অরণ্যের দিনরাত্রি ও আমাডুবি
অভিজিৎ কুমার চ্যাটার্জী
ধলভূমগড়কে ডানহাতে রেখে, সুমিত্র গাড়ি ছোটাল রাউতাড়া রোড ধরে। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার চলে এসেছি। ছোট ছোট জনপদ, কোপাই নদীর একটি শাখা, পার হয়ে পৌঁছলাম সুন্দরদিহ। আমাদের গন্তব্যস্থল আমাডুবি। অবাক হয়ে দেখলাম রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। অমিত বলে উঠল, 'গুরু, এ তো আমি কবির কল্পনা, ছবিতে দেখছি।' ২০১১ সাল থেকে শুরু হয় এই গ্রামীণ পর্যটনের পথ চলা। পাথুরে রুক্ষ ভূমিকে ঘাসের আর গাছের ছায়ায় গড়ে তোলা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। টাটানগর থেকে ৬৫ কি. মি. দূরে আমাডুবি -- প্রাথমিক উদেশ্য ছিল স্থানীয় পায়াৎকার (Pyatkar) শিল্পীদের পুনর্বাস - সে এক দীর্ঘ সংগ্রাম।
সাঁওতালি স্থাপত্যে তৈরি কটেজ আর সবুজের চাতাল মনটাকে মাতাল করে তুলল।
বাংলা ঝাড়খন্ড বর্ডারে, ধলভূমগড় থেকে মাত্র ৪.৫ কি মি দূরে, আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট একটি গ্রাম, নাম তার 'আমাডুবি।' পায়াৎকার শিল্পীদের গ্রাম। মাত্র পঁয়তাল্লিশটি পরিবার, যারা এই বিশেষ সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত, এছাড়া গ্রামে আছে আরও ঊনসত্তরটি সাঁওতালি আদিবাসী পরিবার। অসাধারণ তাদের শিল্প প্রতিভা। চোখ ফেরানো যায় না তাদের শিল্পসত্ত্বাকে অনুভব করলে। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি, এক একটা শিল্প মন্দির। সমগ্র গ্রামটিতে অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষদের বাস, যেন জীবন্ত উপন্যাসের প্রেক্ষাপট৷
আলাপ হল পায়াৎকার শিল্পী অনিল চিত্রকর মহাশয়ের সঙ্গে। আলাপচারিতায় পেয়ে গেলাম কিছু তথ্য – গান, সংকীর্তন ও পায়াৎকার শিল্পকলা চর্চাবিষয়ক। ঘাটশিলার রাজাবাহাদুর রামচন্দ্রধর পায়াৎকার শিল্পীদের আমাডুবিতে জমি দান করেন। সেই থেকে বংশপরম্পরায় এই শিল্পকলা চলে আসছে। 'দাতা কর্ণ,' 'নরমেধ যজ্ঞ' এই ছিল পূর্বতন পায়াৎকার শিল্পীদের বিষয়। কাগজের ওপর হাতে তৈরি রং (মূলত তৈরি গাছের ছাল ও স্থানীয় পাথর থেকে) দিয়ে আঁকা হয়। তুলি তৈরি করা হয় ছাগলের লোম ও বাঁশের কাঠি দিয়ে। তারপর সেই কাগজ কাপড়ের ওপর সাঁটা হয়। ফলে একটা শক্তপোক্ত রূপ পায় ছবিগুলি। শেষে দেওয়া হয় নিম গাছ থেকে তৈরি একধরণের আঠা, যাতে পোকা না লাগে। 'করম পর্ব' (ভাদ্র মাসে একাদশী তিথিতে হয়), 'মনসা পর্ব' এরকম বিভিন্ন হিন্দু উৎসবের ছবিও স্থান পেয়েছে এই শিল্পকলায়। পর্যটকরা কিনতে চাইলে পেয়েও যাবেন দাম ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন মাপের এই ছবিগুলি। কিন্তু এই শিল্পকলা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে যেতে চলেছে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা আর বিক্রির বাজারের অভাবে। বর্তমান প্রজন্ম কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এই সমস্যা থেকে কী করে বেঁচে বেরিয়ে আস্তে পারবে প্রাচীন এই শিল্পকলা কেউ জানে না। রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন মুহূর্ত ও নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে পায়াৎকার শিল্পীদের হাতের কাজ দেখতে দেখতে মনে মনে কুর্নিশ জানালাম! দারিদ্র্য যাঁদের থামাতে পারেনি।
মনে মনে বললাম, 'রুসিকা সঙ্গেকো' - সাঁওতালি ভাষায় 'রুসিকা' কথার অর্থ শিল্পী আর 'সঙ্গেকো' কথার অর্থ একত্রে বাস, সত্যিই যেন শিল্পীদের বাস।
কটেজের বারান্দায় এসে বসলাম, এমন সময় দেখি সুমিত্র আর অমিতের পায়ের কাছে বোতল - আরে এতো মহুয়া! শালের জঙ্গলে এসেছি, মহুয়া তো পান করব-ই।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতেন - আমি মাটি তে পা ঠুকলে মাটি ফুঁড়ে মদের ফোয়ারা উঠবে। ওদের দেখে হঠাৎ কথাটা মনে পরে গেল।
শাল মহুয়ার জঙ্গল, লাল মাটি আর নুড়ি ভরা রাস্তায় গ্রাম - আট দশটা কাঁচা বাড়ি। সাঁওতালি পরিবারগুল নিজেদের ব্যস্ত রাখে বাহাশারহুল দাসইসরফা কতরকমের নাচে। এটাই ওদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। সাঁওতালি ভাষায় নাচকে বলে 'এনেচ' এবং 'তিরিও ওরঙ্গ' মানে বাঁশি বাজানো আর গান কে বলে 'সেরেং'। সামিল হলাম আমরাও। মুগ্দ্ধ চোখে দেখছিলাম মানুষের আদিম সৌন্দর্য। পরিষ্কার করে নিকানো বাড়ির দোরগোড়ায় একটি ছাগল চুপ করে বসে আছে। পায়রাগুলোও এই দুপুরে চুপচাপ -- উড়তেই ভুলে গেছে বোধহয়। দারিদ্র্যের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা আমাদের পক্ষে সত্যিই অসম্ভব। জুন মাসে রজঃস্বলা উৎসবে গ্রামের মেয়েরা তৈরি করে 'জিল পিঠে', শুকনো শালপাতায় পরিবেশন করা হয়।
বেহুরা, কারিয়াকাটা গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল এ যেন চোখকে আরাম দেওয়া প্রকৃতি - শাল পিয়ালের বন, সাঁওতালি নাচ গান, মাদলের বোল। খুব দুঃখ হচ্ছিল - ইসস! যদি বিখ্যাত কবি গুরু রামদাস মাঝির দেখা পেতাম। আলাপ হল তাঁরই নাতির নাতি রাহুল টুডুর সঙ্গে। ঘুরে বেড়ালাম তাঁদের তৈরি আম বাগানে, কোনও বাধানিষেধ নেই আম নেওয়ার। ব্রিটিশ জমানায় গুরু রামদাস মাঝি ছিলেন গ্রাম প্রধান, ব্রিটিশদের রাজস্ব দেওয়ার জন্য তিনি তৈরি করেন এই আম বাগান, বাঁচিয়ে দেন গ্রামের অধিবাসীদের ব্রিটিশদের রাজস্ব আদায়ের অত্যাচারের হাত থেকে। তাঁর লেখা 'খেরওয়াল বংশ ধরম পুঁথি'তে একটু চোখ বোলালাম।
মেয়েদের মাথায় লাল ফুল, পুরুষের পিঠে তিরধনুক, মাথার ওপর আকাশ। বিস্তীর্ণ এই মালভূমি অঞ্চলটা ভীষণ রুক্ষ, সাঁওতালি পরিবারগুলির কাছে ঠিকঠাক খাবার বলতে প্রায় কিছুই নেই। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এরা জমানো ধান দিয়ে কোনওরকমে চালিয়ে নেয়। তারপর শুরু হয় বেঁচে থাকার যুদ্ধ। বৃষ্টি যদি না আসে, যদি খরা হয়, এপ্রিল থেকে শুরু হয় না খেয়ে থাকা, পুরুষদের যেটুকু বা জোটে মেয়েদের প্রায় জোটেই না। এখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় বেমানান লাগছিল।
শাল, মহুয়ার জঙ্গল আর তার মধ্যে ফুটে থাকা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। একটা বাড়ির মধ্যে একজন মাদল বাজাচ্ছে, আর একজন নাচছে। গান ধরেছে, 'পথের মাঝে বৃষ্টি আসিল, বন্ধু আমার বাঁধা পড়িল।' কানে ভেসে আসে মান্ডের, নাগারা আর সিঙ্গা-র শব্দ - সাঁওতাল আর মুন্ডারা তো ভীষণ নাচ আর গান ভালবাসে।
অরণ্যে নিজের মুখোমুখি হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো জিজ্ঞাসা করে উঠি,'মানুষ যেমন কাঁদে, আচ্ছা জঙ্গলের পশুপাখীও কি কাঁদে?' আসলে জঞ্জলের রিমঝিম করা স্তব্ধতা আর তার মধ্যে আমরা! সুনীলের ভাষায় বলে উঠি আমরা যেন 'মুখচোরা বেশ্যা'।
গরুর গাড়িতে করে আমাডুবি ঘুরতে ঘুরতে নিজেদেরকে 'অরণ্যের দিনরাত্রি'-র চরিত্র মনে হচ্ছিল। সেই বোহেমিয়ানিজম তাড়া করে ফিরছিল আমাদের। আমরা যেন 'হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যান'। চিৎকার করে বলে উঠলাম,'বৃষ্টি নামল যখন, আমি উঠোন পারে একা'।
রাত নেমে এল। নদীর ধারে এসে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ - আকাশ নিকষ কালো। দূরে, বহু দূর থেকে কানে ভেসে এল দ্রিদিম দ্রিদিম শব্দ - মাদল কিংবা খোল; কিন্তু এমনই আধোজাগা, গম্ভীর সেই শব্দ যে রীতিমত রহস্যময় মনে হয়। আমরা চুপ করে শুনি...
অভিজিৎ কুমার চ্যাটার্জী পেশাগত ভাবে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। আর নেশা ভ্রমণ। নেশার তাগিদে ঘুরে বেড়িয়ে নির্মাণ করেন পর্যটনকেন্দ্রগুলি নিয়ে বিভিন্ন ট্রাভেল ডকুমেন্টারি।