বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

সিকিয়াঝোড়ার অন্দরে

তরুণ প্রামানিক

~ সিকিয়াঝোড়া ইকো পার্কের আরও ছবি ~

ডুয়ার্স মানে গহন বনানীর অপার নির্জনতার কুহকে ঢাকা মায়াবী চুপকথা। ডুয়ার্স মানে ঝকঝকে নীলাকাশের নিচে হলদেটে সবজে চায়ের বাগানের গালিচা আর নীলচে পাহাড়ের হাতছানি। হ্যামিলটনের বাঁশিওয়ালার মতো শান্ত ও স্নিগ্ধ সে। আজ আমার ঝুলিতে গজরাজের পিঠে চেপে বন্য শ্বাপদে ভরা অসূর্যম্পশ্যা অরণ্যের গভীরে অবাধ বিচরণ নয়, বরং এক অন্য অচেনা ডুয়ার্সের গল্প।
হেমন্তের বিদায় বেলায় বাতাসে সদ্য হিমেল ছোয়া। উচাটন মন ছুটে চলেছে দূরের নীলচে পাহাড়ের সিল্যুয়েটে চোখে রেখে সিকিয়াঝোড়া ইকো পার্কের পথে। হাসিমারা স্টেশন থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে, ভৌগোলিক অবস্থান গত বিচারে এটি আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তর পানিয়ালগুড়িতে অবস্থিত। সিকিয়াঝোড়া একটা পাহাড়ি নদী - বক্সা জঙ্গলের পূর্ব দিকে দমনপুর রেঞ্জ আর পশ্চিম দিকে বক্সা টাইগার রিজার্ভ-এর মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চুপিচুপি বয়ে গেছে জঙ্গলের একদম গভীরে। বেশ কয়েক কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বালা নদীতে। স্থানীয় মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত একটা সেলফ হেল্প গ্রুপ নদীপথে জঙ্গলের অপার সৌন্দর্য আর অ্যাডভেঞ্চারের মজা নিতে ব্যবস্থা করেছে নৌকা সাফারির। বক্সা জঙ্গলের গভীরে পায়ে হেঁটে যেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়, এই নৌকা বিহারে সেখানে পৌঁছানো যায় অনায়াসে। ডুয়ার্সের আমাজন হিসাবে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে রোমাঞ্চকর এই সফর।


টিকিট কেটে নৌকোয় উঠে বসলাম চার বন্ধু মিলে খাঁড়িপথে নৌকা সাফারিতে আমাজনের রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে। টলটলে নদীর স্বচ্ছ জল, দুধারে বাদাবনের মতো ঘন বন দুপাশে রেখে এঁকে বেঁকে খাড়ির মত বয়ে গেছে গভীরে। এক অজানা রোমাঞ্চে মন নেচে উঠল। ছলাৎ ছল মাঝির দাঁড় বাওয়ার আওয়াজ সেই রোমাঞ্চকে বাড়িয়ে দিল হাজারগুণ। চারপাশে জারুল, পানিয়াল, চিকরাশ, পানিসাজ, কদম, লালি আর নাম না জানা অজস্র গাছের সারি। খানিক এগোতেই শাপলা পাতায় জলফড়িং-এর লাফালাফি দেখে মনের আতঙ্ক খানিকটা প্রশমিত হল। আসলে অচেনা জায়গায় চেনা জিনিসের দেখা মিললে বাঙালি মনে খানিক স্বস্তি জাগে। নৌকা বামদিকে বাঁক ঘুরতেই সকালের নরম রোদটা হঠাৎ করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম জঙ্গলের আরও গভীরে প্রবেশ করেছি। কুয়াশা জড়ানো শীতের সকালে নদীপথে গহীন জঙ্গলে সূর্য বড় অভিমানী। ঝিমধরা কুয়াশা ঘনিয়েছে নদীর বুক জুড়ে। সেই কুয়াশা পেরিয়ে হিলহিলে হাওয়া এসে নদীর অন্যপাড়ের গল্প বলে। কত রকম পাখির ডাক কানে আসে। কতক বুঝি, বেশির ভাগটাই বুঝিনা। জলে ভেসে থাকা পানকৌড়ি নীরবতা ভঙ্গ করে ঝটপট করে উড়ে যায় দূরে। আস্তে আস্তে বয়ে চলেছি আমরা ক্লোরোফিলের গন্ধ গায়ে মেখে সবুজ, আরও সবুজের গভীরে। মাথার উপর সুনীল শামিয়ানা, নিস্তব্ধ সকালে নিঃসঙ্গ চিল আর একঝাঁক সবজে টিয়ার ওড়াউড়ি। প্রকৃতি এখানে বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। মেঘ আর পাখিদের দল সেই বাতাসের ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায়। একটা ভালোলাগার আবেশ গ্রাস করে ক্রমশ। কী নিবিড় শান্তি! অনাবিল সেই প্রশান্তিতে মন ভরে যায়।


সহসা একটা বাঁক ঘুরতেই মনে হল জঙ্গলের বাদাবনের ফাঁক দিয়ে কারা যেন অনেকক্ষণ থেকে অনুসরণ করে চলেছে আমাদের। মুখ তুলে দেখলাম দুপাশ থেকে বড়বড় ডাল নুইয়ে নদীর মাঝখান অবধি চলে এসেছে। সেই ডালের ছোঁয়া বাচিয়ে এঁকেবেঁকে কোনোমতে চলেছি আমরা। গাছের ডালে মাঝে মাঝেই নাকি পেঁচিয়ে থাকে ছোট বড়ো সব সাপ। শুনলাম প্রায়ই নাকি নদীতে জল খেতে আসে বন্য জন্তুরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে। মাঝি আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তর্জনী উঁচিয়ে দেখাল কালকেই একদল দানবাকার দাঁতালের দল সার বেঁধে ঢুকেছে নদীর এপাড়ে। তাদের পায়ের চাপে ভেজামাটির গর্ত আর আশেপাশের ধ্বংসের ছবি প্রত্যক্ষ করলাম। মুহূর্তেই হাতপা ঠান্ডা হয়ে এলো, মাঝির নির্দেশে সবাই চুপ। শুধু নিঃশ্বাস আর বুকের ধড়ফড়ানির আওয়াজ। স্বচ্ছ নদীর জলের নীচে জলজ অর্কিড সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠছে। দুইহাতে গাছের ডাল, লতাপাতা সরাতে সরাতে মূল নদীর ধারের এক গভীর খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে পাড়ে এসে নৌকা আটকে গেল। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নেবে মাঝিরা। দিনের এই সময়টাতেও এখানে যেন জমাটবাঁধা অন্ধকার। চারধারে বড় বড় গাছ থেকে জটার মতো শিকড় নেমে এসেছে নীচে। জঙ্গলের বুনো গন্ধ নাকে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। মাঝির হাজার বারণ সত্ত্বেও আমার দুই বন্ধু নৌকা থেকে লাফ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল ফটোগ্রাফির নেশাতে। নৌকার ওপর বসে বসেই দুচোখ মেলে উপলব্ধি করলাম অসূর্যম্পশ্যা এই জঙ্গলের শিহরণ জাগানো রূপ, মাটির সোঁদা গন্ধ। কানপেতে শুনলাম পাতার মর্মর ধ্বনি, শন শন বেগে বাতাস বওয়ার ছন্দ, ঝিঁঝিঁ পোকাদের বিরামহীন কোরাস।
ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগল না। ঊর্ধ্বশ্বাসে হটাৎ ছুটে এল দুই ফটোগ্রাফার বন্ধু। পোশাকে কাদার দাগ, রক্তবর্ণ চোখ, মুখে আতঙ্কের ছাপ। পড়িমরি করে উঠে বসল নৌকাতে। দুহাত দিয়ে কী যেন বলতে চেষ্টা করল মাঝিকে! মাঝি কী বুঝল জানি না। বিদ্যুৎবেগে নৌকা বার করল ওই খাঁড়ি থেকে। একটা চাপা আতঙ্কে তারও ঠোঁট দুটো কাঁপছে। বাকরুদ্ধ আমরা সবাই। খানিকটা ঘোলাটে জলের পথ পিছনে ফেলে রেখে পুনরায় পিছন ফিরে দেখি জঙ্গলের বড় বড় গাছগুলো ঝড়ের মতো জোরে জোরে দুলছে, মনে হল কোনো অতিকায় দানব যেন পিঠ দিয়ে গাছগুলোতে গা ঘসছে। সোল্লাস বৃংহণ পাতায় পাতায় ধাক্কা খেয়ে জঙ্গলের গভীরে হিল্লোল তুলল।
খাঁড়ির থেকে বেরিয়ে আসতে ভয়টা কেটে গেল। জলজঙ্গলের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার স্বাদ-গন্ধ নিয়ে ফিরে এলাম পাড়ে।

~ সিকিয়াঝোড়া ইকো পার্কের আরও ছবি ~


বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তরুণ প্রামানিক একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ, প্রকৃতির মাঝে খুঁজে বেড়ান জীবনের অপার বিস্ময়কে। সৃষ্টির রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের বৈচিত্র্যকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন এভাবেই।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

পাটনিটপ - পন্ড অফ দ্য প্রিন্সেস

স্বাতী চক্রবর্তী

"কখন সময় আসে জীবন মুচকি হাসে ঠিক যেন পরে পাওয়া চোদ্দ আনা" - কবীর সুমনের এই গানটাই সেদিন যেন এক লহমায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। মার্চ ২০১৫-র রবিবাসরীয় দুপুর। কাকুর ফোন…..বাবা চেঁচাচ্ছে "কাশ্মীর যাবি? পিঙ্কি সন্তোষ যাচ্ছে, সঙ্গে কাকু। রাতের মধ্যে জানাতে হবে।" কতদিনের সাধ! ভাবতে হয় নাকি? আমি তো এক পায়ে খাড়া। আমার বন্ধু ঝুমাও রাজী। এরপর পঁয়তাল্লিশ দিন কীভাবে যেন কেটে গেল। কাশ্মীরের বৃষ্টি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি নানারকম মানসিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গতেবাঁধা প্রাত্যহিকতাকে ফেলে রেখে। সফরসঙ্গী কাকু, খুড়তুতো বোন পিঙ্কি, ভগ্নীপতি সন্তোষ ও ঝুমা এবং আরও কয়েকটি পরিবার। সন্তোষের দাদা স্থানীয় সৌরভ দাস কানুনগোর ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় ২৭ এপ্রিল, ২০১৫।

প্রথমে অমৃতসরে নেমে সকাল থেকে রাত জালিয়ানওয়ালাবাগ, ওয়াঘা বর্ডার, স্বর্ণমন্দির ইত্যাদি চক্কর মেরে রাতে জম্মুগামী ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছি। মেঘের ডাকে ঘুম ভাঙল। মনটা কেমন অস্থির। তবে কি আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ দানা বাঁধতে চলেছে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পুনরায় ঘুমের দেশে। মেঘাচ্ছন্ন সকালে জম্মু পৌঁছলাম। জম্মু স্টেশন থেকে সবে বেরিয়েছি লটবহরসহ, গাড়ির কাছে যাওয়ার আগেই চারদিক থেকে ধেয়ে এল ঝোড়ো হাওয়া আর ধূলিকণার সাদর অভ্যর্থনা। তারপরেই হইহই করে এসে গেল বৃষ্টি। শুরু হল কাশ্মীর ভ্রমণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি পাহাড়ি পথে। প্রথম গন্তব্য ছিল পাটনিটপ হিল স্টেশন। আজ শুধু সেই পাটনিটপ-এর স্মৃতিচারণ।

যত উঠছি বৃষ্টির তীব্রতা তত বেড়ে চলছে। পাহাড়ি পথে বাঁকে বাঁকে রহস্যময়তা সঙ্গে বৃষ্টি, সামনের গাড়ির হঠাৎ ব্রেকডাউন, রাস্তার ধ্বস বিভিন্ন প্রতিকূলতায় আমাদের গাড়ির গতি ক্রমশ কমতে কমতে কখনও একেবারেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মনে পড়ছে ঠিক আগের সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরের ভয়ঙ্কর বন্যার কথা। অজানা আশঙ্কায় এই প্রথম একটু ভাবনা হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ছুটছে কিন্ত গাড়ি থমকে। তা বলে প্রকৃতি তো থমকে নেই। সে তার নিজরূপে বিরাজিত, সে তার খামখেয়ালিপনা আর নিজ মর্জিমত চলে আসছে সৃষ্টির সেই আদি মুহূর্ত থেকে। এবার যে যার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কে কতটা উপভোগ করবে তার অপার সৌন্দর্য বা বন্য বোহেমিয়ানা কিংবা সীমাহীন ঔদ্ধত্য। যেমন এই মুহূর্তে আমি খানিক ম্রিয়মাণ। একটুখানি পাহাড়ি বৃষ্টিতে চুপসে গেল আমার মনের ভেতরে উড়তে থাকা অ্যাভেঞ্চারের ফানুস! মনে হতেই নিজেকে বেশটি করে বকে দিলাম, এতই যদি ভয় তবে ঘটা করে আসার দরকার কী ছিল বাপু? তাই চিন্তা ভাবনা ছেড়ে মন দিলাম চারপাশে।

ইতিমধ্যে উঠে এসেছি হাজারখানেক মিটার। ওই তো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে অনতিদূরে। উড়ে উড়ে ছুটে চলেছে এ পাহাড় থেকে সে পাহাড়। বরফের মুকুটে ধাক্কা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড় চূড়ায়। বিস্তীর্ণ বনরাশি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের আপাত নিরীহ গাম্ভীর্যে। বৃষ্টিস্নাতা পাহাড়ি পথ কুহকের মত ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে পাইনের হাত ধরে। "এসে গেছি প্রায়। বাইরে কিন্ত বেশ ঠান্ডা। শীতের পোষাক হাতের কাছে রাখুন।" আমাদের ট্যুর নির্দেশক সৌরভের কথায় সম্বিত ফিরল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের কোলে ঝুলে থাকা আমাদের হোটেল। তখন বোধকরি মনটাও আনচান করছে হোটেলে একটু বিশ্রামের জন্য। ক্লান্তও বটে। ও মা! সেই বাকি পথটুকু পেরোতেও ঘন্টাখানেকের বেশি লাগল। কিন্তু খুব উপভোগ্য সেই পথ।

অবশেষে দুপুরের নির্ধারিত সময় পেছনে ফেলে বিকেল পাঁচটায় হোটেলে ঢুকলাম। চারদিক মেঘের চাদরে ঢাকা। প্রায় অন্ধকার। বাইরে বেরনোর উপায় নেই। বিদ্যুৎ নেই। ঝড়বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত পাটনিটপ। কী আর করা যাবে, আপাদমস্তক শীতের পোষাকে ঢেকে জমিয়ে সবে বসেছি, একটু গল্পটল্প করার অছিলায়। হঠাৎই মনে হল বাইরে একটা আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। এক লাফে ব্যালকনি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের পেছন দিকে আসতে আসতে আলো ফুটছে।

তারপরই আলোর ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে ধীরে ধীরে ক্রমশ দৃশ্যমান সূর্যদেব। মনে হচ্ছে পাহাড়ের মাথায় কেউ বসিয়ে দিয়ে গেল এক দ্যুতিময় হীরে। কী নয়নাভিরাম সেই দৃশ্য। মেঘের চাদর সরিয়ে বেরিয়ে এল শেষ বিকেলের অস্তগামী সূর্য।

আর আমাদের পায় কে? দুদ্দাড় করে সবাই বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। হোটেলের ঠিক বাইরেই আর্মি কোয়ার্টার ডানদিকে রেখে গিয়ে দাঁড়ালাম এক ভিউ পয়েন্টে। আহা! কী অপরূপ সেই দৃশ্য! পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ আর বরফের আলিঙ্গন আর অস্তগামী সূর্যের রঙিন বিচ্ছুরণ।


ফটো তুলতে গিয়ে বেখেয়ালে চলে গিয়েছিলাম একদম কিনারে, এক পা এগোলেই খাদ। এক সেনা অফিসারের হুঁশিয়ারিতে সম্বিত ফিরল। তখনই চোখে পড়ল খাঁজে খাঁজে মোড়ে মোড়ে আমাদের জওয়ানরা। ওই অফিসারের সঙ্গে সন্তোষ আলাপ করল। একজন বাঙালি জওয়ানের সঙ্গে আলাপ হল। কৃষ্ণনগরের ছেলেটির সঙ্গে আড্ডা জমে উঠল। তারপর তার ডাক পড়ল, আর আমরাও বেরিয়ে পড়লাম চড়াই উতরাই পথে। ২০২৪ মিটার (৬৬৪০ ফুট) উচ্চতায় হিমালয়ের শিবালিক পর্বতের হিল স্টেশন, চিনাব নদী বয়ে চলেছে কাছেই - পাটনিটপ মন জয় করে নিল আমাদের। পাটনিটপ অথাৎ 'পাতন দা তালাব' / 'পন্ড অফ দ্য প্রিন্সেস।' নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও স্কিইং, ট্রেকিং, প্যারাগ্লাইডিং এর মত অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্যেও ট্যুরিস্টের কাছে আকর্ষণীয়। নাগ টেম্পল, সানাসার, নাথাটপ, শিব মন্দির, মাথাটপ-এর ন্যায় অনেক জায়গা আছে দেখার মতো। হাতে সময় থাকলে ঘোরা যেতেই পারে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল শীতকালে তুষারপাত আর গরমকালে বৃষ্টিতে সময় অসময় যখন তখন হাইওয়ে বন্ধ হয়ে যায় তাই পথে বা হোটেলে বন্দি থাকা ছাড়া গতি নেই। আমাদের ওপর ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন আমরা রোদ, বৃষ্টি, তুষার সব পেলেও বেড়ানোর সময়ের সামান্য পরিবর্তন ছাড়া কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হইনি।

কিছুক্ষণ পরই আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। চাঁদের আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। ঘুরে টুরে হোটেলে ঢোকার আগে দেখা হল একটু আগে আলাপ হওয়া সেই জওয়ান ভাই-এর সঙ্গে, সঙ্গে আরও একজন জওয়ান। সেও বাঙালি, বাড়ি তারকেশ্বর। সত্যি বলতে কী ওই পরিবেশে বাড়ির নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে অতদূরে বসে আমরা সবাই যেন পারিবারিক পুনর্মিলনের আনন্দ উপভোগ করলাম। কী আশ্চর্য! এবার হোটেল ফিরতে হবে। তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে।

সকালে উঠে সূর্যোদয় দেখতে গেলাম। চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। ধীরে ধীরে কুয়াশা সরে গেল। সোনাঝরা রোদে চারদিক ঝলমল করে উঠল।

আমরা বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছি চারদিকে টহল দিচ্ছে ভারতীয় জওয়ানেরা। ওঁরাই বললেন তাড়াতাড়ি বেরতে, কারণ রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। এও বলে দিলেন শ্রীনগর পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বেরোবেন। আমরা তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠলাম। তার আগে দেখা করে এলাম ওই দুই বাঙালি জওয়ানের এর সঙ্গে। ওরাও তৈরি। ডিউটিতে বেরোচ্ছে। হাত নেড়ে গাড়িতে উঠল। ভাল থাকিস ভাই। ভাল থেকো পাটনিটপ। পাটনিটপকে পেছনে ফেলে রেখে এগিয়ে গেলাম শ্রীনগরের পথে।

 

কলকাতার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন স্বাতী চক্রবর্তী। দৈনন্দিনতায় হাঁপিয়ে উঠলে কোথাও বেরিয়ে পড়েন সুযোগ পেলে। আর তা না হলে মানসভ্রমণ, বিভিন্ন ভ্রমণ ম্যাগাজিন, ট্রাভেল ওয়েবপেজ-এর সঙ্গে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher