দিনে দিনে বর্ধমানে

তপন পাল



-১-
মন উচাটন
চলো বৃন্দাবন
কিন্তু যাই কী করে? পরপর চারটে রবিবার চলে গেল, আমি ঘরে বসা। বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছে না; বড্ড গরম। তা গরম কি ভারতবর্ষে এই প্রথম পড়ছে? অবশেষে প্রায় হাতে পায়ে ধরে বেরোবার ব্যবস্থা করা গেল; খুব দূরে নয়, বর্ধমান। রেলগাড়িতে নয়, নিজের গাড়িতে, নিজে চালিয়ে নয়, সারথির হাতে। ঘুরতে বেরিয়ে সঙ্গে কেউ থাকলে আমার বিরক্ত লাগে, কিন্তু কীই বা করা যাবে! এযাত্রা কপালে সুখ নেই বোঝা যাচ্ছে।

১৪ই জুন, ২০১৭। সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর। বর্ধমানে উড়োজাহাজ যায় না জানি, তবে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি! তারপর উড়োজাহাজ না পেয়ে ভেসে পড়লাম বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। রেললাইন, রাস্তা, নদী সব নীচে, আমরা উড়ে চলেছি উড়োজাহাজের মতই প্রায়। তবে বেশিক্ষণ সুখ কপালে সইল না, ডানকুনির কাছাকাছি গিয়ে ভূমিস্পর্শ। ডাইনে বেঁকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। পথিমধ্যে শক্তিগড়ে বাধ্যতামূলক ল্যাংচা ও শশাভক্ষণ, বিস্তর রেললাইন, খাল, রাস্তা ডিঙিয়ে বর্ধমান।

বর্ধমান শহরটা আমার খুব কাছের। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে। আমার তখন পঞ্চম শ্রেণী। মধুপুরে স্কাউটের অ্যাসোসিয়েশন ক্যাম্প সেরে ফেরার সময় স্কাউটমাস্টার নির্মলদা সেবার আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন যথাক্রমে আসানসোল, রানিগঞ্জ, দুর্গাপুর ও বর্ধমান। কেন? তদানীন্তন চেতনায় মধুপুর ছিল অনেক দূর - সুদূর পশ্চিমে। অতদূরে যখন যাচ্ছিই, আর আসা হয় কী না হয়, তাই এসেছি যখন, তখন ঘুরে যাওয়াই ভাল – এই ছিল মানসিকতা। তারপর কিছু না হলেও পঞ্চাশবার এই শহরে এসেছি। বর্ধমান চিরকালই আমার প্রিয় দিনান্তভ্রমণ গন্তব্য। রেলগাড়ি দেখা হয়, আড়াই ফুটের ন্যারোগেজ রেলগাড়ি চালু থাকাকালীন এখান থেকেই কাটোয়া যেতাম। তারপর বলগনা অবধি ব্রডগেজ হল। এখন তো আড়াই ফুটের ন্যারোগেজ রেলগাড়ি স্মৃতির সম্বল।

বর্ধমানের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। গলসির মল্লসারুল গ্রামে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের তাম্রলিপিতে বর্ধমান নামের উল্লেখ আছে। ১৬৫৬ থেকে ১৯৫৬ বর্ধমান ছিল বর্ধমানের রাজার শাসনে। প্রথমে মুঘল, পরবর্তীকালে ব্রিটিশের দাক্ষিণ্যপুষ্ট রাজপরিবারটি আদতে পঞ্জাবী। আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬ – ১৬০৫) আবুল ফজল আর ফাইজির উৎপাতে তিতিবিরক্ত পির বহরম বর্ধমানে আস্তানা গাড়েন। সঙ্গী পান জয়পালকে। সংহতির, সম্প্রীতির, সহচেতনার সেই ধারা আজও প্রবহমান। বর্ধমান রেলস্টেশন চালু হয় ১৮৫৫-তে। ১৮৬৫ সালে বর্ধমান পৌরসভা গঠিত হয়, সম্ভবত ১৮৬৩ সালে কালাজ্বরের মহামারী ব্রিটিশদের জনস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল। । ১৮৫৫ – ৫৭-র সাঁওতাল বিদ্রোহে রাজারা ব্রিটিশদের খুব সাহায্য করেছিলেন। ১৯০৫-তে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল বর্ধমান। রাজ কলেজের কিছু ছাত্র 'বন্দে মাতরম' বলার দায়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ১৮ মার্চ, ১৯২৩ খিলাফত আন্দোলনের জেরে সারা বর্ধমানে হরতাল।

