সপ্তমন্দিরের দেশে
দেবতোষ ভট্টাচার্য্য
"সব্বোনাশ! এই গরমে!!"
বলেই সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন চ্যাটার্জীদা। জানতুম এই সময় খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে - কারণ চ্যাটার্জীদা ছাড়া ঘুরতে যাওয়ার মজাটাই মাটি। প্ল্যান হচ্ছিল এপ্রিলের শেষে মহাবলীপুরম যাওয়া নিয়ে, কলকাতায় ওঁর বাড়িতে বসেই। কিন্তু এই গরমে ওখানে যাওয়ার কথায় একেবারে বেঁকে বসেছেন তিনি। কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছেনা দেখে ছুঁড়লুম ব্রহ্মাস্ত্র – "গরমে কলকাতার চেয়ে মহাবলীপুরম অনেক ভাল, এখন ভেবে দেখুন বসে বসে সেদ্ধ হবেন কিনা!"
ব্যাঙ্গালোর থেকে মহাবলীপুরম যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হল চেন্নাই গিয়ে সেখান থেকে টানা গাড়ি – তা মোটামুটি আড়াইঘন্টা মত লাগে। আমরা ডবল ডেকার ট্রেনেই যাওয়া ঠিক করলুম, কারণ এই ট্রেনটার কথা আগে অনেক শুনলেও চড়ার সুযোগ হয়নি। ও হ্যাঁ, চ্যাটার্জীদারও একটা টিকিট কাটা হয়েছিল। গাড়ির দুলুনিতে একটু ঢুলুনি মত এসেছে, হঠাৎ তিনি খোঁচা মেরে উঠলেন – "যাচ্ছো তো! মহাবলীপুরমের ইতিহাস কিছু জানা আছে কি?" ঘাড় নেড়ে জানি না বলতেই খুব উৎসাহের সঙ্গে আমায় বোঝাতে শুরু করলেন।
"মহাবলীপুরম জায়গাটা বেশ প্রাচীন হে! আর তেমনি বড়ই রহস্যময়। একসময় খুবই ব্যস্ত বন্দর ছিল এ শহর – সেই টলেমির যুগে এখান থেকে ভারতীয়রা বাণিজ্য করতে যেত সুদূর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। মহাবলীপুরমের মাটি খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা এমন অনেক জিনিস উদ্ধার করেছেন যার বয়স প্রায় দু হাজার বছর – মানে হল গিয়ে খ্রীষ্টাব্দের একদম শুরুর দিক। কেউ কেউ অবশ্য সন্দেহ করেন যে এটি আসলে আরও প্রাচীন। চতুর্থ শতকের চিনা বা রোমান মুদ্রা থেকে এটা পরিষ্কার, পৃথিবীর বহু দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতেন ভারতীয় বণিকরা।
দুঃখের কী জানো, অনেক মুল্যবান জিনিস সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পল্লব রাজাদের সময়, মানে ধরো মোটামুটি তৃতীয় থেকে নবম শতক, মহাবলীপুরম একটি শিল্প সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে সপ্তম শতকের দুই পল্লবরাজ মহেন্দ্রবর্মণ ও তাঁর পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মণের নাম করতেই হয়। মূলতঃ এই অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তিগুলি মহারাজ নরসিংহবর্মণের সময়ই তৈরি।
তবে এই জায়গার নাম কেন মহাবলীপুরম হল তা নিয়ে বেশ মতভেদ আছে। সবচেয়ে প্রচলিত হল - মহা বলবান রাজা বলী, যিনি প্রহ্লাদের প্রপৌত্র ছিলেন, তাঁর নামেই মহাবলীপুরম। মানে এককথায় এ হল মহাবলীর দেশ।" দিব্যি লাগছিল শুনতে। এই বিশাল ভারতবর্ষের ইতিহাস যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনই রোমাঞ্চকর।
প্রায় রাত দশটায় ট্রেন পৌঁছল চেন্নাই। গাড়ি ছুটল চেন্নাই মেরিনা বিচ পেরিয়ে ইষ্টকোস্ট রোড ধরে। মহাবলীপুরমের হোটেল মহাবস-এ যখন পৌঁছলাম তখন আর শরীরে বিশেষ শক্তি ছিল না। ডিনার রেডি করে রাখাই ছিল – খেয়েদেয়ে সোজা বিছানায়। সেই ছোটবেলায় ইতিহাসের পাতায় দেখা ছবিগুলো যে কালকে জীবন্ত হয়ে উঠবে, এই ভেবেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল।
ঐতিহাসিক শহরগুলির যেটা সমস্যা, জনসংখ্যার চাপে ঘিঞ্জি এক শহরে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে তার আকর্ষণটি হারিয়ে ফেলে। সভ্যতার শুরুর দিকের অমূল্য জিনিসগুলোর প্রকৃত মর্যাদা সবাই ঠিক দিতে পারে না। তাই বহু জিনিস হয় হারিয়ে যায় বা অনাদরে নষ্ট হয়ে যায়। এখানে অবশ্য আধুনিক ও প্রাচীন ভারতের এক অদ্ভুত সহাবস্থান লক্ষ্য করা গেল।
গরম সেদিন বেশ ভালই ছিল বলতে হবে। কিন্তু সমুদ্রের হু হু হাওয়ায় কষ্ট তেমন হচ্ছিল না। তবু সকাল সকালই পঞ্চরথ দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হল। প্রথমেই বলে রাখি, এটি পল্লবদের আরও বহু স্থাপত্যকীর্তির মত অসমাপ্ত। প্রধান বিশেষত্ব হল – একটাই পাহাড়ের ন্যায় বিশাল পাথর ওপর থেকে কেটে কেটে এই পাঁচটি মন্দির বানানো, পাঁচটি পাথর নয়। কিন্তু দেখে তা বোঝার যো নেই। শুধু প্রথমটিতেই বিগ্রহের দেখা মেলে – দেবী পার্বতী। এর অনেকটা অংশ সময়ের দাবীতে মাটির নিচে চলে যায়, যা পরে খুঁড়ে উদ্ধার করা হয়েছিল। মন্দিরের চূড়াগুলি অবিকল বৌদ্ধস্তুপের মত। এমনকি পাথরের সিংহের মুখগুলিতে চৈনিক সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। তাই পল্লবদের অন্যান্য কীর্তির চেয়ে এটি একটু অন্যরকমই লাগে।
মন্দিরগুলি অসমাপ্ত হলেও দেখতে কিন্তু ভারী সুন্দর। সত্যি বলতে কী হাজার বছর আগে ভারতীয় কারিগরদের এই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখে চোখে ঘোর লেগে যায় যেন। একটি প্রমাণ সাইজের পাথরের হাতি রয়েছে যা এত স্বাভাবিক যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আরকিওলজিকাল সোসাইটি মন্দিরগুলি পঞ্চপাণ্ডবের নামে নামকরণ করেছে। প্রথমটিতে নারীমূর্তি রয়েছে বলে সেটি দ্রৌপদীর নামে। এছাড়া আছে ভীম, অর্জুন, যুধিষ্ঠির ও নকুল-সহদেব। এখানে বলে রাখা ভাল, পাণ্ডবদের সঙ্গে এগুলির কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই – নিছকই নামকরণ মাত্র। গাইডের কথানুযায়ী, এগুলিতে বিগ্রহ বসিয়ে যাতে পূজার্চনা না শুরু হয়, এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই যাতে এখানে প্রবেশ করতে পারে – সেটিই ছিল নাকি মুখ্য উদ্দেশ্য। এতক্ষণে তপ্ত বালিতে যেন পায়ে ছ্যাঁকা লাগতে শুরু করেছে। ফিরে আসার সময় শোনা গেল, এখনও নাকি মাঝেমধ্যেই খোঁড়াখুঁড়ি চলে। কারণ বিশ্বাস, নিচে আরও অনেক আশ্চর্য লুকিয়ে আছে। থাক না হয় সেসব আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য।
পঞ্চরথের খুব কাছেই রয়েছে ইন্ডিয়ান সী শেল মিউজিয়াম – এটি নাকি এশিয়ার বৃহত্তম সী শেল মিউজিয়াম। অন্তত চল্লিশ হাজার বিভিন্ন আকৃতি ও প্রজাতির শামুক, ঝিনুক ও সামুদ্রিক প্রাণীর দেখা মেলে এখানে। সত্যি বলতে কী, প্রকৃতি যেন দুহাতে মুঠো মুঠো রঙ নিয়ে রাঙিয়েছে তার বড় আদরের প্রাণীকুলকে! আমায় বেশ অবাক করেছে অপূর্ব রামধনুরঙা শামুকগুলো। আর কোণায় রাখা কারুকাজকরা বিশাল শাঁখটি যেন সেই মহাভারতের যুগের পাঞ্চজন্য - কৃষ্ণের হাতেই সে শোভা পায়। এখানে ঝিনুকের পেটের মধ্যে আসল মুক্তো দেখার সৌভাগ্য হল। কয়েকটার আকৃতি তো বেশ বড়।
মিউজিয়ামের দেওয়ালের লেখা দেখা জানা যায় যে এটি রাজা মহম্মদ নামে এক ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে। প্রায় তেত্রিশ বছর ধরে বহু দেশে বিদেশ ঘুরে তিনি এসব সংগ্রহ করেছেন, এবং দান করে গেছেন এই মিউজিয়ামকে। সমুদ্র ও তার সম্পদকে কতখানি ভালবাসলে যে তা করা সম্ভব!
এখান থেকে খানিকটা এগোলে দূর থেকেই চোখে পড়বে লাইটহাউস। মানে নতুন লাইটহাউস। পুরনোটি বহু বছর আগেই পরিত্যক্ত, সেটি মহিষাসুরমর্দিনী গুহার কাছে। যাই হোক টিকিট কেটে চড়া হল ওপরে। শেষ ক'ধাপ সিঁড়ি কিন্তু বেশ সরু ও বিপজ্জনক। একসাথে ওপর নিচ করা একেবারেই অসম্ভব – একদল ওপরে উঠে গেলে তবেই ওপরের দল নিচে নামতে পারে। সমুদ্র এখন বেশ দূরে সরে গিয়েছে বোঝা যায়। ওপরে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া বইছিল, একবার উঠলে আর নামতে ইচ্ছে করে না।
হোটেল মহাবস-এর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালই বলতে হবে। ডিনার টেবিলে চ্যাটার্জীদার ভাবভঙ্গি খুব একটা সুবিধার ঠেকছিল না। এক টুকরো রুটি কায়দা করে পাকিয়ে মুখে পুরে জিজ্ঞেস করলেন – "ল্যান্ড অফ সেভেন প্যাগোডাস" মানে কি বল দেখি? ঠোঁট উলটে বললুম – জানি নে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বোঝাতে শুরু করলেন চ্যাটার্জীদা।
"এখন সমুদ্রের ধারে যেখানে শোর টেম্পল দেখা যায়, সেখানেই আগে নাকি ছিল সাত সাতটা মন্দির। বহু প্রাচীন কাল থেকেই, অন্তত মার্কো পোলোর সময় তো বটেই, ভিনদেশী নাবিকরা এই জায়গাকে চিনতেন সপ্ত মন্দিরের দেশ বলে। বর্তমানে ওই একটি মন্দিরই টিকে আছে। সম্ভবতঃ বাকি সব তলিয়ে গেছে সমুদ্রে। ২০০২ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ওশেনোগ্রাফি এবং বিলেতের সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশন সোসাইটি যৌথ উদ্যোগে সমুদ্র গর্ভে অভিযান চালায়। বোঝা যায় এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যা একসময় শিল্প স্থাপত্যে ভারতের গর্ব ছিল - তা হারিয়ে গেছে সমুদ্র গর্ভে!
যেটুকু জানা যায়, পল্লবরাজ দ্বিতীয় নরসিংহবর্মণ সপ্তম-অষ্টম শতক নাগাদ এর নির্মাণ করেন। বাকীটা চলো কাল নিজের চোখেই দেখবেখন।"
আমাদের হোটেল থেকে সমুদ্র একেবারেই হাঁটাপথ। চারিদিক দেখতে দেখতে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না, বেশ দূর থেকেই চোখে পড়ল মন্দিরের চূড়ো। মন্দিরটি একেবারেই সাগরের কিনারে। সমুদ্রের আগ্রাসন ঠেকাতে প্রচুর বোল্ডার ফেলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই এটি একটি অসাধারণ শিল্পকীর্তি। মন্দিরটির চারিদিক ঘেরা অসংখ্য ষাঁড়ের মূর্তি দিয়ে – যা থেকে সহজেই ধারণা করা যায় এটি দেবাদিদেবের আরাধনার স্থান। মন্দিরের চূড়োটি থাক থাক ভাবে ওপরে উঠে গেছে ঠিক পিরামিডের মত। ষাঁড়ের মূর্তিগুলির বিশেষত্ব হল, প্রতিটির ভঙ্গি আলাদা। এক জায়গায় দেখলুম পাথর কেটে মোষবলির অনুষ্ঠানটি দেখানো হয়েছে নিখুঁত ভাবে। এই মন্দিরটি পুরোপুরি দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলীর মেনে তৈরি হয়নি বোঝা যায়। জীবজন্তুর মুখের গড়ন দেখে চৈনিক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
জমি থেকে প্রায় ছয় ফুট নিচে মন্দিরের চাতাল। বোঝাই যায় অনেকটা মাটি খুঁড়তে হয়েছে। এখানে দুদণ্ড বসলে মন বেশ উদাস হয়ে যায়। আমাদের বহু পুরুষ আগে এই জায়গাটি কত না জমজমাট ছিল, কত লোকের যে স্পর্শ রয়েছে এখানে। কী অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে বানানো এর প্রতিটি অংশ। তাঁরা তখন কি ভেবেছিলেন হাজার বছর পরে লোকে মাটি খুঁড়ে খুঁজে পাবে এ রত্ন ভান্ডার আর মুগ্ধ চোখে শুধু চেয়ে থাকবে। হরপ্পা কোনদিন যাওয়া না হলেও সেখানকার বিখ্যাত জলাধারটির ছবি ভীষণ চেনা। এখানকার জলাধারটি দেখেও অবিকল সেই ছবির মত লাগল। তবে যেটা ভীষণ টানছিল, তা হল জলাধারটির ঠিক মাঝখানে একটি পাথরের যন্ত্র – অবিকল আধুনিক যুগের ভালভের মত দেখতে। তবে কি এটি ফোয়ারা? জানার আজ আর কোনও উপায় নেই।
শোর টেম্পলটি বেশ বড়। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে অনেকটাই সময় লেগে গেল। মন্দিরের পাশেই নীল সমুদ্র, বেশ ভালোই ঢেউ রয়েছে। উত্তাল সমুদ্র, চিকচিকে সোনালি বালি আর আশেপাশের মেলার পরিবেশ ভীষণভাবে পুরীর সমুদ্রকে মনে করিয়ে দেয়। পাড়ে বসে ঢেউ গুনেই দিব্যি সময় কেটে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়েও কোনও নৌকা বা জাহাজ অবশ্য চোখে পড়ল না। আশেপাশে অনেক সীফু্ডের রেষ্টুরেণ্ট আছে। তার অনেকগুলিতেই বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা – এখানে হাঙর পাওয়া যায়। হাসি পায়, জলে হাঙর মানুষ খায় আর ডাঙায় মানুষ ওদের। ও হ্যাঁ, সুযোগ বুঝে সমুদ্দুর চ্যাটার্জীদার চটি নিয়ে পালিয়েছিল। আবার একটু পরে ফিরিয়েও দিয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলতে শুনলুম – সমুদ্র কিছুই নেয় না, সব ফিরিয়ে দেয় বলেই তো জানি। বাকি মন্দিরগুলোও যদি ফিরিয়ে দেয় কোনদিন!
দুপুরের খাওয়া সেরে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন দেখতে চললাম। এটিই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট যা রাস্তা থেকেই বিনা পয়সায় দিব্যি দেখা যায়। খাড়া পাহাড়ের গা কেটে কেটে তৈরী করা এই অপরূপ শিল্পকর্মের জুড়ি মেলা ভার। একমাত্র অজন্তা ইলোরাই বোধহয় পাল্লা দিতে পারে। এখানে গঙ্গার মর্ত্যে আগমনের পৌরাণিক কাহিনীটি বর্ণনা করা হয়েছে। পাশে তপস্যারত অর্জুনেরও মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। তবে ভীষণ সুন্দর লাগল হাতির দলটি – এর মধ্যে বাচ্চা হাতিসহ সুখী হস্তীপরিবারও চোখে পড়ল। কালো ভয়ঙ্কর শক্ত এই গ্র্যানাইট পাথর কুঁদে কুঁদে মূর্তিগুলি কি নিখুঁত ভাবেই না বানানো। ও হ্যাঁ, একটি বাচ্চা সহ হনুমানের পাথরের মূর্তিও রয়েছে পাশেই – আর একজন মায়ের মাথার পোকা বাছছে মনে হল। এত বছর পরেও প্রত্যেকের মুখভঙ্গি সহজেই চেনা যায়। পিছনে কানে এল চ্যাটার্জীদার উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি –
কত শত মাইকেল এঞ্জেলো
একদা এই ভারতবর্ষে ছেলো।
ফিরে তাকাতেই হেসে ফেললেন ফিক করে। ভাবলুম, কবি বৈকুণ্ঠ মল্লিক মোটেও কিছু ভুল বলেননি।
এখান থেকে বাঁয়ে তাকাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। বিশাল এক পাথর প্রায় ঝুলছে পাহাড়ের কিনারায়। জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, পাথরটির এই আকৃতির জন্য এর নাম হয়েছে কৃষ্ণের মাখনের ডেলা। বিপজ্জনক অবস্থানের জন্য বহুবার এটিকে নিচে গড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। হাতী দিয়ে ঠেলেও কোন লাভ হয়নি – মাখনের ঢেলা গড়িয়ে পড়েনি। সাবধানে ওপরে উঠে পরীক্ষা করেও ঠিক বোঝা গেলনা কিভাবে এটি বছরের পর বছর ধরে এভাবে ঝুলছে।
এর পাশেই রয়েছ বরাহ মন্ডপ। যথারীতি পাথরের কাজ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ভিতরের পাথরের দেওয়ালগুলি কেটে কেটে বিভিন্ন মূর্তির মাধ্যমে নানা পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত আছে। বরাহরূপী বিষ্ণু এবং দুর্গামূর্তি দুটি এককথায় অপূর্ব।
তবে যেটির কথা না বললেই নয় সেটি হল গোবর্ধন মণ্ডপ। তপস্যারত অর্জুনের পাশেই এটি। ভিতরে গেলেই চোখে পড়বে পাথর কেটে দেওয়ালে বানানো হয়েছে কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত কড়ে আঙুলে তুলে ধরার ঘটনাটি। পাহাড়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছে বৃন্দাবনবাসী। এক গাভীর দুধ দোয়ান হচ্ছে, পাশেই দাঁড়িয়ে তার ছোট্ট বাছুরটি – অন্য সব দেওয়াল মূর্তিই যেন এর কাছে তুচ্ছ। কী স্বাভাবিক তাদের ভঙ্গিমা, কি সরল চোখের চাউনি। আসলে এখানকার প্রতিটি মণ্ডপই একটা বিশাল পাথর কেটে বানানো। মাঝে মাঝে পাথরের থাম পুরো ওপরের ওজনটি ধরে রেখেছে। হাজারের ওপর বয়স হলেও সবই প্রায় একইরকম ও অক্ষত রয়েছে বলা যায়।
পরের দিন সবারই একটু স্বাদ বদলের ইচ্ছে জাগল। শুনেছিলাম মহাবলীপুরমের অদূরেই আছে একটি নামকরা কুমীর পার্ক, ভাবলুম ঘুরেই আসা যাক। ইস্ট কোস্ট রোডের ওপরই এই পার্কটি বানিয়েছিলেন রোমিউলাস হোইটকর, ১৯৭৬ সালে। প্রায় আট একর জায়গায় নানা প্রজাতির কুমীর, কচ্ছপ ও সাপ পালন করা হয়। সাপের বিষ সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই গরমের সময় তাদের প্রজননকাল বলে সেটি বন্ধ। বিশাল বিশাল পোষ্টার চতুর্দিকে – পড়লে জানা যায় এদের খাদ্যাভাস, জীবনশৈলী ও আরও নানা অজানা কথা। এক জায়গায় লেখা রয়েছে – বাচ্চা বেরনোর সময় নাকি কুমীর ডিম মুখে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, আর তাতেই ডিম ফেটে কুমীর ছানা বেরিয়ে পড়ে। মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম তো অনেক দেখা, এখানে এলে দেখা যাবে কুমীরের অ্যাকোয়ারিয়াম। অনেক বিদেশি প্রজাতির সরীসৃপও আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইগুয়ানা – বাবাজী মনে হল ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে হাসছে। একটি কড়ে আঙুল সমান কচ্ছপও আছে কাঁচের ঘেরা জায়গায়, গায়ে তার অপরূপ কারুকার্য।
ফেরার পথে পড়ল টাইগার কেভ, একেবারে সমুদ্রের পাড়েই এটি। চতুর্দিকে বাঘের মুখ – আকৃতি দেখে বোঝাই যায় দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যের সঙ্গে বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে। কেন এই ধূ ধূ প্রান্তরে এই একটিমাত্র গুহা বানান হয়েছে, তার উত্তর জানা আজ আর সম্ভব নয়। কয়েক ফুট গভীর গর্ত দেখে পরিষ্কার যে মাটি খুঁড়ে এটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কি নিচে আরো কিছু আছে? নাকি পল্লবদের কোন বৃহৎ প্ল্যানের অংশ ছিল এটি – যা দুর্ভাগ্যবশতঃ অসমাপ্ত রয়ে গেছে!
মহিষাসুরমর্দিনী মণ্ডপটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। পাশের সমুদ্রের ঢেউয়ে কিছুক্ষণ পা ভিজিয়ে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়লুম দেখতে। বেশ খানিকটা পাথরের সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় এখানে। মহিষাসুরমর্দিনী মণ্ডপের দেওয়ালের দুটি কীর্তির কথা উল্লেখ করতেই হয় – একটি মা দুর্গার মহিষাসুর বধ ও অপরটি বিষ্ণুর অনন্তশয্যা। এর মধ্যে সিংহের পিঠে রণরঙ্গিনী দুর্গার কাজটি বেশ জটিল। মহিষের মুখ বসানো অসুরটিকে যেভাবে পাথর কুঁদে বানানো হয়েছে, তা বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে।
সাধারণতঃ দক্ষিণ ভারতীয় দেবদেবীর নাম ও মূর্তিগুলি বেশ অন্যরকম হয়, কিন্তু পল্লবদের মণ্ডপগুলিতে যে মূর্তি দেখলাম তা আমাদের বিশেষ পরিচিত। বিষ্ণুর অনন্তশয্যা দক্ষিণ ভারতের আর কোথাও পাওয়া যায় কিনা আমার জানা নেই। দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার অন্যান্য প্রাচীন সৃষ্টির সঙ্গে এখানেই বেশ অমিল। এমনকি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাও কোথাও কোথাও উপস্থিত, যা বেশ অবাক করে। আর্য, দ্রাবিড়ীয় এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির এক আশ্চর্য মেলবন্ধন প্রত্যক্ষ করা যায় এখানে।
পরের দিন ফিরে আসার পালা। চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে বসে বসে ভাবছিলুম – ছোটবেলায় পড়া ইতিহাস বইটা একবার খুঁজে দেখলে হয়! তখন ছিল শুধুই মুখস্ত করে যাওয়া, কিন্তু চোখের সামনে এই অসাধারণ কীর্তিগুলি দেখতে দেখতে চোল পল্লবদের ইতিহাস একবার ঝালিয়ে নিলে মন্দ হয় না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ চোলরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্ব ছিল কর্ণাটকে, তিনি সারাজীবন যুদ্ধ করে রাজত্ব বিস্তার করে গেছেন। তাঁর নজর পরে পল্লবদের ওপর। পল্লবরাজ মহেন্দ্রবর্মণ যুদ্ধে হেরে গেলেও পুলকেশী রাজধানী কাঞ্চীপুরম দখল করতে পারেননি। প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীণ হয়ে ফিরে যেতে হয় তাঁকে। মহেন্দ্রবর্মনের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন প্রথম নরসিংহবর্মণ। তিনি ছিলেন বীর যোদ্ধা, পিতা মহেন্দ্রবর্মনের পরাজয় তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। পল্লব রাজ্যের বাড়বাড়ন্ত দেখে একদিন আবার আক্রমণ করে বসলেন দ্বিতীয় পুলকেশী। কিন্তু একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। শেষে স্বয়ং নরসিংহবর্মণ যুদ্ধে হত্যা করেন পুলকেশীকে। ইতিহাসে তা বিখ্যাত হয়ে আছে বাতাপীর যুদ্ধ নামে। কথিত আছে, বিজয়ী নরসিংহবর্মণ নাকি চোলরাজ্য থেকে ধরে নিয়ে আসেন শিল্পীদের – তাঁরাই বানিয়েছেন মহাবলীপুরমের এই কালজয়ী অপরূপ কীর্তিগুলি।
শতাব্দী এক্সপ্রেসে জানলার ধারের সীটটি বাগিয়ে চ্যাটার্জীদা বললেন – এ যেন সেই সত্যযুগে আবার ফিরে যাওয়া হে! না এলে সত্যিই খুব মিস করতুম!!
প্রবাসী বাঙালি দেবতোষ ভট্টাচার্য কর্মসূত্রে আজ বহু বছর বাঙ্গালোরের বাসিন্দা। ফটোগ্রাফির প্রবল নেশা - আর এই নেশার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায়ই তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয় ঘর ছেড়ে। অবসর সময়ে অল্পবিস্তর লেখালেখির বদভ্যাস থাকলেও, 'আমাদের ছুটি'তেই প্রথম ভ্রমণকাহিনি লেখা তাঁর। লেখার মাধ্যমে যদি একবার বেড়াবার নেশাটি কাউকে ধরিয়ে দেওয়া যায় তবে সেটাই হবে তাঁর মস্ত পাওয়া।