মিজোরামে নতুন বছর

সুবীর কুমার রায়


~ মিজোরামের আরও ছবি ~

মিজোরাম হাউস থেকে মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি পত্র হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই চাল্টলাঙ্গ(CHALTLANG), চামফাই(CHAMPHAI) ও থেনজল(THENZAWL) গেস্টহাউস বুক করার জন্য ফোন করলাম। চাল্টলাঙ্গ গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ আমাদের শুধুমাত্র আইজল পৌঁছনোর দিন, অর্থাৎ একত্রিশে ডিসেম্বরের জন্য ঘর বুক করে দিয়ে জানালেন, পরের দিনে কোন ঘর খালি না থাকায় হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। তাঁরা আমাদের সুবিধার্থে অবশ্য একটি হোটেলের ফোন নাম্বার দিলেন। আমরা সেইমতো পয়লা জানুয়ারির জন্য ঘর বুকিং-এর বিষয় খোঁজখবর নিয়ে রাখলাম।
চামফাই গেস্ট হাউসের ভদ্রলোকটি জানালেন যে তিনি এখন বাইরে আছেন, আমি যেন তাঁকে পরে ফোন করি। যদিও তিনি জানালেন যে আমাদের প্রয়োজনীয় দিন দুটির জন্য ঘর পাওয়া যাবে। আমি তাঁর কথায় সম্মতি জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিয়ে থেনজল গেস্টহাউসে ফোন করলাম।
এখানে আবার এক ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন। ইনি কোন ভাষায় কথা বলেন বোঝার সুযোগ পেলাম না। হিন্দি এবং ইংরেজি, দু'ভাষাতেই আমার কথা শুনে তিনি শুধু 'হ' বললেন। সন্দেহ হওয়াতে আমি কেটে কেটে, সময় নিয়ে, তাঁকে নির্দিষ্ট দিনে প্রয়োজনীয় তিনটি ঘর পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করায়, তিনি আবারও শুধু 'হ' বললেন। আমি তাঁকে ঘর বুকিং-এর জন্য কিভাবে টাকা পাঠাবো জিজ্ঞাসা করায়, একই সুরে তাঁর অভিধানের একমাত্র শব্দ 'হ' বললেন।
বিকালের দিকে চামফাই গেস্টহাউসে আবার ফোন করতে, আগের সেই ভদ্রলোক আবার সেই একই কথা বললেন, তিনি বাইরে আছেন, আমি যেন তাঁকে পরে ফোন করি। তবে তাঁর কথায় জানা গেল যে তিনি গেস্টহাউসেই থাকেন, ঘর পাওয়া যাবে, কোন অসুবিধা হবে না। থেনজলের ভদ্রমহিলার 'হ'-এ আশ্বস্ত হতে না পেরে সন্ধ্যার সময় তাঁকে তাঁর মোবাইলে এস.এম.এস. করে সকালের কথোপকথন উল্লেখ করে, থেনজলের গেস্টহাউসে থাকার দিনক্ষণ পুনরায় জানিয়ে, তিনটি ঘর আমাদের জন্য রাখার অনুরোধ করলাম। কিছুক্ষণ পরে তাঁর পাঠানো এস.এম.এস. উত্তরে জানা গেল, নির্দিষ্ট দিনে আমাদের জন্য তিনটি ঘর রাখা থাকবে। আমাদের তাঁর গেস্টহাউসে নির্দিষ্ট দিনে চলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আশ্বস্ত করা হল, আমাদের কোনরকম অসুবিধা হবে না। যাক, একটা সমস্যা মিটল।
চামফাই গেস্টহাউসের ভদ্রলোককে ফোন করলাম। এবার আমার বক্তব্য শুনে তিনি প্রথমে চারটি ঘরের কথা বললেও, আমার অনুরোধে তিনি তিনটি ঘর নির্দিষ্ট দু'টি দিনে আমাদের জন্য রেখে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তবু নিশ্চিন্ত হতে আমাদের ওখানে যাওয়ার বিস্তারিত, অর্থাৎ কোন গেস্টহাউস, ক'টা ঘর, কোন কোন দিনের জন্য, কতজন যাব, ইত্যাদি তথ্য বিস্তারিত ভাবে দিয়ে, কনফার্ম করার অনুরোধ করে তাঁকে এস.এম.এস. পাঠালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই "নো প্রবলেম, ওয়েলকাম" লেখা এস.এম.এস. পেলাম। এবার নিশ্চিন্ত, মেঘালয়ে থাকার ব্যবস্থা ওখানে গিয়ে করব। মিজোরামে থাকার ব্যবস্থাও পাকা হয়ে গেল।

গোড়াতে আমাদের পরিকল্পনা ছিল ট্রেনে যাওয়ার, সেইমতো যাওয়া-আসার টিকিট কাটাও ছিল, কিন্ত অযথা অনেক সময় নষ্ট ও শারীরিক কষ্টের কথা ভেবে মিজোরাম হাউস থেকে অনুমতি পাওয়ার পরে যাত্রার দিন দু'দিন পিছিয়ে বিমানের টিকিট কাটা হল। যাবার ট্রেনের টিকিটও বাতিল করা হল। নির্দিষ্ট দিনে, অর্থাৎ বছরের শেষ দিনটায় ছোট্ট বিমানে করে আইজলের ছবির মতো সুন্দর সাজানো গোছানো, ঝাঁ চকচকে, হিমালয়ের মিষ্টি গন্ধ মাখা, ছোট্ট বিমানবন্দর 'লেংপুই' গিয়ে নামা গেল। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বেরতে গিয়ে টের পেলাম, বিপদ ও ঝামেলা আমাদের এখনও পিছু ছেড়ে যায় নি।
ট্রেনে যাওয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের মিজোরামে ঢোকার কথা ছিল পরের বছরের প্রথম দিনটিতে। অনুমতিপত্রেও আমাদের পূর্ব ইচ্ছামতো তাই লেখা আছে। কিন্তু আমরা একদিন আগেই মিজোরামে এসে হাজির হয়েছি। কাউন্টারে কর্তব্যরত সিকিউরিটি অফিসার ব্যাপারটা দেখাতে, আমার তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতো অবস্থা। যাওয়ার আনন্দে, উত্তেজনায়, এই ব্যাপারটা মনেও পড়ে নি, ভেবেও দেখি নি। আমার তখন আশা ভরসা একটাই, রাজ্যটা পশ্চিমবঙ্গ নয়। গোটা ব্যাপারটা ওই অফিসারকে বুঝিয়ে বললাম। উনি হাতে একটা কলম নিয়ে বারবার তারিখটার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন—"বুঝতে পারছি, কিন্তু যিনি এই অনুমতিপত্রে সাক্ষর করেছেন, তিনি অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার। ওখানে আমার কলম চালানো উচিত হবে না।" ব্যাপারটা হয়তো সত্যিই তাই, কারণ মিজোরাম হাউসে অনুমতিপত্র তৈরি হওয়ার পরে অনেকক্ষণ সাক্ষরকারী অফিসারের জন্য বসে থাকতে হয়েছিল। শেষে লাল বাতি জ্বালানো গাড়ি নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে সমস্ত অনুমতিপত্রে সাক্ষর করেন। যাইহোক শেষ পর্যন্ত আগের মতোই কলমটি তারিখের কাছে নিয়ে এসে ভদ্রলোক কথা বলতে বলতেই হঠৎ মিজোরামে ঢোকার তারিখটি কেটে আগের দিন করে দিয়ে শুধু বললেন, "আপনারা অসুবিধায় পড়েছেন তাই করে দিলাম।" আমাদের রাজ্যে হলে এই কাজটির জন্য খরচ হয়তো একটু বেশিই হত, আর এখানে কোনও অর্থব্যয়ের পরিবর্তে, তাঁর মুখ থেকে একবার ওয়েলকাম শব্দটি শুনতে হল এবং করমর্দন করতে হল। আমরা বিমানবন্দরের বাইরে পা রাখলাম।

বিমানবন্দর থেকে সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে একসময় আমরা চাল্টলাঙ্গ গেস্টহাউসে এসে পৌঁছলাম। বাইরে থেকে তত সুন্দর মনে না হলেও অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি চারতলা বিশাল বাড়িটার ভিতরটা বেশ সুন্দর। কিন্তু একেবারে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। রিসেপশনটা তো খুবই সুন্দর, বাড়ির চারপাশটাও ফুলের ও অন্যান্য শৌখিন গাছ দিয়ে সাজানো। কিন্তু তবু বোঝা যায় পরিচর্যা ও দেখভালের যথেষ্ট অভাব, কতদিন সুন্দর থাকবে বলা শক্ত। এল প্যাটার্নের বাড়ির চারতলায় পরপর তিনটি ঘর দিয়ে আমাদের একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে অনুরোধ করা হল। আমরা ছাড়া এতবড় বাড়িতে আর কোনও বোর্ডার নেই। স্নান সেরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ডাইনিং হলে খেতে গেলাম। আমরা সাতজন বেশ বড় হলঘরের একপ্রান্তে বসলাম। আর কোনও লোক নেই। খাবারও অতি সাধারণ, ভাত, ডাল, একটা সবজি ও ডিমের ঝোল। পরিবেশক জানালেন, আমরা আজ আসব বলে এবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতেই হয়েছে। গেস্টহাউসে কোন কর্মী নেই, তাই যেন রাতের খাবার ব্যবস্থা অন্যত্র কোথাও করে নিই।
খাওয়া শেষ করে নীচে রিসেপশনে অন্য কোথাও খাওয়ার অসুবিধার কথা জানাতে গেলাম। কাউন্টারের ভদ্রলোক জানালেন যে, বছরের শেষ দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এখানে সবাই উৎসবে মেতে থাকে। তাই গেস্টহাউসে খাবার তৈরি করা তো দূরের কথা, ঘরে পানীয় জল দেওয়ার লোক পর্যন্ত নেই। গোটা গেস্টহাউস ফাঁকা, লোকের অভাবে কাউকে বুকিং দেওয়া হয় নি। এতক্ষণে আমাদের আগামীকাল অন্য হোটেলে থাকতে বলার রহস্য উদঘাটন হল। বললাম, ঘরে পানীয় জল দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ওই কাজটা নিজেরাই করে নেব। তবে আগামীকাল আর অন্য কোনও হোটেলে যাচ্ছি না, এখানেই থেকে যাব। আর এই ঠান্ডার মধ্যে মেয়েদের নিয়ে কোথায় খেতে যাব, আজ রাতের খাবারটা যেভাবে হোক, একটু করে দেবার ব্যবস্থা করা হোক। ভদ্রলোক হ্যাঁ বা না কিছুই না বলে চুপ করে রইলেন।
এখানে আমাদের তিনটে ঘরেই তিনটে ইলেকট্রিক কেটলি রাখা আছে দেখলাম। আমাদের সঙ্গেও একটা এসেছে। সঙ্গে প্রচুর টি ব্যাগ নিয়ে আসা হয়েছে, কাজেই চা খাওয়ায় কোন অসুবিধা নেই। তরুণ জানালো যে সে বিকালে পাঁউরুটি, জ্যাম বা জেলি, ডিম, আলু, ইত্যাদি কিনে আনবে। বলল, আলু ও ডিম ভাগ করে করে চারটে কেটলিতে সিদ্ধ করে নিতে পারলে, জলখাবার, প্রয়োজনে রাতের খাবারের সমস্যাও মিটবে। আমরা তার এই প্রস্তাব নিয়ে ঠাট্টা তামাশা শুরু করে দিলাম।
বিকাল বেলা পায়ে হেঁটে ঘুরবার পথে সামান্য রাস্তা হেঁটেই দেখলাম, রাস্তার দুপাশে পরপর দোকানগুলো সব বন্ধ। রাস্তা একবারে শুনশান, এক-আধজন যুবক যুবতী ছাড়া একটা লোকও চোখে পড়ল না। বুঝতে পারছি আমাদের মিশন-কেটলি 'ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে' হয়েই থেকে গেল, ভূমিষ্ঠ হবার সুযোগ আর পেল না। হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা রাস্তা যাবার পর, একটা দোকান খোলা দেখে ঢুকে পড়লাম। সবকিছুই পাওয়া গেল, যদিও জ্যামের শিশিটা স্থানীয় কোন প্রস্তুতকারকের তৈরি ও প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত ছোট, আর তিন বছর আগের কালচে রঙের এবড়ো-খেবড়ো আলু চল্লিশ টাকা কিলো। খনার বচনের কথা মনে পড়ল - যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন'জন। আমরা তো মাত্র সাতজন, ওই জ্যামের শিশিতে অসুবিধা হওয়ার কথা ধোপে টিকবে না। তাই 'নেই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো' ভেবে, সববিছু কেনাকাটা করে জনশূন্য রাস্তা দিয়ে এক চক্কর শহর পরিক্রমা করে গেস্টহাউসে ফিরলাম।
রিসেপশনের আরামদায়ক বেতের সোফায় দেখলাম দু'চারজন বসে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। নিজেদের ঘরে ঢুকবার আগে দেখলাম আমাদের পাশের দুটো ঘরে লোক এসেছে। খাওয়ার জল আনতে গিয়ে জানা গেল আজ হঠাৎ দু'চারজন সরকারি আমলা দরকারি কাজে এসে উপস্থিত হওয়ায়, রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতেই হচ্ছে, তাই আমরাও সেই খাবারের থেকে কিছু প্রসাদ পাব। তবে লোকের অভাব, তাই খাবার পেতে একটু রাত হতে পারে। মনে হল সেই সরকারি আমলাদের খুঁজে বার করে একটা চুমু খেয়ে আসি। রাতের খাবারের ব্যবস্থা যখন হয়েই গেল, তখন সদ্য কিনে আনা খাবারের সদব্যবহার করে ফেলা উচিৎ। অন্তত পাঁউরুটি আর ডিমগুলোর কথা ভেবে সান্ধ্যভোজের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কাল এগুলোর প্রয়োজন নাও হতে পারে। প্রয়োজন হলে কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। শাস্ত্রেই তো বলা আছে, মিজোরামে এনেছেন যিনি, খাবার জোগাবেন তিনি।
তিন ঘরে চারটে কেটলিতে আলু ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে, ছোটছোট করে কেটে, সিদ্ধ করতে দেওয়া হল। ডিমও সিদ্ধ হল। নু্‌ন, মরিচ গুঁড়ো ও মিষ্টি আমাদের সঙ্গেই আছে। ফলে জ্যাম মাখানো রুটি, নুন-মরিচ গুঁড়ো দেওয়া আলু আর ডিমসিদ্ধ এবং শেষপাতে মিষ্টির পর এক রাউন্ড কফিসেবন করে মহাভোজ সাঙ্গ হল। তরুণটা বোকা হলেও মাথায় বুদ্ধি যথেষ্টই রাখে, আর তাই ও বা ওর পরিবার আমার সবথেকে প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী ও আত্মীয়সম।
রিসেপশন থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে গাড়ির জন্য সকালেই ফোন করে রেখেছিলাম। অনেক চেষ্টা অনেক সাধ্যসাধনার পর, ও প্রান্ত থেকে ফোন ধরে আমার বক্তব্য শুনে জানিয়েছিল সন্ধ্যার সময় গেস্টহাউসে এসে দেখা করবে। সন্ধ্যা অনেকক্ষণ অতিক্রম করে রাত হয়ে যাওয়ায় আবার ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরে ও প্রান্ত দয়া করে ফোন ধরলেও, তার বক্তব্য পরিষ্কার হলনা। পরের দিন সকালে এসে কথা বলবে বলে জানিয়ে ফোন কেটে দিল। মহা মুশকিল, কাল সকালেই আমাদের গাড়ি নিয়ে বেরোবার কথা, শেষে ওর অপেক্ষায় থেকে একটা গোটা দিন নষ্ট হবে। আবার রিসেপশন কাউন্টারের সেই ভদ্রলোকের শরণাপন্ন হলাম। ভদ্রলোক আবারও জানালেন বছরের প্রথম ও শেষ দিনটি এখানে সবাই উৎসবে মেতে থাকে, সমস্ত দোকানপাট বন্ধ রেখে আনন্দে মেতে থাকে। এই দুদিন গাড়ি পাওয়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। আরও খান দু-এক ফোন নাম্বার নিয়ে চেষ্টা করে বিফল হয়ে, শেষে আবার আগের সেই ফোন নাম্বারে ফোন করে একটু মেজাজ দেখিয়েই বললাম যে, সে যদি আমাদের সাথে যেতে চায়, তাহলে এখনই এসে দেখা করে যাক, তা নাহলে আমরা অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে নেব। উত্তরে বিড়বিড় করে সে কী যে বললো বোঝা গেল না।
কী করা যায় বুঝতে পারছি না। এই রাজ্যে প্রায় সাতাশি শতাংশ অধিবাসী খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। বছরের শেষ ও প্রথম দিনটি উপভোগ করার জন্য এই খ্রিস্টান প্রধান রাজ্যে বেছে বেছে এই দিনটাতে আসা। তার ফল যে এমন উল্টো হবে কে জানতো। আমাদের রাজ্যে বড়দিন, বর্ষশেষ, বা নববর্ষের দিনে রাস্তাঘাট-দোকানপাট আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিট বা ওই জাতীয় রাস্তায় তো সারা রাত লোকের ভিড় উপচে পড়ে। আমরা বাঙালি অখ্রিস্টানরাও সাহেব-মেম সেজে, বাড়িতে তালা লাগিয়ে, খ্রিস্টান প্রধান এলাকায় বড়দিন বা নববর্ষ পালন করতে যাই। কিন্তু এরা এই দিনগুলিতে সমস্তকিছু বন্ধ রেখে, পরিবারের সঙ্গে নিজের নিজের বাড়িতে আনন্দে মেতে ওঠে। আমাদের এই রাজ্যে বড় কোন রাজনৈতিক দলের ডাকা বাংলা বন্ধেও রাস্তাঘাট এত ফাঁকা থাকে না, সমস্ত দোকানপাট এইভাবে বন্ধ থাকে না।
যাইহোক প্রভু যীশুর অসীম দয়া ও করুণায়, আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে 'কিমা' নামে বছর ত্রিশের একজন এসে হাজির হল। জানাল যে আজ ও আগামীকাল তাদের উৎসব, তাই আমরা পরশু গেলে তার পক্ষে সুবিধা হয়। আজ ও আগামীকাল গাড়ি বা ড্রাইভার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমরা তাকে জানালাম যে আমাদের হাতে সময় খুব কম, কাজেই দু'দিন আইজলে বসে থাকা কোনও মতেই সম্ভব নয়। কাজেই সে যদি আমাদের ইচ্ছামত মিজোরামের জায়গাগুলো দেখাতে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে কাল সকালে গাড়ি নিয়ে আসুক, তা না হলে আমরা অন্য গাড়ির সঙ্গে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে নেব। এই এক বেলাতেই বুঝতে পেরেছি, আমাদের মতো পাগল ছাড়া মিজোরামে টুরিস্ট বিশেষ একটা আসে না। এখনো পর্যন্ত আমাদের তো একজনও চোখে পড়ে নি। আমাদের প্রতি দয়া বা সাহায্যের হাত বাড়ানো, না খদ্দের হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে জানি না, সে আমাদের ইচ্ছানুযায়ী মিজোরামের জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য দরদস্তুর করে ভাড়া ঠিক করে, কাল সকালে টাটা সুমো নিয়ে আসবে কথা দিয়ে চলে গেল।
রাতে মহামান্য সরকারি আমলাদের সাথে রুটি তরকারি খেয়ে, রাস্তায় একটু পায়চারি করে ঘরে ফিরলাম। আমাদের পাশের ঘরেই এক ভদ্রলোক উঠেছেন। উনি বাঙালি, তাই নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আলাপ করলেন। জানা গেল তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অতি উচ্চপদস্থ কর্মচারী। সরকারি কাজে এখানে প্রায়ই আসতে হয়। এখান থেকে ওঁকে মিজোরামের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। আমরা মায়ানমার-এ হার্ট লেক দেখতে যাব শুনে তিনি জানালেন যে, একবার কলকাতা থেকে আসা তাঁর আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের তিনি হার্ট লেক দেখাতে নিয়ে গেছিলেন। তিনি সঙ্গে থাকায় তাদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা হয় নি। আগে জানলে তিনি আমাদের হার্ট লেকে যাবার ব্যবস্থা করে দিতেন, কিন্তু তাঁর হাতে এখন আর সেই সময় নেই। আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বই-এ পড়েছি যে হার্ট লেক দেখার জন্য মায়ানমারে ঢুকতে কোনও ভিসা পাসপোর্টের প্রয়োজন হয় না। তিনি বললেন এটা সবার জন্য নয়। আমাদের সাহায্য করতে না পারার জন্য তিনি আর একবার দুঃখ প্রকাশ করে বললেন— দেখুন চেষ্টা করে। যে যার ঘরে চলে গেলাম। মিজোরামে সুরাপান ও সুরা বিক্রয় নিষিদ্ধ হলেও, এই ব্যাপারে যে কড়াকড়ি গুজরাটে দেখেছি, তার ছিটেফোঁটাও এখানে লক্ষ্য করি নি। রাস্তার পাশে, এমনকী আমাদের গেস্টহাউসের আনাচেকানাচে সুরার খালি বোতলের সংখ্যাই তার সাক্ষ্য বহন করে। আজ বর্ষপূর্তির উৎসবের যা নমুনা দেখলাম, আগামীকাল সুস্থ অবস্থায় কিমা সাহেব আসলে হয়। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। নিঃশব্দ গেস্টহাউসের ব্যালকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে দূরের অন্ধকারে নানা রঙের আলোর মালা দেখছি। রাত বারটা বাজতেই শুরু হলো আতসবাজি জ্বালানো। জ্বালানো বললাম ফাটানো নয়, কারণ এরা আমাদের মতো শব্দবাজি ফাটিয়ে সকলকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ উপভোগ করার মতো এখনও হয়ে উঠতে পারে নি।
সকাল সকাল চা খেয়ে তৈরি হয়ে কিমা চন্দ্রের আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। আজ ওর সঙ্গে রেইক যাব। ফেরার পথে আইজল শহরের দ্রষ্টব্য যা যা আছে দেখে এখানেই ফিরে আসা। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, কিমা তার টাটা সুমো নিয়ে উপস্থিত হল। আমরা আর এতটুকু সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। আইজল থেকে রেইক-এর দুরত্ব উনত্রিশ কিলোমিটার মতো। কিমা জানালো রেইক পৌঁছতে ঘন্টাখানেক মতো সময় লাগবে।
সুন্দর সবুজ জঙ্গল ও ঝোপেঘেরা রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি একসময় মামিট জেলার রেইক এসে পৌঁছল। রেইক-এর উচ্চতা পাঁচ হাজার ফুটের মতো। মিজোরামের কোন অঞ্চলের উচ্চতাই খুব একটা বেশি নয়, সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা মাত্র সাত হাজার দুইশত পঞ্চাশ ফুট। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল কথাটা ভূগোল বইতে পড়তাম, এখানে এসে মালুম হল নাতিশীতোষ্ণ কাকে বলে। কী আরামদায়ক জায়গা বোঝাতে পারবো না। শুনেছিলাম রেইক একটি হেরিটেজ ভিলেজ। ছোট ছোট কুঁড়েঘর দিয়ে ঘেরা গ্রামটি সত্যিই ভারী সুন্দর। বড় বা আধুনিক স্থাপত্য বিশেষ চোখে পড়ল না। এখানে বিভিন্ন উপজাতির বাসস্থান ও তাদের ব্যবহার্য জিনিস মিজোরাম পর্যটন বিভাগের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণ করা আছে। গোটা রাজ্যটার প্রায় সমস্তটাই এখনও সবুজ জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। স্বাভাবিক ভাবে রেইক গ্রামটিতেও ঘন সবুজের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। একটা স্টেডিয়াম দেখতে পেলাম। পরিষ্কার আকাশ থাকলে এখান থেকে বাংলাদেশের কিছুটা দেখা যায়। তবে এই কুঁড়েঘরের সাম্রাজ্যে চোখধাঁধানো কাফেটেরিয়াটা দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। অনেকক্ষণ সময় রেইক-এ কাটালাম। পায়ে হেঁটে বনজঙ্গল পেরিয়ে অনেকটা পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে বেশ উঁচু একটা জায়গায় গেলাম। এখান থেকে চারিদিকের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। ফিরে এসে কাফেটেরিয়ায় ঢুকলাম। ঝাঁ চকচকে কাফেটেরিয়ায় অর্ডার দিলে খাবার তৈরি করে দেবে। সামান্য চাউ করতে চাউয়ের দামের মতোই অনেক বেশি সময় নিল। একজনও পর্যটক চোখে পড়ল না। এখানে সারা বছরে ক'জন পর্যটক বেড়াতে আসেন সন্দেহ। স্থানীয় মানুষদের এই কাফেটেরিয়ায় খাওয়ার ক্ষমতা বা স্বভাব, কোনোটাই আছে বলে তো মনে হলো না, অথচ এটাকে কী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে দেখে শেখা উচিত। এবার ফেরার পালা। আজই আমাদের আইজল শহরটা ঘুরে দেখার কথা। রেইককে সারা জীবনের মতো বিদায় জানিয়ে, আইজল শহরের উদ্দেশ্যে আমরা গাড়িতে এসে বসলাম।
আইজল-এ দেখার মতো বিশেষ কিছু আছে বলে তো মনে হল না। আর পাঁচটা পাহাড়ি শহরের মতোই। তবে আমরা যেহেতু না জেনে এক অদ্ভুত সময়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি, তার খেসারত তো আমাদের দিতেই হবে। এ যেন এক জনপ্রিয় মেগা সিরিয়াল দেখার সময় অযাচিত ভাবে গৃহস্থ বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ, অথবা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আমরা অনাহূতের মতো গাড়ি নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে কিমার সঙ্গে ঘুরলাম। কিমা-ই আমাদের বড় বাজার এবং অন্যান্য জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সন্ধ্যার পর নির্বিঘ্নে গেস্টহাউসে ফিরে এলাম। আগামীকাল আমরা চামফাই চলে যাব। যাবার পথে টামডিল লেক দেখে যাওয়ার কথা। কিমার কথানুযায়ী দূরত্ব অনেকটাই এবং রাস্তার অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয়, তাই ওকে আগামীকাল খুব ভোরে আসার কথা বলে বিদায় দিলাম। রাতে আমাদের জন্য রুটি তরকারি ও ডিমভাজার ব্যবস্থা হয়েছে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।
বেশ সকাল সকাল শেষবারের মতো কেটলি ব্যবহার করে চা ও সঙ্গে আনা টুকটাক খাবার খেয়ে গেস্টহাউসের বিল মিটিয়ে তৈরি হয়ে, কিমার আগমনের অপেক্ষায় বসে রইলাম। দেখতে দেখতে একটু বেলা হয়ে গেল, কিন্তু কিমা সাহেবের দেখা মিলল না। রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা ঘুরে এলাম, স্থানে স্থানে বনভোজনে যাওয়ার প্রস্তুতি চোখে পড়ল। আজ যদিও উৎসবের সমাপ্তি ঘটা উচিত, কিন্তু রেশ এখনও কাটেনি দেখলাম। ডানপাশ দিয়ে গেস্টহাউসের পিছন দিকে যাওয়া যায়। সম্ভবত সেখানে কর্মচারীরা থাকে। গেস্টহাউসের চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম একটা ম্যাটাডোর জাতীয় গাড়ি এসে আমাদের ঘরের ঠিক সামনের খোলা চত্বরটায় দাঁড়াল। গাড়ি থেকে দু'-চারজন নেমে গাড়ির পিছনের ডালা খুলে রেখে, ওই রাস্তা দিয়ে গেস্টহাউসের পিছনদিকে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম জনা আট-দশ লোক একটা সাদাও নয় গোলাপিও নয় রঙের তাগড়া শুয়োরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে আসছে। শুয়োরটা সর্বশক্তি দিয়ে ও ভীষণ রকম চিৎকার করে এই অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আর পাঁচটা ন্যায্য প্রতিবাদের মতো এটাও ধোপে টিকলো না। যেমন ভাবে কোন পোস্ট বা ওই জাতীয় কিছুকে, যাতে পড়ে না যায় বলে চারিদিক দিয়ে টেনে বাঁধা হয়, তাকেও গাড়িটার কাছে টানতে টানতে নিয়ে এসে ওই ভাবে চারিদিক দিয়ে শক্ত দড়ি দিয়ে টেনে বাঁধা হল। এবার একজন একটা বন্দুক নিয়ে এসে কিছুটা দূর থেকে এক গুলিতে তার প্রতিবাদ চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিল। এতোটা রাস্তা মরা শুয়োর বয়ে আনার কষ্ট লাঘব করতেই বোধহয়, এই ব্যবস্থা। এবার দড়ির বাঁধন খুলে অনেক লোকে বেশ পরিশ্রম করেই তাকে ফাঁকা ম্যাটাডোরে শুইয়ে দিয়ে, নিজেরা গাড়িতে উঠে চলে গেল। পরে শুনলাম ওরা দূরে কোথাও পিকনিক করতে যাচ্ছে। বাকি লোকেরা সেখানে আগেই চলে গেছে। সবাই মনের আনন্দে চলে গেল, শুধু কিমা চন্দ্রের আগমনের অপেক্ষায় নির্জন পুরীতে আমরা সাতজন বসে আছি।
শেষেরও তো একটা শেষ থাকে, অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমাদের কিমা সাহেব গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলেন। আমাদের কোনও কথা বলার আগেই সে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল, কোন অসুবিধা নেই, আমরা টামডিল লেক দেখে ফেরার পথে লাঞ্চ করে সোজা চামফাই চলে যাব। ও যে দয়া করে উৎসবের আনন্দ ছেড়ে এসেছে, এটাইতো সবথেকে বড় পাওয়া, সুবিধেও বলা যেতে পারে। কাজেই এরপর অসুবিধার কোন বদ গন্ধের প্রশ্ন আসতেই পারে না। রাস্তায় কোথায় খাব জানি না, রাজধানী শহর আইজলেরই এই অবস্থা, মাঝপথে ছোট জায়গায় কী পাওয়া যাবে, আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, প্রভু যীশুই জানেন। সঙ্গে অবশ্য শুকনো খাবার যথেষ্টই আছে। ভেবে লাভ নেই, "পড়েছি কিমার (মোগলের) হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।" মালপত্র গাড়িতে বাঁধাছাঁদা করে যীশু যীশু করে, এখান থেকে পঁচাশি কিলোমিটার (কোথাও আবার দেখলাম ৬৪ কিমি) দূরের টামডিল লেক হয়ে আমাদের চামফাই যাত্রা শুরু হল।

নির্মল আকাশ, আবহাওয়াও খুবই আরামপ্রদ, সবথেকে বড় কথা স্থানীয়দের উৎসব ও আমাদের দুশ্চিন্তার দিন শেষ। আমরা যেমন এক রাতের কালীপুজো পাঁচ-সাত দিন ধরে মহানন্দে পালন করি, ওরা বোধহয় এখনও আমাদের মতো অত চালাক হয়ে উঠতে পারে নি। দুপাশে সবুজ পাহাড়ি রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। আইজল থেকে চামফাই-এর দূরত্ব একশো চুরানব্বই কিলোমিটার, কিন্তু আমরা চামফাই যাওয়ার পথে প্রথমে প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার দূরের টামডিল লেক দেখে তবে চামফাই যাব। দুটো জায়গা একই পথে পড়ে কিনা, বা এর জন্য অতিরিক্ত কত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে কিমার কথায় পরিষ্কার হল না।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে একটা দোকান থেকে কিছু ফল কিনে নিয়ে, পাশের চা-কাম স্টেশনারি দোকান থেকে চা খেয়ে, কিছু কেক, বিস্কুট, জলের বোতল ইত্যাদি কেনা হল। দুটো দোকানেই মহিলা বিক্রেতা। আমরা দোকান ছেড়ে চলে আসার সময় মহিলাটি একটু হেসে বললেন, 'কেলবা।' এখানে বেশ ভাষা সমস্যা আছে, ওদের উচ্চারণও অদ্ভুত, তাই 'কেলবা' শুনে আমরা নিজেদের মধ্যে একটু হাসাহাসি করলাম। আমরা বাঙালিরা আজকাল মারবো বা প্রহার করবো কথাটা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, হয়তো ভুলেই গেছি। তার পরিবর্তে এখন যে শব্দটি ব্যবহার করি, তার সাথে মহিলার 'কেলবা'র এত মিল, যে আমরা মহিলাটি কী বলতে চাইছেন বুঝতে না পেরে, নির্ঘাত সেই বিখ্যাত শব্দটি বলছেন বলে নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় ঠাট্টা তামাশা করলাম। মহিলাটি বোধহয় বুঝতে পারলেন যে আমরা তাঁর কথার অর্থ বুঝতে পারিনি, তাই তিনি নিজেই বুঝিয়ে দিলেন যে কেলবা-র অর্থ ধন্যবাদ।
একটা জায়গায় এসে রাস্তা থেকে একটু ওপরে একটা হোটেল দেখিয়ে কিমা আমাদের জানালো যে ফিরে আসার পথে এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়ার কথা বলে আসতে। গাড়ি থেকে নেমে উপরে গিয়ে শুনশান হোটেলে কারো দেখা পাওয়া গেল না। বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর একজন এসে জানালো যে লোকের অভাব, তাই খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে না। তাকে একবার অনুরোধ করলাম শুধু চাপাটি আর একটা সবজি বানিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু ভীষ্ম তার পূর্বপুরুষ ছিলেন কী না জানি না, তবে সে তেমনই প্রতিজ্ঞা করে বসে রইল, চাপাটি সে বানাবে না, বানাবে না, বানাবে না। অগত্যা হাল ছেড়ে গাড়িতে ফিরে এলাম।
একসময় মূল রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে আমরা টামডিল লেক দর্শনে এগিয়ে চললাম, এবং টামডিল লেকের প্রবেশ দ্বারের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। আরও বেশ কিছুটা পথ এসে লেকের পাড়ে হাজির হওয়া গেল। বাঁপাশে একটা গাছে বোর্ড লাগানো। বোর্ডটি আদ্যপ্রান্ত ইংরেজি হরফে লেখা হলেও, বক্তব্য বোঝার উপায় নেই। এখন পর্যন্ত যতটুকু ঘুরলাম, প্রায় কোনও লেখারই মর্মোদ্ধার করতে পারিনি, যদিও সর্বত্রই ইংরেজি হরফে লেখা। প্রথম প্রথম ইংরেজি শব্দে নিজের পাণ্ডিত্য দেখে নিজেরই লজ্জা করবে, মা কালীর দিব্যি বলছি আমারও করেছিল। দশটা শব্দের কোনও বাক্যের অন্তত সাড়ে ন'টার অর্থ জানি না। কোনও কালে শুনেছি বলেও মনে করতে পারি না। এখানে তবু আমরা আসবো বলেই বোধহয়, বোর্ডের একবারে নীচে অপেক্ষাকৃত ছোট হরফে হলেও "INCHARGE, TAMDIL FISH SEED FARM" কথাটা লেখা হয়েছে। ওঃ! কী যে আনন্দ পেলাম, বোঝাতে পারবো না। নিজেকে কেমন সাহেব সাহেব মনে হচ্ছে। পাঁচটা শব্দের পাঁচটার অর্থই আমি জানি, একি কম কথা। কৃতজ্ঞতায় ফার্মের ইনচার্জকে মনে মনে একটা ছোট্ট করে প্রণাম ঠুকে দিলাম।

লেকটি খুবই সুন্দর ও বড়, যদিও জলের রঙ মোটেই নীল নয়, বরং একটু সবজেটে, পুকুরের জলের মতো। লেকটি "লেক অফ মাস্টার্ড" নামেও পরিচিত। এক স্বামী-স্ত্রীর চাষ-আবাদের উপাখ্যান, কিন্তু এত বলতে গেলে পাঠক-পাঠিকার ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে, তাই ইচ্ছা থাকলেও সেই প্রসঙ্গে আর গেলাম না। তবে এখানে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এই লেকটি থেকে আইজলের দূরত্ব একশো দশ কিলোমিটার। সবথেকে কাছের শহর, মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরের সাইতুয়াল।
দেখলাম দলে দলে লোক লেকের পাড়ে বনভোজন করতে এসেছে। রীতিমত জমজমাট ভিড়। সব দলের সামনেই কাঠের আগুনে রান্না হচ্ছে। আমার একটু বেশি চা খাওয়ার বদভ্যাস আছে। চারদিক ঘুরেও একটা দোকান চোখে পড়ল না। শেষে পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রত্যেক দলের হাঁড়ি-ডেকচির দিকে শকুনের দৃষ্টি বুলিয়েও, একটা চা বা কফির পাত্র নজরে পড়ল না। বড় বড় পাত্রে শুধু শুয়োরের মাংস রান্না হয়েছে বা হচ্ছে। দেখলে খাওয়ার প্রবৃত্তি হবে না। আমাদের কিমা সাহেবকে দেখলাম এর, ওর, তার পাত্র থেকে দিব্যি মাংস তুলে মুখে ফেলছে। লেকের একপ্রান্তে একটা ছোট্ট পার্ক আছে। মাঝে একটা ছোট্ট স্নান করার জায়গা। সেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে বড়দেরও জলকেলি করতে দেখলাম। হয়তো বাচ্চার বাবা-কাকা হবে। তবে পার্কটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। লেকের জলে ও পাড়ে অদ্ভুত দেখতে হাঁসের দেখাও পাওয়া গেল। লেকটি যথেষ্ট বড় হলেও, তার আয়তন জানার কোন সুযোগ পেলাম না। হয়তো কোনও বোর্ডে ইংরেজি হরফে লেখা আছে, শুধু শব্দের অর্থ না বোঝার জন্য অজানাই রয়ে গেল। আরও বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলাম। এখান থেকে চামফাই সত্যিই কতটা পথ, কিমা বা প্রভু যীশু, অথবা দুজনেই জানেন। তবে জোর দিয়ে সে কথাও বোধহয় বলা যায় না।
লেকের বাইরে এসে চামফাই-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সঙ্গে আনা কেক, বিস্কুট, কলা, টক আপেল, ডাল ভাজা, বাদাম ভাজা, ইত্যাদি দিয়ে লাঞ্চ সেরে এগিয়ে গেলাম। কিমার হয়তো বেশ অসুবিধাই হল, আমরা এখানে বোধহয় এটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে বাধ্য হলাম। গেট পেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়লাম। একসময় আসার সময়ের সেই খাবারের দোকানের পাশ দিয়ে গেলেও আর নতুন করে অনুরোধ করলাম না। দোকানদারের "যে চাপাটি করে করুক, আমি চাপাটি করব না মা" গোছের গোঁ দেখে সময় নষ্ট করতে আর ইচ্ছা হল না। পরিষ্কার রাস্তা - প্রকৃতি সর্বত্রই তার নিজের খেয়ালে, প্রাণীকুলের স্বার্থে, পৃথিবীটাকে সাজিয়ে দিয়েছেন, আমরাই খোদার উপর খোদকারি করে সেই সব নষ্ট করে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। মিজোরামে দেখলাম খুব প্রয়োজন ছাড়া প্রকৃতির ওপর হাত দেওয়া হয় নি। এ পথটার অনেকটা রাস্তাও বোধহয় এই একই কারণে কিছু করা হয় নি। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে কিমা একটা দোকানের সামনে দাঁড় করালো। কিমা ও আমরা এখানে কিছু খেয়ে নিলাম। দোকানদারের কথায় জানতে পারলাম, খাদ্যবস্তুটি আলুর পরোটা। যাইহোক পেটে তো কিছু পড়ল। কেক-বিস্কুট আর কত খাওয়া যায়। আমরা খেলেও, কিমা পারবে না।
আঁকাবাঁকা পথ ধরে, মাঝেমাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তায় নেমে একটু হাত-পা খেলিয়ে, একসময় বড় রাস্তা থেকে বেঁকে চামফাই ট্যুরিস্ট লজে এসে উপস্থিত হলাম।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


~ মিজোরামের আরও ছবি ~

অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। সেই ভ্রমণ কাহিনি তিন দশক পরে 'আমাদের ছুটি' পত্রিকায় প্রকাশের মারফত প্রথম পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু। এখন ভ্রমণ কাহিনি ছাড়াও গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লেখালেখি করছেন বিভিন্ন জায়গায়।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher