ভূস্বর্গ স্যুইৎজারল্যান্ড

শ্রাবণী ব্যানার্জী


~ স্যুইৎজারল্যান্ডের আরও ছবি ~

ছোটবেলায় সুইৎজারল্যান্ড দেশটির সাথে আমার পরিচয় না থাকলেও বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তার নাম আমার কানে আসত। এই যেমন ধরুন আমার পিতৃদেব তার 'টিসো ওমেগা' ঘড়িটি হাতে লাগিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ভাঙ্গা রেকর্ডের মত আউড়ে যেতেন – 'দেখলি একেই বলে স্যুইস ঘড়ি, একদিনের জন্যও স্লো চললো না'। একবার দিল্লীতে এক পাঞ্জাবীর বাড়ি গিয়ে দেখি দেওয়ালে টাঙ্গানো একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ি থেকে একটা পাখি বেড়িয়ে এসে 'ক্যুক্যু' বলে সময়টা জানিয়ে গেল আর গৃহস্বামীও গর্ব সহকারে বললেন 'দেখে রাখো, এটাই হল সুইৎজারল্যান্ডের কটেজ ডিজাইনের বিখ্যাত ক্যুক্যু ক্লক। জলা-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো এক অ্যাডভেঞ্চারাস দাদা এসে আমার জন্মদিনে একটি লাল টুকটুকে জিনিস দিয়ে বললেন—'এটাকে বলে স্যুইস আর্মি নাইফ, এর পেটের মধ্যে ছুরি, কাঁচি থেকে স্ক্রু ড্রাইভার সবই আছে, কোথাও ট্রেকিং এ গেলে নিয়ে যাস, কাজে দেবে।' বাবা মাঝে মধ্যেই রেডক্রস সংস্থাটি নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলতেন তাই জেনেছিলাম এই রেডক্রসের জন্মও স্যুইৎজারল্যান্ডে। সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলাম যেদিন পিতৃবন্ধু-প্রেরিত কয়েকটি স্যুইস চকোলেট আমার হাতে এসেছিল—খেয়ে মনে হয়েছিল—আহা ইহারেই বোধহয় কয় অমৃত!

প্রথমবার স্যুইৎজারল্যান্ডে গিয়ে দেশটির সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে মনে হয়েছিল এই দেশটিতে বারবার ফিরে আসা যায়। তুষারে ঢাকা পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, সেখানে টুংটাং শব্দ তুলে চরে বেড়াচ্ছে ঘন্টিবাঁধা ভেড়ার দল আর তাদেরই ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে ছোট ছোট ফুলে ঢাকা বাড়ি। পাহাড় ও স্বচ্ছ নীল হ্রদের পাশ দিয়ে কুউউ শব্দ তুলে যখন ধীরগতিতে ট্রেনগুলি চলে যায় তখন মনে হয় এ যেন কোনও স্বপ্নপুরীর দেশ যেখানে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই শুধুই যেন এক অনাবিল আনন্দ। তাই পরলোকের স্বর্গের ভরসায় না থেকে কয়েকবছর আগে আবার সেই ভূ-স্বর্গ স্যুইৎজারল্যাণ্ডে গিয়েই হাজির হয়েছিলাম। মিলান থেকে ইতালি ও স্যুইৎজারল্যান্ডের বর্ডার তিরানোতে পৌঁছলাম কারণ উদ্দেশ্য ছিল 'বারনিনা' এক্সপ্রেসে চেপে সেন্ট মরিজ পৌঁছানো। বারনিনা ও গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস এই দুটি ট্রেনই এতটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে যায় যে গন্তব্যস্থলের থেকেও যাবার রাস্তাটাই তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
জেমস বন্ডের 'গোল্ড ফিংগার' ম্যুভি দেখতে গিয়ে প্রথম সেন্ট মরিজের নাম শুনি। জলের ধারে ক্যাসেলের মত দেখতে বাডরুট প্যালেস হোটেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় ড্রাইভার বলল এখানে প্রিন্স উইলিয়াম, টিনা টার্নার, বরিস বেকার ও জর্জ ক্লুনির মত লোকেরা ছুটি কাটাতে আসে। পাহাড় ও লেকের গা ঘেঁসে দুটি ছোট ছোট গ্রাম নিয়ে এই সেন্ট মরিজে দু-দুবার উইন্টার অলিম্পিক হয়েছিল। সারা বছরই এখানে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা, কারণ বছরের মধ্যে তিনশো দিনই এরা সূর্যের মুখ দেখে। সূর্য ও শুভ্র তুষারের মিলনযাত্রাতে চোখ যেন ঝলসে যায় তাই সারাক্ষণ গগলস পড়ে থাকা ছাড়া কোন গতি নেই। অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি শীতকালে স্কি করার জন্যও জায়গাটি বিখ্যাত। সেন্ট মরিজ থেকে ঘন্টাখানেকের দূরত্বে 'ক্যু' বলে একটি জায়গায় ঘুরতে গেলাম। স্টেশনে নেমে কিভাবে হোটেলে যাব তার ম্যাপটা দেখতে যাচ্ছি এমন সময় দুটি দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে হন্দদন্ত ভাবে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাদের ডিরেকশান দেওয়ার বহর দেখে তাকিয়ে দেখি সামনের এক স্যুইস ভদ্রলোকও দুদিকে মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছেন যদিও তাঁর নাড়ানোর স্টাইলটা একেবারেই ভিন্ন। যাই হোক ছেলেদুটি চলে যেতে তিনি বেঠিক ডিরেকশানটিকে সঠিক করে আমাদের হোটেলে যাবার রাস্তাটি বাতলে দিলেন। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখি একটি দোকানে প্রচুর ভারতীয় হাতের কাজের জিনিস বিক্রি হচ্ছে আর দরজার মুখে একটি ভারতীয় লোকের স্ট্যাচু যার গায়ে গোলাপী রঙের ফতুয়া, মাথায় হলুদ পাগড়ি, পরনে সৌভাগ্যবশত সাদা ধুতি ও পায়ে টিয়াপাখির রঙের নাগরাই জুতো। একটি হাত কোমরে ও একটি হাত মাথায় দিয়ে ভারতীয় পুরুষদের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনমেজাজ দস্তুরমত খিঁচড়ে গেল। চতুর্দিকে ভেড়া চরে বেড়ানো সবুজ উপত্যকার ধারে পুরনো দিনের ক্যু শহরটি খুবই সুন্দর। পাথরে বাঁধানো রাস্তা ও তার ধারে ধারে রং বেরং এর ফুলের সমারোহ। পরের দিন সেন্ট মরিজে ফিরে আরও একদিন সেখানে কাটিয়ে 'গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস' ধরে জারম্যাটের দিকে রওনা হলাম। আপাদমস্তক কাঁচ দিয়ে মোড়া ধীরগামী ট্রেনটি তুষারে ঢাকা পাহাড় ও হ্রদের পাশ দিয়ে এমন ভাবে চলে যে ভেতরে বসে থাকলেও মনে হয় নিজেরাই যেন তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি।
আট ঘন্টার ট্রেনজার্নিতে আমার পাশে বসা এক মহিলার সাথে আলাপ জমানোর ইচ্ছায় স্যুইৎজারল্যান্ডের কোথায় তার বাসস্থান জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি উত্তরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন 'মোরন'। আমি তো তাজ্জব। অ্যা! আমাকে খামোকা মোরন বলা? ভদ্রমহিলা আমার মুখ দেখে তাড়াতাড়ি ভাঙ্গা ইংরাজিতে বললেন উনি আমাকে গাল পাড়েননি কারণ উনি স্যুইৎজারল্যান্ডে 'মোরণ' নামক জায়গাটিতে থাকেন আর এতে নাকি আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, কারণ ওনার এক বন্ধু জ্যুরিখের কাছে 'এগ' অর্থাৎ 'ডিম'-এ থাকেন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম 'তা তোমাদের এই দেশটির নিকনেম কি?' উনি এবারে হাসি হাসি মুখে উত্তর দিলেন 'দ্য ল্যান্ড অব ক্যুক্যু ক্লক এন্ড চকোলেট'। জানালা দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ ঘাসের ওপর প্রচুর গরু চরতে দেখে ও স্যুইস চকোলেট খেয়ে তাদের দুধের কোয়ালিটিটা না হয় বোঝা গেল কিন্তু যখন উনি বললেন স্যুইস লোকেদের একদিনও চীজ আর মধু ছাড়া চলে না তাই এটাকে 'ল্যান্ড অব হানি এন্ড চীজ' বললেও অত্যুক্তি হয় না তখন কেমন একটু খটকা লাগলো। চকোলেট, চীজটা মানা গেলেও মধু এল কোথা থেকে? তারপরে অবশ্য ভেবে দেখলাম যে দেশ সারা পৃথিবীর দু-নম্বরী টাকার পিগি ব্যাঙ্ক তা সে দেশ মধু তো বটেই। মৌমাছির চাষ না হলেও মধুত্বের ব্যাপারে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না।
আমার সেই সহযাত্রীটির কাছ থেকে স্যুইৎজারল্যান্ডের অনেক কথাই জানতে পারলাম। এখানে যারা যে দেশের বর্ডারের কাছে থাকে সেই ভাষায় কথা বলে অর্থাৎ উনি জার্মান বললেও জেনিভার লোক ফরাসী ভাষা বলে এবং দক্ষিণ দিকে ইতালির সাথে বর্ডার হওয়ায় তাদের ভাষা ইতালিয়ান। কিছু অদ্ভুত আইনকানুনও জানা গেল। কি ভাগ্যি এদেশে ফুটপাথে ফুচকা, রোল, আলুকাবলি বা ধুলোর কোটিং দেওয়া মোচার চপ বিক্রি হয়না, তাই রক্ষে! এখানে রাত দশটার পর থেকে পেটের অসুখ করলে আপনি যতবার খুশি বাথরুমে গিয়ে বসে থাকতে পারেন, কিন্তু ফ্লাশ টানতে পারবেন না কারণ তার আওয়াজে আশেপাশের লোকাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। বাড়িতে কানে খাটো লোক থাকলেও সাবধান, রাত দশটার পর জোরে কথা বলা মানা আর রবিবার ছুটির দিন লোকে সারাদিনই ঘুমোতে পারে, তাই ওয়াশিং মেশিন চালানোও নিষিদ্ধ। সারা সপ্তাহের ডাঁইকরা জামাকাপড় নিয়ে রবিবারে কাচতে বসবেন, তা সে গুড়েও বালি। আইনগুলি শুনে চমৎকৃত হয়ে গেলেও ভাবলাম উল্টোটা হলে আমাদের কতটা সুবিধা হত? পৈটিক গোলযোগ আপনার প্রতিদিন ঘটবে না কিন্তু আপনার পাশের ফ্ল্যাটেই কোন রক মিউজিসিয়ান যদি রাত দশটার পর তার সাধনা চালিয়ে যান কিংবা কোনও নৃত্যপটিয়সী ঠিক আপনার মাথার ওপরে তাতা থৈথৈ করতে থাকে, তখন আপনার ব্লাড প্রেশারটি কতটা চড়বে?
এ ছাড়াও মনে রাখবেন স্যুইস নাগরিক হবার কিছু সুবিধাও আছে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য এখানে খাবার দাবার সমেত একটি করে বম্বশেলটার তৈরি করে রাখা আছে, অর্থাৎ কোনও অণু-পরমাণুর বাবার ক্ষমতা নেই এদের কোনও ক্ষতি করে। শুধু তাই নয়, সত্তর ভাগ পাহাড় দিয়ে ঢাকা এই দেশটি এতটাই উঁচুতে টং-এ চেপে আছে যে মনুবর্ণিত আর একটি মহা প্লাবন হলেও এরা শুকনো খটখটেই থেকে যাবে। একেই বলে কপাল! বিশ্বপ্রকৃতির এ যেন একটি অতি আদরের সুন্দরী মেয়ে, যাকে মা ঢেলে সাজিয়েছেন। গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসে বসে বাইরের সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বার বার যেন নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল, বাঃ কি সুন্দর!
জারম্যাটে নেমে দেখলাম এই স্টেশনটিও ফুলে ঢাকা। বাইরে বেরোলেই চোখে পড়বে সেই বিখ্যাত ম্যাটারহর্ন পিক - পিরামিডের মত শেপ নিয়ে একাই একশো হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জারম্যাটে দিন দুয়েক কাটিয়ে স্যুইৎজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নের দিকে রওনা হলাম।

১১৯১ সালে ডিউক বার্ডটোল্ড জীবনে প্রথম একটি ভাল্লুক শিকার করে এই জায়গাটির নাম দেন 'বার্ন' অর্থাৎ ভাল্লুক। শহরের চতুর্দিকেই ভাল্লুকের মুর্তির সাথে সাথে কিছু কিছু বেয়ার পিটও চোখে পড়ে। একটাতে দেখলাম বেশ কিছু ভাল্লুক ছানাপোনা নিয়ে বসে আছে আর দর্শকরা তাদের দেখে হাততালি দিচ্ছে। একটি আটশো বছরের পুরনো টাওয়ারের সামনে দেখলাম বিশাল ঘড়ির ভেতর থেকে ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে কিছু পুতুল বেরিয়ে এসে সময়টা জানিয়ে দিয়ে গেল। এখান থেকে খুব কাছেই একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে উনিনশো পাঁচ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন তার থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কার করেন, পেটেন্ট ক্লার্ক হিসেবে তখন তিনি এই শহরেই কাজ করতেন। বাড়িটির সামনে দেখলাম লেখা আছে E=mc2 । বার্নের পুরনো সরু সরু পাথরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল এই পুরোনো বার্ন শহরটি নতুন বার্নের থেকে ঢের বেশি সুন্দর। বড় বড় পাথরে বাঁধানো স্কোয়ারে দেখলাম লোকজন ফুর্তিতে নাচগান, খাওয়াদাওয়া করছে আর এক জায়গায় রাস্তার ওপরেই বিশাল দাবার ছকে বড় বড় ঘোড়া নিয়ে লোকজন খেলছে ও আশে পাশের জনতা তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। চতুর্দিকে লোকজনকে খেতে দেখে আমারও খিদে পেয়ে গেল, তাই ভাবলাম এদের বিখ্যাত ফন্ডুটা এই তালে খেয়ে নিই। ইংরেজিতে অর্ডার দিতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়লাম, লোকটা আমার কথা এক বর্ণও না বুঝে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। মুখাভিনয়ে আমি মোটামুটি পোক্ত, তার আগের দিনই এক জায়গায় নিজের গায়ের হলুদ জামাটিকে আঙুল দিয়ে গোল করে কেটে ঠুকে ডিমের পোচ বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু ফন্ডুর ব্যাপারে আমি একেবারেই অসহায়। ভাগ্যিস পাশের লোকটিও ফন্ডু খাচ্ছিল, তাই সেদিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করেই কাজ সারা গেল। কিছুক্ষণ বাদে যখন ওয়াইনমেশানো উৎকট গন্ধযুক্ত কিছুটা সাদা টগবগে ফোটা চীজ আর ছোট ছোট করে কাটা শুকনো পাউরুটি এল, তখন তার ঘ্রাণেই অর্দ্ধ নয় পূর্ণ ভোজনংটাই মাঠে মারা গেল। বলা বাহুল্য চিমটে দিয়ে রুটিগুলো চীজে ডোবানো যতটা সহজে হ্‌ গলাদ্ধকরণটা ঠিক সেই স্পীডে হল না।

বার্নে থাকাকালীন একদিনের জন্য জেনিভা ঘুরে এলাম। লেকের ধারে রত্নের মতো জ্বলজ্বলে শহরটি ইউরোপের ইউনাইটেড নেশনের হেড কোয়ার্টার্স ছাড়াও রেডক্রসেরও জন্মস্থান। দূর থেকেই চোখে পড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ফোয়ারা ও আশেপাশের প্রচুর নামীদামী দোকান। তার থেকেও বেশি চোখ কাড়ে ঘাসের রঙবেরং-এর ফুল দিয়ে সাজানো একটি বিশাল গোল ঘড়ি যা কিনা সারাক্ষণই সঠিক টাইম দেখিয়ে যাচ্ছে। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে রিস্টওয়াচের দাম দেখে ক্ষণেক্ষণেই হোঁচট খেতে লাগলাম। এদেশের গর্ব টেনিসসম্রাট 'রজার ফেডেরার' বড় বড় ছবিতে হাতে রোলেক্স ঘড়ি লাগিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের গর্ব ঐশ্বর্য রাইও খুব বেশি পিছিয়ে নেই, তিনিও প্রমাণ সাইজের ছবিতে হাতে লঁজিন ঘড়ি সেঁটে দাঁড়িয়ে আছেন। হাঁটতে হাঁটতে লেকের ফুরফুরে হাওয়ায় পায়ে বেশ ঠান্ডা লাগতে আরম্ভ করলো তাই ভাবলাম রোলেক্স ঘড়ি যখন কপালে নেই তার বদলে একটা মোজাই কিনে নিই একাধারে মেমেন্টোও হবে আবার পা-টাও গরম থাকবে। কাছেই একটি ছোট দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই এক স্যুইস মহিলা হাত জোড় করে নমস্তে বলে সম্ভাষণ জানালেন। তিনি নাকি কিছুদিন আগেই মাত্র চারটি শব্দের ওপর ভরসা করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে সারা উত্তরভারত ঘুরে এসেছেন। উৎসুক ভাবে তার মুখের দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন শব্দগুলি, যথাক্রমে 'খানা', 'পিনা', 'শোনা ও 'যানা'; ওনাদের নাকি রেষ্টুরেন্ট খোঁজার দরকার হলে হাতটিকে মুখের কাছে তুলে বলতেন খানা, তেষ্টা পেলে পিনা, হোটেল খোঁজার প্রয়োজন হলে শোনা আর দ্রষ্টব্যস্থানের ছবি দেখিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলতেন যানা- ব্যাস তাহলেই কেল্লা ফতে। যে দেশের জাতীয় ভাষাই কুড়িটা। সেখানে চারটি শব্দের জোরে ওনার উত্তরভারত ঘোরার গল্প শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম যে মোজা কেনার কথাটাই বেমালুম ভুলে গেলাম। পুরনো জেনিভার পাথরে বাঁধানো রাস্তার ধারে ধারে দামী ব্যুটিকের দোকান, তাই উইনডো শপিং করেও বেশ খানিকটা সময় কেটে যায়। তবে জিনিষপত্রের যা দাম তাতে শপিংটাকে উইনডোর মধ্যে রাখাই বাঞ্ছনীয়। মনে মনে সব কটি পছন্দসই জিনিসেরই শপিং সেরে পাশেই আটশো বছরের পুরনো 'সেন্ট পিটার' ক্যাথিড্রাল চার্চে ঢুকে পড়লাম। চার্চে ঢুকতে এক নয়া পয়সা খরচা নেই, তাছাড়া ভেতরের কারুকার্যও বড় সুন্দর। এসব দেশে ধর্মীয় স্থানে আমাদের দেশের মত পান্ডা বা পুরোহিতের অত্যাচার নেই, তাই এই সুন্দর ক্যাথিড্রালটির ভেতরে কিছুক্ষণ বসে মনটা যেন সত্যিই ভরে গেল।

পরের দিন বার্নে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে 'থুনারসি' লেকের ধারে 'স্পিয়েজ' বলে একটি জায়গায় পৌঁছলাম। পাহাড় ও স্বচ্ছ লেকের ধারে একটি মধ্যযুগীয় ক্যাসেল যার প্রতিবিম্ব জলে পড়ে মনে হচ্ছিল যেন সত্যিই কোনও শিল্পীর আঁকা ছবি। থুন ও ব্রিয়েনেজ লেকের মধ্যিখানে একটা জায়গার নাম ইন্টারলকেন অর্থাৎ ল্যাটিন ভাষায় তা হল দুটি লেকের মধ্যিখান। এখান থেকে ট্রেন নিয়ে 'ইউলফ্রাও' যেতে হয়। সাড়ে এগারো হাজার ফিট উঁচুতে অবস্থিত এই স্টেশনটিতে নেমে আবার স্পেশাল লিফট নিয়ে পাহাড়ের চূড়োতে উঠতে হয়। বরফের ঝড়ের মধ্যেই আমরা 'আলেটস' গ্লেসিয়ারে নেমে পড়লাম কিন্তু হাওয়ার ঠেলায় বেশিক্ষণ দাঁড়ায় কার সাধ্যি! কোনও কষ্টসাধনা না করে দিব্যি বারো হাজার ফিট উঁচুতে একটি হিমবাহর ওপর দাঁড়িয়ে আছি ভেবে বেশ মজা লাগল। এখানেই রয়েছে স্যুইৎজারল্যান্ডের বিখ্যাত আইস মিউজিয়াম যেখানে বড় বড় গাড়ি থেকে জলহস্তী সবই বরফে তৈরি। মেঝে একেবারে তালমিছরির মত চকচকে, তাই হাঁটতে গিয়ে প্রথমেই একটি সপাটে আছাড় খেলাম কিন্তু পরমুহূর্তেই লোকলজ্জার ভয়ে যেন কিছুই হয়নি এমনধারা ভাব দেখিয়ে হাসি হাসি মুখে উঠে পড়লাম। কোনও কষ্ট না করে হিমবাহের ওপর দিয়ে হাঁটাটা সত্যিই স্মরণীয়। ইন্টারলকেন থেকে ট্রেনে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল লুসার্নে পৌঁছলাম। লুসার্নকে চেনার সব থেকে বড় উপায় হল ষোলশো শতাব্দীতে তৈরি একটি কভার্ড ব্রিজ। এই শহরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে 'রিয়স' নদী আর তারই ধারে ধারে সুন্দর সুন্দর পুরনো বাড়ি ও চার্চের সাথে চোখে পড়ে তাদের বিখ্যাত চ্যাপেল ব্রিজ। পরের দিন কেবিল কার নিয়ে মাউন্ট পিলাটাসের মাথায় উঠে চতুর্দিকের বরফে ঢাকা পাহাড় ও দূরে ঘন সবুজ ঘাসের আস্তরণ দেখে মনে হল স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে তা বোধহয় এখানেই। কাশ্মীর আমি গেছি যাকে অনেকেই স্যুইৎজারল্যান্ডের সাথে তুলনা করেন, কিন্তু সেখানকার রাস্তাঘাটের নোংরা, ডাল লেকে শিকারাওয়ালাদের অত্যাচার ও হকার বাদ দিয়ে যদি জায়গাটিকে কল্পনা করতে পারেন তবেই স্যুইৎজারল্যান্ডের স্বাদ কিছুটা পাবেন।

লুসার্ন থেকেই এই রূপকথার দেশটিকে আমাদের বিদায় জানাতে হল,এখান থেকেই ইতালির মিলান শহরে আবার ফিরে যাওয়ার পালা। এটিই বোধহয় আমার দেখা একমাত্র দেশ যেখানে রাস্তাঘাটে একটি হকারের দর্শন মেলেনি, কারণ এ দেশে ঢোকা-বেরোনোর নিয়মকানুন অত্যন্ত কড়া। ইউরোপের মধ্যিখানে বাস করেও কি করে সম্পুর্ণ নিরপেক্ষ থেকে গায়ে একটি আঁচড়ও না লাগিয়ে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ এরা পার করে দিল তা ভেবে আজও বিস্ময় লাগে। বিশ্বের যত দু-নম্বরী টাকা এখানেই খাটে, অথচ এদের বদনাম করা তো দূরের থাক আমরা স্যুইস প্লেনে চেপে, মুখে স্যুইস চকোলেট পুরে, হাতে দামী স্যুইস ঘড়ি লাগিয়ে অত্যন্ত গর্ব অনুভব করি! থাকুক না থাকুক একবার কথাচ্ছলেও যদি বন্ধুমহলে স্যুইস ব্যাঙ্কের সাথে যোগাযোগটা একটু জানিয়ে দিতে পারেন, তাহলে দেখবেন প্রেষ্টিজ একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে আর ঘরে ঘরে নিমন্ত্রণও সামাল দিয়ে উঠতে পারছেন না। এটাতে আশ্চর্য হবার অবশ্য কিছুই নেই কারণ স্যুইৎজারল্যান্ড হল বিশ্বপ্রকৃতির নিজের হাতে গড়া সেই অসামান্যা বিশ্ব-সুন্দরী মেয়ে যে মিষ্টি হেসে মধুর ব্যবহারে এমন নিঁখুতভাবে নিজেকে লোক সমাজে পরিবেশন করে যে তখন সবকিছু ভুলে আমরা শুধু তার দিকেই তাকিয়ে থাকি, তার কোনও দোষ-ত্রুটিই আমাদের চোখে পড়েনা। স্যুইৎজারল্যান্ডের চোখ-ধাঁধানো প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে যোগ হয়েছে সেখানকার মানুষদের নিয়মানুবর্তিতা, মিষ্টি ব্যাবহার ও অসাধারণ সৌন্দর্যবোধ।
সব শেষে জানিয়ে রাখি স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করুন অথবা না করুন ছোটবেলা থেকে স্বর্গের যে ডেস্ক্রিপশান পূর্বপুরুষরা আমাদের মাথায় গেঁথে দিয়েছেন তার সাথে এই দেশটির কিন্তু বিলক্ষণ মিল আছে। তাই সম্ভব হলে জীবিত অবস্থাতেই একবার স্বর্গদর্শন করে আসুন না, ভয় নেই ভালো না লাগলে রিটার্ন টিকিট কাটার সুযোগ আছে, অন্যটা কিন্তু শুধুই ওয়ান ওয়ে।


~ স্যুইৎজারল্যান্ডের আরও ছবি ~

শ্রাবণী ব্যানার্জীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।

 


SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher