স্মৃতি বুনে এলাম
অধীর বিশ্বাস
স্মৃতি বুনে এলাম, না, নিয়ে এলাম? উত্তর দিতে পারে ঢাকার বুড়িগঙ্গা। অঙ্কুরের মেসবাহউদ্দিন রোজ হাঁটতে যায় কূল ধরে। পলকে পলকে জাহাজ। আমরা হাঁটতে থাকি। কত কথা উঠে আসে। নদীকে সঙ্গী করলে মনটা পাপহীন হয়ে ওঠে নাকি!
তাঁর বাড়ি বুড়ি থেকে হাঁটাপথ। দোতলার মেঝে দখল করে ছিলাম বেশ কদিন। যাবার বেলা সময় হল শিল্পী ধ্রুব এষের। মনে হল বাসিপেটে ছফুটের দেহ নিয়ে চলে এল আমাদের দেখতে। ডাক দিল, দাদা!
জড়িয়ে নিলাম। বউদির হাতে তুলে দিল বাংলাদেশের সব নদীনামের চাদর। দাদার জন্য রবীন্দ্রলেখা বস্ত্র। ভাবছিলাম, স্মৃতি কি শুধু যাপন? ঘরসংসার? বেদনা? তুলে দেওয়া কিছু নয়?
দেশ তবু পিছু ছাড়ে না। 'গাঙচিল'-এর প্রকাশক অণিমা সঙ্গ নিল। অথবা সঙ্গী করল আমাকে। অনেকে বলে ওর হেডকর্মচারী আমি। খাওয়াপরা আর হাতখরচা তার ওপর নির্ভর করে। অণিমা কলকাতা ফিরছে ছেলেদের কাছে। স্বভাবতই নিমগ্ন সে।
একটু পরেই ঢাকা-কলকাতা রেলগাড়িটি ছেড়ে দেবে। পাহারাদারও কি আনমনে, অণিমার মতো?
বাড়িতে এসে কেবলই নানামুখ উঁকি দিয়ে যায়। বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে দেহটা ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। কে সে?
. . . . . . . . .
এই আমাদের বাংলা, এভাবেই তো বেঁচে উঠেছি! ভুলে ছিলাম। হয়তো ভুলতেও চাই। নাগরিক হয়ে উঠলে কে মনে রাখে? কিন্তু কখনওসখনও পড়ে হঠাৎ-ই। গতকাল ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দিল ছেলেবেলা। দেখলাম শৈশবকে। আঁচল-আশ্রয় মা আমাদের উঠোন ছেড়ে দেবার পর কপাল পুড়ল চিরতরে। তার পর বাবা দাদা কেন মারত? কচার বাড়ির দাগড়া দাগ নিয়ে হাটের চালার নীচে ঘুমিয়ে থাকতাম। সূর্য ডুবলে দেখি আমার মতো আরও কেউ জায়গা খুঁজছে। তার পর কাছাকাছি। জড়িয়েমড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়া। পাশে-ঘুমনো জগা-পাগলের হো হো হেসে ওঠা কিংবা জোরশব্দের কথাবলায় ঘুম ভাঙত। না, বাড়ি যাব না কোনও দিন! মা থাকলে শত-অবাধ্যেও মারত না কেউ।
আবার হাঁটা। কোনও গ্রামে গিয়ে সুপুরিপাড়া, আগাছা-জঙ্গল সাফ করার পর খাওয়া। আচ্ছা, বাবা দাদা খাওয়ার সময় আমার কথা বলে না? - এমন সব মায়াচিন্তায় নিরুদ্দেশ-থাকা ছিল। মাগুরার সাতদোয়া শ্মশানে চলে যেতাম। সন্ধেনামা মুহূর্তে শকুন কেঁদে উঠত। আমাকে দেখে? ওই একাকীলগ্নেও ভয় করত না। যতক্ষণ চোখ থাকে, সেই দৃষ্টিতে আমার চোখ থেকে মাকে শুইয়ে-আনা বালিশটাকে কিছুতেই সরতে দিতাম না। খাগড়াজঙ্গলের ওই বালিশ আবার ফিরে এলো। ঢাকার রাস্তায় অঘোর-ঘুমনো বালকদের একজনের মুখ বদল করলে তো আমিই!
অন্য ছবিটায় তীব্র হয়ে দেখা দিল বাবা। আমার বাবাও এমন আয়োজনে চুলদাড়ি কাটার অপেক্ষায় বসে থাকত ক্ষুরকাঁচির সংসার বিছিয়ে। হাটের দিন অনতিদূরেই আমি। 'ও চাচা, আসো! বাবা ভাল করে চুলটা কেটে দেবে!'
ঢাকা
পঁয়ত্রিশ বছরের রক্তের টান। সকালে উঠে প্রথম খোঁজ খবরের কাগজ। বেলা বাড়তেই নিশানা বইপাড়ার দিকে। প্যারীদাস রোডের সাইনবোর্ড: মুক্তধারা আর পুঁথিপত্র। বাংলাবাজার গলিপথ পেরিয়েই। নওরোজ সাহিত্যসম্ভার। মাওলা ব্রাদার্স। বাঁক পেরিয়ে বইবাড়ি। প্রচুর সৃজনশীল প্রকাশনা। অংকুর ও চারদিক প্রকাশনার ঘরে আড্ডা হল। প্রকাশকদের সঙ্গে হাই-হ্যালো করে একটু এগোতেই পোস্ট অফিসের গলিতে কলেজ স্ট্রিটের শ্যামাচরণ দে কিংবা বঙ্কিম চ্যাটুজ্জে স্ট্রিট ভেসে আসছিল। এখানেও প্রচুর কাটাকাটির দোকান ভর্তি।
'গাঙচিল' নাকি স্বপ্নের উড়ান দিয়েছে। ঢাকার শাহবাগ এলাকায় জাদুঘরের পাশে 'পাঠক সমাবেশ।' ঢুকে কিছুক্ষণ শব্দহীন দাঁড়িয়ে থাকা। কলকাতায় অক্সফোর্ড বুকস্টোরে ঢুকে মনে হয়েছিল বইজগতে এসে জীবন সার্থক। সেই ধারণা বদলে গেল। মনে হচ্ছিল ফরাসিদেশে বাংলার কোনও ব্যবসায়ী বইয়ের বিপণি খুলেছেন। পাঠক সমাবেশের কর্ণধার বিজুভাই সেই স্বপ্নেরই সওদাগর বুঝি।
সৌভাগ্য ছাড়া কী বলব নিজেকে? আমার ছবি টাঙিয়ে 'boinews24.com'-অন্যতম রবিন আহসান বন্ধুত্বের ফাঁকে আয়োজন করে ফেললেন 'বইআড্ডা'র। পাঠক সমাবেশের ওই ফেস্টুনের ছবি নিজেই তুললাম। সঞ্চালনা করলেন রবিন। অনেক কিছু বলতে দিলেন ওনারা। আমার কথা ধরে বললেন কেউ কেউ। প্রকাশক অধ্যাপক। বই-প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তাও। 'প্রকৃতি'র হাবিব এড়েবেড়ে ধরল। অনেক প্রশ্ন তাঁর। উত্তরও দিলাম রক্ষণাত্মক। সংস্থার কর্ণধার বিজু চা-পানি দিলেন। আপ্যায়নও আন্তরিক। মুগ্ধময় পরিবেশে পাঠক সমাবেশ। ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সঞ্চালক রবিন আহসানকেও। কৃতজ্ঞ রইলাম শহরবাসীর কাছে। ছবি টাঙানো আমাকে বেশ লাগছিল কিন্তু। মনে মনে বললাম, ছেলেদের বলে যাব, কিছুকালের মধ্যেই যদি চলে যাই, তোদের ঘরে এই ছবিটাই টাঙিয়ে রাখিস! দেশমাটিতে পা রেখে কেন মনে হল কথাটা!
চট্টগ্রাম
বাতিঘরের দীপঙ্কর বলল, পাহাড়তলি এলে বলবেন। রেলের কামরা লাইন, ভারতের মত নয়। কলাপাতা শাড়ি জড়িয়ে তন্বী-চেহারার বাংলাদেশ রেল নিয়ে এল আমাদের। ছিমছাম আধুনিক শহর। ঢাকা থেকে যাত্রাকালে জনৈক প্রকাশক জানিয়ে দিলেন, চট্টগ্রাম ইন্টেলেকচুয়ালদের শহর।
শ্বাসপ্রশ্বাসে টের পাই তা। এ-ও টের পেতে থাকি, কোনও দিন, বিশাল এক পাখি এসে শহরটাকে তুলে পাহাড়ের শরীরে নামিয়ে বাস করার অনুমতি দিয়ে গেছে।
পাশেই কর্ণফুলি। নদী না কি সাগরের ডালপালা? কত অজস্র কনিষ্ঠ-জাহাজ! দক্ষিণে মাস্তুল আর মাস্তুলের ঝাপসা-আদল। এ বার বুঝলাম, ছোটবেলায় পড়া 'চট্টগ্রাম কীসের জন্য বিখ্যাত?'
একটু বাদেই রওনা হব পতেঙ্গায়। ওখানে আর কী দেখব, জানি না। বইয়ের জন্য এত বড় বাড়ি বানিয়ে ফেলল 'বাতিঘর'-এর দীপঙ্কর? বইব্যবসা নিয়ে আর কী মনে আছে, অবাক হয়ে ভাবছি! জাহাজ-আদলের এই বইবাড়ি চট্টগ্রামকে দর্শনীয় করে তুলেছে। ঢাকার পাঠক সমাবেশ, দীপঙ্করের এই বাতিঘর আমাদের মতো নগণ্য প্রকাশনায় যুক্ত মানুষদের বলভরসা।
বাল্যকালে জানতাম, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের জন্য বিখ্যাত। আবার পড়েছি, কক্সবাজার কোথায় এবং কীসের জন্য খ্যাত। সেই স্বপ্নের দেশ চাটগাঁয়ে দেখলাম টিলার ওপর শহরের আশপাশে অন্তত বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান আছে। কক্সবাজার তো বটেই, আছে পতেঙ্গা বন্দর কর্ণফুলির মোহনা। স্থানীয় নামজাদা লেখক বলছিলেন, নদীর ওপারে এমন মহল্লা অবস্থান করছে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে, ঢুকলে মনে হবে যেন নিউজিল্যাণ্ডে এসে পড়লাম।
সময় কম ছিল। কক্সবাজারে যাইনি। গেলে রোহিঙ্গা শরণার্থী দেখতে সাধ জাগত। এই বন্দরপরিবেশ সৌন্দর্যে পৃথিবীর যে কোনও সৈকতের চেয়ে আকর্ষক। অতএব থেকে যাওয়ার বায়নাদমন, মনুষ্যজীবনে বেদনার।
আর? আছে। তা হচ্ছে ফয়েস লেক। তারই প্রতিবেশে চিড়িয়াখানা অবস্থিত। সেই লেকেরই দৃশ্য। যেন কিছুদিন আগে বেড়ানো পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের খাঁড়ি দিয়ে যাত্রা চলেছে যেন। যেন অপর দিক থেকে আমাদেরই মতো কোনও ভ্রমণার্থীদল ফিরছেন।
অন্যটি জাহাজবাড়িতে বইবিপণি। বাতিঘর। ঘরের গড়নটি বন্দর-অতিথি জাহাজকে মনে রেখে। সত্যি বলতে অভিনব তার রূপকল্পনা, যা বাংলাদেশ কিছুটা গর্ব করতে পারে। সাবাশ! - ফয়েস লেক কর্ণফুলির বাচ্চা বাচ্চা অসংখ্য জাহাজের মাস্তুল আর ঘোলাজলের উদ্দামতা চোখ থেকে মুছে যাওয়ার নয়, দেখছি!
জাহাজের মাস্তুল, না, কী ওটা, লেখার সময় কাকে জিজ্ঞেস করব? মাস্তুলের পেটে কোলে ভর্তিবই। ধন্যবাদ বাতিঘর, এই প্রান্তজনকে নিয়ে কিছু বলাবলির অনুষ্ঠান করার জন্য।
বাংলাদেশে দীপঙ্করের পরিচয় 'বাতিঘরের দীপঙ্কর'। চট্টগ্রামে বাতি জ্বেলেছে জাহাজবাড়ির ন্যায় স্বপ্নের বইঘরে। কত যে পাঠক! বইকারবারি আমাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। এই যুবক এবার মেতেছে ঢাকার 'বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে' কয়েক হাজার স্কোয়ার ফুটের বইকেন্দ্রের। রূপায়ণ শেষের পথে। আমরা আশাবাদী।
স্থানীয়জনরা বলেন চিটাগাঙ। আমরা চট্টগ্রাম। নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করলে শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। চিটাগাঙে কুমিল্লা নোয়াখালির কথ্যভাষার ছন্দ চলে। না-বুঝলেও অনুভব করা যায়। মায়ের ভাষা আমার মুখ দিয়েও বেরিয়ে পড়ে আনমনে। পতেঙ্গার সমুদ্রসৈকতে যাবার বাসে এমন কথোপকথনের ছন্দ উপভোগ করছিলাম। সত্যি, বাংলায় কত শব্দভাণ্ডার! কত কত লোকভাষা!
দীঘার সমুদ্রে ঢেউ আর গর্জন। পতেঙ্গা শান্ত। বড় হলে শান্ত হয়? বড়, না, গভীর? কর্ণফুলি থেকে এখানে যাকে বলে প্রকৃত জাহাজ! সে জাহাজ দূর-চোখে দেখছিলাম বহু দূরে নোঙরকরা। তার আশপাশ ছোটগুলো পাহারায় যেন। গোনা যায় না। খিদিরপুরে যা দেখেছি, এর চেয়ে অতিকম। তার জন্যই কি বড় করে লেখা: সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার?
বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদ সত্যিই গর্বের। যারা প্রাণভরে ওই প্রকৃতি গ্রহণ করে যাচ্ছি, তা টাকাপয়সা বা সোনা দিয়ে নয়, সে-মূল্য কী, মাপ করতে সময় লাগবে!
পুনশ্চ - এখানে গাড়ির নম্বর লেখার নিয়ম: চট্ট মেট্রো গ ২০১৭
ঢাকায় আবার
মেসবাহ বলে দিয়েছিলেন কনকর্ড মার্কেটে যাওয়ার পথে দীপনপুর ঘুরে আসবেন। দীপনপুর? সে গ্রাম কোথায়? না। এটাও বইবাড়ি। পরিচালক চিকিৎসক। স্বামীর স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে এই বিপণি চালান। কথা হল একটুক্ষণ। এঁদের সঙ্গে ব্যবসার আগ্রহ রেখে বিদায় নিলাম।
কনকর্ড-এও অনেক বিপণি। প্রকাশনা। সাজানোগোছানো। 'প্রকৃতি'ও এখানে। হাবিবের আতিথ্যে ইলিশ-খিচুড়ি শুধু মুখে নয়, অন্তরজুড়ে রেখে দিলাম। ঢাকা তো রাস্ট্র একটা। প.ব. থেকে একটু বড়, কিন্তু আতিথ্য আর ব্যবহারে আমাদের থেকে বড়ই বড় মনে হল। ঢাকা আর চট্টগ্রামকে একযোগে জানাই বিজয়ার শুভেচ্ছা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এসেছিলাম। বয়সে আমি পূর্ণকিশোর। পরের বছরই বস্তিজীবন ছেড়ে যাব। কলকাতা পুরোপুরি নকশাল। রেডিওতে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র - আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি। রাস্তাঘাটে নতুন মুখ। দালানবাড়ি দেখতে দেখতে মানুষ হাঁটছে। জিজ্ঞেস করলে, 'জয় বাংলা।' তখনকার সামরিক শাসনের বিপক্ষে তৈরি হয়েছিল সিনেমাটা। ছবিতে এই গানটাও ছিল। চাবির গোছা মহিলার আঁচলে। একাই শাসন করেন। তার নির্দেশেই চলে গোটা দেশ। বহু সংগ্রামের পর দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু ছিটিয়ে পাকসেনাদের রাজাকার। ওদের হাতেই ঢাকায় খুন হন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ঢাকায় আমার অতিথিনিবাস মেসবাউদ্দিনের বাড়ি। তার থেকে অল্প দূরেই পরিচালকের নামে এই প্রেক্ষাগৃহ। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে হচ্ছিল গানটা আবার গাই: আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালবাসি...
ঢাকার কলেজস্ট্রিট 'বাংলাবাজার'-এর ছবি ধরতে ভুলে গেছি বলে দিতে পারলাম না। ওখানকার প্রকাশক নওরোজ সাহিত্যসম্ভারের জর্জভাই বললেন, এ অঞ্চলে প্রায় দু-হাজার প্রকাশক। সত্যি, অবাক হওয়ার মতো। পাঠ্যবই ইসলামি-প্রকাশনা বেশি অবশ্য। এখানেও কাটাকাটি-প্রকাশক। সাহিত্য-প্রকাশনায় যে সব বই দেখলাম, রীতিমতো ঈর্ষনীয়। বিভিন্ন বই দেখে মনে হচ্ছিল, বইটা যদি আমি পেতাম!
অভিজাত এলাকা শাহবাগ। ধানমণ্ডি। গুলশন। পুরনো পল্টন। আরও। সব তো জানি না এখনও! 'তক্ষশিলা' জানতাম। বই নেন। কিন্তু পরিচালক দিদিকে দেখেই মনে হল, শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। পরিচয়ে জানলাম, যশোরের কন্যা। রাজনীতিতে ছিলেন দীর্ঘদিন। তার আগেই সাহিত্যে অনুরাগ। চাকরি করেছেন। পোষাল না। ঠিক করলেন বইব্যবসা করবেন। করলেনও। এই জীবিকায় বয়স তাঁর সাতাশ বছর। পরিচ্ছন্ন এই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বারদুয়েক দেখা হল। কথা হল অনেক। আশাকথা।
ঢাকার 'বিউটি বোর্ডিং'-এর কলকাতার কফিহাউসের মতো সম্মান। ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে অবস্থান করছে বাড়িটা। লেখক চিত্রশিল্পী রাজনীতিবিদ, কে আসেননি? জর্জভাই মেসবাহউদ্দিন আর বাংলাবাজারের সফরসঙ্গী জাহাঙ্গীর লোডশেডিং-এর মধ্যে মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে দেখাচ্ছিলেন। খাওয়ার জায়গা, ঘরগুলো। দেওয়ালে সম্ভবত প্রখ্যাত মানুষদের নাম লেখা ছিল। ছোট্ট বাগানের কোণে কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতিফলক দেখে বেরিয়ে এলাম।
গল্প করছিলেন সেই সব ব্যক্তি, যাঁদের পদধূলির চিহ্ণ রেখে দিয়েছে বাড়িটা। বিউটি বোর্ডিং। কত নাম। বিখ্যাতজনদের সব নাম জানিও না। মুজিবর রহমান শুধু মনে আছে। ওনারা বলছিলেন, ঢাকার বইমার্কেট 'বাংলাবাজার' ঘুরবেন অথচ এই স্মৃতিবিজড়িত বোর্ডিং না-দেখে গেলে হৃদয় অপূর্ণ রয়ে যাবে।
শোনা গেল, পুরোপুরি সরকার নয়, তার নজরদারি আছে বাড়িটি ঘিরে। যেমনটি আমাদের কলকাতার কফিহাউস। তর্ক নীলনকশা প্রণয় রাজনীতি - এক কথায় ইন্টেলেকচুয়ালদের নিজস্ব-অঙ্গন। আমাদের পরিক্রমা অনেকটা অমন মানসিকতায়।
ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘুরে ঘুরে চলার মধ্যে দেখি অদূরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। গোলাকৃতি নামটি দেখেই মনে পড়ে জগন্নাথ হলের কথা। এর মধ্যেই কি সেই বহু হত্যালীলা সংঘটিত করে পাক ও রাজাকারবাহিনী। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম এমনই কোনও বীর সংগ্রামীদের স্মারকপীঠে। সহচর ইসমাইলকে অনুরোধ জানাই ছবি তোলার জন্য। শহীদস্মারক স্তম্ভকে স্বাক্ষী রেখে আমাদের স্মৃতি রেখে দেওয়ার সেই সময় বেলা দ্বিপ্রহর।
শহর পরিক্রমা ফের শুরু। অচেনা দেখে নাগরিকরা বুঝতে পারে, বিদেশী আমরা। এ ভাবেই শহর ঘুরি। অটো ও দেশে সিএনজি নামে পরিচিত। কখনও বাসেও যাতায়াত। কিন্তু আধঘণ্টার পথ লাগে দেড় ঘণ্টা। এত জ্যাম। অন্তত এমন অভিজ্ঞতা। অন্যদের হয়তো অন্য। তবু ঢাকা বা চট্টগ্রামের মায়া ছাড়ছে না। থেকে থেকেই মনে পড়ছে। মন পড়ে থাকার মায়া হয়তো এ ভাবেই গড়ে ওঠে, রয়ে যায় চিহ্ন হয়ে!
ঢাকা শহরে দিকবিদিক তাকালে খালি ব্যাঙ্ক আর রেস্টুরেন্ট। কোথাও ঘিঞ্জি, কোথাও কলকাতাকে লজ্জায় ফেলে দেবে। মানুষ না-দেখে দেখি যদি, উন্নত কোনও মেট্রোসিটির আদল। দোতলা বাস দেখে, ঘোড়ার গাড়ির টকটক, রাজাবাজার কিংবা খিদিরপুরের রাজপথ সঙ্গে এসেছে বুঝি। এই বাস দেখে খানিক অচেতনে চলছিলাম। শিয়ালদার ক্যাম্বেল হাসপাতালের (নীলরতন সরকার হাসপাতাল) সামনে থেকে ডাক্তার দেখিয়ে দোতলা বাসের বায়না করতাম। রোগেভোগা আমার কথায় বাবা রাজি হত। দোতলা বাস হাওড়ার ব্রিজ আকাশবাণী শৈশবের স্বপ্ন।
এ-বাস কলকাতায় নেই আর। সেই বাসে নামার সময় একদিন কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলেন। বাবা বলল, হয়ে গেছে!
বাবা টিকিট কাটেনি। দশ পয়সাও যদি বাঁচানো যায়! হাসপাতালের বিনা পয়সার চিকিৎসা, বাসভাড়া বাঁচানো, বস্তিবাড়ির দশ টাকা ভাড়া দিয়ে সে জীবনে কি খারাপ ছিলাম?
এর পর ঢাকা ছেড়ে ফিরব পুরনো বাসায়। টের পাচ্ছি, আমার অতিথি-অঞ্চল গেণ্ডারিয়ার মিলব্যারাক, মেসবাহর ১৯০৫ সালে তৈরি বাড়ির দোতলার মেঝের শীতলতা আমাদের পরম আদর দিয়েছিল। ভোরের আজান মাদ্রাসায় পড়া শিশুরা জানলই না কলকাতা থেকে অতিথি এসেছিল দুজন। কিন্তু যে-ভোরে যাত্রাসময় তখন ওরা ব্যস্ত থাকবে উচ্চকন্ঠে পড়াশুনোয়। তবু যে যাব আমরা!
জল এখন নিশিন্তভূমি। ডিম ছাড়বে ওরা। বিরক্ত করা যাবে না। ধরা যাবে না। তিন মাস ওদের থেকে দূরে থাকতে হবে। ইচ্ছে হলেও ওদের পাব না। বাংলাদেশ সরকার বছরে দুবার এমন নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। এপ্রিল আর অক্টোবর। এপ্রিলে নিষেধ ছিল বলে ঢাকার রাস্তাঘাট ভরে উঠেছিল রুপোলি ইলিশে। শোনা গেল, বইমার্কেট বাংলাবাজারের পাশে ঝাঁকার মধ্যেও হাজির ছিল রূপসম্পদ ইলিশের ঝাঁক। আমরা মেসবার বাড়িতে ঝোল ভাজা সর্ষেবাটা দিয়ে রোজই প্রায়...
শুধু হুকুম নয়, ধীবরবৃন্দ চালগম কিছু নগদও পান ওই সময়। মাছ ধরতে না-পারলেও অন্য কর্মে বাধা নেই। দেখলাম, ঢাকার মাছবাজারে পুলিশ মোতায়েন। ১ অক্টোবর থেকে দেড় মাস ইলিশ বিক্রিও বন্ধ। কেমন না? আমাদের দেশেও এই নিষেধাজ্ঞা বলবত। মানা হয় কই? ঢেলে বিকোচ্ছে খোকা-ইলিশ। পুলিশ? দেখি না তো! থাকতে পারে, চোখ যায়নি।
ফেরা
আমার ঘড়ির সময় সকাল ৮-২৫. ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী-এক্সপ্রেস যাত্রা করল। যমুনা সেতু পার হতে প্রায় দশ মিনিট। নদীমধ্যে কিছু দেখা। চর। কিংবা পাড়। পেরিয়েই দেখলাম ফলক। বঙ্গবন্ধু সেতু।
এখন ছেড়ে-আসা প্রিয়জনদের ফোন পাচ্ছি। মনখারাপ। পার হয়ে যাচ্ছে ঈশ্বরদী জংশন। ফলকটাও আড়াল হল এইমাত্র। তবু, ফিরতে তো হবেই!
কিন্তু যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে, যে যে ঘটনা বিদ্ধ হয়ে থাকবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের প্রথমশ্রেণীর দৈনিকের সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে সৌজন্যসাক্ষাত। তিনি আমাদের যৌথজীবনের মধ্যমণি হয়ে ছবি তুললেন।
সহকর্মীদের পরামর্শ দিলেন, অধীরবাবুকে পেয়েছ যখন, প্রকাশনার খুঁটিনাটি জেনে নাও। প্রথমার দায়িত্বভার জাফরভাইয়ের হাতে। যুবক সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে নিবিড় হয়ে রইলাম দুদিন।
দুদিন পর লিখিত প্রশ্নপত্র। এক এক করে আমার দর্শন এবং আমি যা বুঝি, সেই মতো উত্তর দিলাম। অণিমাও বলছিল নিজের মতোই। পরে মধ্যাহ্ণভোজ। যেন ফাইভস্টার ব্যবস্থা। অবশ্য মতিভাইয়ের নির্দেশ ছিল, অধীরবাবুর কাছ থেকে না-জেনে খেতে দেবে না! মজার মানুষ হিসেবেও দেখলাম তাঁকে।
কর্মজীবনে পঁয়ত্রিশ বছর ছিলাম এমনই এক সংস্থায়। অবশ্য নিম্নপদ। ওই পদেই অবসর। সম্মান পেলাম 'প্রথম আলো'য়। আমার প্রতিষ্ঠানের কথা মনে পড়ছিল। আবার মনেও হল, দীক্ষা তো পূর্বতন আশ্রমেই!
'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।' ভুল হলে বন্ধু, ক্ষমা করবেন। শুধু ঢাকা আর চট্টগ্রামে দেখা দৃশ্য। গোটা বাংলাদেশ পরিক্রমার আর কিছু যদি কপালে জুটত!
জীবনে পূর্ণতা দিতে নেই। তা হলে টান থাকে। টান মানে দেহ যদি কলকাতা, ধড় তবে বাংলাদেশ। আমার শৈশবভূমি। এ-ভূমি দেহে কেন এমন ভাবে পলি ফেলে গেল? ভাগ্যিস মায়ের সংসারক্ষেত্রে যাইনি! যে গ্রাম তার নিয়তি ছিল, যে গ্রামের উঠোনে আঁচলধরা চলাচল ছিল আমার, ওই গ্রামে গেলাম না। গেলে দেখাচোখ যদি সহ্য করতে না-পারে?
এগারো দিন তাই কাটল বুড়িগঙ্গা তীরলাগোয়া গেণ্ডারিয়া মিলব্যারাকে। সন্ধেয় বেড়াতে আসা। দুপুরে পাড় ধরে নতুন ঢাকা যাওয়া। ধীরে ধীরে চেনা হয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গায় চোখ-আঁকা জাহাজের সারি পূর্ণ বিশ্রামে। মনে পড়ল, রাজাপুরের ওই চোখচিত্রণ লঞ্চই তো নিতে আসত আমাদের! এখানেও কি নিতে আসছে মা ও ছেলেকে?
আমার নীরব মনেপড়াগুলো ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। সকলকে বলে এসেছি, আবার আসব! কিন্তু কবে? মিথ্যে বলা হয়ে যাবে না তো?
ফিরে এসেছি ৬ মার্চ ২০.১৫ সময়ে। এবং নির্বিঘ্নে। দু:খ একটাই, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেক করতে গেদে সীমান্তে প্রায় তিন ঘণ্টা! দীর্ঘ সময় টিনের শেডের তলায় গুমোট গরমে বুড়োবুড়ি সেদ্ধ হলাম। চারদিক চৌকো খাঁচা। পোটলাপুটলি টেনে নিয়ে যাওয়া আর সেগুলো ফের টানা! চলতিপথে খালি হুমড়ি খাওয়া। দর্শনায় দেশিবিদেশি মিলিয়ে বারোটা কাউণ্টার। এখানে একঘণ্টা কম। শুনেছি, বিদেশে নাকি গাড়ির মধ্যেই চেকিং। এই দুই দেশ অন্তত তেমন না-হোক, যাতায়াতে সময় এবং দুর্দশা কমানোর জন্য যদি একটু ভাবেন, জার্নিটা সুখের হয়!
শেষ দৃশ্য
'তুই এত কামাই করিস ক্যা রে?' বালকস্কুলে প্রায়ই শুনতাম। শুধু স্যার নয়, বন্ধুরাও জানতে চাইত। অনেক মিথ্যে বলেছি। সত্যি যেটা, তা মায়ের অন্তিমযাত্রার আগের দিনগুলোয় মানুষ যেমন কাটায়, মায়েরও তেমন অবস্থা তখন। তা দেখে স্কুলের পথে গিয়েও ফিরে আসতাম। মা বুঝেও বলতে পারত না। হয়তো ভেবেছে প্রাণটা যাওয়ার সময় তার ছোট ছেলেটা অন্তত কাছে থাক! তার জন্য কামাই হত। জীবনে পাঠমন্দিরে না-গিয়েও যদি বেঁচে থাকা জীবনে মা থাকে, তবে সেই অঙ্গীকারে রাজি হতাম।
দেখা হল জনৈক মুসলমান ব্যক্তির সঙ্গে। আরবদেশে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কলকাতা যাচ্ছেন স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে। বাংলাদেশের ডাক্তারের সন্দেহ, লিভারে ক্যান্সার।
বাংলাদেশ ফেরতকালে কামরার মানুষটিকে দেখে আমার বাবা মনে হচ্ছিল। এমন করে কত বার এমন ভাবেই মায়ের মাথায় হাত রেখে কলকাতা ডাক্তার দেখাতে আনত না?
লেখাটা এ জন্য নয়। গেদে সীমান্তের চেকিং-এ অপেক্ষারত দীর্ঘ সময়ে এক জন নানান পরামর্শ দিচ্ছেন। কানে এল, কলকাতার দুর্নামধারী এক বেসরকারি হাসপাতালের নাড়িনক্ষত্র বুঝিয়ে দিচ্ছিল। এমনকী কলকাতা স্টেশন থেকে এঁদের নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। চেন্নাই যাওয়ার দরকার কী!
ভাবছিলাম, লোকটা কী করে জানল? আর কাউকে ঠিক করে এসেছে? অভিবাসন দফতর কিংবা পুলিশ কিছু খোঁজ পায় না? সরল নাগরিকদের এমন প্রতারণা খুবই কষ্টের। অনেক সহায়হীন মানুষ আসেন ভারতে সুস্থ হওয়ার আশায়। পথেই যে এমন ফাঁদ! কী সুন্দর বাক্যালাপ! যেন ঈশ্বরই পাঠিয়েছে তাকে!
কিছু সাবধান করার ইচ্ছেয় বলতে যাব, স্ত্রী অণিমা বলল, এ সবে যেও না। কিন্তু কী করে থেমে থাকি? ও দিকে তাঁর ফোনে চার্জ ফুরিয়েছে। আমাদের কারও চার্জার লাগছে না। ছিটমহল থেকে তাঁর শ্যালক আসবেন। কলকাতা স্টেশন আসতে চলল, ফোনে কিছুতেই লাগছে না। অথচ প্রথম ভারতে আসা।
আমাদের নিতে ছোট ছেলে এসেছিল। ওর মা তো দীর্ঘ ব্যবধানের স্নেহে জড়িয়ে চুম্বন করল। পিছন ফিরে দেখলাম, বাবার মতো মানুষটি তাঁর স্ত্রীকে প্রায় পাঁজাকোল আর সুটকেশ নিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে স্টেশনে ঢুকছেন। দালাল লোকটা কাছাকাছিই তো ছিল!
বাড়ি এসে কত গল্প! রাত বেশি গভীর হয়নি।
ভাবি ছিটমহল থেকে পৌঁছেছে ওই শ্যালক? নাকি এখনও অপেক্ষায়? অথবা হাসপাতালের প্রাইভেট কার নিয়ে গেল তাঁদের?
গাংচিল প্রকাশনার প্রাণপুরুষ ও আনন্দবাজার গোষ্ঠীর প্রাক্তন কর্মী অধীর বিশ্বাস ভালোবাসেন ছোটদের জন্য কলম ধরতে। দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সম্প্রতি প্রকাশ করছেন গাংচিল পত্রিকা। প্রকাশিত বই – 'পুণ্য গঙ্গার কাছাকাছি,' 'চলো ইন্ডিয়া,' ছোটদের চার খণ্ডে 'উড়োজাহাজ' ইত্যাদি। ছোটদের লেখার জন্য পেয়েছেন 'বিদ্যাসাগর' পুরস্কার। ছেলেবেলা কেটেছে ওপার বাংলায়। কলকাতায় এসে বস্তিজীবনে সংগ্রাম করেছেন রোজের বেঁচে থাকার জন্য। দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল জন্মভূমিকে ফিরে দেখার। সেই ইচ্ছাপূরণের কাহিনিই লিখলেন এবার আমাদের ছুটি-তে। তাঁর লেখা প্রথম ভ্রমণকাহিনি।