ধান্যকুড়িয়ার সন্ধানে

অভিজিৎ চ্যাটার্জী


~ ধান্যকুড়িয়ার আরও ছবি ~

সুমিত্রর ফোন : "কি রে কাল সকালে যাবি নাকি ? এই কাছেই।"
আশ্চর্য হয়ে বলি : "কোথায় রে?"
একটু ঝাঁজের সঙ্গে সুমিত্র বলল : "গেলেই দেখতে পাবি, ব্যাটা।"
"আমি আর তুই?" জানতে চাই।
" হুঁ! হুঁ! তোর জন্য সারপ্রাইজও থাকবে।" সুমিত্র বলল।
সুমিত্র আমার স্কুলের বন্ধু, ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল। একটু টেনশন যে হচ্ছিল না, তা বলব না। কী জানি কী সারপ্রাইজ দেবে!
সকাল বেলায় বাড়ির তলায় গাড়ির হর্ন!! সুমিত্র হাজির, তখন কটা বাজে...৭ টা হবে।
গাড়ির দরজা খুলে অবাক - আরে রণজিৎ বসে আছে!
সুমিত্রর মুখে মিটি মিটি হাসি, কি রে সারপ্রাইজটা কেমন হল ??
স্কুলের বন্ধু আমরা। একসঙ্গে কত শৈশবের দিন কাটিয়েছি, সেইসব গল্প করতে করতে, বারাসাত থেকে টাকি রোড ধরে এগিয়ে চললাম বসিরহাটের দিকে।

দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা ছাড়িয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল, ইউরোপিয়ান স্টাইলে তৈরি একটি সিংহদরজা - দুটি স্তম্ভ আছে তাতে - মাঝের আর্চে গ্রীকদেবতা যুদ্ধে রত সিংহের সঙ্গে। রণজিতের অবজারভেশন খুব ভালো। বলল - ভালো করে দেখ, সিংহ মূর্তি দুটো-ই কিন্তু কীরকম লড়াইয়ের মুডে - ইউরোপিয়ান স্টাইলে তৈরি।
সাইনবোর্ড চোখে পড়ল," No Entry Without Permission"। একটা অনাথ আশ্রমের নোটিশ বোর্ডও টাঙানো।
"কী রে, কী করব? ঢুকব?"
সুমিত্রর সপাট উত্তর : "চল না। আমরা কি জঙ্গি?"
আমাদের ঢুকতে দেখে দুজন এগিয়ে এলেন, "কোথায় যাবেন? এখানে তো ঢোকা বারণ।"
সুমিত্র আর রণজিৎ চোখের নিমেষে ম্যানেজ করে নিল তাঁদের। কিন্তু বেশি সময় কাটানো যাবে না বলে দিলেন।
দু'পা এগোতেই চোখে পড়ল ইংরেজদের দুর্গের আকারে এক বিশাল বাড়ি! সামনের পুকুরে তার প্রতিচ্ছবি পড়েছে।
আরে, আমরা কোথায় এসেছি এখনও তো আপনাদের জানানোই হয়নি।
ঠিকই ধরেছেন জায়গাটার নাম 'ধান্যকুড়িয়া'। বসিরহাটের কাছে একটি ছোট জায়গা। এখানে ছড়িয়ে আছে ইউরোপীয় ঘরানায় তৈরি প্রাচীন কিছু জমিদার বাড়ি।
রণজিৎ বলে উঠল আরে, এতো "উইক-এন্ডের আরশিনগর।"

এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটি স্থানীয় গাইন পরিবারের বাগানবাড়ি। বহুপূর্বে এখানকার জমিদার ছিলেন গাইনরা। এই বাড়িটিকে তাঁদের গ্রীষ্মকালীন আবাস হিসাবে ব্যবহার করতেন। প্রায় দুশো বছর আগে গাইনদের জমিদারি গড়ে ওঠে গোবিন্দচন্দ্র গাইনের হাত ধরে, তাঁর অতীত নিবাস ছিল কলসুর-এ। বাংলায় তখন ব্রিটিশরাজ, পাট শিল্পের রমরমা, ব্রিটিশদের সঙ্গে ব্যবসা করে গোবিন্দচন্দ্র প্রভূত অর্থসম্পত্তি করেন। এই ব্যবসা আরও লাভের মুখ দেখতে শুরু করে তাঁর সুযোগ্য পুত্রদের হাত ধরে। তাঁরা হলেন - ক্ষীরোধর, নফরচন্দ্র, মহেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার। গাইন পরিবারের জমিদারি ছড়িয়ে পড়ে উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন জায়গায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জমিদার মহেন্দ্রনাথ গাইন এটি তৈরি করেন। যদিও বাড়িটি সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেননি এই পরিবার। থাকাও হয়ে ওঠেনি তাঁদের। কারণটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে ইতালীয় মার্বেলের মেঝে করে উঠতে পারলেও বেলজিয়াম থেকে কাচ আর এসে পৌঁছায় নি, তাই জানলার কাচ লাগানো আর হয়ে ওঠেনি।
"দেখ, অনেকটা উইন্ডসর কাসেলের মতো দেখতে!" সুমিত্রর কথাতে খেয়াল হল, সত্যিই তো! বাড়ির বারান্দা আর প্রবেশ পথের আর্চগুলিতে যেন তেমনই আদল। বাড়িটির ডানদিকে, ওপরের দিকে তাকালে একটি গোল ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ে, দেখে মনে হয় কোনও সময় হয়ত কোনও বড় ঘড়ি লাগানো ছিল বা এমন হতে পারে যে, ওটি হয়তো গাইন পরিবারের "প্রতীক" ছিল। এই পরিবারের আশুতোষ গাইন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে "রায়বাহাদুর" খেতাব পেয়েছিলেন। বাড়িটির বাঁদিকে চোখে পড়ল ব্রিটিশ দুর্গের আকারে তৈরি একটি স্তম্ভ। একটু ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে নিই। ১৭৪২ সালে জগন্নাথ দাস প্রথম ধান্যকুড়িয়ায় তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার আগে এটি ছিল সুন্দরবনের অন্তর্গত এক জঙ্গুলে জায়গা। একে একে মন্ডল, গাইন, শাহু, বল্লভ নামের বণিকরা বসবাস শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন খুব ধনী। ব্যবসা মূলত ধান ও আখের। ধর্মে সকলেই ছিলেন বৈষ্ণব।

ধান্যকুড়িয়াতে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে, গাইন পরিবারের গোলাপি রঙের বাড়ি। ইংরেজি 'এল' আকৃতির বাড়িটির স্থাপত্য ভারতীয় ও ইউরোপীয়ান ঘরানার এক অপূর্ব মিশেল। কতগুলি লোনিয়ান স্তম্ভ ও একটি লম্বা, খোলা অলিন্দ, যা দিয়ে হেঁটে গেলে প্রবেশ করা যায় ঘরগুলিতে। প্রায় একুশটি স্তম্ভ আছে। তিনটি ভাগে ছড়িয়ে আছে প্রাসাদোপম বাড়িটি। প্রতি তলায় তিরিশটি করে ঘর আছে, দুটি তলা মিলিয়ে ষাটটি ঘর। বাড়িটির শেষ প্রান্তে ছাদের ওপর চোখে পড়ে আভিজাত্যের প্রতীক দুটি বিশালাকৃতি ডোম। বাড়িতে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে "নজর মিনার", যার প্রতিটি কোনায় রয়েছে করিন্থিয়ান স্তম্ভ। কিন্তু যেটি অবাক করে, প্রথম দুটি তলে গোলাকার আর্চ থাকলেও ওপরের তলটিতে কিন্তু রয়েছে ইসলামিক ঘরানার আর্চ। অনেকে এটিকে আবার নহবতখানাও বলেন। তবে এই বাড়িতে ভ্রমণার্থীদের প্রবেশ নিষেধ, পরিবারের লোকজন এখনও এখানেই বসবাস করেন। গাইনদের বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে ধান্যকুড়িয়া-বেনেপারা রোড ধরে একটু এগিয়েই বাঁদিকে চোখে পড়ল গোলাপি রঙের ধান্যকুড়িয়া হাইস্কুল।
গোপীনাথ গাইন-এর হাত ধরে গড়ে ওঠে আজকের গাইন পরিবার। গুড়, পাটের ব্যবসায় সঙ্গী হিসাবে নেন বল্লভ ও সাহুদের। গোপীনাথ গাইনের পুত্র মহেন্দ্রনাথ গাইন এই বাড়িটি গড়ে তোলেন, তাও প্রায় ১৭৫ বছর আগে। ব্রিটিশদের সঙ্গে পাটের ব্যবসায় প্রচুর লাভ করেন। ধান্যকুড়িয়াতে গড়ে তোলেন চালের কল। শুরু করেন বর্ণাঢ্য দুর্গাপূজা, যা আজও হয়ে থাকে। বহু চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে এখানে। গাইন ম্যানসন এর ঠিক পাশেই রয়েছে পরিবারের দেবতা "শ্যামসুন্দর জিউ"-র মন্দির। মন্দিরটিও 'এল' আকৃতির ও হালকা গোলাপি রঙের, দেবতার প্রতিষ্ঠা হয় ১৮২১ সালে।

গাইন ম্যানসন থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললে, ডানদিকে চোখে পড়বে সাদা রঙের সাহুদের বাড়ি। বাড়িটির দেয়াল জুড়ে করিন্থিয়ান স্তম্ভের কাজ আর জানলার ওপরে প্লাস্টার এর কারুকার্য। জানলার আর্চগুলিতে রঙিন কাঁচ। তবে জানলার ওপরে প্লাস্টারের কারুকার্যগুলির মধ্যে ব্রিটিশ ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। বাড়িটির ঠাকুরদালানের স্তম্ভগুলি ও দরজার ওপরের কারুকাজগুলি অনবদ্য। এই বাড়িসংলগ্ন রাধাকান্ত মন্দিরটি প্রতীকচন্দ্র সাহু তৈরি করেন। যদিও বর্তমানে সাহু পরিবারের কেউই এই বাড়িতে বসবাস করেন না। তবে কেয়ারটেকার আছেন, সদালাপী ভদ্রলোক। গাইন ও বল্লভ পরিবারের মতোই ১৮৮৫ সালে এঁরাও ছিলেন ধান্যকুড়িয়ার জমিদার। উপেন্দ্রনাথ সাহু মহেন্দ্রনাথ গাইনের সঙ্গে এখানে প্রথম ইংরেজি স্কুল গড়ে তোলেন। মেয়েদের স্কুলও গড়ে তোলেন এঁরাই।
সাহুদের বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই ডানদিকে কোনায় চোখে পড়বে ভেঙে পড়া নেতাজির এক মূর্তি, একটু এগোলেই সামনে পড়বে একটি পুকুর, বাঁদিকে চোখে পড়বে দোতলা বল্লভ পরিবারের বাড়ি।
শ্যামাচরণ বল্লভ পাটের ব্যবসা করে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তিনি স্বভাবে ছিলেন ভীষণ দয়ালু ও সদালাপী। শ্যামবাজারে এখনও এনাদের বাড়ি আছে। শ্যামাচরণ বল্লভ-এর হাত ধরেই গড়ে ওঠে এই ম্যানসন। গাইনদের সমসাময়িক।

প্রাসাদোপম বাড়িটি সাদা ও সবুজ রঙা। প্রবেশের মুখে রয়েছে বহু অলঙ্কৃত একটি লোহার গেট, এটিও সবুজ- সাদা রঙের। বাড়িটির সম্মুখভাগে নজর কাড়ে করিন্থিয়ান স্তম্ভগুলির সমাহার, আর যা আকর্ষণ করে তা হল, প্লাস্টারের স্টাক্কোর কাজ। দোতলার অলিন্দটি পুরোটাই কাঠের জানলা দিয়ে ঘেরা। সামনে রয়েছে একটি সুসজ্জিত বাগান। ছাদের ওপরে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির বিভিন্ন মূর্তি, তাই স্থানীয়রা এই বাড়িটিকে "পুতুল বাড়ি"-ও বলেন। ছাদের প্রতিটি কোনায় ইউরোপিয়ান স্টাইলের একটি করে মূর্তি। বাড়ির প্রবেশ পথটির মধ্যে রোমান ঘরানার কাজ চোখে পড়ে, এর ওপরে দুটি দ্বাররক্ষীর মূর্তি। বল্লভ ম্যানসন যেখানে শেষ হয়েছে, বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে হলুদ রঙা নজর মিনার চোখে পড়ে। অনেকটা গাইন ম্যানসনে যেরকম আছে, এই নজর মিনারের ছাদের ওপরে দুটি মূর্তি আছে। হয়তো আরও কয়েকটি ছিল, যা কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে।


এই রাস্তা ধরে আর একটু এগোলে ডানদিকে চোখে পড়ে ত্রিতল রাসমঞ্চ, যার নয়টি মিনার আছে। এখানে রাধাকৃষ্ণের একটি মূর্তি আছে। এই মন্দিরের একতলায় প্রতি দিকে পাঁচটি করে প্রবেশপথ, প্রতিটির মাথায় রয়েছে একটি আর্চ। অতীতে ধান্যকুড়িয়াতে বৈষ্ণব ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
রাসমঞ্চ ছাড়িয়ে ওই একই রাস্তা ধরে এসে পড়লাম সাহুদের বাগানবাড়ি। দুটি স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে প্রবেশ করলাম বাগানবাড়িতে। অতীতে এটি ছিল সাহুদের গ্রীষ্মকালীন আবাস। গাইনদের বাগানবাড়ির মতোই এই বাগানবাড়িটি বেশ বড়, কিন্তু গাইনদের বাগানবাড়িটি বেশি ভালো লেগেছিল।
এই ঐতিহ্যশালী বাড়িগুলিতে আজও দুর্গা পূজা হয়, আজও গাইন পরিবারের দুর্গাপুজোতে, অষ্টমীর সন্ধি পুজোর সময়, চারটি গান স্যালুট-এর প্রচলন আছে। একশো আট প্রদীপের আলোয় সেজে ওঠে এই বাড়ি, সেই রঙিন দিনগুলোর আবেশে।
ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, কালের স্রোতে কে যে কোথায় চলে যায়, রয়ে যায় শুধু স্মৃতিচিহ্নটুকু, যা বয়ে নিয়ে যায় ইতিহাসের ধারা।


~ ধান্যকুড়িয়ার আরও ছবি ~

অভিজিৎ চ্যাটার্জী পেশাগত ভাবে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। আর নেশা ভ্রমণ। নেশার তাগিদে ঘুরে বেড়িয়ে নির্মাণ করেন পর্যটন কেন্দ্রগুলি নিয়ে বিভিন্ন ট্রাভেল ডকুমেন্টারি।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher