ম্যান্ডেলার দেশ সাউথ আফ্রিকায়

শ্রাবণী ব্যানার্জী


~ সাউথ আফ্রিকার আরও ছবি ~

বহুদিন ধরেই সাউথ আফ্রিকা যাওয়ার একটা বাসনা ছিল। কিছুদিন আগে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সেখানে যাওয়ার একটা সুযোগ ঘটে গেল, সেটা হাতছাড়া করলাম না।
প্লেনে যেতে যেতে ভাবছিলাম, এক অদ্ভুত দেশ এই সাউথ আফ্রিকা - যে দেশে তিনটি রাজধানী আবার লোকজনও নাকি এগারোটা ভাষায় কথা বলে। আফ্রিকাতে অবস্থিত হয়েও এখানে সাদা-কালো-বাদামী, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সবাই দিব্যি মিলেমিশে একসঙ্গে থাকে অথচ কে বলবে মাত্র পঁচিশ বছর আগেও এ দেশটির ছিল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। যদিও মহাত্মা গান্ধীর এ দেশে একুশ বছর বাস ও জাতির জনক নেলসন ম্যান্ডেলার কল্যাণে সাউথ আফ্রিকার ইতিহাস আজ অনেকেরই জানা। তবুও সেটিকে সংক্ষেপে আর একবার ঝালিয়ে নিতে ক্ষতি কী? তাহলে আসুন প্লেনে সে দেশে পৌঁছানোর আগেই সে কাজটা সেরে ফেলি।
পশ্চিমদিক দিয়ে ভারতবর্ষ যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে 'কলম্বাস' চোদ্দশো বিরানব্বই-এ একেবারে আমেরিকার মত একটি নতুন মহাদেশই আবিষ্কার করে ফেললেন। তখন সব ইউরোপিয়ানদের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষ। তাহলে মশলার ব্যবসা করেই রাতারাতি বড়লোক হওয়া যাবে! তাই কলম্বাসের দেখাদেখি মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে পর্ত্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামারও ধারণা হয়ে গেল তিনিও আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষ যাওয়ার একটি পথ বার করে নিতে পারবেন। আফ্রিকার উপকূল ধরে ধরে চলতে চলতে একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে আজকের কেপটাউন অঞ্চলটি ঘুরে একসময় তিনি কেনিয়াতে পৌঁছে যান। সেখানেই 'আহমেদ ইবন মজিদ' নামে এক নাবিক ওঁকে ভারতবর্ষ যাওয়ার সঠিক পথটি দেখিয়ে দেয়। ভারতবর্ষের বস্ত্র আর মশলা ইউরোপে বেচে ভাস্কো-ডা-গামা এতটাই লাভবান হয়েছিলেন যে তার পর থেকে সেই একই রাস্তা ধরে দলে দলে ইউরোপীয়ান ভারতবর্ষে আসতে শুরু করে। বলাবাহুল্য তখনও শর্টকাট করার জন্য মানুষ নির্মিত 'সুয়েজ' ক্যানালের জন্ম হয়নি তাই এই সুদীর্ঘ পথে নতুন করে রসদ তোলার জন্য মাঝপথে সাউথ আফ্রিকার কেপটাউন জায়গাটিকে বেছে নিত নাবিকেরা। খাবার জাহাজে তুলতে গেলে সেই জায়গায় চাষ-আবাদ করাটা আবশ্যক। অতএব সেই সুযোগে হল্যান্ড থেকে বহু কৃষক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। আজ আমরা তাদের বলি বোয়ারস অর্থাৎ ডাচ ভাষায় কৃষক।
আজকের 'কেপটাউন' জায়গাটি ছিল স্থানীয় উপজাতি 'খোশা'দের বাসস্থান। বন্দুকের সামনে তীর ধনুকের দাঁড়ানো সম্ভব নয় তাই ডাচরা অতি সহজেই তাদের হারিয়ে, হাতেপায়ে শিকল লাগিয়ে এই কালো মানুষগুলিকে চিরকালের তরে দাস বানিয়ে দেয়। সাদারা এদেরকে গরুভেড়ার পর্যায়েই মনে করত কিংবা তারও অধম। 'খোশা' বা স্থানীয় 'ব্যুশম্যান'দের তাক করে গুলি করার জন্য লাইসেন্স পাওয়া যেত কারণ শ্বেতাঙ্গদের কাছে সিংহ শিকারের মত এটাও ছিল দারুণ স্পোর্টস। নেলসন ম্যান্ডেলা ও টুটু-ও এই খোশাদেরই একজন ছিলেন। ডাচদের পর কিছু ফরাসী ও জার্মানরাও এসে এ দেশটিকে পাকাপাকিভাবে নিজেদের বাসস্থান করে নেয়।
আঠারোশো পনেরো সালে ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যুদ্ধচলাকালীন চালে ভুল করে ডাচরা ইংরেজদের বদলে ফ্রান্সের নেপোলিয়ানকেই সাপোর্ট করে বসে। তারা ভেবেছিল নেপোলিয়ানের বাহিনীকে কখনওই ব্রিটিশরা হারাতে সক্ষম হবে না। এর ফল কিন্তু হল বড় সাংঘাতিক। অর্থাৎ নেপোলিয়ানকে পরাস্ত করার পরপরই এদের শায়েস্তা করতে ইংরেজরা এসে সাউথ আফ্রিকার ডাচ অধ্যুষিত জায়গাগুলি প্রায় রাতারাতিই দখল করে নিল। ডাচরা না বুঝতো ইংরেজদের ভাষা, না তাদের আইন কানুন। তাতে আবার আঠারশো তেত্রিশ সালে ইংরেজরা তাদের সব কলোনি থেকে দাসত্ব প্রথা তুলে দেওয়ায় ডাচরা বাধ্য হয়ে সব লটবহর ও খোশা দাসদের নিয়ে নতুন বাসস্থানের খোঁজে উত্তর দিকে হাঁটা দেয়। ইতিহাসে যার নাম 'গ্রেট ট্রেক।' আমরা যে ট্রেকিং করতে যাওয়া বলি সেটি এই ডাচ শব্দ থেকেই এসেছে যার মানে 'ট্যু ট্রাভেল।' উত্তরের এই জায়গাগুলি ছিল স্থানীয় 'জুলু' উপজাতিদের বাস। কিছু দিনের মধ্যেই ডাচরা প্রায় হাজার তিনেক জুলুকে বন্দুকের ঘায়ে খতম করে ও বাদবাকিদের দাস বানিয়ে তাদের জায়গাতেই পাকাপাকিভাবে বসতি স্থাপন কর। এই ভাবেই আজকের সাউথ আফ্রিকার দক্ষিণদিক ব্রিটিশ ও উত্তরটি ডাচদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেল।
"I contend that we (The English) are the first race in the world and the more of the world we inhab it, the better it is for the human race." ইংলিশম্যানদের এই অহংকারই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর সেই মান রাখতে তারা অনেক ভালো কাজও করেছিলেন। আজও পৃথিবীর মেধাবী ছেলেমেয়েদের ফ্রিতে অক্সফোর্ড পড়ার জন্য যে বিখ্যাত 'রোডস' স্কলারশিপটি দেওয়া হয় সেটি এনারই অবদান। আজকের জিম্বাবুয়ে দেশটিও ওঁর নামেই ছিল তখন তাকে বলা হত 'রোডেশিয়া'। এই অহংকারের জোরেই রোডস ঠিক করে ফেললেন ইজিপ্ট তো ব্রিটিশ কলোনি আছে তাই একেবারে দক্ষিণের কেপটাউইন থেকে উত্তরে ইজিপ্ট পর্যন্ত সোজাসুজি ট্রেন লাইন টেনে দিতে পারলেই কেল্লাফতে, তাহলে মধ্যিখানের সব জায়গাই ব্রিটিশদের হাতে চলে আসবে। অগত্যা ডাচরা আর সহ্য করতে না পেরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়, প্রথমে বোয়ারের যুদ্ধে জিততে পারলেও দ্বিতীয় যুদ্ধে তারা ব্রিটিশদের কাছে হেরে যায়। অবশেষে উনিশশো দুই সালে ডাচরা ব্রিটিশদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনা করে দুটি শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় একসঙ্গে মিলেমিশেই এদেশে রাজত্ব করতে থাকে।
কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থা কিন্তু যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই উপরন্তু উনিশশো আটচল্লিশ সালে তার সঙ্গে যোগ হল অ্যাপারটহাইটের যাকে বলে অ্যাপারটেন্স। সাদা ও কালোদের জায়গা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেল। তারা এক বাসে চড়তে পারবে না এমন কি এক সীবিচ বা স্কুল রেস্টুরেন্টেও ঢুকতে পারবে না। এর প্রতিবাদে যে কৃষ্ণাঙ্গরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন 'নেলসন ম্যান্ডেলা', 'টমবো', 'সিসুলু' ও 'সোবুকোয়ে'র মত লোকজন যারা একত্রে বলে উঠেছিলেন - 'There is only one race, The human race'। রোভেনিয়া ট্রায়ালের পর এদের প্রায় সবাইকেই দ্বীপান্তর অর্থাৎ কেপটাউনের কাছে রবেন আইল্যান্ডে চালান করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সাতাশ বছর সশ্রম কারাদন্ডের মধ্যে এই রবেন আইল্যান্ডেই ম্যান্ডেলা আঠারো বছর কাটিয়েছিলেন। অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে ও এদেশের প্রেসিডেন্ট ডিক্লার্কের সহায়তায় উনিনশো নব্বই সালে ম্যান্ডেলা মুক্তি পান ও তিরানব্বই সালে এনাদের দুজনকেই যুগ্মভাবে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হয়।
স্বাধীনতা হাতে আসার পরও এত বছরের অমানুষিক অত্যাচারের বদলা নিতে কৃষ্ণাঙ্গরা যে ধেয়ে আসেনি তার প্রধান কারণ শুধু ম্যান্ডেলার শান্তির বাণী নয়, তার সঙ্গে আর একজনও যোগ দিয়েছিলেন তিনি হলেন আর্চবিশপ 'ডেসমন্ড টুটু'। যে ভাবেই হোক লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন - না রক্তের বদলে রক্ত নয়, শত্রুদের ক্ষমা করে তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দাও। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন – "If you want to make peace with your enemy you have to work with your enemy. Then he becomes your partner" উনিনশো চুরানব্বই সালে কৃষ্ণাঙ্গরা প্রথম ভোটাধিকার পেয়ে ম্যান্ডেলাকেই প্রেসিডেন্টের পদে বসায় আর তার পাঁচ বছর পর তিনি নিজেই সে পদ থেকে সরে যান। দুহাজার তেরো সালের ডিসেম্বরে নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু হয়। তাঁর লেখা 'লং ওয়াক ট্যু ফ্রিডম' বইটি আজ পৃথিবী বিখ্যাত।
জানলার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে আমাদের প্লেনযাত্রাও প্রায় শেষ হবার মুখে। জোহানসবার্গে নেমে কাস্টমস-এর ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেই আর একটি প্লেনে করে সোজা রওনা হলাম কেপ টাউনের দিকে। কথাতেই আছে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। এয়ারপোর্টে নেমে বুকে ব্যাজ লাগানো দুটি মেয়েকে দেখে তাদের ভাষাতেই সম্ভাষণ করে বললাম 'মলো' অর্থাৎ হ্যালো। এই শব্দটি জানার একটি সুবিধা হল শুধু হ্যালো নয়, এটি সুপ্রভাত থেকে শুভরাত্রি সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায়। ইংরেজদের মত বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কখনও গুড মর্নিং বা কখনও গুড আফটারনুনের ঝামেলায় পড়তে হয় না। মেয়েদুটি আমার ভুল সংশোধন করে বলল একজনকে সম্ভাষণ করলে বলবে 'মলো' কিন্তু আমরা একের অধিক আছি তাই তোমাকে বলতে হবে 'মলোয়েনি।' একজনকে কেমন আছ জিজ্ঞাসা করলে বলব 'উনজানি' আর একের অধিক হলেই সেটি হয়ে যাবে 'নিনজানি।' এই ভাষায় দুইয়ের কোন স্থান নেই অর্থাৎ একের অধিক হলেই সেটি বহু। এই ইতালিয়ানদের মতো 'নিনি' ঝংকারগুলি হয়তো কানে মধুরই ঠেকত যদি না তার সঙ্গে এই অদ্ভুত ক্লিক ক্লিক শব্দগুলি যুক্ত হত। এইভাবে কথা বলার কারণ, একসময় খোশারা ছিল শিকারীর জাত তাই এই অদ্ভুত শব্দগুলি শুনলে জানোয়াররা সচেতন হত না, ভাবতো তাদেরই জাতভাইরা আশে পাশে ঘুরছে সেই কারণে শিকার ধরতে সুবিধা হত। সাধে কি ডাচরা এদের নাম দিয়েছিল 'হটেনটট!' জিভ উল্টিয়ে সারাক্ষণই যেন মুখ দিয়ে ঘোড়ার খুরের মত আওয়াজ করে যাচ্ছে।
বেলা তিনটের আগে হোটেলের ঘর তৈরি হবেনা বলে বাস ড্রাইভার আমাদের সারা কেপটাউনই ঘোরাতে শুরু করল। চারদিকে পাহাড়, রাস্তার দুধারে তালগাছের সারি, সমুদ্র ও সাজানো বাড়িঘর নিয়ে এটি এককথায় ভারি সুন্দর শহর। এক সময় আমাদের পেঙ্গুইন দেখানোর জন্য বাসটা সোজা সমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়াল। এদের সাইজ খুব বড় নয় কিন্তু চালচলন দেখার মত। কখনও দেখে মনে হয় তারা একসঙ্গে বসে জটলা করছে আর কখনও বা যেন দুই বন্ধুতে দিব্যি গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছে। সাইজে ছোট হলে কী হবে ক্ষমতার দিক থেকে একেবারে ধানি লঙ্কা। সমুদ্রে কুড়ি কিলোমিটার বেগে সাঁতরে মাছ ধরা প্র্যাকটিস থাকায় কাছে গিয়ে ছবি তুলতে গেলে সেই একই স্পিডে লোকজনের দিকে তেড়ে আসছে। অগত্যা মানে মানে সরে পড়লাম। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমাদের বাস পাহাড় ঘেঁষে দুধারে আঙুরখেতের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করল। নেপোলিয়ানকে যুদ্ধে হারিয়ে ব্রিটিশরা যখন তাকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপ চালান করে দেয়, তিনিও নাকি এই কেপটাউনের 'কনস্টানটিয়া' ওয়াইন ছাড়া আর কিছু মুখে তুলতে পারতেন না। যতই হোক নেপোলিয়ান বলে কথা! যে সে বন্দী তো নয় যে যা জুটবে তাই সোনামুখ করে পান করবে। বাইজান্টাইন সম্রাট কনস্টান্টিনের মেয়ের নামে পরিচিত এই ওয়াইনটিকে তিনি ফরাসী ওয়াইনের থেকেও বেশি পছন্দ করতেন বলে ফরাসীরা নাকি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। এই ভাবেই একসময় ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বাস শহরে ঢুকে পড়ল। এই ঝকঝকে জমজমাটি রাস্তাগুলি দেখলে কে বলবে এগুলো একসময় সমুদ্রের তলায় ছিল! ডাচদের এই ব্যাপারে জুড়ি নেই তারা সমুদ্রে বালি ফেলে রাস্তা তৈরি করে শহরকে সুন্দর করে সাজায়। এখানকার লংস্ট্রিটকে আমাদের পার্কস্ট্রিটের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে কারণ সন্ধ্যা হলেই এখানে লোকজন পার্টির আনন্দে মেতে ওঠে। পার্টি বলে পার্টি! লংস্ট্রিটের কাছে আমাদের পার্কস্ট্রিট নিতান্তই শিশু। রেস্টুরেন্ট বা বার তো ছেড়েই দিন মায় রাস্তাতেও তারা যেভাবে জামা উড়িয়ে নেচে নেচে হল্লা করছিল দেখলে দস্তুর মত হৃৎকম্প হয়।
বেলা দুটো নাগাদ বাস ভিক্টোরিয়া হারবারে গিয়ে হাজির হল যাতে মধ্যাহ্নভোজনটি আমরা সেখানেই সেরে ফেলতে পারি। গাইড মহম্মদ খান ওরফে M.K. আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল তোমরা আমেরিকানরা যেন ভাল ভালো ভালো সামুদ্রিক মাছ বা চিংড়ি দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়ে 'ও মাই গড, সো চিপ সো চিপ' বলে চিল্লিয়ে উঠো না। মনে রেখো এটা আমাদের দেশ আর এখানেই আমাদের থাকতে হবে। জলের ধারে ভিক্টোরিয়া হারবারটি এতটাই জমজমাট যে দেখলে মনে হয় সারাক্ষণই যেন মেলা বসেছে। কেউ রঙবেরং-এর জামাকাপড় পরে বাজনা বাজাচ্ছে, কেউ কেউ বা সেই তালে তাল মিলিয়ে নেচে যাচ্ছে। কোনও কোনও বাচ্চা দেখি গালে সিংহ এঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশেষে একটি সীফুড রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার অর্ডার দেওয়ার সময়ে সাবধানবাণীর মর্মটি বুঝলাম তা না হলে আমিও হয়তো 'চিপ চিপ' বলে গগন কাঁপাতাম। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি সেই প্রথমদিনটি থেকে তারপর যে বারোদিন আমরা দেশটিতে ছিলাম একদিনের জন্যও খারাপ রান্না বা খাবার খেয়েছি বলে মনে করতে পারিনি। গাইড আমাদের হেসে হেসে বলল — চিনে, ভারতীয়, ইন্দোনেশিয়ান, ডাচ, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও লোকাল খোশাদের কম্বিনেশনে আমাদের দেশে যে অনবদ্য খাবারগুলি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আর আমাদের আলাদা করে ফ্যিউশন কুকিং শিখতে হয়নি।
পরের দিন সকাল বেলা গেলাম ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট সেই বিখ্যাত ক্রীস্টেনবস বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে। ডাচরা এই বাগানটি প্রথমে তৈরি করলেও পরে এটিকে সেই সেই বিখ্যাত ইংলিশম্যান রোডস কিনে নিয়ে আরও সুন্দর করে সাজান। টেবিল মাউন্টেনের ঢালে ধাপে ধাপে অভিনব গাছ ও ফুল দিয়ে সাজানো বাগানটি দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। আমাদের গাইড নিজেকে 'রেনবো মিশ' বলে পরিচয় দিল কারণ তার শরীরে নাকি ডাচ, মালয়েশিয়ান, কাশ্মিরী মুসলমান ও স্থানীয় খোশাদের রক্ত বইছে। বাস্তবিক এদেশের মাটিতে পা দেবার পর থেকেই সাদা, কালো ও বাদামীদের সংমিশ্রণে এতরকম চেহারা বা রং-এর শেড চোখে পড়েছে যে এশিয়ান পেন্টসও বোধহয় হার মানতে বাধ্য হবে। মিশ জানিয়ে দিল কেপটাউনে অনেক মসজিদ থাকলেও এখানকার মুসলমানরা আদৌ গোঁড়া নয় আর তাদের মেয়েরাও রাস্তায় বোরখা পরে ঘোরে না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলার সবথেকে স্মরণীয় ঘটনা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত লাংগা টাউনশিপের 'লেলাপা' রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া। বহুবছর আগে এই রেস্টুরেন্টের মালিক 'পোংগোজি' হোটেলে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি কাগজ কুড়িয়ে পায়, যেটা আগের রাত্রে সেখানে থাকা সাদা দম্পতির রেস্টুরেন্টে সামান্য ওয়াইন ও চীজ খাওয়ার রসিদ। দামটা দেখে সে অত্যন্ত চমকে ওঠে। এটা কী করে সম্ভব? সারা মাস হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সে যে মাইনেটা পায় সেটা কিনা সামান্য একটু ওয়াইন আর চীজের দাম? স্বাধীনতা পাওয়ার পর তাই সে নিজের এই ছোট্ট বাড়িটিতেই এই রেস্টুরেন্টটি খোলে আর তার সঙ্গে যোগ করে আফ্রিকান নাচ, গান ও বাজনা। একটি কালো ছেলে যেভাবে মাথা নীচে ও বডি ওপরে করে অর্থাৎ আপসাইড ডাউন হয়ে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল যে অনেকেই দেখলাম খাওয়া ভুলে সেই দিকেই পিটপিট করে চেয়ে আছে। ড্রাম পেটানোর ব্যাপারেও আফ্রিকানদের কোনও জুড়ি নেই। এ এমনই এক ছন্দ কচ্ছপও বোধহয় কোমর দোলাতে বাধ্য হবে। ব্যুফেতে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে 'প্যাপও' সেখানে বিদ্যমান কারণ আমাদের ভাতের মত এই নুন দিয়ে ভুট্টা বাটাটাই এদের প্রধান খাদ্য। এই ভুট্টার সঙ্গে আবার আলু মেশালে তার নাম হয়ে যায় উমুসা। ভারতীয়দের কাছ থেকে শিখছে কিনা জানি না একটি খাবার খেয়ে মনে হল পুরোপুরি বাঙালি ঘুগনি খাচ্ছি আর টমেটো বাঁধাকপির কচুম্বাটিও আমাদের বাঁধাকপির ঘন্টেরই নামান্তর।
পরের দিন সদলবলে কেবিলকার নিয়ে টেবিল মাউন্টেনের ওপরে উঠলাম। নীচ থেকে দেখলে মনে হয় যেন এক হাজার মিটার উচ্চতায় একটি বড়সড় টেবিল দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় উঠে সারা কেপটাউন, রবেন আইল্যান্ড ও চারিদিকে নীল সমুদ্র দেখে মনে হচ্ছিল ঘন্টার পর ঘন্টা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকি।
কেপটাউনে অত্যন্ত চড়া রঙবেরঙের বাড়িতে ভর্তি একটি জায়গার নাম 'বোক্যাপ'। এই রঙের কারণ হল উনিনশো ছেষট্টি সালে মুসলমান অধ্যুষিত এই জায়গাটিকে সরকার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় হেরিটেজ সাইটের কাছে বলে তারা যেন বাড়িতে সাদা রং করে। রাগের চোটে মুসলমানেরা সাদা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে যতরকম উগ্র রং আছে সব দিয়েই বাড়িগুলি রঙ করে নেয় যা কিনা এখন একটি ট্যুরিস্ট স্পট। এই তল্লাটের 'ডিস্ট্রিক্ট সিক্স' মিউজিয়ামটিও একটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পড়ে। প্রায় একই সময়ে কালো ও এশিয়ান অধ্যুষিত এই জায়গাটিতে সাদারা এসে প্রায় ষাট হাজার বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এর লোকেশনটা দুর্ধর্ষ তাই সাদা ছাড়া অন্য চামড়ার লোকেদের সেখানে কোনও স্থান নেই, কারণ সে সময়ে যা কিছু ভালো তা সবই ছিল শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত। মিউজিয়ামে রাখা একটি 'ইউরোপিয়ান ওনলি' লেখা বেঞ্চে আমায় বসতে দেখে মজা পেয়ে আমাদের গ্রুপেরই একটি সাদা ছেলে আমার বেশ কয়েকটি ছবি তুলে ফেলল। এখনও ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে নিদর্শনস্বরূপ হোয়াইট ওনলি বেঞ্চ দেখতে পাবেন, অর্থাৎ মাত্র পঁচিশ বছর আগেও সাউথ আফ্রিকা কেমন ছিল যাতে লোকজন এসে দেখতে পারে। পরের দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা এখান থেকে বারো কিলোমিটার দূরে 'রবেন আইল্যান্ড' যাবার লঞ্চ ধরলাম। নেলসন ম্যান্ডেলার দীর্ঘ সাতাশ বছর জেলে কাটানোর মধ্যে আঠারো বছর এখানেই দ্বীপান্তরেই কাটে। সাংঘাতিক উত্তাল সমুদ্র তাতে আবার দেখলাম বেশ কিছু তিমিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। রবেন আইল্যান্ডে পৌঁছে ম্যান্ডেলার ঘরের সাইজ দেখেও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। অত্যন্ত সরু এক ফালি ঘরে মাটিতে চটের বিছানা আর তার পাশে প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য একটি বালতির ব্যবস্থা। প্রথম দিকে ওঁকে চেনে বেঁধেই রাখা হত আর প্রতিবাদ করলে জুটতো চাবুকের আঘাত। সেদিন সবথেকে স্মরণীয় ঘটনা হল একদা ম্যান্ডেলার প্রিজন গার্ড 'ক্রিস্টো ব্র্যান্ড' এর সঙ্গে আলাপ হওয়া। তাই আমার কাছে তখনকার ঘটনাগুলি না শুনে আসুন ক্রিস্টোর মুখ থেকেই পুরো ব্যাপারটা শোনা যাক।

একদিন দেখি লোকটা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও দিব্যি গুন গুন করে গান গাইছে। কি গান জিজ্ঞাসা করাতে বলল 'এটাকে বলে জ্যাজ, আমেরিকার কালো ক্রীতদাসরা এই গান গাইতো'। তার কয়েকদিন পরেই দেখি টিমটিমে আলোয় কী সব বই পড়ছে। আমায় বলল 'এগুলো মহাত্মা গান্ধীর লেখা বই আর এগুলো না থাকলে আমি বোধহয় এতদিনে পাগলই হয়ে যেতাম'। এদিকে আমি খালি ভাবতাম এত পাজি লোক অথচ দ্যাখ চালচলনে কিছুই বোঝার উপায় নেই। এইভাবেই কী করে জানি না নিজেদের অজান্তেই আমরা এক সময়ে বন্ধু হয়ে গেলাম। বিয়ের পর আমার বউয়ের হাতে তৈরি কেকও ওঁকে লুকিয়ে এনে খাইয়েছিলাম। একবার দেখি ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী 'উইনি' প্রচন্ড গরমের মধ্যেও একটি মোটা কম্বল জড়িয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মধ্যিখানে কাঁচের ব্যবধান থাকায় ওঁরা একে অন্যকে ছুঁয়ে দেখতে পারতেন না। একসময় খেয়াল করলাম উইনি ম্যান্ডেলা আমাকে ইশারায় কম্বলের ভেতরটা দেখতে বলছেন। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দেখি সেখানে একটা খুব ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। আমি তো দেখে তাজ্জব। আমাকে কাকুতি মিনতি করলেন এক মুহুর্তের জন্য হলেও তাদের প্রথম নাতিটিকে আমি যেন একবার ম্যান্ডেলার হাতে তুলে দিই। ধরা পড়লে আমার কঠিন শাস্তি হবে তবুও চোখের জল দেখে থাকতে না পেরে একসময় ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে তুলে ম্যান্ডেলার ঘরে ঢুকে তার হাতে দিয়ে দিলাম। উনি মিনিট খানেকেই মাত্র বাচ্চাটিকে ধরতে পেরেছিলেন কারণ তার থেকে বেশিক্ষণ দেওয়ার সাহস আমার ছিলনা। শিশুটিকে কোলে নিয়ে ওঁর কান্না দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম! পরে আমায় বলেছিলেন – জানো তো আমি আমার নিজের বাচ্চাদের কোনও দিন বড় হতে দেখিনি, তাই নাতিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণের জন্যও আমার সেই সাধ মিটেছিল।
রবেন আইল্যান্ডের পর অন্য দুটি জেলে ম্যান্ডেলার আরও ন-বছর কাটে আর আমিও তার পিছু পিছু ওঁর গার্ড হয়ে যাই। শেষ কয়েক বছর ওঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় তখন আমরা দুজনে একসঙ্গে টেনিসও খেলতাম। প্রথমদিন রান্নাঘরে ঢুকে চিৎকার করে বলেছিলেন – তোমাদের কত টাকা তোমরা রান্নাঘরেও টেলিভিশন রাখো। ভুল ভাঙ্গিয়ে বলেছিলাম এটা টিভি নয়, একে বলে মাইক্রোওয়েভ। এ দেশের প্রেসিডেন্ট হবার পর ম্যান্ডেলা আমার ছেলের চাকরি করে দেন আর সেই ছেলের যখন মোটর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়, দেখি প্রেসিডেন্ট নিজে এসে আমার ছোট্ট বাড়িটার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন – 'আমার প্রথম সন্তানটি যখন মারা যায় তখন জেলখানা থেকে সামান্য কয়েক ঘন্টার ছুটি চেয়েছিলাম যাতে একবার শেষ দেখা দেখতে পারি কিন্তু সে সময়টুকুও আমায় কেউ দেয়নি। আমি তাই নিজে এসেছি তোমার সঙ্গে দেখা করতে কারণ সন্তান হারানোর শোক সব রঙের মানুষের বুকেই সমানভাবে বাজে।' আমার সন্তানের মৃত্যুতে আনন্দ পেয়ে সেদিন ওয়ার্ডেনটি হেসে হেসে বলেছিল – মিঃ ম্যান্ডেলা তোমাকে একটা দারুণ সুখবর দিতে এসেছি তোমার প্রথম সন্তানটি গতকাল মারা গেছে, তাই যদি কোনওদিন জেল থেকে ছাড়া পাও তাহলে একটা বাচ্চাকে অন্তত কম খেতে দিতে হবে। সেই দুঃখের দিনেও চেনে বাঁধা অবস্থায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে রবেন আইল্যান্ডের চুনাপাথরের খনিতে আমায় সারাদিন পাথর ভাঙতে হয়েছে।'

আজ অনেকেই ম্যান্ডেলাকে গান্ধীজির সঙ্গে তুলনা করেন। গান্ধীজির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা থাকলেও ওঁর সত্যাগ্রহকে ম্যান্ডেলা কিন্তু সব সময় মেনে নিতে পারেন নি কারণ দুজনের পরিস্থিতি ঠিক এক ছিল না। সাউথ আফ্রিকাতে একুশ বছর থাকাকালীন গান্ধী যে চারবার জেলের মুখ দেখেছিলেন তার মধ্যে একবার সাত মাসের বাদ দিলে কোনটাই সশ্রম কারাদন্ড ছিল না, উপরন্তু তাদের মেয়াদও ছিল মাত্র মাস দুয়েকের। যে দেশ একসময় শুধুমাত্র গায়ের রঙের মাপকাঠিতেই মানুষ বিচার করত তাদের কাছে গান্ধী ছিলেন বাদামী অর্থাৎ ওঁর স্টেটাস ছিল সাদা কালোর মাঝামাঝি। সে সুবাদেই কালো মানুষগুলির ধারে কাছে নৃশংসতাও তাকে বা অন্য ভারতীয়দের সহ্য করতে হয় নি। ভাবতে অবাক লাগে গান্ধীজী নিজেও কিন্তু এই গায়ের রঙ এর থিয়রিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। কালোদের সম্বন্ধে লিখেছিলেন – "Kaffirs are as a rule uncivilized the convicts even more so. They are troublesome, very dirty and live almost like animals." সাদাদের সম্বন্ধে উনিনশো তিন সালের চব্বিশে সেপ্টেম্বরে লেখা গান্ধীজীর উক্তিটি একটু খেয়াল করুন – "We believe also that the white race of South Africa should be predominating race." আমেরিকাতেও একসময় কালো ক্রীতদাসদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করা হয় তার কিছুটা বিবরণ 'আঙ্কেল টমস কেবিন' বইটি থেকে পাই।
জেলেও ভারতীয়দের থাকা খাওয়া ছিল কালোদের তুলনায় অনেক উন্নত। দিনের পর দিন পিঠে চাবুক, পায়ে শিকল, সারাদিন অসহ্য গরমে পাথর ভাঙা বা ভাতের ফ্যান খেয়েও গান্ধীজীকে বছরের পর বছর জেলে কাটাতে হয় নি। তাই কৃষ্ণাঙ্গরা যখন এই অত্যাচার ও অবিচার সহ্য করতে করতে এক সময়ে ক্ষেপে উঠেছিল তখন ম্যান্ডেলা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন --- "When the waters start boiling it is foolish to turn off the heat." উনি মনে করতেন হাতে কিছুটা স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত অহিংসার বাণী প্রচার করা উচিত নয়। স্বাধীনতা পাবার পরই তিনি গান্ধীজীর মতে মত দিয়ে দেশের লোককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন – না প্রতিহিংসা নয়, কারণ ' An eye for an eye will make the whole world blind.'
পরের দিন গিয়েছিলাম কেপটাউন থেকে পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে ওয়াইন ল্যান্ড ট্যুরে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে আঙুরের চাষ আর তার কাছেই এক একটি ওয়াইন তৈরির কারখানা। আমাদের প্রত্যেকের সামনেই রাখা ছিল চারটে করে ওয়াইনের গ্লাস। তাতে কিছুটা করে ওয়াইন ঢেলে সামনে একটি করে চকোলেট সাজিয়ে গাইড বলল, বাঁদিক থেকে শুরু করতে হবে। প্রতিটি ওয়াইন পান করার আগে তার সামনে রাখা চকোলেটটিকে ভালো করে শুঁকে না নিলে ওয়াইনের আস্বাদই নাকি অনুভব করা যাবে না। আমার পাশে বসা ছেলেটির চকোলেটে এ্যালার্জি শুনে অত্যন্ত খুশি হয়ে নিজের সঙ্গে তারটিও স্পিডে গলাদ্ধকরণ করেছিলাম, এমন সময় গাইড একেবারে হাঁ হাঁ রবে আমার দিকে তেড়ে এল। আমি নাকি বাঁ ডান এর সিকোয়েন্স ফলো না করেই ভুলভাল চকোলেট শুঁকে ভুল ওয়াইন পান করছি। এরও যে এতরকমের নিয়ম আছে তা কে জানত!
বিকেলে কেপটাউনের একটি বস্তির স্কুল দেখতে যাই। গভর্মেন্ট থেকে বস্তিগুলিকে ভেঙে সেই জায়গায় তাদের থাকার জন্য সুন্দর ফ্ল্যাট তৈরি করে দিচ্ছে। বাচ্চারা দেখলাম পোলারয়েড কামেরাতে তোলা নিজেদের ছবিগুলি হাতে পেয়ে একেবারে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেওয়াতে কেউ কেউ নিজেদের টিফিনের থেকেও আমাকে ভাগ দিতে এসেছিল। একজন সাদা টিচার দেখতে পেয়ে হেসে তাদের সরিয়ে নিয়ে গেল। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, এই গরীব কালো বাচ্চাগুলিকে কিন্তু সাদারাই পড়ানো বা গান-বাজনা শেখানোর ভার নিয়েছে। পঁচিশ বছরে কী অসামান্য পরিবর্তন! বাচ্চারা যে ভাবে তাদের সাদা টিচারদের জড়িয়ে ধরে বসেছিল তাতে আর যাই হোক সেটিকে আমার অভিনয় বলে মনে হয় নি।
শেষের দিন সকালেই 'কেপ অফ গুড হোপ' এর দিকে রওনা হলাম। এখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে তারপর জোহানাসবার্গের প্লেন ধরার পালা। এ হল সেই বিখ্যাত 'কেপ অফ গুড হোপ' যা কিনা ভাস্কো-ডা-গামার দৌলতে সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমাদের সবার জানা। এটি এখন ন্যাশনাল পার্কের মধ্যেই পড়ে যেখানে অজস্র বেবুন ও অস্ট্রিচ দেখা যায়। সারা সাউথ আফ্রিকা জুড়েই বড় বড় কারুকার্য করা অস্ট্রিচের ডিম বিক্রি হয় যা লোকে বাড়িতে সাজিয়ে রাখে। আফ্রিকার সবথেকে দক্ষিণ প্রান্তটি পাহাড় সমুদ্র নিয়ে যত সুন্দরই হোক হাওয়ার ঠেলায় সেখানে বেশীক্ষণ দাঁড়ায় কার সাধ্যি! আমাদের গ্রুপের দুটি আমেরিকান ছেলে দেখলাম তাদের রোগা বন্ধুটিকে একেবারে বগলদাবা করে নিয়েই হাঁটছে তাদের ভয় তা না হলে সে নাকি নিমেষের মধ্যেই উড়ে গিয়ে আটলান্টিক ওশানে পড়বে। ট্রাম নিয়ে টং-এ চেপে দেখি সেখানে বড় বড় ভাস্কো-ডা-গামার ছবির সঙ্গে এখান থেকে তিনি কিভাবে ভারতবর্ষ গিয়েছিলেন তার বর্ণনাতেই ভরা।
এখান থেকেই সোজা এয়ারপোর্ট গিয়ে জোহানাসবার্গের প্লেন ধরলাম। গাইড যাত্রাপথেই এই শহরটির ক্রাইম সম্বন্ধে সাবধান করে দিল। আর সেই কারণেই নাকি অফিসগুলো একটু দূরে সান্টন সিটিতে চলে গেছে। আমাদের হোটেলও সেখানেই। গাইড মজা করে বলল এটাই পৃথিবীর একমাত্র শহর যেখানে ডাকাতরা লুটের টাকা গাড়িতে তোলার আগেই অন্য ডাকাতের দল সেগুলিকে কেড়ে নিয়ে চম্পট দেয়। সান্টন সিটিতে পৌঁছে মনে হল কে বলবে এর এত কাছে জোবার্গ! দোকানপাট, অফিস, হোটেল সব কিছু নিয়ে এ এক রীতিমত বড়লোকের জায়গা। হোটেলের সামনেই ম্যান্ডেলা স্কোয়ারে একটি ছ-মিটার উঁচু ম্যান্ডেলার ব্রোঞ্জ স্ট্যাচু। সেটিকে ঘিরে আলো, ফোয়ারা অজস্র নামীদামী রেস্টুরেন্ট ও একটি মাথাঘোরানো শপিং মল। সেটি শুধু সাইজে নয় তার বাহার দেখলেও চোখ ঝলসায়। ভেতরে যারা বাজার করছেন তাদের দামী সাজ পোষাকও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও দেখলাম তেনারা বেশির ভাগই সাদা কিংবা এশিয়ান। অনেক উন্নতি হলেও এদেশে এখনও সাদা কালোর তফাতটা চোখে পড়ার মত। নামীদামী রেস্টুরেন্টে গেলে দেখবেন যারা খাচ্ছে তারা প্রায় সবাই শ্বেতাঙ্গ আর যারা সার্ভ করছে তারা বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ।
পরের দিন আমরা অ্যাপার্টহাইট (Apartheid) মিউজিয়াম ও সেই কুখ্যাত জেলখানা যেখানে গান্ধী থেকে ম্যান্ডেলা সবাই কাটিয়ে গেছেন সে দুটি দেখতে যাই। চেনে বাঁধা সম্পূর্ণ উলঙ্গ কালো ছেলেমেয়েগুলির ওপর সাদাদের অকথ্য অত্যাচারের ছবি দেখতে দেখতে কেমন যেন মনের দিক দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। কেন জানি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদীদের জন্য নির্মিত সেই কন্সেনট্রেশান ক্যাম্পগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। 'কনস্টিটিউসন হিল'এ গিয়ে দেখলাম জেল ও সর্বোচ্চ কোর্ট দুটোই পাশাপাশি। আজকের সাউথ আফ্রিকার নিয়মকানুন অবশ্য খুবই সুন্দর। সর্বোচ্চ কোর্টটি চারিদিক কাচ দিয়ে ঢাকা যাতে ভেতরে কি হচ্ছে লোকজন বাইরে থেকেই দেখতে পারে। আবার যে কোনও সাধারণ মানুষও ট্রায়াল চলাকালীন ভেতরে ঢুকতে পারে। এক সময় এদেশে ভারতীয়দের হাতে পাস নিয়ে ঘুরতে হত যাতে তারা কোথায় যাচ্ছে বা কতদিন সেখানে থাকবে সবকিছু নথিভুক্ত করা যায়। গান্ধীজী তার প্রতিবাদে সব ভারতীয়কেই পাস পুড়িয়ে ফেলতে বলেন তখন সাদারা ক্ষেপে গিয়ে ওঁকে এই ওল্ড কোর্টের জেলে পুরে দেয়। গান্ধীর আবক্ষ মূর্তির পাশেই ওঁর নামে একটি ঘর রাখা আছে যেখানে ওঁর বহু ছবির সঙ্গে ওঁর ব্যবহৃত একজোড়া চটিও দেখা যায়। এক রিপোর্টার লিখেছেন, গান্ধীকে যখন এই সব থেকে কুখ্যাত জেলটিতে আনা হয় তখন ওয়ার্ডেনরা ভেবেছিল কোনও দৈত্যের মতো চেহারা অর্থাৎ 'দারা সিং' টাইপের কাউকে দেখবে। স্কুলবয়ের মত একটি পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ছেলেকে জীপ থেকে নামতে দেখে তারা অত্যন্ত হতাশ হয়ে যায়। এখানে কৃষ্ণাঙ্গদের সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর একটি জানলাবিহীন অন্ধকার ঘরে পুরে দেওয়া হত। তিনমাসে একবার স্নান ও দিনের শেষে খাওয়ার জন্য মিলত ভাতের ফ্যান ও একটুকরো রুটি। তাও দেওয়া হত খোলা শৌচালয়ের সামনে যাতে গন্ধে সেটুকুও পেটে যেতে না পারে। বলা বাহুল্য এই অবস্থায় বেশির ভাগ মানুষই টিকতো না তখন জেলের পাশেই একটি খোলা গর্তে তাদের মৃতদেহগুলিকে ফেলে দেওয়া হত। আমাদের গাইড মহম্মদ বলল তার কাকাকে দশতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় আর বডি বাড়িতে আনার সময় দেখে জীবিত অবস্থাতেই তার নখগুলিকে উপড়ে নেওয়া হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলির ওপর এই পাশবিক অত্যাচারের নমুনা দেখতে দেখতে মনে পড়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের 'আফ্রিকা' কবিতার কয়েকটি লাইন -
'এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।'
সেদিন বিকেলে এখান থেকে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে প্রেটোরিয়া গিয়েছিলাম। এই প্রেটোরিয়া যাওয়ার পথেই ট্রেনে সাদাদের কামরা থেকে গান্ধীজিকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়। প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে অবশ্য দেখলাম এখন সবাই মিলেমিশেই আছে। এখানে পিটার বলে একটি ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল – তার বাবা মা নাকি এখনও সাদাদের ঠিক বিশ্বাস করে না এবং তাদের ওপরে রাগও যায় নি কিন্তু তারা পিটারকে বলেছে 'তুমি তো অ্যাপার্টহাইট দেখে বড় হওনি তাই তোমরা যারা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে তোমাদের উচিত সব কিছু ভুলে যাওয়া, তোমাদের মধ্যে রকম যেন সাদা কালো বা বাদামীর কোনও ভেদাভেদ না থাকে'।
সে রাত্রে নানা ধরনের খাওয়ার সঙ্গে সবশেষে ছিল এদেশের বিখ্যাত মালভা পুডিং। এর বিশেষত্ব হল গরম কেকটি ওভেন থেকে বার করার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপরে প্রচুর পরিমাণ মাখন ঢেলে দেওয়া হয়। সেটি সারারাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করার পর ওপরে ঠান্ডা ক্রিম ও ঘন ক্ষীরের মত দুধ আর বাদাম সহযোগে খাওয়াটাই আদর্শ। বর্ণনাটি শুনেই আন্দাজ করতে পারবেন এটি অখাদ্য হবার সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রেটোরিয়া খুব সুন্দর শহর কোনও সন্দেহ নেই কিন্তু জোবার্গ দুধারে বীথির মত গাছ ও একাধিক ফুলে ঢাকা পার্ক নিয়ে হয়তো আরও সুন্দর হতে পারতো যদি না তার সঙ্গে ড্রাগ বা ক্রাইম শব্দগুলি জড়িত থাকত। অভিজাত এলাকাতেও বাড়িগুলি জেলখানার মত উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যাতে চোরেরা টপকাতে না পারে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে এতটাই ফারাক হয়ত এরজন্য দায়ী। জোহানাসবার্গে 'মোয়ো' নামক একটি বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেখানে নাচগান বা খাবারের বহর দেখে মনে হল এরা এখন বোধহয় ভালোই আছে। রেস্টুরেন্টে মেয়েরা আমাদের সবার মুখেই ফেসপেন্ট করে দিল আর আমাকে অবাক করে দিয়ে একজন বলল তোমাকে চন্দন পড়ানোর মত করে সাজাবো। যদিও সাজানোটি যখন কপাল পেরিয়ে ধীরে ধীরে নাকে চলে এল তখন তাকে নিরস্ত করতে বাধ্য হলাম। এরপরের গন্তব্যস্থল ছিল জোবার্গ থেকে গাড়িতে ছঘন্টা দূরে 'ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক' আর সে রাতটা আমরা সেই জঙ্গলেই ছিলাম। চারদিকে পাহাড় ও গাছপালা নিয়ে যাওয়ার রাস্তাটিও বড় সুন্দর এমন কী অত্যন্ত গ্রাম্য জায়গাতেও রাস্তাঘাটে নোংরা চোখে পড়েনি। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তার ধারে আফ্রিকান মেয়েরা ফল থেকে আরম্ভ করে হাতে তৈরি গহনা বা কাঠের পাখি সবই বিক্রি করছে। আমাদের গ্রুপের একটি ছেলে দেখলাম রাস্তার পাকা পেঁপে কিনে ছাড়াতে না পেরে খোশা সমেতই আরাম করে চিবিয়ে খাচ্ছে আর বলছে, 'Look we are not spoiled Americans, we can adjust anywhere in the world.' কথাটা হয়ত পুরোপুরি ভুল নয় কারণ আর এক জায়গায় দেখলাম ওই গরমেও আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটির কিছু ছাত্র-ছাত্রী কালো বাচ্চাদের ফ্রি-তে পোলিওর টীকা দিচ্ছে। কিছু কিছু আমেরিকান ছেলেমেয়ে প্রাচুর্যে বড় হয়েও পৃথিবীর যে কোন জায়গাতে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমাদের গুজরাটি ভাইরাও অবশ্য পিছিয়ে নেই। একটি গন্ডগ্রামে গিয়ে খেয়াল করলাম হোটেল মোটেল ছেড়ে এক প্যাটেলভাই হার্ডওয়ারের দোকান খুলেছেন।
ক্রুগার পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল আর সেই যাত্রাপথেই যে পরিমাণ হাতি, গন্ডার, জিরাফ, হরিণ, জেব্রা বা জলা জায়গায় কুমিরের দল দেখলাম যে চোখ প্রায় কপালে ওঠে আর কী! সে রাত্রে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল জঙ্গলের ভেতর খড়ের ছাউনি দেওয়া একটি কুটিরে। ভেতরের ব্যবস্থা অবশ্য আর পাঁচটা নামী দামী হোটেলের মতই। রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে মাংস পোড়ানো হল অর্থাৎ 'বারবিকিউ।' চৌহদ্দিটা উঁচু তার দিয়ে ঘেরা, যাতে বন্য জন্তু প্রবেশ করতে না পারে যদিও বাঁদর বেবুনের কাছে সে ব্যবধান তুচ্ছ। তারা দেখলাম দিব্যি গাছে বসেই আমাদের লক্ষ্য করছে।
ি বাইরে আর এখানে তার ঠিক উলটো ব্যবস্থা। হঠাৎ একটি গগনভেদী হুংকারে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। গাইড ফিসফিস করে জানাল, আর একটা অন্য প্রাইডের সিংহ এখানে এসেছে আর খুব সম্ভবত এই তিনটি সিংহীর মধ্যে কাউকে তার মনে ধরেছে তাই এই গর্জন। এখনি মারামারি লাগবে বা ডুয়েল দেখতে পাব ভেবে আমি অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম কিন্তু ড্রাইভার আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে রাজি হল না। ফেরার পথে দেখি দুটো বাচ্চা হাতি একে অন্যের ঘাড়ে উঠে খেলছে আর বড় হাতিরা তাদের ঘিরে রেখেছে। জিরাফও দেখলাম জীপ দেখে বিশেষ ভয় পায় না, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে গলা উঁচু করে পাতা খাচ্ছিল। একটা লেপার্ডকে গাছে বসা অবস্থায় দেখতে পেলেও ক্যামেরা ফোকাস করার আগেই সে অন্তর্ধান করল।
ক্যাম্পে ফিরে এসে স্যুটকেস গোছাচ্ছিলাম কারণ একটু পরেই 'জোবার্গে' ফিরতে হবে। এমন সময় দমদম ধাক্কা শুনে তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি সামনে একটি বড়সড় বেবুন দাঁড়িয়ে। ভয়ে ততক্ষণাৎ দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ওর দোষ ছিল না কারণ আগের দিন সন্ধ্যাবেলা লোকজনের মানা সত্ত্বেও আহা মায়া লাগে বলে তাকে নিজের ভাগ থেকে কিছুটা কেক খেতে দিয়েছিলাম আর খুব সম্ভবত তার স্বাদ ভালো লাগায় সেই খোঁজেই এসেছিল। বাইরে বেরিয়ে শুনলাম একটি মেয়ের হাত থেকে খোলা পেপসির ক্যান কেড়ে নিয়ে একটি বেবুন সেটিকে নাকি তার সামনে বসেই পান করেছে। পরের দিনই আমাদের ফিরে যাওয়ার পালা। সে রাতটি জোবার্গে কাটিয়ে সকালে সেখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে পুরোপুরি কৃষ্ণাঙ্গদের শহর সোয়েটাতে গিয়ে হাজির হলাম। এখানকার লোকজন একসময় সোনা ও কয়লাখনিতে কাজ করত। এখানে একই রাস্তায় দুটি নোবেলবিজয়ীর বাড়ি দেখে খুব ভাল লাগল — একজন ম্যান্ডেলা ও অন্যজন টুটু। এই সোয়েটাতেই 'হেকটর পিটারসন' মিউজিয়ামটি দেখতে গিয়ে আর একবার মনে ধাক্কা খেলাম কারণ এখানে যাদেরকে হত্যা করা হয় তারা সবাই স্কুলপড়ুয়া অর্থাৎ একেবারেই কচিকাঁচার দল। ঢোকার মুখেই এক সাংবাদিকের তোলা সেই বিখ্যাত ছবি যেখানে বারো বছরের 'হেক্টরে'র গুলিবিদ্ধ দেহটিকে তার দিদি তুলে নিয়ে আসছে। এই স্কুলের বাচ্চাগুলির অপরাধ ছিল একটাই তারা আফ্রিকান ভাষার পরিবর্তে স্কুলে ইংরেজি শিখতে চেয়েছিল, তাহলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে। দুঃখের বিষয় এই অত্যন্ত শান্ত প্রতিবাদের ফলও হল বড় মারাত্মক। উনিনশো ছিয়াত্তর সালের ষোলই জুন সরকারের পক্ষ থেকে লোকজন এসে প্রায় সাতশো অসহায় স্কুলের বাচ্চাকে গুলি করে মেরে ফেলল। একটি মৃত বাচ্চার ছবি দেখে চমকে উঠলাম কারণ তার বয়স ছিল আট।
সাদারা ভয় পেয়েছিল এত নৃশংসতার পর এই কালো মানুষগুলি হয়ত স্বাধীনতা পেয়ে বদলা নিতে ছুটে আসবে কিংবা আতলান্টিকের জলেই তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ভাগ্য ভালো যে মানুষটির অসাধারণ বোঝানোর ক্ষমতার জোরে সেটি হয়নি – তিনি হলেন সেই একমেবাদ্বিতীয়ম 'নেলসন ম্যান্ডেলা' যিনি বলেছিলেন - "Forgiveness Liberates the soul it removes Fear. That is why it is such a powerful weapon."
এদেশে অনেক জায়গাতেই এই লাইনটি আপনাদের চোখে পড়বে – In South Africa we are equal whether you are black, white, green, coloured, Indian, Muslim. We're still together. We made South Africa. বছর পঁচিশ আগেও এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে ধরণের ঘৃণ্য ও নির্মম ছিল তার থেকে কি পালটানো সম্ভব ? উত্তরে বলব - হয়তো সম্ভব কিংবা নতুন প্রজন্মের কাছে বোধহয় সব পরিবর্তনই সম্ভব।
অতীতের কথা স্মরণে রেখে আমিও এদেশের শ্বেতাঙ্গদের প্রতি কিছুটা বিরূপ মনোভাব নিয়েই এখানকার মাটিতে পা দিয়েছিলাম তবে আনন্দের সঙ্গেই জানাচ্ছি আমাকে কিন্তু হতাশ হতে হয়েছে। এদের ব্যবহারেই আমি মুগ্ধ হয়েছি। যদিও দেখতাম প্রেসিডেন্ট 'জুমা'র নাম শুনলে সব বর্ণের মানুষরাই চটে উঠত কারণ ANC অর্থাৎ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নাকি দুর্নীতিতে ভরা। ভেবে লাভ নেই - যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ। সোনা, হিরে, কয়লা বা প্লাটিনামের মত খনিজ সম্পদে ভরপুর দেশটিকে আর যাই হোক বাইরে থেকে দেখলে ঠিক তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশ বলে মনে হয় না। দুটি শ্রেণীর মধ্যে রোজগারের ব্যবধান থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গদের বাসস্থানগুলি ঠিক ভারতবর্ষের বস্তি নয়। দুধারে বীথির মত গাছ, ফুলে ঢাকা সুন্দর ঝকঝকে রাস্তাঘাট, সময়ে চলা যানবাহন, সাজানো বাড়িঘর বা পাহাড় সমুদ্র নিয়ে দেশটিকে বাইরে থেকে দেখতে অন্তত খুব ভালোই লাগে।
মনে পড়ে ফেরার দিন ম্যান্ডেলা স্কোয়ারের সামনে মুখে রং করা একটি কালো মেয়ের ছবি তুলতে গিয়েছিলাম কারণ একটি অল্পবয়সী সাদা ছেলে সেই চত্বরেই বসেই বাচ্চাদের গালে ফেসপেন্ট করছিল। ভেবেছিলাম ম্যান্ডেলার মূর্তিটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে এই মুখে রং করা কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চাটির ছবি তুলতে পারলে আমি যে সাউথ আফ্রিকায় এসেছি সেটিকে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারবো। হায়! সে গুড়ে বালি। ক্যামেরা ভালো করে ফোকাস করার আগেই হৈ হৈ করে আরও কিছু গালে রং করা সাদা, কালো ও পাঁচমিশেলি বাচ্চা এসে হাসিমুখে আমার সামনে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সেদিন নিজের ভুল নিজেই বুঝতে পেরে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম। হ্যাঁ এটাই তো ঠিক, এটাই যে আজকের নতুন সাউথ আফ্রিকার আদর্শ ছবি। এই রামধনুর রঙে রাঙা একত্রে খেলে বেড়ানো শিশুগুলির হাসিমুখ দেখে ম্যান্ডেলার সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে গিয়েছিল - If people can learn to hate they can be taught to love, for love comes more naturally to the human heart than its opposite. মনে মনে আর একবার সেই মহামানবকে প্রণাম জানিয়ে বিমানবন্দরের দিকে পা বাড়ালাম।


~ সাউথ আফ্রিকার আরও ছবি ~

শ্রাবণী ব্যানার্জীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher