বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।
[বিভিন্ন সূত্র থেকে শ্রী রামলাল সিংহ সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য পেয়েছি তা হল - পাটনানিবাসী বি-এল উপাধিধারী শ্রী সিংহ ছিলেন প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিক। নব্যভারত পত্রিকার ১৩০২ সালের বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ সংখ্যাদুটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ে পত্রিকার সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী শরীর সারানোর উদ্দেশ্যে মাসখানেক রাজগিরে কাটান ও ফিরে এসে তিনিও পরবর্তীতে পত্রিকায় রাজগির নিয়ে একটি দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখেন। সেই দিক থেকে লেখাটির একটা অন্য গুরুত্বও রয়েছে। সেইসময়ের হিন্দু বাঙালির তীর্থভ্রমণের এই কাহিনিটিতে ধর্ম এবং জাতিবোধের কিছু প্রাবল্য থাকলেও ভ্রমণের বর্ণনা আকর্ষণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাঙালির তীর্থভ্রমণ কাহিনি শাখাটি কিন্তু সম্পূর্ণতই পুরুষ লেখকদের নির্মিত। সেকালের বাঙালি নারীর ভ্রমণকাহিনিতে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্নগোত্রের। তবে যে কোনও লেখাকে তার সমকাল দিয়ে বিচার করাই ভালো।
এই লেখায় উল্লিখিত 'সরস্বতী' নদীটি আসলে 'শর্বতী' নদী। স্থানীয় মানুষদের উচ্চারণ অনুধাবনে লেখক হয়তো ভুল করেছিলেন। ভুলটি নজরে এনে আমাদের ধন্যবাদার্হ করেছেন 'আমাদের ছুটি'-র বন্ধু হিমাদ্রী শেখর দত্ত।]
রাজগৃহ বা রাজগিরি দর্শন
শ্রী রামলাল সিংহ
কবিবর নবীনচন্দ্র সেন মহাশয়ের রৈবতক পাঠে মহাভারতের সেই ঐতিহাসিক ক্ষেত্র, হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনের পুণ্য-তীর্থ ভূমি 'গিরিব্রজপুর' বা আধুনিক রাজগৃহ দেখিবার বাসনা বহুদিন হইতে মনোমধ্যে পোষণ করিতেছিলাম। আত্মীয়–বন্ধুগণের মুখে সেই রমণীয় স্থানের বর্ণনা শুনিয়া ঔৎসুক্য দিন দিন বর্দ্ধিত হইতেছিল। অবশেষে বিগত ১৮৯৪ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর তারিখে, রবিবার বেলা ১০টার লোকেল ট্রেনে আমরা কয়েক জন বন্ধু, দুইজন চাকর, একজন রাঁধুনি ব্রাহ্মণ সমভিব্যাহারে, বাঁকিপুর রেলওয়ে ষ্টেসনে উঠিয়া ২৮ মাইল পূর্ব্ববর্ত্তী বখ্তিয়ারপুর ষ্টেসনে বেলা ১২টার সময় উপস্থিত হইলাম।
এক্ষণে ইষ্টইণ্ডিয়ান রেলওয়ের ষ্টেসন বখ্তিয়ারপুর হইয়াই রাজগৃহ যাইতে হয়। বখ্তিয়াপুর হইতে বিহার ১৮ মাইল দক্ষিণে এবং বিহার হইতে রাজগৃহ ১৫ মাইল পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে। বখ্তিয়ারপুর হইতে বিহার যাইতে হইলে লোকেরা সচরাচর মেল কার্টে যায়, কারণ গরুর গাড়ীতে যাইতে বড় বিলম্ব হয়, প্রায় ১২ ঘন্টা লাগে, এবং এক্কায় যাওয়া বড় কষ্টকর। কিন্তু রাজগৃহ দর্শনার্থী পশ্চিম দেশীয় যাত্রীরা স্ত্রী পুত্র পরিবারবর্গ লইয়া গরুর গাড়ীতেই গিয়া থাকেন। যদিও বখ্তিয়ারপুরে ধর্ম্মশালা, ডাক্বাঙ্গালা প্রভৃতি থাকিবার স্থান ছিল, কিন্তু সকলের মত হইল, পর দিনের অপেক্ষা না করিয়া ৭টা রাত্রেই যাওয়া শ্রেয়। রিজার্ভ গাড়ীতে আমাদের মধ্যে ছয়জন, এবং অনেক অনুনয় বিনয় করাতে মেনেজার মহাশয়ের অনুমতি ক্রমে একজন চাকর সঙ্গে করিয়া বেলা তিনটার সময় বিহারাভিমুখে যাত্রা করিলেন। এবং রাত্রি ৭টার সময় আমরা বাকী ছয়জন সেই পৌষ মাসের দারুণ শীতে স্পেশেল কার্টে যাত্রা করিলাম। বখ্তিয়ারপুর হইতে বেহার যাইবার পাকা রাস্তার দুইধারে সারি সারি নানা রকমের বড় বড় গাছ, মধ্যে মধ্যে বড় বড় সুন্দর পুল; কিন্তু পার্শ্ববর্ত্তী স্থান অতি নিম্ন জলাভূমি বলিয়া গ্রামাদির সংখ্যা বড় কম। মেলকার্ট যাইতে তিন ঘন্টা লাগে। তিন জায়গায় ঘোড়া বদল হয়; বন্দোবস্ত মন্দ নয়।
বিহারঃ- আমরা বিহারে পঁহুছিয়া রবিবার রাত্রে স্বর্গীয় ডিপুটি বিমলা চরণ ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের যত্নে প্রতিষ্ঠিত 'বেলিসরাই' নামক বিশ্রামগৃহে অতিবাহিত করিলাম। বেলিসরাই চাঁদার পয়সায় তৈয়ার হয়, উহা বিমলা বাবুর যত্ন এবং অধ্যবসায়ের পরিচয় দিতেছে। এমন সুন্দর সরাই দেখি নাই। দক্ষিণে সরাই, বামে দাতব্যচিকিৎসালয়; প্রবেশ দ্বারে বিচিত্র রঞ্জিত ইষ্টক-নির্ম্মিত ক্লক্-টাওয়ার। টাওয়ারোপরি ঘড়ির সরঞ্জামও কিছু কিছু দেখা গেল। সরাইয়ের সম্মুখভাগে নাতিপ্রশস্ত প্রাঙ্গণে সারি সারি নারিকেল বৃক্ষ। সরাই দুইভাগে বিভক্ত, পূর্ব্বদিকে ভদ্রলোকদিগের থাকিবার জন্য সারসী খড়-খড়ী দেওয়া পাকা ঘর, প্রত্যেক ঘরের ২৪ ঘন্টার ভাড়া ৷৷৹ আনা মাত্র, কিন্তু একঘরে ৮ জনের অধিক লোক থাকিবার অধিকার নাই; পশ্চিম দিকে গরিবদিগের থাকিবার জন্য ছোট ছোট পাকাঘর, প্রত্যেক যাত্রীর একদিন থাকিবার ভাড়া এক পয়সা মাত্র। এই দুই বিভাগের মধ্যে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, প্রাঙ্গণে বৃহৎ কূপ। ভদ্রলোকদিগের থাকিবার যে বিভাগ, তাহা আবার অর্দ্ধেক হিন্দুর জন্য এবং অর্দ্ধেক মুসলমান এবং ভিন্ন জাতির জন্য বিভক্ত। এক এক অংশে পাঁচ ছয়টি করিয়া ঘর। বাড়ীর প্লিন্থ খুব উচু, চারিদিকে পলতোলা বড় বড় যোড়া থামওয়ালা বারাণ্ডা, কার্ণিসে সুন্দর কারুকার্য্য। উত্তর দিকে ছাতে যাইবার দুইটী সিঁড়ি, সরাইয়ের ছাত হইতে হাঁসপাতালের ছাতে যাইবারও পথ আছে। শুনিলাম, এক সময়ে সরায়ের প্রত্যেক ঘর টানাপাখা, টেবিল, চেয়ার, খাট প্রভৃতি নানা রকম সরঞ্জামে সুসজ্জিত ছিল। কিন্তু এক্ষণে সে সব কিছুই নাই। এ সরায়ের ভার আজকাল মিউনিসিপালিটির হস্তে, কিন্তু কর্ত্তৃপক্ষদিগের অযত্নে দিন দিন অমন সুন্দর সরাই নষ্ট হইয়া যাইতেছে। পাকা সারসী-খড়খড়ীওয়ালা পাইখানার আধুনিক অবস্থা বড়ই শোচনীয়।
আমরা রাজগৃহে যাইবার এবং সেখানে থাকিবার বন্দোবস্ত করিবার জন্য সেই রাত্রেই ডিষ্ট্রীক্ট বোর্ডের ওভারসিয়ার বাবু নন্দলাল মুখোপাধ্যায়ের নিকট গেলাম, তাঁহার সঙ্গে আমাদের মধ্যে দু এক জনের অল্প আলাপ ছিল এবং তাঁহার নামে চিঠিও আমাদের কাছে ছিল। নন্দবাবু বড় ভদ্রলোক, তিনি সেই রাত্রেই আমাদের রাজগিরি যাইবার জন্য তিনখানি উৎকৃষ্ট স্প্রিংওয়ালা এক্কা এবং একখানি গরুর গাড়ী ঠিক্ করিয়া দিলেন, এবং রাজগৃহে ইন্সপেক্সন্ বাঙ্গালায় থাকিবার অনুমতি দিলেন। প্রত্যেক এক্কায় যাইবার আসিবার ভাড়া ৩৲ টাকা এবং যে কয় দিন থাকিবে প্রত্যেক দিনের খোরাকী ৷৷৹ আনা, এবং গরুর গাড়ির যাইবার আসিবার ভাড়া ১৷৷৹ টাকা স্থির হইল। আমরা সে রাত্রে খাবার বিশেষ গোলযোগ না করিয়া বাজারের মোটা লুচি ও ধূলামাখা মিষ্টান্ন খাইয়া জঠরানল নিবৃত্তি করিলাম।
সোমবার - প্রত্যুষে গরুর গাড়ীতে আমাদের বিছানা পত্র এবং একজন চাকর রওনা করিয়া দিলাম। আমরা মুখ হাত ধুইয়া চা রুটি খাইয়া রাঁধুনি ব্রাক্ষ্মণ এবং এক বেলার মত আহারীয় সামগ্রী সঙ্গে লইয়া বেলা সাতটার সময় রাজগৃহাভিমুখে যাত্রা করিলাম। বিহার হইতে রাজগৃহে যাইবার দুইটি পথ, একটি গিরিইয়াক্ হইয়া এবং অন্যটি শিলাও হইয়া। গিরিয়াকের পথ পাকা কিন্তু তিন জায়গায় নদী পার হইতে হয় এবং সে পথে রাজগৃহ ১৮ মাইল; শিলাওয়ের পথ কাঁচা কিন্তু ঐ পথে নদীপারের গোলযোগ নাই, আর রাজগৃহ ১৫ মাইল মাত্র, লোকে সচরাচর এই পথেই রাজগিরি গিয়া থাকে। আমরা শিলাওয়ের পথে চলিলাম। দক্ষিণাভিমুখে কিছুদূর গিয়া পঞ্চানন নদ পার হইলাম; নদবক্ষ শুষ্ক, স্থানে স্থানে কেবল একটু একটু জল দেখা যাইতেছে। পঞ্চানন নদ পার হইয়া গিয়া বরাগাঁও যাইবার পথ দেখিলাম। বরাগাঁও বুদ্ধের প্রধান শিষ্য শারিপুত্রের জন্মস্থান বলিয়া খ্যাত। নলন্দা বৌদ্ধবিশ্ববিদ্যালয় এইখানেই ছিল, শুনিলাম, আজি তাহা বৌদ্ধ মন্দির ও সমাধির ভগ্নরাশি বক্ষে ধারণ করিয়া কাল মাহাত্ম্যের পরিচয় দিতেছে। আমরা সময়াভাবে বরাগাঁও যাইতে পারিলাম না। পথের দুইপার্শ্বে বিস্তৃত ধান্যক্ষেত্রের মনোরম শোভা দেখিতে দেখিতে, খর্জ্জুর ও তালিবনের মর্ম্মর শব্দ শুনিতে শুনিতে, বেলা সাড়ে দশটার সময়, শিলাও গ্রামে উপস্থিত হইলাম। শিলাও একটি বর্দ্ধিষ্ঠ গ্রাম, প্রায় তিন চারি হাজার লোকের বসতি হইবে। এখানকার খাজা ও চিড়ে প্রসিদ্ধ। আমরা দুইই কিছু কিছু কিনিলাম। ভাল খাজা টাকায় ৴২৷৷৹ সের এবং চিঁড়ে ৴১৩সের ৴১৪ সের করিয়া। শিলাও হইতে প্রায় দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গিয়া আমরা আধুনিক রাজগৃহ বা রাজগিরি গ্রামে উপস্থিত হইলাম। রাজগিরি নিতান্ত ক্ষুদ্র গ্রাম নয়, অনেক গুলি পাকা বাড়ী দেখিলাম, বাজারও মন্দ নয়। এখানে একটি বৃহৎ সাধু-সঙ্গত আছে। রাজগিরির বাজারে আমরা কিঞ্চিৎ ঘি এবং তেল কিনিয়া আমাদের নির্দ্দিষ্ট বাসস্থান ইন্সপেক্সন্ বাঙ্গালাভিমুখে চলিলাম। রাজগিরি গ্রাম হইতে একপোয়া পথ পশ্চিম দক্ষিণ দিকে গিয়া সেই বাঙ্গালায় পঁহুছিলাম। সেখানকার চৌকিদার, আমরা নন্দ বাবুর পরিচিত ভদ্রলোক, শুনিয়া তৎক্ষণাৎ ঘরের দরজা খুলিয়া দিল। বাঙ্গালায় দুইটি ঘর, সম্মুখে বারাণ্ডা, ঘরের মেঝেতে মেটীং করা, উপরে চাঁদওয়া; টেবিল, চেয়ার, আলগানি খাট প্রভৃতি নানারকম ইংরাজী আসবাবে ঘরগুলি সজ্জিত, প্রত্যেক ঘরের সংলগ্ন একটি একটি বাথরুম, তাহাতে কমোড ইত্যাদি রহিয়াছে দেখিলাম। সাহেবেরা আসিয়া এই খানে থাকেন। সার চার্লস ইলিয়াট এইখানে ছিলেন। আমাদের ইন্সপেক্সন্ বাঙ্গালায় পঁহুছিতে প্রায় দুই প্রহর হইল। পরামর্শ হইল যে, মকদুম কুণ্ড নামক উষ্ণপ্রস্রবণে স্নান করিতে হইবে, কিন্তু সেখানে মুসলমান ভায়ারা যেরূপ ভাবে দখল করিয়া বসিয়া রহিয়াছেন, দেখিলাম তাহাতে স্নান করিতে ভক্তি হইল না। পরে সপ্তধারায় স্নান করাই স্থির হইল। পথে যাইতে যাইতে নদীতে বিস্তর ছোট ছোট মাছ খেলা করিতেছে দেখিয়া বাঙ্গালী লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। 'ক্ষুধা তৃষ্ণা পরিহরি' গামছা দিয়া বিস্তর মাছ ধরিয়া বাসায় রাঁধিবার জন্য পাঠাইয়া দিলাম। পরে সপ্তধারা কুণ্ডে এবং ব্রক্ষ্মকুণ্ডে স্নান করিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম এবং প্রথমে উত্তম রূপে জলযোগ করা গেল, পরে বেলা তিনটার সময় খিচুড়ি খাওয়া গেল। আহারান্তে অল্পমাত্র বিশ্রাম করিয়া আমরা পর্ব্বতারোহণে বহির্গত হইলাম।
"বৈভারো বিপুলশ্চৈব রত্নকুট গিরিব্রজ, রত্নাচল ইতিখ্যাতা পঞ্চইতি পবনা নগা।" দেখিলাম, সেই গিরিব্রজপুরের উত্তরে বৈভারগিরি এবং বিপুলাচল, দক্ষিণে গিরিব্রজগিরি, মধ্যে রত্নাচল এবং রত্নকূট বা রত্নগিরি পর্ব্বতমালা অচল অটলভাবে দণ্ডায়মান; দেখিলাম, পূর্ব্বদিক্ বিপুল এবং তৎসংলগ্ন রত্নগিরি বা রত্নকূট পর্ব্বত প্রাচীরে, পশ্চিমদিক্ বৈভারের একাংশ চক্রানামক পর্ব্বতে, দক্ষিণ গিরিব্রজগিরির উন্নত শিখর মালায় এবং উত্তরদিক্ বিপুলাকায় বিপুল এবং বৈভারের অভেদ্য পর্ব্বত প্রাচীরে সুরক্ষিত। ঐ বৈভার এবং তৎসন্নিহিত রত্নাচল পর্ব্বত মধ্যস্থিত উপত্যকা ভূমিতেই জরাসন্ধের রাজপ্রাসাদ ছিল, এবং তাহা হইতেই গিরিব্রজপুরের আধুনিক নাম রাজগৃহ হইয়াছে। 'রাজগৃহে' প্রবেশ করিবার চারিটি দ্বার ছিল। প্রথম, বিপুল ও বৈভারের মধ্যস্থিত গিরিসঙ্কটে, দ্বিতীয় গিরিব্রজগিরির মধ্যস্থিত গিরিসঙ্কটে, তৃতীয় গিরিব্রজগিরি এবং রত্নকূট বা রত্নগিরির মধ্যস্থিত ভুমিতে এবং চতুর্থ বোধহয় রত্নাচল এবং বৈভারের অংশ চক্রার মধ্যে'। উপরোক্ত পর্ব্বতমালার উচ্চতম স্থল ১০০০ ফিটের অধিক হইবে না। হান্টার সাহেবের মতে এই পর্ব্বতরাশির প্রস্তর ইগিনিয়স্। ঐ সকল পর্ব্বতমালায় গৃহনির্ম্মাণোপযোগী প্রস্তর স্লাব, কিম্বা বাসনপত্রাদি তৈয়ার হইবার মত প্রস্তর পাওয়া যায়, এমন বোধ হইল না। পর্ব্বতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত এবং ব্যাঘ্র ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্রক জন্তুর আবাসস্থল। আমাদের বাসস্থান পুর্ব্বোক্ত বৈভারগিরির পাদদেশেই অবস্থিত ছিল। সেই ইন্সপেক্সন্ বাঙ্গালার পশ্চিমে আম্রকানন, পূর্ব্বে ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী সরস্বতী কলকলনাদে বহিয়া চলিয়াছে, উত্তরে বৌদ্ধের সমসাময়িক নৃপতি অজাতশত্রুর পিতা বিম্বসার-নির্ম্মিত দুর্গ প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ, এবং দক্ষিণে উন্নতশিখর বৈভারগিরি।
সোমবার সন্ধ্যাঃ- আজি আমাদের প্রথম পর্ব্বতারোহণ। কেহ বা কোট্ পেন্টুলান পরা নেকটাই বাঁধা পুরা সাহেব; কেহ বা ধূতি ওভারকোট্ আঁটা আধ বাঙ্গালী আধ ইংরাজ; আবার কেহ ফুল মোজা পায়, গায় শাল, হাতে সৌখিনী ছড়ি, ধূতি পরা ফুলবাবু। এইরূপে বিচিত্র বেশ ভূষা করিয়া বেলা চারিটার সময় বিপুলাচল আরোহণার্থ বহির্গত হইলাম, সঙ্গে গাইড নাই, নিজেই নিজের পথ প্রদর্শক হইয়া পর্ব্বতের পাদদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের জনৈক স্থূলকায় বন্ধু পর্ব্বতারোহণ দুঃসাধ্য বিবেচনা করিয়া পশ্চাদ্পদ হইলেন। তাঁহার নেকটাই বাঁধাই সার হইল। আমরা পর্ব্বতে উঠিতে লাগিলাম, তিনি ম্লান মুখে একাকী ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে ফিরিলেন। দেখিয়া দুঃখও হইল, হাসিও আসিল। আমরা আন্দাজি একটি পথ ধরিয়া উঠিতে লাগিলাম; কিছু দূর উঠিতে না উঠিতে ঘাম ছুটিতে লাগিল, কেহ ওভারকো্ট্ খুলিলেন, কেহ রেপার ফেলিলেন, কেহ বা কোট কমফর্টার ফেলিয়া রাখিয়া উপরে উঠিতে লাগিলেন। প্রায় তিন শত ফুট উপরে উঠিয়া আমরা একটী জৈন মন্দির দেখিতে পাইলাম, এখানে আসিতেই সূর্য্যাস্ত হইল, কিন্তু সেখান হইতে গিরিব্রজপুরের ভালরূপ দৃশ্য পাওয়া গেল না, ক্রমে আরও উপরে উঠিয়া আর একটি ক্ষুদ্র মন্দির দেখিলাম, তাহাতেও আশ মিটিল না, আরও কিঞ্চিৎ উপরে উঠিলাম। সেখানে এক প্রাচীন দুর্গ প্রাচীর-স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাইলাম। অবশেষে সমাগত সন্ধ্যা দেখিয়া নামিতে লাগিলাম। ধরণী আঁধারের ধূসর বেশ পরিয়াছে, অচেনা পথ ক্ষুদ্র বৃক্ষ ও গুল্মলতাদিতে আচ্ছন্ন; যাহা হউক, সাহসে ভর করিয়া নামিতে লাগিলাম। ক্রমে অন্ধকার গাঢ়তর হইতে লাগিল, দুর্ব্বল বাঙ্গালীর সকল সাহস লোপ পাইল। কেহ হরি হে! বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন, আবার কেহ বা "কুছ পরওয়া নাহি" বলিয়া দ্রুতবেগে নামিতে লাগিলেন। পথে উঠিবার সময় যে সকল বস্ত্রাদি ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছিলাম, তাহা নামিবার সময় পথ-প্রদর্শনের অনেক সহায়তা করিল। কিছু দূর নামিয়া আসিয়া আমাদের মধ্যে দুই জন অপথে গিয়া পড়িলেন, দেখিলেন আর যাইবার পথ নাই, তাঁহারা সেইখান হইতে আমাদের সাবধান করিয়া দিলেন, এবং ফিরিয়া আসিয়া সকলে একসঙ্গে নামিতে লাগিলাম। হিল্ওয়ালা জুতা পিছলাইয়া যাইতে লাগিল, কেহ বা বাহাদুরি করিয়া শিলা খণ্ডের মধ্যস্থিত সঙ্কীর্ণ পথ দিয়া নামিতে গিয়া পড়িয়া গেলেন। যাহা হউক, কোন ক্রমে তো ভালয় ভালয় সে রাত্রে আমরা বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। সন্ধ্যাকালে পর্ব্বতারোহণের যথেষ্ঠ কষ্ট ভোগ করিলাম। কিন্তু গৃহে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম যে, আমাদের পূর্ব্বোক্ত স্থূলকায় বন্ধুটী সকলের জলযোগের বিশেষ আয়োজন করিয়া রাখিয়াছেন। কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া একটু তাস খেলা গেল। পরে পরামর্শ হইল যে, পরদিন অতি প্রত্যুষে উঠিয়া একদিনে সমস্ত গিরিব্রজ দেখিতে হইবে, এবং পাণ্ডাকে ডাকিয়া বলিয়া দেওয়া হইল যে, সে যেন খুব সকাল সকাল আসে।
মঙ্গলবারঃ- রাত্রে আমরা সুখে নিদ্রা গিয়া ভোর পাঁচটার সময় সকলে উঠিলাম, উঠিয়া দেখি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন --- অল্প অল্প বৃষ্টি পড়িতেছে, প্রবল বেগে বাতাস বহিতেছে, কিন্তু বঙ্গীয় যুবক এ সামান্য বাধায় পশ্চাদ্পদ হইবার নয়। ছাতা মাথায় দিয়া মাঠে প্রাতঃক্রিয়া সমাপন করা গেল। বাসায় আসিয়া কেহ বা ইংরাজী মতে, কেহ বা আধ হিন্দু আধ ইংরাজি মতে, এবং কেহ বা হিন্দু মতে, জলযোগ করিয়া বেলা ৭টার সময় গিরিব্রজপুর দর্শনার্থ বহির্গত হইলাম। আমাদের মধ্যে দু একজন অনাহারেও রহিলেন, আমরা পকেটে হিন্দু বিস্কুট লইলাম।
আমরা বিপুল এবং বৈভারের মধ্যবর্ত্তী গিরিপথ দিয়া গিরিব্রজপুরের প্রবেশ করিলাম। দক্ষিণে বৈভার, বামে বিপুলাচল, এই গিরিপথেই জরাসন্ধের জরারাক্ষসী রক্ষীত সূর্য্যদ্বার ছিল, তাহার চিহ্ন আজও লক্ষিত হয়।
বিপুলাচল --- লোকে বলে বিপুলাচলই মহাভারতের চৈত্যক পর্ব্বত। বিপুলাচলের পাদদেশে সর্ব্বশুদ্ধ ছয়টি উষ্ণপ্রস্রবণ দেখিলাম, উহার মধ্যে পশ্চিম-উত্তর পাদদেশে স্থিত মকদুমকুণ্ড বা শৃঙ্গীঋষি-কুণ্ড সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। পূর্ব্বে শৃঙ্গীঋষি এইস্থানে অবিস্থিতি করিতেন, পরে মুসলমানেরা ঐ স্থান অধিকার করিলে মকদুম্ সাহ সেখ্ সরিফ্উদ্দিন আহমেদি এহিয়া নামক জনৈক প্রসিদ্ধ মুসলমান ফকির ৭১৫ হিজারিতে তথায় আসিয়া বাস করেন, এবং তাঁহা হইতেই ঐ শৃঙ্গীঋষিকুণ্ডের নাম মকদুম্কুণ্ড হইয়াছে। তাঁহার প্রকৃত নাম সরিফউদ্দিন, পিতার নাম আহমদ্ এহিয়া, জাতিতে সেখ্, বাসস্থান পাটনার নিকটবর্ত্তী মনের গ্রামে, তিনি সাহ বা উদাসীন ছিলন, এবং তিনি সকলের সেবনীয় ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে মকদুম্ বলিত।
মকদুমকুণ্ড --- মকদুমকুণ্ড চতুর্দ্দিক উচ্চ প্রাচীরে বেষ্টিত, কুণ্ডের পরিসর ছয় হাত দীর্ঘ এবং প্রায় পাঁচ হাত প্রস্থ হইবে। ৺অক্ষয় কুমার দত্ত মহাশয়ের চারুপাঠ প্রথম ভাগে পড়িয়াছিলাম "স্থানে স্থানে ভূমণ্ডলের অভ্যন্তর হইতে যে জলপ্রবাহ নির্গত হয়, তাহা প্রস্রবণ। যে সকল প্রস্রবণের জল স্বভাবতঃ সর্ব্বদা উষ্ণ থাকে, তাহার নাম উষ্ণপ্রস্রবণ।" কিন্তু মকদুমকুণ্ডের জল ভূগর্ভোত্থিত নয়, পর্বত গাত্র হইতে স্বভাবতঃ সর্ব্বদা উষ্ণজল নির্গত হইতেছে। বাহির হইতে সে স্থানটি দেখিবার যো নাই; তবে এইমাত্র দেখিলাম যে, প্রস্তর-নির্ম্মিত একটী নল দিয়া কুণ্ডেতে নাতি উষ্ণ জল পড়িতেছে। কুণ্ড মধ্যে সদা সর্ব্বদা আড়াই হাত তিন হাত জল বদ্ধ থাকে, অতিরিক্ত জল পয়োনালা দিয়া বাহিরে বহিয়া যাইতেছে। কুণ্ডের সংলগ্ন একটি মসজিদ্ আছে, মসজিদের বহির্প্রাঙ্গণে বড় বড় বৃক্ষ; ভিতরের প্রাঙ্গণ ইষ্টক প্রাচীরে বেষ্টিত। এই প্রাঙ্গণের পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণে মকদুম সাহের চিল্লা অর্থাৎ পর্ব্বতগুহা দেখিলাম। এই খানে বসিয়া মকদুম সাহ নিত্য উপাসনা করিতেন। গুহাটি ক্ষুদ্র, উহার প্রবেশ পথের উপরিভাগে একখণ্ড বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড নিম্নদিকে লম্বমান। তথাকার মুসলমান গুহারক্ষক বলিলেন, এক সময় মকদুম সাহ একান্বয়ে চল্লিশ দিন উপবাস করিয়া এই গুহা মধ্যে তপস্যা নিরত হন। হিন্দুদৈত্যেরা, হিন্দুগুহা যবনাধিকৃত এবং হিন্দুর কঠোর তপস্যা যবন কর্ত্তৃক পরাভূত হইতে চলিল দেখিয়া, ঐ প্রস্তর খণ্ড দ্বারা গুহাদ্বার রুদ্ধ করিয়া মকদুম সাহকে মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলেন, মকদুম সাহের সহসা ধ্যানভঙ্গ হইল, তিনি একবার উপর দিকে দেখিলেন, প্রস্তর খণ্ড সেই অবস্থায় রহিয়া গেল, আর পড়িল না। সে দিন হইতে আজি অবদি উহা ঐ অবস্থায় রহিয়াছে। এই চিল্লার কিঞ্চিৎ ঊর্দ্ধে দক্ষিণদিকে মকদুম সাহের নিত্য নিমাজের স্থান যত্ন সহকারে রক্ষিত রহিয়াছে দেখিলাম। মকদুমকুণ্ড আজি বিহারের মধ্যে মুসলমানদিগের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। বহু সংখ্যক নরনারী এই কুণ্ডে স্নানার্থ আসিয়া থাকেন। যাঁহাদের কোন মনস্কামনা পূর্ণ হইয়াছে, তাঁহারা মকদুমকুণ্ডে স্নানান্তে আপনাদিগের পরিধেয় বস্ত্রের একাংশ ছিন্ন করিয়া উপরোক্ত গুহাদ্বারের দুইপার্শ্বে দোলায়মান চামরে বাঁধিয়া দেন; দিন দিন চামর দুইটি নানা বর্ণের ফালিতে পরিপূর্ণ হইয়া আয়তনে বাড়িতেছে। মকদুমসাহ হিন্দুদিগেরও মাননীয় ছিলেন, আজও অনেক হিন্দু তাঁহার চিল্লা দর্শনার্থ গিয়া থাকেন, এবং রাজগিরির পাণ্ডারা হিন্দুদিগের দত্ত পয়সার অংশও পাইয়া থাকেন। আমরা যে দিন মকদুমকুণ্ড দেখিতে যাই, সেদিন জনৈক মুসলমান জমিদার স্ত্রীপুত্রাদি সমভিব্যাহারে মকদুমকুণ্ডে স্নানার্থে আসিয়াছিলেন। পুরুষেরা তাঁবুর ভিতরে, এবং স্ত্রীলোকেরা উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত অঙ্গনের মধ্যে অবস্থিত দেখিলাম, বহির্প্রাঙ্গণে পোলাও কালিয়া তৈয়ার হইতেছিল। কুণ্ডের নিম্নদেশে সমতল ভূমিতে অনেকগুলি মুসলমান পিরের কবর দেখিলাম। মুসলমান দিগের অধিকার কালে এখানে যে প্রসিদ্ধ বিদ্যালয় ছিল, সে গৃহের ভগ্নাবশেষ এই কবরগুলি হইতে উত্তরে অবস্থিত, এক্ষণে কেবল দু তিনটি পাথরের থাম অবশিষ্ট রহিয়াছে।
মকদুমকুণ্ডের কিঞ্চিৎ পশ্চিম–দক্ষিণে অন্য পাঁচটি উষ্ণপ্রস্রবণ, যথা, সীতাকুণ্ড, রামকুণ্ড, গণেশকুণ্ড, সূর্য্যকুণ্ড এবং সোমকুণ্ড। ইহাদের মধ্যে কোনটির জল মকদুমকুণ্ডের জলের অপেক্ষা উষ্ণতর, কোনটির বা জল অপেক্ষাকৃত শীতল। এই পঞ্চকুণ্ডের জল ভূগর্ভোত্থিত। হিন্দু এবং জৈন উভয়েই এই সকল কুণ্ডে স্নানাদি করিয়া থাকেন। এই পঞ্চকুণ্ডের পাশ দিয়া আমরা পূর্ব্বদিন বিপুলাচলে উঠিয়াছিলাম। বৈভারাচলের পাদদেশে যে সকল কুণ্ড এবং পর্ব্বরোপরি যে সকল মন্দিরাদি দেখিয়াছিলাম, তাহার বিবরণ পরে দিব। এক্ষণে বৈভার এবং তৎসম্মুখীন রত্নাচলের মধ্যবর্ত্তী উপত্যকা ভূমিতে অর্থাৎ জরাসন্ধের রাজগৃহে যাহা দেখিলাম, তাহার বিষয়ে দু একটী কথা বলিতে চাহি। আমরা বৈভার গাত্রস্থিত কুণ্ডের নিম্নদেশ দিয়া ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী সরস্বতীর কূলে কূলে দক্ষিণাভিমুখে চলিলাম, কিছু দূর গিয়াই এক শ্মশানে উপস্থিত হইলাম। 'রাজগৃহের' প্রবেশদ্বারে, পার্ব্বত্য নদীকূলে সেই শ্মশানভূমি দেখিয়া মনে হইল, রাজচক্রবর্ত্তী জরাসন্ধের সমৃদ্ধিশালিনী 'রাজগৃহ' আজি যে শ্মশানে পরিণত হইয়াছে, তাহারি নিদর্শনচিহ্ন বুঝি বৈভারের পূর্ব্বাঙ্কে অঙ্কিত রহিয়াছে। আমরা শ্মশানভূমি অতিক্রম করিয়া নাতিদূরে একটি উচ্চস্থানে জরারাক্ষসীর* মন্দির দেখিতে পাইলাম। পাণ্ডা বলিলেন জরা রাক্ষসী উত্তর দ্বারের রক্ষয়িত্রী ছিল বলিয়া তাঁহার মন্দির এইখানে স্থাপিত হইয়াছে।
আমরা এখান হইতে পশ্চিমাভিমুখে বনপথ দিয়া 'শূন্যভাণ্ডার', 'জরাসন্ধের আখাড়া' প্রভৃতি স্থান দেখিতে চলিলাম। পথ সঙ্কীর্ণ, বন গুল্ম লতাদিতে স্থানে স্থানে অবরুদ্ধ, সূর্য্যদেবও প্রখর কিরণে উদিত হইলেন দেখিয়া আমরা ওভারকোট প্রভৃতি ভারি কাপড় চোপড় খুলিয়া ফেলিলাম, জনৈক রাখাল সেই পথে যাইতেছিল, আমাদের পাণ্ডার কথামত সেই সকল কাপড় তাহাকে আমাদের বাসায় রাখিয়া দিবার জন্য দিলাম, এই খানেই বলিয়া রাখি, আমরা বাসায় ফিরিয়া আসিয়া সে সমস্তই পাইয়াছিলাম। আমরা আধক্রোশ আন্দাজ গিয়া বৈভারাচলের দক্ষিণাঙ্কে একটি মনুষ্য–খোদিত গিরিকক্ষ দেখিতে পাইলাম। পাণ্ডা বলিলেন, ইহারই নাম 'শূন্যভাণ্ডার'। এই গিরি কক্ষটি চতুষ্কোণ, দৈর্ঘে ১১ হাত, প্রস্থে ৬ হাত, এবং মধ্যস্থলের উচ্চতা ৪ হাত হইবে। কক্ষ দক্ষিণ দ্বারী, দক্ষিণ দিকের দেওয়াল প্রায় আড়াই হাত মোটা; প্রবেশ দ্বার ৪ হাত উচ্চ এবং ২ হাত প্রশস্ত, প্রবেশ দ্বারের বামদিকে একটি গবাক্ষ উহা উচ্চ ২ হাত, প্রস্থে ১৷৷ হাত। ঐ কক্ষের ভিতরের এবং বাহিরের দেওয়ালে খোদিত অক্ষর সকল দেখিলাম কিন্তু পড়িতে পারিলাম না। গিরিকক্ষের উত্তর দিকের দেওয়ালের পশ্চিম ভাগে একটি লম্বা ফাটা দাগ দেখাইয়া আমাদের পাণ্ডা বলিলেন যে, ইহারই পশ্চাতে জরাসন্ধের স্বর্ণভাণ্ডার ছিল। ইংরাজ গোলাগুলি মারিয়া এই দরজা ভাঙিতে পারেন নাই। সহসা দেখিলে বোধ হয় বটে যে পূর্ব্বে ঐ খানে একটি দ্বরজা ছিল, পরে কেহ বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড দ্বারা উহা বন্দ করিয়া দিয়াছে, কিন্তু আমার বিবেচনায় উহা পর্ব্বত গাত্রে একটি ফাটমাত্র। এই কৃত্রিম গিরিকক্ষ যে এক সময়ে উত্তম রূপে প্লাসটার করা ছিল, এবং উহার বর্হিদ্দেশে বারাণ্ডা ছিল, তাহার চিহ্ন এখনও বর্ত্তমান রহিয়াছে। কক্ষমধ্যে বুদ্ধদেবের মূর্ত্তিখোদিত এক ভগ্ন প্রস্তর খণ্ড দেখিলাম। এই কক্ষের অন্য নাম সোণ-ভাণ্ডার, বোধহয় স্বর্ণভাণ্ডার বা সোণাভাণ্ডারের অপভ্রংশ মাত্র। ইহার নাম শূন্যভাণ্ডার বা সোন্-ভাণ্ডার যে কেন হইল, তাহার কোন বিশেষ পরিচয় পাইলাম না, উহা যে কোন সময়ে ধনাগার ছিল, তাহারও কোন চিহ্ন দেখিলাম না। আমাদের মধ্যে কেহ বলিলেন, এই কক্ষেই বুদ্ধদেব ধ্যানস্থ ছিলেন, এই কক্ষে বসিয়াই তাঁহার শিষ্যগণ বৌদ্ধধর্ম্মের আদি নীতিমালা সঙ্কলন করিয়াছিলেন, ইহাই সেই 'উরু বিল্ব' কক্ষ; কেহ বলিলেন, এই সেই সপ্তপানি গুহা; আবার কেহ বলিলেন, এই খানেই বুঝি জরাসন্ধের প্রসিদ্ধ কারাগার ছিল। যাহার যা মনে আসিল, তিনি তাহাই বলিলেন; আমরা এ তর্ক বৃথা দেখিয়া জরাসন্ধের আখাড়া দেখিবার জন্য পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হইলাম। কিছুদূর গিয়া দেখিলাম, এক প্রশস্ত সমতল ভূমিখণ্ডের চতুর্দ্দিকে লাল মৃত্তিকা এবং প্রস্তর মিশ্রিত উচ্চ প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ এবং প্রাচীরের চতুর্দ্দিকে সরস্বতী নদী প্রবাহমানা। কেহ বলিলেন, এইখানে জরাসন্ধের অন্তঃপুর ছিল, কেহ বলিলেন শূন্যভাণ্ডার নয়, ইহাই জরাসন্ধের সেই কারাগার ---- যেখানে জরাসন্ধ রুদ্রদেবের পূজার্থ 'অশিতি নৃপতি জিনি ভুজবলে রেখেছিল বন্দী করি কারাগারে'। আমাদের পাণ্ডা এ বিষয়ে কিছুই বলিতে পারিলেন না। তৎপরে শূন্যভাণ্ডার হইতে আধক্রোশ পশ্চিমে গিয়া বৈভারের পাদদেশে সেই ভারত খ্যাত রঙ্গভূমি --- সেই জরাসন্ধের আখাড়া নামক স্থানে উপস্থিত হইলাম। পাণ্ডা বলিলেন, জরাসন্ধ নিত্য এই স্থানে মল্লযুদ্ধ করিতেন, এবং ভীমের সহিত এইখানে জরাসন্ধের ১৩ দিন মল্লযুদ্ধ হয়, ইষ্টকের চূর্ণরাশি দেখাইয়া বলিলেন, দেখুন রক্তচিহ্ন এখনও বর্ত্তমান রহিয়াছে। এই স্থানটুকুর বিশেষত্ব এই যে, সেই শৈল –উপত্যকার বন্ধুর উপলরাশির মধ্যে ইহাই একমাত্র মসৃণ মৃত্তিকাময় স্থান; নিম্নে রাঙ্গামাটি, উপরে এক ফুট আন্দাজ ভাঁটা মাটির মত মসৃণ এবং শ্বেতাভ মৃত্তিকায় আচ্ছাদিত, একবিঘা জমি প্রায় এইরূপ। এক সময়ে যে এই আখাড়ার চতুর্দ্দিকে গৃহাদি ছিল, তাহারও নিদর্শন দেখিলাম। একস্থানে দেখিলাম, ইষ্টকরাশি সহস্রাধিক বৎসর প্রকৃতির সহিত যুদ্ধ করিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে, কিন্তু ছুইলেই গুঁড়া হইয়া যায়। আমরা ঐ ইষ্টক চূর্ণ এবং আখাড়ার শ্বেত মৃত্তিকা লইলাম, প্রবাদ যে, জরাসন্ধের আখাড়ার মাটি মাখিলে লোকে সবলকায় হয়। এই আখাড়ার পশ্চিমে আর কিছু দর্শনীয় স্থান আছে কিনা, পাণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি বলিলেন, আর কিছুই নাই; কিন্তু আমরা দেখিলাম, দূরে বৃক্ষাচ্ছাদিত মৃত্তিকা প্রাচীরে পরিবেষ্টিত তিন চারিটি স্থান রহিয়াছে, জানিনা, তথায় কিছু দর্শনীয় বস্তু আছে কি না, কিন্তু পশ্চিমদিকের বন গাঢ়তর এবং দূরতা বশতঃ আমরা আর পশ্চিমদিকে না গিয়া প্রত্যাবৃত্ত হইলাম। এই উপত্যকা ভূমির প্রায় মধ্যাভাগে যে একটি তড়াগ ছিল, তাহার কিঞ্চিৎ অংশ এখনও বর্ত্তমান রহিয়াছে। এই তড়াগের পূর্ব্বদিকে একটু উচ্চস্থানে একটি মন্দির এবং কূপ দূর হইতে দেখিতে পাইলাম, পাণ্ডা বলিলেন উহার নাম 'নির্ম্মাণকূপ', কিন্তু উহা কবে নির্ম্মিত হইল এবং কেই বা নির্ম্মাণ করিল, তাহার বিষয় কিছুই বলিতে পারিলেন না। আমাদের বোধ হইল, উহা কোন বৌদ্ধকীর্ত্তি হইবে। পথ দুর্গম এবং বেলা প্রায় ১০টা বাজিয়াছে দেখিয়া আমরা উহা দেখিতে গেলাম না। রাজগৃহ উপত্যকা দেখা এইখানে শেষ করিলাম।
রাজগৃহ আজি বনগৃহে পরিণত দেখিলাম, সে উপত্যকা ভূমি স্থানে স্থানে যে দৃঢ় প্রাচীরে পরিবেষ্টিত ছিল, তাহার ভগ্নাবশেষ আজি বনবৃক্ষাচ্ছাদিত, রাজপ্রাসাদাদি ভূমিসাৎ হইয়া গিয়াছে, তবু সেই পাষাণময় অট্টালিকার প্রস্তররাশি স্থানে স্থানে স্তূপাকার রহিয়াছে, বৈভারাঙ্কে বাসস্থানার্থ যে সকল স্থান পরিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহার ক্ষীণ চিহ্ন লক্ষিত হইতেছে। আমরা এখান হইতে গিরিব্রজপুরের দক্ষিণ দ্বার দেখিতে চলিলাম। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, গিরিব্রজপুর দক্ষিণ দিকে গিরিব্রজগিরি দ্বারা রক্ষিত। এই গিরিব্রজগিরির মধ্যভাগে যে গিরিসঙ্কট, তথায় 'গজদ্বার' নামক রাজগৃহ প্রবেশের দক্ষিণদ্বার ছিল। পূর্ব্বোক্ত বৈভার এবং বিপুলের মধ্যবর্ত্তী 'সূর্য্যদ্বার' হইতে ঐ গজদ্বার অবধি যে বিস্তৃত রাজপথ ছিল, আজও লোকে সেই পথ অনুসরণ করিয়া যাতায়াত করিয়া থাকে; সর্ চার্লস ইলিয়টের আগমনোপলক্ষে এই পথের স্থানে স্থানে জীর্ণ সংস্কার হইয়াছিল। আমরা শীঘ্র ঐ রাজপথ ধরিবার জন্য অপথ দিয়া, বনের ভিতর দিয়া চলিলাম, যাইতে যাইতে কেহ সুন্দর বনফুলে দেহ সজ্জিত করিলেন, কেহ বনকুল তুলিয়া খাইলেন, আমাদের কবিরাজ মহাশয় কুঁচ, কুরচি প্রভৃতি আয়ুর্ব্বেদোক্ত ঔষধি সংগ্রহ করিতে লাগিলে। আমরা এইরূপে কতদূর অপথে গিয়া পূর্ব্বোক্ত রাজপথে পড়িলাম, বন কন্টকাদিতে বস্ত্রাদি ছিন্ন হইল, কাহারও বা দেহ ক্ষত বিক্ষত হইল। প্রায় একক্রোশ দক্ষিণাভিমুখে গিয়া আমরা গিরিব্রজগিরির পাদদেশে পথপার্শ্বে এক প্রকাণ্ড কূপ সন্নিকটে বৃক্ষতলে অল্প বিশ্রাম লাভ করিলাম। পরে আরও কিঞ্চিৎ দক্ষিণাভিমুখে গিয়া পথের উপরে বামধারে প্রস্তরে বিচিত্রভাষায় খোদিত শ্লোকাদি দেখিলাম। বঙ্গেশ্বর ইলিয়ট বাহাদুর যাহাতে ঐ সকল চিহ্নাদি লোকের চলাচলে বিনষ্ট না হয়, তাহার ব্যবস্থা করিবার আজ্ঞা দিয়াছেন। আমরা এখান হইতে পশ্চিম-দক্ষিণাভিমুখে কিছু দূর গিয়া গিরিব্রজ গিরিমধ্যস্থিত গিরিসঙ্কটে উপস্থিত হইলাম। ইহার কথা পরে বিবৃত করিব।
(ক্রমশঃ)
*জরারাক্ষসী এবং জরাসন্ধের বিস্তৃত বিবরণ মহাভারতের সভাপর্ব্বের সপ্তদশ অধ্যায় এবং পরবর্ত্তী অধ্যায় সকলে দেখুন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ
[ লেখার বাকী অংশ পরের সংখ্যায়। মূল বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]