বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
কুকুবুরু পাহাড় ও সোনকুপির অরণ্য
সায়ন ভট্টাচার্য
“সবাই বলে রুক্ষ পুরুলিয়া – ধূসর পুরুলিয়া কিন্তু আমি বলব সবুজ পুরুলিয়া” - গল্প হচ্ছিল সুজিতদার সঙ্গে। কোথাও আক্ষেপ আবার কোথাও বা গর্ব। সেই গর্বের আনন্দটুকু ভাগ করে নিচ্ছিলাম আমরা। আমরা বলতে শুভ্রা, প্রবীর, শিপ্রা, নিলয়দা, রাকা, শুভ্রজ্যোতি, চন্দনা আর আমি। সত্যিই সবুজ পুরুলিয়া। শাল-পিয়াল, মহুয়া-শিরীষের বনে ঘেরা পুরুলিয়া আর পুরুলিয়ার সেই বুনো স্বাদ পেতে এবারের গন্তব্য সোনকুপি।
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। রাত এগারটায় ট্রেন ছেড়ে পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় বরাভূম। বরাভূম স্টেশন থেকে ১৮ কিমি দূরত্বে কুকুবুরু পাহাড়ের কোলে বনে ঠাসা উপত্যকা সোনকুপি। স্টেশন থেকে একটা গাড়ি ঠিক করে চটপট রুকস্যাকগুলো গাড়ির মাথায় বন্দী করে রওনা দিলাম। বাজার এলাকা ছাড়িয়ে যেতেই দৃশ্যপট বদলে গেল। দুপাশে উন্মুক্ত প্রান্তর। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হল যে, পাখি পাহাড় ও মাঠাবুরু ঘুরে তারপর সোনকুপি ঢুকব। সোনকুপির কিছুটা আগেই দিগারডি গ্রাম। সেখান থেকে ডানহাতি রাস্তা ধরে ১-১১/২ কিমি এগোলেই পাখি পাহাড়। বিখ্যাত শিল্পী চিত্ত দে ও তাঁর সহকারী শিল্পীরা সারা পাহাড় কুঁদে ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন পাখির অবয়ব। এই কর্মযজ্ঞের নাম –"ফ্লাইট টু হারমোনি।" নীচের জঙ্গলে গাড়ি থামল। ট্রেকিং শুরু। শিল্পীদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। পথের পাশের প্রস্তরখণ্ডে টাটকা খোদাইকরা কারুকার্য। নির্বিঘ্নে বেশ কিছুটা ওঠার পর দেখি, পাহাড়টি এবার প্রায় নব্বই ডিগ্রি খাড়া হয়ে উঠে গেছে। ইতি টানলাম হাঁটায়। তবে আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, পাহাড়ের ওই খাড়া অংশেও শিল্পীরা কিভাবে অমন ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন!
বেলা বাড়ছিল। সেই সঙ্গে খিদেও। তাড়াতাড়ি নেমে এসে সোনকুপির রাস্তা ধরলাম। পথে পড়ল মাটা - আদিবাসী গ্রাম। তবে অনেকটা দেরি হয়ে যাওয়াতে না দাঁড়িয়ে সোজা চলে এলাম সোনকুপি বানজারা ক্যাম্প। আপাতত দুদিন এটাই আমাদের বাড়ি । থুড়ি, তাঁবু। কুকুবুরু ছাড়াও চারিদিকে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড় আর সবুজ বনানী। আট বিঘা জমি নিয়ে বিশাল ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। ছোট বড় মিলিয়ে আধুনিক সুবিধাযুক্ত গোটা বিশেক তাঁবু। প্রচুর পলাশ গাছ। সব গাছেই ফুলের আগুন ধরে আছে। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে আছে সারা চত্বরে। দেখেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। পৌঁছতেই বিশেষ এক ধরনের গামছা মাথায় বেঁধে দিয়ে উষ্ণ অভিবাদন জানাল ইন্দ্র। মন ছুঁয়ে গেল।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম সেরে বেড়িয়ে পড়লাম পায়ে হেঁটে জায়গাটা ঘুরে দেখতে। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড যেখানে শেষ, সেখান থেকেই কুকুবুরু শুরু। ট্রেক করে উঠলাম। বেশ উঁচুতে একটা প্রায় সমতল জায়গায়। যতদূর চোখ যায় জঙ্গল। কোথাও ঘন কোথাও পাতলা। কোথাও আবার বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। তারই মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট বড় টিলা। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল ফিঙে (Black Drongo), বাঁশপাতি Green Bee Eater), চিত্রদোয়েল(Indian Robin), নীলটুনি (Purple sunbird), নীলকন্ঠ (Indian Roller), ইউরেশীয় কন্ঠী ঘুঘু (Eurasian Collared Dove), বুলবুল (Red-vented Bulbul), সিপাহী বুলবুল (Red whiskered Bulbul), টিয়া (Rose ringed parakeet), শিকরা (Shikra), হটটিটি (Red-wattled Lapwing), ধলাগলা মাছরাঙা (White-throated kingfisher), গো বগা (Cattle Egret), সাদা বক (Great Egret), কুবো (Greater Coucal), খয়েরি হাঁড়িচাচা (Rouphus Treepie), ছাতারে (Jungle babbler), গোলাপি শালিক (Rosy sterling) ইত্যাদি পাখি।
কুকুবুরুর ঠিক পেছনেই মাঠাবুরু। দুই পাহাড়ের মাঝে সুর্যটাকে ডিমের কুসুমের মতো মনে হচ্ছিল। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ ধরে স্থানীয়রা কাঠ-শালপাতা সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছে। পাখিরাও বাসায় ফিরছে, আমরাও তাঁবুতে ফিরলাম। সন্ধ্যা নামল। সোনকুপি ঘোরার ছক কষছিলাম যখন, ভাগ্যদেবী যে অত্যন্ত প্রসন্ন ছিলেন সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। নিজেদের অজান্তেই আমরা এই জঙ্গলে এসে পড়েছি এক পূর্ণিমার রাতে। ভাবা যায়? সন্ধেটা অন্যরকম ভাবে কাটানোর সব ব্যবস্থাই মজুত ছিল। মহুয়া, বনফায়ার থেকে শুরু করে ছৌ নৃত্য। বলাবাহুল্য প্রকৃতির অকৃত্রিম এই আয়োজনের কাছে অন্যসব আয়োজন ফিকে হয়ে গেল নিমেষে।
বৃষ্টিতাঁবুর বাইরে চাঁদের নরম আলোয় দু-তিনটে খাটিয়া পেতে অস্থায়ী গ্যালারি বানিয়ে, বসে বসে প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম জ্যোৎস্নায় ভেজা সোনকুপির রূপ। মেঘমুক্ত আকাশ, কুকুবুরু মাথায় চাঁদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের পাহাড় যেন। আমরাও 'শংকর'-এর মতো দুঃসাহসিক কাজ করে বসলাম। এই জোছনা রাতে জঙ্গলে ঢুঁ মেরে আসার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। মাত্র পনেরো মিনিট জঙ্গলে নাইট সাফারি, থুড়ি ট্রেকিং। কিন্তু রোমাঞ্চে ভরপুর। সরু পথ ধরে টর্চের আলো ফেলে ফেলে এগোচ্ছি। পাতার ওপর দিয়ে হাঁটার খস্ খস্ শব্দ হচ্ছে ও চারদিকে ঝিঁঝিঁর ডাক। চাঁদের আলোয় জঙ্গল ভারী মনোরম লাগছিল। পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে একটা উঁচু টিলায় উঠে পড়লাম। চাঁদনি রাতের জঙ্গল আর পাহাড়ের ওই রূপ এতোটাই বুঁদ করে দিয়েছিল যে ভুলে গিয়েছিলাম এই জঙ্গল একটি এলিফ্যান্ট করিডর। প্রায়ই দলমা থেকে হাতিরা নেমে এসে এখানে চড়ুইভাতি করে। এছাড়া বুনোশুয়োর, নেকড়ে, ভল্লুক, হায়নারা লুকোচুরি খেলে। আর আছে সজারু। এখন মজারু মনে হলেও, সম্বিৎ ফিরেছিল দূরে থাকা কোনও ময়ূরের আর্তনাদে। বুঝতে পারলাম যে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। তবে সে যাত্রায় সোনকুপির জঙ্গলের প্রহরীদের সঙ্গে মোলাকাত হয়নি।
রাতে ভোজনপর্ব সেরে, খোশমেজাজে গল্পগুজব করতে করতে পরের দিনের প্ল্যান ঝালিয়ে নিলাম। সোনকুপি থেকে আট কিমি গিয়ে বাঘমুন্ডি থেকে আরও ষোল কিমি অযোধ্যা পাহাড়। বাঘমুন্ডির তিন কিমি দূরে ছৌ গ্রাম -চড়িদা। চড়িদা থেকে আট কিমি দূরে নিরুপম প্রকৃতির মাঝে কয়রাবেড়া ড্যাম। অযোধ্যা থেকে ঘুরে আসা যায় তিরিশ কিমি দূরের মুরগুমা লেক।
গল্প চলেছিল অনেক রাত অবধি। উপাদেয় খাবারেও যেমন পরিমাণমত নুন না থাকলে বিস্বাদ লাগে, তেমনই শুভ্রা, প্রবীর, শিপ্রা, চন্দনা, নিলয়দা, রাকা, শুভ্রজ্যোতি ছাড়া সোনকুপি ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। নিলয়দা দুচাকায় সারা ভারত চষে বেড়ান। শুভ্রা চিত্রশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার। শিপ্রা আবৃত্তিশিল্পী ও অভিনেত্রী। চন্দনা রন্ধনশিল্পী। রাকা – ফোটোগ্রাফির পাশাপাশি লেখালেখিতে হাত পাকাচ্ছে। প্রবীর অত্যন্ত সৃজনশীল। নাট্যআলো ও মঞ্চভাবনাতে জুড়ি নেই। শুভ্রজ্যোতি বিজ্ঞানসাধনার পাশাপাশি দুর্দান্ত গিটারিস্ট। নিজগুণে সবাই সবাইকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে। সবাই আমায় ভালোবেসে ক্যাপ্টেনবাবু বলে (টিনের তলোয়ারের কথা ভুলেও ভাববেন না) । আর আমি বোবা হয়ে যাই। এই গুণী সঙ্গীদের কাছে, এই বিরাট প্রকৃতির কাছে আমার নিজেকে নিঃস্ব ও ক্ষুদ্র মনে হয়।
বেসরকারি রপ্তানিকারক সংস্থায় হিসাবরক্ষক সায়ন ভট্টাচার্যের পেশাদারি জীবনের বাইরে অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে প্রকৃতিপ্রেম ও সাংস্কৃতিক চর্চা। ছোট থেকেই নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে ‘উত্তর-হাওড়া শিল্পীলোক’ দলের সঙ্গে নাট্যাভিনয় ও পরিচালনার কাজে যুক্ত। গতানুগতিক ভ্রমণ নয়, খোঁজ চলে অনাঘ্রাত পশ্চিমবঙ্গে কিংবা বাইরে। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন।