আহালদারায় একবেলা

সঞ্চারী সরকার


"কোন অচেনা দেশান্তরে, তোর সঙ্গে এই তেপান্তরে
মোর মনের প্রজাপতি
নাচি নাচি ঘুরি ঘুরি উড়ি উড়ি উড়ে যায়
মন হারানোর ঠিকানায়..."
-"মন হারানোর ঠিকানাই" বটে। মাঝে মাঝে মনটা পালাই পালাই রবে "মন হারানোর ঠিকানা"ই তো খোঁজে। আর তার সঙ্গী যদি হয় মাতাল হাওয়া, উড়াল মৌমাছিদের গুঞ্জন, গাছের কচিপাতা আর কোকিলের কুহুতান; তবে কেমন হয় বলুন তো! 'ফাগুনের' এই 'মোহনায়' চলুন ঘুরে আসি একটা অফবিট ডেস্টিনেশন থেকে।
উত্তরবঙ্গের মেয়ে হলেও বলতে একটুও সংকোচ বোধ হচ্ছে না যে আহালদারার নাম কিছুদিন আগে অব্দিও জানতাম না। বরং খানিকটা গর্ব অনুভব করলাম যে আমি এই নর্থ বেঙ্গলেরই মেয়ে। কত চেনা অচেনা ডেস্টিনেশনের প্রতিবেশী। সে যাই হোক আহালদারার নাম প্রথম জানলাম নার্সারি স্কুলের বন্ধু কৌশিকের ফেসবুকে দেওয়া কতগুলো দুর্দান্ত ছবি দেখে। ছবির ক্যাপশন দেখেই বুঝলাম বেশি দূর নয়, ঘরের পাশেই রয়েছে এই অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। নতুন জায়গার নাম দেখা মাত্রই অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যাত্রাপথের ব্যাপারে সব বিস্তারিত জেনে নিলাম। সময় সুযোগ হলে ভ্রমণ পিপাসু মন ঠিক পাড়ি দেবে এই অজানা ঠিকানায়। গুগুলেও সার্চ করে আরও কিছু ফটো দেখে নিলাম, বুঝতে অসুবিধা হল না যে জায়গাটির কমার্শিয়াল হতে খুব বেশি দেরি নেই, তার আগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে ঘুরে আসতে হবে। আসলে ঘুরতে গেলে কিছুটা নির্জনতাই তো চায় মন। যাই হোক বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না, সুযোগ এল আমার মাসি আর মাসতুতো ভাই-এর হাত ধরে। কর্মব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে বেশ কিছুদিন ধরে মনটা তো পালাই পালাই করছিলই সঙ্গে কৌশিকের দেওয়া ছবিগুলো আগুনে ঘৃতাহুতির মতই কাজ করল। প্রস্তাবটা আমিই রাখলাম মাসির কাছে, চলো ঘুরে আসি। হুজুগে সাড়া দিয়ে মাসিই যাওয়ার দিন আর গাড়ি ঠিক করার কাজটা সেরে নিল।

নির্দিষ্ট দিনে চূড়ান্ত উত্তেজনায় ভর করে রওনা হলাম আহালদারার উদ্দেশ্যে। জলপাইগুড়ি থেকে গজলডোবার তিস্তার হাওয়া চোখে-মুখে মেখে, ওদলাবাড়ির পাহাড়ঘেরা ঘিস নদীর চোখজুড়ানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সেবকে এসে পৌঁছলাম। ভাইয়ের আবদারে ফটো তোলার অছিলায় এখানে খানিক বিরতি। বেশি দেরি না করে আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, পথের সঙ্গী হল আরও একজন - তিস্তা। রাস্তার একদিকে দেওয়ালের মতো পাহাড়, আরেক দিকে গভীর খাদ, সঙ্গে বয়ে চলেছে পাহাড়ি মেয়ের মতই উচ্ছ্বল সবুজরঙা তিস্তা, উফ্ মনোরম দৃশ্য। 'করোনেশন ব্রিজ'-কে ডান হাতে রেখে, কিমি দুই-তিনেক গেলেই কালীঝোড়া বাজার, এখান থেকে কিমি খানেক গেলেই পড়বে হনুমান মন্দির, হনুমান মন্দিরকে ডান দিকে রেখে বিরিক মোড় হয়ে যে রাস্তাটা সোজা ওপরের দিকে উঠে গেল সেখানেই তো অপেক্ষা করছে আমাদের বহুকাঙ্খিত উইক-এন্ড ডেস্টিনেশন আহালদারা।

হিমালয়ের অপার সৌন্দর্যের নীরব দর্শক হয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি গন্তব্যের দিকে। জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না কোনও কিছুই যেন স্পর্শ করে না এই সৌন্দর্যকে! শুধুই এক চুম্বকীয় আকর্ষণ। পথের সৌন্দর্য মনকে যেন এক অন্য সুরে বেঁধে দিল। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অবিশ্রান্ত তিস্তা। নীচে গভীর খাদ। তারই মধ্যে মাঝে মাঝে নজর কাড়ছে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, পাহাড়ের ধাপ কেটে ঝুমচাষ, বাঁশ ও বেতের ঝাড়, দূর থেকে ভেসে আসা নাম না জানা নানা রকম পাখির কিচির-মিচির, আর হলুদ, বেগুনি, গোলাপি, ম্যাজেন্টা, পার্পল, আকাশি-নীল রঙের অজস্র ফুলের মেলা। আর যেটার কথা না বললে পুরো লেখাটাই অসম্পূর্ণ থাকবে তা হল কমলালেবুর গাছ। অজস্র কমলালেবু ধরে গাছগুলো একেবারে নুইয়ে পড়েছিল। গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় একসঙ্গে এতগুলো কমলালেবু দেখার সৌভাগ্য আমার এর আগে হয়নি। অসাধারণ লাগছিল পুরো ব্যাপারটা। রাস্তা ক্রমশ চড়াই হচ্ছে ঠিকই কিন্তু রাস্তার অবস্থা ভালো হওয়ায় যাত্রাপথের ক্লান্তি অনুভূত হল না। বরং যাত্রাপথের সৌন্দর্যকে আরও বেশি করে উপভোগ করার জন্য গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণের বিরতি নিলাম, সুযোগ পেয়ে ভাইও আহ্লাদের সঙ্গে ফোটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যাই হোক খুব বেশি সময় নষ্ট না করে চটপট আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম, গাড়ি চলতে শুরু করল তার নিজস্ব ছন্দে।

রডোডেনড্রন-পাইন-ফার- ম্যাপলের সরলবর্গীয় অরণ্য চিরে হিমালয়ের পাকদন্ডী পেরিয়ে একটা সময়ে আমরা উঠে এলাম মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির একেবারে হায়েস্ট পয়েন্টে অর্থাৎ আমাদের গন্তব্য আহালদারায়। কী অমোঘ সৌন্দর্য চারিদিকে! এখানে অল্টিটিউড প্রায় ৪৩০০ ফিট। গাড়ি পার্ক করিয়ে একচিলতে চা-বাগানের সবুজ ঢাল আর সিঙ্কোনার জঙ্গল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেখানে এসে পৌঁছলাম সেখানে দেখলাম একদিকে তিনটে মেরুনরঙা কটেজ আর আরেকদিকে জমি খানিকটা নীচু হয়ে চলে গিয়েছে আহাল ভিউ পয়েন্ট-এ। এক মুহূর্তও দেরি না করে আমি আর মাসি সটান চলে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। ভাই আগেই চলে যাওয়ার কাজটি সেরে রেখেছে ফটো তোলার তাগিদে।

যাই হোক, কার্শিয়ং, মংপু, তিনচুলে, টাইগার হিল, কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁও সহ শিলিগুড়ি ও ডুয়ার্সের সমতল এরিয়ার পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়, এই 'আহাল' পাহাড়ের ভিউপয়েন্ট থেকে। আর বাকি সব জায়গা থেকে এখানেই আহালদারার স্বাতন্ত্র্যতা। নর্থ বেঙ্গলের মেয়ে হওয়ার সুবাদে এখানকার বেশিরভাগ গন্তব্যস্থান চষে ফেলেছি প্রায়, কিন্তু ৩৬০ ডিগ্রি ভিউটা অন্য কোথাও থেকে এতটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। লিটার‍্যালি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখছিলাম। কী অপরূপ সৌন্দর্য আর কী গভীর নিস্তব্ধতা চারিদিকে! পার্থিব যা কিছু সব তুচ্ছ এই স্বর্গীয় দৃশ্যের সামনে। কপাল ভালো আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে তন্বী কাঞ্চনজঙ্ঘা তার সুস্পষ্ট রূপ প্রকাশ করে অপার্থিব সুখ প্রদান করেন তাঁর রূপমুগ্ধ অগণিত ভক্তকুলকে। কিছুক্ষণ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবিষ্ট হয়ে থাকার পর শুরু হল ফটো তোলার পালা। ফটো তুলতে তুলতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম প্রকৃতি যেন নিজস্ব কায়দায় কোনও মানুষের প্রতিকৃতি খোদাই করে রেখেছে। খুব খেয়াল করে দেখলে মনে হতে পারে এ অন্য কেউ নন, স্বয়ং রবি ঠাকুর যেন! লক্ষ্য করা মাত্রই এই প্রাকৃতিক ভাস্কর্যকে ক্যামেরাবন্দী করতে ছুট লাগালাম। মাসির চোখ রাঙানির কাছে বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না আমার শখের ফোটোগ্রাফি; পাছে পা হড়কে পড়ে যাই। হাতে সময় বেশি ছিল না লাতপাঞ্চার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ফেরার পথে খবর নিয়ে জানতে পারলাম কটেজগুলোতে রাতপ্রতি ১৫০০ টাকা করে ভাড়া। চাইলে ট্রেকও করতে পারেন।

গাড়ি আবার স্টার্ট নিল। গন্তব্য আহালদারা থেকে কিমি পাঁচেক দূরের লাতপাঞ্চার। কালীঝোড়া থেকে আহালদারার উল্টো দিকের রুটে প্রায় তের কিমি পার করলেও অবশ্য পৌঁছে যাওয়া যায় লাতপাঞ্চারে, তবে ওই রাস্তাটা খুব একটা ভালো নয়। যাই হোক আহালদারা থেকে আমাদের এই যাত্রাপথে প্রচুর সিঙ্কোনা গাছ চোখে পড়ল। জানতে পারলাম একদা এখানে সিঙ্কোনা গাছের চাষ করা হত এবং অঞ্চলটি এক সময় সিঙ্কোনা গাছের জন্য বেশ প্রসিদ্ধও ছিল। পাহাড়ের পাথুরে বুক চিরে নেমে আসা ঝর্নার জল যেন স্বাগত জানাল আমাদের লাতপাঞ্চারে। লাতপাঞ্চারে গিয়ে প্রথমেই লাঞ্চটা সেরে নিলাম। লাঞ্চ করতে করতেই দোকানের বছর ছাব্বিশের ছেলেটার কাছে জানতে পারলাম কাছেই একটা বার্ড ওয়াচিং পয়েন্ট রয়েছে, নাম হর্ণবিল নেষ্ট। সেখানে গাড়ি যায় না, হেঁটে যেতে হবে। নানা রকমের পাখির কলতানে স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে হর্নবিল নেষ্ট। এটিই লাতপাঞ্চারে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য। সময়ের অভাবে আমরা সেখানে যেতে পারিনি তাই চারপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। লাতপাঞ্চারে লেপচা জনগোষ্ঠীর আদি বাসভূমি ছিল। তাই এখানে বেশিরভাগই লেপচা জাতির মানুষজন চোখে পড়ল। লেপচা ভাষায় 'লাতপাঞ্চার' মানে 'বেতের জঙ্গল'। অরণ্যপ্রেমীদের জন্য আদর্শস্থান লাতপাঞ্চার। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী ডেস্টিনেশনের উদ্দেশ্যে - নামথিং পোখরি।

নামথিং পোখরিতে আমরা যখন এসে পৌঁছলাম ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় সাড়ে তিনটে ছুঁই ছুঁই। নেপালী ভাষায় পোখরি মানে লেক। লেক হলেও জল ছিল না এই সময়। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদের ছোঁয়ায় শুকনো লেকটাকে ঘিরে থাকা পাইন-ফারের সরলবর্গীয় বৃক্ষরাজি পরিবেশকে স্বর্গীয় করে তুলেছিল। মাসির ইচ্ছায় কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে এই জলহীন লেকেই নেমে ছিলাম আমরা। নীচু সমতল ভূমিটিকে ঠিক যেন গল্ফকোর্স মনে হচ্ছিল। কী ভীষণ উজ্জ্বল সবুজ চারিদিকে! এই স্থানটির নির্জনতাও মনকে উচ্চমার্গে নিয়ে যায়। পাহাড়ের কোলে হেলে পড়া অস্তমিত সূর্য জানান দিচ্ছে আমাদেরও ফেরার সময় হয়ে এসেছে। তবে একবেলার এই এতো কম সময়েও যা দেখেছি তা অনেক দিন পর্যন্ত মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে মনকে সতেজ রাখবে।



 

আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা সঞ্চারী সরকার ভালোবাসেন বেড়াতে। সময় পেলেই ঘুরে বেড়ান উত্তরবঙ্গের আনাচেকানাচে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher