বেঁচে ওঠা ল্যাংটাং-এ
সৌম্যদীপ হালদার
~ ল্যাংটাং-গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকরুট ম্যাপ ~ ল্যাংটাং-এর আরও ছবি ~
ঠিক বুঝতে পারছিনা কোথা থেকে শুরু করব। ২০১৬-র জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। আমরা তিন সদস্য ক্লাবে গেছি। গডফাদারকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাওয়া যায়? মৃদু হেসে বলল, 'যেদিকে দু চোখ যায়, আমাকে জিজ্ঞাসা করবিনা।' তারপর নিজেই বলল, 'ল্যাংটাং ঘুরে আয়।' এক কথায় যাকে বলে মেঘ না চাইতে জল। 'ল্যাংটাং' নামটা নতুন লাগল, তাই করুণ মুখে জিজ্ঞাসা করলাম জায়গাটা কোথায়? স্যার বেশ কিছুক্ষণ আপাদমস্তক তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, 'নেপাল।' একটা রুট ম্যাপও দিলেন।
একটা অচেনা দেশে ট্রেক করার ভাবনাটাই তখন আমাদের তিনজনের কাছে সেরা প্রাপ্তি। কী করে যাব, কিভাবে যাব, কোথায় থাকব সেটা তো পরের ব্যাপার। খানিক পরে গুগল-এ দেখলাম বলছে, ২০১৫-র ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পে নেপাল-এর যে জায়গাটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রায় নেই হয়ে গেছে, তার নামই ল্যাংটাং। ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, মানুষজনের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ অর্থে বদলে গেছে, বলা বাহুল্য শুধু নামটাই এক আছে আর কিছু নেই। একমুহূর্তে তিনজনেরই মন বলল চলো।
অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত দিন ১০ অক্টোবর, ২০১৬ - ঘড়ি বলছে বিকাল ৩.৪৫, মিথিলা এক্সপ্রেস আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের জিজ্ঞাসাও বাড়ছিল। আর এইসবকিছুকে অতিক্রম করে বেড়ে উঠছিল অজানাকে জানবার নেশা। রক্সৌল পৌঁছে সেখান থেকে বীরগঞ্জের পথে হঠাৎ ফোনের টাওয়ার বিদায় জানাতে বুঝলাম এলেম নতুন দেশে।
জেসসি-র কথা অনুযায়ী আমরা মোছাপোখরিতে রইলাম। মোছাপোখরি (৫৮১ মিটার) একটা ছোট্ট শহর, কাঠমান্ডু থেকে দূরত্ব মাত্র ৩.৫ কিমি। পৌঁছে বেশ অবাক হলাম যে বেশিরভাগ মানুষই জানে না ল্যাংটাং বলে কোনও জায়গা আছে!
জেসসি কে তা অবশ্য বলা হয়নি, পুরো নাম জেসসি স্মিথ (Jessey Smith)। যে না থাকলে হয়তো আমাদের ট্রেকটা সম্ভব হতো না। কানাডানিবাসী জেসসি ভূগোলে স্নাতকের পাঠ নিচ্ছে। নেপালের সেই ভয়ানক ভূমিকম্পের পর ওখানে যায়। ফিরে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতা লোনলি প্ল্যানেটে লেখে। সেই লেখা পড়েই ফেসবুকে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ও-ই আমাদের সব পরিকল্পনা, খরচাপাতি আর ল্যাংটাং-এর বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের ওয়াকিবহাল করায়।
১২ অক্টোবর সকাল ছটায় সিয়াব্রু-র বাসে চেপে বসলাম। রাস্তার অবস্থা না বলাই ভালো। তবে তাপি নদীর পার হওয়ার পর থেকে রাস্তাটা বেশ। বিকালে পৌঁছালাম ধুনছেতে। ধুনছে (১,৭৬৪ মিটার ) এখানকার নামকরা একটা শহর যেখান থেকে গোঁসাইকুণ্ড ট্রেক হয়। এখান থেকে সিকিউরিটি চেকের পর অনুমতিপত্র নিয়ে বাস চলল ল্যাংটাং।
অনুমতিপত্র নিয়ে কোথাও সম্পূর্ণ তথ্য পাইনি, নানা জনের নানা মত। ওখানে গিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। গাইডশুদ্ধু ট্রেক করতে গেলে TIMS (Trekkers' Information Management System) কার্ড বানাতে হয়, যার মূল্য প্রায় ৩৫০০ এন সি (নেপালী টাকা)। তবে গাইডের প্রয়োজন না হলে এই কার্ডেরও দরকার হয় না। এছাড়া ল্যাংটাং ন্যাশনাল পার্ক-এর অনুমতিপত্রের জন্য দরকার হয় যেকোনও একটা সচিত্র পরিচিতি পত্র ( ভোটার কার্ড/প্যান কার্ড/পাসপোর্ট ইত্যাদি, কিন্তু আধার কার্ড চলবেনা) আর ১৬৯৫ এন সি (সার্ক দেশগুলির জন্য) অথবা ৩৩৯৫ এন সি (অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে)। এছাড়া হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং-এর জন্য ২২০০ এন সি।
বিকাল সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছালাম সিয়াব্রু-বেন্সি-তে। রাস্তায় দুজন নেপালি বন্ধু পেয়েছিলাম। সিয়াব্রু-বেন্সি (১৪৬০ মিটার) থেকে শুরু হয় ল্যাংটাং ভ্যালি ট্রেক। পৌঁছাতেই তরতর করে বয়ে যাওয়া ল্যাংটাং খোলা যেন সাদর সম্ভাষণ জানাল।
১৩ অক্টোবর সকালে পিঠে স্যাক নিয়ে ল্যাংটাং খোলা-র পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বহু প্রতীক্ষিত বহু প্রত্যাশিত স্বপ্নযাত্রা। নদী যেন সকালের আলোয় হেসে বলে উঠল, 'তাসি দেলে' (তিব্বতী শব্দ যার অর্থ সুপ্রভাত), আজ কিন্তু চলে যেও ঘোড়ে তাবেলা অব্দি। কাজু, ঝরনার জল আর দিদার দেওয়া সুপারিকুচো সহযোগে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে পৌঁছে যাব ৎসেরগো রি (Tsergo Ri) এই ভাবনা নিয়ে একে একে তিওয়ারি, ডোমেইন, ব্যাম্বো অতিক্রম করে রিম্চে (২৩৯৯ মি), লামা (২৪১০ মি) হয়ে রিভার সাইড গ্রাম পৌঁছালাম। ব্যাম্বো থেকে রিম্চের এলিভেশন ডিফারেন্স ৪০০ মিটার এবং পুরোটাই খাড়াই। গোটা রাস্তায় আমাদের সাথী ছিল বানর, কাঠবিড়ালি আর নাম না জানা রকমারি পাখি। রিভার সাইড-এ পৌমচে স্যার দাওয়া (তিব্বতী শব্দ যার মানে সূর্য) বলল, আজ চললাম। ঘড়িতে চোখ পড়তে দেখি বিকেল তখন সাড়ে পাঁচটা। তখনও সেদিনের গন্তব্যস্থল থেকে প্রায় দেড়-দু ঘন্টার দূরত্বে রয়েছি। তবে শেষপর্যন্ত মোটামুটি মিনিট পঞ্চাশের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। এটা ছিল আমাদের জীবনের প্রথম রাত্রিকালীন ট্রেক। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চাঁদনী রাতে এগিয়ে যাচ্ছি তিনজনে। অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা।
দিন্দু লামা ঘোড়ে তাবেলা (Ghoda Tabela)-র তিব্বতী হোটেলের মালিক। এমন চনমনে সতেজ ভালোমানুষ কারোর দেখা মনে হল যেন কখনোই পাইনি। সত্যি কথা বলতে তের ঘন্টা ধরে ১৬ কিমি ট্রেক করে আমরা তখন একেবারে বিধ্বস্ত, কিন্তু দিন্দুজির উৎসাহী ব্যক্তিত্ব আর হাতেগরম সব তথ্য এক মুহূর্তে আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল।
প্রথমে ল্যাংটাং শব্দটার প্রসঙ্গে আসি। আদতে 'লামদাঙ' শব্দের অপভ্রংশ। তিব্বতী শব্দ 'লাম' কথার অর্থ ষাঁড়। প্রচলিত গল্পকথা এই, গুরু পদ্মসম্ভবের পোষ্য ষাঁড়টি তিব্বত থেকে আসার পথে সিফ্রু থেকে ল্যাংটাং হয়ে কায়ানজিং পর্যন্ত গোটা রাস্তাতে সব ঘাস খেয়ে ফেলে। পদ্মসম্ভব খুঁজতে গিয়ে দেখেন যে কায়ানজিং থেকে ১২ কিমি আগে লাংশিশা খারকা নামে স্থানে ষাঁড়টি মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ষাঁড়টির জন্য স্থানটি পবিত্র হয়ে যায়। নাম বদলে হয় লামদাঙ।
১৪ অক্টোবর, ২০১৬, সকালে বিন্দু লামার আতিথেয়তায় তিব্বতী চাপাটি ভোজনের পর যাত্রা শুরু করলাম। একটু এগোতেই চোখে পড়ল তুষারশুভ্র ল্যাংটাং রি (৭২০৫ মি), মনটা একেবারে প্রশান্তিতে ভরে গেল। আগেকার দিনে এখানে ঘোড়ার চল ছিল, আস্তাবলও ছিল। তাই এই জায়গার নাম ঘোড়ে তাবেলা (৩০০০ মিটার )। একে একে ঠ্যাংশেপ, গুম্বা ক্রস করে দূর থেকে চোখে পড়ল ল্যাংটাং।
দেখে ভালো লাগলো ভূমিকম্পের আকস্মিকতার রেশ কাটিয়ে ল্যাংটাং সেজে উঠছে নতুন রূপে - নতুন জায়গায় আধুনিকতার ধাঁচে। আগেকার গ্রামটি আর নেই। তার থেকে আরও মিনিট পাঁচ-সাতেক এগিয়ে গেলে নতুন ল্যাংটাং গ্রাম (৩৫৪১ মিটার)। আরও উত্তর দিকে মুন্ডু (৩৫৪৩ মি) অতিক্রম করে কায়ানজিন গুমফা -র দিকে এগোতে এগোতে গর্জনময়ী খোলা আর ল্যাংটাং লিরুং (৭২৩৪ মি), ল্যাংটাং রি (৭২০৫ মি), গাঙচেঙপ (৬৩৮৭ মি) এবং গাঞ্জালা পাস চোখে পড়ল। তারা যেন দেখছে মনিওয়ালগুলো ঠিক মতো ক্রস করছি কিনা। মনিওয়ালে সবসময় বামদিক থেকে হাঁটতে হয়। কখন যে পৌঁছে গেলাম প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে খেয়াল করিনি। দিন শেষ হয়ে রাত হতেই চাঁদের আলোয় লাংটাং লিরুং-কে খুব মোহময়ী লাগছিল।
পরদিন কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা। ৎসেরগো রি সামিট করার দিন। তিনজনের পদযুগলই জবাব দিলেও আমাদের পালস রেট নরমাল থাকায় বিশেষ অসুবিধা হল না। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ভোর চারটে নাগাদ রওনা দিলাম। প্রায় ১২০০ মিটার এলিভেশন ডিফারেন্স। পথে সেই নদীর সঙ্গে দেখা। চাঁদের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে যাচ্ছি। অক্সিজেন নিয়ে কোনও সমস্যা হয় নি। কিন্তু হাওয়ার প্রবল বেগ বেশ মুশকিলে ফেলছিল। অবশেষে সকাল ৭.৩২ মিনিটে আমাদের বহু প্রত্যাশিত মুহূর্ত এল। আমরা ৎসেরগো রি টপ (৪৯৮৪ মি) সামিট করলাম। ভাবিনি পারব। একটু ডানদিক যেতেই দেখলাম ল্যাংটাং গ্লেসিয়ার - ল্যাংটাং খোলার উৎপত্তি স্থল। আর দেখলাম আকাশ জুড়ে ল্যাংটাং লিরুং, ল্যাংটাং রি, গাঙচেঙপ আর গাঞ্জালা পাস।
এবার নামার পালা। নীচে নেমে শেষবারের মত অনেকক্ষণ কথা হল ল্যাংটাং খোলার সঙ্গে। উঠে আসার আগে বললাম, আবার ফিরে আসব, অপেক্ষায় থেকো।
~ ল্যাংটাং-গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকরুট ম্যাপ ~ ল্যাংটাং-এর আরও ছবি ~
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সৌম্যদীপ হালদার বর্তমানে একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। নেশা বেড়ানো ও ছবি তোলা।