বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

স্মৃতির ম্যাকলাক্সিগঞ্জ

আশুতোষ ভট্টাচার্য

 

হাওড়ার বড় ঘড়ির তলায় জমায়েত হতে লাগলাম একে একে আমি, তাপস, শোভন আর শোভনের বন্ধু পার্থ। পার্থ ছিল একটু ফিটফাট সিরিয়াস গোছের, দেখি সে একটা এট্যাচি গোছের সুটকেস নিয়ে জুতো মোজা পরে এসছে। আমরা তো সারা কলেজ জীবনে কোনদিন জুতো মোজা পরিনি তারপর বেড়াতে যাচ্ছি বন্ধুরা মিলে তায় আবার সুটকেস, তাতে আয়না, চিরুনি, স্নো, পাউডার। লেগে গেল তাপসের সঙ্গে। যত বোঝাই তোর কী অসুবিধে সে বুঝবে না। যাই হোক শেষমেশ দুগগা, দুগগা বলে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসে উঠে বসলাম। রিজার্ভেশন ছিল কিনা এতদিনে সে আর মনে নেই, না থাকার চান্স বেশি তবে ট্রেনটা বেশ ফাঁকাই ছিল সেটা মনে আছে। যাব অনেক দূর, পৌঁছব মাঝরাতে এসব জানতাম তবে থাকার জায়গা টায়গা কিছু ঠিক ছিল না আর সে আমাদের কোন এসব চটজলদি ভ্রমণে করা হত না।
ধানবাদ থেকে ট্রেন হঠাৎ করে কোথায় বেঁকে গেল আর সব নাম না জানা ষ্টেশন অন্ধকারে মাঝে মাঝে উদয় হতে লাগল - চন্দ্রপুরা, ভান্দারিদা, বোকারো, বারমো, গুমিয়া, বরকাখানা ইত্যাদি। এই রাস্তায় আগে কোনদিন আসিনি তাই ঠিকঠাক স্টেশনে নামতে পারব কিনা সেটা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিল। কোন এক সহৃদয় ব্যাক্তি যিনি কিনা এই রাস্তার খোঁজ রাখেন বললেন পাত্রাতু, রে, খালারি এই তিন ষ্টেশনের পরেই তোমাদের গন্তব্যস্থল।
যথা আজ্ঞা বলে ট্রেন স্টেশনে থামতে আমরা নেমে পড়লাম,তখন রাত ১২ টা বেজে গেছে, সারা স্টেশনে চাঁদের আলো লুটোচ্ছে, আমরা চারজন ছাড়া আর একটা দল নামল, আর কেউ নেই। সিগন্যাল হতে ট্রেন দূরের পাহাড়, চাঁদের আলো, অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আরেকটা দল তারাও ট্যুরিষ্ট মনে হয় ব্যাপক হৈ হল্লা করতে করতে ভাল্লুক আছে ভাল্লুক আছে বলতে বলতে তাদের কোন আগে থেকে ঠিক করে রাখা গন্তব্যর দিকে রওয়ানা হল। আমরা আর ওই রাত্রে কোথায় ঘর, হোটেল খুঁজতে যাব? চল ষ্টেশনমাস্টারের কাছে - আজ অব্দি গল্প, সিনেমাতে যত ষ্টেশন মাস্টার দেখছি তারা খুব ভাল মানুষ, দয়ালু, একটু প্রকৃতিপ্রেমী হন, সুতরাং ইনিও এমন হবে আশা করে গেলাম। মানুষটা সাদাসিধে, বললেন, এই রাত্রে তো কিছু পাবেন না, এ তো আর রাঁচি, হাজারিবাগ নয়, তাই রাতটা ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে দিন, সকাল হলে থাকবার জায়গা খুঁজে নেবেন। খাবার পাওয়ার কোন চান্স নেই সেটা বোঝা গেল আর আমরা রাস্তায় রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম সেটাই বাঁচোয়া।

ওই একরত্তি ষ্টেশন তার রিটায়ারিং রুম! যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, কিন্তু আদতে দেখা গেল বিছানাপত্র না থাকলেও মোটামুটি আয়োজন ভালই। একটা হলুদ ২৫ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে, বসবার জন্য কিছু লম্বা চেয়ার, একটা টেবিল। অক্টোবর মাস, তায় ঝাড়খণ্ডের ঠাণ্ডা, কোনমতে চাদর সোয়েটার মুড়ি দিয়ে খানিক জেগে, খানিক ঘুমিয়ে হঠাৎ দেখি সকাল হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এসে আমরা তো অবাক, একটা ষ্টেশন, একটা রেললাইন, পরিষ্কার নীল আকাশ, একটা সিগন্যাল পোস্ট, কিছু ঝাঁকড়া গাছ, কয়েকটা পাহাড় - যেন একটা বড় ক্যানভাসে আঁকা ছবি। পেছন ফিরে দেখি আর একটা ক্যানভাস, ডানদিকে আর একটা, বাঁদিকে আর একটা।
আমাদের বেরোতে হবে, প্রথম কাজ থাকার জায়গা তারপর ব্রেকফাস্ট।


ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা বাঁদিকে চলে গেছে সে রাস্তায় প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে একটা বোর্ডিং স্কুল, সেটা এখন বন্ধ, তার প্রিন্সিপ্যাল, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, পাশেই থাকেন,তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। জানা গেল, স্কুল ছুটির সময়টায় ওনারা এখানে যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের থাকতে দেন। সুতরাং আমরাও জায়গা পেলাম। বেশ ঘরগুলো - এক এক ঘরে ছ-আটটা করে সিঙ্গেল বেড। তারই একটা ঘর পেলাম আমরা। সামনে বেশ সুন্দর একটা বাগান, ক্লাসরুম পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন।
সকালে গরম পুরি, তরকারি আর চা, কোথাও বেড়াতে গেলে এটা পাওয়া গেলে নিজেকে কেমন রাজা রাজা মনে হয়।

এমন স্টেশন আমি জীবনে দেখিনি। এ স্টেশনে কোন চা, পান, বিড়ির দোকান নেই, নেই কোন হকার কী ফিরিওয়ালা। আসলে যাত্রীই নেই কোনও। সমস্ত দিনে এখানে মোটে দুখানি প্যাসেঞ্জার ট্রেন আর দুটো এক্সপ্রেস ট্রেন, তার একটা আবার আমরা যে গভীর রাত্রের ট্রেনে এসেছি। স্টেশনটাও খুব মজার, বড় আপন। রেল লাইন থেকে মেরেকেটে একফুট উঁচু হবে। কিছু দূরে দূরে লাল পাথরের বসবার জায়গা তোমায় ডাকছে, আর আছে বড় বড় গাছ, তাঁদের ছায়ায় বসে খানিক জিরিয়ে নেওয়া।

সকালের ট্রেনটা যখন আসে কিংবা বিকেলের ট্রেনটা যখন যায় এই ফাঁকা স্টেশনটাই সরগরম হয়ে ওঠে, মেলা বসে যায়, কোথা থেকে ছেলে, বুড়ো, বুড়ি, জোয়ান, মরদ, মেয়ে সব হাজির হয়,কেউ পসরা সাজিয়ে বসে তাতে সবজি আছে, ফল আছে, আয়না, চিরুনি, জামা কাপড়, চাদর, খেলনা, বাঁশি সব আছে। অনেক মেয়ে আবার কোলে বাচ্চা নিয়ে, খোঁপায় ফুল টুল গুঁজে হাজির, কেউ একটা মাদুর কিনল কিংবা দেশি মুরগি, কেউ কিনছে কাঁচের চুড়ি কিংবা চুলের ক্লিপ। আমরা কিন্তু কিচ্ছু কিনছি না কিন্তু এই অসীম অনন্তের মধ্যে হঠাৎ কিছু মানুষ দেখে ভাল লাগছে খুব। আস্তে আস্তে দু একটা কেরোসিনের আলো জ্বালায় দোকানদাররা কারণ স্টেশনে যে দু একটা লাইট জ্বলে তাদের কৃপণ আলো চারপাশে পৌঁছয় না।

স্টেশনে ফিরলাম আবার, কারণ ফিরতেই হয়, এ এক অদ্ভুত টুরিস্ট স্পট, এখানে কোন হোটেল রেস্টুরেন্ট হোর্ডিং দিয়ে বসে নেই, কোন ফাইভ পয়েন্ট ঘোরাবার জন্য গাইড নেই, স্টেশনে নামার সাথে সাথে দালাল কী রিকশাওয়ালা আপনাকে এই হোটেল চলুন সেই হোটেল চলুন বলে বিরক্ত করে না, এখানে একটা নদী, কিছু পাহাড়, একটা স্টেশন কী লেভেল ক্রসিং আর পায়ে চলার রাস্তা আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে বসে আছে।
ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি মহুয়ার আসর বসেছে, এদিক ওদিক চাঁদের আলোয় কিছু মানুষ দেখা যায় বটে। আমাদের সেই হস্টেলের কেয়ারটেকার সেও এসেছে,বলল বাবু খাবেন নাকি? একদম ফ্রেশ। ফ্রেশ যে সে তো গন্ধতেই মালুম হয়, মনে হয় গন্ধ সেই চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে, হাল্কা হাল্কা শীতে,সামান্য কুয়াশায় মিশে কী সেই অদ্ভুত শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশে চারদিক মাতাল করে তুলেছে, সুতরাং আমরাও বেশ একটা লাল বেঞ্চিতে বসে পড়লাম।

দূরে তখন সাঁওতাল গ্রামে সবাই নাচগান শুরু করে দিয়েছে, সেই অদ্ভুত গানের ধুন, সঙ্গে নানান বাজনার শব্দ ভেসে আসছে, সেই গ্রামেও লক্ষ্মী আসে। আস্তে আস্তে সেই গান, বাজনা, মহুয়ায় আমরা কখনও ভাসি কখনও ডুবে যাই, দূরে একটা মালগাড়ির হেডলাইট জ্বলে ওঠে, ঘটাং ঘটাং শব্দে চলে যায় সেই মালগাড়ি, এক, দুই, তিন, চার, একত্রিশ, বত্রিশ, উনপঞ্চাশ, পঞ্চাশ আমি বগি গুনতে থাকি যেমন ছোটবেলায় গুনতাম।
আর উল্টোদিকের প্লাটফর্মে তখন এ অঞ্চলের বহুদিন আগেকার মানুষদের আত্মারা ফিসফিস করে কথা বলে...


 

বিশিষ্ট ছড়াকার আশুতোষ ভট্টাচার্য কলমে নামী-অনামী চেনা-অচেনা সকলের জন্মদিনেও চমৎকার ছড়া লিখে দেন। তাঁর কৌতুকময় ছড়ায় ধরা পড়ে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি। ছোটদের নিয়ে আঁকায়-লেখায় প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে বানিয়ে ফেলেন চমৎকার ক্যালেন্ডার। ভালো গদ্যও লেখেন। আরও অনেক কাজের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন আশুতোষ, যার সব হদিস এখনও ''আমাদের ছুটি' পায় নি।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher