-->
স্টিফেন অল্টারের সঙ্গে মিনিটপাঁচেক
[ মার্কিন বংশোদ্ভূত লেখক ও পর্বতারোহী স্টিফেন অল্টারের জন্ম দেশভাগের পর, ১৯৫৬ সালে, ভারতের উত্তরাখণ্ডের মুসৌরিতে। বাবা রেভারেন্ড বব অল্টার ছিলেন ল্যান্ডোরের উডস্টক স্কুলের প্রধানশিক্ষক। সেইসূত্রে তাঁর ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময় ওই ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা হিলস্টেশনেই কেটেছে। প্রয়াত অভিনেতা টম অল্টার তাঁর তুতো-ভাইবোনদের অন্যতম। মূলত ভ্রমণকাহিনি ও উপন্যাস লিখে থাকেন স্টিফেন অল্টার। 'All the Way to Heaven: An American Boyhood in the Himalayas' তাঁর স্মৃতিকথা। লিখেছেন ভারতীয় হাতির ইতিবৃত্ত, গঙ্গা ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় ভ্রমণ নিয়েও। তাঁর শেষতম ননফিকশন গ্রন্থ, হিমালয়ে ভ্রমণের অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা 'Becoming a Mountain' ইতিমধ্যেই বেশ আলোচিত। তাঁর উপন্যাসেও ভারতের বিচিত্র রূপ-রঙ ফুটে উঠেছে সাবলীলভাবে। সম্প্রতি জিম করবেটকে নিয়ে লিখেছেন একটি দীর্ঘ উপন্যাস, 'In the Jungles of the Night'। ছোটদের জন্যও লিখেছেন। দেশ-বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখালেখি বিষয়ে পড়িয়েছেন ও বক্তৃতা দিয়েছেন। বর্তমানে স্ত্রী অমিতাকে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন মুসৌরিতে।]
এ মাসে ঢাকা লিট ফেস্টে তিনি আসবেন, সে খবর আগেই জানা ছিল আয়োজকদের আগাম অনুষ্ঠানসূচি সরবরাহের কারণে। দ্বিতীয় দিন সকালে 'আউট অফ দ্য জাঙ্গল' নামের একটি সেশনে তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার কথা। সেদিন খুব সকালেই, মূল ফটক খোলার সময় লিট ফেস্টে হাজির হলাম। ছুটির দিনের সকাল, ইতস্তত আকারে আগতদের ঘোরাফেরা দেখছি। দেখলাম, লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল হঠাৎ এলেন। তাঁকে ঘিরে আগে থেকেই ভিড়। নজরে পড়ায় আরো অনেকে ছুটছেন তাঁর দিকে। এমন সময় দেখলাম পাকানো গোঁফধারী এক প্রবীণ একা একা আসছেন ফেস্টের বুকশপের দিকে। কাছে গিয়ে বুঝলাম, ইনিই স্টিফেন অল্টার। ঋজু দেহ, ধারালো চেহারা। একটু ভয়ই হচ্ছিল প্রথম প্রথম। একে তো এমন ডাকবুকো মেজাজের মানুষ, তায় আমি ওঁর একটি মাত্র বই ছাড়া আর কিছু পড়িনি। আর সম্বল ইন্টারনেটে পাওয়া কিছু তথ্য। তাও সাহস করে সামনে গিয়ে আলাপ শুরু করলাম।
♦ স্যার, শুভ সকাল! আপনার 'বিকামিং আ মাউন্টেন' বইটি পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল, সে কথা আপনাকে জানাতে ইচ্ছা হলে দেখে গায়ে পড়ে আলাপ করতে এলাম...
বইটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই। ঢাকাতে এই প্রথম কেউ আমার ওই বইটির কথা বললে, এখানকার বুকশপেও (লিট ফেস্টের অফিশিয়াল বুকশপ) দেখছি বইটি নেই। অবশ্য আমার নতুন উপন্যাসটি আছে (জিম করবেটকে নিয়ে লেখা তাঁর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস 'ইন দ্য জাঙ্গল অফ দ্য নাইট')।
♦ আপনার আরেকটি বইয়ের কথা শুনেছিলাম, ভারতীয় হাতি বিষয়ে, সেটাও আর পেলাম না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ! ওটা খুব দরদ দিয়ে লিখেছিলাম!
♦ স্যার, আপনি তো চাইলে ভারত ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য যেকোনো দেশে থাকতে পারতেন, কিন্তু এই উপমহাদেশকেই আপনি বেছে নিলেন কেন? তা কি আপনার জন্মস্থান বলেই?
এই উপমহাদেশ আমাকে ভ্রমণে বেরোতে, পৃথিবীর বহু বিচিত্র রূপ দেখতে আকৃষ্ট করেছে। ভারত, পাকিস্তান কি বাংলাদেশে মানবজীবনের নানা মাত্রা আমি দেখতে পাই। বাংলাদেশে যদিও আমি আগে কখনও আসিনি, তবে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও আমি এখানকার মানুষদের একটু বুঝে নিতে চাইবো।... আচ্ছা, এই এলাকার বৈশিষ্ট্যটা কী? ঢাকার অন্যত্র বেশ দূষণ, কিন্তু এখানে খুব তরতাজা বোধ করছি (লিট ফেস্ট যেখানে হচ্ছিল, সেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের কথা বলছিলেন)!
♦ এটা আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্যে পড়েছে, এখানকার নিসর্গের সুখ্যাতি আছে। আর কাছেই ইংরেজদের গড়া একটি উদ্যানও রয়েছে, রমনা। ...আচ্ছা, ভ্রমণ ও পর্বতারোহণের মাধ্যমে মানুষ চেনা নিয়ে বলছিলেন...
ঠিক তাই! আমার ধারণা, পৃথিবীর সব অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এই এক উপমহাদেশ নিজের হৃদয়ে ধারণ করে আছে। ভালোবাসা থেকে বিদ্বেষ, চাতুরি থেকে সরলতা—সব!
♦ জিম করবেটকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেন, কিন্তু তাঁর একটা সবিস্তার জীবনী লিখলেও তো পারতেন...আমি শুনেছি আপনি কেনিয়ায় জিম করবেটের বোনের সমাধি অবধি খুঁজে বের করেছেন... অবশ্য উপন্যাসটি এখনও পড়িনি..
এটা জিম করবেটকে নিয়ে লেখা উপন্যাস, জিম করবেটের জীবনকথার উপন্যাসরূপ নয়। ফিকশনাল ওয়ার্ক হিসেবে এখানে আমার কল্পনা মিশেছে আবশ্যিকভাবেই। এটাকে কোনোভাবেই কেউ জীবনী হিসেবে পড়ুক আমি তা চাই না। নন ফিকশন ও ফিকশনের ভেতরের তফাৎ বিষয়ে মনের মধ্যে আমি একটা স্পষ্ট পার্থক্যরেখা গড়ে নিয়েছি।
♦ বাংলাদেশ ঘুরে কিছু লিখবেন?
এসেছি তো অল্প সময়ের জন্য...এতে কি আর তেমন অভিজ্ঞতা হয়!
এই অবধি আলাপের পর লিট ফেস্টের একজন স্বেচ্ছাসেবক এসে তাঁকে তাড়া দিলেন, সেশন শুরু হতে মাত্র আর পনেরো মিনিট বাকি। তাই সেলফি তুলে বিদায় নিতে হল। ফিরবার সময় আমার কাঁধটা একটু চাপড়ে দিয়ে মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে আমি দেখতে পেলাম উষ্ণ আন্তরিকতার আভা।
সাক্ষাৎকার – মুহিত হাসান
লেখালেখিই আপাতত পেশা মুহিত হাসানের। মূলত সামাজিক ইতিহাস বিষয়ে চর্চা করেন। প্রকাশিত বই: 'বিস্মৃত কথকতা: সেকালের বাংলার কতিপয় খণ্ডচিত্র'। সম্পাদনা করেছেন কবি শহীদ কাদরীর সাক্ষাৎকার সংকলন। বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে সিপাহি বিদ্রোহের চালচিত্র ও প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন।
ছবি - স্টিফেন অল্টারের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে