শিলাইদহ থেকে সাগরদাঁড়ি
শীলা চক্রবর্তী
ভরা শ্রাবণের বৃষ্টি মাথায় নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলাম, কিন্তু সীমান্ত পেরোতেই ঝকঝকে রোদের হাসি দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করল বাংলাদেশের প্রকৃতি। গন্তব্য ছিল শহর খুলনা। ইমিগ্রেশনের নিয়মকানুন মিটিয়ে অটো ধরে বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশন, ঘন্টা দুয়েকের ট্রেনযাত্রার পর খুলনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়িটি অবস্থিত কুষ্টিয়া জেলায়। সেখানে যাবার জন্য ভোর ছটায় খুলনা থেকে প্রথম বাস ছাড়ে, নাম গড়াই, সময় লাগে ঘন্টা পাঁচেক। রাস্তা মসৃণ, যাত্রা কষ্টকর নয়। কুষ্টিয়া পৌঁছে প্রথমেই যাওয়া হল লালন আখড়ায়। বাসস্ট্যান্ডের অদূরেই, শহরের একেবারে মধ্যিখানে আখড়াটি। মূল প্রবেশপথের দুই ধারে দুটি স্তম্ভ, তার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়ানো দুটি বিশাল একতারা। তার পরেই ভিতরের প্রবেশপথটি, চারটি থামের ওপর জালিকাটা গম্বুজ, সাদা। ভিতরে কালো কালিতে সাঁইজির গানের বাণী লেখা – "মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি"।
এরপর বিশাল গেট পেরিয়ে কেয়ারি করা পাতাবাহারের সারি, মোট তিনটি। এধার ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাঁইজির শিষ্য-শিষ্যাদের সমাধি। প্রাঙ্গনের ঠিক মধ্যিখানে সমাধি মন্দির, তার প্রাঙ্গনেও বিশাখা ফকিরানী সহ অনেক সমাধি। মূল কক্ষটির ভিতরে ডানদিকে কালো পাথরে বাঁধানো ফকির লালন শাহের সমাধি। বাঁদিকে তাঁর পালক মা মতিজান ফকিরানীর সমাধি।
সেখান থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে বিরাট চত্বর, সাঁইজির গান শোনালেন বাউলরা। পিছনেই সাঁইজি সম্পর্কে গবেষণাগার এবং সংগ্রহশালা। রয়েছে বিশাল তামার 'ডেগ', এই হাঁড়ি থেকেই জাতপাত নির্বিশেষে খাবার তুলে খেতেন সাঁইজির শিষ্যরা। রয়েছে সাঁইজির ব্যবহৃত তামাক খাবার হুঁকো গড়গড়া, একতারা, গুবগুবি। এছাড়া রয়েছে সাঁইজির ঘরের দরজা, বসবার চৌকি। রয়েছে নানা শিল্পীর আঁকা সাঁইজির ছবি এবং আরও অনেক কিছু।
আখড়া থেকে বেরিয়ে কুঠিবাড়ির পথে। গন্তব্যের মধ্যপথেই পড়বে বিষাদসিন্ধু খ্যাত মীর মোশারফ হোসেনের বাড়ি। বাড়িটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অধিগৃহীত। রয়েছে দোতলা স্কুলবাড়ি, মীর সাহেবের নামাঙ্কিত। বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের একধারে রয়েছে সংগ্রহশালা। সেখানে মীর সাহেবের প্রচুর ছবি, ব্যবহৃত আসবাবপত্র, গড়গড়া ইত্যাদির সঙ্গে রয়েছে বিষাদসিন্ধুর মূল পান্ডুলিপি। সংগ্রহশালার ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ।
সেখান থেকে সোজা কুঠিবাড়ি। মোট পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ, যথেষ্ট খারাপ রাস্তা। কুঠিবাড়িটি রবিবার পূর্ণদিবস ও সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। খানিকটা দূরেই পদ্মা। শোনা যায় আগে কুঠিবাড়ির গা ঘেঁসেই বয়ে যেত, এখন বেশ দূরে। বিশাল চওড়া ঘোলা জলের নদী, স্রোত একমুখী। নৌকো বাঁধা তীরে, কোথাও শরবন।
কুঠিবাড়ির ভিতরেও রয়েছে পাতাবাহারের কেয়ারি। তিনতলা বাড়িটি লাল, দরজা জানালা সবুজ, জাফরিকাটা।
যেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িরই প্রতিরূপ। রোয়াক পেরিয়ে ঢুকতেই কাঁচের বিশাল বাক্সে রাখা পদ্মা বোটের রেপ্লিকা। রয়েছে কবির ব্যবহৃত শোওয়ার খাট, লেখার টেবিল, লোহার সিন্দুক, আট এবং ষোলো বেহারাবাহিত পালকি। রয়েছে ঘাস ছাঁটবার, আগাছা নিড়াবার এবং জল পরিশোধন করবার যন্ত্র। রয়েছে কবির লেখার প্রতিরূপ ও ছবি, সারা বাড়িতে ছড়ানো। তাঁর ব্যবহৃত একটি সিঁড়ি রয়েছে। সোফা, হাতপালকি, আরামকেদারা সহ বিবিধ বস্তু রয়েছে। কুঠিবাড়ির ডানদিকের ঘাটবাঁধানো পুকুরটিতে ভাসানো আছে বিখ্যাত পদ্মাবোট। ভাঙ্গাচোরা, কোনোমতে কাঠামোটি রয়েছে। এছাড়া কুঠিবাড়ির বাইরেও একটি সুন্দর পুকুর রয়েছে। গীতাঞ্জলি, সোনারতরী, খেয়া প্রভৃতি সরকারী আবাস, থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং করতে হবে। আমরা ফিরে এসেছিলাম। খুলনা ফেরার শেষ বাসটি কুষ্টিয়া থেকে বিকেল চারটেয় ছাড়ে।
একদিন পরেই বেরিয়ে পড়া গেল যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি ঘুরে দেখতে। পৌঁছতে সময় লাগে ঘন্টা দুয়েক। খুলনা থেকে চুকনগর, সেখান থেকে বাস বা অটোয় কেশবপুর বাজার, সেখান থেকে অটোয় সোজা মধুকুঠি। ব্যক্তিগত গাড়ি নেওয়াই ভালো। প্রথমেই চলে গেলাম কপোতাক্ষ তীরে। নদীটি আগে মধুকুঠির ধার দিয়েই বয়ে যেত, এখন বেশ খানিক দূর, হাঁটাপথে মিনিট দশ-পনেরো। বিস্তীর্ণ রোয়াক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে বাঁদিকে সাগরদাঁড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কচিকাঁচাদের কলতানে মুখরিত। সরকার অধিগৃহীত কবির পৈতৃক বাসস্থানের অঙ্গনে সরকারি স্কুল। পাশেই বিশাল বাগান, একধারে পুকুর, শানবাঁধানো ঘাটটির বেশিরভাগটাই ভেঙেচুরে গেছে।
মূল বাড়িটির বেশ অনেকগুলি ঘর নিয়ে সংগ্রহালয়টি। পুরোটাই একতলায়, দোতলায় ওঠার পথ বন্ধ। বিস্তীর্ণ প্রশস্ত প্রাঙ্গণ ঘিরে অনেকগুলি দালান সাগরদাঁড়ির জমিদারদের। সেখানে রয়েছে কবির পারিবারিক ব্যবহৃত খাট, লোহার সিন্দুক, পাথরের পাত্র, লোহার সুদৃশ্য একটি ঢাকা দেওয়া টুপি রাখার জায়গা, কবির বংশলতিকা রয়েছে, বিখ্যাত টেনিসতারকা লিয়েন্ডার পেজের মা জেনিফার, কবির নাতির নাতনি, রয়েছে তাঁর নাম। রয়েছে কবির প্রচুর ছবি, তাঁর বিভিন্ন কবিতার ছবি, ফ্রেমে বাঁধানো।
দেউড়ির পাশেই একটি ছোটো, ঘেরা বাগানে কবির আবক্ষ মূর্তির তলায় শ্বেতমর্মরের ফলকে বাঁধানো মধুকবির সেই বিখ্যাত এপিটাফ বা স্বরচিত সমাধিলিপিটি রয়েছে –
"দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে,
তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এ সমাধিস্থলে..."
কবি শেষ শয্যায় শায়িত আছেন কলকাতার পার্কস্ট্রিট সমাধিস্থানে, সেখানেও এটি উৎকীর্ণ আছে। কবির জন্মদিনে, মধুমেলায়, মধুপল্লীতে দেশবিদেশ থেকে প্রচুর জনসমাগম ঘটে।
শীলা চক্রবর্তীর জন্ম বাংলাদেশের খুলনায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক । মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাধ আইনে স্নাতকোত্তর। প্রয়াগ এলাহাবাদ সঙ্গীত একাডেমি থেকে ধ্রুপদী সঙ্গীতে স্নাতক। পেশায় আইনজীবী। ভালবাসার জায়গা গান, কবিতা, নাটক, লেখালিখি। বেড়াতে ভালবাসেন। দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখির যুক্ত রয়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখাপত্র প্রকাশিত হয়।