সাদা পাহাড়ের দেশের নীল নদী

মার্জিয়া লিপি


~ সোমেশ্বরীর আরও ছবি ~

সোমেশ্বরীর পাড়ে এসেই মনটা বাতাসে এলোমেলো হয়ে ভাসতে থাকে। নদী পাহাড়ের অপরূপ আরণ্যক সৌন্দর্যে বিমোহিত প্রকৃতি। মেঘ ঠেলে সূর্যের আলো এসে পড়ে সবুজ পাহাড়ে। আহা! কী স্নিগ্ধ নরম কাঁচা-পাকা সোনালি রোদ। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে দেখা যায় ভারত সীমান্তের মেঘালয় রাজ্যের মেঘে ঢাকা সাদা-নীল আকাশের নীচে জলপাই রঙের গারো পাহাড়ের উঁচু-নীচু ঢেউ এর মতো দৃশ্য। নদীর দুপাশে বিস্তীর্ণ বালুতট। সোমেশ্বরী তার স্বচ্ছ পানি আর ধুধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। সুসং ও দুর্গাপুরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী সোমেশ্বরী।
সোমেশ্বরী নদীর আদি নিবাস ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝরনাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সৃষ্টি সোমেশ্বরীর। মেঘালয়ের বঙ বাজার হয়ে রানিখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে আমাদের দেশের নেত্রকোনা জেলায় প্রবেশ করেছে। বর্তমানে নদীটির মূলধারা তার উৎসস্থলে প্রায় বিলুপ্ত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য মৌসুমে পানি প্রবাহও থাকে না। ১৯৬২ সালের পাহাড়িয়া ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে এ ধারাটি সোমেশ্বরীর মূল স্রোতধারা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বিরিশিরি, সুসং ও দুর্গাপুর। নেত্রকোনা জেলার একেবারে উত্তরে অবস্থান বিরিশিরি, সুসং-দুর্গাপুরের। পাহাড়ের পায়ের নীচে কাঁচের মতো স্বচ্ছ নদীর পাড়ে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ শুধু নয়, রয়েছে এখানে ইতিহাসের অমূল্য আকর। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সোনালি অতীতের বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রশিক্ষণের জন্য নির্মিত পিলার ও বিরিশিরি কালচারাল সেন্টার।

গারো পাহাড়ের নামানুসারে এখানকার আদিম আধিবাসীদের গারো বলা হয়। গারোদের পরিবার মাতৃপ্রধান। মেয়েরাই সংসারের হর্তাকর্তা। বিয়ের পর ছেলেরা চলে যায় শ্বশুরবাড়িতে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে উভয়েই মাঠে কৃষি কাজ করে। জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ গারো। ওয়াংলা ও কাওকারা তাদের প্রধান উৎসব। নিজেরাই তুলা থেকে সুতা তৈরি করে কাপড় বোনে এবং পোশাক তৈরি করে।
সুসং রাজ্যের গারো সভাপতি দুর্গার নাম থেকে এ এলাকার নামকরণ হয়েছে দুর্গাপুর আর সোমেশ্বরীর নাম হয়েছে রাজা পাঠক সোমেশ্বরের নাম থেকে। রাজা পাঠক সোমেশ্বর, বাইশা গারো নামের এক অত্যাচারী গারো শাসকের হাত থেকে এই অঞ্চলকে মুক্ত করেন। অশোক কাননে এক সিদ্ধপুরুষের নির্দেশে সোমেশ্বর নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং নদীটি পরিচিতি পায় সোমেশ্বরী নামে। একটি অশোক বৃক্ষ নির্দেশ করে তিনি বলেন, ''দেখ যতদিন পর্যন্ত এই বৃক্ষটি জীবিত থাকবে ততদিন তোমার রাজ্যের কোনো অনিষ্ট আশঙ্কা নেই।'' মহাপুরুষের সৎসঙ্গে ও সদুপদেশে এই রাজ্যের উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠা চিন্তা করে সোমেশ্বর তার এই নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যকে 'সুসঙ্গ' নামে অভিহিত করেন। এইভাবেই সুসঙ্গ রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন তিনি।
দুর্গাপুরে রয়েছে কিংবদন্তী সংগ্রামী বিপ্লবী মণিসিংহের বাড়ি। আদিবাসী-হাজং-গারোদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক পটভূমি দুর্গাপুর। উনিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে মহাজনদের অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে মণিসিংহের নেতৃত্বে এখানে সংগঠিত হয় টংক বিরোধী আন্দোলন।
সে আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা ছিলো 'টংক প্রথার উচ্ছেদ চাই', 'জান দিব তবুও ধান দিব না','লাঙল যার জমি তার','জমিদার প্রথার উচ্ছেদ চাই।' টংক প্রথার মূল কথা ছিল ধানে খাজনা আদায়। টাকার পরিবর্তে ধানে খাজনার প্রথা জমিদার ও জোতদারদের জন্য ছিল লাভজনক। সে কারণে কৃষকরা ত্রিশের দশকের শেষের দিকে (১৯৩৭ সাল) ধানে খাজনার বদলে টাকায় খাজনা দেওয়ার নিয়মের জন্য টংক-বিরোধী আন্দোলন করেছিল।
সুসং দুর্গাপুরে ১৯০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন মণিসিংহ। জমিদার পিতা কালীকুমার সিংহ ছিলেন প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক। স্ত্রী কৃষকনেত্রী অণিমা সিংহ। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষক সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক ও সভাপতি। মণিসিংহের বাড়িতে রয়েছে স্মৃতিসৌধ। এই জমিদারপুত্র জমিদারির স্বার্থ না দেখে, দেখেছিলেন কৃষক, গারো, হাজংদের স্বার্থ।
সেসময়ে বিদ্রোহী আদিবাসীদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় সোমেশ্বরীর কাঁচের মত টলটলে নীল পানি। ১৯৪৬ সালের শেষ দিনে বিরিশিরির ক্যাম্প থেকে আসা সশস্ত্র পুলিশ হাজংদের বাড়ি তল্লাশির সময় মেয়েরা দা হাতে পুলিশকে তাড়া করে। ভয়ে পালিয়ে গিয়ে ক্যাম্পের জনা পঁচিশেক পুলিশ নিয়ে এসে তল্লাসি শেষে কুমুদিনী নামের বিবাহিত এক হাজং নারীকে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সবাই পুলিশের দিকে বল্লম ছুড়তে থাকে। সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেয় রাশিমণি ও সুরেন্দ্র হাজং। সোমেশ্বরীর পাড়ে দু'জন পুলিশও মারা যায় সে সংঘর্ষে। তাই এই নদীর সঙ্গে মিশে রয়েছে স্থানীয়দের বেদনার স্মৃতি।

বিস্তীর্ণ বালুতট হেঁটে এসে নদীর কিনারায় এসে নৌকার অপেক্ষা। পাড়ের একপাশের সারাইয়ের জন্য পড়ে আছে মাঝারি একটি নৌকা। যাত্রী পারাপারের জন্য নদীতে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি নৌকা রয়েছে। খরস্রোতা সোমেশ্বরী। পাহাড়ের বরফ গলা স্বচ্ছ, শীতল ধারা। নদীর স্বচ্ছ পানির নীচে ছোটবড় পাথর, নুড়ি ভেসে চলছে। মহাশোল মাছের বসবাস এই সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ নীল পানিতে। টলমলে পানির নীচে পাথরের গায়ের সবুজ শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকে মহাশোল মাছ।
শিল্পীর পোর্ট্রেটে আঁকা নীল রঙের নদী সোমেশ্বরী। দূরে সবুজ পাহাড়, সাদা আসমানি নীল রঙের মিশেল আকাশে হেলান দিয়ে আছে। দেখে মনে হয়, সেই গানের কথা - যেন আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই..। সাদা মেঘগুলো পাহাড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। অপরূপ প্রকৃতিতে সোমেশ্বরীর সৌন্দর্য যোগ হয়ে অনন্য রূপ ধারণ করেছে। স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদীটির একপাশ শীর্ণ। দূরে বহু দূরে সাদা ফিতার মতো হয়ে বয়ে যায়। উঁচু-নীচু বিভিন্ন জলপাই রঙের গাছ অতন্দ্র প্রহরী হয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে হেঁটেই পার হলাম এককালের পাহাড়ি দস্যি নদী। বহু বছরের টগবগে যৌবন আজ অনেকটাই স্তিমিত। অবশ্য আষাঢ় শ্রাবণে তীব্র জল আর স্রোতের উচ্ছ্বাস এসে ভরিয়ে দেয় দুকূল। সোমেশ্বরীর তখন অন্যরকম ভয়ঙ্কর রূপ।
আমাদের এক পাশে বিস্তীর্ণ বালুচর অন্যপাশে সোমেশ্বরী নদী সাপের গতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে চলছে। ধুধু বালু রোদে ঝিকমিক করছে। বিজয়পুর সীমান্ত ফাঁড়ির দিকে গন্তব্য স্থির, রিকশা চড়ে উনিশ জনের দল। দু-তিনজন করে বেশ কয়েকটি রিকশায় পাড়ি দিচ্ছি গ্রামের পথ। আঁকাবাঁকা রাস্তা, বাঁশের ঝাড়, কোথাও ধানক্ষেত, রাস্তার মোড়ে বাঁশের টং-এ পান-বিড়ি-চা আর হরেক রকমের রঙবেরঙের মোড়কে বিস্কুট-কেক-চকলেটের বেসাতি। কাছেই রাণিখং গির্জা। মা মেরীর আর যিশুর ছবির পাশেই পাথরে খোদাই করা আছে গির্জার ইতিহাস। প্রায় একশো পঁচিশ বছরের পুরোনো এই গির্জা স্পেনের মিশনারিদের তৈরি করা। পাহাড়ের টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ময় জাগে, এত অজগাঁয়ে শতবছরের পুরোনো ইট সিমেন্টের দেওয়াল, সিঁড়ি আর পাথরের স্মৃতিচিহ্ন দেখে। সিঁড়ি ভেঙে একটু ওপরে উঠে চারপাশে তাকাতেই মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। পাহাড়-নদী-বালুতট আর গ্রামের সবুজ প্রকৃতি পেরিয়ে গির্জাটির সুন্দর স্থাপনা আর শান্ত-শীতল আমেজ বেশ নজর কেড়েছে সকলের। এই উঁচু জায়গা থেকে নেমে সীমান্তে বিজয়পুর ফাঁড়ির আশেপাশে সাদা মাটি পাওয়া যায়। আমাদের বিশাল কাফেলা এগিয়ে যায় সেদিকে। পথে একপাশে লাল শাপলার শীতল স্নিগ্ধ বিশাল এক দিঘি, পাড়ে নারকেল গাছের সারি। গারো পাহাড়ের পাশ দিয়ে বেশ অনেকদূর ছাড়িয়ে আমরা চিনামাটির পাহাড়ের দেশে।

আধাপাকা রাস্তা, কখনো বাঁশঝাড়ের মাঝদিয়ে মাটির সরু পথ পেরিয়ে প্রায় আধাঘন্টার রাস্তা শেষে দৃষ্টিসীমায় এবার সাদামাটির পাহাড়। রানিখংয়ের পাশেই বিজয়পুর সীমান্ত ফাঁড়ি, বিডিআর ক্যাম্প। এই বিজয়পুরেই রয়েছে চিনামাটির পাহাড়ের টিলা। যা দিয়ে চিনামাটির থালা, কাপ-পিরিচ-ফুলদানি ইত্যাদি তৈরি হয়। শ্রমিকরা মাটি তুলছে। হালকা বিভিন্ন রঙের মিশেল মাটি আর তা থেকে আলাদা করে রাখছে সাদামাটি। কিছু মাটি কাগজে মুড়ে সুভ্যেনির হিসেবে ব্যাগে রেখে এগিয়ে চলি স্থানীয় পুটিমারী বাজারে। পাশেই একটি সেমিনারি, খৃষ্টধর্মাবলম্বী ফাদারদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ফিরে আসার তাড়া। সূর্য মধ্য আকাশ থেকে হেলে পড়ছে পশ্চিমের দিকে। তবে ফেরার আগে বাজারে সেরে নিলাম দেশি মুরগির ঝাল ঝোলে দুপুরের খাবার। গাঢ় সবুজ আর জলপাই রঙের বনানী, দূরের নীল পাহাড় আর স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর সৌন্দর্য বুকে নিয়ে ফিরে এলাম বিরিশিরি থেকে। আবারও চা-পানি খেয়ে যাত্রা ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার পরের দিন - আকাশে ছিল এত্তো বড় এক বিশাল চাঁদ। চাঁদের রূপালী স্নিগ্ধ আলোতে শালবনের মাঝখান দিয়ে তিস্তা এক্সপ্রেসের কু-ঝিক ঝিক কু-ঝিক ঝিক শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা আর নির্জনতা ভেদ করে ফিরে এলাম ভোরের আবছা আলোতে কমলাপুর রেল ষ্টেশনে। ভাবতেই মন খারাপ লাগছিল বিভিন্ন রঙের - সাদা, গোলাপি পাহাড়, জলপাই রঙের গাছপালা, গাঢ় নীল আকাশ, পাহাড়ি কাঁচের মতো স্বচ্ছ নদী সোমেশ্বরী আর স্বপ্নলোকের যাত্রাপথে দ্রুতগামী রেলে চড়ে শালবনের মাঝখান দিয়ে এসে অবশেষে আমাদেরকে ডুবে যেতে হবে মহানগরীর কোলাহলে, জনঅরণ্যে, জনস্রোতে।


~ সোমেশ্বরীর আরও ছবি ~

লেখিকা ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া সরকারি কাজের সূত্রে এবং ভালবাসার টানে নিয়ে ঘুরে বেড়ান বাংলাদেশের আনাচেকানাচে। প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ নিয়ে সেই অনুভূতির ছোঁয়াই ফুটে উঠেছে তাঁর কলমে। প্রকাশিত বই 'আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন।'

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher