মেঘ ছুঁয়ে কল্পেশ্বরে
সুমন্ত মিশ্র
কুঁয়ারিপাস থেকে ফিরেছি কালই, আজ যাব কল্পেশ্বর। আজ অষ্টমী, বাড়িতে থাকলে উপোস করি, কিন্তু এখানে ঘুম ভাঙতেই প্রথম খাওয়ার কথা মনে এল! পাহাড়ে এই এক অভ্যেস - রাত্রে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড় আর সকালে রাক্ষুসে খিদে নিয়ে উঠে গান্ডেপিন্ডে গেলো! জোশীমঠে বাজার খোলে দেরিতে, তাই সাত-সকালে(ছ'টা) খাবারের চিন্তা না করাই ভালো মনে করে 'স্টক'-এর বিস্কুট নিয়ে বসলাম বারান্দায়! সামনে একটা খোলা মাঠ (গান্ধী ময়দান) - সেখানে কিছু ছেলে ক্রিকেট খেলছে। ভোরের আলো ফুটলেও রোদ্দুর পাহাড়ের পাঁচিল টপকে এদিকে ঝাঁপাতে পারেনি তখনও! নবদুর্গা মন্দিরের মন্ত্রপাঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ভালো লাগছে, বাড়িতে থাকতেও পাড়ার মণ্ডপের মন্ত্র এভাবেই কানে আসে - ভেবেই আরও ভালো লাগছে! কিন্তু মনটা গরম চায়ের টানেও কিছুটা ছটফটে! বেরিয়ে পড়লাম - জি এম ভি এন লজের পাশের সিঁড়ি দিয়ে বাসরাস্তায় নামতেই কাছাকাছির মধ্যে দু'তিনটে চায়ের স্টল নজরে এল। তারমধ্যেই রোদের সঙ্গে গলাগলি করা যাবে এমন একটা স্টলে গিয়ে দাঁড়ালাম! ধোঁয়া ওঠা গেলাস হাতে নিয়ে চেয়ে রইলাম পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা নতুন আলোর স্থাপত্যে!
একপিঠ রোদ মেখে চায়ের তৃষ্ণা মিটিয়ে ফিরলাম হোটেলে। বারান্দার রোদে কেউ বড়ি শুকোতে দিয়ে গেছে - মাকেও ডালের বড়ি দিতে দেখেছি, তবে এ বড়িগুলো কেমন অচেনা ঠেকল! ঘরে ঢুকে ব্যস্ত হলাম তৈরি হয়ে নিতে। গোছগাছ, দাড়ি কাটা, চান করা – সব সেরে উঠতে গেল আরও ঘন্টা খানেক। গামছা মেলতে বারান্দায় এসে দেখি এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা বড়ির জায়গাগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখছেন। চোখাচোখি হতেই আলাপ করতে বসলাম - নমস্কার মাঈজি, ইয়ে আপ কিস চিজ সে বানায়ি? মাঈজি ইষৎ হেসে বলেন, "ইয়ে ক্ষিরা কি হ্যায় বেটা।" উম্ তাই, শসার বড়ি, খাওয়া তো দূরের কথা সাতজন্মের কল্পলোকেও যে ছিলনা তাকে চিনব কেমন করে! ধীরে ধীরে মাঈজির সঙ্গে গল্প জমল - মাঈজি-ই এ বাড়ীর কর্ত্রী, বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। ছিলেন পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে, দুই ছেলে - বড় আছে গুজরাটে – স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মী, আর ছোটর দায়িত্বে ব্যবসা সাম্রাজ্য, - দুটো হোটেল ও একটা মিষ্টির দোকান। মাঈজিও খুঁটিয়ে জানতে চান আমি কী করি, ঘরে কে কে আছে, কোথায় গিয়েছিলাম, এখান থেকেই বা কোথায় যাব - এ সবই! কল্পেশ্বর যাব শুনে বলেন, "দশ-সাড়ে দশকে পহলে গাড়ি নেহি মিলেগা বেটা, আরামসে নাস্তা করকে থোড়া রেস্ট লেকে যাও।" সাড়ে আটটা নাগাদ বেরোলাম সকালের টিফিন সারতে - সেও মাঈজির বাতলে দেওয়া রেস্টুরেন্টে। গরম রুটি আর 'চানা ডাল' দিয়ে সকালের খিদের আঁচ নিভিয়ে ফেরার পথেই নজর পড়ল নধর সিঙ্গাপুরি কলায় - কিনে ফেল্লাম গোটা চার, এই একটা ব্যাপারে আমি এক্কেবারে হনুমান, পাকা কলা দেখলেই নোলা চাগাড় দিয়ে ওঠে!
পৌনে দশটা নাগাদ স্যাক পিঠে হোটেল ছাড়লাম, মাঈজির কাছে পেলাম ফের আসার আন্তরিক নিমন্ত্রণ সঙ্গে অমূল্য আশীর্বাদ! মিনিট দু-তিন হেঁটেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, খোঁজ নিয়ে নির্ধারিত জিপের মাথায় স্যাক চাপিয়ে জানলাম দশ জন সওয়ারির মধ্যে সবে অর্ধেক ভর্তি হয়েছে, অগত্যা অপেক্ষা! সময় এগোয়, - দশটা, সাড়ে দশটা, এগারটা – সওয়ারি সংখ্যা ওখানেই থমকে থাকে - সময় কাটে স্ট্যান্ডে পায়চারি করে। কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়ি, তখনই দেবদূতের মত কপালে চাল-সিঁদুরের তিলক কাটা এক ভদ্রলোক উপস্থিত হন। ভদ্রলোক সপার্ষদ, এসেই জিজ্ঞেস করেন, "কিতনা সওয়ারি হুয়া?" ওঁদের তিনজন নিয়ে সবে আট জানাতেই ড্রাইভারকে ডেকে বলেন, "ছোড়ো, বাকি দো কা কিরায়া ভি ম্যায় দে দেঙ্গে, গাড়ি ছোড়ো।" সবাই জিপে উঠলাম, - গাড়ি ছাড়ল। যাব হেলাং হয়ে ঊরগ্রাম পর্যন্ত - জোশীমঠ থেকে ১৪ কিমি পথ হেলাং, সেখানে কল্পগঙ্গার ব্রিজ পেরিয়ে আরও ১১ কিমি গেলে ঊরগ্রাম। তিলককাটা ভদ্রলোক বসেছেন সামনের সিটে জানলার ধার ধরে, রাস্তায় অনেকেই ওঁকে দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার জানাচ্ছেন, বুঝতে অসুবিধা হয়না উনি এ অঞ্চলে বেশ কেউকেটা গোছের! কথা বলে চলেছেন অনর্গল, সবই সরকারি কাজ-কর্ম সংক্রান্ত। আধঘন্টাতেই একটানা উৎরাইয়ে নেমে আসি হেলাং - ছোট্টো জায়গা, গুটি কয়েক দোকানপাট ও লজ, সোজা রাস্তা চলে গেছে চামোলির দিকে, আমরা নেমে যাই ডানদিকে বাঁক নেওয়া রাস্তায়। সামনেই কল্পগঙ্গার জীর্ণ সেতু, - পেরিয়ে উঠে আসি খানখন্দে ভরা শীর্ণ পথে। মধ্যে মধ্যে ছোটো ছোটো ধস, গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে হেলে-দুলে, ঝাঁপিয়ে-লাফিয়ে কোনোক্রমে এগিয়ে চলে আমাদের জিপ। মিনিট পনেরো এগিয়েই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অ্যাম্বুল্যান্স চোখে পড়ে, অনুমান করি হয়তো রাস্তার ভয়াবহতার কথা মনে করেই আপৎকালীন এই ব্যবস্থা!
পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে গাড়ি চলছে – ওপরে উঠছি। উঠছি আর ভাবছি ভেদাভেদ করতে করতে মানুষ তবে ছাড়ল না স্বয়ং ঈশ্বরকেও! হরিদ্বার থেকে জোশীমঠের যে পথে এলাম - সে তো একেবারে ঝাঁ চকচকে পথ -'বদ্রী বিশাল'- এর পথ কিনা! অথচ সেই জোশীমঠেরই মাত্র ২৮ কিমি দুরত্বে পঞ্চম কেদার কেমন অবহেলায় পড়ে! হঠাৎ সামনে থেকে একটা জিপ নেমে আসতে দেখে মনের ধন্দটা একটু হলেও কাটল, - যাক তাহলে এই রাস্তায় গাড়ি 'চলাচল' করে! আরও মিনিট দু-তিন চলে একটা বাঁকের মুখে পৌঁছতেই হৈ হৈ করে একদল মানুষ ছুটে এসে আমাদের পথ আটকান, - ড্রাইভার সাহেব ও তিলক কাটা ভদ্রলোক ওঁদের সাথে নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, বারকয়েক আমার দিকে তাকিয়ে কেমন ইতস্তত করেন! – জানতে চাই, কি ব্যাপার ? যা শুনি তাতে বুঝতে পারি ২০১৫ সালে পৌঁছেও পাহাড় আছে পাহাড়েই! – একজন সন্তানসম্ভবা মহিলা প্রচণ্ড প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে পড়ে আছেন রাস্তার ধারে আর তাঁর পরিবারের লোকজন পাগলের মত ছোটাছুটি করছেন কোনো গাড়ি যদি তাঁদের একটু পৌঁছে দেয় অ্যাম্বুল্যান্সের কাছে - সেই অ্যাম্বুল্যান্স - উঠে আসার পথে যাকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি! –রাস্তার বেহাল অবস্থায় তার পক্ষে আর উঠে আসা সম্ভব হয়নি! ওঁরা আমায় জিজ্ঞেস করেন গাড়িটি ছেড়ে দিতে রাজি কিনা! হিমালয়ে আসি পথ চলতেই, শুধু যে পথে যান চলে সেখানেও পথ চলায় মনের সায় থাকেনা, তাই গাড়ি চাপা! আর এমন পরিস্থিতিতেও কারো সাহায্যে আসবনা এটা ভাবতেই যে কষ্ট হবে - ওঁদের বলি সে'কথা। সবাই তাড়াতাড়ি নেমে ওঁদের দ্রুত এগিয়ে দিই! ড্রাইভার সাহেব যাওয়ার আগে বলে যান, "আধাঘন্টা রুকিয়ে দাদা, ম্যায় ছোড় কর-ই আ রাহা হুঁ"। মনে পড়ছিল প্রায় সতের বছর আগে রূপকুণ্ড থেকে ফেরার কথা। সেবার ওয়ান গ্রামের একটি বাচ্চা মেয়েকে ৩২ কিমি পায়ে হেঁটে ডাক্তার দেখাতে যেতে দেখেছি তার দাদুর সঙ্গে! অসহ্য পেটে যন্ত্রণা নিয়েও তাকে চলতে হয়েছিল অতটা পথ! হাজারো হাসি-মজা করেও আমরা থামাতে পারিনি তার দু'চোখের জলের ধারা! আমরা সমতলের লোকেরা এরপরেও প্রশ্ন তুলি "পাহাড় কেন অশান্ত হয়?"
পাহাড়ের যে বাঁকে দাঁড়িয়ে আছি সেটা বেশ গাছগাছালিতে ছাওয়া, একেবারে 'শ্যামলে শ্যামল' - চারদিকে ঝুপঝুপে ছায়া, কেমন যেন বিষন্নতায় ছোপানো ক্যানভাস! ভাবছিলাম রাস্তায় কাতর ওই ভারতজননী কি শুধুই সভ্যতার বৈষম্যের ফল নাকি অসভ্যতার উন্নয়নেরও জীবন্ত চিত্রায়ণ! "কল্পেশ্বর যায়েঙ্গে?" সম্বিত ফেরে, দেখি প্রশ্নকর্তা সেই তিলককাটা ভদ্রলোক! 'হ্যাঁ' বলি। আরও একগুচ্ছ প্রশ্ন ধেয়ে আসে - কোথা থেকে আসছি? একা কেন? এসবই আমার কাছে 'কমন' প্রশ্নমালা, তাই ঝটপট উত্তরও দিয়ে দিই। এবার আমারও কিছু জেনে নেওয়ার পালা। জিজ্ঞেস করি - আপনি কি সরকারি কোনও কাজে এদিকে এসেছেন? বেশ সগর্ব উত্তর পাই, -"ম্যায় উরগ্রাম কী পঞ্চায়েত প্রধান হুঁ।" শুনেই আমার কেমন চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায়! ওঁকে বলি, আপনার মনে কখনও এ প্রশ্ন আসেনা যে আপনি আছেন কেন! ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে যান। খোলসা করতে বলি - আপনার অঞ্চলের কাউকে রাস্তায় ভূমিষ্ঠ হতে দেখলে আপনার লজ্জাবোধ হয় না? মাত্র প্রথমবার এই পথে আসতে আমারই যদি বিরক্তি বোধ হয় তাহলে এপথ যাদের নিত্য, তাঁদের কষ্ট লাঘবের জন্য প্রধান হিসেবে আপনি কি ব্যবস্থা করেছেন? ভদ্রলোক একটু লজ্জিতই হন, ব্যক্ত করেন নিজের অসহায়তা! বিরোধীদলের প্রতিনিধি হওয়ায় তাঁকে কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, - দেন সে ফিরিস্তিও! তবে আশার বাণীও শোনান, আগামী তিনমাসের মধ্যেই নাকি এই রাস্তা 'সারাই' হয়ে যাবে! – কথার মাঝেই আমাদের জিপ এসে যায়, উঠে পড়ে রওনা দিই। মিনিট দশ উঠেই পাহাড়ের যে ঢালে গাড়ি দাঁড়াল তার নাম 'লিয়ারি' - গোড়ালিডোবা ধুলোয় মোড়া প্রান্তর, ইতিউতি খান তিন-চার অস্থায়ী খাবারের দোকান, - ব্যস, এখানেই জিপযাত্রার ইতি!
লিয়ারি থেকে দেবগ্রাম তিন কিমি। কাঁচা মেঠো পথ ধরে উঠে চলি সেই পথে, সঙ্গী সপার্ষদ হরিশ পানওয়ার, পঞ্চায়েত প্রধান, উরগ্রাম। গল্প করতে করতে মিনিট পাঁচ উঠেই দেখা মেলে 'উরগ্রাম ভ্যালি'র, তিন দিক উঁচু সবুজে ঘেরা রঙবাহারি উরগ্রাম-দেবগ্রাম, উপরের অনন্ত নীল নীলিমা যেন আলিঙ্গনে ডাকে এই বর্ণোজ্জ্বল ধরিত্রীখণ্ডকে! রবি ঠাকুর মনে পড়ে, -"অসীম সে চাহে সীমার নীবিড় সঙ্গ / সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা"। একটু এগিয়েই বাঁদিকে পথ চলে গেছে উরগ্রামের দিকে, সোজা পথে দেবগ্রাম। হরিশবাবু উরগ্রাম যাবেন, তাই বিদায় নেবার আগে আমার দু'হাত নিজের দু'হাতে নিয়ে শুভেচ্ছা জানান, জানাতে ভোলেন না আবার আসার নিমন্ত্রণও! রাস্তার ক্ষোভ রাস্তাতেই পড়ে থাকে, এগিয়ে চলি!
এদিকের রাস্তা সরু, তবে কংক্রিটের, দু-দিকে ক্ষেত - কোথাও রামদানার লাল টুকটুকে ঝুঁটি তো কোথাও পাকা রাজমার হলুদসোনা চেন। মধ্যে মধ্যে কয়েক ঘর বসতি, সেখানে নতুন অতিথিকে মেপে নেওয়ার উঁকিঝুঁকি। কোথাও লোমশ রামছাগলের গম্ভীর দৃষ্টি তো কোথাও রাশভারী মোরগের তীক্ষ্ম চাউনি, বাদ যায়না ভল্লুক সদৃশ সারমেয়রাও! শুধু লোকজন চোখে পড়েনা! মিনিট পঁয়ত্রিশ এঁকেবেঁকে পথ চলে পৌঁছাই দেবগ্রাম - দেবরাজ ইন্দ্রের কল্পতরুপ্রাপ্তির গ্রাম। গ্রামে ঢোকার মুখেই রাস্তার ডানদিকে পাথরে তৈরি একটা ছোট মন্দির - নব্য মনে হয়! আরও কয়েক পা এগোলেই বাঁদিকে 'পথিক গেস্ট হাউস' - ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা তিন ভাষাতেই দেওয়ালের গায়ে বড় বড় করে লেখা। ইন্টারনেটে এই গেস্টহাউসের কথাই লেখা আছে, তবে হোটেলের পরিচালক রাজেন্দ্র সিং নেগির যে ফোন নং দেওয়া আছে তাতে গত দু'দিন বহু চেষ্টা করেও কোনোও যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। উঁহু, একেবারে যে সত্যি বললাম তা নয়, গতরাতে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা ফোন ধরে এমন গালাগাল করলেন যে আমার ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় গেল! যাক্ সে কথা, পথিকের কথা ভেবেই যে পথিক গেস্ট হাউস, স্থাননির্বাচনে অন্তত তার সুন্দর প্রকাশ রেখেছেন নেগি সাহেব। বোঁচকাকাঁধে পাহাড়ি পথ চলে গ্রামে ঢুকেই যদি থাকার জায়গা পাওয়া যায় তাহলে আমার মত পথচলতি মানুষ এমনিতেই খুশীতে ডগমগ হয়ে থাকে। একে এসেছি একা, তার ওপর রাস্তাতেও কোনও ট্যুরিস্ট চোখে পড়েনি, ধরেই নিয়েছি জায়গা পাওয়া যাবে, প্রায় ধেইধেই করে ঢুকে পড়লাম গেস্ট হাউসের উঠোনে। ওঃ বাবা, এতো রীতিমত কলরব! তাও কিনা বাংলা চোখা চোখা শব্দ উচ্চারণে! বেশ হই হই রবে রাত্রের পানপর্বের ব্র্যান্ড নিয়ে আলোচনা চলছে! সঙ্গে সঙ্গে মন পিছলে গেল কয়েকদিন পিছনে, কুঁয়ারি পাস ঘুরে এসে তাঁবু ফেলেছি খুল্লারায়, সারাটাদিন ওখানেই শুয়ে-বসে কাটানো, দুপুরের খাবার খেয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরছি, সঙ্গী সহযোগী রাকেশ। মাঝেমাঝেই বড় বড় পাথরের আড়ালে মাতালকরা হুল্লোড়ের শরীরী অবশেষটুকু নজরে আসছে! আর প্রতিবারই রাকেশ বলে উঠছে - "ইয়ে সব্ বাঙালি লোগোঁ কি হ্যায়।" একসময় বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিলাম, - তু ক্যায়া উসকে সাথ থা? উত্তরে ও বলেছিল - "নেহি সাব ইয়ে ব্র্যান্ড সির্ফ বাঙ্গালি লোগোঁনে হি পিতে হ্যায় ।" প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর ধরে হিমালয়ের দূর্গম পথে পা ফেলতে ফিরে ফিরে আসি, - এ এক আশ্চর্য্য পরিবর্তন! – একই জল-হাওয়ায়, একই পরিবেশে বড় হওয়া আমাদের ছেলেমেয়েরা এত বদলে গেল কিভাবে বুঝে উঠতে পারিনা কিছুতেই, - এও এক অক্ষমতা! হঠাৎ সামনের একটা ঘরের দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এল একটি তরুণী। আমাকে দেখেই কেমন থমকে দাঁড়িয়ে গেল, - তারপর জিজ্ঞেস করল, - "রুম লেনা হ্যায়?", - হ্যাঁ বলতেই বলল, - 'বাঙালি?' আবার বললাম, হ্যাঁ। - আমার বাঁদিকে চোখের ইশারায় একটা ছোট ঘর দেখিয়ে বলল, "ওখানে কথা বলুন, - দেখুন পান কিনা!" আমার যাওয়ার আগেই 'কৌওওন আয়া' বলে এক মহিলা ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, - সামনেই আধবুড়ো গুঁফো লোকটির দিকে আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে জানতে চান, -"বুকিং হ্যায় ক্যায়া?", মাথা নেড়ে জানাই – না। "ফির্ তো রুম নেহি মিলেগা" – শুনে একটু খুশি-ই হলাম - পাহাড়ের নির্জনতায় বঙ্গীয় হট্টগোলে এখন আর কোনোভাবেই অংশীদার হতে ইচ্ছে করেনা, তাই অন্য ডেরার খোঁজে ফের পা বাড়ালাম। মিনিট তিন-চার এগিয়েই রাস্তার ডানদিকে চোখে পড়ল রঙচঙে 'কল্প প্যালেস' লেখা একটা বাড়ি। খেয়াল পড়ল,- হেলাং-এ রাস্তার ধারে এর একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। বাড়ির ছাদে এক মহিলা কিছু রোদে দিচ্ছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করি, রুম মিলেগা দিদি? "হাঁ হাঁ, অন্দর আইয়ে" – আশ্বস্ত হয়ে ভেতরে ঢুকি। ঘর দেখে কল্প প্যালেসেই সেদিনের রাত্রিবাস স্থির করি।
মালপত্র ঘরে রেখে দুপুরের খাবারের ফরমায়েশ করে ক্যামেরা গলায় ছাদে উঠে এলাম। পাহাড়ের সবুজ বেয়ে শরতের চিকচিকে রোদ তখন গড়িয়ে নেমেছে দেবগ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠেঘাঠে। সোনাঝলমল প্রকৃতির সেই রম্যবেশে হারিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ! "কি দাদা মন্দির দর্শনে যাবেন না?" – ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, রাস্তায় দাঁড়ানো তিনজন যুবক আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উত্তরের অপেক্ষায়। বলি, - যাব, তবে দুপুরের খাবার খেয়ে, তাই আরও কিছুটা দেরী হবে। 'সে কি!', প্রায় আঁতকে উঠল ওরা, বলল - "খেয়ে তো চলতে কষ্ট হবে দাদা, তার চেয়ে ঘুরে এসে খাবেন।" হেসেই বললাম, না না, আপনারা এগোন, হয়তো ফিরতি পথে আমাদের দেখা হবে! আসলে মন্দির এখান থেকে মাত্র আধঘন্টার পথ, তাই এদিকের সব কাজ সেরে একেবারে সমস্ত সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাবে মনে করেই খেয়ে বেরোনো ঠিক করেছি। হঠাৎ ঝিরঝিরে বৃষ্টি তাড়িয়ে নীচে নামাল। টেবিলে তখন অপেক্ষা করছে গরম ভাত, কড়িহ্ আর কুমড়ো শাক, - তৃপ্তি করে খাবার খেয়ে বেরোলাম মন্দির দর্শনে, - জয় কল্পেশ্বর! বাঁধানো রাস্তা গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে গেছে দেবতার দ্বারে। - চড়াই খুবই অল্প, তাই হাঁসফাঁস না করে স্বচ্ছন্দেই পথ চলা যায়। ছবির মত প্রাচুর্যে ভরা গ্রাম - ক্ষেতভরা শস্য, ফলভরা গাছ, প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য যেন আত্মগোপন করে আছে এই গ্রামে – দেবগ্রাম। মুগ্ধ আমি হাঁটছি কম, দেখছি বেশি। বেশিক্ষণ অবশ্য অমন চলল না - কোথা থেকে মুঠো মুঠো ছাইকালো মেঘ এসে ছেয়ে দিল আসমানি নীলকে! ওপরের গুরুগুরু রব বুকেও আওয়াজ তুলল – সে অবশ্য নিছক-ই ছবিযন্ত্রের মায়ায়! - পড়িমরি হাঁটা দিলাম একটুকরো ছাউনির খোঁজে। পথের এক বাঁকে হারিয়ে গেল দেবগ্রাম - এদিকটা যেন বড় বড় গাছেদের নির্ভেজাল আড্ডাখানা, - হাওয়ার বেগে তাদের স্বরও জোর পেয়েছে, মসমস্ পায়ে এগিয়ে চলি ওদের ছুঁয়েই!
একটু গিয়েই স্পষ্ট হল ডানদিকের সরু খাতে বয়ে চলা কল্পগঙ্গা - স্পষ্ট হল নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে কল্পেশ্বরের তোরণ-ও! এক-দু মিনিট হেঁটেই দাঁড়ালাম এক বিশাল ধ্বসের মুখে। না, ধ্বস্ পেরোতে হবেনা, এখান থেকে নামতে হবে সোজা নদীগর্ভে, সেখানে সেতু ভেঙে যাওয়ায় কাঠের পাটা ফেলে হয়েছে যাতায়াতের আপৎকালীন ব্যাবস্থা! দেখা পেলাম সেই তিন যুবকের, ওঁরা তখন নদী পেরিয়ে এমুখো। অপেক্ষা করলাম ওঁদের উঠে আসার। উঠে আসতেই গতানুগতিক আলাপ - কোথা থেকে আসছেন? কোথায় যাবেন? বাড়ি কোথায়? – আমি দুর্গাপুরের, ওঁদের জিজ্ঞেস করতে বললেন, 'কলকাতা', সেখানে কোথায় জিজ্ঞেস করে জানলাম, 'কাঁচড়াপাড়া!' বাঙালির এ এক অদ্ভুত রোগ! কল্যাণী থেকে কাকদ্বীপ সব কলকাতা! ভারতের অন্য কোন প্রদেশের মানুষকে এমনটা করতে দেখিনা, ভাগলপুরের লোক যেমন পাটনায় থাকেননা বলে লজ্জা পাননা, তেমনই বেনারস-এর লোকও মুক্ত কন্ঠে বলেন তাঁর শহরের নাম! তবে আমাদের কিসের এত হীনমন্যতা? - উত্তর অজানা! 'পরে দেখা হবে বলে' ওঁদের বিদায় জানিয়ে এগোলাম মন্দির পথে। নদী পেরিয়ে ভাঙাচোরা পাথরে সাজানো সরু পাহাড়ি পথে খানিক উঠেই মহাদেবের মন্দির - ঢুকতেই ডানদিকে পূজারীর বাসগৃহ - লাগোয়া তোরণের মাথায় সিঁদুরলেপা হনুমান মূর্তি, আরও কিছুটা এগোলে পুরনো কিছু নন্দী মূর্তি, ত্রিশূল ও একখানি রঙচঙে তোরণ - তার খিলানে ঝোলানো ঘন্টা, তোরণ পেরিয়েই ডানদিকের প্রায়ান্ধকার গুহায় কল্পেশ্বর শিলাখণ্ড। দর্শন সেরে পূজারীকে দক্ষিণা দিয়ে আর মায়ের জন্য পুজোর ফুল নিয়ে বাইরে এসে বসলাম সাধুদের আখড়ায়। বেশ বৃষ্টি পড়ছে, ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে বসলাম উনুনের আঁচের সামনে। না চাইতেই জুটে গেল এক গেলাস গরম চা, - ভেতো বাঙালির আড্ডা জমল দেবভূমে! ওখানেই আলাপ হল ইয়ান-এর সঙ্গে। বৃষ্টি একটু ধরতেই সাঙ্গ হল সাধুসঙ্গ - ধোঁয়াওঠা মেঘের গলায় মুখ ডুবিয়ে হুড়মুড়িয়ে পা চালালাম। উড়ে যাওয়া মেঘের মতই 'উড়তামনন' পৌঁছে দিল গন্তব্যে। তখনও পশ্চিমী মেঘের জালে উঁকি দিচ্ছে কমলারঙা সুয্যিমামা। ভিজে আলোর ওড়না ধরে ফের বেরোলাম গ্রাম ঘুরতে।
ইচ্ছে ছিল এখান থেকেই বংশীনারায়ণ-ডুমক্ হয়ে চলে যাব রুদ্রনাথ-এ, কিন্তু এ যাত্রায় তা আর হল কই! কাল থেকেই শুরু হচ্ছে এখানের বিয়ের মরশুম - তাই কেউই সঙ্গী হতে রাজি নয়, সাধুরা কেউ ওপথে যাবেন কিনা - খোঁজ নিয়েছি তারও! সেখানেও শুধুই 'না!' হঠাৎ করেই পাহাড় জুড়ে বাদল মেঘের ডানায় চেপে সন্ধ্যে নামে - ডেরায় ফিরি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামে, একান্তে করিডরে চোয়াল চেপে বসে থাকি - চারদিকে অন্ধ-আলো – মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের কাঁপা হাতে ধরা পড়ে পাহাড়ের ফালাফালা রূপ! সন্ধে তখন সাতটা - ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে টর্চ জ্বালিয়ে। কাছে আসতেই বুঝতে পারি 'ইয়ান!' ঠান্ডায় জুবুথুবু, আমাকে দেখে জানতে চায়, এ হোটেলেই উঠেছি কিনা? ভরসা পেয়ে রুম নেয় আমার পাশেই। 'পাওয়ার' নেই, পাশাপাশি চেয়ার টেনে বসি এসে খোলা বারান্দায় - বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝাঁপায় - আমাদের গল্প জমে!
কতরকম প্রশ্ন আসে! - আমি ব্রাহ্মণ কিনা? তাহলে সবার হাতে খাই কি করে? অবিবাহিত জেনেও প্রশ্ন করে, ছেলে-মেয়ে ক'টি? বেশ রাগত স্বরেই বলে উঠি – বিয়ে ছাড়াও সন্তানের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? ও কিন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলে, "আমাদের দেশে তো এমনটা হয়েই থাকে!" বলি, ওই জন্যই তো তুমি-আমি আলাদা দেশের লোক! ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়, বলে – "আমিও বিশ্বাস করি তোমার দেশের ব্যবস্থাটাই ভাল!" খুব অবাক হয় বাড়িতে শুধু মা আর আমি থাকি শুনে! দুঃখ করে বলে - "আমি বিয়ে করার পরে মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখিনি, আর দ্যাখো আজ দশ বছর হল আমার ডিভোর্স হওয়ার পরে আমার স্ত্রীও কোনোদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি!" বেশ লেগেছিল বৃষ্টিভেজা রাতের সেই সাহেবকে! ইয়ান ব্রিটিশ, বয়স ৭৬, কাজ করতেন 'ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ'-এ, - তাই বছরে দুটো 'এয়ারট্যুর'-এ ৫০% ডিসকাউন্ট পান। বেশ কয়েকবারই এসেছেন এ'দেশে। অনেক খারাপের মধ্যেও কোথাও একটা ভালোবাসা জন্মেছে আমার দেশটার প্রতি! চোখ বড়বড় করে বলে - "তোমাদের মধ্যে ডিসিপ্লিনের ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই, কেউ কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করে না, - অথচ অবাক হয়ে দেখি এতবড় দেশটা মোটামুটি ঠিকঠাক-ই চলছে!" শুনে বেশ মজা পাই! ইয়ানের এটা ষষ্ঠ ভারত সফর, পাহাড়ে ওর প্রিয় জায়গা কৌশানি, আর এদেশে ওর প্রিয় শহর মুম্বাই! কাল এখান থেকে ও কৌশানিই যাবে, তারপর মুম্বাই হয়ে দেশে ফেরা। এখানে ও এসেছিল 'ইঞ্জিনিয়র বাবা' নামে এক সাধুর সাথে দেখা করতে। খুব বিস্মিত হয়ে বলে - "জানো, তোমার দেশের একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে!" আমিও বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করি - কি ইয়ান ? বলে - "মুম্বাইয়ের বস্তিতে আমি দেখেছি একই পরিবারের আত্মীয়দের মধ্যে কী তুমুল ঝগড়া, পারলে একে অন্যকে মেরেই ফেলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা একে অপরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেনা, বছরের পর বছর একই সঙ্গে থাকছে! এরপরই ধরা গলায় বলতে শুনি, "আমার চার ছেলে, প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত, অথচ গত পনের বছরে ওরা কেউ একদিনের জন্যও আমার একটা খবর নেয়নি!" মনে মনে বলি, সাহেব এ দেশের ছবিটাও যে অতটা স্পষ্ট নয়! হয়তো বেঁচে থাকার পরিসর যেখানে সংকীর্ণ - হৃদয়ের প্রসারতা সেখানে কিছু বেশিই! নয়তো 'বস্তি'র ছবি 'বসতি'তে এসে অমন পাল্টে যায় কী করে!
পরদিন সকাল হয় ঝকঝকে নীলের মাঝে - হোটেলের দিদির কাছে আখরোটের ছাঁদা নিয়ে আটটাতেই ছেড়ে আসি নেয়ে ওঠা দেবগ্রাম - সঙ্গী ইয়ান। মিনিট দশ হেঁটেই ইয়ান ক্লান্ত বোধ করে - স্যাক কাঁধে হাঁফ ধরছে। ওর স্যাক আমাকে দিতে বলি, কুন্ঠা বোধ করে, বলে - "না না, আমার ব্যাগ আমাকেই বইতে দাও!" ইয়ান আমার পিতৃস্থানীয় - সেটাই ওকে স্মরণ করাই! বলি - আজ তোমার জায়গায় আমার বাবা থাকলে কি তাঁকেও ওই স্যাক বইতে দিতাম? তুমিও তো আমার বাবার বয়সী, আর এটাই আমার দেশের রীতি! ওর দু'চোখ চিকচিক করে ওঠে! লিয়ারি থেকে জিপে ফিরে ইয়ান নেমে যায় হেলাং-এ, দু'হাতে জড়িয়ে বলে,-"আবার দেখা হবে বন্ধু!" জিপ ছেড়ে দেয়, আমি ধরি জোশীমঠের পথ। মন গুনগুন করে – "তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর / সবায়ে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ দেখা যেন সদা পাই।।"
‘হরফ’ নামে একটি প্রিপ্রেস ইউনিট চালান সুমন্ত মিশ্র। হিমালয়ের আতিথ্য গ্রহণ ও ফুটবল খেলার দৃষ্টিসুখ তাঁকে অসীম তৃপ্তি দেয়। ভালোবাসেন রবিঠাকুরের গান শুনতে, প্রবন্ধ পড়তে, ছোটগাছকে বড় করতে, বেড়াতে আর নানারকমের মানুষের সাহচর্য পেতে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ‘আমাদের ছুটি’ কিছু সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে মেলমেশার সুযোগ করে দেওয়ায় আনন্দিত।