-২-
এবার বর্তমানে। শহরে না ঢুকে ওই সড়ক বরাবর এগিয়ে বাঁকা নদী আর ডিভিসি খাল পেরিয়ে কাঞ্চননগরের কঙ্কালেশ্বরী কালীবাড়ি। অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটি মন্দির। রক্ষণাবেক্ষণ চমৎকার। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২০ বঙ্গাব্দ) দামোদর নদের বন্যার সময় বর্ধমান শহরের পশ্চিমে নদীগর্ভ থেকে এই কালীমূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটির বয়স অনির্ণীত। অপ্রথানুগ মূর্তিটি তিন ফুট চওড়া ও পাঁচ ফুট লম্বা একটি অখণ্ড পাথর খোদিত অষ্টভূজা বিগ্রহ। গলায় নরমুন্ডমালা, পদতলে শিব ও তাঁর দুইপাশে দুই সহচরী। আটটি হাতে নরমুণ্ড, শঙ্খ, চক্র, ধনু, খড়্গ, পাশ ইত্যাদি। অষ্টভুজা মুণ্ডমালাধারিণী শূলপাণিনী দেবীর শরীরের সবকটি অস্থি দৃশ্যমানা; তাই তিনি কঙ্কালেশ্বরী। পোড়ামাটির প্যানেলশোভিত মন্দিরটি তন্ত্রমতে প্রতিষ্ঠিত বলে জনবিশ্বাস।

শহরে ফিরে বর্ধমানেশ্বর শিব তথা মোটা শিব। ১৯৭৩ সালে আলমগঞ্জের ভিখারিবাগানে মাটি খুঁড়তে গিয়ে এই অতিকায় শিবলিঙ্গটি পাওয়া যায়, পণ্ডিতদের মতে এটি দ্বাদশ শতকের। পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও এত বড় শিবলিঙ্গ আছে বলে জানা নেই। ওড়িশার ভূষণ্ডেশ্বর শিবলিঙ্গের সঙ্গে ইনি তুলনীয়।

শহরের বুকে পাশ্চাত্য স্থাপত্যের এক উদাহরণ চার্চ মিশনারি সোসাইটি কর্তৃক নির্মিত ক্রাইস্টচার্চ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন চার্লস স্টুয়ার্ট এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্ধমানের মহারাজার কাছ থেকে বাৎসরিক সাড়ে বারো টাকা অনুদান পেতেন বলে প্রকাশ।

শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে বিজয় তোরণ। ১৯০৩ সালে বর্ধমানরাজ বিজয়চাঁদ মহতাবের আদেশক্রমে, লর্ড কার্জনের আগমন উপলক্ষে নির্মিত। জনমানসে প্রবল বিশ্বাস এটি মুম্বইয়ের 'গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া'র আদলে তৈরি; রিকশাওয়ালারা প্রবল আত্মবিশ্বাসে লোককে তা বলেও থাকে। এদেশে ইতিহাসবিদ হতে তো আর পড়াশোনা করতে হয় না। বৃন্দাবনে গেলে পাণ্ডারা ইস্পাতের দোলনা দেখিয়ে বলে এই দোলনায় রাধা-কৃষ্ণ দুলতেন। তারপর খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যায় তাতে টাটা স্টিলের ছাপ মারা। মুম্বইয়ের 'গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া' নির্মিত ১৯২৪ সালে, বিজয়তোরণের অনেক পরে। বর্ধমানের রাজ ইতিহাসের একটা অঙ্গ হল বিজয়তোরণ। পাশেই রামপ্রসাদের লস্যির দোকান। দুটিই এখন অতিবিখ্যাত; 'সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলঙ্কার।' রামপ্রসাদের দোকান বিজয়তোরণের অলঙ্কার, না বিজয়তোরণ রামপ্রসাদের দোকানের!

এক রাজকন্যের আত্মহত্যার সকরুণ আখ্যানবিজড়িত বারদুয়ারি মহারাজ কিরীটীচাঁদ কর্তৃক নির্মিত বারো দরজার প্রাসাদ; যদিও এক্ষণে একটিই দৃষ্ট। বরদা ও চিতুয়ার জমিদার বাবুরা বর্ধমানের মহারাজার প্রাসাদ দখল করেন, তাদের অত্যাচারে রাজকন্যা আত্মহত্যা করেন। প্রতিশোধ নিতে মহারাজ কিরীটীচাঁদ বরদা ও চিতুয়া দখল করে বিজয়স্মারকরূপে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। জানি না এই আখ্যানের ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু।

দামোদর নদ সদরঘাটের সেতুর ওপর থেকে দেখা। তারপর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা মৃগদাব, বর্ধমানরাজ বিজয়চাঁদ মহতাবের সমাধি, বিজয়বাহার, গোলাপ বাগ (১৮৮৪ তে স্থাপিত, রোমান গথিক স্থাপত্যের দারুলবাহার প্রাসাদ এখানেই। কৃষ্ণসায়র ৩৩ একর জমি নিয়ে - ১৬৯১ সালে নির্মিত এই কৃত্রিম হ্রদটি এখন পুরোদস্তুর পার্ক। নবাব বাড়ি ৩০০ বছরের পুরনো, ইন্দো-সিরিয়ান স্থাপত্যের নিদর্শন। রাজবাড়ি মহতাব মঞ্জিল ১৮৫১ সালে নির্মিত; এখন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, সরকারি অফিস। রমনা বাগান গোলাপ বাগের পূর্বদিকে, রানি ব্রজকিশোরী নির্মিত রাণীসায়র।

-৩-
এর আগে অনেকবারই বর্ধমানে গিয়েছি, কিন্তু কোনবারেই সর্বমঙ্গলা মন্দিরে ভোগ খাওয়া হয়ে ওঠে নি; কারণ ভোগ খেতে হলে কুপন কাটতে হয় সকাল নটার মধ্যে। এবারে এক সহৃদয় বন্ধু দায়িত্ব নিয়েছিলেন, আগের দিন কুপন কেটে রেখেছিলেন। অতএব দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে আমি মন্দিরে।

মন্দির নির্মাণ ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজা মহতীচাঁদের কন্যা ধনদেহি দেবী। প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৭৪ সালের ২ আষাঢ়। অনেকখানি জায়গা জুড়ে মন্দির প্রাঙ্গণ; তার মধ্যমণি বিশাল নবরত্ন মন্দির। মন্দিরে প্রবেশদ্বারের উত্তরে গর্ভগৃহে আসীন ধনেশ্বরী শক্তিদেবী ও ধনেশ্বর শিব। সর্ব্বমঙ্গলা মন্দির প্রাঙ্গণে শিবমন্দির পাঁচটি; তন্মধ্যে আটচালা শিবমন্দির দুটি নির্মিত হয়েছিল রাজা চিত্রসেনের আমলে। নাটমন্দির সংলগ্ন আরও তিনটি শিবমন্দির। নাটমন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ প্রাকারলিপি নিম্নরূপঃ
বর্ধমানাধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্ব্বমঙ্গলা মন্দির অবিভক্ত বাংলার প্রথম "নবরত্ন" মন্দির দেবী কষ্টি পাথরে অষ্টাদশভুজা সিংহবাহিনী মহিষমর্দ্দিনী লক্ষ্মীরূপী মূর্ত্তি।

১৭০২ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজ কীর্ত্তিচাঁদ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে রূপার সিংহাসন দেবীর আসন। কষ্টিপাথরে খোদিত দেবী অষ্টাদশভূজা। মূর্তির চরণতলে মহিষ। মহিষমর্দিনী মূর্তি এখানে সর্ব্বমঙ্গলা নামে পূজিত হন। মন্বন্তরা মূর্তি নামেও এই বিগ্রহ অভিহিত। মূর্তির নীচে অস্পষ্ট কিছু একটা লেখা আছে। যার পাঠোদ্ধার করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এই মন্দিরে সূর্যদেব নিত্যপূজিত। লোকবিশ্বাসে, বর্ধমানের উত্তরে সর্ব্বমঙ্গলা পল্লীর এক বাগদি বাড়িতে ছিল দেবীবিগ্রহটি। বাগদীরা ছোট এক টুকরো পাথরখণ্ডের ওপর গেঁড়ি, গুগলি, ঝিনুক, শামুক ভাঙতেন। চুনোলিরা পরে এসে খোলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যেত চুন তৈরি করার জন্য। একদিন গুগলি, ঝিনুকের সাথে ভুলক্রমে মতান্তরে দৈবী ইচ্ছায় পাথরখণ্ডটিও নিয়ে যায় চুনোলিরা। পোড়ানোর সময় খোলগুলি আগুনে পুড়ে গেলেও শেষপর্যন্ত অবিকৃত থেকে যায় কালো এক প্রস্তরখণ্ড। তারপর যেমনটি হয় আর কী! স্বপ্ন পাওয়া, দৈববাণী; সে এক হইহই কাণ্ড। চুনোলিরা প্রস্তরখণ্ডটি নিয়ে গেলেন এক ব্রাহ্মণের কাছে। ইতিমধ্যে বর্ধমানের মহারাজ চিত্রসেন রায় স্বপ্নে দেখেছেন এক দেবীমূর্তি তাঁকে আদেশ দিয়ে বলছেন দেবী অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছেন দামোদরের জলে। মহারাজ যেন দেবীকে উদ্ধার করে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা মহারাজা মানুষ, দুয়েকটা স্বপ্ন না দেখলে, দু-চারটে মন্দির প্রতিষ্ঠা না করলে চলে! আর ঠাকুর দেবতারাও এমন একদেশদর্শী যে তারা কদাচ গরিবগুরবো লোককে স্বপ্ন দেন না, জানেন এদের স্বপ্ন দিয়ে লাভ নেই। সত্যিই! টাকার কী মাহাত্ম্য মাইরি!

অগত্যা সকাল হতেই ঘোড়া ছুটিয়ে দামোদরতটে। তদ্যপি ডিভিসি হয়নি; তাই কেউ বাধাও দিল না। গিয়ে দেখেন একটা লোক বাসন মাজছে। সমীপবর্তী হতে ভুল ভাঙল, রাজামশাই দেখলেন এক ব্রাহ্মণ একটি প্রস্তরখণ্ড মার্জনা করছেন। কোই মিল গ্যয়া। মহারাজ বিগ্রহটি চাইলেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ নারাজ! তা রাজামশাই কী আর জানতেন না এই সব 'সিচুয়েশন' কেমন করে 'ট্যাকল' করতে হয়! তাই বংশপরম্পরায় ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে খাওয়ার প্রতিশ্রুতি - মহারাজ প্রতিশ্রুতি দিলেন ওই ব্রাহ্মণই বংশপরম্পরায় দেবীর নিত্যপুজোর অধিকারী হবেন। ঝামেলা মিটল, সব ভাল যার শেষ ভালো। মহারাজ কীর্ত্তিচাঁদ নির্মিত মন্দিরে দেবী সর্ব্বমঙ্গলা প্রতিষ্ঠিত হলেন মহাসমারোহে। ব্রাহ্মণ পেলেন নিত্যপুজোর ভার। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে দেবীর উল্লেখ আছে। ফলে প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আমি বাউন্ডুলে মানুষ, মন্দিরে মসজিদে ঘুরে বেড়াই। তাই এরকম গল্প শুনে শুনে অভ্যস্ত। কারা এসব গল্প বিশ্বাস করে তাও জানি না। যারা লোকমুখে এই গল্পগুলির উদ্গাতা, তাঁদের কল্পনাশক্তির দীনতা প্রায়ই মনকে পীড়া দেয়। সব মন্দিরের গল্পই এক ধাঁচের, শুরু হলেই বলে দেওয়া যায় এরপর কী হবে – শোনার আগ্রহ অন্তর্হিত হয়। স্বপ্ন দেখা আর দৈববাণীর বাইরে আর কিছু ভাবা গেল না; গল্পগুলিকে করে তোলা গেল না কিঞ্চিৎ বাস্তবতাভিত্তিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন! তবে তাতে আমার কী এসে যায়! আমি তো এসেছি ভোগ খেতে!

মন্দিরে পৌঁছে দেখা গেল পংক্তিতে অনেকেই অপেক্ষমাণ। তিরিশ টাকায় পেটভরা, প্রায় বিয়েবাড়ির খাওয়া; কিন্তু কোন গরিবগুর্বো লোক চোখে পড়ল না; সম্ভবত আমারই চোখের দোষে। সবই পাটভাঙা ধুতিশাড়িতে, খনিজ জলের বোতল হাতে, গাড়ি চেপে ভোগ খেতে আসা উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষ। এমনকি মন্দিরচত্বরে যারা ভিক্ষা চাইছেন তাদেরও পোশাক ও গাত্রবর্ণ দেখে ঠিক ভিক্ষুক বলে মনে হল না। মা তখন বাইরে, গর্ভগৃহ ধোয়ামোছা হচ্ছে। তা সাঙ্গ হতেই রেশমের রাজছত্রের ছায়ায় মা মন্দিরে ফিরলেন। ভোগও শুরু হল। পোলাও, আলুভাজা, পটলভাজা, শাকভাজা। ভাত, শুক্তো, সব্জি সহযোগে ডাল, আলু ফুলকপির তরকারি, পায়েস। প্রতিটি পদই অতীব সুস্বাদু, এবং দেওয়াও হচ্ছে অনেকবার করে। ফলে আমার মামার মত বিয়েবাড়িতে গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়ে 'আর একটু খাওয়ার ইচ্ছে ছিল; দিল না' বলার কোনও সুযোগ নেই। দুপুরে খিদের মুখে গরম ভাত পেয়ে আমিও অনেকটা খেয়ে ফেললাম। পরিবেশনকারীরা সম্ভবত বুঝেছিলেন আমি বহিরাগত; আমাকে প্রসাদ সিন্দুর ফুল দিলেন আলাদা করে। তাঁদের সহৃদয় বদান্যতায় আমি মুগ্ধ হলাম। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি তাঁদের মঙ্গল করুন।

সকালে মন্দির খোলার পর মা মুখ ধোন, সরবত খান। তারপর মঙ্গলারতি। মঙ্গলারতির পর মা চৌকিতে বসে তেল মাখেন, তারপর পঞ্চামৃত দিয়ে স্নান, গহনা পরিধান ও সিংহাসনে উপবেশন। অতঃপর নিত্যপূজা। লুচি সহযোগে ব্রেকফাস্ট। এর মধ্যেই ভক্তরা পুজো দিতে থাকেন। বেলা সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে অন্নভোগ, তৎপরে দিবানিদ্রা। বিকেলে মন্দির খোলে চারটেয়। সকালের মতই স্নান করে গহনা পরে সিংহাসনে। পুজো, সন্ধ্যারতি। রাতে লুচিভোগ। শীতলের পর শয়ন। রাত সাড়ে আটটায় মন্দির বন্ধ। সর্ব্বমঙ্গলার জমকালো পূজা হয় দুর্গাপূজায়, পাঁচদিন মেলা সহ। চোখ কান খোলা রাখলে বোঝা যায়, মায়ের আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল। আর হবে নাই বা কেন! অত্যন্ত জাগ্রত এই দেবীর কাছে কোনও কামনা করে তা পূরণ হয়নি এমন কথা কোনও বর্ধমানবাসী কদাচ শোনেনি। যে কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে, বিবাহে, অন্নপ্রাশনে, পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয়তৃতীয়ায় ব্যবসায়ীদের নতুন খাতার শুভসূচনায় বর্ধমানবাসী মায়ের কাছে একবার আসবেই।

খেয়ে উঠে বাদশাহি সড়ক ধরে কিঞ্চিৎ এগিয়ে তালিত, ডাইনে গুশকরার রাস্তায় উঠেই নবাবহাটের ১০৮ শিবমন্দির। প্রতি শিবরাত্রিতেই সাতদিন ধরে আরাধনা চলে প্রতিষ্ঠা কাল হতেই। রানি বিষ্ণুকুমারী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৮৮ সালে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে, চমৎকার রক্ষণাবেক্ষণ, চারিভিতে বড় বড় গাছ। ভরপেট খাওয়ার পর একটু লম্বা হতে মন আনচান করে।

শহরে ফিরে কমলাকান্ত কালীবাড়ি। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২ - ১৮২০) মহোদয়ের জন্ম মাতুলালয় বর্ধমানের চান্না গ্রামে। বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র তাঁর উচ্ছৃঙ্খল পুত্র প্রতাপচন্দ্রকে শিক্ষা দীক্ষায় উপযুক্ত করে তোলার ভার দেন কমলাকান্তকে। বাড়ি তৈরি করে দেন লাকুড্ডিতে আর মন্দির করে দেন কোটালহাটে। কমলাকান্ত সেখানে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে সাধনা করতেন। কিন্তু দুপুরবেলা, মন্দির তখন বন্ধ।

-৪-
এবার শেষ গন্তব্য। আমার বড় প্রিয়, বিষাদমাখা শের আফগানের সমাধি। পাঠক একবার কপালকুণ্ডলার তৃতীয় পরিচ্ছেদ - প্রতিযোগিনী-গৃহে স্মরণ করুন। 'এ সময়ে শের আফগান বঙ্গদেশের সুবাদারের অধীনে বর্ধমানের কর্মাধ্যক্ষ হইয়া অবস্থিতি করিতেছিলেন। মতিবিবি বর্ধমানে আসিয়া শের আফগানের আলয়ে উপনীত হইলেন।' এই চত্বরের সঙ্গে আমার ভালোবাসা দীর্ঘকালের।

আলি কুলি ইস্তাজিউ ছিলেন পারস্যের শাসকের সফর্চি, অর্থাৎ খাদ্য পরিবেশক। শাসক দ্বিতীয় ইসমাইলের মৃত্যুর পর লোকটি ভাগ্যান্বেষণে কান্দাহার, মুলতান। প্রথমে মনসবদার, তারপর মুঘল দরবারের ছোটখাট সভাসদ। সভাসদ মির্জা ঘিয়াস বেগের স্ত্রীর মুঘল হারেমে যাতায়াত ছিল, প্রায়শই এমত সফরে তার সঙ্গী হতেন কন্যা মেহরুন্নিসা। সম্রাট আকবর নাকি কানাঘুষো শুনছিলেন যে মেহরুন্নিসার সঙ্গে যুবরাজ সেলিমের ইন্টু-মিন্টু চলছে। তখন মুঘল দরবারের সভাসদ আমির ওমরাহদের পরিবারের সদস্যদের বিবাহে সম্রাটের অনুমতি লাগত। ১৫৯৪এ সম্রাটের আদেশে মেহরুন্নিসার বিবাহ হল আলি কুলি ইস্তাজিউর সঙ্গে। এর মধ্যে শিকারে গিয়ে এক বাঘের হাত থেকে যুবরাজ সেলিমের প্রাণ বাঁচালেন আলি কুলি। যুবরাজ খেতাব দিলেন শের আফগান। ১৬০৫-এ সেলিম জাহাঙ্গির নাম নিয়ে সম্রাট হলেন, আলি কুলিকে জায়গিরদার করে পাঠালেন বর্ধমানে। আর রাজা মানসিংহকে সরিয়ে বাংলার সুবেদার করলেন দুধ-ভাই শেখ খুবু কুতুবুদ্দিন খান কোকাকে।

১৬০৭-এ সম্রাট শের আফগানকে দরবারে ডেকে পাঠালেন; অভিযোগ গুরুতর। তিনি নাকি কর্তব্যে অবহেলা করছেন, আফগান বিদ্রোহীদের সঙ্গে নাকি তার ওঠাবসা। শের আফগান গেলেন না। এমত অবাধ্যতা সহ্য করা যায় না; কুতবুদ্দিন যুদ্ধযাত্রা করলেন, আর সেই সঙ্গে ভাগিনেয় ঘিয়াসাকে পাঠালেন শের আফগানকে বুঝিয়েশুনিয়ে তাঁর কাছে নিয়ে আসার জন্য। ৩০ মে, ১৬০৭ শের আফগান গেলে কুতবুদ্দিনের বাহিনী তাকে বন্দী করার চেষ্টা করলেন। শের আফগান আক্রমণ করে আহত করলেন কুতবুদ্দিনকে। বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে কোতল করল শের আফগানকে। পরদিন কুতবুদ্দিন শের আফগানের অনুসারী হলেন। সেই থেকে পির বহরমের ধর্মস্থানে পাশাপাশি শুয়ে কুতবুদ্দিন ও শের আফগান।

দিন এখন অনেকটাই বড়, তবুও বিকেল ঘনায়। বনস্পতির ছায়ায় আঁধার নামে তাড়াতাড়ি। অলসতায় আমি চত্বরে, গাড়ি আছে, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। পাশের পুকুরে তরঙ্গ ওঠে, একটা জলঢোঁড়া সাঁতরে চলে যায়। বসে থাকি।

শের আফগানের মৃত্যুর পর রূপবতী মেহরুন্নিসা কন্যাকে নিয়ে বাহিনীর সঙ্গে দিল্লির পথে। তখন নাকি শের আফগানের ভূত তার পশ্চাদ্ধাবন করে, ডাকতে থাকে, 'মেহের, মেহের!' ভীত সেনাধ্যক্ষ শিরনি চড়ান, চেরাগ জ্বালান মঙ্গলকোটের দরগায়। মুখ নামিয়ে চলে যান মৃত শের আফগান। আজও নাকি বর্ধমান থেকে মঙ্গলকোট অবধি বাদশাহি সড়কে রাতের নিশুতিতে শোনা যায় সেই মরিয়া আর্তনাদ, 'মেহের, মেহের।'

খুব আশ্চর্য লাগে। অভিজাত এক মহিলা কিভাবে চলে যেতে পারেন স্বামী হন্তারকের হাত ধরে! প্রতিশোধস্পৃহা জাগে না? মেহরুন্নিসার কি ইচ্ছা হয়নি মরে যেতে, ইচ্ছা হয়নি চিৎকার করে গাল পাড়তে, অভিশাপ দিতে? ক্রুদ্ধা নারীর অভিশাপই তো ফলে যায় বলে শুনেছি; গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণ, অম্বা ভীষ্ম, ঘসেটি বেগম মিরন... উদাহরণ তো অনেক।

একটা গল্প শুনুন। ইরাকের আরব শাসক হজ্জাজ খলিফা ওসমানের (৬ নভেম্বর ৬৪৪ – ১৭ জুন ৬৫৬) অনুমতি নিয়ে মহম্মদ কাসিমকে পাঠালেন সিন্ধ বিজয়ে। রাজা দাহির, সিন্ধের তদানীন্তন রাজা, সিন্ধুতীরে অররের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলেন। তাঁর রানিরা সতী হলেন। এক রানি, রানি লদি, মহম্মদকে বিবাহ করলেন। রাজা দাহিরের দুই অবিবাহিতা কন্যা, রাজকুমারী সূর্যদেবী ও রাজকুমারী প্রমলদেবী প্রেরিত হলেন খলিফার কাছে, লুণ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রীর এক পঞ্চমাংশের অংশরূপে। এই রাজকুমারী সূর্যদেবী মহম্মদ কাসিমের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন। প্রতিহিংসাপরায়ণা রাজকুমারী খলিফার সম্মুখে নীতা হলে খলিফা তার রূপসৌন্দর্যে মোহিত হন। রাজকুমারী জানান যে তিনি খলিফার যোগ্য নন; কারণ তাঁর কাছে প্রেরিত হওয়ার পূর্বে তিনি মহম্মদ কাসিমের সান্নিধ্যলাভ করেছেন। তাই শুনে খলিফা তৎক্ষণাৎ আদেশ পাঠান মহম্মদ কাসিমকে চর্মাবৃত করে তা সেলাই করে যেন তার কাছে পাঠানো হয়। অনুগত কাসিম তা পালন করেন, বাগদাদের পথেই তার মৃত্যু হয়। নিজের ক্ষমতা জাহির করে রাজকুমারীর মন জিততে তার মৃতদেহ খলিফা রাজকুমারীকে দেখানও।

দিল্লি দরবার। সেখানে মা মেয়ে পারিবারিক আভিজাত্যের জোরে সম্রাট আকবরের প্রধানা পত্নী রুকাইয়া সুলতান বেগমের ব্যক্তিগত সহকারী। সেই সূত্রে মিনাবাজারে সম্রাট জাহাঙ্গিরের সঙ্গে দেখা, বাক্যালাপ। তারপর জল গড়ায়, ১৬১১-তে চৌত্রিশ বছরের মেহরুন্নিসা পরিণীতা সম্রাট জাহাঙ্গিরের সঙ্গে; নতুন নাম সম্রাজ্ঞী নূরজাহান - সম্রাট জাহাঙ্গিরের বিংশতিতমা তথা শেষতমা বৈধ স্ত্রী। লোকে বলে বিবাহের রাত্রে নাকি সম্রাট জাহাঙ্গির সারারাত নির্নিমেষ ও উৎকর্ণ, মেহরুন্নিসাকে দেখেছিলেন আর তার কথা শুনেছিলেন। তিনিই একমাত্র মুঘল মহিলা যার নাম মুদ্রায় উৎকীর্ণ, যার নামে মসজিদে শুক্রবার শুক্রবার খতবা পড়া হয়, যিনি সম্রাটের সঙ্গে ঝরোখায় প্রজাদের দর্শন দেন, ১৬২৬-এ বিদ্রোহী মোহব্বত খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যিনি হস্তীপৃষ্ঠে বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। চেষ্টা করেছিলেন যুবরাজ খুররমের সঙ্গে মেয়ে লাডলির বিয়ে দিতে, কিন্তু যুবরাজ রাজি হলেন না, তিনি তখন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের আপন ভাইঝি মমতাজমহলের প্রেমমুগ্ধ। নূরজাহান তখন মেয়ের বিয়ে দিলেন সম্রাট জাহাঙ্গিরের অপর এক পুত্র যুবরাজ শাহ্‌রইয়ারের সঙ্গে।

২৮ অক্টোবর, ১৬২৭। সম্রাট জাহাঙ্গিরের মৃত্যু। সিংহাসন দখলের দৌড়ে জয়ী যুবরাজ খুররম, নাম নিলেন সম্রাট শাহজাহান, হত্যা করলেন ভ্রাতা শাহ্‌রইয়ারকে। বিড়ম্বিতা নূরজাহানের মৃত্যু ১৭ ডিসেম্বর, ১৬৪৫। তিনি শুয়ে আছেন লাহোরে। কবরের গায়ে ফার্সিতে তাঁর রচিত দুটি লাইন উৎকীর্ণ। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় অনুবাদ করেনঃ 'গরীব গোরে দীপ জ্বেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে। শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে।'

-৫-
ঘড়িতে সোয়া ছটা, সূর্য ডোবার পালা। এবার উঠতেই হয়। ইচ্ছা ছিল ফেরার পথে জি টি রোড ধরে সিমলাগড়ের রেলকালীর মন্দির দেখার। মন্দিরটি রেল লাইনের পাশে হওয়ায় এমন নাম। কিন্তু তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। অগত্যা যাত্রা শুরু। প্রথম বিরতি চার্নক হোটেলে, চা পানের। দ্বিতীয় বিরতি শক্তিগড়ে, ল্যাংচা কিনতে। একদম খালি হাতে বাড়ি ফেরা যায় নাকি!

গ্রন্থঋণঃ
১। Dictionary of Historical Places. Bengal. 1757 -1947, Department of History, Jadabpore University, PRIMUS BOOKS
২। লাডলী বেগম। নারায়ণ সান্যাল। ২০০৫ সংস্করণ দে'জ পাবলিশিং । প্রথম প্রকাশ ১৯৮৬। ISBN 8176121835
৩। The Twentieth Wife. Indu Sundaresan. Washington Square Pres Publication ISBN 0743428188 2002
৪। The Feast of Roses. Indu Sundaresan Washington Square Press Publication ISBN 0743456408 2003
৫। চাচ নামা। পারসিতে লিখিত সপ্তম ও অষ্টম শতকের ভারতবিজয় কাহিনি।
৬। The Age of Wrath. Abraham Eraly. Penguin Vioking. ISBN 9780670087181)
৭। কিংবদন্তীর দেশে, সুবোধ ঘোষ। কলিকাতা নিউ এজ পাবলিশার্স। ১৯৬১


পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher