ইন্দোনেশিয়ার ডায়েরি

দেবলীনা দাস


~ ইন্দোনেশিয়ার আরও ছবি ~ বালির আরও ছবি ~

ইন্দোনেশিয়া বললেই লোকজনের মাথায় সর্বপ্রথম আসে বালির কথা। কিন্তু আমাদের ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ শুরু হয়েছিল জোগজাকার্তা থেকে, ছোট্ট আদরের নাম যার জোগজা। বেয়াড়া টাইমের ফ্লাইটে উড়ে প্রথমে কুয়ালালামপুর, ন' ঘন্টা পরে সেখান থেকে জোগজা। কুয়ালালামপুর থেকে সঙ্গে পেয়েছি বন্ধু অনির্বাণ ও ক্যামেলিয়াকে, আর তাদের পুঁচকে ঋক, আমার ঋষির চেয়ে মাস ছয়েক যে বড়। অনেকটা জার্নি সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, আর আমারটি দিয়েছে এয়ারপোর্টময় গড়াগড়ি।

১. জোগজাকার্তা

জোগজা পৌঁছে ট্যাক্সি পেতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। ট্যাক্সি বা রাস্তায় চলা গাড়িগুলি সব-ই ঝকঝকে, বেশির ভাগের কাঁচ কালো। ছোট শহর, ছোট ছোট রাস্তা। ইন্দোনেশিয়ানরা গাড়ি চালান ধীরেসুস্থে, স্পিড লিমিট অক্ষরে অক্ষরে মেনে। জানা গেল আমাদের ড্রাইভারের নাম হুডি। তার সঙ্গে কথা বলা হল পরের দিন দুপুরে প্রম্বানন মন্দির ও রাতু বোকো যাওয়ার জন্য। এইখানে বলি, ভারতীয় এক টাকায় মোটামুটি দুশো ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া বা আই ডি আর পাওয়া যায়। অতএব আমাদের হিসেবপত্র, কথাবার্তা হচ্ছিল লাখে কোটিতে। "তোর কাছে কত আছে রে?" "এই পাঁচ লাখ মত আছে।" আমি অঙ্কে কাঁচা, হাল ছেড়ে দিলাম প্রথম দিন-ই।

প্রাসাদোপম হোটেল, কিন্তু সব চেয়ে মুগ্ধ করল লোকজনের ব্যবহার। সদাহাস্যময়। আমাদের ছেলেদু'টির দুষ্টুমিতেও বিরক্তি নেই, এমনকী রাতে ডাইনিং হলে বমি করল আমারটি, আমরা যারপরনাই লজ্জিত, ওঁরা অম্লানবদনে পরিষ্কার করলেন।

এখানে একটু খাওয়ার গল্প করি। ডিনারে প্রথম পরিচয় এ দেশে সর্বত্র বিরাজমান ফ্রাইড রাইসটির সঙ্গে, নাম তার নাসি গোরেং। নাসি মানে ভাত। প্লেটে সাজানো আসে, অল্প সবজি দেওয়া সুস্বাদু ভাত, পাশে একটি কাঠিতে গাঁথা মুরগির মাংসের কাবাব জাতীয় টুকরো, ওপরে মাখানো মিষ্টি মিষ্টি একরকম সস - নাম শিক্ষা পর দিন রাস্তার ধার থেকে কিনে খেতে গিয়ে, সাতে আয়াম, আয়াম অর্থ মুরগির মাংস, একটি ভাজা ডিমের পোচ, স্যালাড, কিমচির মত ভিনিগারে ভেজানো কুচো স্যালাড, ও চিংড়ির পাঁপড়। আমরা বেশির ভাগ এই খেয়ে ছিলাম অথবা এর নুডলস ভাই মি গোরেং। রাইস নুডলসতও দেখেছি ব্রেকফাস্টে, বিহুন গোরেং নাম তার। ব্রেকফাস্টে পর দিন দেখলাম আমিষের প্রাধান্য। ইউরোপীয় ও জাভানিজ দু'রকম খাবারই ছিল, দেখলাম জাভানিজ খাবারে সকালেও মুরগি, চিংড়ির পাঁপড় ইত্যাদি। অনির্বাণদের বাড়ি থেকে আনা প্রেসার কুকারে পুঁচকেদের খিচুড়ি ফুটিয়ে নেওয়া হল হোটেলে। সে আরেক মজার গল্প, প্রেসার কুকার কখনো দেখেনি কেউ, সিটি পড়তেই অতএব হুলুস্থুল কান্ড কিচেনে, তাদের বোঝাতে হল যে ওরকম বিদঘুটে আওয়াজ আরও হবে।

বাচ্চাকাচ্চা সামলে বেরোতে লেট, দেখা গেল রাতু বোকো, যেখানে সূর্যাস্ত দেখতে যায় সবাই, সেখানে যাওয়ার আর সময় হবে না। যাওয়ার পথে অঝোর বর্ষণ, কী ভাগ্য থেমে গেল নামার কিছু আগেই, ওদিকে বৃষ্টি হলে কাদাও জুটত কপালে। প্রবেশমূল্য আছে সব জায়গায়, এমনকী ধানের ক্ষেত দেখতে গেলেও, এবং সেটা বেশ কষ্টকর রকম বেশি, কচিগুলোও ছাড়ান পেল না। তবে প্রম্বানন দেখে মন ভরে গেল। মেঘলা আকাশের গায়ে কালো পাথরের বিশাল তিনটি মন্দির ত্রিদেবের, আশেপাশে ছোট্ট মন্দির আরও দু'শোর ওপর, কিছু ভেঙে পড়া, কিছু আস্ত। ইন্দোনেশিয়ায় সব দর্শনীয় মন্দিরের চার দিক ঘিরে বিশাল বাগান, গাছ, প্রম্বাননে বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থাও, চাইলে গোটা দিন ঘোরা যায়। গাইড পেলাম এক বয়স্ক মানুষকে, সুন্দর ভাবে বোঝালেন যে ইন্দোনেশিয়ায় এখন মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হলেও অন্য ধর্মের সঙ্গে তাঁদের কোনো বিবাদ নেই, হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলিকে তাঁরা জাতীয় সম্পদ বলে রক্ষা করেন। জানা গেল হিন্দুরা বালির দিকে সংখ্যায় বেশি।

ব্রহ্মার মন্দিরটি মেরামতির কারণে বন্ধ ছিল, সেটি ছাড়া যা দেখার ছিল সব-ই দেখলাম। উঁচু খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে উঠে অন্ধকারের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেবমূর্তি দেখতে হয়, কিছু জায়গায় গাইডরা টর্চ জ্বালান। আমার পুত্র ভয় পেয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল, অতএব তার বাবা তাকে নিয়ে নেমে গেল নীচে। চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি দেখলাম, তারপর অষ্টভূজা দুর্গা, বিশাল গণেশ। সব চেয়ে ভাল লাগল মন্দিরের গায়ে খোদাই ছবি, আংকোরভাটের কথা মনে পড়ে গেল, অনেকটাই মিল। দশ দিকপালের মূর্তিগুলি সুন্দর, আর রামায়ণের গল্প। গরুড় ও রাবণের যুদ্ধ আর বালি ও সুগ্রীবের লড়াই এবং তার পরে সুগ্রীবের রাজ্যাভিষেকের কথা বিশেষ করে বলতেই হয়।

পরদিন বরোবুদুর বৌদ্ধস্তূপ দেখতে গেলাম সকালে। আজকের ড্রাইভার নাকি হুডির ভাই, নাম ইশতিয়াক। তার ছেলের নাম নাকি যুধিষ্ঠির। সে যাক, পৌঁছে পেলাম কড়া রোদ, ঋষির টুপি কেনা হল নাছোড়বান্দা হকারদের কাছ থেকে। প্রবেশমূল্য দিলে প্রত্যেকের জন্য একটি করে জলের বোতল ফ্রি, এটা গত কালকেই ক্যামেলিয়ার আবিষ্কার প্রম্বাননে। নিয়ে হাঁটা, বিশাল বাগানের মধ্যে দিয়ে, গাছপালার আধিক্যেও ঘাম কিছু কম হল না। আবার সিঁড়ি, হিন্দু, বৌদ্ধ এই সব অর্চনাস্থলগুলি মেরু পর্বতকে মাথায় রেখে তৈরি কিনা। আর ভগবানের কাছে পৌঁছনো, সে কি করে সহজ কাজ হয়। ঋষি অনেকটাই নিজে নিজে উঠল, তবে একদম ওপর পর্যন্ত আমি আর ও যাইনি, নিচে অপেক্ষা করলাম বাকিদের সঙ্গে, খাড়া সিঁড়ি বেয়ে গেল ঋষির বাবা। দেওয়ালের গায়ে আঁকা কতরকম পশুপাখি, বাণিজ্যপোত, আমার সদ্য জীবজন্তু চিনতে শেখা খুদেটি আপ্লুত। পরিসরের মধ্যে হাতি আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ার ব্যবস্থা আছে, আমরা চড়িনি, কিন্তু ঋষির দেখেই আনন্দ। হকাররা শেষের দিকটায় তাড়া করতে বাকি রাখেন, আমার স্বামী অনিমেষ এড়াতে না পেরে কটি পুতুল কিনল। এরকম সব দর্শনীয় স্থল থেকে বেরোতে হয় হকার বাজারের মধ্যে দিয়ে, রাস্তা সেভাবেই তৈরি। পারলে বাঁচান নিজেকে!

এরপর সাড়ে তিন ঘন্টা বিশাল পথ পার করে ডিয়েং মালভূমি, সেখানে আছে একটি আগ্নেয়গিরির মুখ, ধোঁয়া উদ্গীরণ করছে অনবরত, মুখে জল ফুটছে টগবগ। আশেপাশের মাটি গন্ধকে হলদেটে, দুএকটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। ওপর থেকে দেখলাম একটি হ্রদ, সুন্দর, বিশাল, কিন্তু ততক্ষণে এত ক্লান্ত, বস্তা ফেলা মাটির সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারতাম না যদি আমাদের গাইড ছেলেটি না ধরত। পঞ্চপান্ডবের মন্দিরের কাছে পৌঁছে ঋষি ঢলে পড়ল ঘুমে, আমরা গাড়িতে বসে রইলাম তাই। কিন্তু ক্যামেলিয়ারা ফিরে এসে বলল উপেক্ষিত শিখন্ডীরও একটি মন্দির আছে ওখানে। ভাল লাগল, শিখন্ডীকে কেউ তো রেখেছে মনে।

পরের দিন রাতের ফ্লাইট সুরাবায়া যাওয়ার। দিনের বেলা কী করা যায় তাহলে? হোটেলের রুম ছেড়ে ক্লোকরুমে জিনিস রেখে বেরিয়ে পড়লাম গেম্বিরা লোকা জু দেখতে। শিশুদু'টো কিছু আনন্দ পাক, মন্দির হ্রদ ওরা কী বোঝে। কথাপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ততক্ষণে কী যেন অজানা কারণে ঋক আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে, মিমি বলে ডাকছে আমায়। কোলে উঠতে চাইছে, কিন্তু ঋষির তাতে প্রবল আপত্তি। সে যা হোক, চিড়িয়াখানায় দেখলাম টয় ট্রেন চলে, গোটা দিনের টিকিট নিলে তাতে চড়ে যেখানে ইচ্ছে যতবার ইচ্ছে যাওয়া যায়। বোটিংও করা যায়। অতএব ঘুরে ঘুরে বাঘ, হাতি, শিম্পাজি, সাপ দেখলাম। স্নেক পার্কে প্রচুর সাপ, ছবি তোলানো যায় বাছা বাছা সাপের সঙ্গে, আর পাখিদের জায়গাটি খুব সুন্দর সাজানো। ময়ূরকে পেখম তুলতে দেখলাম, আর ব্ল্যাক সোয়ান। বাচ্চাদের সাথে সাথে আমাদেরও মন ভরে গেল।

২. সুরাবায়া

রাতের ফ্লাইটে সুরাবায়া। শ্রীবিজয়া এয়ারলাইন্সের প্লেন মধ্যপথে নাচ দেখালো। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সবাই, ভেবেছিলাম এ যাত্রা এখানেই শেষ। ট্যাক্সি ধরে ঝাঁ চকচকে নতুন হোটেল আলানা। খাবারের দাম কিছু বেশি, আর জোগজার হোটেলে খাবার যেন বেশি ভাল ছিল মনে হল।

সুরাবায়া আসা মাউন্ট ব্রোমোর জন্য, ইন্দোনেশিয়ার একশো সত্তর না তিয়াত্তরটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মধ্যে একটি। অপূর্ব তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। কিন্তু পৌঁছে এদিক ওদিক খবর নিয়ে জানা গেল, যাওয়া সম্ভব নয়। তিন চার ঘন্টার কার জার্নি, তারপর বেশ কিছুটা চড়াই হেঁটে ওঠা, তারপর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হাঁটা, আবার সে ভাবতেই ফিরে আসা। ছেলেদের কোলে তুলে অসম্ভব। তার ওপর ওদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়। আর খরচ শুনেও মধ্যবিত্ত মাথা ঘুরে গেল, ভারতীয় টাকায় পঁচিশ হাজার আনুমানিক, তারপর খাওয়াদাওয়ার খরচ আছে। অতএব ব্রোমো বাতিল। তার বদলে কী করা যায় তাহলে? খুঁজে খুঁজে কিছু দূরে প্রিগেন বলে একটি গ্রামে তমন সাফারি পার্ক যাওয়া হবে ঠিক করা হল, আর রাতে একটি নাইট কার্নিভাল কাম এমিউজমেন্ট পার্ক। রাতে ঋষির জ্বর এল, বুঝতে দেরি হওয়ায় ওষুধ পড়ল সকালে। যখন বেরোলাম ট্যাক্সি ধরে তখনও গা গরম, ভাল কাশি। ব্রোমো যাওয়া হয়নি ভালোই হয়েছে মনে হল। বয়স্ক ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে প্রিগেন পৌঁছলাম, সেখানে ছেলেদের খিচুড়ি খাইয়ে চড়ে বসলাম বাসে।

ব্যাঙ্গালোরের বানেরঘাট্টার মত সাফারি, কিন্তু জীবজন্তু অনেক অনেক বেশি। এক একটি মহাদেশের জন্য এক একটি জায়গা বরাদ্দ, বাস থেকে গ্রিজলি ভালুক, সুমাত্রান বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা কি না দেখা হল! সাফারি শেষ হওয়ার পর চিল্ড্রেন্স জু দেখলাম ঘুরে, ঋষির দেখলাম শজারুদের ভারি ভাল লেগেছে। এখানেই ঋষির প্রথম আর শেষ বায়না, স্যুভেনির শপ থেকে একটা হাতিমুখো টুপি, তার ল্যাজ আর চার হাত পা ও আছে। সেটা কিনে মাথায় পরে তবে শান্তি। ফেরার পথে কেএফসি থেকে কিনে গাড়ির মধ্যে খেয়ে পেট ভরালাম। হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে ট্যাক্সি ধরে সুরোবোয়ো নাইট কার্নিভাল। সে ভারি মজার জায়গা, বিকেলে তিনটে থেকে রাত এগারোটা অবধি খোলা থাকে। দু'টো ই-বাইক নিয়ে বাচ্চাদের বাবারা তাদের নিয়ে টুকটুক করে ঘুরল। মজার সব রাইডস, বাচ্চারা একা চড়তে পারে এমনও বেশ কিছু জিনিস। একটা ওয়্যাক্স মিউজিয়াম কাম ট্রিক ফটোগ্রাফির জায়গা, সেলফি আর এমনি ছবি তোলার জন্য আদর্শ। আমাদের মেলার মত টিপ করে মেরে জিনিস জেতার খেলাও ছিল। ফিরলাম রাত করে, ঋষি ঘুমিয়ে পড়ল কোলে। রাতে জ্বরের ওষুধ খেতে গিয়ে বমি করে সে এক কান্ড। বহু কষ্টে ভুলিয়েভালিয়ে একটু ওষুধ গেল পেটে। সকালে ঘুমোতে দিলাম, ব্রেকফাস্টে আমি আর যাইনি, অনিমেষ এক প্লেট খাবার নিয়ে এল। কোনো রকমে খেয়ে, ছেলেকে তুলে বাবা বাছা করে খাবার, ওষুধ খাওয়ালাম। এবার গন্তব্য ডেনপাসার, বালি। আবার ফ্লাইট, এবার লায়ন এয়ার। এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকে আবার বমি খাবার খেতে গিয়ে। আমার তখন বেড়ানোর শখ মিটে গেছে, কাঁদতে শুধু বাকি। মনে হচ্ছে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরি কোনও রকমে।

৩. বালি

বালি যাওয়ার সময়ে প্লেন গেল সমুদ্রের ওপর দিয়ে। ঝিকিয়ে ওঠা জল, ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ দেখা গেল। এয়ারপোর্ট সমুদ্রের গায়ে, নামার সময়ের সে দৃশ্য ভোলা যাবে না কখনও। তেমনই সাজানো এয়ারপোর্টটি, হয়তো ট্যুরিস্ট বেশি আসে বলেই। বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে হোটেল হ্যারিস সেমিনিয়াক। আগের দু'টি হোটেলের পর এখানে রুমগুলো নেহাত পাতি মনে হল, লোকজনের মধ্যেও আন্তরিকতার অভাব। দুপুরে হোটেলে খেয়ে রাতে বেরোনো হল একটু, সেমিনিয়াক স্কোয়ারে একটু ওষুধ কিনে ইতিউতি হেঁটে গেলাম কুইন্স তন্দুর, ভারতীয় খাবার কিনতে। বসে খাওয়ার জায়গা জুটল না, তাই কিনে হোটেল ফেরত।


সেদিনের প্রথম গন্তব্য ছিল তীর্থ এম্পুল, একটি উষ্ণ প্রস্রবণকে কেন্দ্র করে সুন্দর একটি মন্দির। নিত্যপূজার্চনা হয়, অত ভেতর অবধি পর্যটকদের যাওয়া বারণ। সারং না পরে ভেতরে ঢোকা যায় না, সে আপনার পোশাক যতই গা ঢাকা হোক না কেন। আংকোরভাটে চুড়িদারে চলেছে, এখানে ফ্রি পাওয়া যায় সারং, গায়ে জড়িয়ে চুল বেঁধে নিতে হল, ক্যামেলিয়ার থেকে ক্লিপ নিলাম ধার।

এর পর দেখতে গেলাম ছোট্ট একটি জলপ্রপাত, তার নাম জানা নেই। এখানেও প্রবেশমূল্য! গেলাম আমরা তিন জন, আর ঋক, ঘুমন্ত ঋষিকে নিয়ে গাড়িতে থাকল তার বাবা। নিচ অবধি যাওয়া যেত, কিন্তু প্রচুর সিঁড়ি, যদি বা নামা যেত, ওঠা রোদের মধ্যে কষ্টকর হয়ে যেত। তাই একটু ছবি তুলেই ফিরে এলাম। ফেরার পথে রাস্তার মুখে অনির্বাণরা কিনল বিশাল এক ডাব, আমাদের টাকায় তার একশো টাকা দাম, কিন্তু তার শাঁস আর জল খাওয়া গেল চার জন মিলে।

হা হা হি হি করতে করতে এবার কিন্তামণি, নামটি মনে হয় চিন্তামণির ইন্দোনেশিয়ান রূপ। ওপরে ভিউপয়েন্ট থেকে একটি আগ্নেয়গিরির মুখ আর পাশের বিশাল লেক দেখা যায়, কিছুটা তার কুয়াশা ঢাকা, কিছুটা ঝিকিয়ে ওঠে রোদ পড়ে। ঋষি জেগেছে তখন, তাকে খাইয়ে নিলাম একটি শপিং কমপ্লেক্সের সিঁড়িতে বসে, পাশে স্থানীয় হকার মহিলা এক হাজার ভারতীয় টাকায় দশটি টিশার্ট বেচবেন বলে সে কী ঝুলোঝুলি।

এখান থেকে এবার গেলাম ধানক্ষেত দেখতে। আসলে টেরেস ফার্মিং বা স্টেপ ফার্মিং যাকে বলে। রাস্তার ধারে, ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া যায়, বিশাল তার বিস্তৃতি। কিন্তু সবুজে শুকনো ভাব, প্রাণের অভাব, হয়তো বৃষ্টি হয়নি কিছু দিন। আমরা নিচে নামিনি, কিন্তু সেই প্রবেশমূল্য, গুনতেই হল। খিদে পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওদিকে দোকানপাট তিনটের সময় বন্ধ, তাই এগোলাম উবুদ মাঙ্কি ফরেস্টের দিকে। সার্থকনামা জায়গা মানতেই হবে, গাড়ি থেকে নামার আগেই গাদা গাদা গোদা বাঁদর। খেলছে খাচ্ছে বিশাল বট গাছের ঝুরি ধরে ঝুলছে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে আরও অনেকে তারা, মা বাবা দুষ্টু বাচ্চা, আমি প্রায় রামনাম জপতে জপতে দুরুদুরু বুকে এগোচ্ছি, হাত পা ধরে না টানে তো বাঁচি। কেউ আমার দিকে আগ্রহপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলেই অনুনয়ের সুরে বলি, "না বাবা, আমার কাছে খাবার নেই বাবা, অন্য দিকে যা!" ওপর থেকে প্রথমে নামলাম নিচের দিকে, একটি ড্রাগনমুখো ব্রিজ ধরে। চতুর্দিকে প্রাচীন সব গাছ, বটের ঝুরি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে শ্যাওলা ধরা পাথরকে, ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি জলের ধারা, বাইরের রোদ এখানে হারিয়ে গেছে সবজে, ভেজা, এক অন্য দুনিয়ার আলোকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে। চারপাশে মুখ ব্যাদান করা কপি মহাকপিদের মূর্তি, আর দলে দলে বাঁদর, গা ছমছম করে উঠছিল। অনিমেষের দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি বাঁদরের পেছনে কাঠি না করলে সেও তোমার পেছনে কাঠি করবে না। আমি সে মতে বিশ্বাসী ছিলাম না কোনোদিনই। একটি বাঁদরকে বিনা কারণে এক বিদেশিনীর পা জড়িয়ে ধরতে দেখে বাঁদরজাতির ওপর আর কোনও ভরসা রইল না। পূজাস্থলে ঢোকা নিষেধ, তাই আরেকটি ব্রিজ পার করে উঠে গেলাম ওপরের দিকে যেখানে আরেকটি মন্দির আছে। এই ব্রিজের পাশে বিশালকায় কোমোডো ড্রাগনের মূর্তি, সে যেন জীবন্ত, এক্ষুনি নড়ে উঠবে। মন্দির চত্বরে আবার এক কপিপ্রবর কে দেখলাম এক পর্যটকের ঘাড়ে চড়ে বসতে, আমি তো পালাতে পারলে বাঁচি। না হোক কয়েক হাজার বাঁদরের বাস সেখানে, দলে তো ওরাই ভারি। মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে খানিক গিয়ে একটা ছোট্ট জলের কুণ্ড পেলাম, তাকে ঘিরে জলপানরত জীবজন্তুদের মূর্তি। কুর্ণিশ করতেই হয় সেই অজানা কারিগরকে, যার হাতের তৈরি বাঘের মূর্তি আজও ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়বে মনে হয়। সেখান থেকে সামনে উঠে গেলে বালিনিজ হিন্দুদের একটি শ্মশানভূমি, দেখা হল না কারণ বড্ডই খিদে পেয়েছিল। প্রসঙ্গত: জানাই, ওয়াহানের কাছে শুনেছিলাম বালির হিন্দুদের মৃতদেহকে প্রথমে কবর দেওয়া হয়, পরে প্রতি পাঁচ বছরে কবরস্থানের সব শবদেহকে এক সঙ্গে তুলে পোড়ানো হয়। শবদাহ বেশ খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, তাই এই অভিনব পন্থা অবলম্বন। এখানে একটি বোর্ডে দেখলাম সেই কথাই লেখা আছে।

অত:পর রয়্যাল প্যালেসের কাছে কুইন্স তন্দুরে পেট ভরে বিরিয়ানি খেয়ে হোটেল। ঋষি একটু গাজরের হালুয়া খেল, কিন্তু পথেই সেটা ঘুমের মধ্যে কেশে বমি করে তুলে দিল। পথে দাঁড়িয়েছিলাম ছেলেদের খাওয়ার সব্জি খুঁজতে, একটা বড় সুপারমার্কেটে আলু, ক্যাপসিকাম আর বিনস পেলাম, বিশাল প্রাপ্তি বটেই, কারণ ইন্দোনেশিয়ায় সন্ধেবেলা ফলমূল পাবেন, সব্জি নয়, কিনতে চাইলে সকাল ন'টার আগে।


সেদিন রাত থেকে ঋকের জ্বর, নাক বন্ধ। আমাদের কাছ থেকে নাকের ড্রপ দেওয়া হল। সকালে দেখা গেল বিশল্যকরণী সেই হোমিওপ্যাথিক ওষুধে ঋষির কাশি কিছুটা কম, অতএব ঋককেও সেটা খানিক গলাধ:করণ করানো হল। সেদিন প্রথম গেলাম তমন আয়ু, রয়্যাল টেম্পল এবং বাগানবাড়ি। ট্র্যাডিশনাল বালিনিজ স্থাপত্য, খুব সুন্দর লাগল। পূজাস্থলে ঢোকা বারণ, বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখলাম। লাগোয়া বাগানটি বিশাল, অসুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে রোদের মধ্যে সবটা ঘুরে দেখা হল না।

এর পর উলুন ডানু, ডানু অর্থে লেক। এখানে বিশাল একটি লেকের ওপরে ফুলগাছে ঘেরা অপূর্ব একটি মন্দির, পূজার্থীরা যেতে পারেন। চার ধারে বিশাল বাগান, তার মধ্যে রেস্টুরেন্ট, মায় বাচ্চাদের খেলার জায়গা অবধি। ঋষিকে দোলনা থেকে নামাতে প্রাণ যায় যায়। ভারি রেগে গেল ছেলে, মেজাজ ঠিক হল অনেক পরে। দেওয়াল পেরিয়ে বাগানের দ্বিতীয় ভাগ, একদম লেকের কিনারায় একটি ছোট্ট দ্বীপে যাওয়া গেল। মন ভরে গেল মুক্ত প্রকৃতির বুকে এসে। বেরিয়ে আসার সময়ে আমার ছেলের সঙ্গে আলাপ দুই জাপানী তরুণীর, তাঁরা নাছোড়বান্দা, ওর সঙ্গে ছবি তুলেই ছাড়বেন, অমন মিষ্টি ছেলে ওনারা জীবনে দেখেননি। এরকম এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সুরাবায়া আসার পথে, ইচ্ছে হচ্ছিল বিচ্ছুটাকে দু'দিন সামলাতে বলি, তারপর দেখব কত মিষ্টি লাগে!


এবার টুইন লেকস দেখতে যাত্রা। আকাশের মুখ ভার দেখলাম, ভয় হচ্ছিল বৃষ্টি শুরু হলে নামা যাবে না আর। লেক দুটিকে যেতে যেতেই পাশে দেখতে পেলাম, বিশাল চেহারা তাদের। ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা গেল মাঝে একটি পাহাড় ব্যবধান তৈরি করেছে, দুপাশে লেক বুয়ান ও লেক তাম্বলিঙ্গান, একটি ছোট একটি বড়। একটু দাঁড়াতে না দাঁড়াতে কুয়াশায় ঢেকে গেল সব, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি এসে নামল। ফেরার পথে ওয়াহান জানাল এখানেই তার দেশবাড়ি, পরে বাবা শহরের দিকে চলে গেছেন। কাকার বাড়ি দেখাল, কৃষক তিনি, গাড়ি দাঁড় করালেই নাকি গাড়িতে তুলে দেবেন চাষের ফসল, মায় হাঁসমুরগি। ওখানে শুনলাম বেশ ঠান্ডা পড়ে রাতে, ভোরের দিকে চার-পাঁচ ডিগ্রিতে নেমে যায়।

এর পর গেলাম তানাহ লট। সমুদ্রের বুকে মন্দির, বিখ্যাত সানসেট পয়েন্ট, যাঁরা যাননি তাঁরাও ছবিতে চিনবেন। ঢোকার আগে খেয়ে নিলাম পাশের রেস্টুরেন্টে, সমুদ্রের মুখোমুখি হয়ে বসে। স্যুপের পর আমি নিলাম স্ন্যাপার স্টেক, কেউ চিকেন স্টেক, কেউ নাসি গোরেং, সবশেষে দৈত্যাকৃতি ডাব। মন্দিরের কাছে পৌঁছনোর আগেই সুয্যিমামা পাটে গেলেন আকাশময় লালিমা মাখিয়ে। তারপর ক্রমশ আঁধার হয়ে আসা আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে সমুদ্রের বুকে পাহাড় কেটে দাঁড় করানো সেই মন্দির, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয় এখনও। ওপরে ওঠা যায় না, কিন্তু পুরোহিতদের বসে থাকতে দেখলাম ওপরের চাতালে। একটা গুহার সামনে বেশ ভিড়, পবিত্র জল বোতলবন্দি করার জন্য। অনেক ভারতীয়, কিছু বাঙালিও দেখলাম। ফিরে আসার পথের ধারে ঘাসের ওপর ছেলেরা খেলল। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল দু'টির, সেই দুজনের হাত ধরে হাঁটার বায়না বড় মনে পড়ে এখনও।

পরের দিনও বেরোনো যেত ট্যাক্সি নিয়ে, কিন্তু তার পরদিন ফিরছি। আমরা কুয়ালালামপুর হয়ে ব্যাঙ্গালোর, গোটা দিন লেগে যাবে, আর ক্যামেলিয়ারা কুয়ালালামপুরে এক দিন থেকে ফিরবে। ঋকের শরীর খারাপ, ঘড়ি ধরে ওষুধ পড়ছে। অতএব ভাবলাম পর দিন আরাম করব। পাশেই সেমিনিয়াক বিচে গেলাম। ঋকের জল ভারি পছন্দ, বাবা মা সুইমিং পুল দেখলেই ভয় পায় ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। আমারটা আবার পায়ে সমুদ্রের জল, ভেজা বালি লাগলেই 'নুঙ্গা, নুঙ্গা' ('নোংরা, নোংরা') বলে চেঁচায়। জুতো খুলতে চায় না, না আমাদের খুলতে দেয়, ভারি চিন্তা বুঝি বাবা মায়ের বহুমূল্য হাওয়াই চটি চুরি হয়ে যাবে। সেখান থেকে স্যুভেনির শপ গেলাম, নাম জেনে নিয়েছিলাম ওয়াহানের কাছ থেকেই, কৃষ্ণ তার নাম। সুবিশাল দোকান, হরেক রকম দামের স্যুভেনির। টুকটাক কিনলাম অনেক, তবে ঋষির বগলদাবা করা কাঠের খেলনাগুলো সুবিধের হল না, বাড়ি ফিরেই তাদের টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলল। রাতের ডিনার সারলাম সেমিনিয়াক স্কোয়ারের কাছে জাপানী ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্ট কুনিস-এ। আমি ইয়াকিসোবা বলে যেটা খেলাম সে কলকাতা ফুটের চিকেন চাউমিন যেন। নিন্দে করছি না, ভালোবেসে বলছি, সত্যি-ই ভাল খেলাম। ঋষি নুডলস কে মুনেল বলে, সে ভাগ বসাল আমার পাতে। অনিমেষ নিল ওয়াকোটোজি বলে একটা ডিশ। সেও বেশ খেতে। পরে মনে পড়ল ব্যাঙ্গালোরে 'দি এগ ফ্যাক্টরি' র মজার মেনু তে পড়েছি, জাপানী ওয়া মানে বোধ হয় পেরেন্ট, আর কো মানে চাইল্ড, অর্থাৎ 'ওয়াকো' মানে এমন একটি ডিশ যাতে পেরেন্ট মুরগি ও চাইল্ড ডিমকে এক সাথে পাওয়া যাবে। রেস্টুরেন্টের লোকজন আমরা চপস্টিক দিয়ে খেতে পারি না আর সব জাপানী খাবারকে সন্দেহের চোখে দেখি বলে হেসে কুটিপাটি, আমরা লজ্জায় অর্ধেক লাল।

পরদিন বিদ্রোহী ঋষি আর অসুস্থ ঋককে কোনো রকমে টেনে এনে ফেলা গেল কুয়ালালামপুরে। সেখানেই দুই পরিবারের ছাড়াছাড়ি, ঋককে খুব মিস করেছি পরের ক'দিন। এত দিন এক সঙ্গে থেকে একটা অন্য রকম সখ্যতা তৈরি হয়েছিল, আর ঋকের জন্য আনা চাল-ডাল-সব্জিতে যে আমার ঋষির ও 'টেস্টি' (খিচুড়ি) তৈরি হয়েছে সে কথা তো ভোলার নয়। তা ছাড়া ওদের কাছ থেকে ছেলের খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত কিছু শিখেছি যা কাজে লাগছে এখন। ন' দিনের ট্রিপ, ওরা না থাকলে ছেলে নিয়ে কক্ষনো পারতাম না। রাত বারোটার পর এসে ব্যাঙ্গালোরে বাড়ি ঢুকলাম, শেষ হল ঋষিকে নিয়ে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ট্রিপ! দুগগা দুগগা!!

~ ইন্দোনেশিয়ার আরও ছবি ~ বালির আরও ছবি ~

ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্রী, বইপোকা দেবলীনা দাসের টুকটাক লেখালিখির শখ আছে। তিন বছরের খুদের মা। আট বছর শিক্ষকতা করার পর এখন দিন কাটে ছেলেকে নিয়েই। জীবনসঙ্গীর ছোঁয়াচ লেগে ভ্রমণপিপাসু। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়েন সপরিবারে এদিকওদিক।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher