয়ায় পরদিন তাই হোটেলের ব্যবস্থাপনায় শহর দর্শনের আয়োজন মিস করে উপায়ান্ত না পেয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ছুটে চলা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কী প্রতাপের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করে ভিয়েতনামের উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে এনেছিল তারই সাক্ষী যুদ্ধাবশেষ জাদুঘর। ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্রের উত্থানে আতঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ফ্রান্সকে লেলিয়ে দিয়ে সুবিধে করতে না পারায় পরবর্তীতে নিজেই দেশটির উপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে দখলের অপচেষ্টার নিমিত্তে সাধারণ নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ৬৬-তে শেষ হলেও বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্রের মদতে একই ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে দিনানিপাত করতে হয়েছিল। জাদুঘরের একপ্রান্তে স্পষ্ট বাংলায় লেখা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)'র একটি শুভেচ্ছা বার্তা "বিজয়ী ভিয়েতনাম লাল সেলাম, হো চি মিন লাল সেলাম" শোভা পাচ্ছে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাংলা পোস্টার শোভা পেতে দেখা যে কী গর্বের তা এর আগে অনুভূত হয়নি। জাদুঘরের একপ্রান্তে যুদ্ধবন্দীদের অত্যাচারের সামান্য নিদর্শন প্রদর্শনের ব্যবস্থা। আর আছে আমেরিকার ব্যবহৃত সমরাস্ত্র। দেখলে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না; এই বিশাল অস্ত্রের মুখে দরিদ্র ভিয়েতনাম কিভাবে জয় ছিনিয়ে এনেছিল? আসলে অন্যায্য যুদ্ধ যুগে যুগে নিঃস্ব-দরিদ্রের মনোবলের কাছে কালে কালে পরাভূত হয়। যেমনটা হয়েছিল ৭১-এও!

জাদুঘর ঘুরে দেখে শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলা কু চি গুহার দিকে। শহর থেকে বাসে প্রায় দু ঘণ্টার যাত্রাপথ কু চি টানেল। টানেল দেখতে যাওয়ার পথে দেখা হল যুদ্ধের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ানো বর্তমান প্রজন্মের ভিয়েতনামীদের তৈরি কারুপণ্য ও উৎপাদন কৌশল। তবে টানেল দর্শন স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভিয়েতনামীদের গুহা তৈরির কৌশল বা সেখানে কাটানো জীবন বা যুদ্ধ জয়ের রণনীতি জানার জন্য নয়, বরং আমাদের গাইডের নিদারুণ বর্ণনা, দেশের প্রতি তার মমত্ব, চূড়ান্ত রকমের মজা করতে জানা আর তার ইতিহাস জ্ঞানের দরুণ! কী করেনি সে? যেমন চোস্ত তার ইংরেজি, তেমন গানের গলা; তেমনি সে জানিয়েছে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ভিয়েতনামীদের সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, একই শহরের দুই নামের ইতিহাস জানিয়ে আর তাঁর প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব দিয়ে সে মুগ্ধ করেছে আমাদের। গাইড হলে এরকম-ই হওয়া উচিৎ। অথচ প্রথম দেখাতে মনে হয়েছিল অশিক্ষিত বাসকর্মী হয়তো এক!
ভিয়েতনামীরা ইংরেজিতে খুব একটা পারঙ্গম না, তাতে আপাত অসুবিধা হলেও যোগাযোগ থেমে থাকে না। সবকিছুর শেষে দিনান্তে মানুষে মানুষে যোগাযোগের পথে ভাষা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নইলে এই ভরা গ্রীষ্মে ভিয়েতনামে কেন পর্যটকে গমগম করবে? আফসোস হয় শুধু যখন দেখি ঈশ্বর আমাদেরকেও করুণা করতে কার্পণ্য করেননি; কেবল নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতায় পর্যটনশিল্পের যে বিশাল বাজার, সে বাজারে আমরা এখনও অপাঙক্তেয়!

হো চি মিন শহরের পূর্ব নাম সাইগন। এখনও কেউ কেউ সে নামে তাকে ডাকে। হো চি মিন তাঁর মৃত্যুর পূর্বে জানিয়ে গিয়েছিলেন সাইগন তাঁর জন্মভূমি না হলেও তিনি সাইগনেরই সন্তান এবং সাইগন একদিন ভিয়েতনামের অংশ হবেই। তখন তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইলে যেন সাইগনের নাম হো চি মিন নামে নামাঙ্কিত করা হয়। সেই থেকে এ শহর দুই নামেই পরিচিত। তবে ভিয়েতনামীদের যে গুণের প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে তা এঁদের সারল্য এবং পরোপকারিতা। জাতি হিসেবে যথেষ্ট সভ্য। নইলে কী আর রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তায় কেউ ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলে? অন্তত এ বেলায় বাঙালির মতো অসভ্যতা দেখান না তাঁরা। আর যে বিষয়ে এঁরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা হল ট্যাক্সি ব্যবস্থাপনায়। মুঠোফোনে অ্যাপের মাধ্যমে যেকোন শহরেই ট্যাক্সি ডাকার মিনিট ছয়েকের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ট্যাক্সি আপনার দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হবে। সবই মিটার ট্যাক্সি, তাই অযথা দরাদরির কোন প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের তুলনায় ট্যাক্সিসেবা অনেক সস্তাও বটে। অথচ এই পোড়া দেশে ট্যাক্সির টিকিটিও দেখতে পাওয়া এখন ভাগ্যের বিষয়। আর খরচ এবং দামাদামির প্রসঙ্গ না হয় না-ই তুললাম। যে দেশের বিমানবন্দরে নেমে ঠিকমতো ট্যাক্সসেবাটিই পাওয়া যায় না, সে দেশের অপরিচিত গন্তব্যে যেতে অচেনা কোনও ভিনদেশি কোন ভরসায় আসতে চাইবে?

তবে ভিয়েতনামে সে অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি। নারীরা নীতিনির্ধারণে এখনও উপেক্ষিত। ভিয়েতনামী ছেলেরা বয়স্ক বা মোটা মেয়েদের বিয়ে করতে চায় না। কন্যার পিতাদের তাই মেয়েকে রোগা রাখতে তটস্থ থাকতে হয়। তবে নারীরা ওখানে পুরুষের তুলনায় দুর্দান্ত পরিশ্রমী এবং কর্মঠ। সন্তান লালন, ঘরের কাজ এবং উপার্জন সমান তালে করে যান তাঁরা! তবে এঁরা অন্যদের মতো কারও সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে তথাকথিত ভদ্রতা দেখান না। প্রথম দেখাতেই তাই বয়স জানতে চাইবেন। কারণ বয়সে বড় হলে তাঁকে এক নামে সম্বোধন করে সম্মান জানাবেন আর ছোট হলে ভিন্ন নামে ডেকে হৃদ্যতা বাড়াবেন। কত টাকা বেতন পায় তাও নির্দ্বিধায় শুধাবেন। কারণ যে বেশি আয় করে সে চেষ্টা করবে অন্যের জন্য ভাল আয়ের ব্যবস্থা করার। এই হল ভিয়েতনামীদের স্বভাব! এঁদের বেশিরভাগই নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের অনুসারী নন। পূর্বপুরুষদের পুজো করাই তাঁদের ধর্ম। ক্ষুদ্র কিছু জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মানুসারী। এসবই আমাদের মহান গাইড এ্যালেক্সের কাছ থেকে ধার করা জ্ঞান নিয়ে বর্ণনা করা। তবে এঁদের নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই আর কিছু না থাকলেও একটি করে স্কুটি আছে। স্কুটিই তাদের মূল বাহন। ধনীদের অবশ্য নিজস্ব গাড়ি রয়েছে। গাড়ি এখানে আভিজাত্যের প্রতীক। সঙ্গত কারণেই তাই গণপরিবহন সেভাবে চোখে পড়েনি।

আবার ফিরে আসা যাক যুদ্ধ গুহার গল্পে। মূলত ফ্রান্স যুদ্ধের সময় শুরু হয়েছিল কু চি-র গভীর জঙ্গলে প্রায় ২৫০ কি.মি. দীর্ঘ গুহা তৈরির কাজ যার আরও বিস্তৃতি ঘটে মার্কিন আগ্রাসনের সময়। কু চি হল বিষাক্ত গাছ। কু চি বৃক্ষের আধিক্য থাকায় মার্কিনিরা এই এলাকার নামও সে অনুসারে রেখেছিল। যোদ্ধারা গুহার মধ্যেই জীবন যাপন করত। তাদের প্রাত্যহিক কর্মাদি, খাওয়া-দাওয়া, যুদ্ধপরিকল্পনা সবই চলত গুহাতে। সেনারা ব্যবহার করতো টায়ারের তৈরি জুতো। প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিতে যার অগ্রভাগ হতো বিস্তৃত আর পশ্চাৎ সূচালো। গুহায় কোন মার্কিন সেনা প্রবেশ করলে জুতোর গন্ধে প্রতিপক্ষকে চেনা যেত। কারণ টায়ারের জুতো গন্ধ ছড়াত না, অন্যদিকে বৃষ্টিস্নাত এলাকায় মার্কিনিদের জুতো ভিজে দুর্গন্ধ ছড়াত; ফলে আলোবিহীন গুহায় সহজেই শত্রু ঘায়েল করা যেত। এছাড়াও গুহার চারপাশে বিভিন্ন জায়গায় গুপ্ত ফাঁদ পাতা থাকত শত্রুদের বাগে আনতে। যুদ্ধ গুহার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর! ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বর্তমানে ২০ মিটারের মতো ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। তা পাড়ি দিতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা!
যুদ্ধ-বিগ্রহের নিদর্শন দর্শন শেষে হোটেলে ফিরে পরের দিনের ভ্রমণের বন্দোবস্ত করে উদভ্রান্তের মতো শয্যার জোগাড়যন্তর করা। কিন্তু হায়! বিধি বাম। পরেরদিন সকালে আমার সফরসঙ্গী এই শহরে এক বাঙালির দেখা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সফরের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ছুটে চললো তার আবাস পানে। আসলে বেচারা এই কয়টা দিন ভিয়েতনামের অপরিচিত রসনায় অর্ধাহারে–অনাহারে কাটিয়ে বাঙালির দেখা পেয়ে তার দেওয়া গরুর মাংস ভুনা খাওয়ার নিমন্ত্রণ ফেলতে পারেনি। ফলস্বরূপ ভ্রমণ শিকেয় উঠলেও আগে থেকে নিশ্চিত করায় নির্ধারিত ফি থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। যাই হোক, অত:পর দেশি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাংলায় প্রাণখুলে কথা চালিয়ে তার স্থানীয় বন্ধুর সহায়তায় দিনভর চললো টুকটাক কেনাকাটা। বেলাশেষে পুনরায় হ্যানয়ে পথে উড়াল দেয়া।

ভিয়েতনাম সফরের শেষদিন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হা লং বে-র অপরূপ রূপের আস্বাদনে বাস যোগে প্রাতেই গমন করা। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সে রূপের লেশ দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য হল! প্রকৃতি যেন রূপের ডালি সাজিয়ে বসে আছে হা লং বে-তে। ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার দ্বীপ রয়েছে এই উপসাগরে। যাদের নামও বেশ অদ্ভুত! একটার নামতো মোরগ যুদ্ধ দ্বীপ! হা লং বে'র এক পাড়ে রয়েছে পর্যটকদের জন্য কায়াক চালানোর ব্যবস্থা। দু'জন মিলে কায়াক চালাতে চালাতে পাড়ি দিয়ে দেওয়া যায় ছোট্ট সুড়ঙ্গ। কী চমৎকার সে নিসর্গ! শহুরে জীবনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে ডুব দিতে মন চায় হা লং বে'র স্বচ্ছ জলে। জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে আর মধ্যাহ্নভোজন সারতে সারতে সাগরের রূপ চুপি চুপি আস্বাদন করার মধ্যে যে স্বর্গীয় প্রশান্তি রয়েছে তা এই প্রথম উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হল। তবে বিস্ময়ের শেষ এখানেই নয়। সাগর পাড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব নিয়ে বিশাল সুড়ঙ্গ। জেলেরা বাঁদরের দলকে অনুসরণ করে এই সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করেছিল। সুড়ঙ্গটি চমৎকারভাবে সাজিয়েছে পর্যটন কর্তৃপক্ষ এবং তুলে ধরেছে ভিয়েতনামী ঐতিহ্য।

তবে ভিয়েতনাম সম্বন্ধে যে প্রসঙ্গ না পাড়লে এ ভ্রমণ কাহিনি অসম্পূর্ণ থাকবে তা হল তাদের মুদ্রা। এদের মুদ্রার নাম ভিয়েতনাম ডং বা সংক্ষেপে VND। যার সর্বনিম্ন নোটটি ১০০০ মূল্যমানের এবং সর্বোচ্চটির মূল্যমান ৫০০০০০ মাত্র! নোটের অঙ্ক থেকেই অনুমেয় কতটা মূল্য আসলে নোটগুলি বহন করে! বঙ্গ টাকার একটি নোটের বিনিময়ে এদের প্রায় ২৮৫টি নোট পাওয়া যাবে আর শত ডলারের মার্কিন মুলুকের নোটের বিনিময়ে পাওয়া যাবে ২২.৩ মিলিয়ন ডং! এখানে আসলে তাই ডংয়ের হিসাব মেলাতে কিছুটা বিপত্তিতে পড়তে হয়। উপায়ান্ত না দেখে দোকানি কিংবা ড্রাইভারের সহায়তা নেওয়া। সব ডং তার দিকে বাড়িয়ে দিলে সে তার প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তিটা আবার ফিরিয়ে দেয়। অর্ধ লিটারের এক বোতল পানির দাম এখানে ১৮০০০ ডং! এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত ট্যাক্সি ভাড়া নিয়েছিল সাড়ে তিন লক্ষ ডং। কিছু ক্ষেত্রে সে অঙ্ক কোটিতেও যেয়ে ঠেকে যেমন ল্যাপটপ বা ফোন কেনার মতো মামুলি ব্যাপারে! তবে উপায় একটা এতদিনে বের হয়েছে। এরা সাধারণত শেষ তিনটি শূন্য আর বলে না। ফলে ব্যাপারটা বেশ সোজা হয়ে যায়। আবার শেষ তিনটি শূন্যের আগে পয়েন্ট(.) লেখা থাকে। ব্যস, গেল ল্যাটা চুকে। যেমন খেয়ে দেয়ে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডংয়ের বিল বানালে এরা বলে একশো তিরিশ।
তবে শুধু আমরা না; অনেক পর্যটককেই দেখেছি নতুন এসে ডংয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অবশেষে ত্রাতা হয়ে পাওনাদারকেই কাছা দিয়ে ডংয়ের হিসাব মেলাতে মাঠে নামতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে স্বল্প সময়ের ভিয়েতনাম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ। মনের স্মৃতিপটে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে কফি উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষে থাকা এই আসিয়ান সদস্য। এই কয়েকটা দিনে ভিয়েতনাম যা দিয়েছে, তা সহজে ভোলার নয়। নতুন মানুষ, মূল্যবোধ, সভ্যতা, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটা সব সময়ের জন্যই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতার মুকুটে নতুন পালক যোগ করলো মায়াবী ভিয়েতনাম আর তার সরল মানুষগুলো।


~ ভিয়েতনামের আরও ছবি ~

ভ্রমণপিপাসু রাইসুল সৌরভ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সমন্বায়ক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবীও।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher