জুরিখ থেকে আল্পসের তিত্লিস হিমবাহে
সুদীপা দাস ভট্টাচার্য্য
~ স্যুইৎজারল্যান্ডের আরও ছবি ~
জুরিখ আগমন
চেক প্রজাতন্ত্র-র রাজধানী প্রাগ থেকে 'স্টুডেন্ট এজেন্সি'-র বাসে স্যুইৎজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে এসে পৌঁছেছিলাম ২০১৪-র নভেম্বরের এক সকালবেলা। 'বুকিং ডট্ কম্' এর সাহায্যে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত হোটেল 'লিম্মাতহফ্'-এ আগে থেকেই একখানা ঘর বুক করা ছিল। আমাদের ঘর পাঁচতলায়। ঘরটা দেখলাম ছোট হলেও ঝকঝকে এবং আরামদায়ক। হোটেলটার সবচেয়ে বড় দুটো প্লাসপয়েন্ট হল অনবদ্য স্টাফ এবং দুর্দান্ত লোকেশন। হোটেলের ঠিক সামনেই চওড়া প্রধান রাস্তা, চৌমাথা, 'সেন্ট্রাল' ট্রাম স্টপ আর রাস্তার ওপার দিয়ে বয়ে যাওয়া ছিমছাম শান্ত লিম্মাত নদী; নদীর নামেই হোটেলের নাম। চটজলদি চেক্-ইন সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্য এ শহরের প্রধান আকর্ষণ জুরিখ লেক।
হোটেল এর রিসেপশন ডেস্ক থেকে জানিয়েছিল লিম্মাত নদী জুরিখ লেক থেকেই জন্ম নিয়ে উত্তরদিকে বয়ে শহরের মধ্যে দিয়ে গেছে। সুতরাং নদীটার পাশে পাশে দক্ষিণে মিনিটপাঁচেক হেঁটে গেলেই জুরিখ লেক শুরু। সেই মতোই এগোলাম। ছোট্ট ঝকঝকে লিম্মাত; স্বচ্ছ জলের নীচে ছোট ছোট নুড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। নদীর ওপর দিয়ে সরু পায়েচলা সেতু চলে গেছে ওপারে। ব্রীজের রেলিং-এ অজস্র রংবেরঙের তালা আটকানো। হয়তো এখানে তালা বাঁধলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়! আরও কিছুটা এগোবার পর এমনই একটা সেতুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে চোখে পড়লো লিম্মাত নদীটা যেন হঠাৎই চওড়া আর বিশাল একটা জলরাশির মধ্যে গিয়ে মিশেছে। আর সেই জলের ওপারে ধূসর পাহাড়ের রেখার পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে ঝকঝকে বরফের চূড়াগুলো। বুঝতে পারছিলাম ওই ঝাঁচকচকে জলটাই জুরিখ লেক যাকে ঘিরে আছে সুইশ আল্পস্ পর্বতমালা-র সারি।
পায়ের পাতা ডুবিয়ে জুরিখ লেকে
লেকের দিকে যতই এগোচ্ছি, জায়গাটার জমজমাটি ছবি ক্রমশ চোখের সামনে ফুটে উঠছে। লিম্মাত-এর ওপর সারিবদ্ধভাবে বাঁধা ছোট ছোট মোটর বোট; বোটগুলো বেশিরভাগই নীল, সাদা অথবা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা; বোটগুলো ভ্রমণার্থীদের লেক সফর করায়। জলের ওপর নীল-সাদা আকাশের ছায়ায় একই রঙের কাপড়ে ঢাকা বোটগুলোকে ভারী সুন্দর মানিয়েছে। এবার লেক শুরু; দক্ষিণে যতদূর চোখ যায় শুধুই জলের বিস্তার আর জল ঘিরে গুরুগম্ভীর আল্পস্। লেকের জল যেন আকাশের রং মেখেই এত অতলস্পর্শী নীল। আর সেই নীলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট সাদা পালতোলা নৌকা। শখের মাছ-শিকারীরা বোট থেকে জলে ছিপ ফেলে বসে আছে; লেকের ধার ঘেঁসে বড় বড় লঞ্চের মধ্যে ভাসমান রেস্তোরাঁ; লেকের ধার দিয়ে বৃক্ষশোভিত চওড়া পায়ে হাঁটা পথ; জল ঘেঁসে অথবা রাস্তার একদিকে বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ। সব বেঞ্চই ভর্ত্তি। অনেকে সপরিবারে বা যুগলে বসে ছুটিযাপন এবং খাওয়াদাওয়া করছে; কেউ বা একা জলের ধারের বেঞ্চে লম্বমান হয়ে মিঠে রোদের আমেজ উপভোগ করছে। পুরোটা জুড়ে যেন এক অনন্ত ছুটির মেজাজ।
লেকের আর এক আকর্ষণ দলে দলে ভেসে বেড়ানো বিশাল বিশাল রাজহাঁস। লেকের নীল জলে দুধসাদা ডানার দ্যুতি ছড়িয়ে গর্বিত হাঁসগুলো তরতরিয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে; সঙ্গে আরও অনেক জলচর পাখিও ভিড় করেছে ট্যুরিস্টদের ছুঁড়ে দেওয়া খাবারের লোভে। অনেকেই দেখছি আলাদা করে খাবার কিনে এনেছে শুধু পাখিগুলোকে খাওয়াবে বলেই। এক তিব্বতি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হল; বর্তমানে কর্মসূত্রে ওরা জুরিখেরই বাসিন্দা; তারা এক বিশাল পাউরুটি কিনে এনেছে হাঁসগুলোকে খাওয়াবে বলে, এবং জানালো ছুটির দিনে এমন তারা প্রায়শই করে। জলের মধ্যে খাবার ছুঁড়ে দিলেই পাখিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মারামারি করে ছিনিয়ে নিচ্ছে এ-ওর খাবার। এই লড়াইয়ে অপেক্ষাকৃত শ্লথগতি বিশালদেহ রাজহাঁসগুলোই পিছিয়ে পড়ছিল। আমার তিন বছরের কন্যা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পুরো এক প্যাকেট চিপস উপুড় করে দিয়েছে জলের ওপর এবং আরও এক প্যাকেট দেওয়ারও সবিশেষ ইচ্ছা; তাকে কোনোক্রমে নিরস্ত করে লেকের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলাম একটু ফাঁকা জায়গায় বসার জন্য।
আমরা লেকের উত্তরপ্রান্ত থেকে দক্ষিণে এগোচ্ছি; দেখছি লেকের দক্ষিণে বরফের চূড়াগুলোয় রোদ ঝলসাচ্ছে। লেকের ওপর লঞ্চ জেটি থেকে লঞ্চ ছাড়ছে রাপারস্উইল বলে একটা জায়গার উদ্দেশ্যে; জেটির ওপর বেশ ভীড়। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে জানলাম রাপারস্উইল এখান থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে লেকের পূর্বপারে অবস্থিত একটা জায়গা আর এই ফেরি সেখানে যাওয়ারই একটা মাধ্যম। হাঁটতে হাঁটতে ভীড় ছাড়িয়ে বেশ একটু ফাঁকায় এসে পড়েছি, হঠাৎ বেশ একটা মজার ব্যাপার ঘটলো; দেখছি লেকের ধারের রাস্তার ওপর একপাশে দুটো লালচে পাথরের ভাষ্কর্য; এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার বেঞ্চে বসা মূর্তি– বৃদ্ধার মাথায় টুপি, বৃদ্ধর হাতে লাঠি। এখানে পথে-ঘাটে এমন মূর্তি ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি, তাই তেমন আমল না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি; হঠাৎ দেখি লাঠির ওপর রাখা মূর্তির হাতের আঙুল নড়ছে – একবার নয়, বারংবার। হতভম্ব হয়ে দেখি এ তো মূর্তি নয়, স্যুইস ভিক্ষুকযুগলের ভিক্ষা করার আজব কায়দা! এতক্ষণে চোখে পড়লো তথাকথিত মূর্তিযুগলের পায়ের কাছে একইরকম রঙকরা একটা কৌটোও ছিল, টাকা দেওয়ার জন্য।
অনেকটা সোজা যাওয়ার পর লেক বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে। এখানটায় লেকের ধারে ধারে বেশ একটা সবুজ ঘাসে মোড়া সাজানো পার্ক; জলের ধারে গাছের তলায় পছন্দের বই হাতে বসে বেশ সময় কাটানো যায়; জলের কিনারে বড় বড় পাথরের ওপর বসে পা ডুবিয়ে দিলাম লেকের ঠান্ডা জলে। সামনে চল্লিশ কিলোমিটার দীর্ঘ অথৈ লেকের কিনারাহীন প্রশান্তগম্ভীর জলরাশি; একলা বোট লেকের মধ্যে নিষ্কম্প হয়ে মাছের প্রতীক্ষায়; জলছোঁয়া হাওয়ার সঙ্গে নিস্তব্ধতা ভেঙে উড়ে আসছে পাখিগুলোর ডানা ঝাপটানোর শব্দ। অপার্থিব এক শান্তি চারদিকে।
স্টেশন, অতিকায় দেবদূত এবং সুইশ চকোলেট
বেলা অনেকটা বেড়েছে। বেশ ক্ষুধার্ত বোধ করছি সকলেই। লেকফেরত রাস্তার পাশের একটা ছোট রেস্তোরাঁ থেকে হটডগ আর স্যান্ডুইচ দিয়ে বেশ জম্পেশ ভোজন হল। এবার এগোলাম জুরিখ হাফ্টবানহফ্ বা মেইন রেলস্টেশনের দিকে। সুপ্রশস্ত রাস্তার দুপাশে চমৎকার গড়নের সব বাড়ি; পাঁচ কামরার ট্রাম চলছে রাস্তায়; জুরিখ অপেরা হাউসের মাথায় পাথরের পরী উড়ছে; চার্চ, ঘড়িঘর, বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মূর্ত্তি, ফোয়ারা, রঙচঙে পতাকায় সাজানো ঝলমলে রোদমাখা শহরটাকে আগাগোড়া ভারী প্রাণবন্ত লাগছে। লিম্মাত পেরিয়েই পশ্চিম দিকে স্টেশন। সিল্ নামের আরও একটা ছোট্ট নদী স্টেশনের সামনে দিয়ে উত্তরমুখে বয়ে গিয়ে মিলেছে লিম্মাত-এর সঙ্গে। শুনলাম স্টেশনের কিছু অংশ নাকি সিল্-এর নীচে বানানো। জুরিখ রেলস্টেশন স্যুইৎজারল্যান্ডের ব্যস্ততম স্টেশনগুলোর মধ্যে একটা। এখান থেকে এ দেশের অন্যত্র এবং ইওরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগ আছে। দেখছি অজস্র প্লাটফর্ম থেকে মুহুর্মুহু বহুদিকে ছেড়ে যাচ্ছে ঝকঝকে দ্রুতগতিসম্পন্ন সব দোতলা ট্রেন। আমরাও ইনফর্মেশন কাউন্টার থেকে আমাদের আগামীকালের গন্তব্যের যাবতীয় বিবরণ সংগ্রহ করে নিলাম। ইনফর্মেশন ডেস্কের মেয়েটি বেশ সহৃদয় এবং সহায়ক; আগামীকালের ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়া আসার সমস্ত ট্রেনের পুরো সময়-সারণী, ভাড়া ইত্যাদির প্রিন্টআউট দিয়ে দিল আমাদের। আমার কন্যার দুটো বেলুনও প্রাপ্তি হল তার থেকে। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে স্টেশন ঘুরে দেখছি, দেখি স্টেশনের ভেতর বিরাট হল্-এ কয়েকটা ফুটবল গ্রাউন্ড ঢুকে যায়; সেখানে একদিকে যেমন ধূমপায়ীদের আড্ডা থেকে বেসুরো গলার গান ভেসে আসছে তেমনি আর এক দিকে একটা পথনাটক আর ক্যুইজ গোছের কিছুর পুরস্কার বিতরণ চলছে; স্টেশনের ভেতরই কাফে, রেস্তোরাঁ, গিফ্ট শপ্ থেকে শুরু করে বিখ্যাত সুইশ চকোলেটের লোভনীয় সম্ভার। শেষোক্ত দোকানটায় না ঢুকে পারা গেল না; কাচের শো-কেসে থরে থরে সাজানো রয়েছে হরেক ছাঁদের হরেক স্বাদের গাঢ় খয়েরী-রঙা অমৃত। সুন্দর সোনালীরঙা আর লাল শাটিন ফিতে বাঁধা চৌকোনা বাক্স থেকে তাদের অবিরাম হাতছানি আর উপেক্ষা করা গেল না। কিছু আস্বাদন এবং কিছু আহরণ করে স্টেশনের ভেতরের হলের দিকে এসে দেখি একদিকে ছাদ থেকে ঝুলছে এক অতিকায় নীল গার্জেন অ্যাঞ্জেল; তার চোখ মুখ নেই, মাথাটা ছোট, পরনে বহুবর্ণ খাটো পোশাক, পিঠে সোনালী ডানা, হাতে একগাছা দড়ির মতো কিছু – সেটা জ্বলছে নিভছে। ইনফর্মেশন বুকলেট দেখে জানলাম এই ভাষ্কর্য্যটির স্রষ্টা শিল্পী নিকি দ্য সেইন্ট ফ্যাল; ১.২ টন ওজন এবং ১১ মিটারেরও বেশি উচ্চতার এই অ্যাঞ্জেল হল সুইশ রেলওয়ের ১৫০ বছর উপলক্ষে একটি উপহার। বলাবাহুল্য, এই বৃহদাকৃতি অ্যাঞ্জেলটিকে আমার কন্যার এতটুকু পছন্দ হল না!
বেরোবার সময় আমরা স্টেশনের অন্য দিকটা দিয়ে বেরিয়ে বানহফপ্লাট্জ্ এর দিকে চলে এসেছি; এদিকটা আরও সাজানো। স্টেশনের সুউচ্চ, ভাস্কর্যমন্ডিত প্রবেশদ্বারের মাথায় সুইশ পতাকা উড়ছে; গেটের সামনের ফোয়ারা দিয়ে সাজানো গোল জায়গার শিল্পী রিচার্ড কিসলিং এর গড়া সুইশ রাজনীতিবিদ এবং শিল্পপতি আলফ্রেড এস্চার এর মূর্তি; আর তার ঠিক সামনাসামনি সোজা চলে গেছে প্রশস্ত বানহফস্ট্রাসি – এ শহরের তো বটেই, সমগ্র ইওরোপেরও অন্যতম অভিজাত শপিং আভেন্যু। এ রাস্তা মূলত পদচারীদের দখলে; আমরাও স্রোতে গা ভাসালাম আর রাস্তাটার জৌলুস দেখে চোখে ধাঁধা লেগে গেল। রাস্তার দুপাশে সারবাঁধা দোকানের কাচের ভেতর থেকে হাতছানি দিচ্ছে নামীদামী ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক ফ্যাশনের পোশাক থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ ডিজাইনের জুয়েলারি, ব্রান্ডেড সুইশ ঘড়ি থেকে বিভিন্ন কসমেটিক্স সামগ্রী অথবা সাদা পশমের আদুরে টেডি বেয়ার পরিবার; সাদা আলোর খেলায় দোকানের সুবিশাল কাচে ফুটে উঠেছে মডেলদের ক্যাট-ওয়াক; ফুটপাতে ছাতা খাটানো রেস্তোরাঁতে আছে পানভোজনের ঢালাও ব্যবস্থা। এরই মধ্যে দেখি একটা হ্যান্ডিক্র্যাফ্টস্ এর দোকানে দুলছে আমার কৈশোরে দেখা মন উচাটন করা যশ চোপড়া মুভির বিখ্যাত 'কাউবেল!' নাগালের মধ্যে টুকটাক কিছু কেনাকাটা সেরে আমরা হেঁটে হেঁটে শহর ঘুরতে লাগলাম। পায়ে হেঁটে না ঘুরলে একটা জায়গার নিজস্ব চরিত্র, রং, গন্ধ কিছুই বোধহয় তেমন করে অনুভব করা যায়না।
বিকেল গড়িয়ে রাত
কখন যেন আলতো পায়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে রাতের দিকে। আলো জ্বলে উঠেছে রাস্তায়, দোকানপাটে, লিম্মাত এর সেতুগুলোতে; নদীর জলের গোলাপী আভায় রঙিন আলোগুলোর ছায়া ঝিকমিক করছে। ক্যাবারে ড্যান্স-ক্লাব বার গুলোতে শুরু হয়ে গেছে রঙিন রাতের মাদকতাময় প্রস্তুতি। আমাদের হোটেলের কাছেই দেখি একটা বেশ বড় বার এবং পরপর আরও কয়েকটা ড্যান্স-ক্লাব; তাদের বন্ধ দরজার বাইরে অতি স্বল্পবসনা সুন্দরীদের লাস্যময় বিভঙ্গের ছবি। আমাদের আগামীকালের গন্তব্যস্থলটি জুরিখ থেকে বেশ দূরেই; আজ রাতেই গোছগাছ সেরে নিতে হবে এবং কাল সকাল সকাল সারাদিনের জন্য বেরোনো; তাই শহর পরিক্রমায় ইস্তফা দিয়ে 'কাবাব রোল' আর মেয়ের জন্য 'নুডল্স্' দিয়ে ডিনার সারা হল হোটেলেরই কাছাকাছি একটা ছোট রেস্তোঁরায়। হোটেলের ঘরে ফিরে জানলার সামনে দাঁড়াতে দেখি সামনে বিছিয়ে আছে আলো আঁধারির রাতপোশাক পরা অন্য এক মায়াবী জুরিখ। হলদে আলোমাখা চৌরাস্তা, রাতের ঘন নীল লিম্মাত, সাদা নীল ট্রাম, গাড়ির লাল ব্যাকলাইটের মিছিল, অপেক্ষারত মানুষজন সব যেন ছবির মতো ফুটে উঠেছে; আর দূরে আলো ঝলমল জুরিখ ট্রেন স্টেশন ও পাহাড়ের মাথায় জ্বলে ওঠা টিপটিপ আলোয় শহরটাকে অপূর্ব মোহময় লাগছে।
জুরিখ থেকে দোতলা ট্রেনে লুসার্ন
আজ আমাদের গন্তব্য জুরিখ থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে আল্পস্ পর্বতমালার কোলে অবস্থিত ছোট্ট আল্পাইন গ্রাম এঙ্গেলবার্গ এবং সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু আল্পস্-এরই একটি চির-বরফাবৃত চূড়া এবং হিমবাহ মাউন্ট তিত্লিস। প্রকৃতপক্ষে মাউন্ট তিত্লিস-এরই পদপ্রান্তে এঙ্গেলবার্গ গ্রামটার অবস্থান। জুরিখ থেকে ইউরোসিটি সুপারফাস্ট ট্রেন যাবে লুসার্ন পর্য্যন্ত; সেখান থেকে ছোট সাবার্বন ট্রেনে এঙ্গেলবার্গ এবং এঙ্গেলবার্গ থেকে কেবল্ কার-এ (Cable Car) তিত্লিস। ভেবেছিলাম জুরিখ থেকে প্রথম ট্রেনটাই ধরব; কিন্তু কার্য্যগতিকে একটু দেরী হয়ে গেলেও অবশেষে উঠে বসেছি লুসার্নগামী ট্রেনে। দোতলা ট্রেন, ভেতরটা এরোপ্লেনের মতোই তকতকে; আমরা দোতলাতেই বসেছি দৃশ্যাবলী ভালো দেখা যাবে বলে। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। আজ সকাল থেকেই আকাশ ছাই ছাই রঙের মেঘে ঢাকা ছিলো; চারদিকেও পাতলা কুয়াশার মতো আস্তরণ; এখন এত বেলাতেও সেটা কেটে গিয়ে রোদ ওঠেনি। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। জানতাম অনেক বেশি উচ্চতায় অর্থাৎ পাহাড়ের আল্পাইন অংশে নাকি এইসময় আবহাওয়া চমৎকার থাকে, আকাশ নাকি সবসময়ই সেখানে ঘন নীল; মনে সেইটুকুই ক্ষীণ আশা জাগিয়ে রেখেছি যে হয়তো এঙ্গেলবার্গ-তিত্লিসে গিয়ে ভালো আবহাওয়া পাবো। নচেৎ এতদূর থেকে এসে এত টাকা ট্রেন ভাড়া খরচ করে (জুরিখ থেকে এঙ্গেলবার্গ যাওয়া এবং আসায় একেক জনের দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন ভাড়া ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭০০০ টাকা এবং এঙ্গেলবার্গ থেকে তিত্লিস এর কেবল্ কার-এর ভাড়া প্রায় ৫০০০ টাকা) গিয়ে যদি মেঘ আর কুয়াশা দেখে চোখ ভরাতে হয় তবে তা বড়ই দুঃখজনক!
ট্রেন বেশ স্পীডে চলেছে – বেশিরভাগটাই টানেলের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য টানেল থেকে বেরোচ্ছে; আর তখন হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে আবছা দেখা যাচ্ছে রেললাইনের ধারের রংচঙে ছাদওয়ালা বাড়ি, সবুজ ঘাসে ঢাকা বড় বড় খোলা মাঠ, ফাঁকা ফাঁকা কনিফার বন, এমন কত কী! হঠাৎ একটা ম্যাজিকের মতো ঘটনা ঘটলো। ট্রেনটা একটা টানেলে যখন ঢুকেছে তখনও বাইরে কুয়াশা; কিন্তু যেই টানেল থেকে বেরোলো দেখি এপাশে ঝলমলে রোদ। ঘোলাটে আকাশ ফাঁক হয়ে কোথা দিয়ে জানিনা একটুকরো রোদঝরানো নীল আকাশ বেড়িয়ে পড়েছে। কুয়াশা গায়েব, রেললাইনের পাশে পাশে চলা ছোট ছোট পাহাড়, সবুজ জঙ্গল আর স্ফটিকস্বচ্ছ তিরতিরে নদীটা রোদ মেখে ঝকঝক করছে। এই দৃশ্যটা কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না; পরবর্তী টানেলটায় ঢুকে ট্রেন যখন আবার বেরোলো, আবার চারদিকে সেই বিষন্ন কুয়াশার চাদর। অবাক হয়ে ভাবছিলাম প্রকৃতির মতো জাদুকরই একমাত্র পারে এমন ম্যাজিক দেখাতে!
লুসার্ন পৌঁছেছি। লুসার্ন শহরের কেন্দ্রে এবং লুসার্ন লেকের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত এই স্টেশনটা বেশ বড় এবং নতুন। পুরনো স্টেশনটা এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় ১৯৭১ সালে; বর্তমান ঝাঁচকচকে স্টেশনটা তার পরে বানানো। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং অন্তর্দেশীয় ট্রেনের প্রান্তিক স্টেশন এই লুসার্ন। আমাদের ইউরোসিটি ট্রেনটাও এখান থেকেই আবার জুরিখ ফিরে যাবে। লুসার্ন থেকে এঙ্গেলবার্গ-গামী ট্রেন ছাড়ে প্রতি এক ঘন্টা অন্তর। পরের ট্রেন ১১.১০-এ। হাতে খানিকটা সময় আছে দেখে আমরা স্টেশনের বাইরে এলাম লুসার্ন শহরটাকে একটু দেখার জন্য। স্টেশন থেকে বেড়িয়েই বিশাল গেট, গেটের পরে রাস্তা আর রাস্তা পেরোলেই লেক লুসার্ন। বিশাল লেকের জলের ওপর পাতলা কুয়াশা ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে আছে; জুরিখ লেকের মতো এখানেও লেকের ওপর রাজহাঁস আর অন্যান্য পাখির জটলা; সুসজ্জিত স্টীমারগুলো দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। পতাকা দিয়ে সাজানো লম্বা ব্রীজ লেকের এপার থেকে ওপারে পৌঁছে গেছে; ব্রীজের ওপর গাড়ি, মানুষজনের ভীড়। লেকের ওপারের ঘর-বাড়ি দৃশ্যাবলী কুয়াশার জন্য ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। শুনেছিলাম এখান থেকে নাকি আল্পস পর্বতমালার মাউন্ট পিলাটাস্ এবং মাউন্ট রিগি-র বেশ স্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। লুসার্ন লেক এবং এই দুই পাহাড়ের জন্যই এই শহরটা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু খলনায়িকা কুয়াশার দাপটে আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেলো মাউন্ট পিলাটাস ও রিগি।
এলোমেলো কিছুক্ষণ শহরে ঘুরে আর ফটো তুলে স্টেশনে ফিরে এসেছি। 'বার্গার কিং'-এর দোকান থেকে চিকেন বার্গার, আলুভাজা আর কোল্ড ড্রিঙ্কস্ কিনতে কিনতেই আমাদের ট্রেন দিয়ে দিয়েছে প্লাটফর্মে। তড়িঘড়ি গিয়ে বসলাম ট্রেনে। এই ট্রেনটা একতলা, আগেরটার থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট, অনেকটা ট্রামের মতো; যদিও কামরাগুলোর সজ্জা, পরিচ্ছন্নতা এবং আরাম নিয়ে কিছু বলার নেই। ট্রেন ছাড়লো কাঁটায় কাঁটায় ১১.১০-এ; এঙ্গেলবার্গ পৌঁছবে ১১.৫৩-য়। অর্থাৎ লুসার্ন থেকে এঙ্গেলবার্গ অবধি পথ যেতে সময় লাগবে ৪৩ মিনিট।
সবুজ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে স্বপ্নের ট্রেনযাত্রা
লুসার্ন থেকে ট্রেন চলেছে ঝিকিঝিকি। ট্রেনে তেমন ভীড় নেই। কুয়াশার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি আমরা চলেছি অপূর্ব সুন্দর লুসার্ন লেকটার গা বেয়ে। লেকটা যে কত বড় এবার তার আন্দাজ পাচ্ছি। শহর ছাড়িয়ে ট্রেন একটু ফাঁকায় পড়লে গুছিয়ে বসে আহার্য্য বস্তুগুলোর সদ্ব্যবহার করা হল; আমাদের তরুণী সহযাত্রীনীটির সঙ্গেও আলাপ জমল। আমার মেয়ের সঙ্গে তার হাসি আদানপ্রদান অনেকক্ষণ থেকেই চলছিল; এবার কথা বলে জানলাম সে এঙ্গেলবার্গেরই বাসিন্দা। এঙ্গেলবার্গে এখন বরফ পাওয়া যাবে কিনা, শীতে সেখানে তাপমাত্রা কত হয়, তিত্লিস কতদূর ইত্যাদি তথ্য তার থেকে সংগ্রহ করা গেল। ইতিমধ্যে ট্রেন স্টানস্ পৌঁছেছে; স্টানস্ জায়গাটা লেকের অপর প্রান্তে অবস্থিত একটা গ্রাম, গড় উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট। স্টেশনটা ছোট, দুপাশে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি দেখা যাচ্ছে; ট্রেন স্টানস্ ছাড়তেই বুঝতে পারলাম আমরা প্রবেশ করতে চলেছি আল্পস্-এর একান্ত আপন জাদুরাজ্যে! প্রকৃতি কখন যেন তার কুয়াশার মুখোশ নিজে হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে দূরে; শাণিত সোনারং রোদে ভেসে গেছে চারদিক। নীল আকাশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড় ও কনিফার বন আর সেই পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা অনন্ত প্রসারিত সবুজ ঘাসের মখমলী প্রান্তর যেন হঠাৎ বাধা পেয়ে থমকে গেছে রেললাইনের দুদিকে। সেই নিষ্কলঙ্ক সবুজের রাজ্যে ইতিউতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট সাদা অথবা কালচে খয়েরীরঙা একতলা দোতলা কাঠের বাড়ি; বাড়ির বারান্দায় ঝলমল করছে লাল কমলা অথবা বেগুনীরঙা মরশুমী ফুল; গলায় ঘন্টা বাঁধা গোরু এদিক সেদিক চড়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও আবার পাহাড়ের অনেক ওপরে একলা একটা বাড়ি আর সেখান থেকে নীচে নামার ব্যবস্থাস্বরূপ হাতে দড়ি টানা ছোট্ট ব্যক্তিগত রোপওয়ে।
ট্রেন এগিয়ে চলেছে আর আমরাও জানলার কাচে নাক ঠেকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রয়েছি প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের জগতে। এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম এই দিগন্তবিস্তৃত সবুজের বুক চিরে চলা আমাদের রেললাইনটার পাশাপাশি সমান্তরালে দৌড়ে চলেছে একটা সড়কও; ফাঁকা সড়ক দিয়ে মাঝেমধ্যেই হুশহাশ চলে যাচ্ছে এক-আধটা গাড়ি। দুপাশে বাড়িঘর এবার বেশ কমে এসেছে; শুধুই নিরবচ্ছিন্ন ঘাসে ঢাকা প্রান্তর, পাহাড় আর পাইন-জুনিপারের বন। হঠাৎ দেখি যেন আরেক পরত পর্দা সরে গিয়ে সবুজ পাহাড়গুলোর পেছন থেকে মাথা তুলে দিয়েছে বরফের টুপি পরা ধূসর বর্ণের আকাশছোঁয়া আল্পস! এখানে এখনও বরফপাত শুরু হয়নি, তাই পাহাড়ের বেশিরভাগ অংশই ন্যাড়া, ছাইরঙা; শুধু পাহাড়ের মাথা আর গিরি-শিরাগুলো বরফে ঢাকা আর সেই বরফের ওপর রোদ লেগে অভ্রের মতো চিকচিক করছে। এত কাছে একইসঙ্গে বরফঢাকা পাহাড়, তার বুকে সবুজের অক্লান্ত প্লাবন এবং তারও বুক চিরে আমাদের এমন রোমাঞ্চকর রেলযাত্রা – এই ত্রহ্যস্পর্শে যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছি; এমন দৃশ্য আগে সিনেমার পর্দাতেই দেখেছি। আর আজ স্বয়ং আমরাই এই ঘটমান বাস্তবের নায়ক-নায়িকা-শিশুশিল্পী!
ট্রেন খেলনাগাড়ির মতো মিষ্টি একটা সিটি বাজিয়ে একের পর এক ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম্য স্টেশন পেরোচ্ছে; অনেক উঁচুতেও উঠে এসেছে সেই সঙ্গে। এখানে আকাশ অদ্ভুত নীল। স্টেশনের নামগুলোও ভারী অদ্ভুত সুন্দর – ড্যালেনউইল, নিয়েডেরিকেনবাক্, ওলফেনস্কিয়েসেন্; এর মধ্যে আবার নিয়েডেরিকেনবাক্ স্টেশনে 'স্টপ অন রিকোয়েস্ট।' অর্থাৎ যদি কেউ ওই স্টেশনে নামতে চায় তবে সে ঘন্টা বাজালেই চালক ট্রেন থামাবে নচেৎ ওই স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে না। এঙ্গেলবার্গের দিকে যত এগোচ্ছি পাহাড়গুলোর কোলে বরফ তত বাড়ছে; বরফের রাজ্যের কাছে এসে পড়েছি যে! এতক্ষণ পাহাড়গুলো একবার ট্রেনের ডানদিক একবার বাঁদিক থেকে লুকোচুরি খেলছিল; আর আমরাও প্রায় ফাঁকা ট্রেনে এপাশ ওপাশ দৌড়ে বাকী যাত্রীদের বেশ চিত্তবিনোদন করছিলাম। এবার ট্রেনের দুদিকেই পাহাড়, দুদিকেই বরফ, দুদিকেই আল্পস্!
এঙ্গেলবার্গ-এ পা
ট্রেন গ্র্যাফেনর্ট স্টেশন পেরোলো। এর পরই এঙ্গেলবার্গ। নামার অপেক্ষায় গুছিয়ে বসেছি। গ্র্যাফেনর্ট পেরোতেই ট্রেন ঢুকে পড়লো টানেলে; টানেল বেশ লম্বা, চলছে তো চলছেই। পরে জেনেছিলাম গ্র্যাফেনর্ট থেকে এঙ্গেলবার্গ পর্য্যন্ত পথের চড়াই ঢালটি অত্যন্ত খাড়া আর তাই সেই পথকে পাশ কাটিয়ে পাহাড়ের পেটের ভেতর দিয়ে এই টানেল-পথের ব্যবস্থা। টানেল শেষ হল, ট্রেন ছোটোখাটো ছিমছাম এঙ্গেলবার্গ স্টেশনে ঢুকেছে। এটাই শেষ স্টেশন; ট্রেন এখানে পুরো খালি হয়ে গেল। আমরাও ধীরে সুস্থে নেমেছি আর নেমেই বাকরূদ্ধ! দেখছি, আমরা এসে দাঁড়িয়েছি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টির বুকের ঠিক মধ্যিখানে। যেখানটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার চারদিকে যতদূর চোখ যায়, গ্রামটাকে ঘিরে আছে আল্পসের উত্তুঙ্গ প্রাচীর; আর সেই পর্বতশ্রেণীর স্তরে স্তরে বিচিত্র রঙের খেলা। সামনের দিকের পাহাড়গুলো ঢেউখেলানো ঘাসের ঢালের রং মেখে পেলব সবুজ; তারই মধ্যে মধ্যে পাইন জঙ্গল তার ঘন কালচে সবুজ অথবা হলদে-খয়েরী রঙের তুলি বুলিয়ে দিয়েছে এখানে সেখানে। সবুজের গায়ে পাইন জঙ্গলের কোলে রূপকথার গল্পে পড়া পরীর দেশের মতো সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। পাহাড়ের গায়ে পাইন গাছেদের জটলা যেখানে শেষ হয়েছে, তার ওপরে আর কোনো বড় গাছ নেই; পাহাড় সেখানে ন্যাড়া ন্যাড়া, ধূসর সবুজ বর্ণের। সবুজ পাহাড়গুলোর পেছনে মাথা উঁচিয়ে বিছিয়ে রয়েছে বরফমাখা তিত্লিস এবং আরও কত নাম-না-জানা চূড়া। তারও ওপরে শুধুই দরাজ নীল আকাশের গায়ে সাদা ধোপদুরস্ত মেঘেদের চিলতে তুলির আঁচড়।
স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়েছি; দুপাশে অনেক ছোট-বড় ঝকঝকে হোটেল, দু-তলা তিন-তলা বাড়ি, রেস্তোরাঁ, বসার জন্য রাস্তার ধারে বাঁধানো বেঞ্চ; সদ্য আগত আমাদের ট্রেনটার যাত্রী ছাড়া খুব বেশি মানুষজন নেই রাস্তায়। রাস্তা, যেন কুটোটি পড়ে নেই এমন তকতকে। আমরা ডানহাতি রাস্তা ধরে এগোচ্ছি; হোটেলগুলো ছাড়িয়ে একটু ফাঁকায় পড়তেই পেছন ফিরে দেখি ডাইনে বাঁয়ে পাহাড়ের পায়ের কাছ থেকে শুরু হয়ে অনেক ওপর পর্য্যন্ত পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে ছড়িয়ে আছে এঙ্গেলবার্গ গ্রামটা। এখন সূর্য মধ্য গগনে, তাই গোটা গ্রাম রোদ ঝলমল করছে; আর গ্রামের পেছনদিকে চালচিত্রের মতো সবুজ-সাদা পাহাড়ের রেখার কাছে যেন বিশাল বিশাল ডানা ভাসিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে একদল লাল, কমলা, গোলাপী, বেগুনী রঙের পাখি! এই প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম প্যারাগ্লাইডিং। চমৎকৃত হয়ে আরও কিছুক্ষণ মনুষ্য-পক্ষীদের উড়ান পর্যবেক্ষণ করে পা বাড়িয়েছি সামনের দিকে; সামনেই দেখি আমাদের রাস্তাটা এসে মিশেছে একটা মোম-মসৃণ চওড়া সড়কে; এটাই ট্রেনলাইনের পাশে পাশে ছুটে আসা সেই সড়কটা, এখন গ্রামটাকে লম্বালম্বি চিরে দিয়ে দুপাশে পাহাড় নিয়ে এগিয়ে গেছে সামনের গা ছমছমে গাঢ় সবুজ পাহাড়গুলোর দিকে। রাস্তার দুপাশে চওড়া ফুটপাথ, তারপর কাঁটা তারের বেড়া। রাস্তার একদিকে বেড়ার ওপাশে ঘাসের গালচে, আরও দূরে সারিবদ্ধ সুন্দর সুন্দর সাদা বাড়ি আর তার পেছনে ট্রেনলাইন, স্টেশনবাড়ি; রাস্তার অপর পাশে কাঁটাতার পেরোলেই খানিকটা ঘাসজমির পর গাড়ি পার্কিং এর জায়গা, একটা পায়ে চলা পথ আর তারপরই শুরু সেই মখমল সবুজ ঢালের পাহাড়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুসংবদ্ধ পথনির্দেশ, ট্রাফিক সিগনাল। প্রায় ফাঁকা রাস্তাতেও কেউ সেই নিয়মভঙ্গ করে রাস্তা পারাপার করছে না। ছোটবেলা থেকে আমাদের মনে গ্রাম বললে যে ছবি ভেসে ওঠে তার পাশে এঙ্গেলবার্গকে রেখে সত্যিই চমকে উঠছিলাম। এ গ্রামে প্রাকৃতিক নিসর্গের সঙ্গে আধুনিক জীবনধারণের সমস্ত ব্যবস্থার মেলবন্ধন হয়েছে; এ গ্রামে পাহাড়চূড়াকেও সহজগম্য করে দিয়েছে আধুনিকতম প্রযুক্তিবিদ্যার হস্তক্ষেপ; এ গ্রাম যেন হাতের মুঠোর মধ্যে ধরতে পারা এক স্বপ্নরাজ্য!
রাস্তার ওপাশ থেকে আমাদের টানছে ওই নরম সবুজে মোড়া, পাইনের গন্ধ মাখা আলোছায়া ভূখন্ড। বড় রাস্তা পার হয়ে আমরা ছোট পায়ে চলা রাস্তায় চলে এলাম; তারপর জোরকদমে পা চালিয়ে এক্কেবারে সেই সবুজের কোলে। দূর থেকে বুঝতে পারিনি, এখন কাছে এসে দেখি ঘাসের মধ্যে ফুটে আছে কতশত নাম না জানা ছোট ছোট সাদা হলুদ বুনো ফুল; সবুজ সাম্রাজ্যের শোভা তাতে বেড়েছে বই কমেনি। ভিজে ভিজে ঘাসের নরম গালচে এখানে এত মসণ, ইচ্ছে করছে ঘাসে পা ডুবিয়ে দৌড় লাগাই বল্গাহীন। ঢালু বেয়ে বেশ কিছুটা উঠলাম; চারদিক শান্ত, নিস্তব্ধ; সামনেই একটা লালচে খয়েরী রঙের দোতলা কাঠের বাড়ি। তার কিছুটা পেছন থেকেই শুরু হয়ে গেছে পাইন জঙ্গল। আরও নানারকম গাছও আছে যদিও, দূর থেকে আলাদা করে তাদের পরিচিতি বোঝা যাচ্ছে না; শুধু তাদের হালকা সবুজ, ধূসর, হলদে আর উজ্জ্বল কমলা রং পাইনের কালচে সবুজের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে পাহাড়ের ক্যানভাসে যেন রঙের হোলি খেলেছে।
দড়ি-পথে তিত্লিস
বেলা বেড়ে যাচ্ছে। এইবেলা তিত্লিস যাত্রা শুরু না করলে সেখানে পৌঁছে আর কিছুই দেখা হবে না। ফেরার পথে এঙ্গেলবার্গে আরও কিছুটা সময় কাটাবার ইচ্ছে নিয়ে বড় রাস্তাটায় ফিরে এলাম। পথনির্দেশ দেখে এগোলাম তিত্লিস যাওয়ার কেবল্ কার স্টেশনের দিকে। কিছুটা হাঁটার পরই দেখতে পেলাম দড়িতে ঝুলন্ত সারবাঁধা ছোট ছোট কেবল্ কার শূন্যে দোদুল্যমান অবস্থায় পাইন গাছগুলোর মাথা টপকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে খাড়া পাহাড়ের ঢালটার ওপাশে; দেখেই বুক দুরুদরু করে উঠেছে; এর আগে যে কখনো রোপ ওয়ে-তে যাইনি এমন নয়। কিন্তু ৩,৩৫০ ফুট্ (এঙ্গেলবার্গের গড় উচ্চতা) থেকে ১০,০০০ ফুট্ অবধি ভীষণ খাড়াই পাহাড় বেয়ে ৪৫ মিনিটের কেবল্ কার যাত্রা এই প্রথম। গুটি গুটি গিয়ে বসলাম কেবল্ কারে। এই কারগুলো ছোট বাক্সের মতো, দুদিকে মুখোমুখি সীটে বসে মোট ছ-জন প্রাপ্তবয়স্ক একসঙ্গে যেতে পারে। বাক্সগুলোর উর্ধ্বাংশের চারপাশ কাচের, ফলে বহির্দৃশ্য দেখার কোনই অসুবিধা নেই। নির্দিষ্ট সীমানা পেরোবার পর কার-এর দরজা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো। আমাদের সামনের কার-এ ছোট বাচ্চাসহ এক পরিবার; সেখানা হুশ্ করে দড়ি ধরে দৌড় লাগাতেই আবার আমার হৃৎকম্প, এবং সে হৃৎকম্প থামার আগেই দেখি সবেগে আমাদের যান-টাও কেবল্ কার স্টেশন থেকে শূন্যে বেড়িয়ে এসে আমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নিয়েছে!
কেবল্ কার স্টেশন থেকে বেড়িয়ে এসে আমরা এখন শূন্যে ঝুলে ঝুলে চলেছি পাইনগাছের জঙ্গলটার দিকে। আমাদের সামনে দড়িতে ঝুলন্ত অনেকগুলো কেবল্ কার নির্দিষ্ট ব্যবধান মেনে লাইন করে চলেছে দেখতে পাচ্ছি। পেছনে ফেলে আসা এঙ্গেলবার্গের লাল ছাদওয়ালা সাদা সাদা বাড়ি, চকচকে সর্পিল রাস্তা, কার পার্কিং, নীল জলের একটা টলটলে লেক, সব পাহাড়ের কোলে হাতে আঁকা ছবির মতো আলস্যভরে বিছিয়ে আছে। ক্রমে পাহাড়ের ওপরের ধাপে পাইন গাছগুলোর মাথার ওপর পৌঁছে গেছি; পায়ের তলায় কালচে সবুজের ঠাসা বুনট্ পেরিয়ে একসময় জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেছে দড়ি-পথ। এখানটায় কিছু গাছ কেটে রোপওয়ে-র জন্য সরু রাস্তা বের করা হয়েছে। জায়গাটা ঠান্ডা, থমথমে, প্রায়ান্ধকার; সূর্যের আলো পাইনের ঠাসবুননি ভেদ করে ঢুকতে পারেনি এখানটায়। পাইনের ডাল প্রায় আমাদের কেবল্ কারের জানলা ছুঁয়ে যাচ্ছে; হাতের কাছে ঝুলছে পাইনের খয়েরী খয়েরী কোন্।
পাইনজঙ্গল পার হয়ে দুটো পাহাড়ের মাঝের ফাঁকা সবুজ প্রান্তরের ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে চলেছি। নীচে ছাড়া ছাড়া ছোট দু একটা ঘর, একটা সরু রাস্তা, গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। এখানে কেবল্ লাইনটা একটু নীচে নেমে এসেছে। এমনিতে কার-গুলোর গতিবেগ খুব বেশি নয়, বেশ সহনীয়; শুধু কেবল্ সংযোগকারী খুঁটিগুলো পেরোবার সময় ঝুলন্ত বাক্সগুলোর গতি বেড়ে গিয়ে সেগুলো হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠছে। এখন অবশ্য ভয়ের বদলে এই দড়ি যাত্রা খুবই উপভোগ্য এবং রোমাঞ্চকর লাগছে আমাদের। ফাঁকা জায়গাটা পার হতেই পরবর্তী আরও উঁচু একটা পাহাড় শুরু আর কেবল্ লাইনটাও আচমকা প্রায় আশি ডিগ্রি কোণ করে উঠে গেছে সেদিকে। সেই উঁচুতে উঠে দেখি আমাদের পেছনে অনেক নীচে লাইন করে আসা কেবল্ কারগুলোকে ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। তাদের নীচে পাহাড়ের ছায়া মেখে শুয়ে আছে দু পাহাড়ের মাঝের সেই ফাঁকা ভূখন্ড; আরও পেছনে রোদমাখা এঙ্গেলবার্গ; পাইনগাছগুলোকে এখান থেকে ঝোপের মতো লাগছে। রোদ-ছায়া'র খেলায় চারদিকের বরফশৃঙ্গ, তাদের কোলের কাছের সবুজ পাহাড় আর তারও নীচের পাহাড়তলি অপরূপ মোহময় লাগছে।
ছোট কেবল্ কার Gerschnialp স্টেশন পার হয়ে ৫৯০০ ফুট উচ্চতায় ট্রাবসী স্টেশনে নামিয়ে দিল আমাদের। এখান থেকে অন্য একটা কেবল্ কার যাবে পরবর্তী স্টেশন স্ট্যান্ড পর্যন্ত। সেখান থেকে আবার অন্য আর এক ধাপে তিত্লিস। ঝুলন্ত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কিছুটা অপেক্ষা করতেই ওপরের স্টেশন থেকে লোক নিয়ে মসৃণ দ্রুতগতিতে নেমে এলো তিত্লিস লেখা লাল রঙের কেবল্ কারটা। এতবড় একটা যান যে শূন্যমাধ্যমে দড়িতে ঝুলে ঝুলে এত লোক বহন করতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হোত না! যানটা আকৃতি এবং আয়তনে একটা বাসের সমান; লোকধারন এবং ভারবহন ক্ষমতাও সেই অনুপাতে। দেখতে পাচ্ছি ভেতরে ঠাসাঠাসি মানুষদের ভীড়; তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের পোষ্য সারমেয় এবং লম্বা লম্বা স্কী আর স্কী স্টীক। উল্টোদিকের প্লাটফর্ম দিয়ে তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমাদের দিকের দরজা খুললো। এখন ওপরের দিকে যাওয়ার লোকজন কম, তাই আমাদের কেবল্ বাসটা বেশ ফাঁকা ফাঁকাই ট্রাবসী ছাড়লো। বাসের চারপাশটা পুরোটাই কাচের; তাই ৬০০০ ফুট উচ্চতার এই যাত্রায় চলমান আমাদের চারপাশ দিয়েই সতত সঙ্গ দিচ্ছে বরফস্নাত আল্পস্। ছোট কেবল্ কারে থাকতে থাকতেই নীচের পাহাড়ের প্রকৃতি বদলাতে দেখছিলাম; এখন দেখি পায়ের নীচে ন্যাড়া ন্যাড়া ধূসর সবজেটে পাহাড় আর তার গায়ে এখানে সেখানে ছোট ছোট বরফের ছোপ; যত ওপরে উঠছি, বরফ ততই বাড়ছে। সামনেই অনন্ত বরফরাজ্য; আর অনেক নীচে সেই বরফের ছায়া পড়েছে নীল নির্জন ট্রাবসী লেকে।
৮০০০ ফুট উঁচুতে স্ট্যান্ড স্টেশন থেকে যখন শেষ ধাপের কেবল্ কার-টায় চাপলাম তখন চারপাশে শুধুই বরফ। এটার নাম তিত্লিস রোটেয়ার (Rotair) আর এটার বিশেষত্ব হলো এটা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘূর্ণায়মান কেবল্ কার। স্ট্যান্ড থেকে তিত্লিস চূড়া পর্য্যন্ত যেতে সময় লাগবে পাঁচ মিনিট। এই পাঁচ মিনিট পথ রোটেয়ার ৩৬০ ডিগ্রি কোণে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উঠবে এবং আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত করতে থাকবে চারপাশের ক্রমচলমান দৃশ্যপটের অমল ধবল রূপ। রোটেয়ার যাত্রা শুরু হল; সাদা নীল রঙের গোল রোটেয়ারটা বেশ বড়; তার কেন্দ্রস্থলে চাকতির মতো পাটাতনের ওপর ছোট্ট একফালি বসার জায়গা। সেটায় বসে স্পষ্ট বোঝা গেল নীচের পাটাতনটা ঘুরছে। আমরাও এক জায়গায় বসে বসেই পর্যবেক্ষণ করছি কখনো চারপাশের রোদ ঝলসানো বরফরাজ্য, কখনো দূরদূরান্তের অন্তহীন পর্বতশ্রেণী, আবার কখনো বা খাড়া পাথুরে প্রাচীরের কিনারে গভীর অতলান্ত খাদ। কিছুটা যাবার পর দেখি সামনেই যেন পাহাড়টা শেষ। পাহাড়ের মাথায় বরফের ওপর বড় বড় বিদ্যুতের টাওয়ার এবং অন্যান্য ধাতব নির্মাণ দেখা যাচ্ছে। ওপর দিকে তাকালে এখন শুধুই নীল আকাশ আর পায়ের নীচে, সামনে, চোখ ধাঁধানো নিষ্কলঙ্ক ধবধবে সাদা বরফের রাশি। সেই বরফের ওপর রংবেরঙের পোশাক পরা লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বুঝতে পারলাম তিত্লিসে এসে গেছি।
দশহাজার ফুটে ফটো-সেশন এবং হিমবাহ গুহায় পদস্খলন
পাহাড়চূড়ায় পৌঁছলাম। এই পাহাড়চূড়োর উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ১০,০০০ ফুট। রোটেয়ার থেকে তিত্লিস স্টেশনে নামা হলো; পাহাড়ের মাথায় একটা বিরাট পাঁচতলা বাড়ির একতলা বা লেভেল ওয়ান-এ রোটেয়ার স্টেশনটা; স্টেশন থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে একটা বড় হলের মতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। একদিক দিয়ে সুপ্রশস্ত লিফট উঠে গেছে বিভিন্ন লেভেলে। প্রতিটা লেভেলে কী কী দ্রষ্টব্য তা লেখা আছে লিফ্টের সামনে যাতে ট্যুরিস্টরা সহজে তাদের পছন্দমাফিক গন্তব্য বেছে নিয়ে সঠিক লেভেলে পোঁছে যেতে পারে। হলের অন্যদিকে বেশ সুন্দর ঝলমলে গিফট শপ্; আরও অনেকগুলো করিডোর বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। পুরো জায়গাটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত; যার ফলে বাইরে তাপমান শূন্যের কাছাকাছি হলেও ভেতরটা আরামদায়ক। ব্যাপারস্যাপার দেখে আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ! দশহাজার ফুট উঁচু পাহাড়চূড়ায় একমাত্র কোনো ময়দানবই বোধহয় এমন কান্ডকারখানা বানিয়ে রাখতে পারে।
আমাদের প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ পাহাড়চূড়োর রোদমাখা সাদা বরফের রাশি। তাই অপেক্ষা না করে লিফটের সর্ব্বোচ্চ লেভেলের বাটনটা টিপে দিলাম। নির্ধারিত তলে পৌঁছে লিফট থেকে বেরিয়ে ডানদিকে তাকাতেই খুশীতে প্রাণ থইথই! লিফটের সামনের করিডোরটাই ডানদিকে সোজা গিয়ে মিশেছে খোলা আকাশের নীচে বিছিয়ে থাকা বরফরাশিতে। করিডোরটা মানুষজনের পায়ে পায়ে চলে আসা বরফে ভিজে ভিজে এবং বেশ পিছল; জুতোর তলায় লাগছে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ; পা টিপে টিপে অনতিদীর্ঘ পথটা পেরিয়েই পা রাখলাম তিত্লিস এর বরফমাখা মাথায়। পাহাড়ের মাথাটা বেশ ছড়ানো; এখন পায়ের নীচে শুধুই সাদা বরফ আর মাথার ওপর নীল আকাশ।পেছনে তিনদিক জুড়ে যতদূর চোখ যায় ছড়িয়ে আছে আল্পসের অনিন্দ্যসুন্দর তুষারাবৃত সব গিরিশিখর। আর এখান থেকে সামনের দিকে তাকালে চোখে পড়ছে ধাপে ধাপে নীচে নেমে যাওয়া বরফের প্রান্তরের মধ্যে শুয়ে থাকা বরফজমা একটা লেক, তারও নীচের ঘন ছায়াচ্ছন্ন নীল পাহাড়ের সারি, কেবল কার-এর লাইন আর অনেক নীচ থেকে ওপরে উঠে আসতে থাকা ছোট্ট গোল রোটেয়ারটা।
বরফের ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোচ্ছি; ঠান্ডা বেশ থাকা সত্ত্বেও খাপখোলা ছুরির ফলার মতো ঝকঝকে রোদে এখনও তা টের পাইনি। দেখছি চারদিকে বহু ভাষাভাষী মানুষের আনন্দমেলা; তার মধ্যে বেশ কিছু ভারতীয় পরিবারও আছে; সবাই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে ব্যস্ত। ভারতীয় পরিবারগুলোর সঙ্গে অচিরেই আলাপ জমে গেছে; তারা আমাদের এবং আমরা তাদের ছবি তুলে দিলাম। সম্মিলিত ছবিও তোলা গেল। এবার দেখি ডানদিকে একটা খোলা রেস্তোরাঁ; তিত্লিসের মাথায় বসে আল্পসের রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে ঠোঁট ছোঁয়ানো যাবে নরম-গরম পানীয়ে; বরাফৃত হিমবাহর বুকে বসে স্বাদ নেওয়া যাবে পিৎজা-পাস্তার। আর একটু এগোতেই সামনে বরফের ওপর নানা রোমাঞ্চকর খেলার আয়োজন। কোথাও পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে বিদ্যুতগতিতে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে স্কি; কোথাও বা খোলা বরফের প্রান্তরের ওপর দিয়ে আইস ফ্লায়ার নামক খোলামেলা রোপওয়েতে চেপে লোকজন তরতরিয়ে চলেছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। এবার চললাম তিত্লিসের আর এক অনন্য আকর্ষণ ক্লিফ ওয়াক-এ; পায়ের নীচে তিত্লিস হিমবাহ আর অতল খাদ নিয়ে ৩২০ ফুট লম্বা আর মাত্র তিন ফুট চওড়া একটা ঝুলন্ত সেতু চলে গেছে এক পাহাড় থেকে আরেকটায়। শুধুমাত্র পদযাত্রীদের জন্য তৈরি এই ব্রীজ ইওরোপের সর্ব্বোচ্চ ঝুলন্ত ব্রীজ। ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় এই দোলায়মান হন্টন অভিজ্ঞতার নামই ক্লিফ ওয়াক। ইস্পাতের মজবুত তার দিয়ে বাঁধা আর মোটা তারের জাল দিয়ে ঘেরা কুচি কুচি বরফমাখা দোদুল্যমান ঝুলন্ত সেতুটায় পা দিয়ে একইসঙ্গে রোমাঞ্চ আর হৃৎকম্প হচ্ছিল; কিন্তু চোখের সামনে উদ্ভাসিত অপ্রতীম আল্পস্ আর পায়ের নীচের অতলস্পর্শী গিরিখাতের শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য সবকিছু ভুলিয়ে দিল।
পাহাড়চূড়োয় ফটোসেশন এবং ক্লিফ ওয়াক সেরে অন্যান্য ফ্লোরগুলোর দিকে পা বাড়ালাম। একটা ফ্লোরে দেখি বহু নামীদামী চিত্র তারকা, ক্রীড়াবিদ প্রভৃতি কীর্তিমান ব্যক্তিদের ছবি; এরা সকলেই তিত্লিসে পা দিয়েছেন কোনো না কোনও সময়।
এবার গন্তব্য Glacier Cave বা হিমবাহ গুহা। এটি তিত্লিস হিমবাহর গভীরে, বরফ-তলের কুড়ি মিটার নীচে দিয়ে বানানো দেড়শ মিটার লম্বা এবং বহু শাখাসসমন্বিত এক গুহা বা সুড়ঙ্গ যার ভেতরের বরফের পরিমন্ডল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। প্রথম তলে নেমে চলমান জনস্রোতকে অনুসরণ করে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে; একটা স্লাইডিং দরজা পেরোতেই গা ছমছমে এক শীতল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি! সামনেই নীলাভ আলো মাখা মায়াবী এক বরফ-সুড়ঙ্গ এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে আরও গভীরে। সুড়ঙ্গে পা রাখতেই বিষম বিপত্তি ঘটল; কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার পদস্খলন এবং সশব্দ পতন। আমার কর্তা মেয়েকে সামলে বেশ কিছুটা পেছনে; সে এসে পৌঁছবার আগেই সহৃদয় এক তরুণের বাড়ানো হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েছি; ভালো করে তাকিয়ে দেখি পায়ের নীচের মেঝেটা কাচের মতো মসৃণ বরফের, এবং সেই পিচ্ছিল মেঝেই আমার পতনের কারণ। এবার সাবধান হয়ে সুড়ঙ্গের একপাশের রেলিং ধরে ধরে অনেকটা স্কেট করার ধরণে এগোচ্ছি। এখানে তাপমাত্রা শূন্যাঙ্কের অনেকটা নীচে; কথা বললে মুখের সামনে পাতলা মেঘের মতো ধোঁয়া জমে যাচ্ছে; নাকের ডগাটুকু মনে হচ্ছে আর স্বস্থানে নেই। হিম হিম নীল আলোয় সুড়ঙ্গের দেওয়ালে বরফের ছোট্ট ছোট্ট ক্রিস্টাল ঝলমল করছে। অবাক হয়ে ভাবছি, যে হিমবাহটার ওপর এইমাত্র বরফ ছুঁড়ে খেলা করে এলাম, এখন তারই বুকের ভেতর দিয়ে আমরা চলেছি এক রোমাঞ্চকর অভিযানে!
ফেরার পালা
নির্ধারিত সময় শেষ। এবার প্রত্যাবর্তন। দড়িপথে তিত্লিস থেকে আবার নেমে এসেছি নীচে। এঙ্গেলবার্গ এখন শেষ বিকেলের নরম আলোয় ছায়াচ্ছন্ন। শুধু চারপাশের পাহাড়গুলোর মাথায় সোনালী রোদ লেগে আছে; ঠান্ডাও দেখলাম বেশ জাঁকিয়ে বেড়েছে। লুসার্নগামী ট্রেনের এখনো কিছুটা দেরী, তাই আমরা হেঁটে চলে এলাম রোপওয়ে স্টেশনের কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ী নদীটার ধারে; যদিও একে নদী না বলে ঝোরা বললেই যেন বেশি মানায়! পাহাড় থেকে নেমে আসা বরফগলা জল নিয়ে স্বচ্ছ ঝোরাটা বয়ে যাচ্ছে ঝরঝর করে। আসন্ন সন্ধ্যার আলোমাখা গুরুগম্ভীর পাহাড়গুলোর কোলে চঞ্চল পাহাড়ি ঝোরাটাকে ভারী ভালো লাগছিল।
ট্রেনের সময় হয়ে গেল। একই পথে আবার ফেরা লুসার্ন হয়ে জুরিখ। জানলার ধারে বসে শেষবারের মতো চোখ ছুঁয়ে দেখে নিলাম দিন শেষের কোমল গোলাপী রঙ-মাখা অতুলনীয় আল্পস্-কে। আগামীকাল আবার নতুন যাত্রাপথ, নতুন গন্তব্য; তবু এই দেখাটুকু পুরোনো হতে হতেও চিরন্তন থাক।
~ স্যুইৎজারল্যান্ডের আরও ছবি ~
সুদীপা দাস ভট্টাচার্য্য পেশায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও গবেষক। ভালোবাসা পরিবারের সঙ্গে বেড়ানো, গল্প-উপন্যাস ও কবিতা পড়া এবং অল্পস্বল্প লেখালেখি। মনুষ্যনির্মিত ঝাঁ চকচকে কীর্তি নয়, আকর্ষণ করে নির্জন উন্মুক্ত অনাবিল প্রকৃতি।