বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

মুন্নারের মায়ায়

দেবতোষ ভট্টাচার্য

~ মুন্নারের আরও ছবি ~

দুপুরে জমিয়ে মাংসভাত খেয়ে ভাতঘুম দেওয়ার তোড়জোড় করছি, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো বলার আগেই ওপারে উত্তেজিত গলা – 'দেবতোষদা, ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেছে! অবন্তীর খুব ইচ্ছা মুন্নার যাওয়ার – তুমি একটু ব্যবস্থা কর প্লিজ।' সম্মতি বা আপত্তি কোনোটারই অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিল শালাবাবু।

সস্ত্রীক এই প্রথম আসছে, তাই আলিস্যি ঝেড়ে ক্যালেন্ডারে চোখ রাখলাম। মুন্নার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে এক অপরূপ হিল স্টেশন – কেরালায়। নভেম্বরে দিনক্ষণ ঠিক করে টিকিট কাটতে বসলাম – আজকাল লটারি পাওয়াও বোধ হয় এর চেয়ে সোজা। নাহ্, কপাল ভালোই ছিল বলতে হবে – কন্যাকুমারী এক্সপ্রেসে এর্নাকুলাম পর্যন্ত যাওয়ার টিকিট জুটে গেল।

খুব তাড়াতাড়িই যেন যাওয়ার দিন এসে গেল। শুরুতেই যেন ভূমিকম্প - মোদীজির ডিমনিটাইজেশন! একরাশ চিন্তা নিয়ে উপস্থিত হলাম ব্যাঙ্গালোর সিটি স্টেশন – এখান থেকেই সন্ধ্যায় ছাড়বে আমাদের কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস। নিজেদের বার্থ খুঁজে বসলাম। ডিনার বলতে রেলেরই ঝাল ঝাল এগ বিরিয়ানি – উহুহুহু করতে করতে যে যার মত শোওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলাম।

পরদিন ভোর। হোটেলে কথা বলে গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। ড্রাইভার সাহেবের পরামর্শ মতো নেমে পড়লাম আলুভায়, এর্নাকুলামের ঠিক আগের স্টেশন। এতে ঘন্টাখানেক সময় বাঁচে। রাস্তায় জলখাবার খেয়ে গাড়ি যখন মুন্নারে পৌঁছাল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। খেয়েদেয়ে আজকের দিনটা জিরিয়ে নেওয়াই ঠিক হল।

পরদিন সকালে হোটেলেই জলখাবার সেরে বেড়িয়ে পড়লাম - গন্তব্য পল্লিভাসল্। সবুজের যে এতরকম বাহার হয় তা আগে ধারণা ছিল না। এই চাবাগানে ঘেরা পাহাড়েই অবস্থিত কেরালার প্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। চোখে সবুজের ঘোর নিয়ে এগোলাম দেবীকুলামের দিকে। এইখানেই আছে নয়নাভিরাম লকহার্ট চাবাগান – এদের উৎপাদনের পুরোটাই রপ্তানি হয়। কুড়ি টাকার টিকিট কেটে চাবাগানের ভেতর হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লাম সবাই। হালকা মেঘের চাদরে মোড়া সে যেন এক রহস্যময়ী সুন্দরী। সূর্যও যেন লজ্জায় মুখ ঢেকেছে। ফিরতে কারোরই মন চাইছিল না, কিন্তু দেরী হয়ে গেলে দেবীকুলাম জলাধারটি আর দেখা যাবে না। অগত্যা ভাললাগার ঘোর নিয়েই এগিয়ে চললাম।

সবুজে ঘেরা দেবীকুলাম জলাধারটি অতি মনোরম। উচ্চতা কম হওয়ার দরুণ একটু গরমই যেন অনুভব হয়। এখানে বোটিং-এর দারুণ বন্দোবস্ত। ফিরে আসার পথে আমরা টিকিট কেটে ঢুকলাম লকহার্ট চা ফ্যাক্টরিতে। সেদিন গ্রীন টি তৈরি হচ্ছিল – যে চা রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গায় তার প্রস্তুতপ্রণালী চাক্ষুষ করা এক অন্য অভিজ্ঞতা।

দ্বিতীয়দিন সবাই মিলে প্রথমেই গেলাম মাত্তুপেট্টি হ্রদে। চতুর্দিক নানারঙের পাহাড়ে ঘেরা, আর তাতে অবিরত চলছে রৌদ্রছায়ার মায়ার খেলা। এখানেই স্পিডবোটে চড়ে নিলাম – গতি আর প্রকৃতির এক অদ্ভুত মিলন। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে অপূর্ব এক ইকো পয়েন্ট। সবাই গলা চড়িয়ে পরীক্ষা করে নিলাম ভাল করে।

পরবর্তী গন্তব্য কুণ্ডলা হ্রদ – উঁচু পাহাড়ে ঘেরা এক কৃত্রিম জলাধার। অনেকক্ষণ লুকোচুরির পর মেঘ যেন ধরা দিল। শীতের বৃষ্টি গায়ে মেখে রওনা হলাম মুন্নার এলাকার সর্বোচ্চ স্থান টপ স্টেশনের দিকে। প্রায় ১৭০০ মিটার উঁচু মুন্নার কোদাইকানাল রোডের ওপর এই টপ স্টেশন। বেশ শীত অনুভব করতে লাগলাম, কিন্তু মেঘে ঢাকা পশ্চিমঘাটের এই রূপ যেন ভোলার নয়। ফিরেই গেলাম দেখতে কলারিপায়াতু - কেরালার এক প্রাচীন মার্শাল আর্ট। শিল্পীদের শারীরিক কসরৎ দেখবার মত। গায়ে কি কাঁটা দিয়ে উঠেছিল – কে জানে!

পরদিন ফেরার পালা। এক স্পাইস গার্ডেন থেকে কেনা হল নানা মশলা। ফেরার ট্রেন সেই কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস, তবে এবার এর্নাকুলাম থেকেই। ট্রেন লেট ছিল – তা থাকগে, কারোরই তখন সেসব ভাবতে ইচ্ছা করছিল না। মুন্নারের মায়ায় সবাই তখন আচ্ছন্ন।

~ মুন্নারের আরও ছবি ~

প্রবাসী বাঙালি দেবতোষ ভট্টাচার্য কর্মসূত্রে আজ বহু বছর বাঙ্গালোরের বাসিন্দা। ফটোগ্রাফির প্রবল নেশা - আর এই নেশার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায়ই তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয় ঘর ছেড়ে। অবসর সময়ে অল্পবিস্তর লেখালেখির বদভ্যাস থাকলেও, এটিই তাঁর প্রথম ভ্রমণকাহিনি। লেখার মাধ্যমে যদি একবার বেড়াবার নেশাটি কাউকে ধরিয়ে দেওয়া যায় তবে সেটাই হবে তাঁর মস্ত পাওয়া।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

ক্ষণিকের অতিথি

সৌম্য প্রতীক মুখোপাধ্যায়

রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মন্দাকিনীর কিনারা ধরে কেদারনাথের পথে ৮ কিলোমিটার যেতেই গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের নতুন ঠিকানা তিলওয়ারা। বছর চারেক আগের উত্তরাখণ্ডের মারণবন্যাতে বিধ্বস্ত কেদারনাথের পথের পুরোটা এখনও ঠিক হয়ে ওঠে নি, রাস্তা ছাড়াও বহু পর্যটন আবাস ধংস হয়ে যায় সেই সময়েই। তারপর আবার গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র। তিলওয়ারা তাদের মধ্যে অন্যতম। অবশ্য সে এখনও স্থান করে নিতে পারেনি ভ্রমণগাইড বইগুলিতে।
হরিদ্বার বা হৃষীকেশ থেকে কেদার-বদরির দিকে অথবা কেদার থেকে বদরি (বা তার উল্টোটা) যাওয়ার সময়ই একরাত্রি কাটানোর জন্য তিলওয়ারা আদর্শ স্থান। হরিদ্বার থেকে ঘণ্টা সাতেকের মধ্যে তিলওয়ারা পৌঁছে যাওয়া যায়।
বেশ কিছুটা পরিসর নিয়ে গড়ে উঠেছে নিগমের অতিথিশালা – পাহাড়ের ধাপ বরাবর। সেখানে ছড়ানো ছিটানো বাংলো ধরনের কতকগুলি থাকার স্থান। অতিথিশালার বেশ কিছুটা ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে কেদারনাথ যাবার রাস্তাটি। আর নীচে গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে পাহাড় ভেঙে নামলেই মন্দাকিনী নদীর কিনারা। গাড়ির আওয়াজ এখানে পৌছয়ই না। কান পাতলে শোনা যাবে পাখির কাকলি। আর নিত্যসঙ্গী হবে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদীর শব্দ।
মন্দাকিনীর নদীতটটিকেই কেন্দ্র করে অতিথিশালার বিকাশ। মূল জনপদটি কিছুটা দূরে। আশপাশে কোনও বসতি নেই। সর্বক্ষণের একমাত্র সঙ্গী নিস্তব্ধতা। এখানে নেই কোনও দিগন্তবিস্তৃত সবুজের গালিচা, বরফে আবৃত পাহাড়চূড়ো অথবা কোনও নীল জলের হ্রদ। অথচ এই নেই-গুলি নিয়েও যেন তিলওয়ারা সুন্দর। প্রচারের আলো থেকে দূরে পড়ে থাকা এক শান্ত পার্বত্য গ্রাম ব্যতীত আর কোনও পরিচয়ই নেই তিলওয়ারার। নিগমের এই থাকার স্থানটি সেই আস্বাদ নেওয়ার একটা সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রকৃতি যেন কিছুটা কৃপণই এখানে। মন্দাকিনী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত - তার ধার বরাবর দুটি গিরিখাত উঠে গিয়েছে। পশ্চিম পাড়ের গিরিখাতটি অনেকটাই লম্বালম্বিভাবে উঠেছে নদীর কূল থেকে। আর পূর্ব পাড়ের গিরিখাতটি বেশ খানিকটা দূরে। নদীতীর সেখানে বেশ প্রশস্ত - অসংখ্য ছোট বড় নুড়ি পাথরে ভরা। সেটি অতিক্রম করলেই অতিথিশালাটি। আকাশ এখানে একফালি - চারদিক পাহাড়ে ঘেরা – দিকচক্রবাল দর্শনের কোন সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত কোনোটিই দেখা যায় না।
তাই বলে ঘরের মধ্যে সময় কাটানো উচিত নয় একেবারেই। সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়লাম। বুক ভরে তাজা হাওয়া নিতে নিতে পশ্চিমদিকের দেওয়াল টপকে নেমে গেলাম নদীতটে। নামার আগে ভেঙে নিলাম একটা গাছের ডাল - দাঁতন। নুড়ি-পাথরের ওপর দিয়ে নিজেকে সামলাতে সামলাতে চলে এলাম নদীর পাড়ে। স্পর্শ করলাম বরফগলা হিমশীতল জল। স্রোতস্বিনীর সেই জলধারা থেকে আঁজলা ভরে জল নিয়ে ভালো করে হাত মুখ পা ধুয়ে নিলাম । এইরকম সুযোগ তো বারবার আসবে না আমাদের এই শহুরে জীবনে।
নদীর পূর্বপাড়ে বসে চোখে পড়ল পশ্চিম পাড়ের খাড়াই – ধ্বসে জীর্ণ গিরিখাতের দিকে। আপাতভাবে আকর্ষণবর্জিত হলেও দেখা মিলল হরিণপালের। সকালে জল খেতে নেমে আসে তারা। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসে একদল বানর। জলপানের থেকেও হরিণদের জ্বালাতন করাই যেন তাদের প্রধান উদ্দেশ্য! লোকালয় দূরে বলে বন্যপ্রাণীগুলি বেশ নিশ্চিন্তে নিজেদের মনে ঘোরাফেরা করে। অনেকটা দূরে একটি মন্দির আছে। যদিও মনে হয় না কেউ বড় একটা আসে সেদিকপানে। জঙ্গলের মধ্যে থেকে উড়ে আসে পাখি - কিছু জানা, কিছু না জানা। তারা উড়ে চলে এপাড় হতে ওই পাড়ে। ভিড় করে অতিথিশালার চত্বরেও। চঞ্চল এই পাখির দলকে ক্যামেরা বন্দি করা বেশ কষ্টকর।

নদীর পাড়েই পড়ে আছে বিশাল দু-তিনটে পাথর। ধ্বসের ফলে বা ভূমিকম্পের জন্য হয়তবা গড়িয়ে এসেছিল এখানে। অনায়াসে উঠে যাওয়া চলে তাদের ওপরে। সমস্ত নদী-নদীতট-গিরিখাত-জঙ্গল সেখান থেকে সুন্দর দৃশ্যমান। সকালের আলো মন্দাকিনীর জলের ওপরে পড়তে দেরি আছে এখনও; সূর্যদেবের পুবের পাহাড় পেরোতে পেরোতে বেলা গড়িয়ে যায় অনেকখানি। সেইসময় অনায়াসে যেন মনটা পিছিয়ে যায় অনেকদূরে - বহু দশক আগে এইরকম কোনও পাথরের ওপর বসে করবেট সাহেব বন্দুক হাতে অপেক্ষা করতেন সেই মানুষখেকো চিতাবাঘটির। বন আর নদীর শব্দ, সামনে বাঁধা মড়ি হিসাবে – একটি ভেড়া কিংবা ছাগল, তার ডাক অথবা পাতা চিবোনোর আওয়াজ ছাড়া আর কোনও সঙ্গী ছিল না তাঁর সেদিন। ভাবতে দোষ নেই যে কয়েক দশক আগেও কোনও এক সুন্দর সকালে এই পাথরের ওপর থেকে হয়তবা দেখা যেত একটা চিতা জলপান করতে এসেছে।
এইসব ভাবা যায় যতক্ষণ খুশি; যতক্ষণ না পরবর্তী গন্তব্যের তাড়া বিচলিত করে। সেটা কেদারনাথ হতে পারে বা বদরিনাথ। কিংবা তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলার উদ্দেশে তিন ঘণ্টার দূরের চোপতাও।

 

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সৌম্য প্রতীক মুখোপাধ্যায় একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। চাকরি সূত্রে দীর্ঘদিনের প্রবাসী বাঙালি। অল্প ক'দিনের ছুটি পেলেও বেরিয়ে পড়াই তাঁর নেশা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher