পায়ে পায়ে ডাবলাহাগাং

অর্ণব ঘোষ


জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেক রুট ম্যাপ || জোংরি ট্রেকের আরো ছবি

"চল ছোট্ট করে কোথাও ট্রেক করে আসি," জয়ন্তদার কথাটা যেন কানে অমৃতবাণী শুনিয়েছিল। গত কয়েকমাস কঠিন অসুখে ভোগার পর এভাবে হঠাৎ হিমালয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ খানিকটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। আমার ক্লাব "মাউন্টেন কোয়েস্ট অফ ক্যালকাটা"-র পোড়খাওয়া পর্বতারোহী, আমার পাহাড়ি দাদা জয়ন্তদা অবশেষে "জোংরি" পর্যন্ত ট্রেক করবে বলে ঠিক করল।
পশ্চিম সিকিমের এক অতি পরিচিত এবং সুন্দর ট্রেকিং পথ হল "ইয়াকসাম-গোয়েচা লা" ('লা' মানে পাহাড়ি পথ, গিরিপথ), সুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ। তবে সময়ের অভাবে এযাত্রা "জোংরি" অবধি যাওয়া ঠিক হল। পাকা রাস্তা ধরে শেষ গ্রাম ইয়াকসাম, এখান থেকেই হাঁটা পথ শুরু হয়। সঙ্গী হল আমার বন্ধু বাপ্পা, সুমিতদা, মিলনদা ও ভাই অনিমেষ। বাপ্পা, সুমিতদা ও মিলনদার এটাই প্রথম ট্রেক। অবশেষে পূর্বনির্ধারিত দিনে ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গাড়ি ঠিক করে যাত্রা শুরু করলাম ইয়াকসাম এর উদ্দেশ্যে। এক অদ্ভুত আনন্দ মনে চেপে বসেছে। শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে গাড়ি উত্তরের পথ ধরল, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই মসৃণ চেনা পথ। সেই প্রথম দেখা হওয়ার আবেগ যেন আবারও ফিরে আসছে। একরাশ ভাবনা শেষ না হতেই অবশেষে দেখা হল তার সঙ্গে, দিগন্ত বিস্তৃত অপরূপা হিমালয়। ঘোর কাটতে বুঝলাম আমি আবারও একবার হিমালয়ের কোলে ফিরে আসতে পেরেছি, যেন ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন শেষ হয়ে দিনের আলোয় পৌঁছানো। করোনেশন ব্রিজ (সেবক ব্রিজ) পাশে রেখে সেবক কালী মন্দির পেরিয়ে সর্পিল পথে গাড়ি এগিয়ে চলল, সঙ্গী হলো খরস্রোতা তিস্তা। কিছু পরেই 'মেল্লি', স্বর্গরাজ্য সিকিমে প্রবেশ করলাম। গাড়ি থামল সন্ধে সাতটা নাগাদ - ইয়াকসাম। বাইরে তখন বৃষ্টি।
সুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে প্রায় ১৭৮৫ মিটার উচ্চতায় ইয়াকসাম একটি ছোট্ট, ছবির মত লোকালয়, প্রায় তিনশো বছর আগে এটা সিকিমের প্রথম রাজধানী ছিল। এখন অন্যতম একটি পর্যটন স্থল ও গোয়েচা লা ট্রেক-এর বেসক্যাম্প। আমরা উঠলাম প্রধান সাহেবের হোটেল "হোটেল প্রধান"-এ। প্রধানবাবুর সহায়তায় স্থানীয় প্রশাসনের থেকে অনুমতি জোগাড় ও বাকি কাজ সেরে দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা সেরে নিলাম। খাওয়া দাওয়ার পর এবার শান্তির ঘুম। বাইরে তখনও বৃষ্টি অবিরাম।
প্রথম দিন আমাদের গন্তব্য 'বাখিম'। সকালে উঠে দেখলাম বৃষ্টি এখনও অক্লান্ত। তবে তার মধ্যেই স্থানীয় থানায় কাগজপত্র সইসাবুদ করা ও বনদপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়ার কাজ সেরে ফেলা হল। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে "কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক", তাই বনদপ্তরের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। ইতিমধ্যে আমাদের গাইড ও পোর্টার ভাইরাও হাজির। খাবার ও তাঁবু ইত্যাদি ভারী জিনিস ওঁদের দায়িত্বে দিয়ে নিজেদের রুকস্যাক পিঠে নিয়ে অবশেষে হিমালয়ের কোলে যাত্রা শুরু করলাম।

কৃত্রিম পৃথিবী ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকৃতির কোলে পৌঁছে গেলাম। নিবিড় জঙ্গল, প্রায় কর্দমাক্ত পথ, নাম না জানা বহু পাখির কলরব, অবিরাম হয়ে চলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সুর, মনটা চনমনে হয়ে উঠল। অবশ্য শীঘ্রই বুঝলাম গত কয়েকমাসের অসুস্থতা কতটা প্রভাব ফেলেছে শরীরের ওপর, বুকের ভেতর হাপর চলতে লাগল। ক্রমাগত চড়াই, বৃষ্টিতে পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পথ আরও কঠিন করে তুলছে এগোনো। শুরুর কিছু সময় পেরিয়ে অবশ্য শারীরিক কষ্ট অনেকটা আয়ত্তে এসে গেল, পাহাড়ের ভাষায় যাকে 'অ্যাক্লাইমাটাইজ' হওয়া বলে।
জঙ্গল পথে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছলাম 'সাচেন,' পথের পাশে বেশ কিছুটা জায়গা সমতল, একটি পুরনো বিশ্রামাগারও রয়েছে। বৃষ্টির কারণে পুরো জায়গাটা কাদাভর্তি, স্যাঁতসেতে আবহাওয়া পেয়ে জোঁকেরাও বেশ ভালই উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। অনেকে এখানেই প্রথম রাত কাটায়, তবে আমাদের গন্তব্য 'বাখিম।' ইতিমধ্যে আমরা পেরিয়েছি তিনটি সেতু। পাহাড়ি পথে সেতু মানে একবার উতরাই পথে অনেকটা নেমে আসা, সেতু পেরিয়ে আবার চড়াই ওঠা। সাচেন-এ একটু বিশ্রাম নিয়ে আবারও এগিয়ে চললাম, ঘন মেঘ ঢেকে রয়েছে, টিপটাপ বৃষ্টির শব্দ, নীচ দিয়ে সশব্দে বয়ে চলেছে 'রাথং চু' (চু মানে নদী), অদ্ভুত মোহময় এক পরিবেশ। এসে পৌঁছলাম চতুর্থ ও সবচেয়ে বড় সেতুর সামনে। এরপরেই শুরু হবে একটানা খাড়া চড়াই পথে উঠে যাওয়া, 'বাখিমের চড়াই' নামে যা পরিচিত। নদী এখানে প্রচন্ড খরস্রোতা। নীচে চোখে পড়ল একটি প্রকান্ড গাছের গুঁড়ি আড়াআড়ি নদীবক্ষে রাখা, সেতু হওয়ার আগে যা নদী পেরোনোর জন্যে ব্যবহার করা হত। প্রযুক্তিকে অনেক ধন্যবাদ যে এখন অত নীচ পর্যন্ত আর উতরাই-চড়াই করতে হয়না।

বৃষ্টিটা অবশেষে ধরেছে। সর্পিল পাকদন্ডি বেয়ে মাধ্যাকর্ষণ বলের সঙ্গে লড়াই করে একটানা কঠিন চড়াই ভেঙে অবশেষে বিকাল ছটা নাগাদ পৌঁছলাম 'বাখিম।' না কোনও জনপদ নয় এটা, রাস্তার দুপাশে একটু প্রশস্ত জায়গা। পুরনো একটি বাংলো রয়েছে বনদপ্তরের, শেষবার ভূমিকম্পতে যা চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় পাহাড়ি বন্ধুরা যারা ওই এলাকায় নানারকম কাজে আসে তাদের জন্য একটি 'হাট' রয়েছে ওখানে। সেখানে আমরা কিছুটা জায়গা পেলাম রাতের রান্না করার জন্য। আমাদের পোর্টার বন্ধুরা অবশ্য আমাদের আগেই ওখানে পৌঁছে বিশ্রাম করছে।
এরপর বনদপ্তরের বাংলোর সামনের খোলা জায়গায় তাঁবু লাগিয়ে লেগে পড়লাম রান্নার কাজে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর মাথায় লাগানো 'হেড টর্চ'-এর সামান্য আলোয় রান্না করা প্রথমবার ট্রেকে আসা বন্ধুদের জন্যে সারাদিনের ক্লান্তির পর এক দারুন অনুভূতি। খাওয়াদাওয়া সেরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুকে পড়লাম স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণ আশ্রয়ে। হিমালয়ের কোলে অপার নিস্তব্ধতাকে জড়িয়ে বড় শান্তির ঘুম।

দ্বিতীয় দিন শুরু হল মোহময়ী প্রেক্ষাপটে, ঘুম ভেঙে তাঁবুর দরজা খুলতেই সামনে পেলাম সেই নৈসর্গিক দৃশ্য যার জন্যে বারবার বাখিমের চড়াই ভাঙা যায়। হিমালয়ের গায়ের সবুজ গালিচা যেন সূর্যের আলোয় নিজেকে সেঁকে নিচ্ছে। পরিস্রুত অক্সিজেন, ঝকঝকে আবহাওয়া যেন শরীর-মন তরতাজা করে তুলল।
আজ যাব 'ফেডাং', ৩৬৯৬ মিটার, কয়েক ঘন্টার পথ। প্রাতঃরাশ সেরে দুপুরের খাবার বানিয়ে সঙ্গে নিয়ে নিলাম, পথিমধ্যে খাওয়া হবে। ইতিমধ্যে বাপ্পা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বাকি পথ এগোনোর সাহস পেলনা ও। তাঁবু আর অন্যান্য সামগ্রী গুছিয়ে রওনা হলাম আমরা।
না, আমার জন্যে আজ শুরুটা ভালো হলনা, পায়ের পেশীতে ভালোরকম টান লেগেছে, হাঁটতে বেগ পেতে হচ্ছে। চিন্তিত হলেও জয়ন্তদা জোর দিল, জেদ চেপে গেল, আমি পারবই, পৌঁছতে আমাকে হবেই। ছোট ছোট দূরত্বে লক্ষ্য ঠিক করে ধীরে এগোতে লাগলাম। রাস্তা একইভাবে অসংখ্য বাঁক নিয়ে ক্রমশ উচ্চতা বাড়িয়ে চলেছে, কোথাও সংকীর্ণ কোথাও অল্প প্রশস্ত। উচ্চতার সঙ্গে গাছগাছালি, পারিপার্শ্বিকের পরিবর্তন ও অতুলনীয় নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এসে থামলাম 'সোকা (Tshoka),' এই পথের শেষ গ্রাম। যেন শিল্পীর আঁকা ছবি, অতীব সুন্দর এই গ্রাম। হাঁটাপথের দুইপাশে কয়েকটি ছোটো বাড়ি, একটি হাট, গ্রামের প্রায় শেষে কিছুটা ওপরে একটি জলাশয় ও তার পাশে একটি বৌদ্ধ মনাস্ট্রি। এখানকার ট্রেকার্স হাটটি বেশ সুন্দর, সামনে তাঁবু লাগানোর মত বেশ অনেকখানি জায়গা রয়েছে। অনেক অভিযাত্রীই এখানে রাত্রিবাস করেন।
অবশেষে বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম 'ফেডাং।' চাতাল মত একটি জায়গা, বেশ উন্মুক্ত. মাঝ বরাবর হাঁটা রাস্তাটি চলে গেছে, রাস্তার পাশে একটি হাট, এই হল ফেডাং। পোর্টার বন্ধুরা আমাদের রান্নার সামগ্রী আগেই এখানে হাটে রেখে গেছে। জোংরির অভিমুখে তাকিয়ে দাঁড়ালে আরেকটি অস্পষ্ট হাঁটা পথ ডানদিকে চলে গেছে দেখা যায়, এই পথটি গোয়েচা-লা থেকে ফেরার পথে অভিযাত্রীরা ব্যবহার করে থাকেন, তাতে ফেরার সময় পথ কিছুটা কম হয়। এখানে হাটটি শক্তপোক্ত, তবে বেশ নোংরা, খুব একটা ব্যবহার হয়না মনে হয়। গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে হাটের সামনের জায়গাটি কাদা ভর্তি, বাধ্য হয়েই হাট থেকে একটু দূরে আমাদের তাঁবু ফেলা হল। চারপাশ ঘন কুয়াশায় মোড়া, ঠান্ডাও বেশ ভালোই। খানিক গল্প আড্ডা সেরে ফের রাত্রের খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে লেগে পড়লাম আমরা, আমিও এখন অনেকটাই সুস্থ বোধ করছি। ইতিমধ্যে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল।
এক পোর্টার বন্ধু হাট-এ এসে থামল, পিঠ ভর্তি মাল, আজই সে ইয়াকসাম থেকে রওনা দিয়েছে, গন্তব্য জোংরি, জঙ্গলপথে রাত হয়ে গেলেও তাকে পৌঁছতেই হবে। পাহাড়ে জীবনসংগ্রাম কতটা কঠিন এই ছোট্ট ঘটনা থেকে আবারও অনুভব করলাম। খানিক জিরিয়ে নিয়ে ও চা-বিস্কুট খেয়ে সে আবার এগিয়ে গেল, একটা জলের বোতল ও কিছু হালকা খাবার আমরা তার সঙ্গে দিয়ে দিলাম। প্রার্থনা করি সে যেন সুস্থ ভাবে পৌঁছে গিয়ে থাকে।
রাতের খাওয়া সেরে সবে স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় আত্মসমর্পণ করেছি, হঠাৎ বাইরে থেকে ডাক, "সাবজি, আপকা টেন্ট মে জাগা হোগা?" আমাদের গাইড ভাই ডাকছে। সে ওই হাটে শুয়েছিল, কিন্তু ভয়ে অবশেষে আমাদের কাছে ছুটে এসেছে, এখানে নাকি ভূতুড়ে ব্যাপার আছে। শুনে বেশ মজাই পেলাম। এখানে বলে রাখা ভাল পাহাড়ি মানুষজনের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস বেশ প্রবল। নিস্তব্ধ অন্ধকারে পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে রাতে ঘুমোনোর আগে ভূতের গল্প শুনতে বেশ লাগছিল। তবে সেই গল্পের কারণেই কিনা জানিনা, শিরশিরানি ঠান্ডায় ওই পরিবেশে মধ্যরাতে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে বেরিয়ে গা ছমছমে ব্যাপারটা বেশ ভালোই অনুভব করেছিলাম।
তৃতীয় দিন পেলাম অসাধারণ এক ঝকঝকে সকাল। সুদূরে তুষারাবৃত পান্ডিম-এর শিখর দিনের প্রথম আলোয় রক্তরাঙা দেখাচ্ছিল। নীচ থেকে উঠে আসা মেঘের সঙ্গে সূর্যরশ্মি যেন লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। আমাদের ক্যামেরাগুলোর ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মত। সকালের খাবার খেয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম, ইতিমধ্যে পোর্টার ভাইরাও এসে পড়েছে। তবে আজ মিলনদা একটু ঝিমিয়ে আছে, গতরাত থেকে জল কম খাওয়ার কারণে উচ্চতাজনিত সমস্যা মনে হচ্ছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, আজ পথ তুলনামূলক সহজ। মিলনদাকে বলা হল ধীরে সুস্থে হাঁটতে।
সামনে রাস্তা বেশ মনোরম, চড়াই কম, সঙ্গে উতরাইও রয়েছে আজ, কিছু জায়গায় পথ বাঁশ দিয়ে বাঁধানো, কিন্তু ভেঙ্গে গিয়ে ও বৃষ্টির জন্যে বেশ পিচ্ছিল হয়ে আছে। পথিমধ্যে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে গলায় ঝোলানো ঘন্টায় আওয়াজ তুলে পোর্টার বন্ধুর তত্ত্বাবধানে ইয়াক আর ঘোড়ার দলের মাল নিয়ে চলাচল। উঁচু জঙ্গল শেষ হয়ে আজ বেশ উন্মুক্ত চারপাশ। বিভিন্ন রকম নাম না জানা ফুল ও পাখির আওয়াজে মন ফুরফুরে হয়ে যায়। আর রয়েছে রডোডেনড্রন। নানারকম রং ও চেহারার রডোডেনড্রন ফুলে চারপাশ ছেয়ে আছে। মানসচক্ষে না দেখলে শব্দে এই সুন্দরী হিমালয়ের সৌন্দর্যকে বাঁধা যাবেনা। অবশেষে অভিযানের শেষ, 'জোংরি' পৌছলাম সকাল এগারোটা নাগাদ।
তাঁবু লাগিয়ে পিঠের ভারী রুকস্যাক নামিয়ে একটু নিশ্চুপ অপেক্ষা, না ক্লান্তি নয়, নির্মল প্রকৃতিকে আরও কাছে টেনে নেওয়ার চেষ্টা, হিমালয়ের কোলে আবারও ফিরে আসার আনন্দকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করে নেওয়া। তবে এর মধ্যেই দুঃসংবাদ, মিলনদা বেশ অসুস্থ। শরীরে জল কম, মাথা ঘুরছে। গাইড ভাই রসুনের রস বানিয়ে এনে দিল, স্থানীয় ওষুধ। জয়ন্তদা মিলনদার সঙ্গে থেকে গেল, আমরা একটু বেরোলাম চারপাশটা ঘুরে নিতে।
বেশ খানিকটা প্রশস্ত জায়গা জুড়ে জোংরি। একটা পুরনো হাট রয়েছে, নতুন আরেকটি হয়েছে, তার পাশেই একটা বেশ বড় ঘর রয়েছে যেখানে টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়, গাইড ও পোর্টার ভাইদের রান্না করা থাকারও জায়গা সেটি। উচ্চতার কারণে চারপাশ উন্মুক্ত, বড় গাছের জঙ্গল আর নেই। ওপরের দিকে রাস্তা এগিয়ে গেছে জোংরি টপ-এর দিকে, জোংরির উচ্চতম জায়গা। গোয়েচা লা-র পথে এখানে একটা অতিরিক্ত দিন কাটিয়ে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন অভিযাত্রীরা। জোংরি টপ যাওয়ার পথে কিছুটা গিয়ে রাস্তা নীচের দিক হয়ে চলে গেছে গোয়েচা লা-র দিকে। আমরা ইতিউতি চারপাশটা একটু ঘুরে নিলাম, ক্যামেরা বন্দী করলাম অসংখ্য স্মৃতি।
যেকোনও অভিযানের একটি বড় আকর্ষণ প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে টর্চের আলোয় একসঙ্গে রান্না করা। দিনের শেষে যেন আস্ত আড্ডাখানাতে পরিণত হয় রান্নার তাঁবুটা। পরদিন খুব ভোরে জোংরি টপের উদ্দেশে বেরোনো স্থির হল, গাইড ভাইয়ের সঙ্গে আমি, সুমিতদা ও অনিমেষ। জয়ন্তদা আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে বলে মিলনদার সঙ্গে থাকবে বলে ঠিক করল। সকালে অসাধারণ সূর্যোদয় দেখার আশা নিয়ে হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে অবশেষে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।
চতুর্থ দিন আলো উঠতে তখনও ঢের দেরি, "ভাই ওঠ, আড়াইটে বেজে গেছে," পাশের তাঁবু থেকে সুমিতদার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণ আলিঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে এসে প্রস্তুত হলাম, কনকনে ঠান্ডার মধ্যে তিনটে নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম আমরা তিনজন, সঙ্গে গাইড ভাই। আকাশভর্তি ঝলমল করছে একগুচ্ছ তারা, যেন তাদের অল্প আলো দিয়েই আমাদের পথ দেখানোর চেষ্টা করছে। হেড টর্চের আলোয় ভরসা করে ও আমাদের গাইড ভাইকে অনুসরণ করে সরু পথ ধরে প্রায় এক ঘন্টা পর পৌঁছলাম প্রায় ৪১৭১ মিটার উচ্চতায় জোংরি টপ - স্থানীয় ভাষায় "ডাবলাহাগাং।" আলো ফুটতে তখনও ঢের দেরি।

পুরো শরীর কাঁপছে, ঠান্ডায়, আনন্দে। উচ্চতা সামান্য হলেও গত কয়েকমাসের অসুস্থতার ধকলের পর এটাই এভারেস্টসম, যখন সামান্য নড়াচড়া করাও চরম কষ্টসাধ্য ছিল, তখন পাহাড়ে আবারও আসতে পারা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সম্ভব হয়েছে অবশেষে। এসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল দূর দিগন্তে মৃদু আলোর আভা। চোখের কোণটা একটু আর্দ্র ঠেকল।
দেখতে দেখতে দিগন্ত স্পষ্ট হল। সূর্যের প্রথম আলোয় রক্তরাঙা পর্বতশৃঙ্গগুলির নৈসর্গিক দৃশ্য। মিঠে রোদ্দুর ভাসিয়ে দিল চারপাশ, সেই উষ্ণতা গায়ে মেখে আমরাও যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। পতপত করে উড়ে চলেছে বৌদ্ধ প্রার্থনার পতাকাগুলি। দূরে নীচে উপত্যকায় চোখে পড়ল একপাল ভেড়া চরছে।
পাহাড়ের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ও অনেক স্মৃতি ক্যামেরাবন্দী করে এবার ফেরার পালা, রেখে যাওয়া আবারও ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি। জোংরিতে তাঁবুর কাছে ফিরে এসে আরও একটি অবাক হওয়া বাকি ছিল। তাঁবুতে ঢুকতে গিয়ে দেখি তাঁবুর ওপরে শিশির বিন্দুগুলি জমে বরফ হয়েগেছে।
উতরাই পথে আজ একেবারে বাখিম অবধি নেমে যাব আমরা। প্রাতঃরাশ করে ও দুপুরের খাবার প্যাকেটবন্দী করে, তাঁবু ইত্যাদি গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হলাম দীর্ঘ যাত্রার উদ্দেশ্যে। একই পথে আবার নেমে আসা, তবে আজ শরীর মন অদ্ভুত শান্ত, তৃপ্ত। নেমে আসতেই মিলনদাও সুস্থ অনুভব করতে লাগল ও তরতাজা হয়ে উঠল।
অবশেষে বেলাশেষে পৌছলাম বাখিম। তাঁবু লাগিয়ে নিয়ে বাখিমের সেই হাটের বারান্দায় শুরু হলো চা-আড্ডা। পাহাড়ের কোলে এবারের মত এই শেষ রাত। অফুরন্ত গল্পের স্রোতকে বাঁধ দিয়ে অবশেষে রান্না-খাওয়া সেরে উঠতে আজ বেশ ভালোই রাত হল। আজ ট্রেকের পঞ্চম দিন - খানিকটা অবসাদঘেরা, এবার যে বিদায়ের পালা। যদিও সেই বিদায়যাত্রাকে স্মরণীয় করার দায়িত্ব নিয়েছিল দুটি সারমেয়। বাখিম থেকে ইয়াকসাম পুরো পথ তারা আমাদের সাথী হল - আমরা একসাথে নামলাম, বিশ্রাম নিলাম, জলখাবার খেলাম। পথিমধ্যে দেখা হল হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-এর একটি শিক্ষার্থী দলের সঙ্গে, তারা চলেছে বাখিমের উদ্দেশ্যে।
দুপুরের মধ্যেই ইয়াকসাম পৌঁছে সেই আগের হোটেলেই ঘর নিলাম। বিকেলে ইতিউতি ঘোরাফেরা ও আগামীকালের জন্যে গাড়ি বুক করা হল। আজ রাতে বড়া খানা, সফল ট্রেক-এর উদযাপন। মিলনদা মাংসটা খাসা রেঁধেছিল সে রাতে।

জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেক রুট ম্যাপ || জোংরি ট্রেকের আরো ছবি

জীবনকে দেখা-জানা-শেখার জন্য বেড়ানোই হল সবচেয়ে বাস্তব উপায় – মনে করেন অর্ণব ঘোষ। ভালোবাসেন পাহাড়, প্রকৃতি, গাছপালা আর প্রাণীকূল - তাদের ক্যামেরায় ধরে রাখতেও। "মাউন্টেন কোয়েস্ট ক্যালকাটা" ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর নিজের মনের ট্রেকিং করার সুপ্ত ইচ্ছে আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে। সময় পেলেই পাহাড়ে চলে যান। হিমালয় হলে তো কথাই নেই, একান্ত না হলে পুরুলিয়া কিংবা বাঁকুড়াই সই।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher