তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা আর মায়াবী চাঁদের দেওরিয়াতাল

পল্লব চক্রবর্তী


~ তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা-দেওরিয়াতাল ট্রেকরুট ম্যাপ ~ তুঙ্গনাথ-দেওরিয়াতাল-এর আরও ছবি ~

এখনও ট্রেন দেখলে ছেলেবেলার মতো মন ভালো হয়ে যায়, এখনও দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে বসলে মনে আসে অনাবিল মুক্তির আস্বাদ। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতার প্রবল গরমে ঘামতে ঘামতে যখন হাওড়া স্টেশনে কুম্ভ এক্সপ্রেসে উঠলাম, মনে হল পিছনে ফেলে এলাম রোজকার একঘেয়ে জীবনটাকে। এবার সঙ্গী সহকর্মী ও বন্ধু রাজীব। সেই কবে দেওরিয়া তালের ছবি দেখার পর থেকে আমার স্বপ্ন দেখা আর দিন গোনা শুরু। এবার সুযোগ হতেই রাজীবকে সঙ্গী করে ব্যাগ পিঠে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দেওরিয়া তাল ট্রেকের সঙ্গে জুড়ে দিলাম পঞ্চকেদারের সর্বোচ্চ তুঙ্গনাথ মন্দির আর চন্দ্রশিলা ট্রেক। দুটো জায়গাতেই মোটে তিন চার কিলোমিটার হাঁটা পথ। তাই অল্প কষ্টে একরাশ প্রাপ্তির স্বপ্ন দুচোখে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু।
ঘণ্টাখানেক লেট করে ট্রেন যখন হরিদ্বার পৌঁছাল তখনও বিকেলের আলো ফুরিয়ে যায়নি। স্টেশনে নেমেই ছুটলাম পরের দিনের উখিমঠগামী বাসের টিকিট বুক করতে। উখিমঠকে কেন্দ্র করেই তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশিলা আর দেওরিয়া তাল ট্রেক করব। ঠিক করলাম সকাল সাতটার গৌরীকুণ্ডের বাসে কুণ্ডে নেমে কিছু একটা ব্যবস্থা করে সাত কিলোমিটার দূরে উখিমঠ চলে যাব। উঠলাম পূর্বপরিচিত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে।

পরদিন ঠিক সময়ে বাস ছাড়ল। হৃষীকেশ পেরিয়ে গঙ্গার তীর ধরে এগোতে থাকলাম। দেখতে দেখতে এসে গেলো দেবপ্রয়াগ; এখানে গঙ্গোত্রী থেকে নেমে আসা ভাগীরথী আর বদরীনাথ থেকে আসা অলকানন্দা মিশেছে। দেবপ্রয়াগ পার করে এক জায়গায় বাস থামল। আলুর পরোটা আর চা খেয়ে আবার বাস যাত্রা। মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীল আকাশ আর বহু নিচে বয়ে যাওয়া পান্নাসবুজ অলকানন্দাকে সঙ্গী করে পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ক্রমশ এগিয়ে চলা। ভাবতে অবাক লাগে কত শত বছর ধরে দেবভূমি গাড়োয়ালের এই রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে গেছে কত পুণ্যাকাঙ্খী কিংবা প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের দল। তখন রাস্তা ছিল দুর্গম – বিপদ এবং শ্বাপদ সঙ্কুল।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে এলাম শ্রীনগর তারপর রুদ্রপ্রয়াগ। বেশ ব্যস্ত এবং জমজমাট পাহাড়ি শহর রুদ্রপ্রয়াগ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে ২০১৩ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি কী প্রলয় ঘটে গিয়েছিল এ শহরের ওপর। সেবারের বিধ্বংসী বন্যায় গাড়োয়ালের কম বেশি সব এলাকাই বিধ্বস্ত হয়েছিল, চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগ আর তার ওপরের এলাকাগুলো। বিশেষত কেদারনাথ থেকে শুরু করে মন্দাকিনী নদীর তীরবর্তী এলাকা একেবারে মুছে গিয়েছিল। কিন্তু সময় থেমে নেই, থেমে নেই মানুষের জীবনও।
একটু বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু, এবার মন্দাকিনীর তীর ধরে কেদারনাথের দিকে। রুদ্রপ্রয়াগের পর থেকে বাস ঢিমে তালে চলছে। স্থানীয় মানুষজন বাসে উঠছেন, নামছেন। বেশ ভিড় । এতক্ষণ একটানা বসে থেকে ক্লান্ত লাগছে। এমন সময় চন্দ্রপুরীর একটু আগে দৈত্যাকার চৌখাম্বা প্রথমবার দেখা দিল আমাদের। শরীরে যেন নতুন বল পেলাম, মনে নতুন উৎসাহ। এ ভাবেই পৌঁছে গেলাম কুণ্ড। নেমে পড়লাম আমরা। বাস চলে গেল গুপ্তকাশী হয়ে গৌরীকুণ্ডের দিকে। এখান থেকে পেয়ে গেলাম শেয়ার জীপ, আমাদের নামিয়ে দিল উখিমঠে ঠিক ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বড় গেরুয়া বাড়ির সামনে, শেষ হল আমাদের টানা আট ঘণ্টার সফর।

শহরের এক নির্জন প্রান্তে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বাড়িটার ঠিক পাশ থেকেই শুরু হয়েছে মন্দাকিনীর গভীর আর খাড়া নদীখাত। জানলা দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে বহু নিচে ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে নীলচে সবুজ জলরাশি। নদীর ওপারে গুপ্তকাশী শহর। ঘর থেকেই দেখা যায় কিছু তুষার শৃঙ্গ। সব মিলিয়ে অসাধারণ পরিবেশ। এই অবেলায় ঠান্ডা ডাল ভাত তরকারি খেয়ে পিত্তি রক্ষা করে দুজনে গেলাম শান্ত, ছোট্ট উখিমঠ শহরটা ঘুরে দেখতে। টুকটাক কেনাকাটা আর পরদিন সকালে চোপতা যাওয়ার গাড়ি ঠিক করে ঘরে ফিরলাম যখন, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, দূর পাহাড়ে জোনাকির মতো জ্বলে উঠেছে আলো, ওটাই গুপ্তকাশী শহর। সন্ধ্যারতি দেখে একটু বসতে না বসতেই রাতের খাবার খাওয়ার ডাক এল। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের রান্নায় তেল, ঝাল, মশলার হয়তো অভাব থাকতে পারে কিন্তু আন্তরিকতার অভাব নেই। কাল খুব ভোরে উঠতে হবে, যেতে হবে চোপতা, শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি করে। বিছানাতে গা এলিয়ে দিতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে এল...তখনও কানে আসছে বহু নিচে বয়ে যাওয়া মন্দাকিনীর মিষ্টি শব্দ।
পরদিন সকাল সাতটায় রওনা দিলাম তিরিশ কিলোমিটার দূরে চোপতার উদ্দেশ্যে। গত কয়েকদিনের মতো আজও আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত, ঝকঝকে নীল। সকালের নরম রোদ্দুর ছড়িয়ে পরেছে পাহাড়ের আনাচে কানাচে, দুপাশে ঘন সবুজ বনানী, এরই মাঝে লুকোচুরি খেলা চলছে চৌখাম্বা সহ বেশ কিছু তুষার শৃঙ্গের সঙ্গে, মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে গোলাপী রঙের ফুলে ঢেকে যাওয়া রডোডেনড্রন গাছ। এমন ভরা প্রকৃতির মাঝে ভরে আছে মনও। অদম্য উৎসাহ আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন চোপতা আসবে, হাঁটতে শুরু করব তুঙ্গনাথের পথে।
এ ভাবে কখন যে কেটে গেল এক ঘণ্টার পথ, গাড়ি থামল চোপতা। সবুজ বুগিয়াল, দূরে শ্বেতশুভ্র তুষার শৃঙ্গের হাতছানি আর ফুলের ভারে নুইয়ে পরা রডোডেনড্রন গাছ – সবমিলিয়ে চোপতা এক অসাধারণ জায়গা। কিছু খাবারের দোকান আর দু একটা ছোটোখাটো হোটেল নিয়ে এই পাহাড়ি জনপদ এখনও শহুরে সভ্যতার আগ্রাসনের বাইরে থেকে গেছে। আর দেরি না করে তুঙ্গনাথের পথ ধরলাম। শুধু তুঙ্গনাথই নয়, যাব আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের চন্দ্রশিলাও।

একটা ছোট গেট, তারপর ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সিমেন্টবাঁধানো চমৎকার চলার রাস্তা। শুরু হল যাত্রা। মাথার ওপর গাছের চাঁদোয়া, দুপাশে ফুলভর্তি রডোডেনড্রন গাছের সারি। এরই মাঝে উঁকি দিচ্ছে বেশ কিছু তুষারশৃঙ্গ, আবার কখনও তারা হারিয়ে যাচ্ছে পথের বাঁকে। সুন্দর রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে বসার জায়গা করা আছে। মোটেও কঠিন চড়াই নয়, রাজীব আর আমি দিব্যি গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছি। কিছুটা চলার পর বাঁ দিকে দেখা গেল দারুণ সুন্দর একটা সবুজ বুগিয়াল আর উত্তরদিগন্তে চৌখাম্বা, কেদারনাথ, কেদারডোম এবং আরো সারি সারি নাম না-জানা তুষারশৃঙ্গ। এখানেই পেয়ে গেলাম ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুচোখ ভরে দেখতে থাকলাম চারপাশ। চা পর্ব শেষে আবার পদযাত্রা শুরু। এবার চড়াই ক্রমশ বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে কমছে হাঁটার গতি। বহু নিচে দেখা যাচ্ছে ফেলে আসা বুগিয়াল আর চায়ের দোকানের চকচকে টিনের চাল। খানিকটা যাওয়ার পর প্রথমবার বরফ পেলাম রাস্তার ধারে। মনে হয় দু-তিনদিন আগে বোধহয় তুষারপাত হয়েছিল। এর একটু পরেই অনেক ওপরে চোখে পড়ল তুঙ্গনাথ মন্দির সহ কিছু বাড়িঘর। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে এক সময় পৌঁছে গেলাম পঞ্চকেদারের সর্বোচ্চ তুঙ্গনাথ মন্দির। যথারীতি মন্দিরের দরজা বন্ধ, এখন তুঙ্গনাথ মহাদেবের পুজো হচ্ছে উখিমঠের ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে। বিগ্রহ আবার এই মন্দিরে ফিরে আসবে মে মাসের কোনও এক সময়ে। ছোট মন্দির, যেন কেদারনাথ মন্দিরের রেপ্লিকা। আশপাশে বেশ বরফ পড়ে আছে। আছে বেশ কিছু দোকানঘর আর থাকার জায়গা, তবে তাদের দরজাও মন্দিরের মতোই বন্ধ। শুধু একটা দোকান খোলা পেলাম, সেখানে গরম গরম নুডলস দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আবারও পথে নামলাম। এবার যাব আরও প্রায় এক হাজার ফুট ওপরে এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ স্থান চন্দ্রশিলা।

রাস্তা যেন বেশ খাড়াই লাগছে এবার। বরফের পরিমাণ বাড়ছে। মাঝে মাঝে পা স্লিপ করছে। অত্যন্ত সন্তর্পণে এক পা এক পা করে এগোচ্ছি, কিন্তু তাতেও যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পায়ের নিচে বাঁধানো রাস্তা শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন মোটামুটি চলার উপযোগী সরু রাস্তা, জায়গায় জায়গায় বেশ বিপজ্জনক। অন্য দিকে সূর্যের তাপ ক্রমশ বাড়ছে। এক সময় শেষ হল কষ্টকর পদযাত্রা, পৌঁছলাম চন্দ্রশিলা। এখানেও একটা ছোট্ট মন্দির। চারদিকে ইতস্তত বরফ পড়ে আছে। উত্তর দিগন্তে একশো আশি ডিগ্রি জুড়ে দেখা যাছে একের পর এক তুষার শৃঙ্গ। গাড়োয়ালের বিখ্যাত শৃঙ্গগুলোর পাশাপাশি চোখে পড়ল নন্দাদেবী, ত্রিশূল সহ কুমায়ুনের আরও বেশ কিছু শৃঙ্গও। তুঙ্গনাথে রাতে থাকতে পারলে ভোরের আলোতে এ দৃশ্য আরও স্বর্গীয় হতে পারত। আফশোস হল, এ যাত্রায় চন্দ্রশিলায় রোমাঞ্চকর সূর্যোদয় দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।
চোপতায় নেমে এলাম যখন, জোর খিদে পেয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে উখিমঠের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে ফিরে আসতে আসতে চারটে বাজল। সারাদিন পা দুটোর ওপর দিয়ে খুব ধকল গেছে, শরীর চাইছে বিশ্রাম। কাল আবার যাব দেওরিয়া তাল – আমাদের এই সফরের মূল আকর্ষণ, সেখানে তাঁবুতে কাটাব এক রাত।
পরদিন আবার ঠিক সাতটায় বেরিয়ে পড়লাম সারিগ্রামের উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে চোপতাগামী রাস্তা ধরে সাত কিলোমিটার যাওয়ার পর বাঁ দিকের একটা রাস্তা ধরে আরও কিলোমিটার দুয়েক গেলেই আসে সারি। এখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিল গাইড কাম কুক হর্ষবর্ধন নেগি। সদ্য কৈশোর পেরোনো হর্ষবর্ধনকে সঙ্গী করে এগোতে থাকলাম দেওরিয়াতালের চড়াই পথে। মোটামুটি আরামদায়ক রাস্তা আর দূরত্ব তিন কিলোমিটারেরও কম। কিলোমিটার খানেক ওঠার পর চড়াই অনেকটা কমে এল। এবার পথ শুরু হল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। দুপাশে ভর্তি রডোডেনড্রন গাছ। এখানে ফুলের রঙ চোপতার মতো গোলাপি নয়, বরং টকটকে লাল, আলোয় আলো হয়ে আছে চারপাশ। ভুলে গেলাম পথের যত ক্লান্তি। এই ফুলের দেশের মাঝখান দিয়ে রাস্তা যেন শেষ হয়ে গেল বড় তাড়াতাড়ি, চোখে পড়ল কিছু দোকান, বুঝলাম প্রায় এসে পড়েছে স্বপ্নের দেওরিয়াতাল।

একটা দোকানে বসে টোস্ট ওমলেট আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে কয়েক পা যেতেই দুচোখে বিস্ময়ের ঘোর লেগে গেল। মাথার ওপর বিশাল একখানা ঘন নীল আকাশ, পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের চাদরে ঢাকা তৃণভূমি - যাকে গাড়োয়ালি ভাষায় বলে বুগিয়াল, সামনে মাঝারি আকারের পান্না সবুজ রঙের জলাশয় আর যেন ঠিক তার পরেই শুরু হয়েছে দিগন্তজোড়া তুষারশৃঙ্গরাজি যার মধ্যে সবার আগে চোখে পড়ে বিশাল বপু চৌখাম্বাকে। এটাই দেওরিয়া তাল - দেবতাদের স্নানের জলাশয়। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে মনে হয় যেন স্বপ্নের ভিতর আছি কিংবা কোনও নামী শিল্পীর আঁকা ল্যান্ডস্কেপ দেখছি।
পিঠের ভারী স্যাকটা ফেলে বসে পড়লাম ঘাসের ওপর। মনে হল এভাবেই বসে থাকি, কেটে যাক অনন্ত সময়। তাড়া লাগাল হর্ষবর্ধন, আমাদের টেন্ট নাকি একটু দূরে, আপাতত সেখানেই যেতে হবে। অগত্যা তালের ডান দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম হর্ষবর্ধনকে অনুসরণ করে। আবার ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চড়াই, আবার সেই ফুলে ছেয়ে যাওয়া রডোডেনড্রন গাছের সারি। একটু যেতেই চোখে পড়ল বেশ কিছু তাঁবু খাটানো আছে। তাঁবুর ভিতর ক্যাম্প খাট, বিছানা সব আছে, পাশে কাজ চালানোর মতো বাথরুম আছে, আছে পাথর সাজিয়ে তৈরি ছোট্ট রান্নাঘরও। চারপাশে বেশ ঘন জঙ্গল আর ফুলে ভরা রডোডেনড্রন গাছের সমাহার। তার ফাঁকে বেশ নিচে দেখা যাছে দেওরিয়া তাল। আর চৌখাম্বাকে অনেক কাছে লাগছে। হর্ষবর্ধন দেখাল ডানদিকে বহুদূর চোপতা আর তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা পাহাড়। এরপর ঝটপট চা বানাতে লেগে গেলো সে। ব্যাগপত্তর রেখে, চা খেয়ে আমি আর রাজীব ফের গেলাম তালের পাশে, আর হর্ষবর্ধন দুপুরের রান্নার জোগাড় করতে লাগল। এবার দেখলাম দু-একজন করে ট্রেকার এসে পৌঁছাচ্ছে, এক এক করে লাল, নীল পোর্টেবল টেন্ট পরছে দেওরিয়াতালের পাশে, এমন কী শোনা যাচ্ছে বাংলা কথাও। তির তির করে বয়ে যাওয়া মিষ্টি হাওয়াতে কাঁপছে তালের জল, তাই দেওরিয়াতালের জলে তুষারশৃঙ্গের বহুশ্রুত প্রতিফলন দৃশ্য আমাদের অধরা। কিন্তু যা পেলাম তাই বা কি কম! এতো সারা জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকা স্মৃতি। ক্রমশ লোকজন বাড়তে লাগলো, স্বর্গীয় নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে বেশ গমগম করতে লাগলো চারপাশ। খুলে গেলো তালের পাশে থাকা বন দপ্তরের ছোট্ট বিট অফিস। নাম নথিভুক্ত করে আবার তাঁবুর দিকে এগোলাম।

দুপুরে খিচুড়ি বানিয়েছে হর্ষবর্ধন। আচার সহযোগে অমৃতসমান খিচুড়ি খেয়ে ক্যাম্পখাটে শুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের একবার গেলাম তালের পাশে। এবার যখন ফিরলাম তখন দিন ফুরিয়ে এসেছে। সোলার ল্যাম্পের টিমটিমে আলোয় মনে হল নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ এই পরিবেশে আমরা যেন বিশ্বজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। একটু গা ছমছম করতে লাগল। হঠাৎ চোখে পড়ল তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা পাহাড়ের ঠিক মাথার হলুদ রঙের আলো। চমকে উঠলাম, পরক্ষণে বুঝলাম চাঁদ উঠছে, মনে পড়ল গত কাল পূর্ণিমা গেছে। ক্রমশ পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে লাগল চাঁদ। স্নিগ্ধ পেলব আলোয় ভেসে গেল চারপাশ, মায়াবী আলোয় ধুয়ে গেল এ বিশ্বচরাচর। নিজেকে মনে হল এক কল্পলোকের বাসিন্দা। এই অবাককরা চাঁদের আলোয় নতুন রূপে দেখলাম চৌখাম্বাকে। এরই মাঝে হর্ষবর্ধন বানিয়ে ফেলেছে গরম গরম রুটি আর ডিমের কারি, সময় হয়ে গেছে রাতের খাবার খাওয়ার।
পরদিন একেবারে ব্যাগ গুছিয়ে যখন নেমে এলাম তালের পাশে তখনও ভালো করে দিনের আলো ফোটেনি। রংবেরঙয়ের ছোট ছোট তাঁবুতে তখনও ঘুমিয়ে সবাই। ক্রমে ভোর হল, সোনা রঙ ছড়িয়ে পড়ল আদিগন্ত তুষারচূড়াগুলোর মাথায়। শান্ত তালের জলে দেখলাম তাদের প্রতিফলনের সেই স্বর্গীয় দৃশ্য। তবে জল কম থাকায় ছবিতে দেখা দেওরিয়াতালের মত অত মোহময়ী রূপ ফুটে উঠল না। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বিদায় জানালাম দেওরিয়াতালকে, নামতে লাগলাম সারিগ্রামের পথে। হিসাবমত আমাদের এবারের বেড়ানো শেষ। কিন্তু হাতে এখনও পুরো দুটো দিন রয়ে গেছে। রাজীব বলল - চল আর একটা কোনও ছোট ট্রেক করি। উতরাই পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম আর কোথায় যাওয়া যায়...


~ তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা-দেওরিয়াতাল ট্রেকরুট ম্যাপ ~ তুঙ্গনাথ-দেওরিয়াতাল-এর আরও ছবি ~

পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক পল্লব চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাণিজ্য কর দফতরের আধিকারিক। ভালোবাসেন নানা ধরণের বই পড়তে। নেশা ব্যাগ ঘাড়ে করে পরিবারের কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে কাছে বা দূরের ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া। বেশি পছন্দের পাহাড় আর বন। এক সময় দার্জিলিং-এ চাকরি করেছেন বেশ কিছু দিন। সেই থেকে পাহাড়ের সঙ্গে মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়া।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher