নীল পাহাড়, অর্কিড আর আত্মঘাতী পাখিদের দেশে

সুদীপা দাস ভট্টাচার্য্য


~ হাফলং-জাটিঙ্গার আরও ছবি ~

দক্ষিণ আসামের শহর শিলচর থেকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলপথে চলেছি আসামের একমাত্র শৈল শহর হাফলং ও তার পার্শ্ববর্তী জনপদ জাটিঙ্গার উদ্দেশ্যে। আসামের ডিমা হাসাও জেলায় অবস্থিত এবং উত্তর কাছাড় পার্বত্য অঞ্চলে ঘেরা এই জনপদ দুটির উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ৩০০০ ফুট। যাত্রাপথের অনেকটাই উত্তর কাছাড় পার্বত্য অঞ্চলের গভীর জঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে। আগে এই রেলপথটি মিটার গেজ ছিল; সম্প্রতি ব্রডগেজ চালু হয়েছে। ট্রেন একের পর এক ছোট বড় অন্ধকার টানেল আর অজস্র উঁচু উঁচু ব্রিজ পেরোচ্ছে। কোথাও রেললাইনের গা ঘেঁষে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের দেওয়াল; কোথাও আবার নীচে উচ্ছ্ল জাটিঙ্গা নদী ঘন জঙ্গলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে; কখনও আবার কোথা থেকে হঠাৎ ভেসে আসা কুয়াশার মত মেঘ উড়ে যাচ্ছিল বর্ষা-ভিজে সবুজ পাহাড়-জঙ্গলের গা বেয়ে। শিলচর থেকে নিউ হাফলং স্টেশনের ঘন্টা পাঁচেকের যাত্রাপথটিতে এমন অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতেই কেটে যাওয়ার কথা; কিন্তু প্রাকবর্ষার বৃষ্টিতে ধ্বসের জন্য ট্রেন লেট হয়ে বিকেল হয়ে গেল নিউ হাফলং পৌঁছতে। একেবারে শেষে ট্রেনটা প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটা টানেল পেরোল। স্টেশনে নেমে বাইরে এসে অটো ভাড়া করলাম। স্টেশন অনেক নীচে আর হাফলং শহর পাহাড়ের ওপর। অটোরিক্সা ছাড়া আর কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। অন্ধকার পাহাড়ি পথে উঠতে শুরু করল অটো। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ায় আমরা জবুথবু; শহরের মধ্যে কিছু জায়গায় রাস্তাও বেশ খারাপ; প্রায় মিনিট কুড়ি পর অটো 'হোটেল এলিট' পৌঁছে দিল। হোটেলটা বড় রাস্তার ওপরেই; ঘরগুলো বেশ পরিষ্কার আর আরামদায়ক; সারাদিনের ট্রেনযাত্রার ধকলে ক্লান্ত ছিলাম, তাই পরেরদিনের জন্য একটা অটোরিক্সা বুক করে তাড়াতাড়ি রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম।

সকালে উঠে দেওয়ালজোড়া জানলার পর্দা সরাতেই সামনের বাড়িঘর ছাপিয়ে চোখে পড়ল মেঘে অর্ধেক ঢাকা গুরুগম্ভীর বরাইল পাহাড়ের রেখা। অটোরিক্সা হাজির; সকালের খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জাটিঙ্গার পথে। সকালের আলোয় হাফলং শহরটাকে দেখতে দেখতে চলেছি। ছোট পাহাড়ি শহর; দোকানপাট এরই মধ্যে খুলে গেছে; রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলে চারপাশ ভেজা ভেজা, ঠান্ডা; রাস্তার পাশের বড় গাছ থেকে বাহারি অর্কিডের গোছা ঝুলছে। কিছুটা যাওয়ার পর অটো লোকালয় ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় পড়ল। রাস্তার একপাশে পাহাড়ের গায়ে অজস্র চেনা অচেনা ফুল ফুটে আছে; আর অন্যদিকে জঙ্গলের ফাঁকে অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে রেললাইন, একটা ছোট্ট রেলব্রিজ আর নিউ হাফলং স্টেশনটা। এখানেই রাস্তার ওপর রেলিং দিয়ে ঘেরা জননেত্রী ও স্বাধীনতাসংগ্রামী রানি গাইদিনলিউ-এর মূর্তি। ভিউ পয়েন্টে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অটো আবার চলল। রাস্তা কোথাও বেশ সরু আর অসমতল; প্রচণ্ড ঢালু রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে অটো চলেছে; কিছুটা গিয়ে অবশেষে শিলচর-হাফলং জাতীয় সড়কে পড়া গেল। এবার রাস্তা ভাল। ঠান্ডা হাওয়া আর ঝলমলে রোদ তার সঙ্গে সঙ্গত করছে। রাস্তার দু-পাশে ঘন জঙ্গল, বাঁশগাছ; ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে কাজে চলেছে স্থানীয় উপজাতীয় মেয়ে-পুরুষ; তাদের মাথা থেকে পিঠে ঝুলছে বেতের বড় বড় টুকরি, হাতে দা; অটো থামিয়ে নেমে পড়ে সেই বেতের টুকরি মাথায় আমরা ছবি তুললাম। সামনেই জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝোরা; বাঁশের ফাঁপা চোঙ দিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করে নিয়েছে গ্রামের মানুষ। পথের একপাশে উজ্জ্বল নীল রঙের বুনো ফুল ফুটে রয়েছে; এছাড়াও হাজারো ফুল আর প্রজাপতির মেলা; এরই মধ্যে পাহাড়ের ঢালে কমলালেবুর ক্ষেতে প্রচুর লেবু ফলেছে। জঙ্গলের গন্ধমাখা নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি চুপচাপ; হঠাৎ নির্জনতা খান খান করে পাহাড়ের আরও ওপর থেকে ভেসে এল পরপর 'হুকু হুকু হুক্কু' ডাক! আগে অরুণাচল প্রদেশ গিয়ে এই ডাকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল - হুলক গিবন; আমাদের অটোচালক দাদার ভাষায় হুকু বাঁদর। ঘন জঙ্গল আর অনাবিল প্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে হুলক গিবনের ডাক শুনতে বেশ লাগছিল।

বেশ কিছুক্ষণ পর অটো পৌঁছল 'এথনিক ভিলেজ'। জাটিঙ্গার এই অবশ্যদর্শণীয় স্থানটি ডিমা হাসাও জেলার বনদপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে; চারপাশের পাহাড়ের বুকে একটুকরো সমতল জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা এথনিক ভিলেজটি এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং জীবনশৈলীকে মেলে ধরেছে পর্যটকদের সামনে। বাঁশ, বেত, পাইন এবং আরও নানা গাছে ছাওয়া সবুজ ভিলেজের মধ্যে পরপর তৈরি করা কুকী, মার, গাংতে, রাংখোল, ভাইফে, ডিমাসা প্রভৃতি বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতীর বসবাসের কুটীর; এগুলির উপকরণ মূলত বাঁশ ও বেত; প্রতিটা কুটীর গড়নে এবং ছাঁদে আলাদা আলাদা; অনেক কুটীরের ভেতর উপজাতীয় মানুষদের ব্যবহার্য্ বেতের ঝুরি, টুকরি, বাঁশের জলপাত্র এসব রাখা। এর মধ্যে রংমাই নাগা, দেকিচাং-দের কুটীরগুলো বেশ অভিনব লাগল; রংমাই নাগা কুটীরটি কাঠের; তার ওপর রং দিয়ে গাছ, মানুষ, পশুপাখি এবং আরও বিভিন্ন নক্সা আঁকা; দেখতে দেখতে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের গুহাচিত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ভিলেজের মাঝখানে মাইবঙের উপজাতীয় রাজাদের পাথরের বাড়ির একটি প্রতিরূপ; তার সিঁড়ির ধাপে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ভিলেজের অন্য দিকে চললাম। এদিকটায় ঘন আনারসের ক্ষেত; ছোট ছোট আনারস ধরেছে সবে; বেত-এর ফলও এই প্রথম দেখলাম এখানে; পাশেই আবার পাম জাতীয় ছোট ছোট গাছের গায়ে থোকায় থোকায় দুলছে সাদার ওপর বেগুনী বুটি শৃগাল-লাঙ্গুল(Fox-tail)অর্কিড। ভিলেজের পাশেই অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল এক সুসজ্জিত বাগান, রংবেরঙের মরশুমি ফুলে সাজানো; বাগানের মধ্যে বাচ্চাদের খেলার জন্য দোলনা, ঢেঁকি, স্লিপ, মেরি গো রাউন্ড সব রয়েছে; আর বড়দের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এখানে ওখানে বাঁশ দিয়ে তৈরি টুকটুকে লাল আর গাঢ় সবুজ ছাউনি। ভিলেজকে চারদিক দিয়ে ঘিরে যেন হাতের নাগালে এসে দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের সারি। লাল-সবুজ ছাতার তলায় ঠান্ডা ছায়ায় বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কত সময় যে কেটে গেছে খেয়াল নেই। অটোচালক দাদার ডাকে সম্বিত ফিরল। এবার চললাম জাটিঙ্গা বার্ড ওয়াচ টাওয়ারে।
আত্মঘাতী পাখিদের জন্য জাটিঙ্গা বিশেষ ভাবে খ্যাত। প্রতি বছর বর্ষাশেষের কোনও কোনও কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাতে পরিযায়ী পাখিরা ধীরে ধীরে ডানা মেলে নেমে আসে আলোকরশ্মির আকর্ষণে; আগুনে ঝাঁপ দিয়ে তাদের সেই দলবদ্ধ মৃত্যুবরণের ঘটনা আজও যেন এক গা ছমছমে রহস্যে মুড়ে রেখেছে জাটিঙ্গাকে। টাওয়ারে ওঠার মুখে একটা ফলকে লেখা 'Welcome the coming birds…Let Them Live and Add Attraction to The Jatinga Valley…।' একসময় এই ক্লান্ত, দিগভ্রান্ত পাখিরা ছিলো স্থানীয় উপজাতিদের শিকার; পক্ষী এবং পরিবেশপ্রেমীদের হস্তক্ষেপে এখন জনসচেতনতা কিছু বেড়েছে। এখন পাখি আসার সময় নয়, খালি ওয়াচ টাওয়ারটি দেখেই অতৃপ্ত মন নিয়ে ফিরলাম।

অটো এবার নিয়ে চলল খাসিয়া বসতির মধ্যে দিয়ে স্থানীয়রা যাকে বলে খাসিপুঞ্জী। খাসিয়ারা মেঘালয়ের জনগোষ্ঠী, কিন্তু ছড়িয়ে আছে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও। রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের গায়ে খাসিপুঞ্জীর বাড়িগুলো কাঠের; কাচের জানলায় সুন্দর লেসের পর্দা দুলছে; বারান্দায় টবে রংবেরঙের ফুল; ঝকঝকে তকতকে চারদিক, রাস্তাঘাট। আবর্জনা দেখে অভ্যস্ত আমাদের শহুরে চোখ আর মন রীতিমতো লজ্জা পাচ্ছিল প্রত্যন্ত এই গ্রামের রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি দেখে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম পাহাড়ের বেশ খানিকটা উঁচুতে বিশাল মাঠের মতো একটা খোলা জায়গায়। মাঠটায় দুদিকে গোলপোস্ট পোঁতা; একদিকে একটা তিনতলা ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারটা এমন জায়গাতেই বানানো যে এখান থেকে একদিকে তাকালে দেখা যাবে উত্তর কাছাড় বরাইল পাহাড়ের নিরবচ্ছিন্ন শ্রেণী আর অন্যদিকে প্রায় পুরো হাফলং শহরটা। টাওয়ারের তিনতলায় উঠে যখন দাঁড়ালাম, মনে হল এখানে না এলে জাটিঙ্গার সৌন্দর্যের অনেকটাই অদেখা থেকে যেত। টাওয়ারটা মাঠের একপ্রান্তে পাহাড়ের কিনারে; পিছনদিকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে পাথুরে খাদ; দূরে পিছনের পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে আছে বাড়িঘর, চার্চ, হাফলং শহর। আর টাওয়ারের সামনে মাঠের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ জড়ানো বিস্তীর্ণ, গম্ভীর নীল পাহাড়।
জাটিঙ্গা থেকে হোটেলে ফিরতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। দুপুরে খাওয়া হয়নি কারণ পুরো পথে ছোটখাটো চায়ের দোকান ছাড়া কোথাও তেমন খাবারের দোকান নেই। তাই ওই বিকেলবেলাতেই হোটেলের কাঁচালঙ্কা ছড়ানো ঝাল ঝাল চিকেনকারি আর ভাত দিয়ে লাঞ্চ সারা হল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম দূরের পাহাড়ের মাথার মেঘগুলো যেন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। হোটেলের ম্যানেজার বললেন এই জায়গাটার এই মজা; প্রাকবর্ষার এই সময়ে রোজ রাতে ঝমঝম বৃষ্টি আর সকাল হলেই মেঘ উধাও হয়ে ঝলমলে রোদ। আমাদের ইচ্ছা ছিল কাছাকাছি দোকানবাজার একটু পায়ে হেঁটে ঘুরে আসার; কিন্তু আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনায় আজকের মত আপাতত বিশ্রাম নেওয়াই স্থির করলাম। আগামীকালের দ্রষ্টব্য হাফলং শহর।

আমাদের অটোচালক তালুকদারদাকে বলাই ছিল; ব্রেকফাস্ট করে একটু বেলায় বেরোলাম; প্রথম গন্তব্য হাফলং লেক। হোটেল থেকে বেশ কিছুটা নীচের দিকে নেমে পৌঁছলাম শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত হাফলং লেকের ধারে। চারপাশ সবুজে ঘেরা লেকটা প্রস্থে বেশি না হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ অনেকটাই বড়। লেকের পাশ দিয়ে পরিচ্ছন্ন চওড়া রেলিংঘেরা রাস্তা, জামরঙা ফুলে ছাওয়া জ্যাকারান্ডা গাছের সারি। লেকের প্রধান অংশে টলটলে সবুজ জলের ওপর দিয়ে একটা সরু তারের ঝুলন্ত ছোট সেতু; সেতুর ওপর দিয়ে লেকের ওপারে গিয়ে কিছুটা হেঁটে আবার ফিরে এলাম এপারে রাখা অটোর কাছে। চললাম সার্কিট হাউস। সার্কিট হাউস যাওয়ার ঘুরপথে একে একে তালুকদারদা দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললেন ডন বস্কো স্কুল, প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ, হাফলং সরকারি কলেজ, আরও কত কী। এবার অটো সরু রাস্তায় ঘুরে ওপরে উঠতে শুরু করল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পৌঁছে দিল পাহাড়ের ওপর সার্কিট হাউসের সামনে। একপাশে পুরোনো অসমিয়া ছাঁদের টিনের চালের বাংলো; গেটের দুদিকে বোগেনভিলিয়ার ফুলে ভরা গাছ; পাশেই নতুন দোতলা সাদা রঙের সার্কিট হাউস। চারদিক ঠান্ডা, নিস্তব্ধ। সামনে অনেকটা রেলিংঘেরা খোলা জায়গা আর সেই খোলা চত্বরটার শেষেই নীচে গড়িয়ে গেছে খাদ। রেলিং ধরে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে চোখে পড়লো বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ চড়াই-উৎরাই, অনেক নীচে বিছিয়ে থাকা রেললাইন আর তার ওপারে পাহাড়ের সারি। আরও এক অভিনব দৃশ্যে চোখ আটকাল; উঁচু উঁচু থামের ওপর দিয়ে জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে সাদা ব্রডগেজ রেলব্রিজ; আর তার পাশেই অনেক নীচে শুয়ে আছে একদা ব্যস্ত অধুনা পরিত্যক্ত ছোট্ট ন্যারোগেজ রেলরাস্তাটা; ঠিক যেন অতিকায় দৈত্য আর লিলিপুটের সহাবস্থান। বুঝতে পারলাম এই বিশেষ দৃশ্যটার জন্যই সার্কিট হাউস অবস্থানগতভাবে এত খ্যাত।
সার্কিট হাউস থেকে ইতিউতি ঘুরে হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নেওয়া গেলো। বিকেলে পায়ে হেঁটে বেরোলাম স্থানীয় বাজারে। হোটেল থেকে অনেকটা নীচের দিকে নামলে বাজার; দোকানিরা পসরা সাজিয়েছে; সবজি থেকে সুপারি, মাছ থেকে পায়রা-মুরগি, কী নেই সে বাজারে! রাস্তার দুপাশেও সারি সারি জামাকাপড়, জুতো, টুপি, প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান। পথেই পড়ল বেশ বড় এক মন্দির; আরতি শেষে প্রসাদ বিলি হচ্ছে। টুকটাক কেনাকাটা করতে না করতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি এল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা রেস্তোঁরায় ঢুকে বসলাম; জমাটি ঠান্ডার সন্ধ্যায় বৃষ্টি দেখতে দেখতে ধূমায়িত চাওমিন আর মুর্গিভাজা খেতে বেশ লাগছিল। বেশ খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টি একটু ধরতে একটা অটো জোগাড় করে ফিরে এলাম হোটেলে। আগামীকাল সকালেই ফেরার ট্রেন; তাই দ্রুত গোছগাছ সেরে নেওয়া হল।
সকালের বৃষ্টিভেজা হাফলং-কে পেছনে ফেলে অটো নামছে পাহাড়ের ঢালু রাস্তায়, তখনও রোদ ওঠেনি। বরাইল পাহাড়ের মাথার সাদা মেঘগুলো আজ অনেক নীচে নেমে এসেছে, ওড়নার মতো ভেসে আছে পাহাড়ের বুকে, পাহাড়ি পথের প্রতিটা সতেজ সবুজ বাঁকে; যেন হাত বাড়ালেই মুঠোয় ধরা দেবে। হাফলং-এর স্নিগ্ধ মনোহর রূপ দু-চোখে মেখে স্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেন এলে তালুকদারদা ভিড় ঠেলে আমাদের সিটে বসিয়ে ব্যাগ বাঙ্কে তুলে দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ না ট্রেন ছাড়ে।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। দু'দিনে আপন হয়ে যাওয়া ছোট্ট জনপদটা আর তার কিছু মানুষের উষ্ণ আতিথেয়তার তাজা স্মৃতি নিয়ে ট্রেনের জানলার বাইরে চোখ রাখলাম, সাদা মেঘগুলো থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টিদানা নেমে আসছে চারদিক ঝাপসা করে।


~ হাফলং-জাটিঙ্গার আরও ছবি ~

সুদীপা দাস ভট্টাচার্য্য পেশায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও গবেষক। ভালবাসা পরিবারের সঙ্গে বেড়ানো, গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়া এবং অল্পসল্প লেখালেখি। মনুষ্যনির্মিত ঝাঁ-চকচকে কীর্তি নয়, আকর্ষণ করে নির্জন উন্মুক্ত অনাবিল প্রকৃতি।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher