বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।
[উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত বামাবোধিনী পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা স্বর্ণপ্রভা বসু (১৮৬৯-১৯১৮) কবিতা ও গদ্য লেখার পাশাপাশি লিখেছেন ভ্রমণকাহিনিও। লিখতেন ছোটদের 'মুকুল' পত্রিকাতেও। ভগবানচন্দ্র বসু ও বামাসুন্দরী দেবীর বড় মেয়ে স্বর্ণপ্রভা ছিলেন বাংলার প্রথম যুগের শিক্ষিতা মহিলাদের মধ্যে অন্যতম। তিনিই লজ্জাবতী লতা হাত দিলে এমন নুইয়ে পড়ে কেন তা লক্ষ্য করান তাঁর ভাই বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে। শিক্ষাব্রতী, রাজনীতিক ও সমাজসংস্কারক স্বামী আনন্দমোহন বসুর সবরকম কাজেকর্মে পাশে থেকেছেন চিরকাল।
আজকের বাঙালি পর্বতপ্রেমীদের পাহাড়ে চড়ার হাতেখড়ি হয় সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকিং দিয়ে, এখানে রইল প্রায় একশো কুড়ি বছর আগের 'ছন্দকফ-ফেলুট' ভ্রমণের গল্প। লক্ষণীয় যে ভোরের 'তরুণ অরুণ-আভায়' এভারেস্ট শৃঙ্গের রাঙিয়ে ওঠার কথা বললেও কাঞ্চনজঙ্ঘার বিষয়ে আলাদা করে উল্লেখ করেননি লেখিকা।]
বঙ্গ মহিলার হিমালয় ভ্রমণ
শ্রীমতী স্বর্ণপ্রভা বসু।
২৩এ নবেম্বর, ১৮৯১ সাল
মানুষের মন কিছুতেই তৃপ্ত হয় না – যত পায়, তত চায়। আমাদেরও সেই দশা হইয়াছে। পূর্ব্বে এক মাস কাল দার্জ্জিলিং বাস স্বর্গসুখ মনে হইত। এবার ৭ মাস স্বভাবের ক্রীড়াভূমি হিমালয় শিখরে বাস করিতেছি, তথাপি আরও ৫০০০ হাজার ফিট উচ্চ ফেলুট সৃঙ্গে যাইবার জন্য মন নিতান্ত ব্যগ্র হইল। বন্ধুগনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়া কেবল যে বিফল-মনোরথ হইলা, তাহা নয়; তাঁহারা যতদূর সম্ভব, আমার উৎসাহ-প্রদীপ্ত হৃদয়ে নিরাশার শীতল জল নিক্ষেপ করিতে ত্রুটি করিলেন না। পথের ভীষণ দুর্গমতার কথা শুনিয়া নিরস্ত হওয়া দূরে থাকুক, ব্যগ্রতা আরও প্রবল হইল। ৩টী ইংরেজ মহিলা সহযাত্রী জুটিলেন। গোপনে যাত্রার উপযোগী আয়োজনে ব্যস্ত হইলাম। ক্রমে দুইটী ভদ্রলোক ও একটী স্বদেশীয়া মহিলাও আমাদের দলভুক্ত হইলেন। হৃদয়ের অদম্য উৎসাহ-স্রোত স্থানে স্থানে অনেক বাধা পাইল। ফেলুট যাইবার পথে ২টী ডাক বাঙ্গলা আছে। যাত্রীদিগকে তথায় রাত্রিবাসের অধিকার লাভের জন্য পূর্ব্বেই টাকা জমা দিয়া পাস গ্রহন করিতে হয়। আমরা পাস লইতে যাইয়া শুনিলাম, রুষিয়ার মহাসম্ভ্রান্তবংশীয় দুইজন ব্যারণ ও কাউন্ট ইতিপূর্ব্বেই ৭ দিনের জন্য বাঙ্গলা অধিকার করিয়া লইয়াছেন। দুঃখের সহিত যাত্রার দিন পরিবর্ত্তন করিলাম। এ ঘটনা আমাদিগের পক্ষে বিলক্ষণ অনুকূল হইয়াছিল বলিতে হইবে, কারন দুই দিনের মধ্যে বড় বৃষ্টি হইয়া আকাশ অতি পরিষ্কার হইল। প্রকৃতি যাত্রার জন্য আমাদিগকে যেন সাদরে আহ্বান করিতে লাগিলেন। ২২এ নবেম্বর সোমবার যাত্রার দিন নিশ্চিত হইল।
যাত্রার পূর্ব্বে আমরা কতকগুলি নিয়মে আবদ্ধ হইলাম। ১ম, একজনের আদেশে সকলকে চলিতে হইবে। ২য়, পথের সুবিধা অসুবিধার জন্য কেহ কাহাকে দোষ দিতে পারিবেন না; পথে যে কষ্ট ঘটে, সকলে অম্লানবদনে বহন করিবেন। ৩য়, প্রত্যেকে নিজ নিজ আহারীয় ও শীতবস্ত্রের সংস্থান করিয়া লইয়া যাত্রা করিবেন। ২২এ নবেম্বর রাত্রি ৩টার সময়ে উঠিয়া প্রস্থানের আয়োজন করিতে লাগিলাম। ক্রমে ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদ লইয়া সুপ্রভাত দেখা দিল। অদূরে তুষারমণ্ডিত গিরিশৃঙ্গে বালসূর্য্যকিরণ প্রতিফলিত হইয়া যেন আমাদিগকে সাদরে অভ্যর্থনা করিতে লাগিল। আহারাদি সমাধা করিয়া প্রস্তুত হইলাম। সহযাত্রিগণের দোষে যাত্রা করিতে অনেক বিলম্ব হইয়া গেল। আহারীয় দ্রব্য ও শীতবস্ত্র যত পারিলাম, সঙ্গে লইতে ত্রুটি করিলাম না। প্রচণ্ড শীতের যে বর্ণনা শুনিলাম, তাহাতে এক এক বার ভয় হইল, পাছে বা হিমে জমাট হইয়া যাই। জুতার ভিতর তূলা পুরিয়া পরিলাম, সমস্ত ঠিক্ হইল; তবু ডাণ্ডিওয়ালাদিগের দেখা নাই। (যাঁহারা দার্জ্জিলিং না গিয়াছেন, তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন না, এ শ্রেণীর লোকগুলি কি অদ্ভুত জীব)। আমরা তাহাদের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই অশ্বারোহণে যাত্রা করিলাম। উৎসাহের বেগে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করিলাম, কিছুমাত্র ক্লান্তি বোধ হইল না। এমন সময়ে আমাদের বন্ধু ডাণ্ডিওয়ালাগণ দেখা দিল। তাহাদের অনুগ্রহের প্রতি নির্ভর না করিয়া আমরা রওনা হইয়াছি দেখিয়া সকলেই একটু বিনীতভাব ধরিয়াছিল। আজ যে পথ দিয়া চলিতেছি, তাহা কোন মতেই দুর্গম বলিতে পারি না। আমাদের দলটীও নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। ৬টী ঘোড়া, ৯টী ভদ্রপুরুষ মহিলা এবং ২৫ জন সহিস, ঘাসিয়াড় ও ডাণ্ডিওয়ালা লইয়া চলিয়াছি। পাহাড়ী লোকেরা এ নাতিক্ষুদ্র দলটী ভাল করিয়া দেখিবার আশায় কুটীর ছাড়িয়া রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইতেছে। আমরাও শ্রান্তি দূর করিবার জন্য প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষের ছায়ায় কখন কখন আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি। স্বভাবের কি মনোহর দৃশ্য! এমন নীল আকাশ আর কখনও দেখিয়াছি মনে পড়ে না। ইচ্ছা হয়, এখানেই থাকিয়া যাই। অদূরে উচ্চ নীলবর্ণ গিরিমালা প্রাচীরশ্রেণীর ন্যায় ক্রমশঃ উর্দ্ধগামী হইয়া যেন আকাশ ধরিবার জন্য হাত বাড়াইতেছে। প্রকৃতির এই ক্রীড়াভূমিতে বসিয়া সেই মহান্ শিল্পীর অদ্ভুত শিল্পকৌশল চিন্তা করিতে করিতে এ ক্ষুদ্র মন অনন্তভাবে ডুবিয়া যাইতেছে। বেলা প্রায় ৩-৩০ সময়ে আমাদের প্রথম বিশ্রাম-স্থান সুখিয়াপুখরী পঁহুছিলাম।
স্থানটি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষপূর্ণ, তাহার ছায়ায় তুষার-মণ্ডিত পর্ব্বত-শৃঙ্গ ঢাকিয়া গিয়াছে। আমাদের বিশ্রামগৃহটী এত ক্ষুদ্র যে, কি করিয়া এতগুলি লোকের স্থান সমাবেশ হইবে, ভাবিতে পারি না। তথাপি এ গৃহটীতে মাথা রাখিবার স্থান পাইয়াই যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা অনুভব করিতেছি। একটু বিশ্রামের পর রন্ধনের আয়োজনে ব্যস্ত হইলাম। সন্ধ্যার পূর্ব্বেই আহার শেষ করিয়া বেড়াইতে বাহির হওয়া গেল। ঘন বৃক্ষশ্রেণী ছাড়া দ্রষ্টব্য আর কিছুই নাই। রাত্রিতে আমরা ৬টী মহিলা এমন ভাবে শয়ন করিলাম যে পায়ে দেওয়াল ঠেকিল। ৩টী ভদ্রলোক অনেক কষ্টে পাশের একটী ঘরে কোনমতে স্থান করিয়া লইলেন। আজকার দিনত বেশ উৎসাহে কাটিল।
২৪ নবেম্বর
রাত্রি ৪টার সময়ে উঠিয়া প্রস্তুত হইতেছি। আজ বড় দুর্গম পথ – ১৮ মাইল দুরারোহ পর্ব্বত অতিক্রম করিয়া আশ্রয়-স্থান ডাক বাঙ্গলায় পঁহুছিতে হইবে যত শীঘ্র পারি, একটু চা পান করিয়া মধ্যাহ্নের আহার সঙ্গে লইয়া যাত্রা করিলাম। শীতের প্রকোপে ডাণ্ডিতে বসিয়া যাওয়া অসাধ্য। হাত, পা একেবারে অবশ হইয়া গিয়াছে বোধ হইল। ডাণ্ডি হইতে নামিয়া অতি দ্রুত চলিলাম। প্রায় এক মাইল হাঁটিবার পর শরীর একটু গরম বোধ হইল। ক্রমাগত উপরে উঠিতেছি বলিয়া বিশ্বাস হইতেছে। আমাদের সহযাত্রী একটী ইংরেজ মহিলার উৎসাহের সীমা নাই। তিনি সকলের অগ্রে দৌড়িতেছেন এবং ফেলুট পঁহুছন পৃথিবীর মধ্যে অতি সহজ-সাধ্য কাজ বলিয়া তাঁহার ধারণা জন্মিয়াছে।
ক্রমে আমরা ইংরেজ ও নেপাল রাজ্যের সন্ধিস্থলে পঁহুছিলাম। অদূরবর্ত্তী স্তম্ভগুলি ইংরেজ অধিকারের সীমা নির্দ্দেশ করিয়া দিতেছে। আমরা ইংরেজ রাজ্য ছাড়িয়া নেপালের সীমাস্থিত একটা পাহাড়ে উঠিয়া নেপাল রাজ্য দেখিতে পাইলাম। ঐখানে বসিয়াই মধ্যাহ্নভোজন সম্পন্ন হইল। সৌভাগ্যক্রমে ডিম ও দুগ্ধ পাইয়া অতি আহ্লাদের সহিত ক্রয় করিলাম।
অর্দ্ধ ঘন্টা বিশ্রামের পর আবার যাত্রা করিলাম। এবার পর্ব্বতের নিম্নদেশে অবরোহণ করিতে হইবে। উপরে উঠা অপেক্ষা নিম্নাবতরণ কষ্টকর ও বিপদ্জনক। ঘোরতর জঙ্গলের অভ্যন্তরে সঙ্কীর্ণ পথ। এখানে সূর্য-কিরণ কোন দিন প্রবেশ করিয়াছে, বোধ হয় না। পথের পাশে ভয়ঙ্কর খাদ, চাহিতে ভয় হয়। একটি গড়াইলে কোথায় যাইয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া পড়িব, ঠিক্ নাই। ঘোড়াগুলি স্বাভাবিক সংস্কারের অধীন হইয়া কেমন পা টিপিয়া টিপিয়া নামিতেছে, দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হইল। আমরাও অতি সন্তর্পণে চলিতেছি। জোঁকের যে ভয়ানক বর্ণনা শুনিয়াছিলাম, তাহাতেই অধিক সতর্ক হইয়াছি, ক্ষণে ক্ষণে বোধ হইতেছে যেন কত জোঁকে রক্ত শোষণ করিয়া লইল। অমনি মোজা খুলিয়া সন্ধান করিতেছি। পরম সৌভাগ্য যে কল্পনার সাহায্যে কষ্টভোগ ভিন্ন প্রকৃতপক্ষে একটীও জোঁকের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। যে জোঁকের ভয়ে এখানে আসিব কিনা চিন্তা করিতেছিলাম, তাহার দৌরাত্ম্য একবারও ভোগ করিতে হয় নাই। নামিতে নামিতে বোধ হইতেছে, যেন মুখ থুবড়িয়া আছাড়িয়া পড়িব। উচ্চ বৃক্ষশাখায় বসিয়া একপ্রকার পাখী এমন পরিষ্কার শিশ দিতেছিল, যেন ঠিক্ মানুষের গলার স্বর বলিয়া ভ্রম হইল। পাখীর কন্ঠে এমন মিষ্ট স্বর আর কখনও শুনি নাই। ক্রমে এত ঘোর জঙ্গলে প্রবেশ করিলাম যে, কি নীল আকাশ, কি উচ্চ গিরিশৃঙ্গ কিছুই দৃষ্ট হইল না। আমাদের সহযাত্রী বাঙ্গালী মহিলা আজন্ম কলিকাতায় প্রতিপালিতা; কখন বাঘ, ভালুক, কি গণ্ডার বাহির হইয়া আমাদিগকে গ্রাস করে, তিনি কেবল সেই কল্পনায় ব্যস্ত। এ পথে কেন আসিলেন, বলিয়া ক্রমাগত স্বামীকে অনুযোগ দিতেছেন। আমিত ব্যাপারখানা দেখিয়া হাসিতে হাসিতে অস্থির। আমোদে পথ-কষ্ট ততটা বোধ হইল না। আমাদের ঘোড়াটা হাঁটিয়া আসিতেছিল, হঠাৎ ভয় পাইয়া বিদ্যুদ্বেগে নীচের পথে ছুটিয়া গেল। এমন ঢালু পথ যে, একবার দৌড়িলে শরীরের বেগ সংযত করা অসাধ্য। পাশে ভয়ঙ্কর খাদ, এক অঙ্গুলী ওদিকে সরিলেই নিশ্চিত মৃত্যু। ঘোড়াটিকে মৃত অবস্থায় খাদে পতিত দেখিব ভাবিয়া অগ্রসর হইতে পা চলিল না। অবশেষে পর্ব্বতের মূলদেশে উপত্যকা ভূমিতে পঁহুছিয়া যখন দেখিলাম, অন্যান্ন ঘোড়ার সহিত আমাদের প্রিয় টম অক্ষতশরীরে বিশ্রাম করিতেছে, তখন কত আহ্লাদ হইল, বর্ণনা করিতে পারি না। কৃতজ্ঞহৃদয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম।
এবার অবরোহণ শেষ করিয়া কেবলই উচ্চে উঠিতে হইবে। উপত্যকা-ভূমিতে অর্দ্ধঘন্টা বিশ্রামের পর আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম। সেই ঘোর শীতের মধ্যেও পথশ্রমে ঘাম ছুটিল। একটু চলিয়া ঘোর তৃষ্ণাতুর হইলাম, অথচ এ পথে ঝরণা নিতান্ত বিরল। কতক্ষণে ঝরণা পাইব, কেবল সেই চিন্তায় ব্যাকুল। সঙ্গে যে দুই একটী লেবু ছিল, তাহাতে কথঞ্চিৎ তৃষ্ণা দূর করিলাম। এক এক মাইল পথ যেন দ্বিগুণ বোধ হইল। বেলা প্রায় ৪-৩০ সময়ে আমাদের বিশ্রাম-স্থান টংলু শৃঙ্গে পঁহুছিলাম। কি মনোহর দৃশ্য! চারিদিক্ দেখিয়া পথ-কষ্ট ভুলিয়া গেলাম। পর্ব্বতশৃঙ্গে মুকুটের ন্যায় ডাক-বাঙ্গালা বিরাজ করিতেছে। গৃহটী সকল প্রকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যে সজ্জিত। বড় বড় কুঠরীতে খাট চেয়ার ইত্যাদি গৃহসজ্জা প্রচুর রহিয়াছে। পাক ও আহারাদির পাত্রও অনেক পাইলাম। একটী মহা অসুবিধার বিষয় যে এক মাইল না গেলে জল পাওয়া যায় না। অগত্যা তথায় জলের জন্য লোক পাঠাইয়া আমরা সূর্য্যাস্তের মনোহর শোভা দেখিবার জন্য নিকটস্থ পর্ব্বত-চূড়ায় উঠিলাম। দার্জ্জিলিং সহরের গৃহাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর ন্যায় দৃষ্ট হইল। দূরবীক্ষণ-যোগে তুষারমণ্ডিত পর্ব্বত-শৃঙ্গ কত নিকটে দেখিলাম – মনে হইল যেন হাত বাড়াইয়া ধরিতে পারি। বাঙ্গালায় পঁহুছিয়া দেখি উঠানে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বরফখণ্ড পড়িয়া রহিয়াছে। অস্তগামী সূর্য্য-কিরণে পর্ব্বতশৃঙ্গ যেন হাসিতেছে। অন্ধকারের সহিত শীতের দুরন্ত প্রভাব অনুভব করিতে লাগিলাম। প্রত্যেক কুঠরীতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড জ্বলিতেছে তাই রক্ষা, নতুবা হয়ত শীতে জমিয়া যাইতাম। বিনামূল্যে যত ইচ্ছা কাঠ জ্বলাইতে পারা যায়। এই সুব্যবস্থার জন্য গবর্ণমেন্টকে কতই ধন্যবাদ দিলাম। চিমনীর আগুনে পরম আহ্লাদে রন্ধন করা গেল। সারারাত্রি বোধ হয় ৫।৬ মণ কাঠ জ্বালাইয়াছি। চিমনীর নিকট খাট আনিয়া শয়ন করিলাম। জল জমে কি না দেখিবার জন্য দুই গ্লাস জল বাহিরে রাখিয়া দিলাম। ৪টার সময়ে আবার যাত্রার আয়োজন আরম্ভ হইল। গ্লাসের জল ঠিক্ পাথরের ন্যায় কঠিন হইয়াছে দেখিয়া কত আহ্লাদ হইল, বলিতে পারি না। তাপ ২৯ ডিগ্রীর উপরে উঠিল না দেখিয়া আরও আশ্চর্য্য বোধ করিলাম।
২৫এ নবেম্বর বুধবার সূর্যোদয় দেখিবার জন্য আবার উচ্চ শৃঙ্গে উঠিলাম। এবার বিলক্ষণ কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছিল। দুরন্ত শীতে পা দুইটী হঠাৎ একেবারে অবশ হইয়া গেল, ঠিক্ যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ হইলাম। সে পার উপর কোন মতেই শরীরের ভার রাখিয়া দাঁড়াইতে পারি না। এ দিকে যাত্রার জন্য সঙ্গীরা ডাকিতেছেন। প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিয়া পা দুখানি অনেক সেঁকিতে সেঁকিতে সেই ভয়ঙ্কর কষ্টের অবস্থা হইতে মুক্তি পাইলাম। ৭-৩০ সময়ে ছন্দকফু অভিমুখে চলিলাম, এই মনোহর দৃশ্য ছাড়িয়া যাইতে মন চলিতেছে না।
২৫ এ নবেম্বর, বুধবার
বালসূর্য্য কিরণে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যরাশি উথলিয়া পড়িতেছে। যে দিকে চাই, নয়ন ফিরাইতে ইচ্ছা হয় না। বামে দক্ষিণে, সম্মুখে পশ্চাতে স্বভাব সৌন্দর্য্য-ভাণ্ডার খুলিয়া বসিয়াছে, কোন্ দিকে চাহিব? তুষারপাতে দুরারোহ সঙ্কীর্ণ পথ অতি পিচ্ছিল হইয়াছে, উপরে মাথা তুলিয়া চলিতে চলিতে ২।৪ বার পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গেলাম! আজও ১৫ মাইল না চলিলে আশ্রয়স্থান পাইব না বলিয়া অতি দ্রুত চলিতেছি। পথে দুধ ও ডিম পাইয়া আগ্রহের সহিত ক্রয় করিলাম। প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিবিড় জঙ্গল ছাড়িয়া আজ বাঁশবনে পড়িয়াছি। যতদূর দৃষ্টি চলে, কেবল বাঁশের জঙ্গল; ক্কচিৎ ২।৪ টা ওক কি পাইন বৃক্ষ পাষাণময় পর্ব্বতগাত্র হইতে উঠিয়া আকাশের দিকে শির উন্নত করিয়া রহিয়াছে। তুষারপাতে বাঁশের পাতাগুলি ধবল বেশ ধরিয়াছে। বাঁশের ফুল আর কখনও দেখি নাই, আজ প্রথম দেখিয়া মনে বিশেষ আনন্দ হইল। ফল হইতে ঠিক্ চাউলের ন্যায় শাঁস বাহির করিয়া চিবাইয়া দেখিলাম সেও ঠিক্ যেন চাউল। শুনিয়াছি বাঁশের ফল দুর্ভিক্ষের পূর্ব্বলক্ষণ। দুর্ভিক্ষের সময়ে বাঁশের ফলে অনেকের জীবন রক্ষা হয়। আমরাও এই ফল কতক সংগ্রহ করিয়া লইলাম। আজ দুর্গম পথের বর্ণনা সম্ভবে না। পথ এতই সঙ্কীর্ণ যেন দুই খানা পা পাশাপাশি রাখার স্থান হয় না। পর্ব্বতের উপর মহোচ্চ পর্ব্বত-দেহ বেষ্টন করিয়া কত বক্রভাবে ঘোরাণ পথ, পার্শ্বেই ৬০০০।৭০০০ হাজার ফিট নীচু খাদ, চাহিলে প্রাণ কাঁপিয়া উঠে। পশ্চাৎ হইতে সম্মুখের দুরারোহ পথ দেখিয়া মনে হয় না যে এ পথে উঠিবার ক্ষমতা হইবে। উচ্চ শৃঙ্গ আরোহণে ঘন ঘন শ্বাস বহিতেছে। যতদূর দৃষ্টি চলে, মানুষের বসতিচিহ্নের নামমাত্রও দেখিলাম না। দুরন্ত শীতে পাহাড়ের গায়ের তৃণরাশি যেন অগ্নিদগ্ধ হইয়া গিয়াছে। যে "বড় বেণ্ডাম" (এক প্রকার লালবর্ণ ফুল) ফুটন্ত অবস্থায় দেখিবার আশায় ইউরোপের নানাস্থান হইতে ভ্রমণকারিগণ এখানে আগমন করেন, তাহার শত শত গাছ পাষাণময় পর্ব্বত-দেহে জঙ্গলের আকার ধারণ করিয়াছে। দুঃখের বিষয়, এই ভুবনবিখ্যাত ফুল দেখা ভাগ্যে ঘটিল না। এপ্রিল মাস ফুল ফুটিবার সময়, সুতরাং গাছ দেখিয়াই আমাদিগকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইল। উপরে উঠার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট অধিক অনুভব করিতেছি। মাঝে মাঝে হাঁপানির ন্যায় বোধ হয়। শুনিলাম, উচ্চপদস্থ কোনও সৈনিক পুরুষ অনেক আড়ম্বর ও ব্যয় করিয়া "ছন্দকফ" যাত্রা করিয়াছিলেন। টংলু পর্য্যন্ত পঁহুছিয়াই শুষ্ক (রাচুমোঠ) উচ্চ শৃঙ্গে উঠিবার ফলে তাঁহার নাক মুখ দিয়া এমন রক্তস্রাব আরম্ভ হইল যে, প্রাণের দায়ে তিনি দলবলশুদ্ধ দার্জ্জিলিং ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইলেন। বলশালী সৈনিকের যখন এদশা ঘটিল, তখন আমার ন্যায় দুর্ব্বলা নারীর ভাগ্যে ফেলুট দর্শন ঘটে কি না এক একবার ভাবিতে লাগিলাম। যাহাহউক যে অদম্য উৎসাহ লইয়া দার্জ্জিলিং হইতে যাত্রা করিয়াছিলাম, পথের দুর্গমতা দেখিয়া তাহার কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। ঈশ্বরের মঙ্গলময় হস্ত যেন আমাকে গন্তব্য স্থানে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিল। বেলা প্রায় ১২টার সময়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণাতে সকলেই একান্ত পীড়িত হইয়া বাঁশবনের ঘন ছায়াতে আহার ও বিশ্রামের জন্য বসিলাম। এখানেও জল নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য। একটী অতি সঙ্কীর্ণ জলধারা পর্ব্বতগাত্র বহিয়া পড়িতেছে, তাহাও এত পঙ্কিল যে এত তৃষ্ণাতুর হইয়াও সে জল পানে প্রবৃত্তি হয় না। ঘোড়াগুলি জল দেখিবামাত্র পা দিয়া খুঁড়িতে খুঁড়িতে একটু গর্ত্ত করিয়া জল পান করিতে লাগিল। পশুদিগকে ঈশ্বর যে স্বাভাবিক সংস্কার দিয়াছেন, তাহা দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ করিলাম। আমাদের সহযাত্রী একটী ভদ্রলোক একটু বেশী স্থূলকায় বলিয়া পথকষ্টে বেশী ক্লান্ত হইয়া পড়েন। এখানে আমরা বসিয়া বিশ্রাম করিতেছি, তিনি একবারেই লম্বা হইয়া শুইয়া পড়িয়াছেন, এবং হয়ত বা এখানেই ভ্রমণের শেষ হয় ভাবিতেছেন। আহ্লাদের বিষয় অধিকক্ষণ তাঁহাকে এ নিরাশ ভাবে থাকিতে হয় নাই। প্রচুর আহারের ফলে দেখিতে দেখিতে তাঁহার শরীরে নববল সঞ্চারিত হইল। আমাদের মত এতগুলি কোমল দুর্ব্বল জীব লইয়া কি করিয়া উদ্দেশ্য স্থানে পঁহুছিবেন, এখন তিনি কেবল সেই গুরুতর ভাবনায় ব্যস্ত। তাঁহার উদ্বেগ দর্শনে আমরা ৬টী মহিলা যে সমস্বরে ধন্যবাদ জানাইয়াছি, তাহা বলা বাহুল্য। তাঁহার জন্যই আমরা বাস্তবিক চিন্তিত। কারণ, যে ক্ষীণকায় ঘোড়াটী তাঁহার ভাগ্যে ঘটিয়াছে, সে গত দুইদিন যথাসাধ্য কর্ত্তব্যের গুরু বোঝা বহিতে ত্রুটি করে নাই। কিন্তু আজ তাহার ধৈর্য্য পরাভব মানিয়াছে। এতেক গুরুভার প্রভুকে বহন করা তাহার সাধ্যাতীত কাজ, তাহার উপর সেই ভার লইয়া এই দুরারোহ পার্ব্বতীয় পথে উঠা কত দুষ্কর। বেচারা অন্য উপায় না দেখিয়া ধীরে ধীরে চলিতেছে, হঠাৎ প্রভুকে লইয়া একেবারে ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল। আরোহীর আঘাত লাগিয়াছে ভাবিয়া আমরা নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইলাম। সৌভাগ্যের বিষয়, একটু অপ্রস্তুত হওয়া ভিন্ন তাঁহার অন্য ক্ষতি ঘটে নাই। তিনি আর কি করিবেন, লজ্জা ঢাকিবার জন্য উঠিয়াই ঘোড়ার অকর্ম্মণ্যতার যথেষ্ট নিন্দা ও তাহাকে বিলক্ষণ কশাঘাত করিয়া নিজ উপস্থিত বুদ্ধির বিস্তর প্রশংসা করিলেন। টলুং নদের জল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলিয়া শুনিয়াছিলাম, কিন্তু আমরা সতর্ক না হইয়া যত ইচ্ছা পান করিয়াছিলাম, আজ তাহার ফলভোগ করিতেছি। সকলেরই অসুখবোধ হইতেছে। সঙ্গে ঔষধ ছিল, তাহা সেবন করিয়া ৩।৪ ঘন্টার মধ্যে অনেক সুস্থ হইলাম। ঠিক্ গোধূলির সময় ছন্দকফ বাঙ্গলায় পঁহুছিলাম। সঙ্গিনী একটী মহিলা নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পশ্চাতে রহিয়াছেন, শুনিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার সাহায্যের জন্য ডাণ্ডি পাঠান গেল। অল্পক্ষণ মধ্যে তিনি পঁহুছিয়া আমাদের সকল উদ্বেগ দূর করিলেন। উঠানের একটা গামলার ভিতর অনেক বরফ জমিয়াছিল, প্রকাণ্ড একখণ্ড বরফ তুলিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলাম। এক্ষণে পানীয় জলের ঝরণা অতি নিকটে শুনিয়া তথায় যাইয়া দেখি, জল জমিয়া পাষাণের ন্যায় কঠিন আকার ধারণ করিয়াছে। একটী ভদ্রলোকের তাহা দেখিয়া বিলাতের কথা মনে পড়িল। তিনি বরফরাশির উপরে দাঁড়াইতে চেষ্টা করিয়া সজোরে পড়িয়া গেলেন। বলা বাহুল্য যে বরফের উপর দাঁড়াইবার জন্য দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেন নাই। আমাদের লোকেরা বড় বড় কাষ্ঠখণ্ডের সাহায্যে উপরের বরফের স্তর ভাঙ্গিয়া যেই জল তোলে, অমনি তাহা জমিয়া যাইতে লাগিল, দেখিয়া আমরা বিশেষ আনন্দিত হইলাম। কেবলই মনে হইতে লাগিল, গ্রীষ্মতাপিত কলিকাতাবাসিগণ এত বরফ দেখিলে কতই কৃতার্থ বোধ করিতেন। আমরা তাপের অধিকার অতিক্রম করিয়া তুষারের রাজ্যে পঁহুছিয়া যেন নূতনজীব হইয়া দাঁড়াইয়াছি। এবার গৃহের অভ্যন্তরে পঁহুছিয়া শয্যাদি ও আহারের শৃঙ্খলাতে ব্যস্ত হইলাম। এই বাঙ্গালাটী আকারে বিলক্ষণ ক্ষুদ্র, কুঠারীগুলি পূর্ব্ব বাঙ্গালার ন্যায় আরামজনক নয়।
চিমনীতে প্রকাণ্ড আগুন জ্বালিবার ফলে শীতের প্রভাব তত অনুভব করিলাম না। রন্ধনশালে যাইয়া পাক করা দুষ্কর, চিমনীতেই পাকাদি করিয়া পরম আহ্লাদে আহার করা গেল। এখানে তরল অবস্থায় জল পাওয়াই কঠিন, পয়ানপাত্রে ঢালিতে ২ জল জমিয়া যাইতেছে। আজ আমাদের গন্তব্য সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছিয়াছি। ফেলুট এখান হইতে ৮।১০ মাইল দূরবর্ত্তী, কিন্তু উচ্চতর নয়।
২৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। রাত্রিতে চিমনিতে এত কাঠ দিয়াছিলাম যে, দেখিলাম সকাল পর্য্যন্তও ধু ধু করিয়া আগুন জ্বলিতেছে। সূর্য্যোদয়ের অনেক পূর্ব্বেই উঠিয়া স্নানাদির পর বাহির হইয়া কি অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিলাম; সম্মুখের উচ্চ পাহাড় হইতে এভারেষ্ট শৃঙ্গ হীরকের ন্যায় ঝকমক করিতেছে। বালসূর্য-কিরণ প্রতিফলিত হইয়া কখন কখন মাঝে মাঝে তাহাকে ইন্দ্রধনুর বর্ণে সাজাইতেছে। প্রকৃতির এমন রমণীয় শোভা দেখিয়া আপনাকে ভুলিতেছি। এখানে অন্ততঃ দুই তিন দিন থাকিবার ইচ্ছা প্রবল হইয়াছে। দার্জ্জিলিং ছাড়া পর্য্যন্ত আহার বিভাগের ভার সাধারণতঃ আমার উপর পড়িয়াছিল। আজ প্রত্যুষে উঠিয়াই কোনও কাজে হাত না দিয়া কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যয় দেখিব স্থির করিলাম উচ্চ একটা পর্ব্বতশৃঙ্গে প্রকান্ড পাষাণখণ্ডের উপর বসিয়া সেই অনন্ত দেবের অনন্ত প্রসারিত রাজ্যে অনিমেষনয়নে দেখিতে লাগিলাম। সাংসারিক চিন্তা আপনা হইতে হৃদয় ছাড়িয়া দূরে পলাইয়া অনন্ত দেবের পূজার স্থান প্রশস্ত করিয়া দিল। এদিকে আমাদের বাঙ্গলায় আহারাদি ও যাত্রার জন্য তাড়াতাড়ি আরম্ভ হইয়াছে। উপর হইতে বিলক্ষণ গোল শুনিতেছি। প্রকৃতির শোভায় মন প্রাণ এতই মুগ্ধ যে আহারাদির ইচ্ছা একেবারেই নাই। তথাপি আমার প্রভুভক্ত চাকর অনেক পরিশ্রমে সেই দুরারোহ শৃঙ্গে কিঞ্চিৎ আহার আনয়ন করিল। আমি তাহাকে সেই আহার পুরস্কার দিলাম। সে পাইয়া মহা সন্তুষ্ট, নিমেষে ভোজনপাত্র শূন্য করিল। অনেকবার আহ্বানধ্বনি শুনিয়াও আমি নামিলাম না। উপর হইতে দেখি, সহযাত্রিগণ জিনিস পত্র বাঁধিয়া সত্য সত্য রওনা হইতেছেন, কাজেই ধীরে ধীরে দলের সহিত একত্র হইলাম। আমার অনুপস্থিতিতে ** মহাশয়ের উপর কুলীদিগকে ডাকিয়া দ্রব্যাদি বোঝাই, কোথায় কি আছে দেখা ইত্যাদি ভার পড়িয়াছিল। আসিয়াই দেখি, যুগান্তর উপস্থিত। ক্রমাগত তর্জ্জন গর্জ্জন করিতে করিতে তাঁহার কপালে ঘাম ছুটিতেছে, 'এমন বিশৃঙ্খলতার মধ্যে চলা ভার, এমন কি দার্জ্জিলিং ফিরিয়া যাওয়া শ্রেয়স্কর' ইত্যাদি অনেক বলিলেন। এত সহজ কাজে পুরুষদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিতে পারে ভাবি নাই, সুতরাং বিলক্ষণ হাসিতে লাগিলাম। পুরুষবর কাহারও প্রতি ক্রোধ ঢালিতে না পারিয়া নিরুপায় ঘোড়ার পৃষ্ঠে লাঠি প্রহার করিতে করিতে ক্রোধাগ্নি কথঞ্চিৎ নির্ব্বাপিত করিলেন। আজ যে অপূর্ব্ববেশ ধারণ করিয়াছি, পরিচিত লোকে দেখিলেও ম্যাকবেথের ডাইনী বলিয়া ভয়ে দূরে পলাইতেন। ফটোগ্রাফ তুলিবার সুবিধা থাকিলে নিশ্চয়ই অপূর্ব্ব ছবি তুলিয়া বন্ধুগনকে উপহার দিতাম। প্রথমতঃ অত্যন্ত মোটা সাড়ী ও জেকেট পরিয়া আয়তন দ্বিগুণ হইল, তাহার উপর মাথা কপাল সব ঢাকিয়া ৩।৪ খানা শাল জড়াইলাম। হাতে মোটা পশমের দস্তানা। দুই হাতে দুই খানা বাঁশের লাঠি ভর করিয়া চলিতেছি। আশঙ্কা হয়, এই বর্ণনা পড়িয়া অনেকে ভয় পাইবেন। আজ ঘোড়াগুলিকে অতি সাবধানে লইয়া যাইতে হইল, কারণ সম্মুখের পর্ব্বতসকল একোনাইট প্রভৃতি নানা প্রকার তীব্র বিষের গাছড়াতে পূর্ণ। ঘাসের সহিত অজ্ঞাতে এ বিষ আহার করিয়া অনেক পশু মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। এমন তেজস্কর বিষের গাছ দেখিলাম যাহার আঘ্রাণেই জীবন শেষ হয়। দুরন্ত শীতের কথা কি বলিব? এত কাপড়ে ঢাকা, তবু শীতে যেন অবশ করিয়া তুলিতেছে। এক একবার বোধ হইল শরীরের রক্ত বুঝি জমিয়া গেল। শরীর গরম করিবার জন্য অত্যন্ত বেগে দৌড়িয়াও কিছু হইল না, অবশেষে কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া প্রকান্ড অগ্নিকুণ্ড জ্বালিলাম। চা প্রস্তুত হইল। তাহা পান করিয়া কত আরাম বোধ হইল, বলিবার নহে। দার্জ্জিলিং থাকিতে শুনিয়াছিলাম, ১০।১৫ মিনিট পরে পরে ব্রাণ্ডি প্রভৃতি তেজস্কর সুরাপান ভিন্য ফেলুট-যাত্রিগণ বাঁচিতে পারে না। আমরা এ কথায় কর্ণপাত করি নাই, কিন্তু আমাদের সহযাত্রী ** মহাশয় মহিলাদিগকে মোমের পুতুলী ভিন্ন ভাবিতে পারেন না। পথিমধ্যে আমরা মারা গেলে তিনিই সকল নিন্দার ভাগী হইবেন ইত্যাদি অনেক চিন্তা করিয়া এক বোতল সঙ্গে আনিয়াছিলেন। পথে কাহাকেও একটু বসিতে দেখিলেই নিতান্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া বলিতেন, "একটু ঔষধ খান, নতুবা আপনার ফেলুট পঁহুছান ভার। আমাকেই শেষটা অপদস্থভাবে ফিরিতে হইবে দেখিতেছি।'' ভদ্রলোকটির উদ্দেশ্য অতি মহৎ হইলেও আমরা তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করি নাই। একটি বন্ধুর পরামর্শ অনুসারে দার্জ্জিলিং হইতে ক্ষুদ্র শিশিতে কিঞ্চিৎ আদার আরক আনিয়াছিলাম, আজ এই ঘোর শীতে তাহা খুব কাজে লাগিল। অল্প পরিমানে পান করিয়া বেশ গরম বোধ করিলাম। দেখিতে দেখিতে ঘন মেঘ আমাদিগকে ঢাকিয়া ফেলিল। বৃক্ষশ্রেণী পর্ব্বতচূড়া কিছুই দেখা যায় না – এমন কি ৩।৪ হাত দূরস্থ পদার্থও দেখিতে পাই না। যেন সন্ধ্যার অন্ধকারে দিগ্দিগন্ত আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ইহার মধ্যে আবার তুষারবর্ষণ আরম্ভ হইল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তার ন্যায় তুষারকণাতে শাল পূর্ণ করিলাম। কোন্ পথে চলিব, দূর হইতে কিছুই দেখা যায় না। তথাপি শীতের তাড়নায় সকলেই দ্রুতগতিতে চলিলাম। আজ পথে প্রকাণ্ড গগনস্পর্শী পাইন ভিন্ন অন্য বৃক্ষ দেখি নাই। গাছগুলি যেন সৃষ্টির আরম্ভ হইতে দাঁড়াইয়া আছে। পথ ক্রমেই অধিক দুর্গম হইতেছে – এমন কি আরোহী লইয়া যাওয়া দুষ্কর বুঝিয়া ঘোড়াগুলি আপনা হইতে থাকিয়া থাকিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। সঙ্কীর্ণ পথ একেই তুষারপাতে পিচ্ছিল, তাহার উপর আল্গা পাথর পড়িয়া শতগুণ দুর্গম হইয়াছে। ডাণ্ডিওয়ালাগণ আমাকে লইয়া খাদে গড়াইতে গড়াইতে বাঁচিয়া গেল। এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার পাইয়া ঈশ্বরকে কত ধন্যবাদ দিলাম। ঘোর মেঘমালা ভেদ করিতে করিতে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে আমরা ফেলুট বাঙ্গলায় পঁহুছিলাম। লক্ষ্যস্থানে সকলে নিরাপদে পঁহুছিলাম বলিয়া যে অনির্ব্বচনীয় আনন্দ জন্মিল বলিবার নহে। সর্ব্বাগ্রে সেই মঙ্গলময় বিধাতাকে কৃতজ্ঞতা উপহার প্রদান করিয়া শয্যাদির শৃঙ্খলায় প্রবৃত্ত হইলাম। রাত্রির অন্ধকারে বাহিরের কিছুই দেখা গেল না। এই বাঙ্গলাটী অন্যান্য বাঙ্গলা হইতে উৎকৃষ্ট। কুঠরীগুলি বেশ বড় বড়; গৃহসজ্জা, পাক ও ভোজন পাত্র যথেষ্ট পাওয়া গেল। গ্লাস-ঢাকা বারাণ্ডা এত লম্বা যে দৌড়িয়া শরীর গরম করিতে লাগিলাম, হাতের অঙ্গুলীর মাথায় অত্যন্ত ব্যথা বোধ হইল, ভাবিলাম ফাটিয়া রক্ত বাহির হইবে। পুনরায় সেই আদার আরক পান করিলাম। চিমনীর আগুনে পাকাদি করিয়া আহার করা গেল। প্রত্যুষে যে মনোহর দৃশ্য দেখিব, কল্পনা চক্ষে তাহা চিত্রিত করিতে করিতে অনেক রাত্রিতে বিশ্রাম করিতে গেলাম।
২৭এ নবেম্বর, শুক্রবার।
ক্রমে সুপ্রভাত দেখা দিল। প্রকৃতি যে অনন্ত সৌন্দর্য্য-ভাণ্ডার খুলিয়া বসিয়াছেন, তাহা দেখিতে মন নিতান্ত ব্যগ্র। রাত্রি থাকিতেই জাগিয়াছি। আমরা তিনটী মহিলা খুব পুরু কাপড়ে শরীর ঢাকিয়া একটু দূরবর্ত্তী উচ্চশৃঙ্গে চলিলাম। প্রভাতের মৃদুমন্দ বায়ু-হিল্লোল আমাদের শরীর মনে যেন নবজীবন সঞ্চার করিয়া দিল। যে অভিনব দৃশ্য সম্মুখে বিরাজমান, তাহা দেখিতে দেখিতে সত্যই আপনাকে ভুলিতেছি। এ অতুলনীয় দৃশ্যের এক কণাও চিত্রিত করা ভাষার সাধ্য নহে। সেই সর্ব্বশক্তিমান্ অনন্ত শিল্পী প্রকৃতি-দেহ অমূল্য ভূষণে সাজাইয়া রাখিয়াছেন, তাহা দেখিয়া আমার ন্যায় ক্ষুদ্রজীব আত্মহারা হইয়া স্তম্ভিত হইবে আশ্চর্য্য কি? পর্ব্বতদেহে প্রকাণ্ড শিলাখণ্ডগুলি এমন ভাবে লাগিয়া আছে যে, মনে হয় এখনই গড়াইয়া পড়িবে; অথচ কতশত বৎসর হইতে যে এ ভাবে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, তাহা কে বলিতে পারে?
আমরা একখণ্ড প্রকাণ্ড পাষাণে বসিয়া নীরবে একদৃষ্টিতে স্বভাবের রমণীয় সৌন্দর্য্যরাশি দেখিতেছি। আজ আমাদের সম্মুখে এমন এক নূতন রাজ্য প্রকাশিত, যাহার অস্তিত্ব পূর্ব্বে কল্পনাতেও আঁকিতে পারি নাই। দার্জ্জিলিং হইতে তুষারমণ্ডিত যে সকল গিরিমালা দৃষ্ট হয়, তাহা দেখিয়া কতই মুগ্ধ হইয়াছি। তাহাদের দীর্ঘতা ও উচ্চতা ভাবিয়া কতই বিস্মিত হইয়াছি। সে সকল পর্ব্বত ব্যতীত আরও কত নূতন গিরিমালা তুষারের অমল শুভ্রবসনে শরীর ঢাকিয়া আজ আমাদের সম্মুখে প্রকাশিত হইতেছে। সর্ব্বোচ্চ এভারেষ্টশৃঙ্গ পূর্ণমাত্রায় নিজ সৌন্দর্য্য খুলিয়া দেখাইতেছে। এমন মেঘ ও কুয়াসা-শূন্য দিন অল্প লোকের ভাগ্যেই ঘটিয়া থাকে। এভারেষ্ট-শৃঙ্গের তুষার-মণ্ডিত উন্নত শির যেন স্বর্গের পথে মিশিয়া গিয়াছে। এই তুষারমণ্ডিত পর্ব্বতমালা কতশত ক্রোশ ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে ভাবিয়া অবাক্ হইতেছি। মাথার উপর মেঘশূন্য অনন্ত নীলাকাশ, তাহারই নীচে ক্রমশঃ উচ্চ প্রাচীরশ্রেণীর ন্যায় সুদূর-প্রসারিত গিরিমালা, নিম্নে ভয়ঙ্কর খাদ, এ সকল আমার ক্ষুদ্র মনে কেবলই এক অনন্ত অসীম ভাবের তরঙ্গ তুলিয়া দিয়াছে। এ স্বর্গভূমিতে পঁহুছিয়া এ ক্ষুদ্র হৃদয়ও যেন সাগরের ন্যায় তরঙ্গময় ও প্রশস্ত হইয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্রত্বের রাজত্ব এখানে তিষ্ঠিতে পারে না। চারিদিকে এক অনন্তের রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছে। এ সকল যাঁহার হস্তে গঠিত হইয়াছে, তিনি কত বড় মহান্, কত অসীমশক্তিশালী! যে হস্তে তিনি এ অসীম রাজ্য গড়িয়াছেন, আমার ন্যায় ক্ষুদ্র প্রাণীও সে হস্তেরই রচনা, ভাবিতে ভাবিতে বিস্ময়-সমুদ্রে ডুবিতেছি। এ অনন্ত রাজ্যে দাঁড়াইয়া নিজকে কি ক্ষুদ্রই দেখিতেছি! এক বন্ধু বলিয়াছিলেন "পর্ব্বত ও সমুদ্র না দেখিলে ঈশ্বরের অসীম ভাব হৃদয়ে ধারণ করা যায় না" আজ আমি তাহার সত্যতা বুঝিলাম। পূর্ব্বকালে ঋষিমুনিগণ এ হিমাচলে বসিয়া নিরাহারে সেই অনন্ত দেবের ধ্যান ধারণায় নিযুক্ত থাকিতেন শুনিয়াছি, আজ এ দৃশ্য দেখিয়া সে কথা আর কল্পনাপ্রসূত বলিয়া বোধ হয় না। প্রকৃতির এ নন্দনকাননে ক্ষুধা তৃষ্ণা বিষয়চিন্তা প্রভৃতি ক্ষুদ্র সাংসারিক ভাব আপনা হইতেই পলাইয়া যায় – মানুষের মন সেই অনন্তদেবের অসীম ভাবে পরিপূর্ণ হইয়া স্বর্গের শোভা ধারণ করে।
ক্রমে বালসূর্য্যের সুবর্ণময় কিরণমালা, তুষারমণ্ডিত গিরিশৃঙ্গ উজ্জ্বল করিতে লাগিল। তরুণ অরুণ-আভা সর্ব্বাগ্রে এভারেষ্ট-শৃঙ্গের তুষারমণ্ডিত উচ্চ শিরে পতিত হওয়াতে ক্ষণে ক্ষণে ইন্দ্রধনুর বর্ণ প্রতিফলিত দেখিতেছি। সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে তুষাররাশি উজ্জ্বল হীরকস্তূপের ন্যায় ঝলসিতেছে। চাহিতে চাহিতে চক্ষে ধাঁধা লাগে। চারিদিকের দৃশ্য স্বর্গের অনন্ত সৌন্দর্য্য হৃদয়ে জাগাইয়া দিতেছে। আমাদিগকে আজই যে স্বভাবের এ নন্দনকানন হইতে বিদায় লইতে হইবে, একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছি। মনে ভাবিতেছি, এমন স্থানে বাস করিলে মানব স্বর্গের জীব হইতে পারে। স্বভাবের এ অনন্ত সৌন্দর্য্য দেখিয়া হৃদয় আপনা হইতেই স্বর্গের পথে ধাবিত হয়।
সংসার-ভাবনা ভুলিয়া গিয়াছি। হৃদয়ে যে উচ্চভাব হইয়াছে, তাহার কতক অংশ লইয়াও যদি গৃহে ফিরিতে পারি, নিজকে ধন্য মনে করিব। কোন মতেই ইচ্ছা হয় না, এ দৃশ্য ছাড়িয়া যাই। অন্ততঃ দুই দিন থাকিবার জন্য দলের অধিনায়িকাকে যথেষ্ট অনুনয় বিনয় করিলাম। বিশ্রামদিন রবিবার দার্জ্জিলিঙে না কাটাইলে চলিবে না বলিয়া, তিনি কোন মতেই আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। কাজেই আমরা যাত্রার উদ্যোগে ব্যস্ত হইলাম। মধ্যাহ্নভোজনের পর আহার-দ্রব্য প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছে দেখিয়া সকলেই আশ্চর্য্য বোধ করিলাম। যে লোক আহার-দ্রব্য বহন কার্য্যে নিযুক্ত ছিল, সে গোপনে খাদ্যগুলি নিঃশেষ করিয়াছে, স্পষ্ট বুঝিয়াও কিছু বলিলাম না। অধিনায়িকার পরামর্শে নূতন পথ ধরিয়া দার্জ্জিলিং ফিরিয়া চলিলাম। তাঁহার ধারণা যে, এপথে গেলে অন্ততঃ ১৫।১৬ মাইল পথ বাঁচিয়া যাইবে। নূতন দৃশ্য দেখিতে দেখিতে চলিব ভাবিয়া আমরাও প্রফুল্ল হইলাম। দলনেত্রীর বর্ব্বর সহিস আমাদের পথ-প্রদর্শক, তাহার একটী কথাও বুঝিতে পারি না। বেলা প্রায় ১২টার সময়ে সেই গগনস্পর্শী গিরিমালা, সেই অমল শুভ্র এভারেষ্ট-শৃঙ্গ, সকলেরই নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া দার্জ্জিলিং অভিমুখে যাত্রা করিলাম। যতদূর দৃষ্টি চলে, দেখিতে দেখিতে ধীরে ধীরে পথ চলিতেছি। পথের বর্ণনা সম্ভবপর নয়। এখন কেবল নীচে নামিতেছি। এমন উচু নীচু পথ যে, খালি ডাণ্ডি লইয়াই লোকগুলি আছাড়িয়া পড়িতেছে। কোমর পর্য্যন্ত গভীর গর্ত্তের মত স্থানে নামিয়া উপরে উঠি, আবার গর্ত্তে পড়ি। এই সুগম পথে কত দ্রুত চলা সম্ভব, সহজেই অনুমান করা যায়। ক্রমে আমরা পর্ব্বতের মূল দেশে নিবিড় বাঁশবনে যাইয়া পড়িলাম। সেই গগনভেদী পর্ব্বত-চূড়া, সুনীল আকাশ কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। গভীর জঙ্গল ভেদ করিয়া সূর্য্য-কিরণও প্রবেশ করিতে অক্ষম। বর্ষার সময়ে বোধ হয় স্থানগুলি জলে পূর্ণ ছিল, কারণ এখনও পদভরে মাটী বসিয়া যাইতেছে। বন্য জন্তুর সাক্ষাৎলাভ একটুও আশ্চর্য্যের বিষয় নয়। এ কয়দিনের অল্পাহারে ঘোড়াগুলি অত্যন্ত শীর্ণ হইয়াছিল, আজ অপর্য্যাপ্ত বাঁশপাতা আহার করিয়া বিশেষ তৃপ্ত হইতেছে। দলের অধিনায়িকা আশা করিয়াছিলেন, ৬ মাইল পথ অতিক্রম করিলেই আজ রাত্রির জন্য ফরেষ্ট বাঙ্গালায় বিশ্রামস্থান পাইবেন। কিন্তু প্রায় ১০ মাইল পথ আসিয়াও যখন মনুষ্যের বসতি-চিহ্ন লক্ষিত হইল না, তখন সকলেরই ধারণা জন্মিল পথ হারাইয়াছি। এখন কোথায় আশ্রয়স্থান, কতদূর গেলে লোকের মুখ দেখিব, দার্জ্জিলিং আর কতদূর সকলই অনিশ্চিতের মধ্যে দাঁড়াইল। এত দুর্গম পথও আমোদে চলিতেছিলাম, বিপথে পড়িয়াছি শুনিয়া মনের ভাব হঠাৎ পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল, তথাপি ভয়ে আকুল না হইয়া সকলেই সাহসে নির্ভর করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
আমাদের সঙ্গে একজন বুদ্ধিমান্ পাহাড়ী ছিল, রাত্রির অবস্থানের উপযুক্ত একটী স্থান দেখিবার জন্য তাহাকেই অগ্রে পাঠান গেল। ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল, আমরা ক্রমেই ঘোর দুর্গম পথে প্রবেশ করিলাম। পথ বলা যাইতে পারে, এমন কিছুই নাই। বর্ষার জলে ধৌত হইতে হইতে স্থানে স্থানে গভীর গর্ত্ত হইয়াছে। কখন তাহাতে পড়িয়া প্রকাণ্ড বৃক্ষের মূল অবলম্বনে উপরে উঠিতেছি। স্থানে স্থানে ভীমকায় বৃক্ষ পড়িয়া রহিয়াছে, আমরা কখনও লম্ফ দিয়া, কখনও নীচের সুড়ঙ্গের পথে হামাগুড়ি দিয়া চলিতেছি। কাপড় জুতা ছিঁড়িয়া খণ্ড খণ্ড হইতেছে। সহযাত্রী একটি মহিলা নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন, কোন মতেই চলিতে পারেন না। তাঁহার সঙ্গে ৩ জন যাত্রী পশ্চাতে রহিলেন। ৩ টী মহিলা পূর্ব্বেই অগ্রসর হইয়াছেন। আমি ডাণ্ডি-ওয়ালা-গুলিকে লইয়া সেই বনপথে চলিতেছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও ডাণ্ডিওয়ালাদের সঙ্গে চলিতে পারিলাম না। তাহারা অনেক আগে চলিয়া গেল। কত ডাকিয়া উত্তর পাই না। সেই নিবিড় জঙ্গলে আমি একাকিনী জঙ্গল ভেদ করিয়া দক্ষিণে কি বামে অগ্রসর হইব জানি না। এখন গৃহে বসিয়া সেই অবস্থা ভাবিতে ভাবিতে কম্পিত হইতেছি, কিন্তু তখন মনে এমন এক অপূর্ব্ব সাহস জন্মিয়াছিল যে, তাহার বলে এই প্রতিকূল অবস্থাতেও বিচলিত হইয়া পড়ি নাই। দিবসেও যে দুর্গম পথে চলা ভার, রাত্রির অন্ধকারে সে পথে কি কষ্টে একা চলিতেছি, তাহা বর্ণনীয় নহে। একটু শব্দ শুনিলেই আশঙ্কা হয় যে, হয়ত বা ভালুক আসিতেছে। ভালুকের দৌরাত্মের অনেক গল্প শুনিয়াছিলাম, তাই ভালুকের কথা মনে পড়িতেছিল। ২।৩ মাইল এই ভাবে চলিতে চলিতে অগ্রগামী মহিলাদের সাক্ষাৎ লাভ করিয়া যেন মৃতদেহে জীবন পাইলাম। রাত্রিটা এই ঘোর জঙ্গলে বন্যজন্তুদের সহিত কাটাইতে হইবে ভাবিতেছি। পথশ্রমে এতই ক্লান্ত যে, আর অগ্রসর হইবার ক্ষমতা নাই, তথাপি সহযাত্রী মহিলাদের আশা-জনক কথা শুনিয়া ধীরে ধীরে চলিলাম, ঘোর অন্ধকারে কোথায় যাইয়া পড়িব, ঠিক্ নাই। হঠাৎ দূরের আলোক দৃষ্টে প্রাণে নূতন আশার সঞ্চার হইল। আমাদের লোকেরাই যে বুদ্ধি করিয়া লন্ঠন জ্বালিয়া আনিতেছে, তাহাতে বিশেষ কৃতজ্ঞ হইলাম। পশ্চাতের যাত্রীদের জন্য উদ্বিগ্ন হইলাম। একটী লন্ঠন দিয়া ৩ জন লোককে তাঁহাদের অনুসন্ধানে পাঠান গেল। এদিকে আলো হস্তে লইয়া আমরাও অগ্রসর হইতেছি। সম্মুখে একটু সমতল ভূমি দেখিয়া তথায় রাত্রি কাটাইব স্থির করিয়া কম্বল পাতিয়া বসিলাম। সহযাত্রী মহিলাগণ তখনও আশ্রয়স্থান পাইবার আশা ত্যাগ করেন নাই। তাঁহারা কতকদূর যাইয়াই আমাকে আহ্বান করিলেন। এত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, উঠিতে ইচ্ছা হয় না; তথাপি অগ্রসর হইলাম। একটী ভুটীয়া রমণী সহাস্য মুখে হাত বাড়াইয়া অভ্যর্থনা করিয়া আমাদিগকে তাহার বাঁশের কুটীরে লইয়া গেল। অপ্রত্যাশিত আতিথ্যলাভ করিয়া অবাক্ হইলাম। গৃহখানি কেবল বাঁশে গঠিত, অধিকাংশ স্থান শস্যে পূর্ণ। বসিতে স্থান পাইয়া যে আরাম বোধ হইল, বলিবার নহে। এখন পশ্চাদ্বর্ত্তী সহযাত্রীদের জন্যই যত চিন্তা হইতেছে। প্রায় একঘন্টার পর সকলেই নিরাপদে আসিয়া পঁহুছিলেন। দীর্ঘকাল পরে আত্মীয়দের সহিত সাক্ষাৎলাভে যত না আনন্দ জন্মে, ৯ জন সহযাত্রী একত্রিত হইয়া তদপেক্ষা আনন্দিত হইলাম। এত ক্লান্তির মধ্যে আহার-চিন্তা আসিল না। শয়নের একটু স্থান পাইলেই কৃতার্থ হই। আশ্রয়দায়িনী ভুটীয়া নারী আমাদিগকে সুখী করিতে কত ব্যস্ত! মুখ ধুইবার জল ঢালিয়া দিতেছে। আহারের কথা বারবার জিজ্ঞাসা করিতেছে, যেন আমরা কুটুম্বভাবে আসিয়াছি। আমরা প্রথমে আহারের অনিচ্ছা জানাইলাম, সে কিছুতেই ছাড়িবে না। অবশেষে ৬ সের আলু সিদ্ধ ও ৩ সের চমরী গরুর দুধ আনিয়া দিল। সঙ্গে কিছু মাখন সম্বল ছিল, তাহার সাহায্যে সেই সিদ্ধ আলু যে তৃপ্তির সহিত আহার করা গেল, বর্ণনা করিতে পারি না – রাজভোগেও এত তৃপ্তি হয় না। এখন শয়নের ব্যবস্থায় ব্যস্ত হইলাম। একখানা কম্বল ঝুলাইয়া কুটীরের সেই সঙ্কীর্ণ স্থান দুই ভাগ করা গেল। এক অংশে পুরুষগণ ও অন্য অংশে আমরা ৬টী মহিলা আশ্রয় লইলাম। পথের কথা বলিতে বলিতে আমাদের মধ্যে হাসির লহরী উঠিল। আজ জীবনের একটী স্মরণীয় দিন। যে নূতন অবস্থায় পড়িয়াছি তাহা চিন্তা করিতে করিতে একবারও নিদ্রা আসিল না। কলিকাতার পিঞ্জরাবদ্ধ পাখী হিমালয়ের ঘোর জঙ্গলে ভুটীয়াগৃহে আতিথ্য গ্রহণ করিব, কল্পনাতেও ভাবিতে পারি নাই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, এই প্রতিকূল অবস্থাতেও মন নির্জ্জীব হইয়া পড়ে নাই, বরং নূতন অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া আনন্দিত হইতেছি।
২৮এ নবেম্বর, শনিবার
অতি প্রত্যুষে উঠিয়া আমরা যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইলাম। ভুটিয়া স্ত্রীলোকটি ভুট্টার রুটী ও কতকগুলি আলু সিদ্ধ সঙ্গে দিল। আমরা তাহাকে ৫টী টাকা দিয়া ও কৃতজ্ঞতাসূচক অনেক কথা বলিয়া বিদায় গ্রহণ করিলাম। স্ত্রীলোকটীর সদাশয়তার কথা ভাবিয়া আশ্চর্য্য বোধ করিতেছি। ভুটীয়া-গৃহে জন্ম গ্রহণ করিয়াছে বটে, কিন্তু ভদ্রবংশীয়া মহিলাদের যে সদ্গুণ থাকা উচিত, ইহাতে তাহার অভাব দেখিলাম না। ভুটীয়া স্ত্রীলোকটী সেই অজ্ঞাত রাজ্যে পথ দেখাইবার জন্য অনেক দূর পর্য্যন্ত সঙ্গে চলিল। পাহাড়ের নীচে অনেক চমরী গাভী দেখিলাম। পূর্ব্ব দিনের পথশ্রমে যথেষ্ট ক্লান্ত আছি, এমন কি, পার ব্যথায় চলিতে অত্যন্ত কষ্ট হইতেছে। আশা, হয়ত একটু ভাল পথ পাইব। ভাল পথ পাওয়া দূরে থাকুক, এমন স্থান দিয়া চলিতে হইতেছে যে পূর্ব্ব দিনের কষ্ট ভুলিয়া যাইতে হইল। গভীর গর্ত্তে নামিয়া অগ্রসর হইতেছি, ঝরনার জল পড়িয়া তাহা কর্দ্দমপূর্ণ ও পিছল হইয়াছে। সঙ্গিনী একটী মহিলা দুই একবার পড়িয়া যাইয়া আর হাঁটিবেন না স্থির করিলেন। আমরা মহা বিপদে পড়িলাম, কি করা যায় ভাবিতেছি, এমন সময়ে সেই ভুটীয়া স্ত্রীলোকের আত্মীয়া একজন স্ত্রীলোক তাঁহাকে পিঠে বহন করিতে সম্মত হইল। এ দুর্গম পথে একজন মানুষ পিঠে করিয়া চলিতে পারিবে, কোন মতেই বিশ্বাস হইল না। কিন্তু সে আমাদের কথায় কর্ণপাত না করিয়া সঙ্গিনীকে পিঠে বাঁধিয়া এমন দ্রুতবেগে চলিয়া গেল যে, আমরা অবাক্ হইয়া চাহিয়া রহিলাম। কত হাসিলাম, বলিতে পারি না। বহুদূর হইতে ঘোর তুফানের মত শব্দ শুনিতে শুনিতে পর্ব্বতবাহিনী এক ভীমস্রোতা নদীর তটে পৌঁছিলাম। প্রকাণদ পাষাণখণ্ডে বাধা পাইয়া ফেনরাশি ছড়াইতে ছড়াইতে কি ভীম রবে ছুটিতেছে! শব্দে কর্ণ বধির হইয়া গেল। স্রোতের বেগ দেখিয়া মাথা ঘুরিয়া যায়। নদীগর্ব্ভে পাষাণস্তূপ পড়িয়া আছে। একটা শিলাখণ্ডে বসিয়া নদীর নির্ম্মল জলে হাত মুক ধৌত করিলাম, পথশ্রান্তি যেন একবারে দূর হইল। পর্ব্বতের মূল দেশ হইতে উপরের শোভা কি রমণীয় দেখাইতে লাগিল! পারাপারের জন্য দুই বৃহৎ কাষ্ঠখণ্ড একত্রে বাঁধা রহিয়াছে। সন্তরণে অপটু বলিয়া জলে আমার বিশেষ ভয়। বৃক্ষকাণ্ডের উপর দিয়া কেমন করিয়া এ ভীমস্রোতা নদী পার হইব ভাবিয়া অত্যন্ত ভয় হইল। ঘোড়াগুলি সাঁতার দিয়া স্বচ্ছন্দে পার হইয়া গেল, দেখিয়া কিঞ্চিৎ সাহস জন্মিল, ধীরে ধীরে চলিয়া নিরাপদে অপর পারে পৌঁছিলাম। এ পারের পথের কথা বলিবার নহে। যাঁহারা সেই পথে চলিয়াছেন, তাঁহারা ভিন্ন অন্যের পক্ষে তাহার দুর্গমতা উপলব্ধি করা দুষ্কর। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষের শিকড় অবলম্বন করিয়া পর্ব্বতশিখরে উঠিতেছি, আবার হামাগুড়ি দিয়া নামিতেছি। একবার নামা উঠাতেও দুর্গম পথ শেষ হইল না। ৫, ৬টা উচ্চ পর্ব্বত এই প্রকার কষ্টে অতিক্রম করিলাম। এবার কোথায় একটু ভাল পথ, দেখিয়া আশা জন্মিবে, না তাহার পরিবর্ত্তে প্রকাণ্ড ঝরণার মুখে যাইয়া পড়িলাম। ডাণ্ডিওয়ালাদের নিকট শুনিলাম, - এই ঝরণা ধরিয়া উপরে উঠা ভিন্ন পথ নাই। শরীরে যত টুকু বল অবশিষ্ট ছিল, এ কথা শুনিয়া তাহাও যেন ছাড়িয়া গেল। সমস্ত দিন প্রায় আহার ঘটে নাই বলিলেই হয়। তাহার উপর ঘোর পরিশ্রম। একটু বিশ্রাম লাভের জন্য আমরা ৪ জন যাত্রী পর্ব্বততলে বসিলাম। সেই ভুট্টার রুটী আহার করিতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু এত কদর্য্য যে তত ক্ষুধার সময়েও তাহা মুখে দিতে পারিলাম না। মরুয়া বীজের কিছু খই সম্বল ছিল, তাহা অতি উপাদেয় বলিয়া আহার করা গেল। ডাণ্ডিওয়ালাগন এ পথে আসার একান্ত বিরোধী ছিল, এখন আমরা যত ক্লান্ত হইতেছি, তাহারাও আপনাদের অভিজ্ঞতার গর্ব্ব করিতে করিতে আমাদিগকে তত নিন্দা করিতেছে। দলের অধিনায়িকা আমাদিগকে এই পথে আনিয়াছেন বলিয়া তাঁহার প্রতি ইহাদের অধিক বিদ্বেষ জন্মিয়াছে। কষ্টের সময়ে লোকগুলির নিন্দাবাদ শুনিয়া আরো বিরক্ত হইতেছি, কিন্তু তাহাদের আলাপ যেন কিছুই বুঝিতে পারি না, এই ভাণ করিতেছি। সঙ্গী ভদ্রলোক পাথরের উপর গড়াইয়া পড়িলেন। ডাণ্ডিওয়ালাগণ যদি তাঁহাকে পিঠে বহিয়া চলে, ভাল, নতুবা তিনি কদাচ উঠিতে পারিবেন না। জন্মস্থান ও দূরস্থ পিতা মাতাকে উদ্দেশ্য করিয়া বিলাপধ্বনিতে সেই কষ্টের মধ্যেও তাঁহার কাতরোক্তি শুনিয়া আমরা হাসিতে হাসিতে অস্থির। আমরা এত ক্লান্তির ভাব প্রকাশ করিলে দুর্ব্বলা স্ত্রীলোক বলিয়া কতই উপহাসের ভাগী হইতাম। এই ভদ্র লোকটী সঙ্গী না হইলে এত হাসিবার সুযোগ ঘটিত না, পথশ্রান্তি দ্বিগুণ কষ্টকর হইত, এজন্য আমরা সকলেই তাঁহার নিকট অনেক কৃতজ্ঞতা জানাইয়াছি। তিনিও এমন শান্তপ্রকৃতি যে, সকলকে এত হাসিতে দেখিয়া একদিনও ধৈর্য্যহারা হন নাই, বরং এতগুলি শ্রান্ত পথিকের শ্রান্তি দূর করিতে সমর্থ হইয়াছেন ভাবিয়া নিজকে কৃতার্থ মনে করেন। যাহা হউক, এতক্ষণ বিশ্রামের পর, ঝরণা-অধিরোহণ-পর্ব্ব আরম্ভ হইল। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আলগা পাষাণস্তূপ বহিয়া ভয়ঙ্করবেগে জলস্রোত নামিতেছে, তাহার উপর চলা কি দুঃসাধ্য ব্যাপার; সহজেই কল্পনা করা যায়। আমাদের বস্ত্রাদি ও জুতা একেবারে ভিজিয়া গেল। দুইটী ঘোড়া উলটিয়া নীচে পড়িতেছিল, আশ্চর্য্য ভাবে রক্ষা পাইল। ৬টী ঝরণা অতিক্রম করিয়া প্রায় সূর্য্যাস্তের সময়ে ঘোর জঙ্গলের মধ্যবর্ত্তী একটী জনশূন্য ভগ্ন গবর্ণমেন্ট বাঙ্গলায় পঁহুছিলাম। সকল দিকের দরজা বন্ধ, অগত্যা শার্শি ভাঙ্গিয়া অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে হইল। গৃহটী দুই অংশে বিভক্ত, কিন্তু একেবারে গৃহসজ্জাশূন্য; তথাপি যে আশ্রয় পাইলাম ইহা ভাবিয়া আমরা কতই কৃতজ্ঞ। আহার সামগ্রী একেবারে নিঃশেষ হইয়াছে, সুতরাং কিছু সংগ্রহ না করিলে পরদিন পথ চলা দুষ্কর। ৬মাইল দূরবর্ত্তী স্থানে ৩টী টাকা দিয়া লোক পাঠাইলাম। অনেক রাত্রিতে সে ৴২ সের চাউল মাত্র লইয়া ফিরিল। এমন মোটা চাউল কখনও দেখি নাই, কিন্তু ক্ষুধার সময়ে তাহাই কত উপাদেয় বোধ হইল। কৃতজ্ঞ হৃদয়ে বিশ্রাম করিতে গেলাম। অত মোটা চাউলের অন্ন আহার করার ফলে সহযাত্রী বালিকাটী নিতান্ত পীড়িত হইয়া পড়িল। এমন স্থানে তাহাকে পীড়িত দেখিয়া যার পর নাই উৎকন্ঠিত হইলাম। সৌভাগ্যের বিষয়, সঙ্গে যে ঔষধ ছিল, তাহা সেবন করিয়া অনেক সুস্থ বোধ করিল। রাত্রিশেষে এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে, পীড়িত বালিকাকে লইয়া যাত্রা করা উচিত কিনা, চিন্তা করিতে লাগিলাম। আজ এ বাঙ্গালায় থাকিলেও আহারীয় দ্রব্য মিলিবেনা। অগত্যা যাওয়াই স্থির হইল।
২৯শে নবেম্বর, রবিবার ৭টা
আবার অপরিচিত পথে চলিলাম। বৃষ্টির জলে পথ কর্দ্দমময়। গর্ত্তগুলি জলপূর্ণ। কিছুদুর যাইয়াই এক প্রকাণ্ড ঝরণার মুখে পঁহুছিলাম। পূর্ব্বদিন ঝরণা ধরিয়া উপরে উঠিতে হইয়াছিল, আজ নীচে অবতরণ শতগুণে দুঃসাধ্য ব্যাপার। ঝরণার মাঝে যে প্রকাণ্ড পাথর রহিয়াছে, লম্ফ দিয়া তাহার উপর পা রাখিতেছি। আলগা পাথর শরীরের ভারে গড়াইয়া যাইবে ভয়ে দুই পাশের জঙ্গল জড়াইয়া ধরিয়া নামিতে চেষ্টা করিলাম। কি ভয়ানক ব্যাপার! ইহা যে বিছুটীর জঙ্গল জানিতাম না। আমাদের দেশীয় বিছুটী ইহার কাছে কোথায় লাগে। দেখিতে দেখিতে দুই হাত ফুলিয়া রক্তবর্ণ হইল। যে স্থানে বিছুটীর পাতা লাগিয়াছিল, তাহা অগ্নিদগ্ধ হইয়া গেল। ঝরণা ধরিয়া অনেকদূর যাওয়ার পর এক নদীর ক্ষুদ্র স্রোতে পঁহুছিলাম। এবারও কাপড় ইত্যাদি ভিজিয়া গেল। অনেক দূর এভাবে চলিলাম। জুতা ও বস্ত্রের দুর্দ্দশার কথা কি বলিব? সহযাত্রী ভদ্রলোক কেবল অদৃষ্টের নিন্দায় ব্যস্ত। বরাবর পিতামাতাকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। প্রায় ১২টার সময়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় একান্ত পীড়িত হইয়া নদীকূলে একটু সমভূমিতে পঁহুছিলাম। আহার ভিন্ন পথ চলা অসাধ্য ভাবিয়া, যে অল্প পরিমাণ মোটা চাউল সম্বল ছিল, তাহা দ্বারা রান্না করা গেল। কোন কোন সহযাত্রী নদীতে স্নান করিয়া তৃপ্ত হইলেন। কত কৃতজ্ঞতা ও তৃপ্তির সহিত সেই অন্ন আহার করিলাম। নদী পার হইয়া আবার পর্ব্বতশৃঙ্গে উঠিতে হইল। পথে কত প্রকাণ্ড ঝরণা অতিক্রম করিলাম। পর্ব্বতের নিম্নদেশ এলাচের জঙ্গলে পূর্ণ, যতদূর দৃষ্টি চলে কেবলই এলাচ গাছ দেখিলাম। সম্মুখে ভুটিয়াদের কয়েকখানা ক্ষুদ্র কুটীর দৃষ্টে নিতান্ত আশ্বস্ত হইয়া তথায় পঁহুছিলাম। আশা ছিল, দার্জ্জিলিং কয় মাইল দূরবর্ত্তী তাহারা নিশ্চয় বলিয়া দিবে। দুঃখের বিষয়, অনেক চেষ্টাতে একটী কথাও বুঝিতে কিম্বা বুঝাইতে সক্ষম হইলাম না। বিষন্ন হৃদয়ে আবার গন্তব্য পথে চলিতে হইল। আজ পর্ব্বতের মূলদেশে ৫।৬ টা নদী অতিক্রম করিলাম। দূরে ধানের ক্ষেত দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হইল। ক্রমে ক্রমে আমরা সেই ধান ক্ষেতের উপর দিয়াই চলিলাম। পাকা ধানের সুগন্ধ কি মনোহর! দুই একটী পাহাড়ীর দেখা পাইয়া জানিলাম, পুলবাজার নামক স্থান নিকটবর্ত্তী। অত্যন্ত উৎসাহে চলিলাম। কিন্তু পুলবাজারের কোন চিহ্নই দৃষ্ট হইল না। আবার ঘোর জঙ্গলে পড়িতে হইল। কখন কখন দুই একজন লোক দেখা যায়, কিন্তু তাহাদের কথায় নির্ভর করিয়া কেবলই নিরাশ হইতেছি। আমরা জিজ্ঞাসা করি, "পুলবাজার কয় মাইল?" উত্তর "দুই মাইল।" আমরা বলি, না ১০ মাইল হইবে; তাহারাও বলে "হাঁ ১০ মাইল।" প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তখন এরূপ নিরাশাজনক উত্তর পাইয়া নিতান্ত বিরক্ত হইতেছি। স্থির করিলাম, পথের দূরত্ব সম্বন্ধে কাহাকেও আর জিজ্ঞাসা করিব না। বাঁশবন ও ঝরণা অতিক্রম করিতে করিতে নিতান্ত দুর্গম স্থানে পঁহুছিলাম। আবার সহযাত্রিগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া চলিতে হইল। এমন বক্রপথে একত্র চলা অসাধ্য। আমার সঙ্গী ডাণ্ডিওয়ালা ও মুটেগণ যমদূতের ন্যায়, তাহাদিগকে লইয়া চলিতে চলিতে মনে কত আশঙ্কা হইল। ঠিক সন্ধ্যার সময়ে এমন স্থানে পঁহুছিলাম, যে স্থানে এক পর্ব্বত ভাঙ্গিয়া পাষাণরাশি স্তূপীকৃত হইয়া রহিয়াছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রায় কিছুই দৃষ্ট হয় না। পশ্চাতে যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করিয়াও দেখা পাইলাম না, অগত্যা ধীরে ধীরে ভগ্ন পথে অবতরণ করিতেছি। নির্ব্বিঘ্নে পঁহুছিব সে আশা হইতেছে না। সৌভাগ্যক্রমে নিরাপদে সেই ভয়ঙ্কর স্থান অতিক্রম করিলাম। সম্মুখে বিজন বনের অন্তরালে ভগ্ন পথ, সহযাত্রীদের কাহারও দেখা নাই, অথচ তাঁহাদের অপেক্ষায় এই অন্ধকার মধ্যে ডাণ্ডিওয়ালাদের সহিত বসিয়া থাকাও ভয়ানক। অন্ধকারে পথ দৃষ্ট হয় না, অতি সাবধানে চলিলাম। প্রাণের দায়ে ডাণ্ডিওয়ালাদের ধর্ম্মজ্ঞান উদ্রেক করিবার জন্য ঈশ্বর, পরকাল, পাপ পুণ্য ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ আরম্ভ করা গেল; কিন্তু তাহাদের মনে যে কোন একটা ভাব জন্মাইতে সক্ষম হইয়াছিলাম, এরূপ বোধ হয় না। ভুটিয়াদের ধর্ম্মজ্ঞান আশ্চর্য্য ধরণের। তাহাদের ভূতের ভয় সর্ব্বাপেক্ষা প্রবল। তাহারা যে সকল ধর্ম্মানুষ্ঠান করে, তাহা কেবল ভূতের দৌরাত্ম্য হইতে রক্ষা পাইবার জন্য। আমরা চলিতেছি, পর্ব্বতের যে স্থানে প্রতিধ্বনি শুনা যাইতেছে সেই স্থানে ভূতের বাস বলিয়া ডাণ্ডিওয়ালাগণ ভয়ে মৃতপ্রায় হইয়া প্রাণপণে দৌড়িতেছে। আমিও সেই সুযোগে তাহাদিগকে ঈশ্বরের শক্তি বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছি। হায়! কুসংস্কারের অধীন হইয়া জীবন্ত মনুষ্য যে কত হীনদশাগ্রস্ত হয়, তাহার দৃষ্টান্ত দেখিলাম। এই ভীমকায় বলিষ্ঠ লোকগুলি ভূতের ভয়ে এত কাতর, যে আমি ভূত তাড়াইবার যে কোন উপায় বলিব, তাহাই করিতে প্রস্তুত। এ দিকে যত হাঁটিতেছি, দুর্গম পথ আর শেষ হয় না। রাত্রিও অধিক হইল, "পুলবাজার" নিকটে, কেবল এ আশায় নির্ভর করিয়া অগ্রসর হইতেছি। এক জন সহযাত্রীরও দেখা পাইলাম না। একটা নিবিড় বাঁশবন ভেদ করিয়া চলিতেছি। এমন সময়ে কোন বন্যজন্তুর এমন একটা ভীষণ গর্জ্জন ধ্বনি কর্ণের প্রবেশ করিল যে, আমার শরীরের ধমনীগুলি কম্পিত হইয়া উঠিল, এমন একটা বিষম আতঙ্কের অবস্থা জীবনে কখনও অনুভব করি নাই। তথায় দাঁড়াইয়া থাকা নির্ব্বোধের কার্য্য বিবেচনা করিয়া প্রাণপণে দ্রুতগতিতে চলিলাম। নদীস্রোত চলিয়াছে বলিয়া নিম্নভূমির ধান্যক্ষেত্রগুলি ভয়ানক কর্দ্দম পূর্ণ। মাঝে মাঝে প্রকাণ্ড পাথর পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার উপর দিয়া চলিতে যে কষ্ট হইল, তাহা বর্ণনীয় নহে। জুতা কখন কখন কর্দ্দমে বদ্ধ হইয়া খসিয়া থাকে, আজ যে কোন লোকালয়ে পঁহুচা ভাগ্যে ঘটিবে, সে আশা মনে একবারও জাগিতেছে না। এমন ঘোর প্রতিকূল অবস্থায়ও যেন এক নূতন বল পাইয়া চলিতেছি। এ দিকে দুরন্ত শীতে হাত পা শরীর অসার করিয়া তুলিতেছে। হঠাৎ দূরে আলো দেখিয়া প্রাণে নূতন আশার সঞ্চার হইল, কতকগুলি শুষ্ক বাঁশপাতার আলো জ্বালাইয়া দ্রুতপদে চলিলাম। "ওগো তাঁহারা আসিতেছেন" আমার সহযাত্রী ভগ্নীর এই স্বর যেন সেই ঘোর শ্রান্তি ও নিরাশার মধ্যে কর্ণে অমৃত বর্ষণ করিল। যে পুলবাজারের অন্বেষণে এত ঘুরিয়াছি, এখন সেই পুলবাজার পঁহুছিয়া সর্ব্বশক্তিমান্ করুণাময় পিতাকে কত ধন্যবাদ দিলাম। দুইটী সহযাত্রী অগ্রে পঁহুছিয়া আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। এত বিলম্ব দেখিয়া বিপদ আশঙ্কায় কতই উদ্বিগ্ন হইতেছিলেন! আমাকে দেখিয়া মনে করিলেন, সকলেই বুঝি একত্র আসিয়াছি। আশ্রয়স্থানে পঁহুছিয়াও নিশ্চিন্ত হইতে পারিলাম না। যে ৬ জন সহযাত্রী পশ্চাতে রহিয়াছেন, তাঁহাদের কষ্ট ভাবিতে ভাবিতে মন নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। এই ঘোর অন্ধকারে দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া তাঁহারা রাত্রির মধ্যে পঁহুছিতে পারিবেন কিনা, সন্দেহ হইতে লাগিল। একান্তমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে লাগিলাম। প্রায় এক ঘন্টা পরে দূরে কথা শুনিয়া আশা হইল, তাঁহারা আসিতেছেন। সকলকে নিরাপদে পঁহুছিতে দেখিয়া যে অসীম আনন্দ জন্মিল, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। দলের অধিনায়িকা আমাদের কষ্ট দেখিয়া নিজকে শত দোষী ভাবিতেন। এবার এত কষ্টের পর একত্রিত হইয়া আমাদের গলা জড়াইয়া আনন্দের আতিশয্য বশতঃ কাঁদিয়া ফেলিলেন। প্রতিকূল অবস্থা আমাদের বন্ধুতা যেন শত গুণ দৃঢ় করিয়া দিল। পরস্পরকে স্নেহ সম্ভাষণ করিয়া গৃহাদির শৃঙ্খলায় ব্যস্ত হইলাম। "পুলবাজার" প্রকৃত পক্ষেই একটী বাজার। এখান হইতে অনেক আহারীয় দ্রব্য প্রতি সপ্তাহে দার্জ্জিলিং প্রেরিত হয়। মাড়োয়ারী মহাজনগণ বাজারের একমাত্র অধিবাসী। তাঁহারা আমাদিগকে যে প্রকার সমাদরের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন; তাহা কদাচ ভুলিব না। এক মহাজন আমাদের রাত্রিবাসের জন্য নিজের দ্বিতল ঘর ছাড়িয়া দিলেন। পরিষ্কৃত গৃহে প্রবেশ করিয়া যে আরাম অনুভব করিলাম, কোন কথায় তাহা প্রকাশ করিতে পারি না। আমাদের কথা বুঝিতে পারে, এমন লোক পাইয়া, কতদূর আশ্বস্ত হইলাম, তাহা কেবল আমরাই অনুভব করিতে পারি। সেই মহাজন লুচি তরকারী প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে আনিয়া উপহার দিলেন। আহার করিয়া বোধ হইল, এমন উপাদেয় দ্রব্য জন্মেও যেন আস্বাদন করি নাই। শুনিলাম, দার্জ্জিলিং এখান হইতে ৮ মাইল দূরবর্ত্তী, পরদিন ৪।৫ ঘন্টার মধ্যে অনায়াসে পঁহুছিতে পারিব। সকলেই বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। কিন্তু মনের আনন্দে নিদ্রা আসিল না। আজ আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন, পথের কষ্ট ও এক এক জনের আত্মকাহিনী শুনিতে শুনিতে যে হাসির তরঙ্গ উঠিল তাহা বলিবার নহে। গৃহে ৩টী শিশুর সরল স্নেহপূর্ণ মুখ আমার হৃদয়ে জাগিতেছে। এত ব্যগ্রতা বোধ হইতেছে যে, এ ঘোর রাত্রিতেও যাত্রা করিতে প্রস্তুত। এক সপ্তাহের অধিক কাল পৃথিবী হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া রহিয়াছি। আমার সংবাদও কেহ জানেন না, আমিও কোন সংবাদ রাখি না। নানা চিন্তার তরঙ্গ হৃদয়ে খেলিতে লাগিল। হঠাৎ রাত্রি প্রভাত হইয়াছে দেখিয়া চমকিত হইয়া শয্যা পরিত্যাগ করিলাম।
৩০শে সোমবার প্রভাত-সময়ে স্বভাবের শান্তিপূর্ণ ছবি প্রাণে নব উৎসাহ ঢালিয়া দিল। আজই গৃহে পঁহুছিয়া বন্ধুবান্ধব ও সন্তানদের স্নেহপূর্ণ মুখ দেখিব, ভাবিতে ভাবিতে কি অনির্ব্বচনীয় আনন্দ জন্মিতেছে। একটী ক্ষুদ্রস্রোতা নদী পুলবাজার বহিয়া কুলুকুলু শব্দে চলিয়াছে, আমরা তাহার নির্ম্মলজলে মুখ ধৌত করিয়া তৃপ্ত হইলাম। পুলবাজার পর্ব্বতের মূলদেশে অবস্থিত; আকাশভেদী পর্ব্বতমালা চারিদিকে মস্তক তুলিয়া রহিয়াছে। নদীর মধ্যে একখানা পাষাণখণ্ডে বসিয়া চারিদিকের নীরব সৌন্দর্য্য দেখিয়া লইলাম। পূর্ব্বদিবসের পথশ্রান্তির জন্য অনেকেই শীঘ্র শীঘ্র যাত্রার জন্য প্রস্তুত নহেন। আমি সর্ব্বাপেক্ষা ব্যস্ত, প্রতি মুহূর্ত্ত আমার নিকট দীর্ঘ সময় বোধ হইতেছে। যাত্রীদিগের প্রস্তুত হইবার বিলম্ব দর্শনে অধীর হইয়া পড়িতেছি। কিঞ্চিৎ জলযোগের পর যাহার যে পরিষ্কার বস্ত্রাদি অবশিষ্ট ছিল, তাহা পরিধান ও ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদ মস্তকে গ্রহণ করিয়া দার্জ্জিলিং অভিমুখে যাত্রা করিলাম। সকলেরই সহাস্য মুখ। বেশভূষার পারিপাট্য দর্শনে কে মনে করিতে পারে যে, আমরা এত কষ্টরাশি অতিক্রম করিয়াছি। ঘোড়াগুলি আরোহী পৃষ্ঠে লইয়া সগর্ব্বে বন্ধুর পার্ব্বতীয় পথে উপরে উঠিতেছে। আরোহিগণের কে আগে যাইবেন, বাজী রাখিয়া তাঁহারা বেগে ঘোড়া চালাইতেছেন। ডাণ্ডিওয়ালাগণও আমাকে লইয়া খুব ছুটিয়াছে। আমি সকলের অগ্রে, পশ্চাতের সহযাত্রীদিগকে দেখিতে দেখিতে চলিয়াছি। ক্ষুদ্র পর্ব্বতবাহিনী দুইটী নদী পার হইয়া চাক্ষেত্র ভেদ করিয়া অগ্রসর হইতেছি। এখন কেবল সোজা উপরে উঠিতে হইল। ঘোড়াগুলি ঘামে যেন স্নান করিয়াছে। চাক্ষেত্রের কুলিগণ বিস্ময়ে পূর্ণ হইয়া আমাদের বৃহৎ দলটি ভালরূপে দেখিবার জন্য নিকটে আসিয়া দাঁড়াইতেছে। আমরা কোথা হইতে আসিলাম বারবার কেবল এই একই প্রশ্ন। ক্রমে দার্জ্জিলিং সহরের গৃহগুলি মালার ন্যায় দৃষ্ট হইল। আমাদের হৃদয়ও আনন্দে নাচিয়া উঠিল। প্রায় ১টার সময়ে গৃহে পঁহুছিলাম। সন্তান ৩টীকে নিরাপদ ও সুস্থ দেখিয়া যে অসীম আনন্দ জন্মিল, তাহা প্রকাশ করা অসাধ্য। এতদিন দুঃখ কষ্ট ভোগের পর গৃহের মূর্ত্তি কি মধুর বোধ হইতেছে। প্রগাঢ় ভক্তিভরে সেই সর্ব্বমঙ্গলদাতা ঈশ্বরচরণে হৃদয় প্রণত হইল। সর্ব্বত্র তাঁহার দয়ার নিদর্শন দেখিয়া কৃতজ্ঞতাভরে হৃদয় উথলিয়া উঠিতেছে। যে উদ্দেশ্যে এত অর্থ ব্যয় ও কষ্ট স্বীকার করিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম, তাহা সফল করিয়া নির্ব্বিঘ্নে সুস্থ দেহে আবার সকলে একত্রিত হইলাম, একথা যত ভাবি, ততই মন কৃতজ্ঞতাসাগরে ডুবিয়া যায়।
ফেলুট হইতে জীবন্ত প্রত্যাগত হইয়াছি শুনিয়া বন্ধুবান্ধব অনেকেই সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তাঁহাদের সাদর সম্ভাষণে আমাদের দ্বিগুণ আনন্দ জন্মিল। সন্ধ্যাবেলা ওজন হইতে গিয়া জানিলাম, একসপ্তাহের পরিশ্রমে শরীরের ভার ৴৫ সের কমিয়াছে। এজন্য একটুও দুঃখিত নহি। প্রকৃতির মহান্ দৃশ্য দর্শন করিয়া আমাদের চক্ষে যে একটা দোষ জন্মিয়াছে, তাহা বলা উচিত।
এখন দার্জ্জিলিং সহরের জেলা পাহাড়, অব্সারভেটরী হিল প্রভৃতি পর্ব্বত বলিয়াই মনে হয় না। রাস্তাগুলি সমতল বোধ হইতেছে; এ পথে দিন রাত্রি চলিলেও যে ক্লান্তি বোধ হইতে পারে, এমন বোধ হয় না। রাস্তার বাহির হইলে হাসি পায়। ফেলুট হইতে প্রত্যাগত হওয়ার কয়দিন পরে বার্চ্চ হিল পার্কে ৯টী সহযাত্রী একত্রিত হইয়া বনভোজন করিলাম। পথের নানা গল্প করিতে করিতে দিনটা পরম সুখে চলিয়া গেল। একটা দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করিয়া ফিরিয়াছি বলিয়া আমাদের বিলক্ষণ সম্মান বাড়িয়াছে, কিন্তু তজ্জন্য আমার মনে একটুও গর্ব্বের ভাব আইসে না। পাঠক মনে করিবেন না আমার এ ভ্রমণকাহিনী অতিরঞ্জিত। অতিরঞ্জিত দূরে থাকুক, যেরূপ অভাবনীয় প্রতিকূল অবস্থায় পতিত হইয়াও ধৈর্য্যবলে অপরাজিতচিত্তে দার্জ্জিলিং প্রত্যাগত হইয়াছি তাহা বাস্তবিকই স্মরণযোগ্য। মন কষ্টে একটুও দমিয়া যাওয়া দূরে থাকুক, সুবিধা পাইলে আবার আজি "ফেলুট" যাত্রা করিতে প্রস্তুত আছি। জীবনে আবার কি তেমন আনন্দের দিন আসিবে?
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ বামাবোধিনী পত্রিকা, চৈতন্য লাইব্রেরি
[ মূল বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]