বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

চেনা রুটিনের গণ্ডি ছাড়িয়ে

সৈকত সোম

~ বিষ্ণুপুরের আরও ছবি ~

বাঙালি মানেই বোধহয় এক পা বাড়িয়ে রাখা বাইরের জগতের দিকে। রসনাতৃপ্তি আর ভ্রমণ পিপাসার আকর্ষণ তার নিজস্ব পরিচয়। দশটা-পাঁচটার ডিউটি আর সান্ধ্য আড্ডায় চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালির রোজকার অভ্যাস। কিন্তু কখনও কখনও মন চায় এই রোজকারের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে বাইরের দুনিয়ায় চোখ রাখতে। আর তা যদি পূর্বপরিকল্পিত না হয় তাহলে তার মজাই আলাদা।
এইরকমই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়েছিলাম হঠাৎ-ই। ঘোরার তীব্র নেশা আর পকেটের কথা চিন্তা করে এ সপ্তাহে বিষ্ণুপুর যাওয়াই ঠিক করলাম, সঙ্গে গনগনি আর জয়পুরের জঙ্গল।

আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল গনগনি। পশ্চিমবঙ্গের টুরিস্টস্পটে নবতম সংযোজন। যাকে বলা হয় 'ক্যানিয়ন অফ বেঙ্গল।' খুব কম লোকই এখনও জায়গাটা সম্পর্কে জানে তাই নিস্তব্ধ সৌন্দর্য বজায় আছে। মেদিনীপুর জেলায় গড়বেতা স্টেশনে নেমে টোটোতে মাত্র দশ কিমি পথ। ভাড়া আট টাকা জনপ্রতি। এখন খড়গপুর বা সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে অনেক ট্রেন যায় গড়বেতায়, তাই যাওয়াটা কোনো সমস্যাই নয়। তবে অসুবিধে একটাই, এখানে রাত্রিবাসের সুবিধা নেই।
সত্যিই বিশাল এই গিরিখাত। শীলাবতী নদী বয়ে চলেছে, তাকে কেন্দ্র করেই এই গিরিখাত। কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথা মনে এলো, যদিও তার সঙ্গে তুলনা হয় না। তবে এর সৌন্দর্য আমার কাছে কিছু কম বলে মনে হল না। রাঙামাটির চড়াই উৎরাই পথ। বিরাট জায়গা জুড়ে এর বিস্তার। নিজের চোখেই কেবলমাত্র এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। লেন্সে যেন তার সিকিভাগটাও ধরা গেল না। জায়গার নিস্তব্ধতা আর সৌন্দর্য ভাষাতেও প্রকাশ করা যায় না।

পরের গন্তব্য জয়পুরের জঙ্গল। এখানেই আমরা রাতটা কাটিয়েছিলাম। জয়পুর জায়গাটার সৌন্দর্যই আলাদা। ঘন জঙ্গল পথের দুধারে, মাঝে জাতীয় সড়ক। এখানকার ত্রাস হল বুনো হাতি। মাঝে মাঝেই জঙ্গল থেকে হাতি লোকালয়ে চলে আসে। বনদপ্তর যথেষ্ট তৎপর হওয়া সত্ত্বেও এলাকার মানুষ হাতির উপদ্রব থেকে নিস্তার পায় না। এই অরণ্যের একটা স্বকীয়তা আছে তা হল পিয়ারডোবা এয়ারফিল্ড (Piardoba Airfield) এটা একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাদের ব‌্যবহারের জন‌্য তৈরি হয়েছিল। এত গোপন একটা জায়গা ভাবাই যায় না এত যত্নে আছে এখনও।

পরের দিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ‌্যে। বাসে জয়পুর জঙ্গল থেকে বিষ্ণুপুর মাত্র কুড়ি মিনিটের রাস্তা। ভাড়া জনপ্রতি মাত্র ১২ টাকা। বিষ্ণুপুর - 'দ্য সিটি অব টেম্পল' এক অসাধারণ মন্দির নগরী। মল্ল রাজাদের ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা বিষ্ণুপুর জুড়ে। একটা টোটো ভাড়া করে ঘন্টাতিনেকেই ঘুরে নেওয়া যায় পুরো বিষ্ণুপুর শহর। টেরাকোটার কাজ মন্দিরগুলির বিশেষত্ব। বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে রামায়ণ, মহাভারত ও নানা পৌরাণিক কাহিনী খোদাই করা আছে পোড়ামাটির পাতে। প্রতিটি মন্দিরই অসম্ভব সুন্দর। তার মধ‌্যে কেবল তিনটি মন্দিরই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে - রাসমঞ্চ, জোড়বাংলা আর পঞ্চরাই মন্দির। মন্দিরগাত্রের অপূর্ব সব কারুকার্যের সঙ্গে সেদিনের উপরি পাওনা ছিল শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ।

আমাদের এবারের সাপ্তাহান্তিক বেড়ানোর ইতি এখানেই। সেদিন ছিল রবিবার, ট্রেন কম, তাই তাড়াতাড়ি স্টেশনে এসে ট্রেন ধরলাম। এরকম দুটো দিন ঘরের বাইরে কাটাতে পেরে বেশ কিছু ভালোলাগার রেশ নিয়ে ফিরছি। আবার নতুন উদ‌্যমে শুরু করবার ইন্ধন নিয়ে। মাথাপিছু হাজার টাকায় এইরকম সপ্তাহান্ত কাটিয়ে শরীর মন দুই-ই এখন বেশ চাঙ্গা।


হলদিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈকত সোম ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

শিল্পগ্রাম রঘুরাজপুরে

মঞ্জিলা চক্রবর্তী

পুরী থেকে দূরত্ব মাত্র বারো কিমি, গাড়িতে আধ ঘন্টা বা খুব বেশি হলে পৌনে এক ঘন্টায় পৌছানো যায় এখানে। এবার জগন্নাথধামে গিয়ে একদিন ঘুরে এলাম এই শিল্পগ্রাম রঘুরাজপুরে। প্রবেশফটক পেরিয়ে হঠাৎ যেন ঢুকে পড়লাম কোনও রূপকথার রাজ্যে! আমাদের নিয়ত চলমান, ব্যস্ত নাগরিক সমাজের সঙ্গে যেন এই রূপকথার গ্রামের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! পথের দুধারে সার সার বাঁধা ঘর। ঘরে ঘরে যেন রোমাঞ্চ খেলা করে! দেওয়ালগুলোতে সব সূক্ষ্ম কারুকার্য। এগুলো এক একজন শিল্পীর শিল্পের নিজস্ব ঠিকানা। গ্রামটিতে কমবেশি শ'খানেক শিল্পী পরিবারের বাস। আর প্রতি পরিবারেরই এক বা একাধিক জন প্রায় কোনও না কোনও শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত। এককথায় শিল্পীদের গ্রাম - লোকশিল্পের গ্রাম।

গাড়ি থেকে নামার আগেই একজন এগিয়ে এলেন, দিদি আসুন বলে...! তার শিল্পকর্ম দেখতে এগিয়ে গেলাম। পটচিত্র হল এখানকার শিল্পীদের মূল উপজীব্য বিষয়। আর এই পটচিত্রই রঘুরাজপুরকে বিশ্বের দরবারে পটচিত্রগ্রাম হিসাবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। এক শিল্পীভাই দেখালেন কিভাবে পটচিত্র বানানো হয়। কাপড় ও আঠা দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রস্তুত ক্যানভাস, তালপাতা ও তসর শিল্ক বা সম্বলপুরী শাড়ির উপর পটচিত্রগুলো আঁকা হয়। প্রথমে খড়িমাটি বা কাঠ কয়লা দিয়ে রেখাচিত্র আঁকা হয়, পরে বিভিন্ন উজ্জ্বল বর্ণ দিয়ে সুনিপুণ শৈল্পিক দক্ষতায় তুলির সূক্ষ্ম টানে ফুটে ওঠে পটচিত্র। বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবী, পৌরাণিক দৃশ্যাবলী, মথুরা বিজয়, অযোধ্যা বিজয়, রাসলীলা, ফুল ও লতাপাতা, পশুপাখি প্রভৃতি হল চিত্রের বিষয়বস্তু।

নারকেল মালা, সুপারি, তালপাতা, নারকেল ছোবড়া, বাতিল করা বোতল প্রভৃতি পরিবেশ বান্ধব উপকরণ দিয়ে শিল্পীরা বানিয়েছেন নানান শৌখিন দ্রব্য। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে রং ব্যবহার করেছেন সেগুলো প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি। যেমন শাঁখের গুঁড়ো থেকে সাদা রং, তেঁতুল বীজের পাউডার থেকে লাল রং, পাথর গুঁড়িয়ে হলুদ রং, প্রদীপ বা লন্ঠনের কালি থেকে কালো রঙ,ফলের বীজ ও ফুলের নির্যাস থেকে প্রস্তুত করা নানান রঙ। কয়েকজন শিল্পীর হাতে আঁকা অসাধারণ কিছু ছবি দেখলাম। একজন দেখালেন তাঁর বানানো কিছু আদিবাসী ঘরানার গয়না, অনেকটা ডোকরার কাজের মত। কেউ কেউ পাথর খোদাই করেন - পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন আপন শিল্পকলা। রথযাত্রার সময় পুরীর জগন্নাথদেবের রথে চিত্র অঙ্কন করতে যান রঘুরাজপুরের শিল্পীরা। স্নানযাত্রার পর যে পটচিত্রে জগন্নাথদেবের পূজা হয়, তাও যায় এই গ্রাম থেকেই। বিশ্ববন্দিত ওড়িশি নৃত্যশিল্পী কেলুচরণ মহাপাত্রের বসতবাড়ি এই রঘুরাজপুর গ্রামেই। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটির ভগ্নপ্রায় দশা।

২০০০ সালে Indian National Trust for Art & Cultural Heritage (INTACH) রঘুরাজপুর গ্রামটিকে 'হেরিটেজ ক্র্যাফটস ভিলেজ'-এর তকমা দেন। শিল্পীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে পর্যটকদের সামনে তাঁদের লোকশিল্পকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেন। ফলে আপনি শিল্পদ্রব্য কিনুন আর নাই কিনুন, এখানে প্রত্যেক শিল্পীই তাঁর শিল্পকর্ম অত্যন্ত আগ্রহ ও ধৈর্য্যের সঙ্গে দেখাতে চান। আর বেড়ানোর মরসুমে দেশি বিদেশি পর্যটকদের সমাগমে যেন হস্তশিল্পের হাট বসে এই শিল্পগ্রামে। আমিও ওঁদের কাছ থেকে একটি পটচিত্র কিনলাম। ওটা হাতে নিয়ে মনে মনে ভাবলাম রাত পোহালেই তো আমি পৌঁছে যাব আমার শহরে। আমার ঘরের মতই আবার এই অখ্যাত গ্রামের শিল্পকর্ম সাত সাগর আর তেরো নদী পেরিয়ে ভিনদেশের কোন প্রাসাদ কিংবা অট্টালিকাতেও শোভা পাবে!

তবে অফ্ সিজনগুলোতে যখন পর্যটকরা কম আসেন তখন ওঁদের বিক্রিবাটাও কমে যায়। সেই সময় শিল্পীরা বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করেন। কেউ কেউ চাষবাস করেও সংসার চালান। শিল্পের কদরে শিল্পীর খ্যাতি। শিল্পীদের এই গ্রাম ঘুরে, মাটির কাছাকাছি থাকা সহজ সরল মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের অপূর্ব সব শিল্পকর্ম দেখে আমি অভিভূত!

একরাশ ভাললাগার মুহূর্ত বুকে নিয়ে যখন পুরীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম তখন পড়ন্ত বিকেলের নরম সোনালি আলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে গ্রামটির ওপর।

 

মঞ্জিলা চক্রবর্তীর পেশা শিক্ষকতা। সংসার ও কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততা থেকে বারে বারে বাইরে টেনে নিয়ে যায় তাঁর গভীর প্রকৃতিপ্রেম! প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করতে ভালবাসেন। কখনও কখনও মানব-সৃষ্টিও ভাললাগায় ভরিয়ে তোলে মন! আর স্বল্প অবসরের এই ভালোলাগা-ভালবাসারাই তাঁর লেখালেখিতে অক্সিজেন জোগায়।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher